লেখক: তন্ময় রায়

যা কোন স্থির বস্তুকে চলায় বা কোন চলমান বস্তুকে থামায় তাকে বল বলে। আমরা যত কাজ করি, সব কিছুর পিছেই কোন না কোন বল এর অবদান আছে। আমরা হাতে কোন জিনিস ধরে রাখতে পারি ঘর্ষণ বলের কারণে। আমরা কোন জিনিষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সরাই বলেরই সাহায্যে। কিন্তু এই সব বলের উৎপত্তি কোথায়? উৎপত্তির আগে আমাদের জানতে হবে বলের প্রকারভেদ। বর্তমানে বলকে ৩ ভাগে ভাগ করা হয়। এরা হল মহাকর্ষ বল, electroweak বল এবং সবল নিউক্লীয় বল। আমাদের দৈনিক জীবনে যত বল দেখি সবই এই ৩টি বলের কোন না কোন একটির রূপভেদ। সব কিছুই তো ইলেক্ট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন দিয়ে তৈরি। এবং প্রত্যেক বস্তুতেই প্রোটন ও নিউট্রন ধারী নিউক্লীয়াসকে কেন্দ্র করে ইলেক্ট্রন ‘ঘুরতে’ থাকে। এই নিউক্লীয়াস ও ইলেক্ট্রন এর মধ্যে অনেক ফাকা স্থান থাকে, তাহলে ১টি বস্তুর মধ্যে দিয়ে আরেকটি ঢুকে যায় না কেন? ইলেক্ট্রন ঋণাত্মক চার্জ ধর্মী বলে ১টি ইলেক্ট্রন আরেকটি ইলেক্ট্রনকে বিকর্ষণ করে। প্রত্যেক বস্তুর বাইরের দিকে ইলেক্ট্রন থাকে। এবং এই ইলেক্ট্রন – ইলেক্ট্রন বিকর্ষণের জন্যই ১টি বস্তু আরেকটি বস্তুর মধ্যে দিয়ে ঢুকে যায় না। এজন্যই আপনি হাত দিয়ে মাউস টা ধরতে পারেন। এমনকি আমরা যে হাত পা নড়া চড়া করতে পারি তার পিছনেও ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক বলের হাত আছে।

এখন আসা যাক বলের উৎপত্তি তে। কিন্তু বলের উৎপত্তি আলোচনা করতে গেলে আগে মহাকর্ষ দিয়ে শুরু করলে হবে না। এজন্য আগে আমাদের একটু ইতিহাস দেখতে হবে। বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন যে ১টি অণুর মধ্যে ২টী পরমাণু কিভাবে পরস্পরকে আকর্ষণ করে। ২টি পরমাণু ইলেক্ট্রন আদান প্রদান বা শেয়ারের মাধ্যমে পরস্পরকে আকর্ষণ করে অণু গঠন করে। এরপর তাদের মাথায় প্রশ্ন জাগলো যে ১টি পরমাণুর নিউক্লীয়াসের মধ্যে নিউট্রন ও প্রোটন কিসের আকর্ষণে আটকে আছে? বিজ্ঞানী হাইসেনবার্গ ধারণা করলেন যে পরমাণুর মধ্যে যে রকম ইলেক্ট্রন আদান প্রদান এর জন্য আকর্ষণ বলের সৃষ্টি হয়, সেরকম হয়ত নিউটন ও প্রোটন এর মধ্যেও হয়। তখনকার বিজ্ঞানীরা জানতেন যে ১টি নিউটন ১টি ইলেক্ট্রন ত্যাগ করে প্রোটনে পরিণত হয় এবং ইলেক্ট্রনটি গ্রহন করে ১টি প্রোটন ১টি নিউটনে পরিণত হয়। কিন্তু এতে সমস্যা হল যে নিউক্লীয়াসের মধ্যে নিউটন ও প্রোটন এর মধ্যে যে বিশাল বল বিরাজ করে হিসাব করে দেখা গেল যে ইলেক্ট্রন আদান প্রদানের মাধ্যমে কোন ভাবেই সম্ভব না। তখন বিজ্ঞানী ইয়াকুওয়া প্রোপজ করলেন পাইওন (পাই মেসন) নামে ১টি নতুন কণার অস্তিত্ত্ব। এর প্রায় ১০ বছর পরে এই কণা আবিষ্কৃত হল। কিন্তু প্রশ্ন হল যে এই পাইওন আদান প্রদান এর জন্য নিউট্রন ও প্রোটন এর মধ্যে আকর্ষণ সৃষ্টি হয় কেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে অনেক গাণিতিক জ্ঞান প্রয়োজন, এখানে সে সব আলচনা করা সম্ভব নয়। কিন্তু কণা আদান প্রদানের জন্য যে আকর্ষণ এমনকি বিকর্ষণ বলের সৃষ্টি হতে পারে সে ধারণা আনার জন্য ১টি উদাহরণ এর কথা কল্পনা করা যেতে পারে। ধরা যাক ২জন ছেলে ২টি ফুটবল নিয়ে খেলা করছে।বালক-১ বালক-২ এর হাতের ফুটবল ধরে টানছে এবং বালক-২ বালক-১ এর হাতের ফুটবল ধরে টানছে। এই সিচুয়েসন এর জন্য বালক ২জনের মধ্যে একটি আকর্ষণ কাজ করবে। আবার যদি বালক ২জন দূরে দারিয়ে পরস্পরের দিকে ফুটবল ২টি ছুড়ে দেয় তখন তাদের মধ্যে ১টি বিকর্ষণ সৃষ্টি হবে। এই সাদামাটা উদাহরণ আমাদের বুঝতে সাহায্য করে যে কোন কণা আদান প্রদানের মাধ্যমে কিভাবে আকর্ষণ বা বিকর্ষণ বলের উৎপত্তি হয়। প্রকৃতপক্ষে নিউট্রন ও প্রোটনের মধ্যে এরূপ পাইওন আদান প্রদান এর জন্যই তাদের মধ্যে এরূপ আকর্ষণ বলের সৃষ্টি হয়।

