মডারেটরের নোটঃ আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের শেষলগ্নে বাঙালি যখন চূড়ান্ত বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঠিক তখনই এই দিনটিতে নরঘাতক রাজাকার, আলবদররা মেতে ওঠে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞের হলিখেলায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাত্র দু’দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর রাতের অন্ধকারে ঘাতকচক্র তাদের নীল নকশা অনুযায়ী কেবল ঢাকা শহরেই প্রায় দেড়শ বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশার কৃতী মানুষকে চোখ বেঁধে অপহরণ করে নিয়ে যায় অজ্ঞাত স্থানে। সেই রাতে তালিকা ধরে ধরে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিসেবী ও পদস্থ সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাদের ঘর থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে হত্যা করে ফেলে রাখা হয় রায়েরবাজারের বদ্ধভূমিসহ অসংখ্য বদ্ধভূমিতে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে পুরো জাতিকে মেধাশূন্য করে যাবার অন্তিম বাসনা পাকিস্তানীদের বর্বরতার এক অভিশপ্ত নমুনা। আমরা মুক্তমনার পক্ষ থেকে এই দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। আমাদের মুক্তমনার আর্কাইভ থেকে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের উপর একটি লেখা ব্লগে পুনঃপ্রকাশিত হল।
:line:
স্মৃতিময় ৭১ : যে ভাবে মওলানা মান্নান হত্যা করেছিলো আলীম চৌধুরীকে
শ্যামলী চৌধুরী
চিত্রঃ ডঃ আলীম চৌধুরী
একাত্তরের কিছু আগে আজিমপুরের বাসা থেকে আমরা পুরানা পল্টনের নতুন বাসায় চলে এলাম। বাসাটি ছিল তিনতলা। আলীম সেটি ভাড়া নিয়েছিল নিচের তলায় চোখের ক্লিনিক করবে বলে। কিছুদিনের মধ্যেই ক্লিনিক হয়ে গেলো।
এক তলায় ক্লিনিক, দোতলা ও তিনতলায় আমরা থাকতাম। আরম্ভ হলো সংগ্রাম। ২৫ মার্চের রাতেই বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাদের বাসায় এলেন। তিনি ছিলেন আমার ননদের বাসায়। তাকে লুকিয়ে রাখার দায়িত্ব পড়লো আমাদের ওপর। কয়েকদিন তাকে তিনতলার একটি ছোট ঘরে রেখে ২৯ মার্চ শাড়ি পরিয়ে আমরা সরিয়ে দিলাম। আমার ছোট ভাই স্বপন বোরকা পরিহিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেবকে মরহুম আহমেদ ভাইয়ের বাসায় দিয়ে এলো। সেখানে থেকেই তাকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একাত্তরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি মওলানা আবদুল মান্নান আমাদের নিচের তলায় এসে আশ্রয় নিলেন। একদিন সকাল ১০টার দিকে টিপটিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। হঠাৎ দোতলা থেকে দেখি আমাদের প্রতিবেশী তৎকালীন পিডিবির মতীন সাহেব একজন লোক নিয়ে আমার স্বামীর কাছে এলেন। মতীন সাহেব তাকে বললেন, ভদ্রলোক পরিবার নিয়ে অত্যন্ত বিপদে পড়েছেন। তার ঘরবাড়ি কে বা কারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। তিনি একেবারেই নিরাশ্রয়। এই মুহূর্তে তাকে আশ্রয় না দিলে ভদ্রলোকের খুবই অসুবিধা হবে। সব শুনে আলীম ওপরে উঠে এলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো। আমি শুনেই এক কথায় না করে দিলাম। সেও নিচে গিয়ে তাদের মানা করে দিলো কিন্তু মওলানা মান্নান এবং মতীন সাহেবের অনুনয়-বিনয় শুনে আবার আলীম ওপরে উঠে এলো। আমাকে সে বোঝাতে চেষ্টা করলো কিন্তু আমি কিছুতেই রাজি হলাম না। সে তখন আমার শাশুড়িকে অনুরোধ করলো আমাকে রাজি করানোর জন্য। অগত্যা আমি চুপ করে গেলাম। কিন্তু আমি আর আমার মা সেদিন ঐ লোকটিকে আশ্রয় দিতে হলো বলে রাগে-দুঃখে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। মওলানা মান্নান এক কাপড়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে উঠে এলেন আমাদের বাসার এক তলায়। চক্ষু ক্লিনিকের রোগীর বিছানা চাঁদর ইত্যাদি পাল্টে তাদের কথাতে দিলাম। ক্লিনিক বন্ধ হয়ে গেলো। চেম্বারটি দোতলায় আমাদের ড্রয়িংরুমে স্থানান্তর করা হলো। প্রায় ৪/৫ দিন চা, নাস্তা, দুপুর ও রাতের খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করলাম। ৭/৮ দিনের মাথায় দেখা গেলো- মওলানার বাড়ি জিনিসে ভরে গেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সব সময়ই তার ওখানে আসতো। প্রায়ই রাতভর হৈহুল্লোড় চলতো সে বাড়িতে।
কয়েকদিন পর দেখা গেলো দুজন আলবদর আমাদের দিকের গেটে পাহারারত আর ৪/৫ জন মওলানার গেটে। তখনো বুঝিনি যে এরা আসলে আমাকে পাহারা দেয়। ভেবেছিলাম মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে মওলানা এই ব্যবস্থা নিয়েছেন। এ ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েও কোনো লাভ হলো না। একদিন মওলানার কাছে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি চিঠি এলো- আলীম ভাই ওপরে না থাকলে তোমাকে কবেই আমরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতাম। সেদিন থেকে আমাদের দিকের পাহারা আরো জোরদার করা হলো। মনে যাই থাক মুখে মওলানা খুবই ভালো ব্যবহার দেখাতেন আমার স্বামীর সঙ্গে। তিনি সব সময়ই বলতেন- ডাক্তার সাহেব, আপনার উপকার আমি জীবনে ভুলবো না। আপনার কোনো ভয় নেই। আপনার কোনো বিপদ হবে না। যদি কখনো কোনো অসুবিধায় পড়েন, সোজা আমার কাছে চলে আসবেন। আমি আপনাকে রক্ষা করবো। আমার জীবন থাকতে আপনার কোনো ক্ষতি কেউ করতে পারবে না।
আমার স্বামী এই আশ্বাসবাণীতে নিশ্চিন্ত হয়ে রইলেন। প্রতিদিন চেম্বারে মুক্তিযোদ্ধারা আসতো। এখানে তাদের বিনামূল্যে চোখের চিকিৎসা হতো, ওষুধ দেওয়া হতো। আবার গাড়ি করে তাদের নিরাপদ জায়গায় পৌঁছে দেওয়া হতো। আলীম নিহত হওয়ার পরও মুক্তিযোদ্ধারা এসে আমাকে বলেছে, এই দেখুন আমার চোখে এখনো আলীম ভাইয়ের দেওয়া ব্যান্ডেজ। এ সম্পর্কে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট আবু সাঈদ চৌধুরী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আচ্ছা বলুনতো মিসেস চৌধুরী, আপনাদের নিচের তলায় আলবদর আর ওপরের তলায় মুক্তিযোদ্ধারা আসে, এ আপনাদের কোন ধরনের ব্যবস্থা ছিল? আমি সেদিন কোনো উত্তর দিতে পারিনি। মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গোপন হাসপাতাল ছিল। সেখানে ডা. রাব্বি, আলীম এবং অনেক ডাক্তার গিয়ে চিকিৎসা করতেন। আলীম তার গাড়ির বনেট ভরে বিভিন্ন ওষুধের কোম্পানিতে ঘুরে ঘুরে ওষুধ সংগ্রহ করতো এবং তা মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরবরাহ করতো। সে চাঁদাও তুলেছে বহু টাকা অনেকের কাছ থেকে। দূর থেকে আলীমের গাড়ি দেখলে অনেকেই বাড়িতে নেই বোঝানোর জন্য দরজা বন্ধ করে দিতেন যাতে সে ফিরে যায়। তারা ভয় পেতেন এই ভেবে যে, আলীমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখলে পাছে বিপদে পড়তে হয়। বিপদে পড়া অনেক বাঙালি পরিবারকে আশ্রয় এবং সাহায্য দিতে সব সময়ই আলীম ব্যস্ত থাকতো। এ সব কিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জানা ছিল বোধহয়, কিন্তু আমরা তা বুঝতে পারিনি। বুঝেছিলাম যখন তখন আর শেষ রক্ষা হলো না। একাত্তরের ১৫ ডিসেম্বর সেদিন। সকাল ৮টায় আলীম তৈরি হচ্ছিল সলিমুলাহ মেডিকেল কলেজে যাওয়ার জন্য। তখন সে সেখানে কর্মরত ছিল। মাস দেড়েক আগে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ থেকে বদলি করে তাকে সলিমুলাহ মেডিকেল কলেজে নিয়োগ করা হয়েছিল। সে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললাম- এই তো বেরিয়ে যাচ্ছো, আসবেতো সেই কারফিউ আরম্ভ হয়ে গেলে। বুঝতে পারছি আজো আমাদের বাসা থেকে সরে যাওয়া হবে না। আলীম বললো, না ঠিকই সময়মতো চলে আসবো। কোথায় যাবো সে জায়গাও ঠিক করে আসবো। তুমি নীপা, শম্পাকে নিয়ে তৈরি থেকো। বেলা ১টা বেজে গেলো। কারফিউ আরম্ভ হয়ে গেলো আবার। ঠিক তখনি গাড়ির শব্দ পেলাম। বুঝতে পারলাম, এসেছে। গাড়ি গ্যারেজে রেখে ওপরে উঠে এলো। কিছুক্ষণ পরই শুরু হলো বোমাবর্ষণ। ভারতীয় মিগ তখন পাকিস্তানি ঘাঁটির ওপর অনবরত আক্রমণ চালাচ্ছিল। আমরা কোনোরকমে খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। বেলা প্রায় সাড়ে ৪ টারদিকে দোতলার সামনের বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে আলীম, মা আর আমি দেখছিলাম পিলখানার ওপরে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ। সে বলছিল, এ দেশের পাকিস্তানিরা বোকার স্বর্গে বাস করছে। ভারতীয় বিমানকে বাধা দেওয়ার ক্ষমতাই তাদের নেই। দ্যাখো, ওরা ইচ্ছামতো বোমা ফেলছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন এটা তাদের আকাশ। আর এরা বলে কিনা আমেরিকার সপ্তম নৌবহর এসে এদের বাঁচাবে। গতকালও মওলানা বলেছে, ২/১ দিনের মধ্যেই নাকি সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে যাবে। বলেই খুব হাসছিল সে।
