লেখাটির জন্য একটি গৌরচন্দ্রিকা দরকার। দুনিয়ার তাবৎ বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীরাই যেখানে হকিং এর তত্ত্ব নিয়ে হিমসিম খান, তার বইয়ের রিভিউ লেখার দুঃসাহস করেন না খুব একটা, সেখানে আমার মতো একজন ছা-পোষা লেখকের গ্র্যাণ্ড ডিজাইন বইটির রিভিউ করা দুঃসাহসিক মনে হতে পারে। আমি নিজে কোন পদার্থবিজ্ঞানী নই। তবে, কোয়ান্টাম বলবিদ্যা সহ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ধ্যান ধারনাগুলোর সাথে আমি পরিচিত হয়েছিলাম একাডেমিকভাবে আমার মাস্টার্স কোর্স আর পিএইচডির কিছু কোর্সের সময়। আমার একাডেমিক জ্ঞান সেটুকুই। তারপর চাকরী বাকরী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় এবং সর্বোপরি পদার্থবিজ্ঞানের কোন গবেষণার সাথে সরাসরি জড়িত না থাকায়, মুলতঃ জনপ্রিয় ধারার ইংরেজী বই পুস্তক এবং বিজ্ঞান পত্রিকাই ছিলো আমার ভরসা, আমার জ্ঞানের উত্তোরণের বাহণ। কাজেই এই রিভিউটি কোন বিজ্ঞানী হিসেবে নয়, স্রেফ পাঠক হিসেবেই নেয়ার জন্য অনুরোধ করছি। মুক্তমনায় অনেক একাডেমিকভাবেই চর্চা করা পদার্থবিজ্ঞানী রয়েছেন। তাই রিভিউয়ে কোন ভ্রান্তি থাকলে সেটা সংশোধন করারও অনুরোধ জানাচ্ছি।

 

মাঝখানে তানভীরুল ইসলাম গ্র্যাণ্ড ডিজাইন বইটির অনুবাদ শুরু করেছিলেন। কিন্তু চারটি অধ্যায় প্রকাশের পর ভদ্রলোককে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। 🙂  পাওয়া গেলে ভালো হত যদিও। আমার এই অবমৃশ্যকারিতা করার কষ্টটুকু – মানে এই অর্বাচীন রিভিউটি হয়তো লেখার প্রয়োজন পড়তো না। যা হোক, রিভিউটি লেখার সময় বই থেকে হকিং এর উদ্ধৃতিগুলোর অনেকগুলর জন্যই তানভীরুলের অনুবাদের উপর ভরসা রেখেছি। এই সুযোগে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি তাঁকে। আর হকিং এর বইটি বেরুবার সময় লণ্ডন টাইমসে প্রকাশিত ফিচার নিয়ে সোরগোল চলার সময় আমি একটি লেখা লিখেছিলাম – ‘স্টিফেন হকিং-এর ঈশ্বরবিহীন মহাবিশ্ব’ শিরোনামে। এই রিভিউটিতেও কিছু কিছু জায়গায় আগের লেখার পুনরুক্তি খুঁজে পাবেন পাঠকেরা। এর জন্য দুঃখপ্রকাশ করা ছাড়া আমার গত্যন্তর নেই। রিভিউটি মূলতঃ আমার বইয়ের এক প্রকাশকের অনুরোধে তড়িঘড়ি করে লেখা।

:line:

 grand_design_bbok1

 

‘মহাবিশ্বে মহাকাশে মহাকাল-মাঝে
আমি মানব একাকী ভ্রমি বিস্ময়ে, ভ্রমি বিস্ময়ে’               

স্টিফেন হকিং এর  ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ বইটি পড়তে গিয়ে বার বারই রবিঠাকুরের উপরের চরণগুলোর কথা মনে হচ্ছিলো। হকিং তার এই নতুন বইটি লিখেছেন ক্যালটেকের পদার্থবিজ্ঞানী লিওনার্ড ম্লোডিনোর সাথে মিলে,  এবং এটি বেরিয়েছে ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।   যে দিন বইটি বাজারে আসে (সেপ্টেম্বর ৭, ২০১০), সে দিনই বইটি আমি হাতে পাই; এবং এটির একটি পর্যালোচনা করবো বলে মনস্থ করে ফেলি।  
 
হকিং এর নতুন বইটি খুব বেশি বড় নয়। ২০০ পৃষ্ঠারও কম। নিবিষ্ট মনে পড়লে দু দিনের মধ্যেই শেষ করে ফেলা যায়। ঢিলেমি করে পড়লেও এক সপ্তাহের বেশি লাগার কথা নয়। আমার আগ্রহের কারণেই হোক, আর বইয়ের ভাষার গতিশীলতার জন্যই হোক আমি প্রথম দিনেই বইটি মোটামুটি শেষ করে ফেলি। তারপরে আবারো পড়ি।  অন্ততঃ বার চারেক পড়া হয়েছে এম্নিতেই, উলটে পালটে দেখেছি অসংখ্যবার। কিন্তু বইটির নতুনত্ব কখনোই কমেনি। বইয়ের আকার দিয়ে আসলে বইটির মূল্যায়ন করা যাবে না।  শুধু আধুনিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের ক্ষেত্রেই নয়, দর্শনের ক্ষেত্রেও আছে রীতিমত চমক। এই বইয়ের প্রতিটি লাইনই পাঠকে চিন্তাশীল করবে,লুব্ধ করবে,পরিশিলীত করবে নতুন জ্ঞানের সমীরণে। মোট আটটি অধ্যায়ে সাজানো এই ছোট্ট বইটি। বইয়ের অধ্যায়গুলোর বাংলা করলে অনেকটা শোনাবে এ রকমের – ‘অস্তিত্বের রহস্য’, ‘নিয়মের নীতি’, ‘বাস্তবতা কী?’, ‘বিকল্প ইতিহাস’, ‘সার্বিক তত্ত্ব’, ‘আমাদের মহাবিশ্ব নির্বাচন’, ‘আপাতঃ অলৌকিকতা’ এবং সবশেষ অধ্যায়টি – ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’।
 
এই শেষ অধ্যায়টির নামেই পুরো বইটির নামকরণ করেছেন হকিং এবং ম্লোডিনো।  বইয়ের নাম শুনে প্রথম ধাক্কায় কারো কারো মনে হতে পারে বুদ্ধিদীপ্ত অনুকল্প  বা ইন্টেলিজন্ট ডিজাইনকে প্রমোট করা কোন বই বোধ হয়।  বলতে দ্বিধা নেই, আমারও এক ধরণের খুঁতখুঁতানি ছিলো  বইটিকে ঘিরে – যখন মাস খানেক আগে বইটির নাম প্রকাশিতব্য বই হিসেবে ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ নামটা  বিভিন্ন সাইটে আর পত্র-পত্রিকায় দেখেছিলাম। আর সেই সাথে উপরি হিসেবে হকিং-এর পূর্ববর্তী বইয়ের প্রবাদপ্রতিম ‘মাইণ্ড অফ গড’-এর ধোঁয়াশার ব্যাপারটা তো মাথায় ছিলোই।  তাই ‘ঘর পোড়া গরু যেমন  সিঁদূরে মেঘ দেখলে ভয় পায়’ ঠিক তেমনি একধরনের ভয়ার্ত অনুভূতি ছিলো প্রাথমিকভাবে বইটিকে ঘিরে। কিন্তু  বইটি হাতে পাবার পর এই অনুভূতি  কাটতে সময় লাগে নি।  না, বইটি ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের কোন বই নয়, নয় কোন ছদ্মবেশী পরিকল্পনাকারী অস্তিত্বের বিজ্ঞানময় প্রচার; বরং বইটি নিখাঁদ বিজ্ঞানের বইই, আর বইটি পড়ে আমার মনে হয়েছে ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ যেন ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইনের এক ‘গ্রাণ্ড সমাধি’ রচনা করতে এসেছে!  সে অর্থে বইয়ের শিরোনামটা আমার কাছে মজার এক কৌতুক বলেই  শেষ পর্যন্ত ধরা দিয়েছে । অবশ্য গূঢ় বিষয় নিয়ে  হকিং এর ‘অনর্থক’ কৌতুক করার ব্যাপারটি নতুন নয়।  ব্যাপারটি যে কেবল আমারই চোখে পড়েছে তা নয়। বিষয়টি নজরে পড়েছে ক্যালিফোর্ণিয়া ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির স্বনামখ্যাত পদার্থবিদ এবং সুলেখক শন ক্যারলেরও। হকিং এর বইয়ের রিভিউ করতে গিয়ে সেজন্য ড.ক্যারল  প্রথমেই লিখেছেন[1] –

 ‘[হকিং এর] বইয়ের শিরোনামে ‘ডিজাইন’ শব্দটির ব্যবহার লেখকের সেই চতুর কৌতুকপ্রিয় মননকে তুলে ধরেছে, যার সাথে আমরা ইতোমধ্যেই সম্যকভাবে অবহিত হয়ে গেছি। না, মহাবিশ্বের বিবিধ ধাঁধার সমাধান করতে গিয়ে  লেখকের উত্তরের সাথে ইন্টেলিজেন্ট ডিজাইন কিংবা ধর্মীয় মতবাদের কোনই সম্পর্ক নেই’। 

হকিং -ম্লোডিনো তাদের  বইটির প্রথম অধ্যায়ের নাম রেখেছেন  ‘অস্তিত্বের রহস্য’।   আমাদের অস্তিত্বের সাথে সম্পর্কিত অন্তিম সমস্ত প্রশ্নের পসরা সাজিয়ে অধ্যায়টি শুরু করেছেন তারা। অধ্যায়টি শুরু করেছেন এভাবে[2] (গ্রান্ড ডিজাইন,পৃষ্ঠা ৫) –

‘আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্বই খুবই কম সময়ের জন্য। আর এই ক্ষণিকের অস্তিত্বে এই মহাবিশ্বের খুব কম অংশই আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব। কিন্তু মানুষ স্বভাবে খুবই কৌতুহলী। সে জানতে চায়, সিমাবদ্ধ জীবনেও উত্তর খোঁজে। এই কোমল-কঠোর পৃথিবীর বুকে ক্ষণিকের জন্য জন্ম নিয়ে  উপরের সুবিশাল মহাকাশ আর নক্ষত্রপুঞ্জ দেখে যুগে যুগে আমাদের মত মানুষ হাজারো প্রশ্ন করে গেছে –  এই যে মহাবিশ্বে আমরা আছি একে বোঝার উপায় কী? এই মহাবিশ্বের আচরণ কেমন? বাস্তবতার প্রকৃতিই বা কেমন? সবকিছু কোথা থেকে এলো? মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে কি কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন আছে? আমাদের বেশির ভাগই এসব প্রশ্ন নিয়ে সারাক্ষণ মাথা ঘামায় না, কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই কখনো না কখনো এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে’।

প্রথম অধ্যায় থেকে শুরু করে  পুরো বইটি জুড়েই হকিং সেই সমস্ত কঠিন প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেগেছেন যেগুলো আমাদের অস্তিত্বের সাথে জড়িত শুধু নয়, সাপ্রতিক সময়ে আধুনিক বিজ্ঞান এবং দর্শনের প্রান্তিক সমস্যা হিসেবে বিবেচিত। যেমন,   
 
– কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
– কেনই বা আমাদের অস্তিত্ব আছে?
– কেন ভৌত সূত্রগুলো ঠিক এই সেটটাই আমরা দেখছি, অন্যরকম নয় কেন?
 
হকিং (এবং ম্লোডিনো) সার্থক পদার্থবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে সমস্যাগুলোকে দেখেছেন, এবং দাবী করেছেন এই প্রশ্নগুলো অতীতে দর্শনের কিংবা ধর্মশাস্ত্রের  এখতিয়ারে বিবেচিত হলেও আজ সেটা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানেরই অণুসন্ধিৎসার অংশ। তারা দাবী করেছেন, আধুনিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন ব্যখ্যার মাধ্যমেই  উপরের অন্তিম প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা পাওয়া যয় – কোন ধরণের ঐশ্বরিক কিংবা অপার্থিব প্রকল্পের আমদানী ছাড়াই।    
 
হকিং তার বইটির নিয়মের নীতি (The rule of Law) শিরোনামের ২য় অধ্যায়টিতে পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র বলতে কি বোঝায়, কিভাবে সেগুলো উদ্ভুত হতে পারে তা নিয়ে বেশ কিছু অংশ জুড়ে প্রাঞ্জল আলোচনা করেছেন। পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম বা সূত্রগুলো নিয়ে স্টিফেন হকিং এবং ম্লোডিনো যে সমস্ত প্রান্তিক  প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন সেগুলো হল –
 
–  নিয়মগুলো কিভাবে উদ্ভুত হল?
–  নিয়মগুলোর কি কোন ব্যতিক্রম আছে?
–  নিয়মগুলোর কি একটিই সম্ভাব্য সেট আছে?
 
নিঃসন্দেহে প্রতিটি  প্রশ্নই পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক সমস্যাগুলোর অন্যতম।  প্রাকৃতিক নিয়ম জিনিসটি কি তা বোঝাতে অধ্যায়টি শুরু করেছেন সূর্যগ্রহণ দিয়ে। প্রাচীন কালের মানুষেরা বহুদিন ধরেই সূর্যগ্রহণ ব্যাপারটার সাথে পরিচিত ছিলো। বছরের পর বছর দেখতে দেখতে তারা একসময় উপলব্ধি করেছিল যে, এই সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ এগুলো ইতস্ততভাবে ঘটে না, বরং ঘটে কিছু নিয়মে চলা ছক অনুসরণ করে। এভাবেই শুরু হয়েছিল মানুষের প্রাকৃতিক নিয়মকে বোঝার  নিরন্তর প্রক্রিয়া। তারপর এসেছে থেলসের কথা – যিনি ২৬০০ বছর আগে ভাবতে পেরেছিলেন এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চলছে কিছু নিয়মের উপর ভর করে। থেলস ছাড়াও অধ্যায়টিতে ক্রমান্বয়ে এসেছে  পিথাগোরাস, অ্যানাক্সিমেণ্ডার, এম্পিডিওক্লিস, হিপোক্রেটিস, অ্যানাক্সোগোরাস, ডিমোক্রিটাস, অ্যারিস্টাকাস সহ অন্যান্য অয়োনীয়দের ইতিহাসকথন। বিজ্ঞানী হকিং ইতিহাসের বিভিন্ন কালীক ঘটনাপ্রবাহকে সুসাহিত্যিকের মত বর্ণনা করে গেছেন, নিজেকে শুধু বিজ্ঞানেই সীমাবদ্ধ থাকেননি, তুলে এনেছেন অয়োনীয় সভ্যতার আলোকিত ইতিহাস, কখনো চলে গেছেন কেপলার, দেকার্তে, নিউটন, গ্যালিওর সময়ে, কখনোবা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের অতি সাম্প্রতিককালের লব্ধ জ্ঞান থেকে বিজ্ঞানের ইতিহাসকে তুলে এনেছেন অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্যে। আর এই অধ্যায়টি হয়ে উঠেছে বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষনীয় অধ্যায়গুলোর একটি।  অধ্যায়টি পড়তে পড়তে আমার কেন যেন  জীবনান্দ দাসের সুচেতনা  কবিতাটির দু’চরণ মাথায় প্রতিধ্বনি তুলছিলো অবিরাম –

‘আমাদের পিতা বুদ্ধ কনফুশিয়াসের মতো আমাদেরও প্রাণ
মূক করে রাখে; তবু চারিদকে রক্তক্লান্ত কাজের আহ্বান।
সুচেতনা, এই পথে আলো জ্বেলে — এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে;
সে অনেক শতাব্দীর মানষীর কাজ…’ 

আমার মতে, হকিং-ম্লোডিনোর এই বইয়ের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং বিস্তৃত প্রেক্ষাপট হল আধুনিক কোয়ান্টাম বলবিদ্যার গভীর এবং সাবলীল ব্যাখ্যা। আর, এই ব্যাখ্যাগুলোকে সাধারণ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হয়েছে কোন ধরণের গাণিতিক সমীকরণের ব্যবহার ছাড়াই। রিচার্ড ফেইনমেনের কোয়ান্টাম বলবিদ্যার প্রচলিত নিয়ম (যেটিকে ফেইনমেন অভিহিত করতেন ইতিহাসের যোগ বা ‘sum over histories’ নামে) কে ব্যাখ্যা করেছেন বিস্তৃত পরিসরে।  একটা মজার বিষয় এখানে না বললেই নয়।  হকিং-ম্লোডিনোর এই বইয়ে ফেইনমেনকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে ক্যালটেকের একটি স্ট্রিপ ক্লাবের বঙ্গোবাদক হিসেবে, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী হিসেবে নয়। এটা অবশ্য ফেইনমেনকে খাটো করার জন্য নয়, বরং ফেইনমেনের ব্যতিক্রমী চরিত্র পাঠকদের সামনে তুলে ধরতেই এই কাজটি করেছেন কৌতুকপ্রিয় হকিং।  সে যাই হোক, ফেইনমেন তার কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নিয়ে গবেষণায় দেখিয়েছেন, একটি কণার কেবল একটি ইতিহাস থাকে না, থাকে বিভিন্ন সম্ভাব্য হিস্ট্রির সমাহার, অর্থাৎ গাণিতিকভাবে – অসংখ্য সম্ভাবণার অপেক্ষক।  আমরা কণার দ্বিচিড় বা ডবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট থেকে ব্যাপারটার সত্যতা জেনেছি। ঠিক একই পদাঙ্ক অনুসরণ করে হকিং দেখিয়েছেন যে, এই অদ্ভুতুরে ব্যাপারটা আমাদের মহাবিশ্বের জন্যও একইভাবে সত্য। মহাবিশ্বেরও কেবল একক ইতিহাস আছে মনে করলে ভুল হবে- কারণ আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বও কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমে কোয়ান্টাম স্তর থেকেই যাত্রা শুরু করেছে আর আমাদের মহাবিশ্বের নিয়মগুলো উদ্ভুত হয়েছে মহাবিস্ফোরণের ফলশ্রুতিতেই। আমি একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি তার বই থেকে (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ৮৩)–

‘আমরা দ্বিচিড় পরীক্ষার সাহায্যে কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের একটা চিত্র তুলে ধরেছি। আমরা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এই ফাইনম্যানীয় সূত্রায়ণই পুরো মহাবিশ্বের উপর প্রয়োগ  করে আমরা দেখবো যে, একটা কণিকার মতো, এই মহাবিশ্বেরও কোনো একক ইতিহাস নেই, বরং রয়েছে সম্ভাব্য সকল ইতিহাস।  ইতিহাসগুলোর প্রতিটির নির্দিষ্ট সম্ভাব্যতা আছে। এবং মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থার উপর আমাদের করা পর্যবেক্ষণ, তার অতীতকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে, এই ভিন্ন ভিন্ন ইতিহাসকে নির্ধারণ করে। ঠিক যেমনটা ঘটে দ্বিচিড় পরীক্ষাতে যেখানে বর্তমানের পর্যবেক্ষণ কণিকাটির অতীকেও প্রভাবিত করে। আর এসব বিশ্লেষণের মাধ্যমেই আমরা দেখতে পাবো বিগব্যাং-এর মাধ্যমে কীভাবে মহাবিশ্বের প্রকৃতির সূত্রগুলোর উদ্ভব হয়েছে…’

 শূণ্য থেকে মহাবিশ্বের উদ্ভবের ধারণাটি অবশ্য নতুন কিছু ছিলো না।  বেশ কিছুদিন ধরেই এটি পদার্থবিজ্ঞানের মূলধারার গবেষণার অন্তর্ভুক্ত হিসেবে বিজ্ঞানীরা একে বিবেচনা করছেন। আমি আমার প্রথম বই ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫) বইটিতে তথাকথিত শূন্য থেকে কিভাবে জড় কণিকা সৃষ্টি হয় তা নিয়ে বিশদভাবে বাঙ্গালী পাঠকদের জন্য আলোচনা করেছিলাম[3]। আসলে খুব কম কথায় বললে, কোয়ান্টাম তত্ত্বানুযায়ী শূন্যতাকে আনেক তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। শূন্যতা মানে আক্ষরিক অর্থে শূন্য নয়- পদার্থ বিজ্ঞানীদের মতে যে শূন্যদেশকে আপাতঃ দৃষ্টিতে শান্ত, সমাহিত মনে হচ্ছে, তার সূক্ষস্তরে সবসময়ই নানান প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। এর মধ্যে নিহিত শক্তি থেকে পদার্থকণা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তৈরী হচ্ছে, আবার তারা নিজেকে সেই শক্তিতে বিলীন করে দিচ্ছে। যেমন, শূন্যাবস্থা থেকে সামান্য সময়ের ঝলকানির মধ্যে ইলেকটন এবং পজিটন (পদার্থ-প্রতি পদার্থ যুগল) থেকে পদার্থ তৈরী হয়েই আবার তা শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে পারে। এই ইলেকট্রন এবং পজিট্রনের মধ্যকার ব্যবধান থাকে ১০-১০ সেন্টিমিটারেরও কম, এবং পুরো ব্যাপারটার স্থায়িত্বকাল মাত্র ১০-২১ সেকেণ্ড[4]। ব্যাপারটাকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় বলে ‘ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন’। ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশন কোন রূপকথা নয়,  নয় কেবল গানিতিক বিমূর্ত মতবাদ; বিজ্ঞানীরা কিন্তু ব্যবহারিকভাবেই এর প্রমাণ পেয়েছেন। একটি প্রমাণ হচ্ছে ‘ল্যাম্ব শিফট’, যা আহিত পরমাণুর মধ্যস্থিত দুটো স্তরে শক্তির তারতম্য প্রকাশ করে। তবে কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের সবচেয়ে জোরদার প্রমাণ পাওয়া গেছে বিখ্যাত ‘কাসিমিরের প্রভাব’ থেকে ।  ১৯৪৮ সালে ডাচ পদার্থবিদ হেনরিখ কাসিমির বলেছিলেন,  কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন সত্যি হয়ে থাকলে দুটো ধাতব পাত খুব কাছাকাছি আনা হলে দেখা যাবে তারা একে অন্যকে ধীরে ধীরে আকর্ষণ করেছে। এর কারণ হচ্ছে, ধাতব পাত গুলোর মধ্যকার সঙ্কীর্ণ স্থানটিতে ভ্যাকুয়াম ফ্লাকচুয়েশনের ফলে খুব উচ্চ কম্পাঙ্কের তড়িচ্চুম্বকীয় ‘মোড’-এর উদ্ভব ঘটে যা ধাতব পাতগুলোকে একে অপরের দিকে আকর্ষণে বাধ্য করে। এ ব্যাপারটিই পরবর্তীতে মার্কস স্প্যার্ণে, স্টিভ লেমোরাক্স প্রমুখ বিজ্ঞানীদের পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়।

 

virtual_particle1virtual_particle2চিত্রঃ বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, যে শূন্যদেশকে আপাতঃ দৃষ্টিতে শান্ত, সমাহিত মনে হচ্ছে, তার সূক্ষস্তরে সবসময়ই নানান প্রক্রিয়া ঘটে চলেছে। এর মধ্যে নিহিত শক্তি থেকে পদার্থকণা স্বতঃস্ফুর্তভাবে তৈরী হচ্ছে, আবার তারা নিজেকে সেই শক্তিতে বিলীন করে দিচ্ছে। এ প্রক্রিয়াটির মূলে রয়েছে ‘রহস্যময়’ কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশন বা তথাকথিত ‘জিরো পয়েন্ট এনার্জি’। এ প্রক্রিয়ায় পদার্থ ও প্রতিপদার্থ যুগলের আকারে যে অসদ কণিকা (virtual particle) প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে তা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব অনুযায়ী প্লাঙ্ক ধ্রুবকের পরিসীমার মধ্যে বিলীন হয়ে যায়।   
 

বিজ্ঞানীরা আজ মনে করেন, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের ‘রহস্যময়’ ব্যপারগুলো কণার ক্ষেত্রে যেমনিভাবে সত্য, ঠিক তেমনি ভাবে মহাবিশ্বের জন্যও একইরকমভাবে সত্য হতে পারে।   তারা মনে করেন এক সুদূর অতীতে কারণবিহীন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের (Quantum Flactuation) মধ্য দিয়ে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিলো, যা পরবর্তীতে সৃষ্ট মহাবিশ্বকে স্ফীতির (Inflation) দিকে ঠেলে দিয়েছে, এবং আরো পরে পদার্থ আর কাঠামো তৈরির পথ সুগম করেছে। এগুলো কোন বানানো গল্প নয়। মহাবিশ্ব যে শূন্য থেকে উৎপন্ন হতে পারে প্রথম এ ধারণাটি ব্যক্ত করেছিলেন এডওয়ার্ড ট্রিয়ন ১৯৭৩ সালে ‘নেচার’ নামক বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জার্নালে[5]। এর পর আশির দশকে স্ফীতি তত্ত্বের আবির্ভাবের পর থেকেই বহু বিজ্ঞানী প্রাথমিক কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশরে ধারণাকে স্ফীতি তত্ত্বের সাথে জুড়ে দিয়ে মডেল বা প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন[6]।  শূন্য থেকে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির ধারণা যদি অবৈজ্ঞানিক এবং ভ্রান্তই হত, তবে সেগুলো প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক সাময়িকী (Scientific Journal) গুলোতে কখনই প্রকাশিত হত না। মূলতঃ স্ফীতি-তত্ত্বকে সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে, এবং প্রায় সবগুলোতেই এই তত্ত্ব অত্যন্ত সাফল্যের সাথে এ পর্যন্ত উত্তীর্ণ হয়েছে[7]।  স্ফীতি তত্ত্ব গ্যালাক্সির ক্লাস্টারিং, এক্স রশ্মি এবং অবলোহিত তেজস্ক্রিয়তার বিন্যাস, মহাবিশ্বের প্রসারণের হার এবং এর বয়স,  মহাবিশ্ব গঠনে এর উপাদান গুলোর প্রাচুর্য – সব কিছুই ব্যাখ্যা করতে পেরেছে নিখুঁত সৌন্দর্যে।  আমি এর কারিগরী দিকগুলো নিয়ে বিস্তৃতভাবে মুক্তমনায় একটা লেখা লিখেছিলাম বাংলায় -‘স্ফীতি তত্ত্ব এবং মহাবিশ্বের উদ্ভব’  শিরোনামে[8]। সম্প্রতি রায়হান আবীরও মুক্তমনায় প্রাকৃতিক উপায়ে মহাবিশ্বের উৎপত্তির  বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করে ততোধিক সুন্দর একটা প্রবন্ধ লিখেছেন – ‘নির্ধর্মকথাঃ ইন দ্য বিগিনিং …‘ শিরোনামে[9]। প্রবন্ধগুলোতে প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে তার সম্ভাব্য ব্যাখ্যা ছাড়াও এর অস্তিত্বের পেছনে একটি আদি ঐশ্বরিক কারণের খণ্ডন, স্বতস্ফুর্তভাবে মহাবিশ্ব সৃষ্টির পেছনে কোন মিরাকলের খণ্ডন ছাড়াও পদার্থের উৎপত্তি এবং শৃঙ্খলার সূচনার  বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।  হকিং অবশ্য এখানেই থেমে থাকেননি, আরো বহুদূর এগিয়ে গিয়ে স্ট্রিংতাত্ত্বিকদের দেয়া ‘এম থিওরী’র সাথে ফ্লাকচুয়েশনের একটি যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। এই সেই ‘এম তত্ত্ব’- যে তত্ত্ব থেকে আমরা জেনেছি যে, আমাদের এই চিরপরিচিত  বিশাল মহাবিশ্বের  বাইরেও এমনি ধরনের অসংখ্য মহাবিশ্ব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এবং বলাবাহুল্য এগুলোর সবগুলোই উদ্ভুত হয়েছে প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে স্বতস্ফুর্তভাবে। এটিই হচ্ছে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের মালটিভার্স বা অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা।
 

muliverse_quantum_fluctuation

চিত্রঃ হকিং এর মতে, কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের মাধ্যমেই অসংখ্য মহাবিশ্ব স্থান-কালের শূন্যতার ভিতর দিয়ে আবির্ভূত হয়েছে, এদের মধ্যে কোন কোনটি হয়তো ক্রান্তীয় আকারে পৌঁছুতে পেরেছে, এবং তারপর  অতিস্ফীতিয় প্রসারণে ক্রমান্বয়ে ছায়াপথ, তারকামণ্ডলী – এবং নিদেন পক্ষে অন্ততঃ একটি ক্ষেত্রে আমাদের গ্রহের মতো পরিবেশে জীবনের উদ্ভব ঘটিয়েছে।

     
 
অনন্ত মহাবিশ্ব সম্বন্ধে হকিং এর নিজের বক্তব্যই উদ্ধৃত করা যাক বই থেকে (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ৮)-

‘এম তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের মহাবিশ্বই কেবল একটি মাত্র মহাবিশ্ব নয়। বরং এম তত্ত্ব ভবিষ্যদ্বানী করছে যে, অগণিত মহাবিশ্বের উদ্ভব ঘটেছে স্রেফ শূন্য থেকে। আর এর পেছনে ঈশ্বর কিংবা এ ধরণের কোন অপ্রাকৃত সত্ত্বার হস্তক্ষেপের দরকার নেই।’ 
 

শুধু অনন্ত মহাবিশ্বের ধারণা পাঠকদের সামনে হাজির করেই ক্ষান্ত হননি হকিং, পাশাপাশি গণনা করে দেখিয়েছেন ‘অসংখ্য মহাবিশ্বের’ সম্ভাব্য সংখ্যাও। সে সমস্ত ভিন্ন মহাবিশ্বে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের ধরণও ভিন্ন হতে পারে বলে হকিং মনে করেন। তার মতে  (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ১১৮),

 
‘এম তত্ত্বের নিয়মগুলো তাই ভিন্ন ভিন্ন মহাবিশ্বের অস্তিত্বের ধারণাকে সম্ভাব্য করে তুলে। মহাবিশ্বগুলোর প্রকৃতি কীরকম হবে তা নির্ভর করবে অন্তঃস্থানের (internal space) বক্রতার প্রকৃতির উপর। কাজেই, এম তত্ত্ব থেকে পাওয়া সমাধান অসংখ্য মহাবিশ্ব থাকার সম্ভাবনা তৈরি করেছে, তার সংখ্যা হতে পারে এমনকি ১০৫০০ টিও। এর মানে হল, আমাদের চারপাশে  ১০৫০০ টির মতো মহাবিশ্বের অস্তিত্ব রয়েছে, এবং প্রতিটির উপর কাজ করতে পারে ভিন্ন ভিন্ন  প্রাকৃতিক সূত্র।’

 
ব্যাপারগুলোকে বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর মতো শোনালেও বিজ্ঞানীরা  আজ  মনে করছেন, আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান যখন একেবারে শূন্য থেকে কেবল একটি নয়, অসংখ্য মহাবিশ্ব সৃষ্টির একটি প্রাকৃতিক এবং যৌক্তিক সমাধান দিতে পারছে, তখন ঈশ্বর সম্ভবত একটি ‘বাড়তি হাইপোথিসিস’ ছাড়া আর কিছু নয়। বিজ্ঞানী ভিক্টর স্টেঙ্গর, লরেন্স ক্রাউস, এলেন গুথ, আদ্রে লিন্ডেরা সেটা অনেক আগে থেকেই বলে আসছিলেন[10] । হকিংও শেষপর্যন্ত সেই একই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন –   ‘গড হাইপোথিসিস’ বা ‘ঈশ্বর অনুকল্প’ মোটা দাগে অক্কামের ক্ষুরের পরিস্কার লংঘন। তিনি নিজেই সেটা বলেছেন বইয়ের সবচেয়ে আলোচিত উদ্ধৃতিটির মাধ্যমে –

 
‘It is not necessary to invoke God to light the blue touch paper and set the universe going’

স্টিফেন হকিং এর বক্তব্য মিডিয়ায় তুমুল বিতর্ক সৃষ্টি করেছে বলাই বাহুল্য ।  এই লাগাতার বিতর্কের সূচনা হয়েছিলো তার বই বেরুবার দিন এক সপ্তাহ আগে থেকেই। লণ্ডনের টাইমস পত্রিকা তার প্রকাশিতব্য নতুন বইটি ফিচার করতে গিয়ে বইয়ের কিছু অংশ প্রকাশ করে সেপ্টেম্বর মাসের দুই তারিখে।  হ্যানা ডেভলিনের রিপোর্টে প্রকাশিত টাইমসের সেই নিবন্ধের শিরোনাম ছিলো – ‘God did not create the universe, says hawking’[11]। সেখান থেকেই নতুন বইয়ে বিধৃত ঈশ্বর সম্বন্ধে হকিং এর পরিবর্তিত ধারণা পাঠকদের সামনে উঠে আসে।  টাইমসে প্রকাশিত সেই অংশবিশেষে হকিংকে উদ্ধৃত করে লেখা হয়েছিলো -বিগ ব্যাং কোন স্বর্গীয় হাতের ফসল কিংবা ফ্লুক ছিলো না। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র মেনেই প্রাকৃতিকভাবে বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে অনিবার্যভাবেই শূন্য থেকে মহাবিশ্ব উদ্ভুত হয়েছে; আর সেই সাথে ফুঁরিয়েছে মহাবিশ্ব তৈরির পেছনে ঈশ্বরের ভুমিকাও।

 
 
চিত্র: ‘ঈশ্বর মহাবিশ্ব তৈরি করেনি’ –২রা সেপ্টেম্বর লণ্ডন টাইমসে প্রকাশিত  কলামের শিরোনাম।
 

ধার্মিকরা স্বভাবতই আশাহত হয়ে গালির তুবড়ি ছুটিয়ে চলেছেন খবরটি প্রকাশের পর থেকেই। পাদ্রী সন্ন্যাসী ঠাকুর পুরুতেরা একজোট হয়ে স্টেটমেন্ট দিতে শুরু করেছিলেন তাদের মহাপতন ঠেকাতে। তারা বলছেন, মহাবিশ্ব কিভাবে শূন্য থেকে তৈরি হতে পারে বিজ্ঞান না হয় এখন তা ব্যাখ্যা করতে পারে, কিন্তু কেন মহাবিশ্বের সৃষ্টি – তা নাকি বিজ্ঞান বলতে পারে না। আর অবধারিতভাবেই তাদের কাছে একটাই উত্তর – ‘ঈশ্বর’!  কিন্তু কোন্‌ ঈশ্বর? যথারীতি মুসলিমরা দাবী করছে ইসলামিক ঈশ্বর আল্লহার, খ্রীস্টানেরা দাবী করছে বাইবেলীয় ঈশ্বর যীশুর, আর ইহুদীরা দাবী করছে জেহোভার। এই হচ্ছে তাদের  হকিং এর বিরুদ্ধে ‘একজোট’ হবার নমুনা।  নীচের কার্টুনটি  থেকে ব্যাপারটি আরো পরিস্কার হবে-

 

চিত্র: কার্টুন – ‘মহাবিশ্ব  সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের কোন ভূমিকা নেই’ – হকিং এর এই উক্তির বিরুদ্ধে ধর্মবাদীরা একজোট! 
 

হকিং এর বইটি নিয়ে লণ্ডন টাইমসের নিবন্ধটির পর আমি মুক্তমনায় কৌতুক করে লিখেছিলাম যে, এপলোজিস্টদের জন্য খারাপ খবরের সংখ্যা প্রতিদিনই বেড়ে চলছে। প্রতিদিনই একটা করে নতুন বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি ঘটে, আর ধার্মিকদের ‘গড’ এর আকার আরো সংকুচিত হয়ে পড়ে। উইলিয়াম প্যালে ১৮০২ সালে প্রকাশিত বই ‘Natural Theology, or Evidence of Existence and Attributes of the Deity, collected from the Appearences of Nature’ এর মাধ্যমে যে ‘ডিজাইন আর্গুমেন্ট’ বা সৃষ্টির পরিকল্পিত যুক্তির অবতারণা করেছিলেন ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব এসে সেই ডিজাইন আর্গুমেন্টকে বাতিল করে দিয়েছিলো সত্তুর বছরের মধ্যেই। তারপর যত দিন গেছে বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির ইতিহাস মানে জ্ঞানের ফাঁক-ফোঁকর থেকে ঈশ্বরকে হটানোরই ইতিহাস – ‘গড ইন গ্যাপ্স’ এবং ‘আর্গুমেণ্ট ফ্রম ইগনোরেন্স’ থেকে মুক্তির প্রচেষ্টাই বলা যায়। এ বছর (২০১০) ক্রেগ ভেন্টর তার গবেষণায় দেখিয়েছেন কৃত্রিমভাবে প্রাণের সৃষ্টি করাও আজ আর বিজ্ঞানীদের আয়ত্বের বাইরে নয়। ভেন্টর প্রাথমিকভাবে ইস্ট থেকে ক্রোমোজমের বিভিন্ন মাল মশলা সংগ্রহ করেছিলেন, আর ক্রোমজমের পূর্ণাঙ্গ রূপটি কম্পিউটারে সিমুলেশন করে বানিয়েছিলেন Mycoplasma mycoides নামের একটি ব্যাকটেরিয়ার জিনোমের অনুকরণে[12]। ক্রেগ ভেন্টরের এই ঐতিহাসিক আবিস্কারের পর পরই আমি মুক্তমনায় একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম ‘অবশেষে মানুষের ঈশ্বর হয়ে ওঠা : তৈরি হল প্রথম কৃত্রিম প্রাণ’ শিরোনামে[13]।  ডারউইন থেকে শুরু করে আজকের ডকিন্সের ক্রমিক প্রচেষ্টায় জীববিজ্ঞানের কাঠামো থেকে ঈশ্বর হটে গেলেও ঈশ্বর সাহেব একটা অন্ধকার গুহা খুঁজে পেয়েছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের তথাকথিত ফাইনটিউনিং, এন্থ্রোপিক আর্গুমেন্ট এবং সর্বোপরি হকিং এর ‘মাইণ্ড অব গড’ -এর মধ্যে। বড়ই দুর্ভাগ্য, সেখান থেকেও ঈশ্বরকে ক্রমশঃ হটে যেতে হচ্ছে। সেজন্যই লণ্ডন টাইমসে লেখা হয়েছে[14] –

‘আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান ঈশ্বরের জন্য কোন জায়গা আর খালি রাখেনি, স্টিফেন হকিং এর উপসংহার এটাই। যে ভাবে ডারউইনবাদ জীববিজ্ঞানের চৌহদ্দি থেকে ঈশ্বরকে সরিয়ে দিয়েছে,  ব্রিটেনের সবচেয়ে বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ঠিক সেরকমভাবেই মনে করেন, পদার্থবিজ্ঞানের নতুন তত্ত্বগুলো ঈশ্বরের ভূমিকাকে  অপাংক্তেয় করে তুলেছে।’  
 

‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ বইটি প্রকাশের কিছুদিন আগে এবিসি নিউজের একটি সাক্ষাৎকারে  স্টিফেন হকিংকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো ধর্মান্ধতা আর বিজ্ঞানের এই লাগাতার সংঘাতে কে জয়ী হবে? হকিং এর দ্বিধাহীন উত্তর ছিল – ‘সায়েন্স উইল উইন’!  হকিং সেই সাক্ষাৎকারে পরিস্কার করেই বলেছেন,

‘ধর্ম আর বিজ্ঞানের মধ্যে একটি পরিস্কার জায়গায় পার্থক্য আছে। ধর্ম মূলতঃ ঐশী -বানী আর রিলিজিয়াস অথরিটির উপরই নির্ভরশীল , সেখানে বিজ্ঞান নির্ভর করে যুক্তি আর প্রমাণে। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানই জয়ী হবে, কারণ বিজ্ঞানের এই পদ্ধটিটাই উৎকৃষ্ট বলে প্রমাণিত হয়েছে’।

বইটি প্রকাশের পর পর ল্যারি কিং লাইভেও সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন হকিং। সেখানে তাকে ধর্ম ও বিজ্ঞানের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন করা করা হলে একই ধরণের উত্তর দেন হকিং[15]-

‘বিজ্ঞান ক্রমশঃ সেই সকল প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে শুরু করেছে, যা এতোদিন কেবল ধর্মের এখতিয়ারে অন্তর্ভুক্ত ছিলো। বিজ্ঞান নিজেই আজ  সয়ংসম্পূর্ণ।ধর্মতত্ত্বের প্রয়োজন তাই ফুঁরিয়েছে’। 

হকিং-এর এ উত্তর পেয়ে ল্যারি পুনরায় জিজ্ঞাসা করেছিলেন –
 
– ‘তাহলে কি ঈশ্বর নেই?’
 
–  ‘হয়তো থাকতে পারেন, কিন্তু মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে তার কোন ভুমিকা নেই।’ – এই ছিলো স্টিফেন হকিং এর উত্তর!
 
নিঃসন্দেহে স্টিফেন হকিং এর এ এক সাহসী পদযাত্রা। আর সে হিসেবে ‘গ্র্যাণ্ড ডিজাইন’ আবির্ভূত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের অন্যতম উচ্চাভিলাসী একটি গ্রন্থ হিসেবে।
 
স্টিফেন হকিং শুধু প্রথাগত ধর্মতত্ত্বেরই নয়, মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছেন প্রথাগত দর্শনেরও। তিনি বইয়ের শুরুতেই তার পাঠকদের ধাক্কা দিয়েছেন এই বলে (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ৫)  –

‘ফিলোসফি ইজ ডেড’ । 

এটি হকিং-ম্লোডিনোর বইয়ের আরেকটি স্মরণীয় এবং আলোচিত উদ্ধৃতি। লেখকদের মতে, দার্শিনিকেরা নন, বরং বিজ্ঞানীরাই আজ গহীন আঁধারে উজ্জ্বল আলোকবর্তিকা।   আজকের দিনে কয়েকজন বিখ্যাত বিজ্ঞানের দার্শনিকের নাম বলতে বললে হকিং, ওয়াইনবার্গ, ভিক্টর স্টেঙ্গর, ডকিন্স -এদের কথা সবার আগেই চলে আসে। এরা কেউ কিন্তু প্রথাগত দার্শনিক নন, তবুও দর্শনগত বিষয়ে তাদের অভিমত ইদানিং যথেষ্ট গুরুত্বপুর্ণ হয়ে উঠেছে। একটা সময় দর্শন ছিল জ্ঞান চর্চার মধ্যমনি। প্রাকৃতবিজ্ঞান ছিল তার সহচরী। এখন দিন বদলেছে – বিশ্বতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব এমনকি অধিবিদ্যার জগতেও প্রাকৃতবিজ্ঞান বিশেষ করে পদার্থবিদ্যা শুধু প্রবেশ করেনি, দর্শনকে প্রায় স্থানচ্যুত করে দিয়েছে। অধিবিদ্যা জানতে হলে তো এখন আর ‘স্পেশাল’ কোন জ্ঞান লাগে না। কেবল ধর্মের ইতিহাস, নন্দনতত্ত্ব আর ভাষার মধ্যে আশ্রয় নেয়া ছাড়া আর কোন পথ পায়নি আধুনিক অধিবিদ্যা। অন্যদিকে, আধুনিক পদার্থবিদ্যা আজকে যে জায়গায় পৌছেছে – সেটি অধিবিদ্যার অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারে। মহাবিশ্বের উৎপত্তি আর পরিণতি নিয়ে একজন দার্শনিকের চেয়ে অনেক শুদ্ধভাবে বক্তব্য রাখতে  সক্ষম হবেন একজন হকিং কিংবা ওয়াইনবার্গ। ডিজাইন আর্গুমেন্ট নিয়ে অধিবিদ্যা জানা পন্ডিতের চেয়ে বিজ্ঞান থেকেই অনেক ভাল দৃষ্টান্ত দিতে পারবেন ডকিন্স বা শন ক্যারল। আজকে সেজন্য মহাবিশ্ব এবং এর দর্শন নিয়ে যে কোন আলোচনাতেই পদার্থবিজ্ঞানীদেরই আমন্ত্রণ জানানো হয়, এরিস্টটলের ইতিহাস কপচানো কোন দার্শনিককে কিংবা সনাতন ধর্ম জানা কোন হেড পন্ডিতকে নয়। মানুষও বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে নানা রকমের দর্শনের কথা শুনতে চায়, তাদের কথাকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। গ্রান্ড ডিজাইন বইয়েও ভবিষ্যদ্বানী করা হয়েছে – সনাতন দর্শনের প্রয়োজন দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে, আর তার স্থান নিতে চলেছে আধুনিক বিজ্ঞান! হকিং তার বইয়ে সরাসরি অভিমত ব্যক্ত করেন দর্শন এবং আধুনিক বিজ্ঞান সম্বন্ধে এভাবে  (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ৫) –
 

‘আগে আমাদের এবং মহাবিশ্বের অস্তিত্বের সাথে জড়িত প্রশ্নগুলো কেবল দর্শনশাস্ত্রের সমস্যা হিসেবে গন্য হত। কিন্তু দর্শনের মৃত্যু হয়েছে।দর্শনশাস্ত্র বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে চলতে পারেনি। আজকে বিজ্ঞানীরাই বরং নতুন জ্ঞানের অন্বেষণে সফল পথপ্রদর্শক’।

 
 
হকিং-এর উক্তির বাস্তব প্রতিফলন আমরা পাই জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখকদের পরিসংখ্যানেই। আজকে বিজ্ঞানের দর্শনের উপর লেখা সাম্প্রতিক বই গুলো, যেমন  – ‘গড – দ্য ফেইল্ড হাইপোথিসিস’, ‘গড ডিলুশন’, ‘নিউ এথিজম’, ‘মাইণ্ড অব গড’ থেকে শুরু করে ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’ -এর মত বইগুলো লিখছেন ভিক্টর স্টেঙ্গর, রিচার্ড ডকিন্স, পল ডেভিস কিংবা স্টিফেন হকিং-এর মতো বিজ্ঞানীরাই।  এ থেকেই সাম্প্রতিক ধারাটি উপলব্ধি করা যায় কিন্তু। এরিস্টটল, সক্রেটিস, স্পিনোজা কান্ট, রাসেলের ঐতিহ্যের কি দুঃখজনক পরিনাম, ভাবা যায়? [16]
 
সম্পূর্ণ বইটি পড়লে পাঠকেরা আরো দেখবেন, ‘দর্শনের মৃত্যু ঘটেছে’ বলে বইটি শুরু করলেও, দর্শন নিয়েই লেখকেরা কথা বলেছেন বইটির অধিকাংশ জায়গায়। সাদা চোখে ব্যাপারটা স্ববিরোধী মনে হতে পারে। আসলে তা নয়। স্টিফেন হকিং  দর্শনের সমস্যাগুলোকে দেখতে চেয়েছেন একজন পদার্থবিজ্ঞানীর চোখ দিয়ে।  আগেই বলেছি, তার মতো পদার্থবিজ্ঞানীরাই আজকের দিনের বিজ্ঞানের দর্শনিক।  স্টিফেন হকিং চিন্তার ঝাঁকুনি দিয়েছেন দর্শনের অনেক বিষয়েই, পদার্থবিজ্ঞান থেকে পাওয়া সাম্প্রতিক জ্ঞানের নিরিখে। তার মধ্যে একটি প্রচণ্ড আলোচিত বিষয় হলো – বাস্তবতা বা রিয়ালিটির ধারণা। হকিং-এর মতে আলাদা ভাবে বাস্তবতা কী, সেটা বলার কোন অর্থ হয় না; আমরা যেটা বলতে পারি সেটা হল প্রতিরূপ-কেন্দ্রিক বাস্তবতা (Model dependent realism)। হকিং তার বইয়ে গোল্ডফিশ মাছের একটি মজার উদাহরণ দিয়েছেন। ধরুণ, আপনার বাড়ীর কাঁচের জারে একটি গোল্ডফিশ আছে। গোল্ডফিশ জারের পানির মধ্যে আজীবন থেকে তার চোখ দিয়ে পৃথিবীর বা চারপাশের যে বাস্তবতা দেখছে, আপনার বাস্তবতা তা থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু আপনি কি হলফ করে বলতে পারবেন যে আপনার দেখা বাস্তবতাই ‘প্রকৃত বাস্তবতা’? আমরাও যে গ্লাসের জারে রাখা গোল্ডফিশের মতো করেই এক-একটি গোল্ডফিশ নই, সে সম্বন্ধে কি আমরা নিশ্চিত?

 

goldfish_reality

চিত্রঃ  কাঁচের জারে রাখা একটি গোল্ডফিশ  আজীবন থেকে তার চোখ দিয়ে পৃথিবীর বা চারপাশের যে বাস্তবতা দেখছে, আমাদের বাস্তবতা তা থেকে অনেকটাই আলাদা। কিন্তু আমরাও শেষ বিচারে যে গ্লাসের জারে রাখা গোল্ডফিশের মতো এক-একটি গোল্ডফিশ নই, সে সম্বন্ধে কি আমরা নিশ্চিত?  

 
একটি ব্যাপার এখানে বুঝতে হবে। যে বাস্তবতাই হোক, আমরা কিন্তু শেষপর্যন্ত তা অনুধাবন করি আমাদের মস্তিস্ক কোষের সাহায্যে। আর মানব মস্তিস্ক তৈরি হয়েছে দীর্ঘদিনের বিবর্তনীয় পথপরিক্রমায়। মস্তিস্ককে যদি বিবর্তনীয় পথে সৃষ্ট একটি তথ্য-প্রক্রিয়াজাত যন্ত্র হয়ে থাকে, স্বাভাবিক নিয়মেই সেই যন্ত্রের কিছু ত্রুটি থাকে যাবে (যেরকম ত্রুটি অন্য সব যন্ত্রেরই থাকে)। এই ত্রুটিযুক্ত জৈবিক যন্ত্রের সাহায্যে পরিপূর্ণ বাস্তবতার আস্বাদন কি সম্ভব? হয়তো নয়। কাজেই প্রকৃত বাস্তবতার সন্ধান আমরা হয়তো কখনোই পাব না। আসলে প্রকৃত বাস্তবতাটা কী – সেটা বলারই কোন অর্থ হয় না। যেটা আমরা বলতে পারি – মডেল বা প্রতিরূপ নির্ভরশীল বাস্তবতা। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে – এম থিওরী যদি সত্য হয়ে থাকে, তবে বাস্তবতা আসলে একটি নয়, অনেকগুলো – এবং অনেক সময়ই তা পরিস্থিতি নির্ভর হতে পারে। তিনি তার বইয়ে বাস্তবতা প্রসঙ্গে বলেন (গ্র্যান্ড ডিজাইন, পৃষ্ঠা ৪২),
 

‘কোনো চিত্র- বা তত্ত্ব-অনির্ভর বাস্তবতার অস্তিত্ব নেই। আমরা বাস্তবতার যে ধারণাটা গ্রহণ করব সেটাকে বলব প্রতিরূপনির্ভর বাস্তবতা: এ ধারণা অনুযায়ী ভৌত তত্ত্ব এবং বিশ্বচিত্র হচ্ছে একধরনের প্রতিরূপ (সাধারণতঃ গাণিতিক) যেখানে একগুচ্ছ নিয়ম এ কাঠামোর বিভিন্ন অংশের সাথে পর্যবেক্ষণের একটি যোগসূত্র তৈরি করে। এই প্রতিরূপকেন্দ্রিক বাস্তবতাই হচ্ছে সেই কাঠামো যার সাহায্যে আধুনিক বিজ্ঞানকে বোঝা যায়।’

 
স্টিফেন হকিং  আমাদের জোরালো একটি ধাক্কা দিয়েছেন ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ নিয়েও। হকিং তার বইয়ে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের উদ্ভব নিয়ে ভেবেছেন আমরা আগেই বলেছি, কিন্তু  তার ভাবনাকে তিনি সেখানেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি বলেছেন, এমনকি আমাদের চিন্তাচেতানাও পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের বাইরে নয়। তাই তিনি ‘স্বাধীন ইচ্ছে’ নিয়ে প্রশ্ন করেন অত্যন্ত যৌক্তিক ভাবেই [17]-

‘মানুষ কি স্বাধীন ইচ্ছা করতে সক্ষম? আমাদের যদি মুক্তইচ্ছা থেকেই থাকে তাহলে বিবর্তনের ঠিক কোন ধাপে সেটার উদ্ভব হয়েছে? নীল-সবুজ শৈবাল বা ব্যাক্টেরিয়াদের কি মুক্তইচ্ছা আছে, নাকি তাদের আচরণ সয়ংক্রিয়, বৈজ্ঞানিক ভাবে সূত্রবদ্ধ? শুধু বহুকোষী জীবেরই কি মুক্তইচ্ছা আছে, নাকি শুধু স্তন্যপায়ী প্রাণীদের? আমরা ভাবতে পারি যে একটা শিম্পাঞ্জি হয়তো নিজের স্বাধীন ইচ্ছাতেই কলাটা চিবাচ্ছে, বা বিড়ালটা সোফা ছিড়ে কুটিকুটি করছে, কিন্তু তাহলে Caenorhabidis elegans নামক গোলকৃমির কথা কী বলব,যেটা শুধু মাত্র ৯৫৯টা কোষ দিয়ে গঠিত? সে নিশ্চই কখনো ভাবে না, “ওই যে, ওই মজার ব্যাকটেরিয়াটা আমি এখন মচমচিয়ে খাবো”, কিন্তু দেখা যায় এমনকি তারও নির্দিষ্ট পছন্দ-অপছন্দ আছে এবং নিকটবর্তী অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে সে হয় কোনো অনাকর্ষণীয় খাবারেই সন্তুষ্ট হয়, অথবা ছুটে যায় আরো ভালো কিছুর দিকে। এটা কি মুক্তইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ?’ 

মানব মস্তিস্ক তৈরি হয়েছে বিবর্তনের এবং সর্বোপরি পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকে মেনেই। কাজেই আমরা চাই বা না চাই, আমাদের চিন্তাও সেই পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মের মাঝেই হয়তো সীমাবদ্ধ থাকবে,আমরা তা চেষ্টা করলেও অতিক্রম করতে পারব না। সে হিসেবে ‘মুক্তচিন্তা’ বা ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ ব্যাপারটা এক ধরণের বিভ্রম বা ইল্যুশন- অন্ততঃ হকিং এর তাই অভিমত। তাই তিনি বলেন – 

‘যদিও আমরা ভাবি যে আমাদের মুক্ত ইচ্ছার ক্ষমতা আছে তারপরও আনবিক জীববিদ্যার জ্ঞান থেকে জানা যায় সকল জৈব প্রক্রিয়াই পদার্থবিজ্ঞান আর রসায়ণের সূত্রাবলি মেনে চলে, তাই তারা ঠিক ততটাই সুনির্ধারিত যতটা সুনির্ধারিত গ্রহসমূহের কক্ষপথ। স্নায়ুবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক গবেষণাসমূহ এই ধারণাকেই সমর্থন করে যে আমাদের মস্তিষ্ক বিজ্ঞানের পরিচিত সূত্রগুলো মেনেই কাজ করে, এবং আমাদের সব ধরণের কর্মকান্ড নির্ধারণ করে, প্রকৃতির নিয়মের বাইরের কোনো অপ্রাকৃত কোন  কিছুর হাতে এই নিয়ন্ত্রণ নেই। জাগ্রত অবস্থায় রোগীর মস্তিষ্কে অপারেশন করার সময় এটা দেখা গেছে যে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ বৈদ্যুতিক ভাবে উদ্দীপ্ত করে রোগীর মধ্যে হাত-পা নাড়ানোর, ঠোট নাড়ানোর, এমনকি কথা বলার আকাংক্ষা সৃষ্টি করা সম্ভব। আমাদের সকল আচরণ যদি ভৌত বিধিগুলো দিয়েই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে তাহলে এখানে স্বাধীন ইচ্ছার অবস্থান কোথায় সে চিন্তা করা দুষ্কর। তাই দেখা যাচ্ছে আমরা কিছু জৈব যন্ত্র ছাড়া কিছুই নই, এবং ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ শুধুই একটা বিভ্রম’। 

‘স্বাধীন ইচ্ছা’ শুধুই একটা বিভ্রম – তার এই মন্তব্য নিঃসন্দেহে অনেক বিতর্কের জন্ম দেবে, শুধু ধার্মিকদের মধ্যেই নয়, পাশাপাশি অনেক মুক্তচিন্তকদের মাঝেও; কিন্তু আমার মতে, এই শক্তিশালী অভিব্যক্তিটি বইটিতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা। দার্শনিক অভিব্যক্তিটি হল, আমাদের মস্তিস্ক যদি পদার্থবিজ্ঞানের এবং বিবর্তনের নিয়মকে মেনেই তৈরি হয় তবে, আমরা দূর্ভাগ্যবশতঃ সেই নিয়মের ‘কারাগারেই’ বন্দি থাকব, যদিও আমরা সব সময়েই মনে করে যাব আমাদের ‘ফ্রি-উইল’ বা ‘স্বাধীন ইচ্ছে’ জাতীয় কিছু আছে। চিড়িয়াখানায় বা গাছের ডালে যে বানরকে  কলা খেতে দেখা যায় – সেটা আমরা ভাবতে পারি এই বলে যে, স্বাধীন ইচ্ছার জন্যই বানরটি কলা খাচ্ছে – কিন্তু একটু গভীর ভাবে ভাবলেই বোঝা যাবে যে বানরটি কলা খাচ্ছে আসলে প্রবৃত্তির বশে – যে প্রবৃত্তি জৈব বিবর্তনীয় পথেই উদ্ভুত হয়েছে – পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক নিয়মগুলো মেনেই। মানুষও সেই ধারার ব্যতিক্রম নয়। মানুষের বিভিন্ন কাজও কিন্তু জৈব বিবর্তনিয় নিয়ম বা শেষ পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই হচ্ছে। স্বাধীন ইচ্ছা বলতে যদি দেহ বহির্ভূত কার্যকারণহীন কোন ক্ষমতাকে বোঝানো হয় – অর্থাৎ, একজন মানুষ কোন কিছুর দ্বারা একেবারেই প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রিত না হয়ে ‘স্বাধীন ভাবে’ কোন কাজ করতে সক্ষম বলে ভাবা হয় – সেটা আসলে ধার্মিকদের আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসকেই ঘুরিয়ে বলা হবে[18]। বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন লিবেট আশির দশকে একটি কৌতুহলোদ্দীপক পরীক্ষার মাধ্যমে[19] দেখিয়েছিলেন যে ফ্রি উইল আসলে একটি বিভ্রান্তি বই কিছু নয়[20]। স্নায়ুবিজ্ঞানের অতি সাম্প্রতিক গবেষণা থেকেও কিন্তু এই ধারণার স্বপক্ষে নানা সত্যতা পাওয়া গেছে। যেমন, ২০০৮ সালের একটি গবেষণা থেকে জানা গিয়েছে যে, কোন ব্যক্তি সচেতন হবার বা এ সম্বন্ধে কিছু বুঝে উঠার অন্ততঃ ১০ সেকেণ্ড আগে  থেকেই তার মস্তিস্ক কোন কাজ করে ফেলতে পারে[21]। ব্যাপারটা সত্য হয়ে থাকলে ব্যক্তির স্বাধীন ইচ্ছা ব্যাপারটি সত্যই এক ধরণের বিভ্রম, কিন্তু নিঃসন্দেহে খুব শক্তিশালী বিভ্রম! বস্তুতঃ ‘স্বাধীন ইচ্ছা’ নিয়ে গ্র্যাণ্ড ডিজাইন বইয়ে হকিং-এর গোছানো চিন্তাভাবনাগুলো মানব মস্তিস্ক নিয়ে সাম্প্রতিক গবেষণারই প্রতিধ্বনি যেন।    
 
গ্র্যাণ্ড ডিজাইন বইটির প্রশংসা শুধু নয়, সমালোচনাও হতে পারে বেশ কিছু দিক থেকেই। একটি বড় সর সমালোচনার কথা তো বইটি পড়তে পড়তেই মনে আসছিল। হকিং যে সমস্ত তত্ত্বের উপর ভর করে তার ভারী ভারী উপসংহারগুলো টেনেছেন, সেগুলো বড় বেশি প্রান্তিক, অনেক বেশি দুর্গম। বিশেষ করে ‘এম তত্ত্ব’ কিংবা ‘মাল্টিভার্সের’ যে সমস্ত ধারণাগুলোর উপর ভিত্তি করে হকিং তার ‘বাজি’গুলো ধরছেন, সেগুলো এখনো প্রমাণিত কোন বিষয় নয়। এমনকি এ তত্ত্বগুলো কখনো পর্যবেক্ষণ করে যাচাইযোগ্য কিনা, তা নিয়েও বিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। তারপরেও, আমি বলবো প্রান্তিক এই জ্ঞানগুলো আমাদের জন্য জরুরী। আর নিঃসন্দেহে আজকে যে তত্ত্বগুলো ‘বিপ্লবী’, ‘অবাস্তব’ কিংবা ‘অপ্রমাণিত’ বলে ভাবা হচ্ছে, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়নের সাথে সাথে আর তেমনটি মনে নাও হতে পারে। তত্ত্ব দেবার বহু বছর পরে সেই তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রমাণ পাওয়া গেছে – এমন দৃষ্টান্ত বিজ্ঞানে বিরল নয়। এমন অনেক সময়ই  হয়েছে – বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলো যে সময়ে প্রস্তাব করা হয়েছিলো, সে সময় সে তত্ত্বগুলোকে প্রমাণ করার মতো যথার্থ প্রযুক্তি বিজ্ঞানীদের হাতে ছিলো না। কিন্তু তা বলে সেই তত্ত্বগুলো অবৈজ্ঞানিক কিছু ছিলো না। যেমন, বিখ্যাত ‘হকিং রেডিয়েশনের’ কথা বলা যেতে পারে। কৃষ্ণগহবর থেকে তেজস্ত্রিয়তার বিচ্ছুরণের যে প্রস্তাব হকিং বিগত সত্তুরের দশকে করেছিলেন (যাকে সাধারণভাবে এখন ‘ব্ল্যাকহোল ইভাপোরেশন’ হিসেবে অভিহিত করা হয়), তা প্রমাণ করার মতো প্রযুক্তি তখন আমাদের হাতে ছিলো না। সম্প্রতি প্রযুক্তির উন্নয়েন সাথে সাথে বেশ কিছু প্রমাণ আমরা পেতে শুরু করেছি[22]। প্রমাণ  প্রযুক্তিগত এবং অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে এম তত্ত্ব কিংবা অনন্ত মহাবিশ্বের প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখন পর্যন্ত না পাওয়া গেলেও এগুলো গাণিতিকভাবে সুসংহত। কাজেই ভবিষ্যতে  পাওয়া যেতেই পারে এই তত্ত্বগুলোর প্রত্যক্ষ কিংবা হয়তো পরোক্ষ কোন আনুষঙ্গিক প্রমাণ[23]। হকিং সেটা খুব ভালভাবেই জানেন। তাই তিনি প্রযুক্তির কালীক সীমাবদ্ধতার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতি নন, তিনি বাজি ধরেন ‘সীমার মাঝে অসীম’ সব সমস্যার সমাধানে। তার শেষ দানের বাজি  শুধু বিজ্ঞানীদেরই নয়, আন্দোলিত করে ছাপোষা এই আমাদেরও, দলছুটের গানের মতো অনুরণন তোলে তা আমাদের মনে –

‘তুমি আমার বাহান্ন তাস
শেষ দানেও আছি
তোমার নামে ধরেছি আমার
সর্বস্ব বাজি…’ 

এ ধরনের বাজি ধরা হকিং এর জন্য অবশ্য নতুন কিছু নয়। তিনি জীবনে বহু কিছু নিয়েই বাজি ধরেছেন, এমনকি নিজের জীবন নিয়েও। ১৯৬৩ সালে ২১ বছর বয়সে  যখন তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করছিলেন, তখনই আর দূরারোগ্য  স্নায়বিক রোগ -‘মোটর নিউরণ ডিজিজ’ ধরা পড়ে। তাকে বলা হয়েছিলো তিনি বড়জোড় মাত্র বছর দু’এক বেঁচে থাকতে পারবেন। হকিং হতাশ না হয়ে জীবন নিয়ে বাজি ধরেছেন। আরো বেশি করে পদার্থবিজ্ঞানের প্রান্তিক জ্ঞানের সাহায্যে মহাবিশ্বের রহস্য উন্মোচনে  নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। ১৯৬৩ সালের পর থেকে আরো ৪৭ বছর কেটে গেছে। হকিং থেমে থাকেননি, মারাও যাননি। নিজের মননকে আরো দৃঢ় করেছেন, আর আমাদেরও সেই সাথে আলোকিত করেছেন ‘আলোকেরই ঝর্ণাধারায়’। তার বেঁচে থাকাটাই তো এক অলৌকিক ব্যাপার বলে মনে হয় সাধারণ মানুষের কাছে। কিন্তু হকিং এর কাছে তার ব্যাখ্যা সম্ভবতঃ ভিন্ন, কারণ তিনি আস্থা রাখেন  অলৌকিকতায় নয়, বরং বিজ্ঞানের অগ্রগতি এবং সেই সাথে তার প্রবল ইচ্ছাশক্তির উপর। মোটর নিউরণ ডিজিজ  তার  দেহকাঠামোকে হুইল চেয়ারের চৌহদ্দিতে বন্দি করলেও বন্দি করতে পারেনি তার পরিশিলীত মননকে, পারেনি বন্দি করতে তার প্রসারিত চিন্তাচেতনাকে। এ ধরণের রোগে বেঁচে থাকা রোগীদের আমরা যেখানে প্রায়শঃই দেখি রাম নাম জপে কিংবা ‘আল্লা -বিল্লা’ করেই সময় পার করে দিতে, কিংবা নিয়োজিত থাকে মহান স্রষ্টার গুণকীর্তনে, সেখানে হকিং এর ব্যতিক্রমী মনন নিয়ত নিয়োজিত মহাবিশ্বের অন্তিম রহস্যগুলোর যৌক্তিক সমাধানে, আর মহাবিশ্বের  রহস্যের হকিং-সমাধানে স্রষ্টার আদপে কোন ভুমিকাই নেই!

