” একজন রাজাকার সবসময়ই রাজাকার, কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা সবসময়ই মুক্তিযোদ্ধা না”

এই উক্তিটা বহুল প্রচারিত এবং যথেষ্ট জনপ্রিয় উক্তি। যদিও এ উক্তিটুকু আসলে কার সে সম্পর্কে আমার তেমন কোন ধারনা নেই। পোস্টের শুরুতেই এমন একটা উক্তি দিয়ে পোস্টকে তিক্ত করে ফেলার কোন ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু আসল ফ্যাকড়া তো বাধালই ঐ এক উক্তি। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমরা কত দিক থেকে বিচার করব? মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়+মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময়, এই দুটো আলাদা সময়কালকে যদি আমরা মান বিচারের জন্য আলাদা করে নেই, তাহলে কোন অংশ প্রাধান্য পাবে? ইতিহাস কোন সময়ের পক্ষ নেবে?

আমাদের বেশিরভাগ মানুষই হয়তো এক বাক্যে বলে দেবে যে অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসই আগে। মানুষ ভূল করতেই পারে, পরবর্তী সময়ের ভূলের জন্য পূর্ববর্তী সময়ের গৌরব প্রশ্নবিদ্ধ হবে এটাতো আশা করা যায় না। আমিও সেটাই ভাবার চেষ্টা করি, কিন্তু বাস্তব তো সেটা ভাবতে দেয় না। বাস্তব বিজয়ী বীর কেও এক ধাক্কায় মাটিতে নামিয়ে আনে। শেষ সময়ের একটি মাত্র পরাজয় শুরুর দিকের সব বিজয়কে ইতিহাস থেকে মুছে দেয়। আর যদি মুছেও না দেয়, তাহলেও ইতিহাস তিক্ত হয়ে যায়।

কিভাবে? এ নিয়ে বেশি কিছু বলার অপেক্ষা রাখেনা। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে রাজাকারদের ক্ষমা এবং বর্তমানে তাদের দম্ভ আর ইতিহাস বিকৃতির অক্লান্ত চেষ্টা দেখলেই বোঝা যায় যে আমাদের ভূলটা কি ছিল।

যা হোক, রাজাকারদের সাথে নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধাদের তুলনা করার কোন সুযোগ নেই। তাই এই উদাহরন শুধু উদাহরন হিসাবেই থাক।

কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী সময়ের ভূলভ্রান্তি বা অপরাধমূলক কাজ কে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখব? ইতিহাস কি বলবে? আগামী প্রজন্মের কাছে কি পৌছাবে? আগামী প্রজন্ম অথবা আমাদের প্রজন্মই বা কি সিদ্ধান্ত নেবে তাদের ব্যপারে?

সূচনায় এত সব ঘোলাটে কথাবার্তা লেখার একটাই কারন, এই ব্যপারটা নিয়ে সোজাসুজি আমি কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। গত দুই দিন ধরে মাথায় যন্ত্রণা দিচ্ছে। কোন ফলাফল নেই।

যারা মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তী সময় নিয়ে মোটামুটি ভাল জ্ঞান রাখেন তারা এতক্ষণে নিশ্চই বুঝে গেছেন যে কথাগুলো এখন এই সময়ে লিখে দেবার কারন কি। হ্যাঁ, সেক্টর কমান্ডার লেঃ জেনারেল (মুক্তিযুদ্ধকালীন মেজর) মীর শওকত আলীর মৃত্যু।

তার মৃত্যুর সংবাদ পাবার পর ফেসবুকে একজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার বিতর্কগুলোকে উর্ধ্বে রেখে তাকে স্যলুট জানিয়ে একটা স্ট্যটাস দিয়েছিলাম। কিন্তু ঐ স্ট্যটাস দেয়ার পর থেকেই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকল যে, তার বিতর্কগুলোকে কি উর্ধ্বে রাখা যায়? তার বিতর্কগুলোকে সরিয়ে রেখে তাকে কি মহামানব হিসাবেই মৃত্যুর পরে গণ্য করা হবে?

টিভি নিউজ, সংবাদপত্রেও দেখা যাচ্ছে যে তার বিতর্কগুলোকে দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে। আজকে প্রথম আলোতে আমার খুবই প্রিয় একজন লেখক, মুক্তিযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া শওকত আলীকে স্মরণ করে কিছু কথা লিখেছেন। তিনিও বিতর্কগুলোকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টাই করেছেন। এখন প্রশ্ন হল, এরকম করলে তো যারা তার সম্পর্কে বা তার বিতর্কগুলো সম্পর্কে জানেন না তাদের কাছে তিনি মহামানব টাইপ কিছু একটা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবেন।
(যেমন সাঈদীর কুকীর্তি সম্পর্কে যারা জানে না, তারা অনেকেই তাকে মহাবুজুর্গ আল্লার ওলী টাইপ কিছু একটা মনে করে!! কেন যেন এই বাজে উদাহরণটাই মাথায় আসল। এই উদাহরন ও মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যায় না বলে আমি আবারো এটাকে শুধুই উদাহরণ হিসাবেই দেখতে বলব।)

যারা তার সম্পর্কে বিতর্কগুলো কী তা জানেন না, তাদের জন্য বলছি, উনার শুধু বিতর্কগুলো নিয়ে লিখতে গেলেও আরো একটা কি দুটো পোস্ট হয়ে যাবে। যেগুলো আমি নতুন করে এখানে টেনে আনতে চাচ্ছি না।

এখন আমার প্রশ্ন হল যে, তার সমাধিতে আমরা কি বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ফুল দেব, নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যায় সহযোগিতাকারী হিসাবে এড়িয়ে যাব? ইতিহাসের একজন নির্মাতা হিসাবে শ্রদ্ধা করব, নাকি ইতিহাসের বিকৃতিকারী হিসাবে ঘৃণা করব (ঘৃণা শব্দটা আমার ব্যবহারের কোনই ইচ্ছা ছিল না)? রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন এজন্য স্যলুট দেব, নাকি রাজাকারদের সাথে আপোসকারী হিসাবে স্যলুট থেকে বঞ্ছিত করব? নতুন প্রজন্মই বা তার সম্পর্কে কী সিদ্ধান্ত নেবে?

প্রাসংগিক কিছু পোস্টের লিংকঃ
১- একজন মুক্তিযোদ্ধার প্রস্থানঃ আপনাকে লাল সালাম জেনারেল এ পোস্টে নজরুল ভাই এবং রিটন ভাইয়ের মন্তব্য।
২-তাহেরের স্বপ্ন (পঞ্চম ও শেষ পর্ব) এ পোস্টের সব মন্তব্য।