ঠিক তার একটু পরেই আমরা একটি গাড়ির শব্দ পেলাম। দাঁড়িয়ে দেখলাম, মাটি লেপা একটি ছোট মাইক্রোবাস এসে আমাদের বাসার নিচের তলায় মওলানার দরজার সামনে দাঁড়িয়েছে। এরকম গাড়ি প্রতিদিনই আসতো সময়ে-অসময়ে তার কাছে। কাজেই গাড়ি দেখে আমাদের অন্য কিছু মনে হয়নি। আলীম শুধু বললো, উঁকিঝুঁকি দিয়ো না, ভেতরে যাও। এই বলে সে বাথরুমে গেলো। আমি আর মা ভেতরে চলে এলাম।
প্রায় ৪৫ মিনিট পর আমাদের সিঁড়ির নিচের বাইরের দিকের দরজায় বেল বেজে উঠলো। ওপর থেকে দেখলাম দুজন আলবদর বন্দুক উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে দরজা খুলতে বলছে। আমি আলীমকে জিজ্ঞেস করলাম, খুলবো নাকি। সে বললো, খুলে দাও। বলেই সে নিচের তলায় মওলানার কাছে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। আমি বললাম, কোথায় যাও। বললো, মওলানা সাহেবের কাছে। তিনি তো অসুবিধা হলেই যেতে বলেছেন। আমি বাধা দিইনি। সিঁড়ি দিয়ে নেমে মওলানার দরজায় প্রাণপণে শব্দ করতে লাগলো আর বললো, মওলানা সাহেব, একটু দরজাটা খুলুন। অনেকবার বলার পরও মওলানা দরজা খুললেন না। শুধু ভেতর থেকে বললেন, আপনি যান, আমি আছি।
আলীম তখন দৌড়ে ওপরে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু ততোক্ষণে ওরা ঢুকে গেছে ভেতরে। তাকে দেখেই বললো, হ্যান্ডস আপ। আপনি আমাদের সঙ্গে চলুন। আলীম বললো, কেন? ওরা বললো, দরকার আছে। সে কাপড় বদলে আসতে চাইলে ওরা বললো, অন্য কাপড়ের দরকার নেই। কোথায় যেতে হবে জানতে চাইলেও বললো, তা গেলেই জানতে পারবেন। লুঙ্গি আর শার্ট পরেই আলীম ওদের সঙ্গে চলে গেলো। ওরা দরজার বাইরে যেতেই কাজের ছেলে দুটি ওপরে দৌড়ে এসে বললো, সাহেবকে ওরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ছুটে মওলানার কাছে গেলাম যার মুখের দিকে তাকাতেও আমার ঘৃণা হতো সেই আমি তার পায়ে পড়ে গলোম। আকুল হয়ে কেঁদে বললাম, মওলানা সাহেব, এখনো গাড়িটা ছাড়েনি, আপনি একটু দেখুন। একটু ওদের বলুন। মওলানা চুপ করে বসে রইলেন। গাড়িটা ছাড়ার শব্দ পাওয়া গেলো। তখন তিনি আমাকে বললেন, ঘাবড়াবেন না। ওরা আমার ছাত্র। ওরাই উনাকে নিয়ে যাচ্ছে। ডাক্তার রাব্বি এবং আরো অনেককেই ওরা নিয়ে যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন নিয়ে যাচ্ছে? তিনি বললেন, চিকিৎসার জন্য। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, কোথায় নিয়ে গেলো? বললেন, ‘সিএমএইচ-এ’।
আমি কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ওপরে উঠে এলাম। এসেই মিসেস রাব্বিকে ফোন করতে চেষ্টা করলাম। অনেক চেষ্টার পর একবার পেলাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ বিকাল ৪টায় নিয়ে গেছে। আর কি ওরা ফিরবে? আমি এ কথা শুনে খুব ভয় পেয়ে গেলাম। আবার নিচে ছুটে এলাম। মওলানাকে বললাম, আপনি আমাকে একটু সঠিক খবর দিন। আমার অস্থিরতা দেখে তিনি বললেন, এতো উতলা হচ্ছেন কেন? বললাম তো চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেছে। কাজ হয়ে গেলেই দিয়ে যাবে। বললাম, শীতের কাপড়তো নেয়নি। ওগুলো পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিন। তিনি বললেন, সে ব্যবস্থা ওরা করবে। ওপরে উঠে আবার ফোন করতে চেষ্টা করলাম কিন্তু তখন আমার ফোনটির আর কোনো শব্দ নেই- ডেড। আমি আরো দিশেহারা হয়ে পড়লাম। আবার গেলাম মওলানার কাছে। বললাম, আমার টেলিফোন ডেড। আপনি একটু হাসপাতালে ফোন করুন, আমি আলীমের সঙ্গে কথা বলবো। তিনি বললেন, পাগল হয়েছেন? এখন ওরা ভীষণ ব্যস্ত। এখন ফোন করা যাবে না। ফোনের কাছে এসে ব্যর্থ চেষ্টা করলাম ফোন করতে। রাত বাড়তে থাকলো। কান পেতে রইলাম, দরজার কড়ানাড়া শোনার জন্য। সামান্যতম আওয়াজেও সচকিত হয়ে উঠেছিলাম। বার বার শুধু মনে হচ্ছিল, এবার সে এসেছে।
