সতর্কবার্তাঃ লেখাটি নিজ দায়িত্বে পড়ুন। লেখাটি পড়ার পর আপনার মস্তিষ্ক একটি ভাল/খারাপ মিম দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। উক্ত মিম আপনার জীবনের গতিপথ বদলে দিতে পারে যেটা আপনার জন্য ভাল/খারাপ হতে পারে। যদি ভালো হয় তার কৃতিত্ব যেমন আপনার, কারণ মিমটি আপনি গ্রহন করেছেন, তেমনি খারাপ হলেও দায়িত্ব আপনার। লেখকের এখানে কোন দায় নেই।

অমরত্বের ইচ্ছে মানুষের সব সময়। মানুষ কোন না কোন ভাবে চায় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে। এই সেদিন আমার পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটি হু হু করে কাঁদছিলো মৃত্যু ভয়ে। সে মরতে চায় না। এই বয়সেই তার মাঝে মৃত্যু ভয় চলে এসেছে। আমি জানতে চাইলাম কেন তুমি এতো ভয় পাচ্ছো? ভয়টা কিসের? সে জবাব দিল, মারা গেল তার ঘুম আর ভাঙ্গবে না, সে আর কোন দিন খেলা করতে পারবে না, সে আর কোন বন্ধুর সাথে কথা বলতে পারবে না, এটা সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না। একটু ভাল ভাবে খেয়াল করে দেখুন এখানে কিন্তু নরকের কোন ভয় নেই। তাহলে দেখতে পারছেন যে কোন প্রকার নরক নামক বস্তুর ভয় ব্যতীতও একজন স্বাভাবিক মানুষের মনে মৃত্যু ভয় চলে আসতে পারে। তারজন্য ধর্ম পর্যন্ত যেতে হয় না। এরকম মৃত্যু ভয়ই হতে পারে একজন দয়ালু ঈশ্বর নামক চিন্তার শুরু।

যা হোক, দু’ভাবে মানুষ নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে। একঃ তাঁর নিজের জিনের প্রতিলিপি তৈরীর মাধ্যমে, দুইঃ তার নিজের বিশ্বাস/আদর্শ/সংস্কৃতি/ভাষা/ ইত্যাদী মিমের প্রতিলিপ তৈরীর মাধ্যমে। জিনের প্রতিলিপ সম্ভব সেক্সের মাধ্যমে অথবা ক্লোনিং এর মাধ্যমে আর মিমের প্রতিলিপ সম্ভব মস্তিষ্কের মাধ্যমে। জিন এবং মিম এই দু’টোর প্রতিলিপি তৈরির মাধ্যমেই কেবলমাত্র নিশ্চিত করা যায় যে একজন মানুষের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি তৈরী হয়েছে। তাহলে বুঝা যাচ্ছে যে কোন ভাবেই একজন মানুষ তার সম্পূর্ণ প্রতিলিপি রেখে যেতে পারে না। ক্লোনিং এর ফলে জিনের সম্পূর্ণ প্রতিলিপি সম্ভব হলেও যে মিমের প্রতিলিপি একই হবে তার নিশ্চয়তা নেই। যে কারণে টুইন বাচ্চাদের ক্ষেত্রে জেনেটিক বৈশিষ্ট একই থাকলেও তাঁদের চরিত্র ভিন্ন হতে পারে। আবার সেক্সের ফলে জিনের যে প্রতিলিপ তৈরী হয় সেখানে কখনই বাবা/মার একশত ভাগ প্রতিলিপি আসে না।

আমরা যদি ক্লোনিং এর প্রসঙ্গকে আপাতত বাহিরে রাখি, তবে সেক্সই কেমাত্র উপায় জিনের প্রতিলিপি জন্য। তেমনি মিমও কেবলমাত্র প্রতিলিপি তৈরী করতে পারে যদি সে কোন মস্তিষ্কের সংস্পর্শে আসে। যেমন আপনি যদি নির্দিষ্ট কোন সংস্কৃতি/ভাষা/বিশ্বাস এর কথা কোনদিন নাই শুনেন তবে সেই মিমটি সম্পর্কে কোন ধারনাই আপনার মস্তিষ্কে থাকবে না। একটি মিম মস্তিষ্কে তার প্রতিলিপ তৈরী করতে পারে আমাদের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে। চোখ, কান, ত্বক, ঘ্রাণ, এগুলোর মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানকেই তাহলে আমরা মিম হিসেবে সংঙায়িত করতে পারি। যিনি বর্ণান্ধ তার মস্তিষ্কে রঙের কোন ভিন্নতা নেই। তাই মস্তিষ্ক নির্দিষ্ট কোন মিমের সংস্পর্শে না আসলে মস্তিষ্কে সেই মিমের প্রতিলিপি তৈরী হয় না। মিমের সংস্পর্শে আমরা প্রতিনিয়তই আসছি। এই যে লেখাটি পড়ছেন, আপনি একটি মিম পাচ্ছেন। একটি বই পড়ছেন, মুভি দেখছেন, টিভি/রেডিও দেখছেন/শুনছেন প্রতিনিয়ত মিমের সংস্পর্শে আসছেন। বাবা-মা সন্তাদের সব সময় কোন না কোন মিম দিচ্ছেন। আপনার বন্ধু/বান্ধব, স্কুল/কলেজ, অফিস/আদালত সব কিছু হতে আপনি মিম পাচ্ছেন।

এখন কে বেশি শক্তিশালী তাহলে? জিন নাকি মিম? প্রশ্নটির জবাব পেতে হলে আমাদেরকে দেখতে হচ্ছে কার প্রতিলিপি তাহলে বেশি তৈরি হচ্ছে? কে বেশি ছড়িয়ে দিতে পারছে নিজেকে? সেক্সের দ্বারা আপনি আপনার নিজের জিনের কতগুলো প্রতিলিপি তৈরি করতে পারছেন? চেঙ্গিস খানের মত হলেও এক জীবন বেশি হলে একশত সন্তান রেখে যেতে পারলেন একাধিক স্ত্রীর ঘরে। তারপরেও কথা থাকে – জিনের প্রতিলিপি কখনই নিজের একশত ভাগ হয় না এবং জিনের প্রতিলিপি হলেই মিমের প্রতিলিপি তৈরি হয় না। অন্যদিকে মিমের প্রতিলিপি আপনি যে কারোর মাঝেই ছড়িয়ে দিতে পারেন, তার জন্য নিজের জেনেটিক প্রতিলিপির দরকার নেই। যে কারণে খুব সহজেই একটি মিম কোটি কোটি মানুষের মস্তিষ্কে ছড়িয়ে যেতে পারে।

তাহলে বুঝতেই পারছেন কেন মানুষ আজ এগিয়ে গিয়েছে অন্য জীবের তুলনায়। অন্যান্য প্রাণী গোষ্ঠী যেখানে কেবলমাত্র জিনের প্রতিলিপি তৈরি করে সেখানে মানুষ জিনের প্রতিলিপির সাথে মিমেরও প্রতিলিপি তৈরি করে। জিনের মিউটেশান যেখানে খুব ধীর গতির, মিমের মিউটেশান সেখানে দ্রুত গতির। যে কারণেই বিবর্তনের এক দম শেষ দিবসে এসে আধুনিক মানুষের উদ্ভব হলেও খুব সহজেই মানুষ অন্যান্য জীব গোষ্ঠি্কে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছে হুর হুর করে, এবং এ সম্ভব হয়েছে মস্তিষ্কের এই মিমের প্রতিলিপির ফলেই। মানুষ তার পূর্ব-অভিজ্ঞতায় অর্জিত জ্ঞান তার পরবর্তী জেনেরাশানে ছড়িয়ে দিতে পেরেছে, এবং ছড়িয়ে দিতে পেরেছে অন্যান্য মানুষের মাঝেও।

মিমের বিবর্তন দ্রুত গতির হলেও, সেটিও প্রাকৃতিক নির্বাচনের বাহিরে নয় মোটেই। যে মিমগুলো সময়ের প্রেক্ষিতে টিকে থাকায় সহায়তা করেছে তারাই নির্বাচিত হয়েছে এবং মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছে। ধর্ম, নৈতিকতা, গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ সহ যে কোন মিমকেই এই প্রাকৃতিক নির্বাচনের দৃষ্টিতে দেখা সম্ভব। প্রতিটি মিমের কাজ হচ্ছে নিজেকে ছড়িয়ে দেওয়া, নিজের প্রতিলিপি তৈরি করা। মানুষের মস্তিষ্কই এই মিমগুলো ধারণ করে আবার বর্জন করে। সময়ের প্রয়োজনেই ধর্মগুলো এসেছিলো, আবার তাঁদের কার্যকারিতা না থাকলে সময়ের প্রয়োজনেই সেগুলো বিবর্তিত হবে অথবা হারিয়ে যাবে।

জিনপুলে যেমন পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে যাওয়ার আগে ড়্যান্ডম মিউটেশান ঘটে তেমনি মিমের ক্ষেত্রেও ঘটে। এক বাংলা ভাষাই যদি দেখেন তবে দেখবেন যে আজকে আমরা যে ভাষায় কথা বলি সে ভাষাতেই কি আমাদের কয়েক পূর্বপুরুষ আগের মানুষেরা কথা বলতো। সামনের দিকে ভাষার মাঝে আরো পরিবর্তন আসবে, এবং সেটাই স্বাভাবিক। এখন যখন কোন মিম নিজেকে অবিকৃত রেখে ছড়াতে চায় তখনই কনফ্লিক্ট শুরু হয়। ধর্ম যদি নিজেকে বিবর্তিত করতে পারতো তাহলে কোন সমস্যা ছিল না। কিন্তু ধর্ম যখন নিজেকে ঈশ্বরের বাণী বলে অবিকৃত থাকতে যায়, তখনই সে অন্যান্য মিউটেডেট মিমের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।

মিউটেশন অবশ্যই নন-মিউটেশানের তুলনায় উন্নত হবে। মিউটেশানের ফলে জিনপুলে, মিমপুলে অনেক বৈচিত্র থাকে। যার ফলে যে কোন প্রতিকূল পরিবেশে এই বৈচিত্রের মধ্য হতে কারোর না কারোর টিকে থাকার সম্ভাবনা থাকবে এবং তারাই পরবর্তীতে বংশবৃদ্ধি করবে। কিন্তু সবাই একই রকমের হলে পুরো মানবকূল ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। যে কারণে আমার ব্যক্তিগত অভিমত মানব ক্লোনিং যদি কোন দিন বৈধ হয়ও, সেক্সের ফলে সৃষ্ট মানব জাতিই টিকে থাকবে, ক্লোনিং মানব জাতি নয়। এ কারণেই আমি মনে করি ঐশ্বরিক ধর্মের মিমগুলো যদি সময়ের সাথে নিজেদেরকে বিবর্তিত না করে তবে তারা অন্যান্য প্রগতিশীল মিমগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এবং হারিয়ে যাবে মানুষের মস্তিষ্কে থেকে যেভাবে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী হতে বহু ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, রীতি-নীতি। ধর্মে বিশ্বাসীরা এই বাস্তবতা যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে ততই সভ্যতার জন্য মঙ্গল হবে।

নোটঃ উপরের সতর্কবার্তাটির ধারণাটি “Virus of the mind : the new science of the meme / Richard Brodie ” বইয়ের সূচনা থেকে ধার করা। মিম নিয়ে নিজেও মাত্রই জানছি। তাই স্বতস্ফুর্ত আলোচনা হোক এটাই কামনা করি। আর আমি ঠিক করেছি এখন থেকে কোন বিষয় নিয়ে লিখলে লেখার সাথে চেষ্টা করবো একটি হলেও মূল বই সংযুক্ত করে দিতে যেন আগ্রহী পাঠকেরা চাইলে মূল বই থেকে আরো বেশি জানতে পারে। শুধু লেখার উদ্দেশ্য এবং নিজের আনন্দের জন্যই আমার কোন লেখা নয়। লিখি যেন নিজের চিন্তাগুলো অন্যদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পারি। তাই অনুরোধ থাকবে মূল বইগুলো পড়ুন। নিজেও জানুন এবং অন্যের মাঝেও ছড়িয়ে দিন। এভাবেই একমাত্র সম্ভব সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর মিমগুলোকে আউট নাম্বার করা।

আজ মিম নিয়ে একটি বই দিচ্ছি যেটি আমার ইস্নিপ্স ফোল্ডার থেকে ডাউনলোড করতে পারবেন Darwinizing culture : the status of memetics as a science / edited by Robert Aunger ; with a foreword by Daniel Dennett. । বইটি্র সফট কপি জোগাড় করে দেওয়ার জন্য সচলায়তন সদস্য শুভাশীষকে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ।