শাপে বর
মোকছেদ আলী*

শাপে বর কথাটা বোধ হয় নিছক প্রবাদ বাক্যই নয়, ইহার বাস্তব প্রয়োগ যে মাঝে মাঝে পাওয়া যায়, আমি স্বয়ং নিজে তাহার স্বাক্ষী।

গত আশ্বিন মাসে বাম হাতে ও বাম কাঁধে বেদনা অনুভব করিতে থাকি। প্রথম প্রথম এইটা লইয়া মাথা ঘামাই নাই। হয়ত শোওয়ার দোষে ব্যাথা হইয়াছে, এমনিতেই সারিয়া যাইবে। কিন্তু না, সারিয়া উঠা তো দূরের কথা; আরো বৃদ্ধি পাইতে থাকিল।

কার্তিক মাসের শেষাশেষি হিমেল হাওয়া বইছে, মাঠে মাঠে পাকা আমন ধানের মহা সমারোহ। শুধু ধানই নয় সঙ্গে আখেরও বাহার। একদিন বিকালে মাঠ হইতে ফিরিয়া গায়ের গেঞ্জিটা খুলিতে গিয়া আর খুলিতে পারি না। বাম হাতের গোড়া বা কাঁধের উপরে এমন বেদনা হইল যে, হাতখানা আর উপরে তুলিতেই পারিলাম না। অবশেষে নাতিন আসিয়া বলিল, “দাদা আমি আস্তে করিয়া খুলিয়া দেই।” না না করিতে করিতে ডান হাতখানা ফস করিয়া খুলিয়া ফেলিল। তারপর গেঞ্জিটা মাথার উপর দিয়া খুলিয়া বাম হাতের উপর দিয়া বাহির করিয়া দিল। এমন সুন্দর কায়দায় বাহির করিয়া দিল যে আমি বেদনা টেরই পাইলাম না। এবার নাতিন সাবধান করিয়া দিল, “দাদা আপনি আর গেঞ্জি গায়ে দিবেন না। তাহার চেয়ে বুকফাড়া একটা ফতুয়া তৈরী করিয়া নেন গা। আর ডাক্তারের কাছে দিয়া দেখাইয়া ঔষধ খান গা। আমার মনে হয় আপনার বাত হইয়াছে।”

নাতিনের সুপরামর্শমত দর্জির দোকানে গিয়া কম দামের ছিটের একটা মেরজাই ফতুয়ার অর্ডার দিয়া মহি ডাক্তারের কাছে গেলাম। বাপরে বাপ! ডাক্তারের ঘরে যে এতা ভীড় হয় আগে কোন দিন দেখিনি। আল্লাহর রহমতে আজ ১৫/১৬ বৎসর হইল- এমন কোন রোগ বালাই আমার হয় নাই যাহাতে আমাকে ডাক্তারের কাছে যাইতে হইয়াছে। অথবা ডাক্তারকেই আমার কাছে আসিতে হইয়াছে। চেয়ার বেঞ্চ যে কয়খানা ছিল রোগীদের দ্বারা তাহা পূর্বেই দখল হইয়াছে। আমাকে দেখিয়া আমার নানী শাশুড়ীর বাড়ির কাছের একজন মান্য করিয়া একটু সরিয়া বসিয়া বেঞ্চের মুড়ায় একটু জায়গা করিয়া দিয়া বলিলেন, বাবাজী বসেন গো।

আমি আর কি করিব? মামা শশুড় সম্পর্কের আবুল মৃধার অনুরোধে বসিয়া পড়িলাম। ঘন্টা খানেক পরে আমার উপর আল্লাহর রহমত নাজেল হইল। ডাক্তার সাহেবের চেলা, মানে কমপাউন্ডারী শিক্ষা করিতেছেন, আমাকে ডাক্তারের চেম্বারে লইয়া গেলেন।

