এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমাদের বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিলের শ্রীমঙ্গল শাখার সদস্য সমীক সেন আমাকে ফোনে জানালো ঢাকাস্থ ইসকনের কিছু সদস্যের সাথে বির্তকের এক পর্যায়ে তারা একটি বই রেফার করেছে পড়ে দেখার জন্য। বলেছে ‘এত্ত যে বিজ্ঞান নিয়ে পণ্ডিতি দেখাও তোমরা, তবে এই বইটির বক্তব্য খণ্ডন করে দেখাও তো?’ পরপর কয়েকদিন তারা এই বই নিয়ে নাকি বেশ চেঁপে ধরছে। আমি ইসকনের এই বইটি দেখিনি, তাই সমীক বললো সে আমাকে বইটি দেখাতে চায়। আর সম্ভব হলে একটি জবাব তৈরি করে দিতে। কিছুদিন পর সমীকের কাছ থেকে বইটি পেলাম। বইয়ের নাম ‘বিজ্ঞান সনাতন ধর্ম বিশ্ব সভ্যতা’, লেখক গোবর্দ্ধনগোপাল দাস, ভক্তিবেদান্ত গীতা একাডেমি, নদীয়া, পশ্চিমবঙ্গ। বইটি হাতে আসার পর এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম। প্রচণ্ড এক উত্তেজনা তৈরি হলো নিজের মধ্যে। জবাব তৈরি করতে গিয়ে দেখি মেজাজ ঠাণ্ডা রাখতে পারছি না। বারে বারেই উত্তেজিত ধ্বনি বের হয়ে আসছে। আমি জানি না এখানকার কোন পাঠক এই বইটি পাঠ করেছেন কিনা? একজন বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের কাছে এই ধরনের বই পাঠের পর নিজেকে সংযত রাখা যথেষ্ট কঠিন। নিমকহারামির সীমা থাকা উচিৎ । বিজ্ঞান ছাড়া যাদের একদিনও চলে না, ওরা ভালো করেই জানে চব্বিশ ঘণ্টা হরি নাম জপ করলেও এক মুঠো চাল সিদ্ধ হয়ে মুখে জুটবে না। তিন লক্ষ বার, দশ লক্ষ বার হরি নাম জপ করলেও কলেরা, টাইফয়েড, যা, ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী ভালো হবে না। কারো বাপেরও সাধ্য নেই মন্ত্র পড়ে এদের সুস্থ করে তোলতে পারে। ধর্মীয়নেতারা নিজেদের অসুখের সময় ঠিকই মন্দিরে না গিয়ে হাসপাতালে দৌড় দেয়। ডাক্তার-ডায়গনিস্টিক সেন্টার আর ফার্মেসিতে আঠার মতো লেগে থাকে। এসব তো আমাদের চোখের সামনেই প্রতিনিয়ত দেখছি। দিনরাত নিরামিষ, নিরামিষ করে, ঠেলায় পড়লে মুরগির ঘুঘুলি খেতেও তখন চক্ষুলজ্জা হয় না। সেই বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে যারা, বিজ্ঞানীদের বৈজ্ঞানিক বিতর্ক নিয়ে যারা মজা লুটার আনন্দ পায় তাদেরকে নিমকহারামের দল বলা হবে না তো কি বলা যায়, আমি জানি না। এর থেকে অনেক খারাপ উপাধি দেয়া যায়, কিন্তু আমার মতে এর থেকে ভালো উপাধি দেবার সুযোগ নেই।

সমীকের কাছে আমার ছোট একটি প্রতিক্রিয়া পাঠিয়ে দিয়েছিলাম বইটি পাবার সপ্তাহ দুয়েক পর। সমীক ইসকনের সদস্যদেরকে প্রতিক্রিয়াটি পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু সেই থেকে এরা সবাই চুপ। কয়েকবার তাগাদা দিয়ে এ বিষয়ে ওদের মুখ থেকে কোনো শব্দ বের করতে পারেনি। বিযুকা’র আরেক সদস্য বর্তমানে ইংল্যান্ড নিবাসী অসীম দাসকে ইমেইলে লেখাটি পাঠালে সেও এটিকে ফেসবুকে ইসকনের গ্র“পে পোস্ট দেয়। এখানে বলা অপ্রাঙ্গিক হবে না, বেশকিছু দিন আগে অসীম এবং আমার সাথে ইসকনের কিছু সদস্যের দীর্ঘ বির্তক হয়েছিল। সেখানে কয়েকবার ওদের মিথ্যাচার আর ভণ্ডামো হাতেনাতে ধরিয়ে দেয়ার পরও হুঁশ হয়নি। একটার পর একটা ইস্যু নিয়ে আসার পর শেষমেশ প্রাণের উৎপত্তি এবং জৈববিবর্তন নিয়ে বির্তকের এক পর্যায়ে ওদের কেউ কেউ আমাদের নসিহত করেছিল হারুন ইয়াহিয়ার ডারউইনিজম রিফুটেড এবং গোবর্দ্ধনগোপালের এই বইটি পড়তে। ওখানে নাকি সব আছে। আমি হাসবো না কি কাঁদবো বুঝতে পারলাম না। চোরে চোরে যে মাসতুতো ভাই তা আবারও প্রমাণিত হল! যাহোক, অনেক চেষ্টা করেও দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর ওদের কাছ থেকে কোনো জবাব না আসায় আমার এই পাঠ-প্রতিক্রিয়াটি ব্লগে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। ফেসবুকে আমিও এই লেখাটি প্রকাশ করেছিলাম। সেখানে কেউ কেউ ব্যক্তিগতভাবে ম্যাসেজ পাঠিয়েছিলেন, কেউ কেউ কমেন্ট বক্সে মন্তব্য করেছিলেন লেখাটি ব্লগে প্রকাশ করার জন্য। সকলকেই আমার আন্তরিক ধন্যবাদ। জাকির নায়েক, হারুন ইয়াহিয়া প্রমুখের প্রচারিত তথাকথিত ইসলামি-বিজ্ঞানের মতো হিন্দু ভণ্ডের দল কি করে খ্রিস্টান আইডিওয়ালাদের তথ্য ধার করে হিন্দুত্ববাদী মোড়কে নতুন কিসিমের বৈদিক-বিজ্ঞান ছড়িয়ে দিতে চায় তা বোঝার পাশাপাশি, এদেরকে চিনে রাখার দরকার আছে। আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে যেখানে বিজ্ঞানের কোনো প্রাতিষ্ঠানিকায়ন ঘটেনি এখনও, বিজ্ঞানের প্রতি পেশাদারিত্বমূলক মনোভাব গড়ে ওঠেনি, তাই বিজ্ঞান আর ধর্মের মিশেলে উদ্ভট জগাখিচুড়ি তৈরির প্রচেষ্টা ধর্মবাদীরা করেই যাবে-এ তেমন আশ্চর্যজনক নয়। তাই আমার মতে একজন বিজ্ঞান-আন্দোলন কর্মীকে বিজ্ঞানের তত্ত্ব-তথ্য-উপাত্ত জানার পাশাপাশি অবশ্যই ধর্মবাদীদের এই ধরনের ভণ্ডামির মনস্তত্ব এবং কর্মপ্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত থাকতে হবে। পপুলার লেভেলে শুধু ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, বায়োলজি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকলেই চলবে না জানার পরিমাণ ক্ষেত্রবিশেষে আরো গভীরে নিয়ে যেতে হবে। আমি বলছি না যে, একজন বিজ্ঞান-আন্দোলন কর্মীকে বিজ্ঞানের সকল শাখাতেই টেক্স্টবুকের সমস্যা সমাধান পর্যন্ত জ্ঞান আহরণ করতে হবে। কিন্তু ইদানীং দেখা যাচ্ছে ধর্মবাদী বিজ্ঞান-ভণ্ডরা তাদের সকল আলোচনাতেই বিজ্ঞানের পরিচিত-অর্ধপরিচিত টার্মগুলো ব্যবহার করে, যাতে বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের সামঞ্জস্য রয়েছে এমন একটি ধারণা গণচেতনার মধ্যে স্থান করে নিতে পারে। তাদের এ অপচেষ্টা অবশ্যই রুখতে হবে। তা সে যে ধর্মের তরফ থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আঘাত আসুক। এ দায়িত্ব প্রতিটি বিজ্ঞান-আন্দোলন কর্মীর, প্রতিটি বিজ্ঞান-চেতনাসম্পন্ন মানুষের।