   

চিত্রঃ স্টিফেন হকিং – দূরারোগ্য মোটর নিউরণ ডিজিজ  তার  দেহকাঠামোকে হুইল চেয়ারের চৌহদ্দিতে বন্দি করলেও বাক্সবন্দি করতে পারেনি তার চিন্তাশীল মননকে।
 

স্টিফেন হকিং তার বইয়ে বিজ্ঞানের এবং দর্শনের প্রান্তিক সমস্যাগুলো নিয়ে সাধারণ জনগনের জন্য আলোচনা করেছেন কোন ধরণের  গানিতিক সমীকরণ কিংবা ভাবগম্ভীর জটিলতায় না ঢুকেই।  ফলে বইটি হয়েছে গতিশীল কিন্তু  থেকেছে ভারমুক্ত।  আইনস্টাইন বিজ্ঞানের দূরূহ তত্ত্ব মানুষকে শেখানো নিয়ে বলতেন, ‘তুমি যা শিখেছ তা যদি তোমার দাদীকে বোঝাতে না পার, তাহলে তুমি আসলে কিছুই শেখোনি’[24]। আমার ধারণা, স্টিফেন হকিং – লিওনার্ড ম্লোডিনোর গ্র্যাণ্ড ডিজাইন পড়লে আইনস্টাইনের এই উক্তির তাৎপর্য খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করবেন পাঠকেরা।  

তথ্যসূত্র
[1] Sean Carroll, The ‘Why?’ Questions, Chapter and Multiverse, The Wall Streat Journal, Online: http://online.wsj.com/article/SB10001424052748704358904575477583868227458.html
[2] অস্তিত্বের রহস্য, ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ – স্টিফেন হকিং [অধ্যায় ১], অনুবাদ – তানভীরুল ইসলাম, মুক্তমনা, ১৪ আশ্বিন ১৪১৭ (সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১০)।
[3] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী (অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫) ; মূল বইয়ের সপ্তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
[4] আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, পূর্বোক্ত।
[5] E.P. Tryon, “Is the Universe a Vacuum Fluctuation?”, Nature 246 (1973): 396-97.
[6] উদাহরণ হিসেবে এখানে কিছু সাম্প্রতিক পেপারের উল্লেখ করা যেতে পারে  :
* David Atkatz and Heinz Pagels, “Origin Of The Universe as a Quantum Tunneling Event” Physical review D25 (1982): 2065-73;
* S.W. Hawking and I.G.Moss “Supercooled Phase Transitions in the Very Early Universe “, Physics letters B110 (1982):35-38;
* Alexander Vilenkin, “Creation of Universe from Nothing” Physics letters 117B (1982) 25-28,
* Alexander Vilenkin, “Quantum Origin of the Universe” Nuclear Physics B252 (1985) 141-152,
* Andre Linde, “Quantum creation of the inflationary Universe,” Letter Al Nuovo Cimento 39(1984): 401-405
* Victor Stenger, The Universe: The Ultimate Free Lunch,” European Journal of Physics 11 (1990) 236-243. ইত্যাদি।
[7] বিস্তারিত তথ্যের জন্য The Inflationary Universe: The Quest for a New Theory of Cosmic Origins, Alan H. Guth, Perseus Books Group (March 1, 1998) দেখুন।
[8] একই লেখা একটু পরিবর্তিত আকারে মাসিক সায়েন্স ওয়ার্ল্ডের ২০০৬ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় (বর্ষ ৫, সংখ্যা ৬০, ডিসেম্বর ২০০৬) ‘ইনফেশন থিওরি : স্ট্যান্ডার্ড বিগ ব্যাং মডেলের বিদায় কি তবে আসন্ন?’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।
[9] রায়হান আবীর, নির্ধর্মকথাঃ ইন দ্য বিগিনিং …, মুক্তমনা, https://blog.mukto-mona.com/?p=9693
[10] এ প্রসঙ্গে পড়া যেতে পারে অ্যালেন গুথের ‘The Inflationary Universe’ (Basic Books, 1998 ) কিংবা ভিক্টর স্টেঙ্গরের ‘God: The Failed Hypothesis (Prometheus Books, 2008)’,   কিংবা ইউটিউব থেকে দেখা যেতে পারে লরেন্স ক্রাউসের বিখ্যাত ‘A Universe From Nothing’ভিডিওটি (Lawrence Krauss, AAI 2009) ইত্যাদি।
[11] The Times on 2 September, 2010;
[12] Creation of a Bacterial Cell Controlled by a Chemically Synthesized Genome”. science magazine., Published Online May 20, 2010, Science DOI: 10.1126/science.1190719;
[13] অভিজিৎ, অবশেষে মানুষের ঈশ্বর হয়ে ওঠা : তৈরি হল প্রথম কৃত্রিম প্রাণ, মুক্তমনা, ৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৭ (২১ শে মে, ২০১০)
[14] ” Modern physics leaves no place for God in the creation of the Universe, Stephen Hawking has concluded. Just as Darwinism removed the need for a creator in the sphere of biology, Britain’s most eminent scientist argues that a new series of theories have rendered redundant the role of a creator for the Universe”; The Times newspaper on 2 September, 2010;
[15] “Science is increasingly answering questions that used to be the province of religion. The scientific account is complete. Theology is unnecessary.”, said Stephen hawking in Larry King Live, Theology unnecessary, Stephen Hawking tells CNN,
 
[16] অজয় রায়, বিজ্ঞান ও দর্শন : জড়ের সন্ধানে (সাইদুর রহমান ফাউণ্ডেশন বক্তৃতা), ১৯৯৩-৯৪
[17] বিধিসূত্র, ‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ – স্টিফেন হকিং [অধ্যায় ২], অনুবাদ – তানভীরুল ইসলাম, মুক্তমনা, ১৭ আশ্বিন ১৪১৭ (অক্টোবর ২, ২০১০)।
 
[18] এ প্রসঙ্গে মুক্তমনা থেকে পড়ুন, অপার্থিব, বিবর্তনের শিক্ষা, ৩০ মাঘ ১৪১৫ (ফেব্রুয়ারি ১২, ২০০৯)
[19] Libet, B., Gleason, C.A., Wright, E.W., Pearl, D.K. (1983). Time of conscious intention to act in relation to onset of cerebral activity (readiness-potential). The unconscious initiation of a freely voluntary act. Brain. 106 (3):623–642.
[20] সুসান ব্ল্যাকমোরের Consciousness: A Very Short Introduction নামের বইটিতে ‘ডু উই হ্যাভ ফ্রি উইল’ নামের অধ্যায়টিতে লিবার্টের পরীক্ষার বিস্তৃত বর্ণনা আছে। সুসান ব্ল্যাকমোর তার বইয়ে এ প্রসঙ্গে উপসংহার টেনেছেন এই বলে –
Even if, free will is, technically a illusion, it is very powerful illusion and so the feeling of being free carries on, even for the people who no longer believe is true!
 
[21] Soon, C.; Brass, M.; Heinze, H.; Haynes, J. (2008). “Unconscious determinants of free decisions in the human brain.”. Nature neuroscience 11 (5): 543–545.
[22] এ প্রসঙ্গে পড়ুন, First Observation of Hawking Radiation, Technology Review, kfc 09/27/2010 ইত্যাদি।
 
[23] প্রত্যক্ষ প্রমাণ ছাড়াও শুধু পরোক্ষ পরীক্ষণের ভিত্তিতে বহু তত্ত্বকে বিজ্ঞান গ্রহন করে নিয়েছে; বিজ্ঞানের ইতিহাস অন্ততঃ তাই বলে। আসলে পরমানুর অস্তিত্বও প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞান গ্রহণ করেছিল পরোক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতেই (কিছু রাসায়িনিক পদার্থের সংমিশ্রনের অনুপাত থেকে, আর পরবর্তীতে ব্রাউনীয় সঞ্চরণ থেকে); আবার প্রাথমিকভাবে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বও বিজ্ঞান স্বীকার করে নিয়েছিল পরোক্ষ পর্যবেক্ষণে, ‘চোখে দেখে’ নয়। এরকম উদাহরণ আছে বহু।বিগ ব্যাং থেকে শুরু করে বিবর্তন তত্ত্ব পর্যন্ত অনেক কিছুর প্রমাণের জন্য আমরা আজও পরোক্ষ প্রমাণেরই আশ্রয় নেই।
[24] You do not really understand something unless you can explain it to your grandmother. — Albert Einstein