আমি যেটা লিখতে যাচ্ছি-সেটাকে ব্লগ হিসাবে না দেখে আলোচনা হিসাবে দেখুক সবাই। আমি এখানে বারো জনকে নিয়ে আলোচনা করব, যাদের জীবন এবং দর্শন আমার চিন্তাকে সব থেকে বেশী প্রভাবিত করেছে। আমি চাইব, বাকীরাও লিখুক কিভাবে তারা প্রভাবিত হয়েছে। শুধু বারোজনের মধ্যেই চিন্তা ধারাকে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে, তারও কোন মানে নেই।

স্যার কার্ল পপারঃ সত্যি কথা হচ্ছে, স্যার পপারের লেখাগুলো পড়া এবং বোঝার আগে, দর্শন নিয়ে আমি পড়েইছি শুধু। বুঝেছি অল্প। স্যার পপারের বিজ্ঞানের দর্শন গভীরে জানার পর, দর্শনের দরজা প্রথম চওড়া হয়ে খুলে যায় আমার মনে। বিজ্ঞানের দর্শন বা ফলসিফিকেশনের পেছনে কাজ করে “ইনডাকশনিজমের” সীমাবদ্ধতা। যা ঢাকতে ফলসিফিকেশন দর্শনের জন্ম। শুধু এই শেষের দুটিবাক্য গভীরে বুঝলেই বাজারে চালু সব দর্শনকে অতি দ্রুত বোঝা সম্ভব। এবং সেই ফলসিফিকেশন ফিল্টার দিয়ে তাকালে বাম, ডান, মৌলবাদি, কমিনিউস্ট, প্রগতিশীল, ধার্মিক-সবার সীমাবদ্ধতা এবং গন্ডী একদম পরিষ্কার ভাবে প্রতিভাত। তাই আমার জীবনে দুটো অধ্যায়-প্রিপপারিয়ান, যেখানে পড়েইছি শুধু, বুঝেছি কম। এবং পোষ্ট পপারিয়ান-যেখানে প্রচলিত দর্শনগুলি জলভাতের মতন সোজা হয়ে গেছে।

মোহন দাস গান্ধীঃ গান্ধীর সাথে পরিচিতি অতুল্য ঘোষের গান্ধীর জীবনী দিয়ে। খুব ছোট বেলায়। তখন খুব প্রভাবিত হয়েছিলাম তা না। কারন অধিকাংশ বামপন্থী পরিবারেই একটা গান্ধীবিরোধি এন্টাগনিজম কাজ করে। গান্ধীবিরোধিতা অনেক বাম-বাঙালী বালখিল্যতার অন্যতম আরেকটি। কোন সন্দেহ নেই গান্ধী চূড়ান্ত ভাববাদি-কিন্ত নিজের জীবনে গান্ধীবাদ অভ্যেস না করলে গান্ধীকে বোঝা মুশকিল। শত্রুকে হিংসা করা খুব কঠিন কাজ কি? শত্রুকে ভালবাসতে কজন পারে? গান্ধীর ধারাপাত পড়ে বা বলে কিছু হয় না। নিজের জীবন দিয়ে, নিজের জীবনে প্রয়োগ করে বুঝতে হয়। তবেই বোঝা যায়, শত্রুকে জয় করার কত সহজ পথ গান্ধী দিয়ে গেছেন। গোটা পৃথিবীতে যখনই কোন বিদেশীর সাথে দেখা হয়, তারাও গান্ধীকে নিয়ে উদ্বেলিত। হয়ত আমরা সবাই আশাবাদি। তাই সারভাইভাল স্ট্রাটেজিতে আলটুইজম প্রাণী জগতে আখছার দেখা গেলেও, যুদ্ধ বিদ্ধস্ত মানব সমাজের সামনে, গান্ধী চিরকাল পথ দেখাবেন।

লালন ফকিরঃ আউল, বাউলের দেশ এই বাংলা। বাউল সঙ্গীত ছোট বেলায় যে বুঝতাম- তা না। বাউল দর্শন ও না। সোরেন কিয়ার্ডগার্ডের অস্তিত্ববাদ পড়ার পর এবং নানান অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারি, আসলে মানুষের ওপর কোন দর্শন নেই। মানুষ হচ্ছে সব দর্শনের সিঙ্গুলার পয়েন্ট। কমিনিউজম, ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদের পতন এবং পচনের একটাই কারন- এরা বোঝে না-এ সব কিছুই মানুষের জন্যে। তাই মানবতাকে দমন করে, মানবতার শবের ওপর যখন কমিনিউজম, ইসলাম বা হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে, তার থেকে মৃতদেহের পচা গন্ধ বেড়োয়। মানুষ যে সব দর্শনের সিঙ্গুলার পয়েন্ট-এটাই বাউল কথা। এই অন্তর্মুখী দর্শনই পারে আমাদের এই সব ভুলভাল কমিনিউজম, হিন্দুত্ববাদ, ইসলাম থেকে মুক্তি দিতে।

কার্ল মার্ক্সঃ এটা আমার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যে মার্ক্সবাদ বুঝেছি পপার পড়ার পর। তাই লেনিনবাদি মুর্খদের কবলে পড়তে হয় নি। সমাজ বিবর্তনের যে রূপরেখা মার্ক্স দিয়েছিলেন, সেটাকে আমি সঠিক বলেই মনে করি। কিন্ত লেনিনবাদিরা তার যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেটা ভুল। মার্ক্সবাদে কোন বিপ্লব নেই-সবটাই সামাজিক বিবর্তনের সায়েন্স ফিকশন। মার্ক্স যেভাবে ধনতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র এবং তার থেকে কমিনিউজম আসবে বলে হিস্টরিসিজম করেছিলেন, সেটাকে আমি ঠিক বলেই মনে করি। স্যার পপার এই ধরনের হিস্টরিসিজমকে অবাস্তব বলেছেন। সেটাও ঠিক হতেই পারে-কারন কমপ্লেক্স সিস্টেমে ডেটারমিনিজম না থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্ত তবুও মানুষের নির্মান শুধু বিজ্ঞানভিত্তিক না। কিছু বিশ্বাস, তা ক্ষীণ হলেও থাকতেই পারে। সমাজতন্ত্রের পতনের ফলে অনেকেই মার্ক্সবাদ সঠিক কি না, তাই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন-কিন্ত বাস্তবত এটাই যে পৃথিবীতে যেসব সমাজতান্ত্রিক দেশগুলি প্রতিষ্ঠা হয়েছে-সেগুলোতো আসলেই ফ্যাসিস্ট ন্যাতসি রাষ্ট্র। মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্যে আন্তর্জাতিকতা বাধ্যতামূলক। আরো একটা ব্যাপার লেনিনবাদিরা সম্পূর্ন গুলিয়েছে। সেটা হচ্ছে মার্ক্স খুব পরিস্কার ভাবে লিখে গিয়েছিলেন, উৎপাদন ব্যাবস্থার উন্নতি বা উন্নত উৎপাদন ব্যাবস্থায় ধনতন্ত্রের মাধ্যমে না পৌঁছালে, সমাজতন্ত্রের আগমন সম্ভব না। এখন কতটা উন্নতি বা কি ধরনের উন্নতি দরকার বা ধনতন্ত্রের কি ধরনের সংকট দরকার, যা সমাজতান্ত্রিক বিবর্তন সূচিত করবে, সেই ব্যাপারে তার বক্তব্য বা তত্ত্ব ভুল ছিল। ধনতন্ত্র সমস্ত সংকট কাটিয়েছে উন্নত আবিস্কারের মাধ্যমে। এখন আস্তে আস্তে সেই আবিস্কার করাটাও একটা বিশাল জটিল পদ্ধতি হয়ে যাচ্ছে। আগে দু একজন মিলে আবিস্কার করতে পারত-এখন আস্ত কয়েক বিলিয়ান ডলারের কোম্পানী গুলোও আবিস্কার করতে পারছে না-কারন প্রযুক্তি আরো জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। অর্থাৎ আবিস্কার করার ক্ষমতা ধনতন্ত্র হারাচ্ছে। আমার মতে এটাই আসল সংকট। মন্দা সাময়িক-একটা সার্কলে আসে যায়। কিন্ত আবিস্কারের পদ্ধতি বন্ধ হয়ে গেলে ধনতান্ত্রিক ব্যাবস্থা মুখ ধুবরে পড়বে। এবং আস্তে আস্তে সেই দিকেই আমরা এগোচ্ছি, যা সমাজতন্ত্রের সহজাত বিবর্তন ত্বরান্বিত করবে। কোন বিপ্লবী তত্ত্ব না -এই গণতান্ত্রিক ক্রমবিবর্তনই মার্ক্সবাদ! বাকীটা বিকৃতি!