এখন, যদি ১টি প্রোটন একটি নিউটনকে আকর্ষণ করার জন্য ১টি পাইওন সৃষ্টি করে তা ছুড়ে দেয়, তাহলে তো প্রোটনটির শক্তি বা ভর, কিছু একটা কমে যাওয়ার কথা। প্রোটনটি নিশ্চয় এমনি এমনি কোন কিছু সৃষ্টি করতে পারে না, তাহলে তো শক্তির নিত্যতা সূত্র অমান্য করা হবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কখনো দেখা যায় না যে তার ভর বা শক্তি কোনটাই কমে গিয়েছে। এই দুইটি বিপরীত ধর্মী ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য এগিয়ে আসে হাইসেনবার্গ এর অনিশ্চয়ওতা নীতি। এই নীতির একটা রূপ বলে যে কোন ঘটনার সময়কাল সম্পর্কে নিশ্চিত হলে সেই ঘটনায় উপস্থিত শক্তি অনিশ্চিত হয়ে পরে। এখন প্রোটনটি নিকটবর্তী একটি নিউট্রনকে ১টি পাইওন এত দ্রুত ছুড়ে দেয় যে সময় অনেক নির্দিষ্ট হয়ে পরে। এজন্য সেই অল্প সময়ের মধ্যে প্রোটনটির শক্তি কমলেও সেটি হাইজেনবার্গ এর অনিশ্চয়তার নীতির জন্য কোন ভাবেই বুঝা সম্ভব নয়। হাইজেনবার্গের নীতি শুধু কোন দার্শনিক মতবাদ নয়। এর গাণিতিক সূত্র এবং পরিমাপ আছে। এই পরিমাপ থেকে হিসাব করে বিজ্ঞানী ইয়াকুওয়া বললেন যে পাইওন এর ভর ইলেক্টন এর ভর এর ২০০ গুণ এর বেশি হবে। এবং এর প্রায় ১০ বছর পরে এই কণা আবিষ্কৃত হয়, এবং তার ভর দেখা যায় ইলেক্টন এর ভরের ২৫০ গুণ এর মত।

এই বিশাল এক আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীদের মাথায় চিন্তা আসল যে, যদি সবল নিউক্লীয় বল এভাবে কণা আদান প্রদানের মাধ্যমে কাজ করে তাহলে বলের অন্যান্য রূপের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হতে পারে। তারা ইলেক্ট্রম্যাগনেটিক বলের জন্য একটি কণার কথা বললেন, এই কণা হল ভার্চুয়াল ফোটন।ফটোন হল সেই কণা যা দিয়ে আলো তৈরি। কিন্তু ভার্চুয়াল ফোটন একটু অন্য ধরণের কণা। এটি আমাদের চোখে আলোকানুভুতি দিতে পারে না। একে সরাসরি ডিটেক্ট করাও সহজ না। সাধারণ ফোটনের মত এটির বেশিক্ষণ স্থায়ীও নয়। আবার দূর্বল নিউক্লীয় বলের জন্য দায়ী intermediate vector boson. এই কণা ভার্চুয়াল ফোটনের মত ভর শূন্য নয়। এই কণা ৩ প্রকার। ২টি W (চার্জ ±e) এবং ১টি Z (চার্জহীন)।

সকল প্রকার বলের সৃষ্টির জন্য দায়ী কণা গুলিকে বলা হয় intermediate field boson. এই বোসোন আদান প্রদানের জন্যই এই সব বলের সৃষ্টি। এই তত্ত্ব আরও বলে যে বলের ক্রীয়াসীমা (range) আদান প্রদান রত কণার ভরের উপর নির্ভর করে। এই কণার ভর যত কম হবে, এই বলের সীমা তত বেশি হবে। ফোটন এর ভর শূন্য বলে এর দ্বারা সৃষ্ট ইলেক্টম্যাগনেটিক বলের সীমানা অসীম। কিন্তু পাইওন ভরযুক্ত বলে সবল নিউক্লীয় বলের নির্দিষ্ট একটি সীমানা রয়েছে। একই ভাবে বেটা বিকিরণের জন্য দায়ী দূর্বল নিউক্লীয় বলের পিছনেও কোন ভরযুক্ত কণা আছে।

তাহলে এই সব বল গুলোর মধ্যে সম্পর্ক কোথায়? বিজ্ঞানী স্টিভেন উইনবার্গ এবং আব্দুস সালাম একই সাথে স্বাধীনভাবে দেখান যে ইলেক্টম্যাগনেটিক বল এবং দূর্বল নিউক্লীয় বলের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। তারা দেখান যে ইলেক্টম্যাগনেটিক বল ও দূর্বল নিউক্লীয় বল একই ঘটনার ভিন্ন দিক, যে ঘটনা চারটি ভরহীন বোসোন এর জন্য সৃষ্টি হয়। spontaneous symmetry breaking নামে একটি প্রসেস এর মাধ্যমে এই ৪টি বোসোন এর ৩টি ভর অর্জন করে W এবং Z কণায় পরিণত হয়। এর ফলে দূর্বল নিউক্লীয় বল সৃষ্টি হয় এবং তার একটি সীমা বিরাজ করে। কিন্তু এসময় একটি বোসোন থাকে যা ভর পায় না, এবং এটি ভার্চুয়াল ফোটন হিসাবে পরিচিত হয় ও ইলেক্টম্যাগনেটিক বল সৃষ্টি করে।

ইতিহাস এ পর্যন্তই। এখন বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখছেন অদূর ভবিষ্যতে সবল নিউক্লীয় বলকে electroweak বলের সাথে একিভুত করবেন। এজন্য তারা গ্লুয়ন নামে এক field boson এর কথা বলেছেন। এরপরে বাকি থাকবে মহাকর্ষ। এই সব চেয়ে দৃশ্যমান ও আপেক্ষিকভাবে সহজ বলটিই বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশি ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। বিজ্ঞানীরা ধারনা করেন যে মহাকর্ষেরও একটি field boson আছে। তারা এর নাম দিয়েছেন গ্র্যাভিটন। মহাকর্ষের সীমা অসীম বলে এই কণাও ভর শূন্য হবে। এই কণা আলোর বেগে চলে, সে জন্য মহাকর্ষ বলও আলোর বেগ অর্জন করতে পারে। এই কণা সকল পদার্থের সাথে খুবই কম ইন্টারেকশন করে, সেজন্য এটি ডিটেক্ট করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু আমাদের জ্ঞান এবং টেকনলজি আরও যত উন্নত হতে থাকবে আমরা আরও তত এগিয়ে যাব এই সব বলের উৎপত্তির রহস্যের সমাধানে। আসা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে যখন সব বল একীভূত করতে সক্ষম হব, এবং grand unified theory বা GUT আমাদের হাতের নাগালে থাকবে।

দ্রষ্টব্যঃ সবল নিউক্লীয় বল কাজ করে হাড্রন (নিউট্রন, প্রোটন ইত্যাদি) কণার মধ্যে। প্রকৃতপক্ষে তাদের মধের কার্ক (quark) দের মধ্যে এই আকর্ষণ কাজ করে। এই সম্পর্কে এত কিছু এখানে লেখা সম্ভব নয়। পরে সম্ভব হলে এসব নিয়ে অন্য একটা প্রবন্ধ লিখব।