কিন্তু না, সে আসেনি। সে রাতে নয়, কোনো রাতেই নয়। পথের দিকে চেয়ে চেয়ে রাত ভোর হলো এক সময়। হঠাৎ কানে এলো, জয়বাংলা ধ্বনি। ছাদে ছাদে বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে সবাই জয়োলাস করছে। আমার চোখে তখন অন্ধকার। বুকে সর্বনাশের ঘণ্টধ্বনি। আমি পথে নেমে এলাম আমার স্বামীকে খোঁজার জন্য। একটি রাস্তায় দেখতে পেলাম বিজয়োলাস করে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে আসছে। আমি নির্নিমেষ তাকিয়ে খুঁজলাম একটি মুখ, না সে নেই। দিশেহারা আমি তখন বাসায় এসে কাজের ছেলেদের পাঠালাম আলীমের ছোটভাই হাফিজের কাছে গেণ্ডারিয়ায়। ওরা ফিরে এলো। রাস্তায় এলোপাতাড়ি গুলি চলছে, তাই যেতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা এলো কয়েকজন, বললো, আলীম ভাইকে যে মেরেছে সে কোথায়? বললাম, জানি না। মওলানা আবদুল মান্নান তখন পালিয়েছে। কিছুক্ষণ আগেও সে আমাদের খাওয়ার ঘরে লুকিয়েছিল, পরে পালিয়ে গেছে।
১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজারের ইটখোলার বধ্যভূমিতে আরো অনেক বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে পাওয়া গেলো আলীমের লাশ। গায়ের শার্টটি গায়েই ছিল। হাত দুটো দড়ি দিয়ে পেছনে বাঁধা। চোখ বাঁধার গামছাটা গলায় এসে ঠেকেছে। বুকটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। তলপেটের ও কপালের বাঁদিকে বেয়নেটের আঘাত। হয়তো আরো ছিল আঘাতের চিহ্ন কিন্তু আমি আর দেখতে পারিনি। আজিমপুর নতুন গোরস্থানে তার বাবার পাশেই তাকে সমাহিত করা হলো।
শ্যামলী চৌধুরী : ডা. আলীম চৌধুরীর স্ত্রী। রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘স্মৃতি : ১৯৭১’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত (মুক্তমনায় পূর্বপ্রকাশিত)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসর – রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস সহ আরো যারা এদেশকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে দেউলিয়া করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়িত করতে গিয়ে নয় মাসব্যাপী দেশের অগণিত বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করেছে, তাদের সেসব নিয়ে নাঈমুল হোসেন চৌধুরীর পিডিএফ ই-বুক কপিটির লিংক এখানে দিলাম-
মিডিয়াফায়ার
গুগল ডকুমেন্ট অনলাইন
আমাদের একাত্তর
এই ফিচারটিও অনেক ডিটেইলস বলেছে জহির রায়হান সম্পর্কে। এখানেও কিন্তু আলোচনাতে বিষয়টির সারবিক বিবেচনা করা হয়েছে, এক পাক্ষিক সমাপ্তি টানা হয়নি। বিশেষ করে ফিচারটির নিম্নোক্ত অংশটি বেশ মজার-
@নিঃসঙ্গ বায়স,
আপনি বলছেন:
বাহ! চমৎকার আপনার পাঠ-অনুসন্ধান! :deadrose:
@বিপ্লব রহমান,
কিছু মনে করবেন না, আপনার সাথে মিলল না বলে কী মন খারাপ করলেন? ভালো থাকুন,। অন্য কোনো বিষয়ে পরে আলোচনা হলেও হতে পারে, এই বিষয়ে আর সম্ভব নয় আপনার মত একমুখী ব্যক্তির সাথে আলোচনা করার। ধন্যবাদ।
আমি আসলে কোনোকিছুতেই পক্ষপাতমূলক আলোচনার পক্ষপাতি নই।
এই একটি ছাড়া বাকীগুলো আমার পড়া ছিল। কিন্তু অতিসম্প্রতি এর বিপক্ষীয় একটা মত পড়েই পুনশ্চ দিয়েছিলাম।
যারা এখন বড় বড় কথা বলেন তারাই জহির রায়হানের নিখোঁজ হবার সঙ্গে জড়িত…সুচন্দা ও ববিতা
মানিক ভাইয়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, তার বইতে যে সৈনিকের বক্তব্যের ভিত্তিতে জহির রায়হানের মৃত্যু প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিশ্চিত করা হয়, তার authentication কী? আমাকে ভুল বুঝবেন না এই প্রশ্নের জন্য। প্রশ্নটি এই কারণে করলাম কারণ মানিক ভাইয়ের লেখাটি প্রথমে ১৯৯৯ সালে দৈনিক ভোরের কাগজে প্রকাশিত হয়। পরে এটি বই আকারেও প্রকাশ হয়েছিলো জানি। কিন্তু এতদিন এই বিষয়ে কোনো সংবাদ কেনো পাওয়া গেলো না? যেহেতু, আর্মি অফিসারদের সাথে জহির রায়হান অপারেশনে গিয়েছিলেন, সেহেতু আর্মি হেডকোয়ারটারেই তো এই বিষয়ে তখন থেকেই সুস্পষ্ট রেকর্ড থাকা উচিৎ ছিলো? যদি থেকেই থাকতো, তাহলে তার এতদিনেও তা প্রকাশ করেনি কেনো? আর যদি নাই থেকে থাকে তাহলে তার মূল কারণটা কী? এরকম আরো অনেক আলোচনা/পাল্টা আলোচনা করা যায় এই প্রসঙ্গে। আর এই প্রশ্ন শুধুমাত্র