১.
In the name of God, Most Gracious, Most Merciful
1. Say: He is God, the One and Only;
2. God, the Eternal, Absolute;
3. He does not beget, nor is He begotten;
4. And there is none comparable to Him. (Al-Akhlas:112)

আব্রাহামিক ধর্মগুলির মধ্যে একেবারে আধুনিকতম হলো ইসলাম| উপরের ঘোষণা ইসলাম কে আলাদা করে দেয় তার অপরাপর পূর্বসুরী ধর্মগুলি থেকে, ইহুদি একেশ্বরবাদের বিশুদ্ধিকরণ ও খ্রিস্টীয় ট্রিনিট্রিয় গোঁজামিলকে অস্বীকার করে| তবে শুধু এই তাত্ত্বিক জায়গাতেই যদি ইসলামের মহত্ত্ব সীমিত ধরে নেই, ধরে নেই যে সুরা ইখলাসের সৌন্দর্য্যে বিমোহিত হয়েই সকলে ইসলাম গ্রহণ করেছে , তাহলে অন্তত বঙ্গদেশে ইসলামের প্রচার ও প্রসার কে ব্যাখ্যা করা যাবে না| কারণ হিন্দু রাজা কর্তৃক অত্যাচারিত, হিন্দু সমাজ কর্তৃক অস্পৃশ্য-অযোগ্য ঘোষিত শ্রেণীসমূহ, যারা বুঝেছিল স্বীয় বাহুবল/মস্তিষ্ক বলে তাদের অবস্থার পরিবর্তনের কোন সম্ভাবনাই নেই, সেই অংশটি ইসলামের Egalitarianism দ্বারা আকৃষ্ট হয়েই স্বধর্ম বিচ্যুত হয়েছিল বলে মনে হয় | এর আগেও তারা একই কারণে গৌতম বুদ্ধের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিল| মুশকিল হলো রাজধর্মের সাথে প্রজাধর্মের মিল না হলে, কিছু ক্ষেত্রে রাজার রাজ্য শাসন মুশকিল হয়ে পড়ে, বিশেষত সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদের ক্ষেত্রে | তাই সর্বহারা প্রজার ধর্মের উপরও কর্তৃত্ব করা চাই তার| বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বাংলা ছেড়ে পালালো, অস্পৃশ্য-অযোগ্য সেই আগের অবস্থানেই রয়ে গেল| অন্তত অশোকের পর থেকে ভারতের এই অংশটির এরকমই চলছিল| আবার যখন ইসলাম একই শ্লোগান নিয়ে সামনে আসলো, তখন লাভের মধ্যে লাভ হলো: রাজশক্তি থেকে ব্রাহ্মণ্যবাদ বিতারিত| রাজা মুসলমান, প্রজাও মুসলমান হবার সুযোগ পেল| সেই হলো বাংলার ইসলমী কৌমের(!) শুরু|

এইখানেই একটু বিবেচনার বিষয় আছে| আমি ইসলামের প্রথম কৌমকেই আদর্শ কৌম বলে ধরতে চাই | অনেকেই আমার সাথে হয়ত একমত হবেন| কেউ গুণগত সমীক্ষার পর, আর কেউ নিছক কৌম নেতা(মুহম্মদ স:)র প্রতি সম্মানের জায়গা থেকে| এর পর কি কি পরিবর্তন এসেছে? ইসলাম আরবের চৌহদ্দিতে আসতে না আসতেই, রাজনীতির কুটিল চক্রে জড়িয়ে গেল অভিজাত কুরাইশদের কল্যাণে, আততায়ীর হাতে খুন হলেন খলিফারা, পরিবারতন্ত্র শুরু হয়ে গেল | খলিফা