ভূমিকা শেষে এবার মূল লেখাটিতে যাই। আগেই বলে রাখি গোটা লেখাটিতে তাড়াহুড়ার ছাপ স্পষ্ট। এখানে ছোট ছোট ১০টি পয়েন্টে ‘বিজ্ঞান সনাতন ধর্ম বিশ্ব সভ্যতা’ বইটির চতুর্থ অধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি। ব্লগে এ লেখাটি প্রকাশ করার ইচ্ছে হওয়ার পর ভাবলাম কয়েকটি পয়েন্ট বড় করে নিই। যাতে সাধারণ পাঠক, যারা গোবর্দ্ধনগোপালের বইটি পাঠ করেননি, তাদের কাছে আমার বক্তব্য বুঝতে সহজ হবে। তাই অল্প কয়েকটি জায়গায় ঈষৎ পরিবর্তন করেছি।

‘বিজ্ঞান সনাতন ধর্ম বিশ্ব সভ্যতা’ শিরোনামের বইয়ের গায়ে দাম যদিও লেখা নেই, তবে শক্ত কাভার, রঙিন ছবি আর কাগজের কোয়ালিটি দেখে বোঝা যাচ্ছে, বইটির মূল্য একেবারে যেনতেন নয়। সমীক এতো দামি বই কিনে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে আমাকে আসলে চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এটার কি সদ্বগতি করা যায় তাই ভাবছি! প্রায় ৫০০ পৃষ্ঠার ঢাউস সাইজের বইটি সম্পূর্ণরূপে পড়া এখনো শেষ হয়নি তবে বেশকটি অধ্যায় আমার ইতিমধ্যে পড়া হয়েছে। অধ্যায়গুলি পড়ে আমার মনে হয়েছে, এই বইয়ের প্রতিক্রিয়া জানানোর মধ্যেই রয়েছে সদ্বগতির শ্রেষ্ঠ পথ। সেজন্য এ পথই বেছে নিলাম। সমীক আপনাকে আর একটু কষ্ট করতে হবে। নীচে এই বইয়ের একটি অধ্যায়ের উপর ছোট পরিসরে আমার বক্তব্য তুলে ধরছি। আপনি সম্ভব হলে এই চিঠির ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে ইসকনের সাথে যোগাযোগ করে নীচের পয়েন্টগুলোর ব্যাখ্যা দাবি করবেন। যদি ইসকনের সদস্যরা ইতিবাচক মনোভাব প্রদর্শন করেন অর্থাৎ আমার জবাবের প্রেক্ষিতে তারা পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করতে ইচ্ছুক থাকেন তবে পরবর্তীতে আরো বিস্তারিতভাবে প্রত্যেকটি পয়েন্টে আলোচনা করতে বা লিখে দিতে রাজি আছি।

নেহাত বিজ্ঞান-বিরোধী বই কিংবা ধর্মীয় বই হলে আমার কোনো আপত্তি থাকতো না। কোনো ধরনের জবাব দেয়ারও প্রয়োজন বোধ করতাম না। বাজারে রসময় দাসগুপ্তের মত লেখকদের বইয়ের তো অভাব নেই। তাই বলে কী সব বিজ্ঞান-বিরোধী বইয়ের জবাব দিতে হবে নাকি? কিন্তু কথা হচ্ছে, এ বইয়ে বিজ্ঞানের বিরোধিতা করতে গিয়ে এত্তো বেশি বিজ্ঞানের অপব্যাখ্যা, ভুল ব্যাখ্যা আর ম্যানুপুলেশন করা হয়েছে, তার কোনো সীমা নেই। বিজ্ঞান বা বিজ্ঞানীরা যা বলেনি, তাই বিজ্ঞানের নাম করে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা এই বইটি পাঠ করেননি, তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি, এই বইয়ের মুখবন্ধ লিখে দিয়েছেন প্রফেসর ডঃ সুদীপ্ত ঘোষ, ডিপার্টমেন্ট অব্ মেটালার্জিক্যাল এন্ড মেটেরিয়ালস্ ইঞ্জিনিয়ারিং, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আই.আই.টি), খড়গপুর। মুখবন্ধের এক জায়গায় প্রফেসর সুদীপ্ত বলেছেন “

শ্রীল প্রভুপাদ বিজ্ঞানসম্মতভাবে আধ্যাত্মিক জ্ঞান-এ প্রবেশের উপযোগী প্যারাডাইমের খোঁজ বিশ্বের বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষকে জানাতে ভক্তিবেদান্ত ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন। বৈদান্তিক ধারায় যে কোন আচার্যের মতো শ্রীল প্রভুপাদ অনুভব করেছিলেন যে কেউ যদি বিজ্ঞানসম্মতভাবে ও যুক্তিশীলতার সাথে প্রকৃত বাস্তব সত্যকে স্বরূপত জানতে চান, তাহলে তিনি সুনিশ্চিতভাবে ভগবদ্গীতা, বেদান্ত ও শ্রীমদ্ভাগবতের শিক্ষা-উপদেশে আস্থাবান হবেন। …প্রথিতযশা চিন্তাবিদ্, বিজ্ঞানী ও বিদগ্ধ ব্যক্তিদের রচনাকর্ম গভীরভাবে অধ্যয়ন-পর্যালোচনা করে গােবর্দ্ধনগোপাল দাস এই বইটিতে একজন যুক্তিশীল মানুষের অকৃত্রিম জিজ্ঞাসাকে উপস্থাপন করেচেন, যা ভগবদ্গীতার ও ভাগবতের সুমহান শিার অভিমুখে পাঠককে পরিচালিত করবে।

” প্রফেসর সুদীপ্ত ছাড়াও আরো যারা এই বইয়ের রচনায় পঞ্চমুখ হয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন, ডঃ পুরুষোত্তম চক্রবর্তী, সিনিয়র প্রফেসর অব ফিজিক্স, সাহা ইনস্টিটিউট অব নিউকিয়ার ফিজিক্স, কলকাতা। ডঃ পুরুষোত্তম বলেছেন : “

সনাতন ধর্ম ও বিজ্ঞানের মধ্যে কোন সংঘাত নেই। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে কোনো ধর্মমতের সঙ্গে বিজ্ঞানের যে বিরোধ দেখা দিয়েছিল, তার জন্য প্রকৃত ধর্মকে দায়ী করা যায় না। প্রকৃত ধর্ম কখনো বিরোধ, সংঘাত, শোষণ সৃষ্টি করে না, বরং এইগুলোকে দূর করে মানব সমাজকে কলুষমুক্ত করে। প্রকৃত ধর্ম মতবাদ নয়, এটি আদি, অকৃত্রিম সনাতন সত্য।… বিজ্ঞান সনাতন ধর্ম বিশ্বসভ্যতা বইটি এই প্রয়োজনীয় দার্শনিক তত্ত্বকে গভীরতা দিতে সম হবে বলে আমার বিশ্বাস।

ডঃ তাপস বন্দোপাধ্যায় (সায়েন্টিফিক অফিসার, ভাবা অ্যটমিক রিসার্চ সেন্টার, কলকাতা) বলেছেন :

“বিজ্ঞান সনাতন ধর্ম বিশ্বসভ্যতা বইটি বহু নির্ভরযোগ্য তথ্যে সমৃদ্ধ; এটি প্রামাণিক তথ্যের সংকলন।”

এর বাইরে আরো আছেন বিশ্বভারতীর রসায়নবিজ্ঞানী শ্রীবাসুদেবপ্রসাদ দাস, ক্যালফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানী ডঃ পার্থ বিশ্বাস, ডঃ শেখ মকবুল ইসলাম (বিভাগীয় প্রধান, বাংলা সাহিত্য বিভাগ, সেন্ট পলস্ কলেজ, কলকাতা) প্রমুখের নামে এই বইয়ে বাণী ছাপানো হয়েছে। এঁদের নাম তুলে ধরে আমি শুধু এতটুকুই বোঝাতে চাচ্ছি যেনতেন চুনোপুটির হাতে রচিত নয় এ বইটি। এর সঙ্গে রাঘববোয়ালেরা জড়িত। কিন্তু আমার মতে এ বই পাঠ করে একজন সাধারণ পাঠকের জ্ঞান কতটুকু বাড়বে জানি না তবে চকচকে প্রচ্ছদ, রঙিন ছবি, আর দামি কাগজের মধ্যে দিয়ে মুরগীর বিষ্ঠা ‘অমৃত’ বলে পরিবেশন করার কৌশল যে ভালো রপ্ত হয়েছে ইসকনের, তা সহজেই বোঝা যায়। উপরোক্ত বইয়ের প্রত্যেকটি বাক্যে, প্রত্যেকটি অধ্যায়েই গণ্ডগোল রয়েছে। অসততার ছাপ রয়েছে। বিজ্ঞান সম্পর্কে যাদের জ্ঞান ‘ক অর গোমাংস’ তারা লিখেছেন বিজ্ঞানের বিরোধিতা করে বই! ‘সাবাস ইন্ডিয়া সাবাস!’ এ বইয়ে এতো ভুলের সমাহার যে প্রত্যেকটি লাইনের জবাব দিয়ে সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে গেলে আমাকে কয়েকটি মহাভারত লিখে ফেলতে হবে! বুঝতে পারি না, একজন লেখক কি করে এতো কাণ্ডজ্ঞানহীন বর্জ্যপদার্থ রচনা করতে পারলেন? ন্যূনতম বৈজ্ঞানিক জ্ঞান না রেখে এত্তো উল্টাপাল্টা বক্তব্য সাধারণ জনগণকে গিলানো হচ্ছে, ভাবাই যায় না। ধর্মের পে সাফাই গেয়ে, বিজ্ঞান-বিরোধী বই তো বাজারে প্রচুর আছে। কিন্তু এই বইয়ের মতো ‘শতাব্দীর সর্বোচ্চ কলঙ্কিত আবর্জনা’ সত্যি বলছি, এর আগে আমার নজরে আসে নি। সমীক এ জন্য আপনাকে পুনরায় ধন্যবাদ। আমি কৃতজ্ঞ।

চতুর্থ অধ্যায়ের মধ্যেই আজকে আমার বক্তব্য সীমাবদ্ধ থাকবে। পরবর্তীতে বাকি অধ্যায় নিয়ে আরো জবাব পাঠানো হবে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, আমার সম্পাদনায় চার্লস ডারউইনের ২০০তম জন্মবাষির্কী উপলে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশের কাজ চলছে আর জৈববিবর্তন নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা আর ভুল ব্যাখ্যার জবাব দিয়ে ‘জৈববিবর্তন তত্ত্ব : নানা জিজ্ঞাসা’ শিরোনামের আরেকটি গ্রন্থ লেখা চালিয়ে যাচ্ছি। ডারউইনের স্মারকগ্রন্থ আশা করি আগামী বইমেলাতে প্রকাশ করা সম্ভব হবে। দ্বিতীয় বইটিতে ইসকনের বইয়ে জৈববিবর্তন নিয়ে উল্লেখিত প্রশ্নাবলী এবং ভুল ব্যাখ্যাসহ আরো প্রচুর প্রশ্নের জবাব লেখা চলছে এখনো। বিধায় এই চিঠিতে জীবের বিবর্তন নিয়ে বিজ্ঞান সনাতন ধর্ম বিশ্ব সভ্যতা বইয়ের ভুল ব্যাখ্যার জবাব ইচ্ছে করে কিছুটা সংক্ষিপ্ত আকারে দিচ্ছি।

১. চতুর্থ অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বিবর্তনবাদ : কল্পবিজ্ঞান যখন বিজ্ঞান’। শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই অধ্যায়ে কি কি আলোচনা হয়েছে এবং লেখক কি বলতে চাচ্ছেন। এই অধ্যায়ের ভূমিকা একেবারে ফালতু কথায় ভরপুর। যত্তসব বকওয়াস। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলতে পারি কার্ল স্যাগান, ফ্রান্সিস ক্রিক মোটেই বিবর্তন-বিরোধী ছিলেন না। ১৫৪ পৃষ্ঠায় যেমন দাবি করা হয়েছে। কার্ল স্যাগানের ‘কসমস’ ডকুমেন্টারিটি সারা বিশ্বেই জনপ্রিয়। বিশেষ করে বিজ্ঞানের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের কাছে। জনপ্রিয় এ বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্যচিত্রটি বাংলাদেশের বিটিভিতে একসময় প্রচারিত হয়েছিল। এখনও বাজারে এই ডকুমেন্টারি সিডি-ডিভিডি আকারে পাওয়া যায়। ৭টি পর্বে তৈরি কসমস ডকুমেন্টারিতে লেখক মহাবিশ্বের উৎপত্তি সংক্রান্ত বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছিলেন, তেমনি বহির্বিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব, পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব, জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া, মানব সভ্যতার বিকাশ ইত্যাদি ক্রমান্বয়ে আলোচনা করা হয়েছে। কার্ল স্যাগান সারা বিশ্বের অত্যন্ত পরিচিত বিজ্ঞানমনস্ক গবেষক ছিলেন। তাকে জৈববিবর্তন তত্ত্বের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর উদ্দেশ্য কি? বইটিতে বলা হয়েছে ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএ বা জিন আবিষ্কারক। ভুল বক্তব্য। ফ্রান্সিস ক্রিক-জেমস ওয়াটসন যৌথভাবে একটি ‘যুগ্ম সর্পিলাকার’ মডেলের মাধ্যমে ডিএনএন’র গঠনের ব্যাখ্যা দিয়ে ছিলেন। ওয়াটসন-ক্রিকের মডেল তৈরির বছর খানেক আগে থেকেই জীবকোষে ডিএনএ’র অস্তিত্ব সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিৎ ছিলেন। এমন কি ডিএনএ’র উপাদান (চারটি নাইট্রোজেনঘটিত জৈবক্ষার অ্যাডেনিন (A), থায়ামিন (T), গুয়ানিন (G), সাইটোসিন (C)) সম্পর্কেও জানতেন। জানতেন না শুধু, এসকল উপাদান দিয়ে ডিএনএ’র অভ্যন্তরীণ গঠন কেমন। যা ওয়াটসন-ক্রিক যৌথভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। ফ্রান্সিস ক্রিক জৈববিবর্তনের বিরোধী ছিলেন এমন তথ্যের উৎস কি? সম্পূর্ণ মিথ্যে বক্তব্য। আর ডিএনএ এবং জিন এক কথা নয়। সহজ কথায় হচ্ছে, জীবদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান প্রোটিনের সাংকেতিক লিপি হল ‘জিন’ (বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জিন ডিএনএ’তে অবস্থিত, কিছু ভাইরাসের ক্ষেত্রে আরএনএ’তে)। যা জীবের বংশগতির একক। একেকটি ‘জিন’ একেকটি প্রোটিনের সাংকেতিক লিপি। কয়েকটি ‘কোডন’ মিলে জিন গঠিত। কোডন হচ্ছে তিনটি নাইট্রোজেনঘটিত জৈবক্ষারের মিলিত রূপ; যেমন ACT কিংবা GCA।

২. ১৫৪-১৫৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, “গ্যালাপেগাস দ্বীপে জাহাজ পৌঁছালে ডারউইন সেখানে পাঁচ সপ্তাহ কাটান, লক্ষ্য করেন জীববৈচিত্র্য। সেখানে তিনি কিছু ফিঞ্চ প্রজাতির পাখি দেখা পায়। প্রায় ১৪টি প্রজাতির ফিঞ্চ রয়েছে এই দ্বীপে। ডারউইন কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন, ডায়েরীতে লেখেন। কিন্তু তখন তাঁর বিবর্তনবাদের কথা মনে হয়নি আদৌ! …কোষের ডিএনএ-এ কোডিং মেকানিজম সম্বন্ধে তাদের (ডারউইন এবং পক্ষীবিশারদ জন গোল্ড-অনন্ত) কোনো ধারণাই ছিল না সেই সময়। কেবল বাহ্য আকৃতি বিচার করে এই ঘটনার প্রায় সাতাশ বছর পর ডারউইন বই লিখে উপস্থাপন করেন তার ন্যাচারাল সিলেকশান তত্ত্ব।” ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞতা আর ভুল ব্যাখ্যা প্রচার পেয়েছে এ বাক্যগুলিতে। জৈববিবর্তন তত্ত্বের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত থাকলে এতো চটজলদি মিথ্যে কথা বলা যেত না। বোঝা যাচ্ছে লেখক উদ্দেশ্যমূলকভাবে ইতিহাসের ম্যানুপুলেশন ঘটিয়েছেন। বলা হচ্ছে, ‘ডারউইন কিছু নমুনা সংগ্রহ করেন’। শুধুমাত্র গ্যালাপোগাস থেকে সংগৃহীত নমুনার তালিকা আমি তুলে দিচ্ছি : তিন প্রজাতির কচ্ছপের বাচ্চা, ১৬ প্রজাতির শামুক, সম্পূর্ণ নতুন ১৫ প্রজাতির মাছ, সামুদ্রিক সরীসৃপ ইগুয়ানা, ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুড়, সীল, পেঙ্গুইন, মোট ২৬ প্রজাতির পাখি যথা পেঁচা, কবুতর, রেন, ফাইচোর, থ্রাশ ফিঞ্চ প্রজাতির পাখি। ডারউইন ১৩ প্রজাতির ফিঞ্চ পাখি নমুনা হিসেবে সংগ্রহ করেন। পাঁচ বছরের বিগল জাহাজের ভ্রমণ শেষে ইংল্যান্ডে ফিরে এসে ডারউইন তার প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব দাঁড় করানো জন্য শুধুমাত্র ফিঞ্চ পাখির বাহ্যিক গঠনের উপর নির্ভর করেননি, টানা বিশটি বছর সংগৃহীত বিভিন্ন পশু-পাখি নিয়ে গবেষণা করেছেন, বিভিন্ন জীববিজ্ঞানীর সঙ্গে তার বক্তব্য শেয়ার করেছেন। ডারউইনের জীবনী নিয়ে বাজারে প্রচুর বই আছে। বাংলা ভাষায় আমি রেফার করবো ড. ম. আখতারুজ্জামানের বিবর্তনবিদ্যা (বাংলা একাডেমী থেকে ২০০০ সালে প্রকাশিত, নতুন সংস্করণ হাসান বুক হাউজ, ঢাকা), নারায়ণ সেনের ডারউইন থেকে ডিএনএ এবং চারশো কোটি বছর (আনন্দ প্রকাশনী, কলকাতা) কিংবা বন্যা আহমেদের বিবর্তনের পথ ধরে (অবসর প্রকাশনী, ঢাকা) বই থেকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত জেনে নিতে।

৩. একই পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘১৮৫৯ সালে তার (ডারউইন) ‘দি ডিসেন্ট অব ম্যান …দি অরিজিন অব স্পিসিস বইয়ে প্রথম ইভলুশন শব্দটি ব্যবহার করেন।’ ডিসেন্ট অব ম্যান বইটি ১৮৫৯ প্রকাশিত হয়নি। এটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৭১ সালে। অরিজিন অব স্পিসিজ বইটি প্রকাশিত হয়েছে ১৮৫৯ সালে। বইটির পুরো নাম : The Origin of Species by Means of Natural Selection, Or the Preservation of Favored Races in the Struggle for Life। তাছাড়া ‘ইভলুশন’ (Evolution) শব্দটি ডারউইন নিজে আবিষ্কার করেননি এবং প্রথম ব্যবহারও করেননি। এমন কী ডারউইনের পূর্বসূরি ল্যামার্ক বা হেকেল পর্যন্ত না। ডারউইন জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন ‘পরিবর্তনসহ উত্তরাধিকার’ (Descent with modification)। অরিজিন অব স্পিসিজ বইয়ের একদম শেষ প্যারায় একবার মাত্র ডারউইন ইভলুশন শব্দটি উল্লেখ করেছেন তাও ভিন্ন অর্থে। জার্মান জীববিজ্ঞানী আল ব্রেখট ফন হেলার (Albrecht Von Haller) ১৭৪৪ সালে ইভলুশন শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন।

৪. ১৫৭ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে ভালুক হয়ে উঠল মস্ত তিমি’ অংশে আবারো ম্যানুপুলেশন করা হয়েছে। জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে নিজেদের অজ্ঞানতার ভাণ্ডার নিয়ে অনবরত ডারউইন এবং জৈববিবর্তনকে ব্যঙ্গ করা হয়েছে। যার ফলে গোটা লেখাই খেলো হয়ে গেছে। আজকের জৈববিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে ‘ভালুক থেকে তিমির বিবর্তনে’র কথা মোটেও বলা হয়নি। সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমির বিবর্তন সম্পর্কে বৈজ্ঞানিক তথ্য কেবল ফসিল রেকর্ড থেকে জানা যায়নি, একই সাথে আণবিক জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন গবেষণা থেকেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে। তিমির বিবর্তন নিয়ে ১৮৫৯ সালের জ্ঞান দিয়ে ২০১০ সালে এসে সমালোচনা করা হচ্ছে। জীববিজ্ঞানের বৈজ্ঞানিক গবেষণা কি ১৮৫৯ সালেই আটকে আছে? মনে হচ্ছে আপডেটেড ইনফরমেশন লেখকের জানা নেই। একটি প্রশ্ন, আজকের পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা-জ্ঞান কি নিউটনের যুগে আটকে আছে? নিউটনীয় যুগ পেরিয়ে পদার্থবিজ্ঞান আইনস্টাইনের যুগও পার হয়ে গেছে। এখন কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের যুগ চলতেছে। তেমনি জীববিজ্ঞান সম্পর্কিত জ্ঞান-তথ্য-উপাত্ত ডারউইনের যুগে আটকে নেই। এ বিষয়টি স্পষ্টই মাথায় রাখতে হবে। ডারউইনের অনেক বক্তব্যই যে সংশোধিত হয়েছে এ বিষয়টি জীববিজ্ঞানীরা হরহামেশাই স্বীকার করেন। কিন্তু ক্রিয়েশনিস্টরা বারে বারেই দেখা যায়, পুরানো কাসুন্দি ঘেটে ডারউইনের ভুল বের করে চলেন। অসুবিধা নেই। ডারউইন যুগের বংশগতি বা জীববিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায় যে তথ্যের দুর্বলতা ছিল তা বিজ্ঞানীরা কখনোই অস্বীকার করেন না। বরং জোর গলায় প্রচার করেন। যাতে মানুষ বুঝতে পারে, জানতে পারে, শিখতে পারে উনবিংশ শতকের জীববিজ্ঞান আজকের একবিংশ শতকে এসে এসে কী কী আপডেটেড হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমি এখানে বলতে পারি বিখ্যাত ইভো-ডেভো সায়েন্টস্টি সন বি. ক্যারলের উপস্থাপনায় What Darwin never Knew ডকুমেন্টারি ফিল্মটির কথা। আগ্রহীরা দেড় ঘণ্টার এ ডকুমেন্টারিটি দেখলেই বুঝতে পারবেন, (কষ্ট করে গাদা গাদা বই পড়ে সময় নষ্ট করতে হবে না!!) ডারউইনের যুগ থেকে জীববিজ্ঞান আজকের একবিংশ শতাব্দীতে কতটুকু এগিয়েছে। কোনো জীববিজ্ঞানীই লুকোচুরি করে দাবি করেন না ‘ডারউইন জীবের বিবর্তন নিয়ে সব জানতেন এবং তার অরিজিন অব স্পিসিজ বইয়ের সকল বক্তব্য একদম সম্পূর্ণরূপে বৈজ্ঞানিক মহলে গৃহীত হয়েছে।’ মোটেও না। ভুল স্বীকার করতে বিজ্ঞানের জগতে কোনো কার্পণ্য নেই। জীববিজ্ঞান কোনো স্থবির কোনো জ্ঞানের শাখা নয়। বিবর্তনীয় বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান আর আণবিক জীববিজ্ঞানের কল্যাণে জৈববিবর্তনকে এখন গবেষণাগারে চাক্ষুস প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে। আরেকটি কথা। এই পৃষ্ঠায় ‘ডারউইনের বক্তব্য’ বলে ফুট নোটে কয়েক লাইন ইংরেজি বক্তব্য রয়েছে। যার অনুবাদও দেয়া হয়েছে এই পৃষ্ঠায়। গোবর্দ্ধনগোপালের বই থেকে ইংরেজি অংশটুকু তুলে দিচ্ছি : In North America the black bear was seen by Heame swimming for hours with widely open mouth, thus catching, like a whale, insects in the water. Even in so exteme a case as this, if the supply of insects were constant, and if better adapted competitors did not already exist in the country, I can see no difficulty in a race of bears being rendered by natural selection, more and more acquatic in their structure and habits, with larger and larger mouths, till a creature was produced as monstrous as whale. ডারউইন তার অরিজিন অব স্পিসিজ বইয়ের প্রথম সংস্করণে (২৪ নভেম্বর, ১৮৫৯) এরকম বলেছিলেন, হিয়ামের ভ্রমণকাহিনী থেকে জেনেছেন, ঐ অভিযাত্রী উত্তর আমেরিকায় ভালুককে পানিতে নেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে মুখ হাঁ করে শিকার ধরতে দেখেছেন ডারউইন তিমিরও একই ধরনের শিকার ধরার পদ্ধতি লক্ষ্য করেছেন। তিনি এও বললেন, ভালুক জাতীয় কোনো প্রাণী থেকে তিমির বিবর্তন হয়ে থাকে তবে তিনি খুব একটা বিস্মিত হবেন না। অরিজিন অব স্পিসিজ-এ ডারউইনের এ মন্তব্যের কারণে তার বন্ধুমহলে এবং বৈজ্ঞানিকমহলে তীব্র হাস্যরস এবং তীর্যক মন্তব্য করা হয়। ফলে ডারউইনকে অরিজিন অব স্পিসিজ-এর পরবর্তী সংস্করণগুলোতে এ মন্তব্যটি বাদ দিয়ে দিতে হয়। আণবিক জীবিজ্ঞানের বদৌলতে তিমি-ডলফিনের গ্রোথ হরমোনের জিন সিকুয়েন্স বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী তিমি-ডলফিনের ডিএনএ সিকুয়েন্সে শতকরা ৯৯ ভাগ সাদৃশ্য রয়েছে। কিন্তু এদের একটা আরেকটার সরাসরি পূর্বপুরুষ নয়। বরং এরা একই পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভূত। প্রাণীজগতে তিমি-ডলফিনের নিকট আত্মীয় স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে জলহস্তী, যার সাথে তিমি-ডনফিনের ডিএনএ সিকুয়েন্সের মিল শতকরা ৯৭ ভাগ। জলহস্তীর সাথে তিমির যেমন আণবিক পার্থক্য অত্যন্ত কম তেমনি বাহ্যিক শরীরের আকৃতিতে পার্থক্যের পরিমাণ কম। পূর্বে প্রত্ন-জীববিজ্ঞানী এবং আণবিক জীববিজ্ঞানীদের বক্তব্য ছিল মাংসাশী খুরযুক্ত এক সময়কার স্থলচর স্তন্যপায়ী থেকে তিমির বিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক্রিয়েশনিস্টরা সবসময়ই জৈববিবর্তন-বিজ্ঞানীদের বক্তব্য বিকৃত করে উপস্থাপনে পারঙ্গম। তিল বললেই তালের কথা বুঝে যায়! খুরযুক্ত প্রাণীর কথা বলতেই ক্রিয়েশনিস্টরা প্রচার করা শুরু করলো, ডারউইন একসময় বলেছেন ভালুক থেকে তিমির বিবর্তন ঘটেছে আর এখন বিজ্ঞানীরা আগের অবস্থান থেকে সরে এসে বলছেন গরু থেকে তিমির উদ্ভব হয়েছে!! গোবর্দ্ধনগোপাল বাবুও তার গুরু আইডিওয়ালা ক্রিয়েশনিস্টদের কাছ থেকে ‘গরু থেকে তিমি উদ্ভব’ তথ্যটি ধার করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে বগল বাজিয়েছেন একচোট। তিনি বোধহয় জানেন না বা জানার সুযোগ হয়নি গরু যে মাংসাশী প্রাণী নয় এ বিষয়টি তার নিজের গুরু ক্রিয়েশনিস্টরা বেমালুম চেপে গিয়েছিলেন এবং জীববিজ্ঞানীরা কখনোই বলেননি তৃণভোজী গরু থেকে তিমির উদ্ভবের কথা। আর গরু ছাড়া কি কোনো প্রাণীর পায়ে খুর নেই!! শুকর, জলহস্তি, ঘোড়া, উট ইত্যাদি প্রচুর প্রাণীর পায়েই আঙুলের বদলে খুর রয়েছে। যাইহোক, বর্তমানকালের বেশিরভাগ জীববিজ্ঞানীই মনে করেন প্রাণীজগতে তিমির গ্রুপটি বিবর্তিত হয়েছে জলহস্তী-শুকরের বংশপুরুষ artiodactyls থেকে। (আগ্রহীরা পাঠ করুন ব্রিটিশ বংশগতিবিদ স্টিভ জোন্সের লেখা Almost Like a Whale: The ‘Origin of Species’ Updated এবং Darwin’s Ghost: The Origin of Species Updated বই)। এছাড়া গরুর সাথে তুলনা করে তিমির বিশাল আকৃতি নিয়ে গোবর্দ্ধনগোপাল যা যা বলেছেন, তার ব্যাখ্যা বতর্মানকালে বিবর্তনীয় বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান (Evolutionary Developmental Biology) খুব পরিস্কার করে দিয়েছে। এ বিষয়েও জানার জন্য বাজারে পর্যাপ্ত বই রয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায়, আমরা মানুষেরা প্রায়শ আমাদের সাপেক্ষে কোনো কিছুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা বিবেচনা করি। এটা আমাদের সাধারণ অভ্যাস। পৃথিবীতে তিমি একমাত্র বিশাল আকৃতির প্রাণী নয়। বিশাল দেহের অনেক প্রাণী যেমন ডায়নোসর, ম্যামথ ইত্যাদি অতীতে ছিল, বর্তমানেও যেমন বিশাল আকৃতির হাতি, জিরাফ আছে আবার অতিক্ষুদ্র অণুজীব ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া জীব রয়েছে যাদের খালি চোখেও দেখা যায় না। উদ্ভিদের মধ্যে বট গাছের মতো বিশাল দেহের অধিকারী বৃক্ষ যেমন আছে, তাল গাছের মত লম্বা এবং তেমনি আম-জাম-কাঠাল গাছের মতো মাঝারি সাইজের উদ্ভিদও আছে, অতিক্ষুদ্র জলজ শৈবাল রয়েছে যাদের আবার খালি চোখে দেখা যায় না। অর্থাৎ আমি এটাই বলতে চাচ্ছি জীবের বিশালকার, মাঝারি আকার কিংবা অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকার এসবই জীবজগতের বৈশ্বিক বাস্তবতা। ভ্যারিয়েশন। অপ্রাকৃত বা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জীববিজ্ঞানীদের মতে কোনো জীব শুধুমাত্র আকৃতির পরিবর্তনের ফলেই বিশাল আকার বা ক্ষুদ্রাকার দেহ লাভ করেনি। প্রাণী বা উদ্ভিদের দৈহিক আকার ব্যাখ্যায় ঐ প্রাণীর জীবনকাল, বিপাকক্রিয়া, খাদ্যাভ্যাস, খাদ্যের পর্যাপ্ততা, ইকোলজি, চলাচলের সমতা ইত্যাদি বিবেচনায় নেয়া হয়। এ বিষয়ে জানতে আগ্রহীরা পাঠ করুন : John Tyler Bonner এর লেখা Why Size matters: From Bacteria to Blue Whales বইটি।

৫. ১৬১ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে জিরাফ পেল তার ল…….ম্বা…. গলা’ অংশে জৈববিবর্তনের নাম করে ভ্রান্ত বক্তব্য পরিবেশন করা হয়েছে উদ্দেশ্যমূলকভাবে। ডারউইনের নামে এখানে যা বলা হয়েছে, তা ল্যামার্কের বক্তব্য। জীবের বিবর্তন সম্পর্কে ডারউইনের সঙ্গে ল্যামার্কের বক্তব্যের প্রচুর পার্থক্য রয়েছে। এই পার্থক্যের বিষয়টি সম্মানিত লেখক গোবর্দ্ধনগোপাল কি অবগত ছিলেন না? না-কি ইচ্ছেকৃতভাবেই ম্যানুপুলেশন করা হয়েছে। জিরাফের লম্বা গলা সম্পর্কে ল্যামার্ক-ডারউইনের আলাদা আলাদা দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাখ্যা রয়েছে যুক্তি’র তৃতীয় সংখ্যার (জানুয়ারি, ২০১০) ৫৩-৫৫ পৃষ্ঠায়। তাই এখানে আর পুনরুল্লেখ করলাম না।

৬. ১৬৫ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে মাছ হাঁটতে শুরু করেছিল ডাঙায়’ অংশে আবারো জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অজ্ঞতাই পেয়েছে। জীববিজ্ঞানীরা কখনোই দাবি করেন না, এক বা একাধিক মাছ একদিন বা দুইদিনেই কোনো জলে উঠে উভচর বা সরীসৃপে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। সিলাকান্থ, লাঙফিস, মাডস্কিপার মাছের নাম জানা থাকলে এদের বৈশিষ্ট্য জানার চেষ্টা করুন। মাছ থেকে উভচর জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে অনেক কিছু বুঝতে পারবেন।

৭. ১৬৫ পৃষ্ঠায় ‘কিভাবে উদ্ভব হল পাখির : পেঙ্গুইন পাখা মেলেছিল আকাশে’ অংশে আবারো পূর্বের কথা বলতে হচ্ছে। জৈববিবর্তন তত্ত্ব অনুসারে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকে পাখি এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব ঘটেছে। আধুনিক গবেষণার মাধ্যমে কোন জাতীয় সরীসৃপ থেকে পাখির উদ্ভব তা অনেকাংশেই নিশ্চিত করা বলা সম্ভব হচ্ছে। ছোট আকারের থেরাপড ডায়ানোসর থেকে পাখির উদ্ভব ঘটেছে। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত জীবাশ্ম প্রমাণ জীববিজ্ঞানীদের কাছে রয়েছে। জীবাশ্ম-প্রমাণ একটি-দুটি নয়। শুধুমাত্র আর্কিওপটেরিক্স প্রজাতির পাখির পূর্বপুরুষের ফসিল ১৮৬০ সাল থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে নয়বারে প্রচুর পরিমাণে ফসিল পাওয়া গেছে। এছাড়া চীনের লায়নিং প্রদেশে ১৯৯৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বহুবার পাখির পূর্বপুরুষের ফসিল পাওয়া গেছে। এসব ফসিলের অভ্যন্তরীণ গঠন, ডিএনএ টেস্ট, এনাটোমিক্যাল টেস্ট থেকে খুব স্পষ্টভাবে থেরাপড ডায়নোসর থেকে পাখির বিবর্তনের বিষয়টি ফুটে উঠেছে। কেউ যদি বিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণা সম্পর্কে ইচ্ছেকৃতভাবে জানতে না চায়, উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুজে বসে থাকতে চায় সে স্বাধীনতা অবশ্যই তার আছে। কিন্তু বিজ্ঞানের কোনো বিষয়ের বিরোধিতা করতে হলে অবশ্যই যাচাই করে নেয়া ভাল, সর্বশেষ গবেষণা থেকে কি জানা গেছে। কারণ বিজ্ঞান স্থির কিছু নয়। বিজ্ঞান কখনো নিজেকে অপৌরষেয় দাবি করে না। এটি পরিবর্তনশীল। নিত্যনতুন গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞান নিজেকে ঋদ্ধ করছে।

৮. ১৬৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ‘এক প্রজাতি রূপান্তরিত হয়ে অন্য প্রজাতি : সত্যি না গল্প’ অংশ পাঠ করে মনে হয়েছে লেখক প্রজাতির সংজ্ঞা সম্পর্কেই অবগত নন। প্রজাতির সংজ্ঞা হচ্ছে, এটি এমন একটি প্রাকৃতিক জীবগোষ্ঠী, যার সদস্যরা নিজেদের মধ্যে প্রজনন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে, যাদের সকলের আছে সাধারণ জিন ভাণ্ডার এবং অনুরূপ অন্য আরেকটি প্রাকৃতিক জীবগোষ্ঠী থেকে প্রজননের দিক থেকে বিচ্ছিন্ন। এ সংজ্ঞাটি যৌনজননশীল উদ্ভিদ-প্রাণী উভয়েরই ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বর্তমানে মানুষের যেহেতু অন্য প্রজাতি টিকে নেই, তাই মানুষের উদাহরণ টানলে অনেকেই এ বিষয়টি বুঝতে উঠতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ ফিঞ্চ পাখির প্রসঙ্গ এখানে নিয়ে আসি। আমরা জানি বর্তমানে ফিঞ্চ পাখির ১৪টি প্রজাতি আছে। এর মধ্যে যে কোনো দুটি প্রজাতির কথা ধরা যাক। Geospiza fortis এবং Geospiza magnirostris । ফিঞ্চ পাখির ১৪টি প্রজাতির সকলের নাম ফিঞ্চ। কিন্তু এরা প্রজাতিতে ভিন্ন। ভিন্নতা কিসে? ভিন্নতা হচ্ছে Geospiza fortis প্রজাতির ফিঞ্চ পাখিরা নিজেদের মধ্যে প্রজনন সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এর ফলে এদের প্রজননে সম বংশধর জন্ম নেয়। এরা আবার একই প্রজাতির অন্য সদস্যদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। এভাবে Geospiza fortis প্রজাতির জিনের আদান-প্রদান চলতে থাকে। কিন্তু Geospiza fortis প্রজাতির ফিঞ্চ পাখিরা Geospiza magnirostris প্রজাতির ফিঞ্চদের সাথে যৌনসম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না। জিনের বিনিময় হয় না। তাই উভয়েই স্বতন্ত্র প্রজাতি। বর্তমানে পৃথিবীতে বাঘের ৬টি প্রজাতি টিকে আছে। গত শতাব্দী পর্যন্ত নয়টি প্রজাতি ছিল। যাহোক, বাঘের যে কোন একটি প্রজাতির সাথে অনেক সময় সিংহের কোনো এক প্রজাতির প্রজননের মাধ্যমে লাইগার নামক বাচ্চা জন্ম নেয়। আবার গাধা এবং ঘোড়া থেকে খচ্চর। লাইগার বা খচ্চর কেউই প্রজননে সম নয়। এরা সংকর জাত। অর্থাৎ তারা যদিও ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতি থেকে যৌন মিলনের ফলে জন্ম নিয়েছে ঠিকই তবে এরা নিজেরা প্রজননে অম থাকে। তারা কোনো বংশধর রেখে যেতে পারে না। অর্থাৎ এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতিতে প্রজননে বিচ্ছিন্নতাই প্রজাতির সংজ্ঞার বৈশিষ্ট্য। এখন প্রশ্ন দেখা দেয়, প্রজনন-বিচ্ছিন্নতা যদি প্রজাতি থেকে প্রজাতি থাকে তবে তবে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব হয় কিভাবে? এটাই জৈববিবর্তনের সেন্ট্রাল অংশ। জীববিজ্ঞানীরা প্রকৃতিতে প্রজাতির উদ্ভবের চারটি পদ্ধতির কথা আমাদের জানিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে : Allopatric, Peripatric, Parapatric, Sympatric । জানার আগ্রহ থাকলে জীববিজ্ঞানের বই থেকে এ বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নিতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, প্রজনন বিচ্ছিন্নতা জীবজগতে পার্মানেন্টলি কনস্ট্যান্ট নয়। ধ্রব হলে তো নতুন প্রজাতির উদ্ভব হতো না। প্রায়ই বিভিন্ন দেশের জীববিজ্ঞানীরা কৃত্রিম নির্বাচনের মাধ্যমে এক প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির উদ্ভব ঘটাচ্ছেন। যেমন বাংলাদেশে কৃষিবিজ্ঞানীরা বিরি নামে নতুন প্রজাতির ধান উদ্ভাবন করেছেন, এ খবর সবাই জানেন। বিরি নতুন প্রজাতির ধান মানে কি? মানে হচ্ছে, কৃষিবিজ্ঞানীরা বিরি নামক প্রজাতির ধান ক্রসব্রিডিং করে অন্য প্রজাতির ধান থেকে উদ্ভাবন করেছেন। ধরে নিচ্ছি এর নাম ইরি-৪৭। এখন ইরি-৪৭ এবং বিরি-৪৬ প্রজাতির ধান গাছের ক্রসব্রিডিং বা সহজ বাংলায় বলা যায় যৌনসম্পর্ক স্থাপন করালে কোনো ফলন হবে না। শুধু নতুন প্রজাতির ধান গাছ নয়, বিভিন্ন ধরনের খাদ্যশষ্য, রবিশষ্য, ফলের নিত্যনতুন প্রজাতি তৈরি করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। এছাড়া মানুষ নিজে কুকুর, বিড়াল, ছাগল, গরু, কবুতর, ফলের মাছি প্রভৃতি জীবের নতুন প্রজাতি উদ্ভাবন করেছে। তাই এক প্রজাতি থেকে নতুন প্রজাতির উদ্ভব একদম অবাস্তব বা অতিকল্পনা নয়।

৯. ভিতরে প্রতিটি পৃষ্ঠায় প্রচুর ভুল তথ্যে ঠাসা। আমি এতো আলোচনায় আপাতত যাচ্ছি না। এখন দেখা যাক ১৮৫ পৃষ্ঠা। শিরোনাম ‘চান্স ভ্যারিয়েশন ফ্যাক্টরের অদ্ভুত কারসাজি’। লেখা রয়েছে ‘ডারউইনের মতে প্রজাতির উদ্ভবে ‘চান্স ভ্যারিয়েশন ফ্যাক্টর বা দৈবক্রমে সংঘটিত প্রকরণ তত্ত্ব এক বিশেষ ভূমিকা পালন করে।’ ভুল বক্তব্য। ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞতা নাকি ইচ্ছেকৃত চালাকি? ডারউইন কখনোই এমনটা দাবি করেননি। ভ্যারিয়েশনের উদ্ভবের প্রক্রিয়া ‘মিউটেশন’ সম্পর্কে ডারউইন মোটেই জানতেন না। সেখানে দৈবক্রমে বা অদৈবক্রমে আবার কি? ডারউইন সম্পর্কে এমন দাবির পর যা বলা হয়েছে তা প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্পর্কে ভুল ব্যাখ্যা আর অজ্ঞতার মিশেল। জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়া সম্পর্কে এমন ভ্রান্ত ধারণা (চান্স ভ্যারিয়েশন ফ্যাক্টর) দাঁড়িয়ে আছে মিউটেশন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যেকার পার্থক্য সম্পর্কে অজ্ঞতার উপর। জৈববিবর্তনের ‘কাঁচামাল’ বিপ্তি-আকস্মিকভাবে সংঘটিত মিউটেশন থেকে একক জীবে ভ্যারিয়েশনের উদ্ভব হয় কিন্তু জীবের গোটা বিবর্তন প্রক্রিয়াটি মোটেও চান্স আর র্যান্ডমের কারসাজি নয়। পরিবেশের সাথে অভিযোজনম ভ্যারিয়েশন বা প্রকরণ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বংশধরের মাধ্যমে প্রজাতি বা জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ার এ বিষয়টি মোটেও র্যান্ডম বা আকস্মিক, বিপ্তি কিংবা দৈবক্রমে ঘটা কোনো ঘটনা নয়। এটি চূড়ান্ত (deterministic) একটি প্রক্রিয়া। পরিবেশের জন্য উপযুক্ত ভ্যারিয়শনসম্পন্ন জীব অধিক হারে বংশধর রেখে যেতে পারে, আর অনুপযুক্ত ভ্যারিয়েশনসম্পন্ন জীবের পরিবর্তিত পরিবেশে টিকে থাকা দায় হয়ে যায়, বিলুপ্তি ঘটতে থাকে ধীরে ধীরে। প্রকৃতিতে জীবজগতে ‘নির্বাচন’ ক্রিয়াশীল থাকে নন-র্যান্ডম, দৃঢ় ক্রমবর্ধমান (cumulatively) পদ্ধতিতে। রোমান সভ্যতা যেমন একদিনে তৈরি হয় নি, উত্তর- দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের বরফ যেমন তাৎণিকভাবে উদ্ভূত হয় নি, তেমনি প্রাকৃতিক নির্বাচন-ও তাৎণিক কোনো ঘটনার ফল নয়, নয় ইতঃস্তত, বিক্ষিপ্ত চান্সের কোনো খেলা। জীবের বিবর্তন প্রক্রিয়াটি রূপ পায় হাজার থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন প্রজন্মের মাধ্যমে।

১০. এরপরও মিথ্যার মিশেল চলমান। আমাদের এখানের কাস থ্রি-ফোরের বাচ্চারা জানবে রক্তের রঙ লাল কেন? অথচ গোবর্দ্ধনগোপাল ২০৩ পৃষ্ঠায় বলতেছেন ‘হিমোগ্লোবিন বাতাস থেকে প্রাণদায়ী অক্সিজেন ধারণ করে কোষ কলায় পৌঁছে দেয় এর জন্য রক্তের রঙ লাল।’ লোহিত কোষের মধ্যে রয়েছে হিমোগ্লোবিন, যার মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন পৌঁছে যায়। হিমোগ্লোবিন (haemoglobin) শব্দের হিম লোহার একটি যৌগের নাম আর গ্লোবিন হল এক ধরনের প্রোটিন। লোহার এই যৌগের বিরাট সংখ্যায় উপস্থিতির জন্য রক্তের রঙ লাল দেখায়। আরেকটু বলা যায় রক্তের সাথে লৌহিতকোষের অভিযোজনের বাই-প্রোডাক্ট বা উপজাত হিসেবে রক্তের রঙ লাল। অর্থাৎ জীবদেহে রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন পৌঁছে যায়, সেটা অন্য ফাংশন।

চলবে…