জামাত করেনি, জহির রায়হানের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে অনেক বামপন্থী লোকজনই এই আলোচনা করেছেন। কোনো যৌক্তিক আলোচনা/ প্রশ্ন শুধুমাত্র কোনো এক সময় জামাত উত্থাপন করলেই তা নিশ্চয়ই তার যৌক্তিকতা হারাবে না। সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে তো জামাতেরও অবস্থান ও যুক্তি আছে। তাহলে কী আমরা জামাতকে সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষ লড়াই করার সত্তিকার শক্তি হিসেবে বিবেচনা করবো? নিশ্চয়ই না। কেননা, ইতিহাস বলে মৌলবাদ আর সাম্রাজ্যবাদ শেষ বিচারে পরষ্পরের বন্ধু, কোনোভাবেই শত্রু না। তাই এই দুই অপশক্তির বিপক্ষেই প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার মানুষদের যুদ্ধ করতে হয়। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবস্থান নিয়ে নাহয় আর কথা নাই বললাম। সবাই জানে তা।
ধন্যবাদ আপনাকে বিপ্লব রহমান। আশা করি আমার পুনশ্চের কারণ ব্যাখ্যা করতে পেরেছি আপনাকে। এই প্রসঙ্গে আপনার যে কোনো আলোচনার জন্য অপেক্ষা করলাম। ভালো থাকুন।
@নিঃসঙ্গ বায়স,
হুমম…আপনার সমস্যাটি তাহলে মস্তিকপ্রসূত। কারণ আপনি তো সিদ্ধান্তহীনতায় থাকতে চান। সিদ্ধান্তমূলক অবস্থানে পৌঁছালে পক্ষপাতিত্ব থাকবে বৈকি। খুব বিনয় করে বলছি:
তাহলে এতো বিভ্রান্তি আসে কোথা থেকে? সুচন্দা-ববিতা’র কী এ বিষয়ে কোনো অনুসন্ধান আছে? তাহলে জহির পরিবারের সদস্য হলেই তাদের কথায় এতো যায়-আসে কেনো? :-Y
উহু…আমার ধারণা, জুলফিকার আলি মাণিকের ওই অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি আপনি মন দিয়ে পড়েননি। বইটি তো নয়ই। কারণ এতে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীকে উদ্ধৃত করে জহিরা রায়হান ‘অন্তর্ধান রহস্য’র যবনিকা টানা হয়েছিল। সেক্ষেত্রে তো ওই প্রতিবেদনের authentication নিয়ে প্রশ্ন আসে না।…
তাছাড়া ওই প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর পরই শাহরিয়ার কবির, আজিজ মিসিরসহ জহির রায়হানের সহকর্মী সাংবাদিকরা এর তথ্যর সঙ্গে একাত্বতা প্রকাশ করে একাধিক কলাম লিখেছিলেন, যা মূল বইটিতে সংযোজন করা হয়েছে।
সেনা বাহিনী তো ১৯৭১ এ এবং এর পরে এর চেয়েও বড় বড় অপারেশন করেছে। সে সব অপারেশনের ‘সুস্পষ্ট রেকর্ড’ সদর দপ্তরে আছে বা নেই তা কী নিশ্চিত করে বলা যায়? তারা কী এ পর্যন্ত কোনো অপারেশনের তথ্য প্রকাশ করেছে? আজব!! 😕
আসলে জেগে ঘুমালে জাগানো যায় না। আর ঘুমন্ত ব্যক্তির সঙ্গে যুক্তি-তর্কও চলে না।… 😛
@বিপ্লব রহমান,
ভুল বলেছেন। আমি আপনাদের মত মনগড়া সিদ্ধান্ত নিতে চাই না, সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে শেষ প্রশ্নটারও সমাধান করে নিতে চাই।
আপনি কিন্তু আমার একটা প্রশ্নেরও জবাব দিতে পারেন নি, শুধুমাত্র যুক্তির বিকল্প যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন।
আপনার এই বক্তব্যই আপনার যুক্তির সীমানাকে নির্দেশ করে, অন্য আর কিছুই লাগে না।
মানিক ভাইয়ের প্রতিবেদনটি আমার পড়া, বইটি নয়, আপনি বইয়ের কথা উল্লেখ করেননি আগের আলোচনাতে, প্রতিবেদন্টির কথাই বলেছিলেন। আর অনল রহমানের লেখাটিও পড়েছি। আবার সুচন্দা-ববিতার সাক্ষাতকারও পড়েছি। কোনোটাকেই আপনার মত ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেওয়া আমার সম্ভব না, কিন্তু একই সাথে কোনোটাকেই প্রশ্ন না করে গ্রহন করা ও মেনেন নেওয়াও সম্ভব না। আর যাই হোই, আমি তো আওয়ামীলীগ, বিএনপি অথবা জামাতের মত অযৌক্তিক একপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ নই, হওয়া সম্ভবও না।
তাই শেষে আপনার বক্তব্যই আপনাকে ফিরিয়ে দিচ্ছি-
আপনার সাথে আলোচনা করার ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু আপনার শেষ কমেন্টের পর আপনার মুক্ত চিন্তার দৌড় বোঝা হয়ে গেছে আমার। তাই, আপনার সাথে পরবর্তী কোনো আলোচনার আর আগ্রহ পাচ্ছি না। ভালো থাকবেন।
ছোট মুখে বড় প্রশ্ন ও পুনশ্চঃ
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১; মোটামুটি শিওর বাংলাদেশ প্রায় স্বাধীন হয়েই গেছে বা গেল। তাহলে ‘বুদ্ধিজীবী’ লেভেল দেওয়া মানুষ গুলাকে হত্যার প্রয়োজন পরল কেন?