আমলের গ্যারিসনভিত্তিক আগ্রাসনের জায়গায় সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় আগ্রাসন শুরু হলো| এর পর ইসলাম ছড়ালো একদিকে ইরাক ও পারস্যে, অন্যদিকে আফ্রিকার উত্তর উপকূলে | এ পর্যন্ত আসতে না আসতেই কৌম আর একটি মাত্র ভিত্তি বিশ্বাসের জায়গা রইলো না, অনেকগুলি মতবাদ(school) তৈরী হলো| রাজধানী মক্কার জায়গায় এরই মধ্যে কখনো দামেস্ক, কখনো কুফা, কখনো বাগদাদ| আরেকটা ঐতিহাসিক ঘটনা এরই মধ্যে ঘটে গেল, মঙ্গোলিয়ান আক্রমণ, এটিকে অনেক ইসলামিক মনে করেন ইসলামের প্রথম বড় পরাজয়, আবার অনেকেই এটিকে দেখেন ইসলামের বিজয় হিসেবে, কেননা মঙ্গোলিয়ান খানদের অনেকেই পরাজিত ধর্মটিকে গ্রহণ করেছিল| আমি প্রথম দলে| ইসলামের সংকোচন বা কুন্ঠার শুরু হলো চেঙ্গিস খানের আক্রমণ থেকে| কৌমের বিভক্তির শুরুও সেখান থেকেই|

এর পর কৌমের সেনাপতিরা স্পেনে ঢুকছেন পশ্চিম দিকে, আর ভারতে ঢুকে যাচ্ছেন পূর্বদিক দিয়ে | আর কোন বিজিত জাতি যা পারে নি ভারতবর্ষে তাই করে দেখালো মুসলমান অধিগ্রহণকারী| হিমালয়ের বাধা যদি একমাত্র বড় কারণ হত তাহলে অনেক আগেই সেই বাধা অনেকে পার করেছিলেন, কিন্তু পারেন নি বাকি কাজ সমাধা করতে| মহামতি কার্ল মার্ক্সের মতে কারণ , “ইংরেজ আগমনের পূর্বের সবগুলি বিজয়ী জাতির সভ্যতার চেয়ে সিন্ধু সভ্যতা উন্নততর ছিল|” এইখানে মার্কস ভুল করে বসেছিলেন| কারণ তিনিও পশ্চিমের প্রভাব মুক্ত নন| ইউরোপের শৌর্যের উত্তরাধিকার তার মধ্যে ছিল| পূর্বের রীতিনীতি ভালো করে বোঝার মানসিকতা তথাকথিত রেনেঁসা থেকে পাওয়া যায় নি | রেনেঁসা দিয়ে ছিল লুথারিয় ধর্মীয় সংশোধনবাদ, উপনিবেশবাদ, বুর্জোয়া শিল্প বিপ্লব ইত্যাদি| মার্কস কে একটু শুধরে দেয়া যায় চাইলে| মার্কস ইংরেজের সাফল্যকে পশ্চিমা রং লাগাতে চেয়েছেন| তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ইংরেজ না হলে জার্মান(!) ইত্যাদি, না হোক অন্তত নিচুজাত স্লাভরা হয়ত জয় করতই ভারতকে| পশ্চিমাদের ভুল তো স্পষ্ট| ইংরেজ যেটা করেছে অস্ত্রবলে, বুদ্ধিবলে ধোঁকাদিয়ে, সেটা ইসলাম কিভাবে পেরেছিল? এটা কি সিন্ধু সভ্যতার উপর আরব সভ্যতার জয়? না| তাহলে আরব সভ্যতার পরাজয়? তাও না (এখানে কিন্তু মার্ক্স এর ব্যাখ্যা অধিবিদ্যক!!!)| তাহলে? মার্ক্সের/ডারউইনের তত্ত্বেই এর উত্তর মিলে, এবং সে ব্যখ্যা রীতিমত দ্বান্দ্বিক| সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকা যেমন করে আর্য-অনার্যের মিথিস্ক্রিয়ার স্থান করে দিয়েছিল, তৈরী হয়েছিল সনাতন ধর্ম(একটি ধর্ম নয়)| তেমনি আরব হয়ে পারস্যের ভিতর দিয়ে আসা বিজিতের সাথেও ঘটে গেল সম্মেলন, কিছুটা ধর্মের, বাকিটা সেই যে গ্যারিসন ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থা ছিল, যা কিনা সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার জন্য সবচেয়ে উপযোগী না হলেও, সনাতন ব্রাহ্মণ্যবাদ যে অবস্থা তৈরী করে রেখেছিল তার চেয়ে শ্রেয়তর, বিবর্তনের পথেই ছিল| আরো অধিক কাল পশ্চিম মুক্ত থাকলে অবস্থা কি হতো সেটা অন্য ভাবনার বিষয়|

আবার ফিরে যাই বঙ্গদেশে মুসলমান আগমনের সময়ে| যে ইসলামকে বাঙালি গ্রহণ করলো, সেটা যে প্রথম কৌমের ইসলাম নয় তা নিশ্চিত| সেটা আজ থেকে প্রায় হাজার(৯০০) বছর আগেকার কথা| আর প্রথম কৌম থেকে মাত্র পাঁচশ বছর পরের কথা| ততদিনে অনেকগুলি মতবাদ-মতভেদ তৈরী হয়ে গেছে এবং গ্রহণকারীর ধর্ম নির্ভর করছে প্রচারকারীর ধর্মের উপর| আহমাদিয়া/শিয়া/বাহাই কি মুসলমান? আমরা কি একে কোরানিক ধর্মসমূহ বলতে পারি? যে নামেই বলি না কেন, খলিফা উমর ফারুকের পর থেকে প্রত্যক্ষভাবে, এবং ইতিহাস বলে আবু সুফিয়ান ইত্যাদির ইসলাম গ্রহনের সাথে সাথে পরোক্ষভাবে রাজনীতি শুরু, এবং ইসলামের মতবাদগুলির মধ্যেও বিরোধের সূত্রপাত| আমরা অবশ্যই ভুল করব যদি বলি যে এই মতবাদ সমূহ শুধু রাজনৈতিক কারণে অর্থাৎ কৌমের নেতৃত্বের লড়াই থেকে শুরু| অনেকগুলি মতবাদের ভিত্তি একেবারে খাটি আধ্যাত্মিক, বিশ্বাসের সাথেও জড়িত, কিছু মতবাদ আবার একেবারে তত্ত্বীয় তারতম্যের কারনেও সূচিত হয়েছে| আমি নিজে ইসলাম বলতে শুধু প্রথম কৌমের ধর্মটিকেই মানতে চাই, কিন্তু সে কৌমের আকার ছোট, পরিধি শুধুই মক্কা-মদিনা ও তার আশপাশ এবং এর পরবর্তী বহু রাজনৈতিক-আধ্যাত্মিক সংশোধন/পরিবর্ধনের স্থান নেই| কিন্তু সেই সবের পথনির্দেশ রয়েছে| তবে আশার বিষয়টা এরকম যে, একই সাথে যখন অনেকগুলি মতবাদ উপস্থিত, তখন এগুলির সাথে তুলনার জন্য একটি আদর্শ(প্রথম কৌমের ধর্ম) বিদ্যমান, সেহেতু “ইসলাম” বললে তার রেফারেন্স প্রথম কৌম থেকেই শুরু করতে হবে, সেই অর্থে বর্তমান মতবাদগুলিকে ব্যক্তিগত বিবেচনা ও কিতাব সমূহের একান্ত বিষয়ীগত(subjective) অনুবাদের(interpretation not translation) , যতক্ষণ না পর্যন্ত পরবর্তী ঐশী চরিত্রের আবির্ভাব না হচ্ছে|

২.
