২০১০ সালের জুন মাসে রাজধানীর আদাবরে শিশু সামিউল আজিম হত্যাকান্ডে তার মা আয়েশা হুমায়রা এশা এবং এ বছরই আগষ্টে খিলগাঁওয়ের সিপাহীবাগে শিশুকন্যা জেনিফার ইসলাম তানহা হত্যার সাথে তার মা হালিমা ইয়াসমিন তমার সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ দুজনকেই গ্রেফতার করেছে।এবং পরকীয়া প্রেম এ দুটো ঘটনার জন্য দায়ী বলে খবরে প্রকাশ।
উপরোক্ত দুটো খবরই বিভিন্ন দৈনিকের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়েছে এবং বেশ কয়েকদিন ধারাবাহিকভাবে ফলো- আপ খবরও বড় করে ছাপানো হয়েছে।
পাশাপাশি প্রায়শঃই বাবার হাতে শিশু সন্তান খুনের খবরও প্রকাশিত হয়, তবে তা বিভিন্ন দৈনিকের ভেতরের পাতায় এবং অনেক সময় বাবা বাধ্য হয়ে এমন কাজ করেছে বলে খবরটিতে ইঙ্গিত থাকে। যেমন, ৩ নভেম্বর,১০ এর কালের কন্ঠ পত্রিকার ২০ নং পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের কালামপুর গ্রামে অভাবী এক বাবার হাতে ১১ মাসের শিশুপুত্র খুন হয়েছে। পুলিশ ওই খুনের দায়ে বাবা তৌহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার ও শিশুপুত্র রিয়াজের খন্ড-বিখন্ড লাশ উদ্ধার করেছে। এখানে অভাবী বিশেষণটি উল্লেখ করার মত এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে খবরটিতে বিশেষণটির ব্যবহার সাংবাদিক ও সম্পাদক সচেতনভাবেই করেছেন।
যেমন করেন নারীদের বেলায় পরকীয়া শব্দটির ব্যবহার।
১৭ নভেম্বর,১০ তারিখের পত্রিকার খবর অনুযায়ী, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে এক পাষন্ড পিতা নিজ হাতে খুন করেছে ৯ মাসের নিস্পাপ যমজ দুই সন্তান শীমু ও সীমান্তকে। পারিবারিক কলহের জের ধরে খুনের পর লাশ পানিতে ফেলে দেয় ঘাতক পিতা। ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৫ নভেম্বর,১০ মধ্যরাতে সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ কদমতলী এলাকায়। পুলিশ ঘাতক পিতা কাশেমকে গ্রেফতার করেছে।
এখানে পিতাকে ঘাতক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তার পিতার চেয়েও ঘাতক পরিচয়টিই বেশী প্রাধান্য পেয়েছে।
বাবাদের কর্তৃক সন্তান হুত্যার এমন বহু ঘটনা আমি দৈনিক সংবাদের ভিতরের পাতায় পড়ি, কিন্তু এ নিয়ে আলোড়ন দেখি না। শুনি না। সাধারণত ফলো-আপ খবরও করে না।
সামিউল ও তানহার হত্যাকান্ড নিয়ে দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় খবর প্রকাশিত হয়েছিল বলে ঐ দুটো খবরই ছিল ঐ সময়ে ‘টক অব দি টাউন’ পরকীয়া প্রেম গোপন করতে প্রেমিকের সাথে যোগসাজুসে সন্তানকে মেরে ফেলেছে মা।
এ নিয়ে আলোড়ন ছিল বিভিন্ন ঘরোয়া আড্ডায়, সামাজিক অনুষ্ঠানে,অফিসে, আদালতে, থানায়, হাসপাতালে, ভ্রমণে। আর বাবা নামের ব্যক্তিরা অহরহই সন্তানসহ স্ত্রীদের মারছে। এ নিয়ে এমন কোন হৈচৈ নেই। সমাজ ধরেই নিয়েছে মা মানেই অতিমানবিক কোন সত্ত্বা। মা মানেই সব লোভ লালসার উর্ধ্বে এক দেবী চরিত্র। আসলে মা বাবা মানেই সন্তানের প্রতি অপত্যস্নেহ — শুধু মা নয়। এ সত্যটি সাধারণ মানুষ থেকে সাংবাদিকরা পর্যন্ত ভুলে যায়।ব্যতিক্রমী বাবা পাওয়া যায় মিলিয়নে দুয়েকটি আর ব্যতিক্রমী মা পাওয়া যায় বিলিয়নে দুয়েকটি। তারা শরীরে মানুষ হলেও মনে অন্য কোন সত্ত্বা।
এ বিষয়ে পরিবারে, অফিসে, সামাজিক অনুষ্ঠানে, প্রচার মাধ্যমে কোথাও শিশু হত্যাকারী নারীটিকে অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করার আগে তার মা পরিচয়কে প্রাধান্য দিয়েছে। বলা হয়েছে– মা হিসেবে এটা কি করে করল? ফলোআপ প্রতিবেদনেও মা হিসেবে নারীর চরিত্র হনন। আমার প্রশ্ন নারী অপরাধীর নয় কেন?
বাবা মারলেও খুনী মা মারলে সে ও খুনী। বাবা মারে নিজ হাতে। আর মায়ের বেলায় মারে যৌথভাবে অর্থাৎ মায়ের যোগসাজুসে সন্তান মায়ের প্রেমিকের হাতে বা পরকীয়া প্রেমের বলি। মূলত মায়ের প্রেমিক পুরুষটিই জড়িত থাকে এবং হত্যায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
উপরন্তু সামিউল ও তানহাকে কে মেরেছে তা যখন প্রমানিত নয়, তখন প্রচার মাধ্যমে নারীকে মা হিসেবী উপস্থাপন করে ফায়দা লুটা এবং পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর মানসিকতা বর্জন করা উচিত।
নারী মাত্রই তাকে মা ও স্ত্রী বানানোর একটা চেষ্টা সমাজের সব সময়ই আছে।
বোধে, ভাবনায়, ভ্রমণে,বাড়িতে এক সুর —–
কুসন্তান অনেক হয় মা
কুমাতা নয় কখনও তো।
ভক্ত রাম প্রসাদ কালিকে না পেয়ে তার গানের মধ্যে উপরোক্ত আক্ষেপ। এ গানটির লাইনও অনেকে উদাহরণ হিসেবে শুনিয়েছে এবং দেবী কালির রণ রঙ্গিনী মূর্তির রেফারেন্সও দিয়েছেন নেতিবাচকভাবে।
মা কিভাবে সন্তান হত্যার সাথে জড়িত হল? ওরা মা নামের কলঙ্ক। ছিঃ নারীরা সব পারে। নারীরা ছলনাময়ী। কীভাবে সন্তানকে পরকিয়া প্রেমের বলি করল ? এমন স্টেরিওটাইপ কথাবার্তা। নারীকে এর ভেতরে ভরে একটা গতানুগতিক ফ্রেমে বাঁধাই করার নমুনা। বড্ড চকচকে সে ফ্রেম। কাঁচটাও তথাকথিত সামাজিক লেন্সে বেশ স্বচ্ছ।
নারী মা হলেও অপরাধী হতেই পারে। বহু বাবার সন্তানসহ স্ত্রীকে হত্যার ঘটনা পত্রিকার পাতায় অহরহই প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে এত ঘৃণা, এত ধিক্কার শুনি না। তানহার মা হালিমা আর সামিউলের মা আয়েশা অপরাধী। অন্যান্য পুরুষরাও অপরাধী হয়। সে সব অপরাধীদের পুরুষ পরিচয় মোটেই উল্লেখ্য নয়। কারাগারে নারীর চেয়ে পুরুষ বেশি হলেও কেউ পুরুষমাত্রই অপরাধী ভাবে না। হালিমা আর আয়েশা (অভিযোগ প্রমানিত হলে) আইন ও সমাজের চোখে অপরাধী হবে। তাদের জন্য মা নামের দোহাই দিয়ে সমস্ত নারী জাতিকে হেয় করার একটা প্রবণতা প্রতীয়মান —- যা কোনভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
অভিযুক্তকে — অপরাধীকে মা বানানোর চেষ্টা যার পরিপ্রেক্ষিতে নারী সমাজকেই দোষারোপ করার সুযোগ সৃষ্টি করা। ব্যক্তি অপরাধীকে গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া।
এ দোষ ও দায় চাপানো থেকে নারীকে অব্যহতি দেওয়া হোক। আমি এর তীব্র নিন্দা করছি।
আপনার লেখা খুব ভালো লাগলো…………।।
পুরুষ তান্ত্রিক এ সমাজ ব্যাবস্থায়,পুরুষেরা সবসময় যেন মুখিয়ে থাকে নারীকে হেয় করতে…তাই যে কেনো ক্ষেত্রে তাদের কাছে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে নারী পরিচয় বড় হয়ে উঠে………….
@রনি,
বিষয়টি অনুধাবনের জন্য ধন্যবাদ।
@ গীতা দি, বিষয়টি আলোকপাত করার জন্য ধন্যবাদ।
অনেক সময়ই আদালত কর্তৃক অপরাধী ঘোষিত হওয়ার আগেই সাংবাদিকরা সংবাদ লেখার সময় সরাসরি সন্দেহভাজন আসামীকে ‘খুনি’ বা ‘সন্ত্রাসী’ বলে নিজেই রায় দিয়ে ফেলেন। এ রকম ‘মিডিয়া ট্রায়াল’ ছাড়াও গণমাধ্যমে যেহেতু ‘পরকীয়ার বলি শিশু অমুক’ — জাতীয় সংবাদ খুবই মুখরোচক, তাই ঘটনা তা না হলেও অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো সাংবাদিক মহাশয় শেষ পর্যন্ত সম্পত্তির নিয়ে বা পারিবারিক কলহের জের ধরে খুন হওয়া কোনো শিশুকেও পরকীয়ার বেদীতে বলি দেন। …
এছাড়া একই কারণে গৃহবধূ হত্যা বা আত্নহত্যার নেপথ্যেও অতি উৎসাহী সাংবাদিক অহেতুক ‘পরকীয়া’ খুঁজে বেড়ান।
এখনো মনে করতে পারি, নয়ের দশকের শুরুতে মুনির-খুকু প্রেম কাহিনী কি রগরগে সংবাদই আকারেই না পরিবেশিত হয়েছে! সে সময় অবলীলায় ধর্ষিতার নাম ও ছবিও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হতো। সেই সঙ্গে থাকতো ‘রাতভর ধর্ষণের’ মারাত্নক বর্ণনা!!
তবে লক্ষ্য করবেন, এখন খুব খুব ধীরে ধীবে হলেও বস্তুনিষ্ঠ, সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার চর্চা বাড়ছে। আসলে এদেশের গণমাধ্যম সবেমাত্র পেশাদার হতে শুরু করেছে। গণমাধ্যমও আস্তে আস্তে শিল্প হয়ে উঠছে। তাই আগামী আরো এক দশকে এখনকার পরিস্থিতি হয়তো অনেকটাই পাল্টে যাবে– এমনটিই আশা করা যায়।
আবারো আপনাকে সাধুবাদ। :yes:
@বিপ্লব রহমান,
ধন্যবাদ বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্যের জন্য।
খুব গভীর একটি বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন, সংবাদ পরিবেশনে লৈঙ্গিক রাজনীতি সম্পর্কে আগে অবহিত ছিলাম না।
@পৃথিবী,
পড়া ও মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য যায়গায়। এভাবে সন্তার হত্যা কি এখনই বেশি হচ্ছে নাকি এটি সবসময়ই এরকমই? এব্যাপারে কি কারও কাছে কোন তথ্য আছে?
@Atiqur Rahman Sumon,
সন্তান হত্যা নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা নেই, তবে যেটুকু জানি অন্যান্য অপরাধ সব সময়ই ছিল, শুধু প্রচারটা ছিল সীমিত।
পুরুষতন্ত্র নারীকে মায়ের মহিমান্বিত মর্যাদা দিয়েছে তার নিজস্ব স্বার্থেই, নারীর মর্যাদার কথা ভেবে নয়। নারীকে আরো শক্ত করে চার দেয়ালের মধ্যে আটকে রাখার বিশেষ ফন্দি ছিল এটা।
@ফরিদ আহমেদ,
:yes: সহমত
গীতা দাস,
অবশ্যই এর নিন্দা জানানো উচিৎ। একমত। :yes:
@ব্রাইট স্মাইল্,
সহমত পোষণের জন্য ধন্যবাদ।
এটা অবশ্যই নিন্দনীয়। আপনিই প্রথম যাকে আমি এ বিষয়টায় প্রকাশ্য আলোকপাত করতে দেখলাম, সেজন্য ধন্যবাদ। একজন অপরাধীকে ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করার বদলে লিঙ্গ ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হচ্ছে। সম্ভব হলে মিডিয়ার সাথে সিরিয়াস পলিসি সংলাপের ব্যবস্হা করুন। আমি দেশে থাকলে এ ব্যপারে কিছু করার চেষ্টা করতাম।
@সংশপ্তক,
উত্তম প্রস্তাব। তবে যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে তো সব খানে চলতে পারছি না। দল লাগবে। আমি যে নারী সংগঠনের সাথে জড়িত তাদেরকে নিয়ে করার প্রস্তাব দিব। তবে এর সাথে আর্থিক যোগানের ব্যবস্থা করেই এগুতে হবে।
@গীতা দাস,
মিডিয়াসহ বিবিধ সরকারী-বেসরকারী মহলের সাথে পলিসি ডায়ালগের কিছু অভিজ্ঞতা আমার আছে। আপনার সাংগঠনিক অভিজ্ঞতা থাকায় এবিষয়ে এগোনোর কর্মপদ্ধতি নির্ণয়ে আপনার সাথে আলোচনা করা আমার জন্য সহজ। ইতিপূর্বে উত্তরাধিকার আইন সংস্কার নিয়ে কাজ অনেকদূর এগোনোর পর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তহীনতার কারনে বিষয়টা ঝুলে যায় যা এখনও ঝুলে আছে। আমার জানামতে, আর্থিক বন্দোবস্ত করা খুব একটা কঠিন কাজ হবে না যদি সঠিক কর্মপদ্ধতি নিয়ে আগানো যায়। কোন পরমর্শের দরকার হলে জানাবেন।
@সংশপ্তক,
সঠিক কর্মপদ্ধতি কি না জানি না, তবে বিভিন্ন সাংবাদিক ফোরাম , বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকদের সাথে সংলাপ করা যেতে পারে। আর এ বিষয়ে মুক্ত- মনার লেখক বিপ্লব রহমান সহযোগিতা করতে পারেন। আরও কেউ এ বিষয়ে আগ্রহী ও দক্ষ হলে এগিয়ে আসতে পারেন। সাংবাদিকদের যে সব প্রশিক্ষণ হয় সেখানে নারী সংবাদ প্রকাশের সংবেদনশীলতা ও নারী অধিকারের বিষয়টি সংযোজনের জন্য লবি ও এ্যাডভোকেসি করা যেতে পারে। আমি অবশ্য জানি না বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে বিষয়টি কিভাবে পড়ানো হয়।
এ ছাড়া বিস্তারিত আলোচনার জন্য আমরা ই বার্তায় যোগাযোগ করতে পারি।
ধন্যবাদ বিষয়টি নিয়ে আগ্রহের জন্য। আমার নারী বিষয়ক লেখা কিন্তু আন্দোলনের জায়গাটি খুঁজে বের করার জন্য।