– তারা ছিলেন একইসাথে পাকিস্তান ও ভারতের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের বিরোধী।
– তারা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতন্ত্রি।
– তারা ছিলেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিরোধী।
– স্বাধীন দেশে তারাই হতেন মূল চালিকাশক্তি
এদের মেরে ফিনিশিং টাচটা কে দিল ?
উত্তরঃ
A. ভারত অর্থাৎ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’।
B. আল বদর রাজাকাররা, নিজ দায়িত্বে।
C. পাকিস্তান, বাঙালীর মেরুদণ্ড ভেঙে আবার পাকিস্তান হবার একটা অপশন রেখে।
D. আওয়ামীলীগ তার ভবিষ্যৎ চিরস্থায়ী অপ্রতিদ্বন্দ্বী অবস্থান নিশ্চিত রাখতে ।
আপনি কোন অপশন প্রেফার করতে চান
কেনো জানি, এদানিং এই সকল দিন, এই সকল দিবসে ঘর হতে বের হয়ে সবার সাথে এক মিছিলে সামিল হতে আমার আর তেমন আগ্রহ কাজ করে না। যারা এই দিনগুলোতে আবেগে আপ্লুত হয়, তাদের অধিকাংশকে দেখলেই প্রচন্ড ঘৃণা হয়, অসহ্য লাগে তাদের অবিরাম অভিনয় দেখতে। এতগুলো মহান আত্মত্যাগের যে মূর্ত প্রতীক, সেখানে গিয়ে যখন স্বার্থের কারণে অবিশ্রান্ত মিথ্যাচার করতে দেখি তাদেরি সময়ের কোনো মানুষ/ তাদেরি কোনো সহযোদ্ধাকে, তখন সেই সমাবেশে, সেই মিছিলে যাওয়াটাও ওই সব মহামানুষদের স্মৃতির প্রতি অবমাননা বলে বোধ হয় আমার কাছে।
@নিঃসঙ্গ বায়স,
প্রশ্নোত্তর/ অপশন আকারে যে সব বিষয়ের অবতারণা করেছেন, আশাকরি সময় হলে আপনি নিজেই এর জবাব খুঁজে পাবেন। হয়তো মিছিলে না যাওয়ার হতাশাটুকুও কাটিয়ে উঠবেন ইতিবাচক কোনো ঘটনায়। আমার আগ্রহ আপনার পুনশ্চ নিয়ে। …
এটি একটি জঘন্য জামাতি প্রচার। :no:
জামাতিরা বহু বছর ধরে প্রচার করে আসছে, ১৯৭১ এ যুদ্ধ যখন ফুরিয়ে আসছে, স্বাধীন বাংলার ক্ষমতা মসৃন করতে আওয়ামী পান্ডারা বাম ঘরনার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। আর তারা এই হত্যার দায় চাপিয়ে দেয় রাজাকার-আলবদার-আলশামস, তথা জামাত-শিবিরের ওপর। জহির রায়হান নিজেও বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে নাকী ‘নিখোঁজ’ হন! এ কারণেই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জামাত
‘দোয়া দিবস’ পালন করে।
…সামহোয়ার ইনব্লগ ডটনেট-সহ বিভিন্ন বাংলা ব্লগে এ নিয়ে জামাতচক্র দীর্ঘ অপপ্রচার ও কুৎসা রটিয়েছে, বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। …এখনো এমন জামাতি প্রচারণা বন্ধ নেই।
দৈনিক সংগ্রাম কি বলছে, পড়ুন : শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের আলোচনা:
জহির রায়হানের নিখোজ হওয়ার জন্য যারা সংশ্লিষ্ট তারাই ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী -আজহার
আবার মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগাররা বিভিন্ন সময় তথ্য-প্রমানসহ এসব জামাতি প্রচারণার জবাবও দিয়েছেন। কাটিয়ে দিয়েছেন সেসব বিভ্রান্তি। আমি ধরেই নিচ্ছি, আপনি এ সব না জেনেই বাংলা ব্লগের বিভ্রান্তির ওই গলিত লাশ/ মাড়ি টেনে মুক্তমনায় এনেছেন।
এ নিয়ে অনেক আগে লিখেছিলাম:
পড়ুন : জহির রায়হান: একটি ব্যক্তিগত কথন
আরো পড়ুন: অমি রহমান পিয়ালের ব্লগ ডেথ অব আ জিনিয়াস : জহির রায়হান
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। :yes:
মানুষ হয়ে ওঠা
মানুষগুলোর জল-ভেজা চোখ দেখে
মনে হয়-
এখনো সূর্যাস্ত হয়নি।
মানুষ হয়ে ওঠা
মানুষগুলোর মানবিক ক্রোধ দেখে
মনে হয়-
সূর্যোদয়, খুব বেশি দূরে নয়।
যতদুর মনে পড়ে শ্যামলী নাসরিন চৌধূরীকে গত জোট সরকারের আমলে উদয়ন স্কুলের প্রিন্সিপালের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ডঃ আলীমের মত মানুষগুলোর সরলতা ( নাকি বোকামী) দেখলে অবাক হই। এই ধরণের মহানুভবতা বোধ হয় অর্থহীন। মান্নানের মত অমানুষগুলো যখন দিব্বি গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়, স্বাধীন দেশের সরকারে কেউকেটা হয়ে দেশ চালায় তখন সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে শুধু চিৎকার করতে ইচ্ছা করে। মনে হয় কি হবে আজ চার দশক পরে এইসব জানোয়ারদের বিচারের কথা বলে, আসলেই কি কোনদিন এদের বিচার হবে! যে ‘মহানুভব’ বাংলাদেশীরা এদের এবং পাকিস্তানীদের ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলে, ভালবাসতে শেখার কথা বলে তাদেরকে গালি দেওয়ার ভাষাও বোধ হয় আমার জানা নেই।