এবার আসা যাক “নাস্তিক্যবাদ” ও “সেক্যুলার” প্রসঙ্গে| প্রথমেই নাস্তিক্যবাদ| নাস্তিকের সাথে আস্তিকের বিরোধের জায়গা কোথায়? ইশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত যুক্তি তে, তর্কে| একমাত্র সম্পর্কের জায়গাটিতে এই নাস্তিক বেচারা ধার্মিকের চেয়েও অসহায়| সে নিজের অস্ত্র বলে দাবি করে কখনো মুক্ত চিন্তাকে, ব্যর্থ হলে দর্শনকে, সেখানেও ব্যর্থ হলে বিজ্ঞানকে| বিজ্ঞান ব্যর্থ না| তবে সে নাস্তিকের উদ্দেশ্য সমাধা(serve the purpose) করে না| বিজ্ঞান চলে নিজের পদ্ধতিতে| বিজ্ঞান ধার্মিকের উদ্দেশ্যও সাধন করে না| নাস্তিক এর ভাষা বিজ্ঞানের ভাষা থেকে আলাদা, কারণ বিজ্ঞানের ভাষা ধর্মের ভাষা-আস্তিকের ভাষা থেকে আলাদা| আস্তিক ও নাস্তিক উভয়েই বিজ্ঞানকে কাছে রাখতে চায়| বলা যায় ব্যবহার করতে চায়| কোন এক গোষ্ঠীর পার-নাস্তিক ড: অমুক তমুক এর সাথে ইসলাম প্রচারকারী ড: জাকির নায়েকের কিন্তু এখানে যথেষ্ট মিল রয়েছে| আমি জাকির নায়েক কে “ইসলাম” প্রচারকারী বলছি বটে, কিন্তু এখানে যথেষ্ট তর্কের সুযোগ রয়েছে| এর আগের অনুচ্ছেদ গুলিতে এটার কারণও কিন্তু ব্যাখ্যা(subjective reasoning) করার চেষ্টা করেছি| নাস্তিকের মতে আস্তিক যুক্তিবাদী না, আস্তিকের কাছে নাস্তিক অবিশ্বাসী| এই দুইটি ধারনাই প্রমাণ করে যুক্তি ও বিশ্বাস সম্পর্কে আস্তিক ও নাস্তিক উভয়ের ধারণার অসার জায়গা টি| বিশ্বাসের জায়গায় উভয়েই বিশ্বাসী, তবে ভিন্ন তাদের বিশ্বাস, আর যুক্তির জায়গায় উভয়ের তর্ক বিশ্বাসকেই অনুসরণ করে| এদের অস্ত্রগুলি কি? কখনো ভাষা, কখনো বিজ্ঞান, কখনো রাজনীতি, অর্থাৎ যেখানে যে পাথর কুড়িয়ে পাওয়া যায়, তাই ছুড়ে মারো| উভয়েই হয়ে যেতে পারে গোঁড়া ও মৌলবাদী| কারণ ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান/অপ্রমান তাদের সাধ্যের কর্ম নয়| আস্তিকের বোঝা দরকার এটা শুধু ঈশ্বর নিজেই পারেন| আর নাস্তিক ? তার জন্য অনেকগুলি পন্থা আছে| নিজের সাথে তর্ক চালিয়ে যাওয়া/অজ্ঞতাবাদী হয়ে যাওয়া/প্রচলিত ধর্মের বাইরে ঈশ্বরকে খোঁজা| পরেরটাতে সে ব্যক্তি আর নাস্তিক থাকে না | আস্তিক্যবাদের বিপরীতে এইগুলিকে দাড়া করলে আমরা যা পাই তা হলো, এগুলি একেক ধরনের পর্যবেক্ষণ, বিষয়ীগত| নৈর্ব্যক্তিক কোন সত্য এদের নেই(কোথাও কি আছে?), ফলে এরা অন্য কোন নৈর্ব্যক্তিক সত্য কে সত্য বলে মেনেও নিবে না| মজার ব্যাপারটি হলো এরাও দল বড় করে| কারণ এরা এক ধরনের শূণ্যতা তৈরী করে ফেলে এদের মনোজগতে, অথচ বিজ্ঞান এদেরকে বলে শূণ্যতা নেই. বাস্তবের বাইরে কোন কিছু থাকলে সেটার জন্য বাস্তবের যে সঠিক ব্যখ্যা বিজ্ঞান করতে চায়, সেটা যদি কোন ভাবে অবাস্তবের পক্ষে যায়, এরা আঁতকে উঠে স্বভাবজাত কারণেই| অথচ বিজ্ঞানের সে বিষয়ে মাথাব্যথা কিন্তু কমই| অজ্ঞতাবাদী যখনই দ্বন্দ্বকে অস্বীকার করতে চাইবে তখনই সে তার সংশয়ের উর্ধ্বে কোন এক বিশ্বাসকে স্থান দিবে, যা তাকে দাঁড়া করিয়ে দেবে অন্যদের সাথে একই কাতারে যার সাথে সে ভিন্নতা দাবি করে| অজ্ঞতাবাদীর সমালোচনা করা এইখানে বিষয়ের অনেক বাইরে চলে যাওয়া হবে|

এর পর আসা যাক “সেক্যুলার” বিষয়ে| এই টার্মটা ইউরোপীয়| আমরা ইউরোপের ভক্ত, কারণ দীর্ঘদিন আমাদের পূর্বপুরুষ হিন্দু-মুসলিম, ইত্যাদি ইংরেজের তথা ইউরোপের চাকর হয়েই ছিলেন| ফলে ইউরোপীয় প্রভুরা যখন আমাদের “সেক্যুলার” ইত্যাদি নানা ইউরোপীয় তকমার মর্ম শেখাতে আসে তখন আমরা হৃদয়/মস্তিস্ক কোনভাবেই না মানতে/বুঝতে পারলেও তার প্রতি সম্মান দেখাই| “সেক্যুলার” মানে ধর্মহীনতা/ধর্মনিরপেক্ষতা এটা নিয়ে তর্ক করার আগে, পশ্চিমের “religion” ও প্রাচ্যের “ধর্ম” এর সংজ্ঞা যে ভিন্ন এটা মনে রাখতে হবে, বুঝতে হবে| এখনো পর্যন্ত যেহেতু মুক্ত/একক বিশ্বের উদ্ভব ঘটেনি তাই এই পার্থক্য নিয়েই আগাতে হবে| যারা এই পার্থক্য মানেন না তার হয় সময়ের চেয়ে এগিয়ে গেছেন, অথবা পাশ্চাত্য মানবতার পক্ষে আছেন| ফলে ফরাসীবিপ্লব + শিল্পবিল্পব + ইউরোপীয় রেনেঁসা+… থেকে উদ্ভুত গোষ্ঠী যা পুঁজির উপর, বিশ্ববাজারের উপর, বৈশ্বিক সম্পদের উপর করায়ত্ত করতে চায় খুব স্বাভাবিক ভাবেই, সেই একই গোষ্ঠী ব্যবহার করতে চায় বিশ্ব সংস্কৃতি-ধর্ম-ভাষা ইত্যাদিকে| সেই আগের কার মতন| এই সেক্যুলার দাবিটি এক সময় রাজার সাথে চার্চের ও ঈশ্বরের সম্পর্ককে ছিন্ন করেছিল| সামন্ত সমাজের অবসান ঘটেছে, কিন্তু সেই সমাজের থেকে নিজের প্রয়োজনীয় টুকুকে রেখে অপ্রয়োজনীয়টুকু বাদ দেয়ার কাজটি সুবিধাবাদী/মালিকেরা ভালো মতই সমাধা করেছেন| এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন| রাশিয়ান সমাজতন্ত্রের যুগে এদের মন্ত্র ছিল “মুক্ত বাজার”, এবং এখন এদের মন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে, “ধর্মনিরপেক্ষতা/ধর্মহীনতা”, “সন্ত্রাস” ইত্যাদি, উদেশ্য একই: বৈশ্বিক পুঁজি-বাজার-সম্পদ এর উপর নিয়ন্ত্রণ হাসিল| নিউইউর্কের কোন এক গলিতে মসজিদ তৈরীতে বিরোধিতাও সেক্যুলারিসজম, ফ্রান্সে নারীর পর্দা তথা বোরকাকে নিষিদ্ধ করা বা সুইজর্ল্যন্ডে মসজিদের মিনার নির্মানের উপর নিষেধাজ্ঞা, সকলই বোধ করি সেক্যুলারিজম বা পশ্চিমী মানবতার পক্ষে| এমনকি ঐ বিশেষ সেক্যুলার-নাস্তিক গোষ্ঠীর ড: অমুক তমুক দেরকে এই যুক্তি দিতেও দেখা যায়, হিন্দুর সংস্কৃতি বাঙালি আর মুসলমানের সংস্কৃতি খুচুড়ি, আরবের হাতে পাকানো| সেকুলার মার্কিন মুলুকে মন্দির-গির্জা যার যার সংস্কৃতিকে বহন করে যায়, মসজিদ শুধুই সন্ত্রাস ছড়ায়| আরেকটা যুক্তি শুনি, যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের মুসলমানেরা নাকি যুক্তরাষ্ট্রের ভিতরের মুসলমানদের কথা চিন্তা না করেই