লিখেছেনঃ মুহাম্মদ মেহেদী হাসান

হাজার বছরের পোড় খাওয়া পৃথিবীটার সমস্ত প্রাচীনত্বের মাঝে আমার অর্বাচীন চোখ দুটি দৃষ্টিশক্তির সর্বস্ব উজার করে দেখতে প্রাচীন সূর্যটার অস্তগামী শৈল্পিকতা। আমাদের বাড়িটাতে সূর্য ডোবার অনেক পরেও অন্ধকার নামতো না। গোধূলীর সমস্ত আভা বুজে আসার পরেও সূয্যিদৈত্ত যেন অপার বিলাত আমাদের বাড়িটার চারপাশে।
একেতো গ্রামের প্রথম বাড়ি ছিল এটি। তার উপর পাকা রাস্তা থেকে বেশ দূরত্বে কাঁচা রাস্তার অনেকটা মাড়াতে হতো বাড়ি পৌঁছাতে। স্বভাবতই কাঁচা মাটির রাস্তার দু’পাশ জুড়ে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত চোখে পড়তো শুধু ধানক্ষেত । সাথে কাঁচা-পাকা ধান পাতার ঢেউ দোলানো নয়ানাভিরাম দৃশ্যপট। অতি দূরে কিছু উঁচু ভিটে, কলা বাগান আর পানি তোলার মোটর ঘরগুলো ছাড়া চোখে পড়তো শিল্পীর তুলির মত একটা গ্রাম। বেশ দূরে হওয়ায় রাস্তার পুলটা থেকে দূর গ্রামের অবয়বটাকে ঠিক শিল্পীর তুলির আঁচড়ের বিশাল কোন ক্যানভাসই লাগতো। এ বিশাল উন্মুক্ত প্রান্তরটাতে তাই সন্ধ্যে নামতো সূর্য ডোবার খানিকটা পরেই।
নানা জাতের গাছ আর নানা আকৃতির বিশালতায় যখন অন্ধকার ছেয়ে ফেলতো গ্রামটাকে, তখন কানে বাজতো হাটুড়েদের ঘরে ফেরা আর তিন চাকার ভ্যানের ক্যাঁচ-ক্যাঁচানি। ভৌতিকতা কাটিয়ে ছোট ঝোপের আড়াল থেকে জোনাকগুলো হঠাৎ বের হতো কেরোসিন কুপির রাজত্ব খর্ব করতে। আবার ঈষৎ ঝিলিক দিয়ে দ্রুত লুকিয়ে পড়তো ঘিঞ্জি ঝোপ-লতার আড়ালে।
প্রতিদিনই খানিকটা দেরিতে সন্ধ্যা নামায় দিনের দূরত্বও যেন বোড়ে যেতো খানিকটা। অতিরিক্ত পাওয়া সময়টুকুতে তাই সকলের চলতো কাঁচা মাটিতে খোলা পায়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে আসার চর্চা। রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আবার হঠাৎই দুম করে নামতো সন্ধ্যা। তখন সদ্য আবাস ছাড়া জোনাকগুলোর পিছু ধাওয়া করতে করতে দ্রুত ফুরিয়ে আসতো সদর দরজার দূরত্বটুকু।
ভৌতিক অন্ধকার চিঁড়ে গায়ে লাগতো চোখ বুজে আসা বাতাস। বাড়ির উত্তর দিকের নয়াদিঘীর পাড়ের বিশাল গাব গাছটিতে তাকালে ছম্ ছম্ করে উঠতো। লম্বা আঁচল ছড়িয়ে পাট চুলের কোন লিকলিকে বুড়ির শুকনো অবয়ব যেন ভ্রম ধরিয়ে দিত আমাদের। ভয় অনেকটা জোঁকের মত কামড়ে থাকতো। এই ভয় তাড়ানোর উপায়ও কারো জানা ছিল না। গায়ে শিরশিরে অনুভূতি তাই ছিল নিত্য পাওনা। এমন কথা ছিল গাবগাছ পেলেই নাকি ভূত পেত্নিরা নিরাপদ জীবন যাপন শুরু করে।
