উৎসর্গ: বন্যা আহমেদ
মার্কিন বিপ্লবের ইতিহাসে টমাস পেইনেরসাধারণ জ্ঞান” পুস্তিকাটির বড়সর ভূমিকা আছে। পুস্তিকার লক্ষ্য ছিল ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের অসারতা তুলে ধরে মার্কিন জনগণকে বিপ্লবে উৎসাহিত করা। এ লেখার মূল বিষয়বস্তু তাই রাজতন্ত্র, গণতন্ত্র নয়। কিন্তু লেখাটির প্রথম দিকে যেকোন ধরণের সরকারের প্রতি ধ্রুপদী উদারপন্থার গভীর সন্দেহ এবং এই সন্দেহজাত “সীমাবদ্ধ সরকার”-এর ধারণার একটি সংক্ষিপ্ত, কিন্তু স্পষ্ট বিবরণ পাওয়া যায়। এই অংশটুকু নিচে অনুবাদ করা হল।

সরকারের উদ্দেশ্য ও গঠন বিষয়ে
কিছু লেখক সমাজ ও সরকারকে এমনভাবে মিশিয়ে ফেলেন যে সন্দেহ জন্মাতে পারে যে এদুটোর মধ্যে পার্থক্য আদৌ নেই, বা থাকলেও খুব সামান্য। অথচ সমাজ আর সরকার আলাদা শুধু নয়, তাদের উৎস অব্দি আলাদা। সমাজের জন্ম প্রয়োজন থেকে, আর সরকারের জন্ম মানুষের চরিত্র-দৌর্বল্য থেকে। দুটিই মানুষের ক্রম-সমৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে, প্রথমটি ধনাত্মকভাবে — আমাদের সৎ প্রণোদনাকে একত্রিত করে; আর দ্বিতীয়টি ঋণাত্মকভাবে — মানুষের অনৈতিকতাকে নিয়ন্ত্রণে রেখে। প্রথমটি মিলিত করে, দ্বিতীয়টি বিভেদ-সূচক — সমাজ মায়ের মত, সরকার শাস্তিদাতা।

সমাজ, তার যেকোন রূপে, আশীর্বাদস্বরূপ; সরকার, এমনকি তার শ্রেষ্ঠতম প্রকাশেও, বিকট প্রয়োজন। শাসনযন্ত্র যখন কুৎসিৎ রূপ ধারণ করে, তখন তা হয়ে দাঁড়ায় অসহনীয় — কারণ সরকার যখন আমাদের ভোগায়, তখন সেই ভোগান্তিকে তীক্ষ্ণতর করে এই জ্ঞান যে এই ভোগান্তির অস্ত্র আমাদের নিজেদেরই তৈরি! আদম-হাওয়ার গায়ে জড়ানো পাতার পোষাক যেমন প্রমাণ দেয় তাদের হারানো নিষ্কলুষতার, সরকারও তেমনি কলুষতার প্রতীক; রাজার প্রাসাদের তলায় খুঁজলে পাওয়া যাবে স্বর্গের ধ্বংসাবশেষ। কারণ বিবেক যদি হত অপরাজিত, ঋজু, সর্বত্রমান্য — তাহলে আইনের দরকার হত না কোন; কিন্তু তা যখন নয়, তখন মানুষকে বাধ্য হয়ে তার সম্পদের একাংশ ছেড়ে দিতে হয় বাকিটা রক্ষার জন্য; এবং এটা সে করে দুটি সম্ভাব্য ক্ষতির মধ্যে ছোটটিকে বেছে নেয়ার সাধারণ আক্কেল থেকে। নিরাপত্তার ব্যবস্থা করাই তাই সরকারের প্রথম ও শেষ উদ্দেশ্য, আর যে সরকার-ব্যবস্থা সর্বোচ্চ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে পারবে সর্বনিম্ন ক্ষতির বিনিময়ে, সেই ব্যবস্থাই শ্রেষ্ঠ ,এই সিদ্ধান্ত অতএব স্বতঃসিদ্ধ।

সরকারের গঠন ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার জন্য ধরে নিই, অল্প কিছু লোক পৃথিবীর এক জনশূণ্য কোণে বাসা বাঁধল, অন্য কারো সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। এই প্রাকৃতিক স্বাধীনতার পরিবেশে তাদের প্রথম চিন্তা হবে সমাজ-গঠন। সমাজ কেন? অসংখ্য কারণে। একা মানুষের শক্তি তার প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য, অবিরাম একাকীত্ব মানব-প্রকৃতি-বিরোধী — তাই সে অচিরেই অন্যের সাহায্য ও সঙ্গ খুঁজে নেবে, বিনিময়ে নিজেও হবে অন্যের সঙ্গী ও সহকর্মী। চার-পাঁচজন মিললেই একটা চলনসই ঘর বানিয়ে ফেলতে পারবে তারা, কিন্তু একা লোক আপ্রাণ খেটেও হয়ত কিছুই গড়ে তুলতে পারবে না — গাছ কাটতে পারলে টেনে নিয়ে আসতে পারবে না, আনতে পারলে কেটে তক্তা বানাতে পারবেনা, তক্তা যদিবা জোটে বাড়ি খাড়া করতে পারবে না কিছুতেই — আর ইতিমধ্যে ক্ষুধাসহ শত প্রয়োজনের ধাক্কা তাকে বাধাগ্রস্ত করবে। অসুস্থতা, বা এমনকি সামান্য দুর্ভাগ্য পর্যন্ত মৃত্যুকে ডেকে অানতে পারে, কারণ এগুলি সরাসরি মৃত্যুর কারণ না হলেও কাজকর্ম অসম্ভব করে তুলবে, তারপর যা ঘটবে তা হবে জীবনের অবসান শুধু নয়, ধ্বংস।

অতএব প্রয়োজন, আবিষ্কারের সতত জননী, আমাদের নতুন অভিবাসীদের একত্রিত করবে একটি সামাজিক বন্ধনের মধ্যে, এবং যতক্ষণ অন্যায়ের স্পর্শমুক্ত থাকবে এই সমাজ ততদিন আইন ও সরকার হবে অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু নিষ্কলুষ ন্যায় যেহেতু স্বর্গেও দুষ্প্রাপ্য, তাই প্রথম দিকের মরণপণ সমস্যাগুলো যতই কেটে যেতে থাকবে, ততই দায়িত্বজ্ঞান ও ভ্রাতৃবোধে ঘাটতির লক্ষণ বাড়তে থাকবে, এবং নৈতিকতার এই অভাব পূরণ করার জন্য অবধারিত ভাবে কোন না কোন রকমের সরকার গঠনের প্রয়োজন অনুভূত হবে।

বড় একটা বটগাছ বেছে নিয়ে তার তলাতেই হয়ত তাদের ছোট্ট সংসদটি বসাতে পারবে এরা। খুব সম্ভব, তাদের প্রথম আইনগুলি হবে উপদেশ ধরণের, যা অমান্য করার শাস্তি হবে হয়ত স্রেফ মানুষের নিন্দা। এই প্রথম সংসদে তার প্রাকৃতিক অধিকার অনুযায়ী প্রতিটি মানুষের স্থান থাকবে।

কিন্তু কলোনিটি আস্তে আস্তে যত বাড়তে থাকবে, সমস্যাও ততই বাড়বে, মানুষ যতই দূরে দূরে থাকা শুরু করবে, ততই কঠিন হয়ে উঠবে সকলের পক্ষে সংসদের প্রতিটি অধিবেশনে যোগদান করা। আইন-প্রনয়নের কাজটা নির্বাচিত কিছু লোকের ব্যবস্থাপনায় ছেড়ে দেয়ার ধারণাটা তখন স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসবে। এই প্রতিনিধিদের দায়িত্ব হবে তাদের নির্বাচকদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করা, পুরো জনগোষ্টি উপস্থিত থাকলে তাদের আচরণ ও সিদ্ধান্ত যেমন হত, সংসদে এই প্রতিনিধিদের কাজকর্ম ঠিক তেমনটি হওয়া চাই। কলোনি আরো বাড়লে এই প্রতিনিধিদের সংখ্যা আরো বাড়ানোর প্রয়োজন পড়বে, হয়ত এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করা হতে পারে, যাতে প্রতিটি এলাকা থেকে আনুপাতিক হারে সংসদ-সদস্য থাকে। প্রতিনিধিদের স্বার্থ আর জনগণের স্বার্থ যাতে এক থাকে, সেই লক্ষ্যে নির্বাচন হতে হবে ঘন ঘন, ফলে প্রতিনিধিরা নিজেদের চামড়া বাঁচানোর তাগিদেই জনগণের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে। নিয়মিত নির্বাচন জনগণের বিভিন্ন অংশের মধ্যে আদান-প্রদানের মাধ্যমে সাধারণ উদ্দেশ্যের বিনির্মানেও সাহায্য করবে, তৈরি করবে পারস্পরিক সহযোগিতার একটি ভিত্তি, আর এই ভিত্তির উপরেই নির্ভরশীল সরকারের শক্তি, আর জনগণের সুখ (রাজার অর্থহীন অধিকারের উপর নয়)।

সরকারের উৎপত্তি ও বিকাশের এই তাহলে ইতিহাস — এটা মানুষের নৈতিকতা ও বিবেকের সীমাবদ্ধতা-জাত একটি সংগঠন। সরকারের উদ্দেশ্যও তাই সীমাবদ্ধ, এর উদ্দেশ্য শুধু নিরাপত্তা ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করা। যতই ছানি পড়ুক আমাদের চোখে, শত শত বছরের সংস্কার যতই আপত্তি তুলুক, বিভিন্ন ব্যক্তিগত স্বার্থ যতই বিভ্রান্ত করুক আমাদের, এই সিদ্ধান্তের সঠিকতা যুক্তি ও প্রকৃতির বিচারে তর্কাতীত।