ফ্রেডরিক নিৎসেঃ যদি আমাদের জীবনের সমস্ত অতীত সিদ্ধান্তকে বিশ্লেষন করি কি দেখব? প্রতিটা সিদ্ধান্তের পেছনে “ভয়” এর দীর্ঘ করাল ছায়া। কতকিছুর ভয়! সামাজিক মর্যাদা, ক্ষমতা হারানোর ভয়, অর্থনাশের ভয়, চাকরি হারানো অনিশ্চিত জীবনের ভয়- ভয়ের সুদীর্ঘ লিস্টের সমষ্টি আমরা। শুধু ধর্মভীরুদের দোষ দিয়ে কি হবে? ঈশ্বরকে ভয় না করলে কি হবে, বাকী হাজার হাজার জিনিস হারানোর ভয় আমার মতন নাস্তিকদের। আমি লেখক না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার কেন? ইঞ্জিনিয়ারিং এর থেকে লিখতে আমার একশোগুন ভাল লাগে। তবুও আমি লেখক নই, ইঞ্জিনিয়ার। কারন দারিদ্র্যের ভয়। তাই নিৎসে বলছেন, প্রতিটা মানুষ তার নিজের কাছে একটা বিরাট “এমব্যারাসমেন্ট”। ভয়ের চোটে মানুষ বাধ্য হয় নানান কম্প্রোমাইজ করে-যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেকে অপমান করা। এটা প্রতিটি মানুষের জীবনে একটা সাশ্বত সত্য। নিৎসের নিহিলিস্ট দর্শন বা মরালিটির ভক্ত আমি না। কিন্ত ভয়কে জয় করতে পারলে, আরো উন্নত মানুষ হওয়া সম্ভব। ভয় আমার সিদ্ধান্তকে কতটা প্রভাবিত করছে-এটা বুঝতে নিৎসে ছারা উপায় নেই।

মেঘনাদ সাহাঃ বিজ্ঞানী হয়ে সমাজের জন্যে কি করা উচিত? এই ব্যাপারে নানা মুনির নানা মত। থাকতেই পারে। তবে বিজ্ঞানীকুলে এই ব্যাপারে মেঘনাদ সাহা আমার প্রথম পছন্দ। বাল্যের সুকঠিন দারিদ্রই তাকে বাধ্য করেছিল সমাজ সচেতন হতে। তার নাম নোবেল প্রাইজের জন্যে ৬ বার বিবেচিত হয়েছে-স্যার রমনের আগেই তার নাম দুবার নোবেলের জন্যে উঠেছে। উনি নোবেল প্রাইজ পান নি। তাতে কি? ভারত যাতে বিজ্ঞানযজ্ঞে পিছিয়ে না পড়ে তার জন্যে নিজে হাওড়ার ওয়ার্কশপ থেকে এশিয়ার প্রথম সাইক্লোট্রন বানিয়েছেন। যেখানেই ছিলেন, নিজেই ছুতোরের কাজ করে যন্ত্র বানাতেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর, ভারতের নদীপরিকল্পনাও তার কীর্তি। ধর্মের বিরুদ্ধে ছিলেন আকুতোভয়। উনার লেখা বাংলা বই ছোট বেলায় পড়েছি। ত্রিকোনিমিতি উনার বই পড়ে শেখা-এবং সেটাও অদ্ভুত ছিল। এমন সমাজ সচেতন বিজ্ঞানী বিরল।

এন্টন চেকভঃ চেকভের ছোট গল্প প্রিয় বলে, চেকভকে এই লিস্টে রাখি নি। আর কোন সাহিত্যিকের সাথে আমার নাড়ির যোগ এত তীব্র না। যে শ্লেষ এবং মাইক্রোস্কোপ দিয়ে চেকভ আমাদের খুঁটিনাটি দেখেছেন-প্রতিটা সম্পর্কই আমার কত চেনা।
আমার চেনা জানা পৃথিবী, বাস্তবতা একটা পেঁয়াজের মতন। যত ছাড়াবে, তত ঝাঁজ। প্রতিদিনের সম্পর্ক কত সার্বজনীন, কত অসাধরন সুন্দর হতে পারে, সেই ছোট ছোট অনুভুতির মণিমুক্তগুলো চেকভ থেকেই কুড়িয়েছি।

রবীন্দ্রনাথঃ রবীন্দ্রনাথ কেন? অনেক বাঙালী আমার লিস্টে ১-১০ সবকটাতেই রবীন্দ্রনাথ বসাতে পারলে খুশী হবেন। আমি অবশ্য সেই কারনে রবীন্দ্র প্রভাবিত না। রাশেলের মতন আমিও রবীন্দ্রদর্শনে নতুন কিছু পাই নি। সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ মহৎ-কিন্ত অমন সাহিত্যিক বাংলায় না আসলেও বিশ্বে অনেকেই আছেন। আমি রবীন্দ্রপ্রেমী শুধু দুটো কারনে- গান আর তার ভাষাকৌশল। গান নিয়ে কিছু বলার নেই। আমার কাছে রবীন্দ্র সংগীত ভাষা, সুর এবং ছন্দে বিশ্বশ্রেষ্ঠ। সেটা অবশ্য আমার অভিমত। তবে রবীন্দ্রনাথের ভাষা নিয়ে আমার বলার আছে অনেক কিছু। ভাষার শৈল্পিক প্রয়োগ সব সাহিত্যকর্মীর প্রাথমিক কর্ম হতে পারে-তবে রবীন্দ্রনাথের হাতে তা যে পর্যায়ে উন্নিত হয়েছে-সেখান থেকে ভাবপ্রকাশের সময় একটা বিশ্বাস মনে সব সময় কাজ করে। ভাষাই আসল ভাবব্রহ্ম!

গৌতম বুদ্ধঃ আমার পিএইচডি থিসিস গৌতম বুদ্ধকে সমর্পিত। জীবনে ওঠা নামা থাকে। পাওয়া না পাওয়ার অসংখ্য বেদনার বলয়ের বৃত্তে আমাদের কিৎ কিৎ খেলা। আমার জীবনে আনন্দ এবং দুঃখ দুটোই কম। প্রথম কারন, প্রত্যাশা নেই। দ্বিতীয় কারন জেন দর্শন। সব কিছুরই দুটোদিক দেখতে পাই। জীবনের ব্যালান্স শিটে নিট লাভ বা নিট লোকসান বলে কিছু নেই। কিছু পেলে, কিছু হারাতে হয়। আমি আমেরিকাতে বসে “উন্নত” জীবনে উনুনের শিক কাবাব হচ্ছি না শিক কাবাব খাচ্ছি-সবটাই জীবনের দিকে কিভাবে তাকাচ্ছি, তার ওপর নির্ভরশীল। যদি ভাবি ভাল ভাল খাচ্ছি, ঘুরছি-তাহলে লাভে আছি। আবার যখন দেখি চারিদিকে শুধুই “আমি”-ছোটবেলার মাঠ, নদী, বন্ধু, তুতো আত্মীয়রা হারিয়ে গেছে-“আমি” নামে এক তালগাছ তেপান্তরের মাঠে এক পায়ে দাঁড়িয়ে-তখন কিছুটা বেদনা হয় । হারানোর চাপ। এই উভচর পৃথিবীকে বুঝতে জেন দর্শনই শ্রেষ্ঠ।