বাড়ির পশ্চিম দিকটাও যে দখল করে রাখা যায়নি। প্রকান্ড আমগাছ, হাজার হাজার সুপুরি গাছের সারি, বেত আর বাঁশ ঝড়ের সমন্বয়ে সেদিক তো ছিল আস্ত ভূতুড়ে রাজ্যই। উত্তর-পশ্চিম ভুলে তাই দক্ষিণের খোলা দিগন্তের দিকেই চাইতাম প্রকৃতির বিশালত্ব ধরার জন্য। পূর্ব দিকের পুকুর পাড়ের মেহগনি গাছটা অনেকটা আড়াল করে দাঁড়ালেও চোখ যেতো দূর-দূরান্ত পর্যন্ত।
বর্ষাকালে এই ধানক্ষেতগুলোই আবার ডুবে যেতো পানিতে। বন্যার পানি কখনও বাড়ির কানা পর্যন্ত ছুঁয়ে যেত। শাপলা, কচুরি পানা, আর হরেক দেশী মাছের আনাগোনায় ভরে থাকতো অন্তত দেড় দুই মাস। কোমড় জল, কোথাও বা হাঁটু জল, তবুও অথৈ জলের দিব্যি প্রদর্শনী দেখাতে প্রতি বছরই আসে সেই বর্ষা। সদ্য ভরে যাওয়া ডোবাগুলোতে পাট গাছের পঁচুনি গন্ধ যেন চুম্বুক টানে নিয়ে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছেদের। আর বিশাল কলাগাছের ভেলাতে চড়ে দিব্যি সাগর অভিযানের তৃপ্ততার সাথে সওদা করতাম আমরা।
এবারের বর্ষাটা যেন একটু দ্রুতই এসে পড়লো। একদা বিকেলে দাদাজানের হাতে প্রকান্ড দুইটা রামদা দেখে অবাক হলাম। কিন্তু চোখের সামনে বিশাল কলাগাছের ভুপাতিত হওয়ার দৃশ্য দেখে বুঝতে বাকি রইলো না বন্যা আসন্ন। সদ্য কাটা ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে যেইনা অবাক হব দেখি দাদাজান আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট হাসছেন। সকালে স্কুল থেকে ফেরার সময়ই তো শুকনো ছিল তেগুলি। দাদাজানের চাহনিতেই বুঝতে বাকি থাকে না আজ রাতেই বন্যার জল এখন বাড়ন্ত হবে যে উঠোনের কোনা পর্যন্ত ছূঁয়ে ফেলতে পারে।
চৌদ্দ পুরুষের কোন গাড়ি-ঘোড়া না থাকলেও বছরে একবার এই ভেলা আমাদের কাছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির তরী হয়ে আসে। ছোটবেলায় সুপুরির খোলের এক জাতীয় টেনে চলা গাড়ি অবশ্য আমাদের ছিল। তবে তা নিতান্তই দাদীর হাতপাখা বানানোর সাধে জল ঢেলে। অনেকটা তাকে মনক্ষুন্ন করে আদায় করা। তবে সমবয়সীর সংখ্যা কম থাকায় তাতে অনেকটা সময় শুধু বসেই কাটাতে হত। নিতান্তই কাউকে পাওয়া গেলে বলে-কয়ে দশ-বিশ হাত টানানো যেত আরকি।
দাদীর হাতপাখার যখন প্রায় বারোটা বাজা সারা তখন তাঁর হঠাৎই মনে পড়ে, “আরে এটা তো চুলা জ্বালাতে লাগবে।”
অগত্যা কী আর করা!
দ্বিতীয়বার তাঁকে মানাতে না পেরে ছেড়ে দিতে হয় সুপুরি খোলের রাজত্ব। তখন আমার অবস্থা হয় অনেকটা সিংহাসন হারা রাজার মত। দুনিয়াতে এত কিছু থাকতে উনুন জ্বালাতে এটিই কেন তাঁর চাই আজও বুঝে উঠতে পারি না। জিনিসটা যে কত আরাধ্যের তা কী তিনি বুঝেন না? অবশ্য আমার ধারণা বুঝে শুনেই তিনি লেগে পড়েন স্রেফ, “বেশ হয়েছে আর নয়” রাজত্ব কায়েমের জন্য।
একে তো খোলটা নিয়ে ফিরবেন। তার উপর মরার উপর খরার ঘা গয়ে আসে বকুনি। খোলের গাড়ি চলার সময় উঠানের আলগা মাটি যে সমানভাবে সরে যেয়ে মসৃন রান্তা বানিয়ে দেয় এতেই তাঁর আপত্তি। ঝাড়া উঠোনটা নষ্ট করে যেন মহা অন্যায় হয়ে গেছে।
অগত্যা কী আর করা আসমানমুখী সুপুরি গাছগুলোকেই অভিযোগ জানাই। পরের ঝড়ো বাতাসে আর যাই হোক সুপুরি খোল যেন এ মর্তে না ঝড়ে।
গ্রীষ্মে তাও একটু আধটু গোল্লাছুট আর আধা ছেড়া একটা বলই খেলার সঙ্গী। যে বলের কোন কোন দিক দিয়ে আবার ছেড়া আবরন ভেদ করে আলুর মত করে পেট বেরিয়ে পড়ে। অসতর্কতায় কখনও যদি সেটি লেবু গাছটার দিকে উড়ে যায় তো সারা! চুপসানো টুপির আকৃতির বল নিয়ে ছুটতে হয় রিক্সা মেকানিকের কাছে। কখনও রিক্সা চাকার টিউবের মত দু’চারটা ব্যান্ডেজ লাগিয়ে আবার লেবু গাছের ভয়ে বাড়িতে ফেরা।
আর বর্ষাকালে তো না যায় বল খেলা। না টানা যায় সুপুরি গাছের খোল। পাট ডান্ডি কেটে পাশা খেলা কিংবা দাবার গ্রাম্য সংস্করণ ষোল গুটি সাত গুটিই তখন একমাত্র ভরসা। তাও ওসব আবার বড়দের কিংবা উচ্ছন্নে যাওয়া কাজহীনদের খেলা হয়ে ওঠে পুরোটা বর্ষার একমাত্র সঙ্গী।
ভেলা বানানোর কয়েকদিন আগেই অবশ্য সেই ভূতুড়ে গাব গাছ থেকে গাব পেড়ে আনা হয়। বিশাল বালতিতে সেই গাব থেঁতলে পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় কয়েকদিন। বর্ষা উপলক্ষে বছর ধরে বোনা দাদাজানের সাধের জালটাতে অবশেষে সেই গাব রস মাখানো হয়। অনেকটা যুদ্ধে যাবার পূর্বের রনপ্রস্তুতির মত।
গাবের রস জালে মাখার ফাঁকে ফাঁকে দাদাজান আকাশের দিকে তাকান। মাঝে মাঝে দুই একবার গলা খাকরি দেন। আমার দিকে আড়চোখে তাকান কতকবার। যেন আমার মনের উৎফুল্লতা ধরতে চান।
আমার দাদাজানের অনেক টাকা-পয়সা ছিল না। তবে দিল দরিয়াতে তাঁর কোন কমতি ছিল না। বর্ষাকালে শুকনো পাট বোঝাই ভ্যানের পিছু পিছু ছুটতো দাদাজানের মান্ধাতার আমলের সাইকেল খানা। আর তাঁর পিছনের বসার জায়গাটাতে পাছায় আস্ত বটিতে বসার আতঙ্ক নিয়ে উসখুস করতাম আমি। দাদাজান মাঝে মাঝে ঘাড় সামান্য কাত করে হাঁক দিতেন-
পা দুইখান ফাঁক কইরা রাখ। নয়তো চাকার মইধ্যে ঢুইকা যাইবো। শ্যাসে তোর মায়ে আবার কইত পোলাডারে নিয়া গিয়া মারছিলোই প্রায়।
এদিকে দাদার কথার মাঝে অসাবধানতায় সাইকেল পাকারাস্তা থেকে ভাঙ্গা ইটের উপর নামা সারা। আর ঝাকুনিতে আমার পাছার বারোটা বাজা সারা।
তবে পাট বিক্রি শেষে যখন মিষ্টি দোকানে বসাতেন দাদাজান, তখন সব কষ্ট ভুলে বসতাম।
বানানো ভেলাটা পুকুর পাড়ের হেলানো ডুমুর গাছটার সাথে বেঁধে রেখে দাদাজান যখন ঘুমাতে যান। আমার ঘুম তখন নাই বললেই চলে। কখন ভোর হবে আর দেখবো দাদাজান ভেলায় চড়ে ডাকছেন।
আয় আয় তোর লাইগাই বইসা আছি। বেলা কতখানি হইল আর তোর দেখি বিছানাত্ থন ওঠার নামই নাই।
ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মাঝে আচমকা একটু বেশি নড়তে থাকি হয়তো। স্বপ্নে যে তখন ভেলায় ভাসছি। ভেলার মাঝে বসে আছি। কিছুটা ভয় নিয়ে। দাদাজান পিঠের কাছে দাঁড়িয়ে মসৃন চিকন বাঁশটা দিয়ে বৈঠা চালাচ্ছেন। ভেলা একটু নড়লেই ঘাড় সামান্য কাত করে দাদাজানের দিকে তাকাচ্ছি। দাদাজান আমার আতঙ্ক বুঝতে পেরে বলে ওঠেন, ভয় নাই আমি আছি না।
দাদাজানের কথায় সাহস ফিরে পাই। আবার ভেলায় ভাসার আনন্দে বুদ হয়ে যায়। দাদাজান ভেলার গতি কমিয়ে একটি কচুরি ফুল তুলে দেন। দূরে একটি লাল শাপলা দেখতে পাই। লাল শাপলা দাদাজানেরও চোখ এড়ায় না।
দাদাজান নিজ থেকেই বলেন ফিরতি পথে খেয়াল করিস তুইলাদিব নি। আমি মাথা দোলাই।
দাদাজান নিজে নিজে পরিকল্পনা করেন, কোথায় কোথায় ডারকি পাততে হবে, কোথায় কোথায় জাল। পরিকল্পনার কিছু কিছু জোরে জোরে বলেও যান। খালের কাছাকাছি এসে দাদাজান প্রায় পুরো বাঁশটা ডুবিয়ে পানির গভীরতা মাপেন। অস্ফুটস্বরে বলেন, কাল অবধি পানি তো দেড় দুই হাত বাইড়া যাইতে পারে।
আমি দাদাজানের কাছে জানতে চাই, তাহলে কী রাস্তার উপর পারি উঠে পড়বে? তাহলে তো স্কুলে যেতে সমস্যা হবে।
দাদাজান আমার মনের কথা বুঝতে পারেন। আসলে স্কুলের চিন্তা নয়। ভেলায় ভাসার সুযোগ হবে কী না তাই যে জানতে চাচ্ছি। দাদাজান উত্তর করেন না।
আমি অপেক্ষা করি। অস্ফুটস্বরে আবার বলে উঠি-
স্কুল , স্কুল, স্কুল—–
মায়ের ডাকে ঘুম ভেঙ্গে যায়। উঠে পর, অনেক বেলা হয়ে গেছে। স্কুল যাবি না। সুন্দর স্বপ্নটাতে জল ঢালার জন্য মা’র প্রতি রাগ হয়। মনটাও খারাপ হয়ে যায়। দ্রুত তৈরী হয়ে বাড়ির বাইরে আসি। যদি রাস্তাটা ডুবে যায়। যদি ভেলায় ভাসা হয়।
নাহ্, পানি খুব একটা বাড়েনি।
মনটা আরও খারাপ হয়ে যায় যখন দেখি এই সামান্য পানিতেই দাদাজান ভেলা ভাসিয়ে ডারকি পাততে গেছেন। দাদাজানের উপর সামান্য রাগ হয়। কিন্তু এ যাত্রায় স্কুল না যেয়ে উপায় থাকে না।
স্কুলে সকল ভাবনা জুড়ে থাকে দাদাজান, ভেলা, আর ভেলা। বারবার চোখে ভেসে ওঠে দাদাজান ভেলার উপর। আর আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে হ্যাবলার মত তাকিয়ে আছি। কদিন পরেই স্কুল বন্ধ হবে। দেখি দাদাজান কয়বার আমার চোখ এড়িয়ে ভেলায় ভাসেন। দিন-রাত পাহারা দিবো। ভাবনার মাঝেই ঘন্টা পড়ে যায়। নতুন ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু ভেলা আর দাদাজান শব্দ দুটো চেপে রাখতে পারি না।
বাড়ি ফিরে দেখি দাদাজান গরু চড়াতে গেছেন। কখন বাড়ি আসেন তারও ঠিক নাই। মনটা আরও খারাপ হয়ে যায়। ভেলাটার পাশে গিয়ে ঘুরঘুর করি। দেখি একটা ব্যাঙ ভেলার উপর বসে আছে। ব্যাঙটার উপর ভীষণ রাগ হয়। একটা মাটির ঢেলা তুলে নিয়ে ব্যাঙের দিকে ছুঁড়ে মারি। নাহ্, ব্যাঙের গায়ে লাগে না। তবে ব্যাঙটা পানিতে লাফিয়ে পড়ে। ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়ি।
বিকালে ঘুম থেকে উঠে উঠেনের বাইরে দৌড় দেই। এবারও দাদাজানের দেখা পাই না। গোয়াল ঘরের ছাউনিটার নিচে গরু দুটোকে দেখা যায়।
দাদাজান তাহলে বাড়ি আসছিলেন। ঘুমানোর জন্য নিজের উপর প্রচন্ড রাগ হয়। পানি একদিনেই অনেক বেড়ে যায়। দাদাজান হাট করে ফেরেন। আমার জন্য গুঁড়ের বাতাসা নিয়ে আসেন। দাদাজানের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তবে বাতাসার লোভও সামলাতে পারি না। বাতাসা নেয়ার ধরন দেখে দাদাজান আমার মনের অবস্থা আঁচ করতে পারেন।
রাত্রে খাবার সময় দাদাজান আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে দাদিকে বলেন, কাল অবধি পানি রাস্তায় উঠে যেতে পারে। আমার তখন ভেলা ছাড়া স্কুল যাওয়া সম্ভব নয়। খুশি চেপে রেখে আমি দাদাজানের উপর রাগ করার অভিনয় করি। দাদাজান একবার আমার দিকে আড় চোখে চেয়ে দাদির দিকে চোখ রেখে মুখে এক ধরনের ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলেন। দাদি রুই মাছের বিশাল অখন্ড মাথাটা আমার পাতে তুলে দেন।
দাদাজান এবার গল্প ধরেন, এক ছিল দাদা আর নাতি। তারা একসাথে মাছ ধরতে যেত। প্রতিদিনই অনেক মাছ পাওয়া যেত। একদিন বাধলো বিপত্তি। মাছ হল অল্প। তার উপর বড় মাছ মাত্র একটা। রাত্রে খেতে বসে দাদা বলেন আজ মাথাটা আমি খাই। নাতির তো বয়স কম, বাকী জীবনে অনেক মাথা খাইতে পারবে। আমি আর কয়দিনই বা বাঁচবো। শুনে নাতি নাকি বলে দাদা তো অনেক মাছের মাথা খাইতে খাইতে এত বড় হইছেন। আজ মাথাটা আমিই খাই। বলতে বলতে মাথাটা নাতি নিজের পাতে নেন।
গল্প শুনতে শুনতে খেয়ালই করিনি যে দাদাজান কখন রুই মাছের মাথাটা নিজের পাতে নিযেছেন। হাসতে হাসতে এবার তিনি মাথাটা আমার পাতে তুলে দেন। আমারও হাসি পায়। দাদিও হাসতে থাকেন।
পরদিন সকালে পানি রাস্তা ছোঁয় না। আমারও ভেলায় চড়ে স্কুলে যাওয়া হয় না। তবে স্কুল থেকে ফিরে দেখি দাদাজান বাড়িতেই আছেন।
বিকালে রোদের তেজ কমে আসলে দাদাজান আমাকে ডাক দেন। আমি স্যান্ডেল পরেই দৌড় দিই।
দাদাজান বলেন, ভেলায় চড়বা না, যাও জুতো খুইলা রাইখা আস। আনন্দে আমার ভোঁ দৌড় দেখে দাদাজান চিৎকার করে ওঠেন।
আস্তে, আস্তে, পইরা যাইবা, হাত-পা ভাইঙ্গা ফেলবা তো।
আমি সাবধানে ভেলায় উঠে বসি। ভেলায় আগে থেকেই জাল, ডারকি রাখা। দাদাজান জানতে চান আমার স্কুল কবে। নিজ থেকেই বলেন রোজ দুইবার করে আমাকে ভেলায় ভাসাবেন।
দাদাজান আধা ফোটা একটা শাপলা ফুল পাশ কাটিয়ে চলে যান। আমি দাদাজানের দিকে চেয়ে হাত প্রশস্ত করি। কিন্তু সেদিকে দাদাজানের যেন খেয়ালই নাই। আমার আনন্দে ছেদ পড়ে। দাদাজান তবু ভ্রুক্ষেপই করেন না।
জাল, ডারকি পেতে দাদাজান এবার আমার দিকে নজর দেন। সাবধান করে দেন যেন পানিতে হাত না দেই। সাপ, পোকার ভয় দেখান। আমিও এদিক ওদিক হ্যাঁ সূচক মাথা দোলাই। কয়েকটা শাপলা, কচুরি পানা ফুল আমার হাতে ধরিয়ে দেন। নিজে ভেলা থামিয়ে উপুড় হয়ে পানির নিচে কাঁধ অবধি তলিয়ে দেন। আমার রাগ হয়। আমাকে মানা করে আবার নিজে পানিতে হাত দিছেন বলে?
তবে মুঠো ভরে শালুক আর পানি সিঙ্গারা যখন তুলে আনেন আমার আনন্দের সীমা থাকে না। পালাক্রমে দীর্ঘ দূরত্ব চক্কর দিয়ে বার কয়েক থেমে শালুকে ভরিয়ে ফেলেন ভেলার উপরটা। আমার মনে হয় দাদাজানের হাতে যেন জাদু আছে। যেখানেই হাত ডোবান সব যেন শালুক হয়ে যায়।
দাদাজান জানে আমি সাঁতার জানি না। পানি খুব গভীর নয়। তবুও অনাকাঙ্খিত কোন দুর্ঘটনা এড়াতে তিনি সদা সাবধান থাকেন। দাদাজান মাঝে মাঝে সেঁচা দিয়ে কাচুরিপানা নিংড়ে টোকরাই জমাতে থাকেন। মাঝে মাঝে হাঁক দেন, টোকরাইগুলান খলাইটার মাঝত থো তো। তোর দাদীর নয়া হাঁসের বাচ্চাগুলানক খাবার দিবে এহন। টোকরাই খায়া হাঁসের বাচ্চাগুলান নাদুস-নুদুস হয়া উঠতো।
বর্ষা এলেই দাদী হাঁসের ডিম ফোটাতে দেন। কী করে যেন বোঝেন বর্ষা আসন্ন। দিন গুনে এমনভাবে ডিমে তা দেয়ার ব্যবস্থা করেন যেন ডিম ফুঁটে বাচ্চা না হলে বর্ষা আসবেই না।
প্রতিবারই আমার মনে হয় এবার বাচ্চা বেরোতে বেরোতে বর্ষা চলে যাবে। কিন্তু অবাক করে ঠিক বর্ষার মাঝেই ডিম ফেটে বাচ্চা বের হয়। আর পুরো বর্ষা জুড়ে অল্প পানিতে বাচ্চাগুলো থই থই নাচতে থাকে। এসময় শামুকের ভিতরের অংশটুকু যেন বাচ্চাগুলোর বাড়ন্তের ডাক বয়ে আনে।
আমি সদ্য জন্মানো হাঁসের কচি বাচ্চাগুলোর খাওয়ার দৃশ্য ভাবতে ভাবতে শামুকগুলো খলাইয়ের মাঝে তুলে রাখি।
দাদাজান আবার হাঁক দেন জলদি করে। টোকরাইগুলান পানিত নামে গেলো তো।
আমি হাত চালাতে থাকি। খলাইয়ের মাঝে শামুকগুলোর একটার সাথে আরেকটার সংঘর্ষে টুং টুং করে শব্দ হয়ে।
সন্ধ্যা থামতে থাকে। ডুবন্ত সূর্যের আভায় পানির রঙ বদলে যায়। সোনালী আভায় পানিও সোনাবরন ধারন করে। দাদাজান দু’এক জায়গায় জাল উঠিয়ে দেখেন মাছে ধরছে কী না। মাছ ধরে নাই। কিন্তু দাদাজান হতাশ হন না।
বলেন, দেইখো কালকে জাল মাছের মইধ্যে সাঁতার কাটবো। বাড়ি ফিরে তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ি।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি দাদাজান মহাব্যস্ত। পাট বোঝা করে সাজিয়ে রাখছেন। আজ বিক্রি করতে নিয়ে যাবেন। দাদাজানের ব্যস্ততা দেখে তাঁকে আর ঘাটানোর সাহস হয় না।
বিকেল হতে হতে কাঁচা রাস্তার উপর পানি ওঠে। দাদাজান আমার জন্য গুঁড়ের হাতি-ঘোড়া আনতে চেয়ে পাট বোঝাই ভেলা নিয়ে বেরিয়ে পরেন। আমগাছ তলায় দাঁড়িয়ে মন খারাপ করে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি দাদাজানের চলে যাওয়ার দিকে। দাদাজান একবারও পিছনে ফিরে তাকান না।
যদি দেখতেন——–
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। কান ভোঁ ভোঁ করতে থাকে। এক সময় প্রচন্ড শব্দে ঘুম ভেঙ্গে যায়। এলার্ম বন্ধ করতে করতে দেখি রাত প্রায় সাড়ে চারটা।
মন খারাপ হয়েই থাকে। ঢাকা শহরের ইট পাথরের আবদ্ধ ঘরে শুয়েও পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে ভেসে আসে। মনে হয় যেন ভেলাটাতেই শুয়ে আছি।
উঠে পড়ার তাগাদা অনুভব করি। সদ্য দেখা স্বপ্নটাকে মনে হয় কোন টাইম মেশিনে চড়ে অতীত ঘুরে আসার মত।
সেদিনের সেই পাট বোঝাই যাত্রার পর দাদাজান আর ভেলায় ওঠেননি। পরদিন দাদাজান অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে তা গুরুতর রূপ নেয়। প্রায় এক মাস আমাদের উৎকন্ঠায় কাটিয়ে এক মাঝ রাতে সবার মায়া ছিন্ন করে পারি দেন চির ঘুম রাজ্যের দেশে। আর কখনও আমিও ভেলায় ভাসিনি।
হাত-মুখ ধুয়ে ঢাকা শহরের আলো আঁধারিতে রাস্তায় নেমে আসি। আশে পাশে তাকিয়ে একটা রিক্সাও খুঁজে না পেয়ে হাঁটা দিই গাবতলী বাস কাউন্টারগুলোর দিকে। ঈদের অগ্রিম টিকিট যুদ্ধে না জিততে পারলে আমার যে ফেরা হবে না। ফেরা হবে না দাদাজানের ঘুম রাজ্যের সেই গ্রামটাতে। যেখানে দাদাজান ঘুমিয়ে থাকেন বছর অন্তর আমরা ফিরবো বলে।
ঘুমন্ত শহরের নিস্তব্ধতা চিড়ে দূর থেকে এ্যাম্বুলেন্সের আওয়াজ ভেসে আসে।
আমি সাবধানে বৈঠা টানি যেন ছলাৎ ছলাৎ শব্দে দাদাজানের শান্তির ঘুম না ভেঙ্গে যায়।