টানিয়া-টুনিয়া টিপিয়া-টুপিয়া দেখিলেন। কিছু জিজ্ঞাসাবাদও করিলেন, নাড়ীও দেখিলেন। সর্বশেষ থেটিস্কোপ বুকে পিঠে লাগাইয়া খচ খচ করিয়া লিখিয়া দিলেন একটা কাগজে। কমপাউন্ডার নিয়ে কয়েক প্রকারের বড়ি ও ক্যাপসুল দিলেন। ভোল্টারিন বড়ি। আর এনডোমিন ক্যাপসুল। খাওয়ার নিয়ম-কানুন বাতাইয়া একটা ফর্দ দিলেন। দাম মোটে ৪০ টাকা। পকেট হইতে ৪০ টাকা বাহির করিয়া দিয়া চলিয়া আসিলাম বাড়িতে।

কার্তিক মাসও চলিয়া গেল। অগ্রহায়ন মাসও যায় যায় করিতে লাগিল। কিন্তু আমার হাতের কাঁধের বেদনা অগ্রহায়ণ মাসের পিছু না ধরিয়া থাকি থাকি করিতে লাগিল। বেদনা যখন থাকিবে তখন আর কি, তাহার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে।

অবশেষে পৌষ মাসের পুশুরার দিন গেলাম হামেদ ডাক্তারের কাছে। খুব ফটফটে থড়বড়ে লোক। বেদনার কথা শুনিয়া বেদনাযুক্ত বাম হাতে দিয়া দিল একটা ইনজেকশন। তারপর কিছু রাংতায় মোড়া বড়ি দিলেন। খাওয়ার নিয়ম-কানুন বাতাইয়া বলিলেন, তিন দিন পর আবার আসিবেন। ইনজেকশন দিতে হইবে। ৪ টা দিলেই বাত বাপ বাপ করিয়া পালাইবে। ডাক্তারের বলার ভঙ্গি দেখিয়াই মনে হইল, এই বাত দৌড়াইয়া পালাইলো বুঝি। না হাসিয়া থাকিতে পারিলাম না। ডাক্তার রসিক খুব। আমি হাসিলাম। বাতের যাওয়ার কথা শুনিয়াই মুখে হাসি ফুটিয়াছে। আর চলিয়া গেলে যে কি রকম হাসি ফুটিবে তাহাতো দেখিবার বিষয়।

উহু শীত চলিয়া গেল। ফাল্গুনের হাওয়ায় বোধ হয় ভালো হইবে। এলোপ্যাথি হইতে হোমিওপ্যাথিতে আসিলাম। মানে পথ বদলালাম। পাকা সড়ক ছাড়িয়া কাঁচা রাস্তায় নামিলাম। যে যা বলে তাই মাখি, খাই। কিন্তু বেদনা আর যায় না।

ভাবিলাম, শীতের জন্য বেদনা বোধ হয় বেশী হইয়াছে সেইজন্য আর ঔষধপত্র খাওয়া একেবারেই বাদ দিলাম। বাংলাদেশে ঔষধ পানির যা দাম, ঔষধ কিনিতে গেলেই বাড়ির কিছু ঘটি বাটি আগে বেচিতে হয়। তাহা না হইলে তো কেনা যায় না।

এক মহিলা কহিল, চাচা আপনি রোজ সকালে আসবেন, আমি ঝাইড়্যা দিব, ৭ দিন ঝাড়লেই সাইড়্যা যাইব। মহিলার কথায় বিশ্বাস করিলাম- তবুও একবার জিজ্ঞাসা করিলাম, টাকা পয়সা কিছু লাগিবে কি? মহিলা বিস্ময় প্রকাশ করিয়া কহিল, চাচা কয় কি? ঝাঁড়তে কি কেউ পয়সা কড়ি নেয় নাকি? আপনে আসবেন বেলা উঠার সময়, ঝাইড়্যা দিব।

পরদিন হইতে পর পর তিন দিন সে মায়ের স্নেহ দিয়া হাতের বেদনাস্থল ডলিয়া ঝাড়িল। কম বেশি কিছু বোধ করিলাম না। তারপর দিন সে তাহার এক আত্মীয়ের বিবাহ উপলক্ষে পাবনার চর আশুতোষপুরে গেল। ৮/১০ দিন, কিম্বা বেশিও দেরী হইতে পারে। ওখানে তাহার মা বাপের বাড়ি। স্বামীর কূলেও অনেক আত্মীয় স্বজন আছে। অনেকদিন পরে গিয়াছে। সব আত্মীয় বাড়ি যদি একদিন করিয়াও থাকে, তবে একমাস থাকিতে হইবে।

বেদনা লইয়াই চলাফেরা করি। পাকা রাস্তার পার্শ্বে দাঁড়াইয়া এক লোকের সহিত কথা বলিতেছি। ডবল রাইডিংএ একটি মোটর সাইকেল আসিতেছে। আমি রাস্তার এক পার্শ্বে। হঠাৎ সাইকেল আসিয়া আমাকে প্রচন্ড একটা ধাক্কা দিল। কয়েকটি শিশু হাসিতে হাসিতে দৌড়াইয়া রাস্তার উপর আসিলে তাহাদের রক্ষার জন্য সাইড দিতে গিয়া আমার উপর চড়াও হইয়াছে। আমি ধাক্কা খাইয়া সটান পড়িয়া গেলাম। সাইকেল সঙ্গে সঙ্গে থামাইল। আমি উঠিয়া দাঁড়াইলাম। তাহারা আমার পরিচিত। আমার কাছে মাফ চাইল, “হুজুর, ছেলেদের বাঁচাইতে গিয়া আপনাকে আঘাত দিলাম, ক্ষমা করিবেন।

বলিলাম, “দূর্ঘটনা, আপনারা তো আর ইচ্ছা করিয়া আমায় আঘাত দেন নাই। বেশি লাগে নাই। চলিয়া যান।” আমার অনুমতি পাইয়া তাহারা চলিয়া গেলেন। যাওয়ার সময় একটু উপদেশ দিলেন, “ডাক্তারের কাছ হইতে ২/৪ টা বড়ি লইয়া খাইবেন।” বলিয়াই আমাকে খুব সস্তাদরের একটা সালাম দিয়া চলিয়া গেলেন।

বড়ি টরি আর কিছু খাওয়া হইল না। মনে মনে ভাবি এমন আর বেশি লাগে নাই। পড়ে যাওয়ায় বা হাতের কনুইয়ের চামড়া একটু ছুলিয়া গেলো। তিন দিন পরে ছুলে যাওয়া স্থানটা পাকিয়া পুজ হইল। বেদনাও হইল। যে হাতটা বাতের বেদনায় কষ্ট পাইতেছি, সেই হাতটাই আবার খুব বেদনা হইল।

কিন্তু মজার ব্যাপার, পুজ বেরিয়ে যাওয়ার পর হইতেই আমার হাতের বেদনা কমিতে লাগিল। সপ্তাহ খানে পুঁজ ঝড়িল। এখন আমি হাতের বেদনা মোটেই অনুভব করিতেছি না। সম্পূর্ণ সুস্থ হইয়া গিয়াছে। নাতিনের সাহায্য ছাড়াই আমি গায়ে গেঞ্জি দিতে পারি, খুলিতে পারি। কোন অসুবিধা বা কষ্ট হয় না।

কত টাকা পয়সা খরচ করিলাম। কত কি মালিশ করিলাম। ঝাড়ফুকও দিলাম। কিন্তু যথা পূর্বং তথা পরং।

আর কিনা মোটর বাইকের ধাক্কায় একবারেই সুস্থ হইলাম। সাধারণত মোটর সাইকেল দূর্ঘটনায় মানুষ হাসপাতালে যাওয়ার তালে থাকে; আর আমার বেলায় সাপে বর হইল।