যুক্তরাষ্ট্রকে মুসলমানের শত্রু ঘোষণা করে| তাদের জন্য বলি, ইউরোপের-যুক্তরাষ্ট্রের উদার মানবতাবাদীরা এখন তার ভুখন্ডে মুসলমানের জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে প্রকাশ্যে| কিন্তু ইহুদি-মার্কিন লবি’র(!) লক্ষ্য শুধুই ইসলাম ও মুসলমানের ধ্বংস, এহেন কূপমন্ডুকীয় ধারণাতেও আমি বিশ্বাস করি না, এই ইহুদি-মার্কিন লবিও সাময়িক| ইউরোপীয় শক্তির ইহুদি নিধনের/বিনাশের ইতিহাস ভুলে যাবার নয়, এবং সেই কারণটিও শুধুই ধর্মীয় নয়, অর্থনৈতিকও বটে| ধর্মীয় বা অন্য কোন ধরনের জাতীয়তাবাদে তাই এর উত্তর পাওয়া যাবে না, যদিও লড়াই এর আপাত অস্ত্র হিসেবে জাতীয়তাবাদ ব্যবহৃত হতেই পারে| তাহলে মুখোশটা মানবতার, শ্লোগান সেক্যুলারিজমের কিন্তু আসল কথা যেন তেন উপায়ে উদ্দেশ্য হাসিল| উদ্দেশ্য আপনার মসজিদ দখল না, উদ্দেশ্য আপনার ঘর দখল করা| বিশ্বযুদ্ধের সময়টাকে ইহুদির (ধর্মের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ হিসেবে নিলে ভুল করাই হত, যদিও তাতে জাতিগতভাবে তারাই সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল|

৩.
একটু আগের অংশে ফিরে যাওয়া দরকার| অর্থাৎ বঙ্গে ইসলাম প্রসঙ্গে| সোজা কোথায় আমার বাংলাদেশ| ইতিহাসকে ব্যখ্যা যেখানে না করলেই নয় সেই সব খানে করতেই হবে, অন্তত নিজের পক্ষটাকে, নিজের অবস্থানতাকে স্পষ্ট করে তলার জন্য| কোন এক অদ্ভুত উপায়ে পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল| ভেঙ্গে গেল| এর মধ্যে শুধু “বখতিয়ারের ঘোড়া” দেখলে আল মাহমুদের মতন জামায়াতে এছলামির প্রতি সহানুভুতিশীল হওয়া যায়, সেই ক্ষেত্রে অস্বীকার করা হয় বাংলাদেশের অভ্যুত্থানকে| যে ভাবে একজন হিন্দু সাতশ বছরের ইতিহাসকে অধীনতার ইতিহাস বলে দাবি দাবি করে(রবীন্দ্রনাথ) একই ভাবে একজন মুসলমান যদি “বখতিয়ারের ঘোড়া”র স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে তাহলে সে নিজের জন্ম ইতিহাসকেই অস্বীকার করে| তার মানে খন্ডিত আকারে দেখার ও বোঝার কোন উপায় নেই| বাংলাদেশের ভুখন্ড আপাতত নির্দিষ্ট| পাকিস্তান আমলে, “বখতিয়ারের ঘোড়া” / “সিন্দাবাদের ঘোড়া” কোনো স্বপ্নই টিকে নি| জন্ম হয়েছে এক অভূতপূর্ব কিন্তু পূর্ব আঘ্রাত ভুখন্ডের| ইতিহাস বাংলার এই স্বাধীনচেতা, নিজের ধর্ম সংস্কৃতিকে টিকিয়ে রাখার কথা বলবে| মহাভারতে জরাসন্ধ্র আর মোগল আমলের প্রতাপাদিত্য/বারো ভুইঁয়ার কাহিনী সেই সাক্ষ্য দেয়| পদ্মা-মেঘনা বিধৌত মাটির তলায় পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন তেমন পাই না, তথাপি এই জাতির গর্বের কোন কমতি ঘটে কি? ঘটে তখনই যখন আমাদের মূলসুরটুকু আমরা বিস্মৃত হই| সেটা ঘটে এবং হরহামেশাই ঘটে| লুটপাট ঘটে ধর্মের নামে, আগুন লাগে| শুধুই কি ধর্মের জায়গাতেই আমাদের বিচ্যুতি? উহু|

৪.
ড: জাকির নায়েকের সাথে আমার প্রথম পরিচয় টিভিতে তার অনুষ্ঠান দেখে| আমি ঈশ্বরের যে সংজ্ঞার অনুসারী জাকির তার থেকে ভিন্ন| তাই জাকিরের ও তার বিরুদ্ধবাদীদের তর্কাতর্কির কোনকিছুই আমার অনুসন্ধানের অংশ হবার কথা না| কিন্তু হয়ে যায়| কারণ আমি বাংলাদেশের মানুষ| আমি জাকিরকে দেখি চায়ের স্টল, পুরীর দোকান, মধ্যবিত্তের ড্রয়িং রুম-বেড রুম, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের(!) আড্ডা ইত্যাদি নানা জায়গায়| আমি কোনোভাবেই এই জায়গাগুলি থেকে নিজেকে সরিয়ে বাংলাদেশের কোথাও নিজেকে ভাবতে পারি না| কারণ এর বাইরে যে অল্প জায়গাগুলি আছে সেসব বদ্ধস্থানে আমি শান্তিও পাই না| তাহলে জাকিরকে আমার নিজের জন্যই দরকার| জাকির থেকে পালাতে হলে আমাকে বাংলাদেশ থেকেই পালাতে হবে, অথবা এর মধ্যে থেকে জাকিরের সাথে বোঝাপড়া করতে হবে| জাকির কি সর্বগ্রাসী? এই যে চায়ের দোকান-পুরীর দোকান বলতে বলতে বৃত্তটাকে প্রায় বাংলাদেশের সমান করে ফেললাম, এটা কি ঠিক হলো? না ঠিক হয় নি| পুরোপুরি ঠিক হয় নি| জাকির নাস্তিক্যবাদের চেয়ে যে সর্বগ্রাসী তাতে সন্দেহ নেই| নাস্তিক বিষ বই-পুস্তক, ওয়েব সাইট ছেড়ে পুরীর দোকানে যায় না| আর সেকুলার? সে তো বিশ্বব্যাপী ইসলামকে শত্রু বানিয়েই রেখেছে| আমি তো নাস্তিক না, সেকুলারও না| আমার বন্ধু যে কিনা ঈশ্বরে বিশ্বাসী এবং প্রথম কৌমের ইসলামকে আদর্শ ভাবে, তার কি দশা? অথবা যে লোকগুলি জাকির ভিন্ন অন্যান্য মতবাদগুলির বিশ্বাসী(এমন হতে পারে প্রত্যেকেই যার যার বিষয়ীগত পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা থেকে) অথবা আমার হিন্দু-খ্রিস্টান বন্ধুগনের কি দশা? এই সব বিশ্বাসের জায়গাতে জাকির কিছুনা কিছু উত্পাত করেই, সেই দোষে জাকিরকে আক্রমণ করে লাভ নেই, বিশ্বাসসমূহের মধ্যে তুলনার তো প্রশ্নই আসে না| আসছে মিথ্যা তথ্য ও কু-যুক্তি প্রদান| এ জায়গায় জাকির আসলে পারদর্শী নয়| আমার এক জ্ঞানী বন্ধু এই ভাবে জাকিরের প্রতি বিদ্বেষের বিরুদ্ধে, এমন কি দেলোয়ার হোসেন সাইদীকেও সে ছাড় দিতে চায়| তার অবস্থানের পুরোটা অংশ জুড়ে উদারনৈতিকতা-বাক স্বাধীনতা-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ইত্যাদি ইত্যাদি| আমি আরো একটা জুড়ে দিতে চাই, সেটা হলো সুবিধাবাদ| এর মধ্যে আছে মজা-দেখনে ওয়ালা লোকজন| আরো নানা ধরনের মতবাদের লোক| অনেকেই জাকির নায়েকের কথা শুনে, অনেকে না শুনে, কেউ ইসলাম, কেউ ইন্ডিয়া, কেউ চরমপন্থা, কেউ হিন্দু-কেউ খ্রিস্টান, কেউ ইহুদিপ্রেম/বিদ্বেষ, কেউ মার্কিন-পশ্চিম প্রেম-ঘৃনা থেকে নানা ভাবে জাকিরের সাথে জড়িয়ে পড়ছে| আর না হলে এই লেখা পড়ে, কিংবা জাকির সংক্রান্ত খবরাখবরেও আমরা জাকিরের সাথে জড়িয়ে পড়ছি| আরো আছে, এক দেশে জরিপ হচ্ছে কতলোক বউ কে ভয় পায় আর কত লোক পায় না, তা নিয়ে| এক লোক বুঝতে পারছে না কোন দিকে যাবে? শেষে ভাবে, বউ বলেছিল “যেদিকে লোক কম” সেদিকেই যাই|

জাকিরকে এখন আর “কোন খবর না”/”অপ্রয়োজনীয়” ঘোষণা করার উপায় নেই| পক্ষ-বিপক্ষ দুই ই প্রবল| আর তাই একে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই| আমি হিন্দু হই আর নাস্তিক হই আর সংশয়বাদী হই! জাকির বাংলাদেশে আসছে| জাকিরের মুখোমুখি আমি হচ্ছি এক ভাবে না এক ভাবে| আমার প্রতিবেশী, আমার বন্ধু কেউ না কেউ যাচ্ছেন/যাবেন জাকিরের সমাবেশে, উপরের নানা কারণে| প্রভাব থাকছেই| তাহলে আমি কি করব?

জাকিরকে কানাডা আমেরিকা ভিসা দেয় না, আমরাও দিব না, এটা একটা কু-যুক্তি| কর্মপন্থা স্থির করা যায়, বিশেষ করে জাকিরে যাদের মাথাব্যথা খুব বেশি তারা বই পুস্তক আর ওয়েব সাইটের দুনিয়া ছাড়াও চায়ের স্টলের দুনিয়াতে গেলে কাজ আগাতে পারে| অন্তত পাবলিক টিভি-রেডিওর পথে| অনেকের মতে জাকির যে যুক্তিতে, যে মতে কথা বলে সেই ভাবে তার সাথে তর্ক করা যায় না| কিংবা তর্ক করে তার প্রয়োজনীয়তার জায়গা ধ্বংস করা যাবে না| নিষ্ক্রিয় থাকলে তার ভক্ত-কূলে ভাটাও আসবে না| আপনি শুধু একা হবেন| মেরুকরণের জগতে আপনি আরো অসহায় অনুভব করবেন, বৌয়ের কথায় ফাঁকা জায়গায় যাবেন, সেটিও নিরাপদ নয় আর|

৫.

জাকির আসছেন, জাকির হয়ত আসবেন, চলেও যাবেন| আমাদের সরকারের অবস্থাটি কি? কোনো ভাবে কি একে বাংলাদেশের বর্তমান বিরাজমান রাজনৈতিক অবস্থার সাথে মেলানো যায়? চাইলে যায় কিন্তু| ১৯৯৬ এর সাথে এই সরকার ও সরকারী দলের কিন্তু গুণগত পার্থক্য আছে| এবারে তার সাথে আছে অনেকেই স্বৈরাচারী, বাম, ডান, সুশীল ইত্যাদি ইত্যাদি| ফলে সে প্রতুলের ভিসাকে যেরকম অস্বীকার করছেনা, জাকিরের ভিসাতেও তার বেশি আপত্তি নেই| বিশেষ করে দেশদ্রোহী রাজাকারগুলির বিচার যখন ঘটছে, অযোধ্যার রায় হচ্ছে ঠিক সেই মুহুর্তে জাকিরের উপস্থিতির ফায়দা কিভাবে নিবে আওয়ামী লিগ? ভিসা প্রত্যাখ্যানের প্রশ্নই আসে না| কারণ এটি বিপদবাহী হতে পারে| আমি নিজেও সরকারের এহেন বিপদ চাই না| জাকির আসুক| এইখানে এই ভূমিতে জাকিরকে কিভাবে মোকাবেলা করবেন তাই ভাবুন|