জালালুদ্দিন রুমিঃ লালন ফকিরের পূর্বসূরী রুমি। মানবতার দর্শনের শ্রেষ্ঠ প্রচারক কে জানতে চাইলে, আমি একবাক্যে রুমিকেই বেছে নেব। প্রেমিকের কোন ধর্ম নেই-প্রেমই তার একমাত্র ধর্ম অথবা, আমি পূবের না, পশ্চিমের না, ইসলামের না, খ্রীষ্ঠের না— জাতি ধর্ম ভুলে যে মানব ধর্মের সাধনার ডাক, তার পথিকৃত তিনিই। পরবর্ত্তীকালে শ্রী চৈতন্য, রামকৃষ্ণ, ররীন্দ্রনাথ বা লালনের মধ্যেও রুমির বাণীই আমরা একাধিবার শুনবো। জাতিশুন্য, ধর্মীয় পরিচয়শুন্য যে ভবিষ্যতের পৃথিবীর স্বপ্ন আমি দেখি, রুমি সেই স্বপ্নের প্রথম এবং প্রধান কান্ডারী।

স্বামী বিবেকানন্দঃ ক্লাস সেভেনে বিবেকানন্দ রচনাবলীর সাথে আমার পরিচয়। প্রাচ্যের দর্শন জানতে হলে বিবেকানন্দ রচনাবলীর বিকল্প নেই। কিন্ত প্রশ্ন উঠবে প্রাচ্য দর্শন কেন? সম্প্রতি স্টিফেন হকিংস বলেছেন, দর্শনের মৃত্যু হয়েছে-বিজ্ঞান তার স্থলাভিষিক্ত। কথাটি যতটা সত্য, ততটাই ভুল। সত্য এই জন্যে যে জ্ঞানের প্রতিটি আনাচে কোনাচে বিজ্ঞান যেভাবে হানা দিয়েছে, তাতে জ্ঞান ভিত্তিক যেকোন এম্পিরিক্যাল দর্শনের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়েছে। কিন্ত পরিপূর্ন জ্ঞান বা বিজ্ঞানের সাহায্যেও কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না। এমন একটি প্রশ্ন -জীবনের উদ্দেশ্য কি ? বিন্দু হতে এই মহাবিশ্বের উৎপত্তি, আবার বিন্দুতেই মহাবিশ্বের মৃত্যু হবে। এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য যে এই সভ্যতা, মহাবিশ্বের মৃত্যু হবেই। এর মধ্যে খানে আমরা যাই কিছু করি না কেন-কিছু যায় আসে না। সবার পরিণতি সেই বিন্দুতেই শেষ। তাহলে কোন জীবন দর্শন ঠিক-কোনটা বেঠিক আমরা কি করে বলবো? সেই উত্তর বিজ্ঞান দিতে পারে না। এখান থেকেই দর্শনের শুরু। ইসলাম বা একেশ্বরবাদি ধর্ম গুলো আমি এই জন্যেই পছন্দ করি না-এদের অজ্ঞতা এদের বুঝতে দিচ্ছে না, কোন জীবন দর্শন ঠিক , আর কোনটা বেঠিক, এটা বইভিত্তিক, বা জ্ঞান ভিত্তিক হতে পারে না। ভারতীয় দর্শন এটাই শিক্ষা দিয়েছে, জীবন দর্শন আত্মোপলদ্ধি বা রিয়ালাইজেশন থেকে আসে। নিজের প্রতি ডিসিপ্লিনড অনুসন্ধানই, জীবন দর্শনের জন্ম দেয়। এবং সেই জন্যে প্রত্যেকের আলাদা জীবনদর্শন থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই আমরা বলি যতমত, তত পথ। নিজের জীবনদর্শন খোঁজার এই স্বাধীনতা শুধু ভারতীয় দর্শনেই দেয়। প্রতিটা একেশ্বরবাদি ধর্মের কি করিতে হইবে টাইপের জীবনদর্শন, আদিমকালের ছেলেমানুষ দর্শন এবং সমাজে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়। তবে ভারতীয় দর্শনেও কি করিতে হইবে টাইপের ঢাউস বই আছে-সেগুলো একেশ্বরবাদি ধর্মগুলোর মতন বিপজ্জ্বনক। ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানকে “ইসলামাইজেশন অব হিন্দুজিম” বলে ভাবা যেতে পারে। ভারতীয় দর্শনের সাধনায় রুলবুকের স্থান নেই-তা স্থান কাল নিরেপেক্ষ আত্মোপলদ্ধির জগৎ।

ভ্লাদিমির লেনিনঃ আমি ঘোর লেনিন বিরোধি। ১৯১৮-১৯২১ পর্যন্ত লাল সন্ত্রাসের মাধ্যমে লেনিন যত কৃষক শ্রমিক এবং রাজনৈতিক কর্মী খুন করেছেন, তার প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা থাকাও অসম্ভব। তার লেখাও আহামরি কিছু না-পান্ডিত্যের বদলে নির্বুদ্ধিতা এবং ওপর চালাকি আমার বেশী চোখে পড়ে। কিন্ত তবুও সমাজ বদলের জন্যে রাজনৈতিক সংগঠন করতে গেলে, লেনিনের জীবন এবং কর্মের দিকে বারবার তাকাতে হবে। ১৯১৭ সালের এপ্রিল মাসে বলশেভিক পার্টি যখন সম্পূর্ন ধ্বংশ, তখন শুধু মাত্র জনরোষকে কাজে লাগিয়ে মাত্র ছমাসের মধ্যে রাশিয়া দখল করে নিলেন। তার সাথে কিছুই ছিল না। শুন্য থেকেই ম্যাজিক দেখিয়েছিলেন। কি করে সম্ভব হল? একটা ছোট ঘটনা। তখন বলশেভিক মুখপত্র প্রাভদাতে প্রবন্ধ বেশী ছাপা হত না।শ্রমিকরা নিজেদের দুর্দশার কথা চিঠি লিখে জানাত। এক অর্থে সেটাই পৃথিবীর প্রথম স্যোশাল মিডিয়া।
আজকের ভারতে মিডিয়ার এত চাকচিক্য-অথচ অসংগঠিত ক্ষেত্রের প্রান্ত্রিক শ্রমিক কৃষকদের অবরুদ্ধ কথাকে জন সমকক্ষে আনার জন্যে কোন মিডিয়া নেই। লেনিন যেটা ১৯১৭ সালে পেরেছিলেন, আমাদের দেশ তা আজও পারে নি। রাজনৈতিক নেতৃত্বে সফল হতে গেলে লেনিনের জীবনকে ভালভাবে জানা জরুরী।

মিখাইল বাকুনীনঃ ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের অমানবিক দিক গুলো দেখলে প্রথমেই যার কথা মনে পড়ে তিনি বাকুনীন। স্টালিন এবং ধনতন্ত্রের অত্যাচারের একটাই যোগসূত্র। সেটা ক্ষমতা। স্টালিন তখন ও জন্মান নি-কিন্ত বাকুনীন বলে গিয়েছিলেন কোন মহান বিপ্লবী যদি অত্যাচারী জ়ারের সিংহাসনে বসে, সে এক বছরের মধ্যে জারের চেয়েও শতগুন অত্যচারী হবে।স্টালিন তার বিশুদ্ধ প্রমান। জারের আমলে স্টালিন রাজনৈতিক কর্মের জন্যে তিনবার সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হন। একবার গৃহকত্রীর পেট করে দিয়ে আসেন। পরের বার এক ত্রয়োদশী কন্যাকে বিয়ে করেন। আর স্টালিনের আমলে, বলশেভিক বিপ্লবের অন্যতম উজ্জ্বল নেতাদের সবাইকে খুন করা হয়েছে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরোধিতার কারনে। শুধু স্টালিন কেন, বাকুনীনের বক্তব্য ছিল অর্থ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা মানুষের মন এবং হৃদয়কে বিকৃত করে। ধনতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের পচনের কারন এই ক্ষমতা-তার উৎস অর্থ বা রাজনীতি যাই হোক না কেন। পশ্চিম বঙ্গের মানুষ বাকুনীনকে চেনে না। তারা দেখেছে খালি পায়ে হাঁটা সত্তর দশকের কমরেডরা আজ গাড়ি হাঁকিয়ে ঘোরে। ঠিকাদারিতে আঘাত করলে মানুষ খুন করে। বাকুনীনের কথা জানলে, তারা বুঝত, এটা বাকুনীন অনেক দিন আগেই বলে গিয়েছিলেন। সুতরাং ক্ষমতার প্রকৃত বিকেন্দ্রীকরন ছারা যে কোন সিস্টেমই অমানবিক বা অত্যচারী হতে বাধ্য।

চে গুয়েভেরাঃ চে কে কি আমি কমিনিউস্ট বলবো? আমি নিজে ১০০% কমিনিউস্ট বিরোধি। তবুও কেন চে? কারন সাধারন এবং অত্যচারিত মানুষের প্রতি “আজন্ম” এবং অকৃত্রিম ভালবাসাতে চে অদ্বিতীয়। গান্ধীও ক্ষমতার প্রতি লালায়িত ছিলেন-চে ছিলেন না। চে কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল-এক জন আদর্শ বিপ্লবী কে? চে জানিয়েছিলেন, যে মানুষকে ভালবাসতে পারে। চে বলেন নি পার্টির প্রতি আনুগত্যের কথা। বলেন নি নন্দীগ্রামে যখন মানুষকে খুন বা ধর্ষন করছে ভারতীয় কমিনিউস্ট পার্টির লোকেরা, শুধু সেই পার্টির লোক বলে, আনুগত্যের কারনে, সেই অমানবিক ঘটনা সমর্থন করতে হবে। মানুষের প্রতি ভালোবাসাই একজন বিপ্লবীর প্রথম এবং প্রধান পরিচয়। অনেকেই হয়ত সেটা বলে। তারপর লেনিন, স্টালিন, মাওদের মতন অত্যচারী শাসকে পরিণত হয়। চে কিন্ত কিউবার ক্ষমতার ক্ষীর খেলেন না। আফ্রিকাতে গেলেন বিপ্লব করতে। সেখান থেকে বলিভিয়াতে। সোভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন যখন কাস্ত্রো সোভিয়েত প্রভুদের বুট চাটতে ব্যাস্ত ছিলেন। এমন অকৃত্রিম মানব প্রেমিক বিশ্বইতিহাসে বিরল।

আমি বাকীদের ও অনুরোধ করব, তারাও তাদের জীবনের অনুপ্রেরণাদের নিয়ে লিখুন। আমরা তাদের দেখেও অণুপ্রাণিত হই।