@বন্যা আহমেদ,
খুব কম সংখ্যক মানুষের কাছে সে শুধু মান্নান, বেশীরভাগ মানুষের কাছে মৌলানা মান্নান। মৌলানা তার নির্দোষ, নিষ্পাপ, নিরপরাধের সার্টিফিকেট, তাই এরা ধর্ষণ, খুন করেও পার পায়,। ‘মৌলা’ এর অর্থ হল ‘মাবুদ’, ‘কর্তা’, ‘গুরু’, ‘শিক্ষক’, আর ‘না’ এর অর্থ হল ‘আমাদের’।
এদের পাপকে পাপ বলতে গেলে বুকের পাটা শক্ত হতে হয়। তাই বেশীর ভাগ মুসলমান, এমনকি মুক্তিযোদ্ধাও এদের সামনে মাথা নত করে, এদের প্রতি অন্ধ মহানুভবতা দেখায়।
@বন্যা আহমেদ,
ভাবতে অবাক লাগে এই ঘাতক মান্নান ওরফে মৌলানা মান্নানের উগ্র সাম্প্রদায়িক দৈনিক ইনকিলাব দাপটের সঙ্গেই না একটি বড় ধরণের প্রচার সংখ্যা নিয়ে টিকে আছে! আবার বেশি কিছুদিন ধরে প্রয়াত মান্নান পুত্র বাহাউদ্দীন মালিকানাধীন ইনকিলাব নিজেদের ‘মুক্তযুদ্ধের পক্ষের দৈনিক বলে ঘোষণা দিয়ে আসছে!!
শহীদ বুদ্ধিজীবী ডঃ আলীম চৌধুরীকে বিনম্র শ্রদ্ধা।। :rose:
“ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে—
তারা বলে গেল `ক্ষমা করো সবে’, বলে গেল `ভালোবাসো—
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো’।
…
…
…
কন্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃসপ্নের তলে।
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে—
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?”
এই লেখাটা সবটুকো পড়ার মতো মনের জোর নাই।
মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়। আর কতদিন মনের মধ্যে কষ্ট বয়ে বেড়াব যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করতে পারার?
মুক্তমনা এডমিন,
সম্ভবত ফন্ট চেইঞ্জিং এর কারণে কিছু কিছু যায়গায় (ন্ন) যুক্তাক্ষরটি আসছেনা, দয়া করে ঠিক করে দিন।
এই লেখাটি এক সপ্তাহের জন্যে স্টিকি করা হউক, প্লিজ। লেখাটি পড়ে একবার কেঁদেছি, আমি আরেকবার পড়বো, আমি বারবার পড়বো, বারবার কাঁদবো, আমি এই কয়টা দিন প্রচুর কাঁদতে চাই।
@আকাশ মালিক,
ঠিক করে দেয়া হয়েছে যেখানে যেখানে চোখে পড়েছে। আরো কোথাও সমস্যা থাকলে বলবেন।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
@মুক্তমনা এডমিন,
অ/ট: চমৎকার ব্যানার উপহার দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। :clap2:
@বিপ্লব রহমান,
আপনাকেও ধন্যবাদ। ব্যানারের ব্যাপারে অন্য ব্লগারদের মতামত পেলেও আমাদের ভাল লাগতো।
@আকাশ মালিক,
:yes: :yes:
কান্না পাচ্ছে। এই লেখা পড়ে কান্না পেল, জাহানারা ইমামের “একাত্তরের দিনগুলি” পড়ে তার স্বামী, রুমি, আজাদ এদের জন্য কেঁদেছিলাম, একাত্তরে চিঠি পড়ে কেঁদেছি। যারা বলে এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, যা হয়েছে তা ছিল গৃহযুদ্ধ, যারা বলে এদেশে যুদ্ধাপরাধ হয়নি, যারা বলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে যুক্তিসঙ্গত নয়, যেই জানোয়ারের দলকে, যাদের অনুভূতিকে মুক্তিযুদ্ধ স্পর্শও করতে পারেনা তাদের সাথে এক আকাশের নিচে আছি ভাবলেও খারাপ লাগে 😥
বহুবার পড়েছিলাম আগে, আবারো পড়লাম।
এই মাওলানা মান্নান মারা যাবার পরে তাকে শেষ দেখা দেখার জন্য ছুটে এসেছিলেন এমন বেশ কিছু ব্যাক্তিত্ব যাদের নাম শুনলে সবার চোখ কপালে উঠবে। বেশ কজন পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা সে তালিকায় ছিলেন। সেদিনই আবার বুঝেছিলাম যে আমাদের দেশে ঘাতক দালালদের বিচার ব্যাবহারিক ভাবে কত কঠিন।
@আদিল মাহমুদ,
ভাবছি সেসব পদকপ্রাপ্তদের কয়জন আসলেই মুক্তিযোদ্ধা? কোথায় যেন শুনেছিলাম পদকপ্রাপ্তদের সবাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয়। এ ব্যাপারে কিছু জানাতে পারেন?
@রামগড়ুড়ের ছানা,
এই মান্নান যার নামে ৭২ সালে সচিত্র বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল “এই নরপশুকে ধরিয়ে দিন”, তার জানাযায় কত লোক হাজির হয়েছিল জানো?
আসলে এটা আমাদের কালচারগত সমস্যা। আমরা পারিবারিক/সামাজিকভাবে বড় বেশী বন্ধনে জড়িয়ে পড়ি। মান্নানের জানাজায় যাওয়া সবাই যে মুক্তিযুদ্ধ্বের আদর্শ ভুলে গেছিলেন মনে হয় না। তবে ব্যাক্তি মান্নানের কাছে তারা রাজাকার মান্নানের চরিত্র ভুলে গেছিলেন। কাদের সিদ্দিকীর সাথে নিজামীর হাত মেলানোর ছবি মনে নেই? পদক প্রাপ্ত দুয়েকজনের নাম মনে আছে, তবে বলতে চাই না। একজন ছিলেন বিএনপির এক সিনিয়র নেতা, যিনি জিয়ার সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, বিএনপিতে তীব্র জামাত বিরোধী বলে পরে কোনঠাসা হয়ে পড়েন।
৭১ এর পর পর রাজাকারদের বিচার করা যায়নি তার একটি পরোক্ষ কারন ছি্ল এটিও। একই পরিবারের কেউ রাজাকার কেউ মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের আত্মীয়দের বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। আমার নিজের পরিবারেই ঘটেছে তেমন। খোদ বংগবন্ধুরও তেমন রেকর্ড আছে বলে শোনা যায়।
@আদিল মাহমুদ,
আমারই পরিবারে আমি অন্তত চারজন রাজাকারকে জানি যাদের কান কাটার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা বাসায় হানা দিয়েছিল, কিন্তু আমারই এক মুক্তিযোদ্ধা চাচা তাদেরকে আড়াল করে রেখেছিলেন(উনারা সম্পর্কে চাচাতো ভাই ছিলেন)। তাদের মধ্যে একজন পরে আমার বড় ফুপুকে বিয়ে করে(সম্পর্কে খুব সম্ভবত তার খালাতো বোন)। এখন আমার ১৩জন চাচা-ফুপুর মধ্যে আমার বাবা ও ছোট চাচা বাদে সবাই সক্রিয়ভাবে জামায়াতের রাজনীতি করে। যেই ফুপুরা কিশোরী বয়সে স্টুডিওতে গিয়ে পছন্দের নায়িকাদের অনুকরণে ছবি তুলত, তারা এখন রীতিমত ওহাবী কায়দায় পর্দা করে, এমনকি ৮-৯ বছরের নাতনীদেরও আপাদমস্তক পর্দায় আবৃত করে রাখে। নিজের অভিজ্ঞতায় দেখলাম কিভাবে একটা রাজাকার একই পরিবারের কয়েক শত সদস্যকে দূষিত করতে পারে। সেদিন যদি মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে এলাকার আর অন্যসব রাজাকারদের মত ব্রাশফায়ার করে মারত, আজকে হয়ত আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে ধর্মীয় গোঁড়ামীমুক্ত একটা সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ থাকত। করুণা জিনিসটা ভাল, কিন্তু আর সবকিছুর মত এই জিনিসটারও আতিশয্য কল্যানকর নয়।
@পৃথিবী,
আসলে রাজাকারদের বিচারের বিপক্ষে আমাদের জাতীয় কালচারের এই স্বজনপ্রিয়তা বা দৃঢ় পারিবারিক বন্ধন যে একটা শক্ত বাধা হয়ে আছে এই গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট কেন যেন এই ইস্যুতে আলোচনায় আসে না।
এটা খুবই গুরুত্বপূর্ন পয়েন্ট।
@আদিল মাহমুদ,
আমার পরিবারেও। মুক্তিযোদ্ধা দুইজন ছিলো আর রাজাকারও ছিলো একটা। তার আঠারো মাসের জেলও হয়েছিলো সেই সময়। পরে জামাত করতো, কিছুদিন আগে মরে গিয়েছে। আর মুক্তিযোদ্ধা দুইজনের একজন এখনও বেঁচে আছে, তবে রাজনৈতিক কোন ফায়দা লুটার ইচ্ছা বা শক্তি কোনটিই এখন আর তার নেই। সে যে মুক্তিযোদ্ধা এইটাই অনেকে ভুলে গিয়েছে, পুরো সাধারণ মানুষ।
:rose2: