মহাবিশ্বের এক ছোট্ট গ্রহে বসবাস আমাদের, এই জীবজগতের অসংখ্য উদ্ভিদ এবং প্রাণীর এবং তাদেরই একাংশ হয়ে মানুষের। হ্যা, জীবজগত, উদ্ভিদ, প্রাণী এসবকিছু বলার পরেও বিশেষভাবে আলাদা কর বলা প্রয়োজন হচ্ছে মানুষের কথা, যারা আদতে আর দশটা প্রাণীর মতই প্রাণীকূলের আরেকটি প্রজাতি মাত্র। তবু কেন এইভাবে আলাদা করে বলতে হচ্ছে? কারণ, এই যে আমি লিখেছি, আপনি এখন পড়ছেন, ঠিক এইভাবে আর কোন প্রাণী পারছে না লিখতে পড়তে। আমি ভাবছি, আপনাকে ভাবাচ্ছি, এমনি করে কত না নানান ভাবে প্রতিমুহূর্তে আমরা করছি যোগাযোগ। চিন্তা করুন সে সময়ের কথা, যখন মানুষ আগুন দেখে ভয়ে পালাতো, মানুষের বসবাসের জঙ্গলগুলো আগুনে পুড়ে হতো ছারখার। ডালে ডালে ঘর্ষণে যে আগুনের স্ফুলিঙ্গ সৃষ্টি হত, শুকনো পাতায় ছড়িয়ে পড়ে সে আগুনের ফুলকি থেকে সর্বগ্রাসী দাবানল কেড়ে নিতো মানুষের প্রাণ, স্থান আর সঙ্গঘবদ্ধতা, তাকে ভয় না পেয়ে উপায় কি ছিল? তবু সেইকালে মানুষ চিন্তা করেছে, কেন এই আগুন? কেন আকাশ থেকে আসে বজ্রের গর্জন। তারা জানেনা কিছুই, জানার নেই উপায়ও কোন। কিন্তু প্রশ্নটা ঠিকই করে ফেলেছে। অজ্ঞতা থেকে হয়ত সেদিন আগুনের আক্রোশ মেটাতে পূজো দিয়েছে আগ্নিদেবকে, সে মানুষের ব্যর্থতা নয়, বরং সাফল্য এইখানেই, মানুষ প্রশ্নটা করে ফেলেছে নিজেদের কাছে, খুঁজতে শুরু করেছে উত্তর! আর এইভাবেই কোন এক অতি আদিম যুগে ঘটেছিল বুদ্ধির উন্মেষ। সেই মানুষ, আজ জ্ঞান বিজ্ঞান সভ্যতা, সংস্কৃতি, সমাজ কতকিছুর ধারক ও বাহক! সেই আদিম এক বুদ্ধির উন্মেষ কোথায় নিয়ে এসেছে মানুষকে। কিন্তু কই, আর কোন প্রাণীতো পারেনি এই উত্তোরণে সামিল হতে। বনে আগুন লাগলে আজো বন্যপশুরা প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালায়, কিন্তু হাজার হাজার বছর ধরে তারা কেবল ছুটেই পালালো, আগুনে কাঁচা ফল-মাংস রান্না তো করে খেতে পারল না। তাই স্বাভাবিকভাবেই সমগ্র প্রাণীজগতের কথা বলার পরেও আলাদা করে বলতে হয় মানুষের কথা, তার বৌদ্ধিক বিকাশের কথা, সভ্যতার উত্তরণের কথা, প্রকৃতিকে ব্যবহার করতে পারার কথা। আর এইসবই মানুষ পেরেছে কেবল মাত্র অন্যসব প্রাণীর চেয়ে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন মস্তিষ্কের জোরে, মস্তিষ্কের ভিন্ন গঠনের জোরে। আমাদের এই উত্তরণের সবটুকু রহস্য লুকিয়ে আছে মাথার খুলির মাঝে যে নরম টিশ্যুটা, সেইখানে।

মস্তিষ্ক আসলে কী?
এই প্রশ্নের আসলে কোন সোজাসাপটা উত্তর নেই। মানুষ নিজেদের দেহ নিয়ে ঘাটাঘাটি, কাটাকাটি করতে করতেই এক সময় জেনে গেছে, মাথার খুলির মাঝের নরম টিশ্যুটুকুই সব না, ঐ টিশ্যু খুলির নীচ দিক দিয়ে ছড়িয়ে গেছে সমস্ত দেহে, একবারে আঙ্গুলের ডগা পর্যন্ত। তাতেও কি বলা যায়, মাথার খুলির মধ্যকার নরম টিশ্যু আর তার থেকে মেরুরজ্জু ধরে জালের মত ছড়িয়ে পড়া সব তন্তুগুলো মিলেই মস্তিষ্ক? না, তাতেও মস্তিষ্কের স্বরুপ ধরা যায় না।

এইখানে একটা মজার ঘটনা বলা যায়, “Introduction to Brain & Behavior” এর লেখক, Bryan Kolb আর Ian Q. Whishaw তাদের বইতে লিখেছে, তাদের এক বন্ধু, হার্ভে, তার স্নাতকোত্তর গবেষণার বিষয় হিসাবে বাছাই করছিল মস্কিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কিন্তু গবেষণা ছাড়াও তার ছিলো অন্য একটা উদ্দেশ্য, তার ইচ্ছা ছিল, তার মৃত্যুর পর তার মস্তিষ্ককে একটা বোতলের মধ্যে সংরক্ষন করতে হবে, যাতে সে তার মৃত্যুর পরও মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে বাহ্যজগতের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। তার ধারণা ছিল, বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের মাধ্যমে একদিকে সে বাহ্যজগত থেকে তথ্য গ্রহন করতে পারবে, আরেকদিকে, তার মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে বাহ্যজগত তার কাছ থেকেও তথ্য জানতে পারবে। মোট কথা, আমরা স্বত্তা বলে সাধারণভাবে যা বুঝি, সে মস্তিষ্কের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার আদান প্রদানের মাধ্যমে মৃত্যুর পরও তার সেই স্বত্তাকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিল। তার গবেষণা ব্যর্থ হয়নি, যা ব্যর্থ হয়েছে, তা হল তার গবেষণার পিছনের উদ্দেশ্য। কারণ, মস্তিষ্কের ধারণাটাই ছিল না তার সঠিক। সমগ্র স্নায়ুতন্ত্রকে যদি কোনভাবে দেহ থেকে আলাদা করেও ফেলা হয়, তাহলে কি কাজ করবে মস্তিষ্ক? না করবে না। কারন মস্তিষ্ক যে কাজ করে, তার জন্য দেহের কোষগুলোও দরকার। কোষগুলো না থাকলে মস্তিষ্ক মূল্যহীন, মৃত। তারমানে, মস্তিষ্কের সংজ্ঞা যেমন সহজে দেয়া যায় না, তেমনি, দেহ থেকে মস্তিষ্ককে আলাদা করাও যায় না। কোন এক সুদূর ভবিষ্যতে যে বুদ্ধিমান মানুষ মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে দেহ থেকে আলাদা করে ফেলতে পারবে না, একথা বলা যায় না, তবে, এখনো পর্যন্ত দেহ ভিন্ন মস্তিষ্কের কথা চিন্তাও করা যায় না। তাই মস্তিষ্ককে বুঝতে হলে বুঝতে হবে মাথার খুলির মধ্যকার নরম টিশ্যুকে, স্নায়ুতন্ত্রের সবকটা তন্তুকে, এর কার্যপ্রনালীকে, কিভাবে তা কোষের গভীরে ছড়িয়ে দেয় রাসায়নিক বা বৈদ্যুতিক সঙ্কেত এই সব কিছুকেই।

মস্তিষ্ক নিয়ে গবেষণার শুরু
মানুষ মস্তিষ্ক নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা করতে শুরু করেছে খুব বেশীকাল আগে নয়। ১৮৪৮ সালে একটা রেলওয়ে দূর্ঘটনায় বিস্ফোরণের ফলে ফাইনেজ গেজ নামের একজন ২৫ বছর বয়সী রেইলরোড কর্মীর মাথার সামনের দিকে প্রায় এক মিটার লম্বা এবং ৩ সেন্টিমিটার চওড়া ট্যাম্পিং আয়রন রড ঢুকে যায়, তারপরও সে বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু এই ঘটনায় সে প্রাণে বাঁচলেও তার আচরণে অসামান্য পরিবর্তন চলে আসে। একজন শক্তিশালী, বিনয়ী এবং নিয়ন্ত্রিত আচরণ এবং চরিত্রের অধিকারী মানুষ পরিনত হয় একজন পাশবিক আসক্তিপূর্ণ অনিয়ন্ত্রিত চরিত্রের যুবকে। তার চিন্তা এবং কাজে যে সামঞ্জস্য ছিল, তা বিনষ্ট হয়ে গিয়েছিল পুরোপুরি, তার সিদ্ধান্তগুলো হয়ে গিয়েছিল কেবলই সাময়িক, সময়ের সাথে সাথে তার সিদ্ধান্তও খুব দ্রুত বদলে যেত। ফাইনেজ গেজের চিকিৎসক জন এম. হারলো এর মতে, সে যোগ্যতা এবং আচরনের দিক থেকে হয়ে গিয়েছিল শিশুসুলভ যদিও শক্তিশালী যুবকের শারীরিক আসক্তি ঠিকই ছিল তার। ফাইনেক গেজের ব্যক্তিত্বে যে অকল্পনীয় পরিবর্তন আসে, তার উপর ভিত্তি করে হারলোর এই রিপোর্টটি প্রকাশিত হয় দূর্ঘটনার ২০ বছর পর, ১৯৬৮ সালে। পরবর্তি সময়ে অধুনিক প্রযুক্তির সাহাযে তার মস্তিষ্কের আঘাতের স্বরূপ চিত্র নির্ণয় করা হয়।


কম্পিউটার প্রযুক্তির সাহায্যে তৈরী করা ফাইনেজ গেজের আঘাতের সদৃশ চিত্র

গেজের ফ্রন্টাল কর্টেক্সে আঘাতের ফলে সে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেছিল তার সামাজিক সংযম, যা প্রায়শই তার অসংলগ্ন ব্যবহারে প্রকাশ পেত। ট্যাম্পিং আয়রন রড তার ক্ষেত্রে কাজ করেছে ফ্রন্টাল লবটমির মত, যা প্রায়শয়ই শেখার ও বোঝার ক্ষমতার (cognitive) এবং ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ঘটায়। গেজের মাথার আঘাতের প্রকৃতরূপ এবং এর ফলাফল দূর্ঘটনার পর থেকে এখনও পর্যন্ত বহুল আলোচিত একটি বিতর্কের বিষয় হয়েই আছে। এই ঘটনাটা বিজ্ঞানীদের ব্যাপকভাবে উৎসাহিত করে একজন মানুষের আচরণ ও মনকে কিভাবে মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রন করে তা অনুধাবন করার জন্য।

মনের ধারণা বা মেন্টালিজম
বহুকাল আগে থেকেই মানুষ নানা ভাবে জানার চেষ্টা করেছে, কীভাবে মন বা স্বত্ত্বা কাজ করে। এই সম্পর্কে প্লেটো বা তার শিক্ষক সক্রেটিসের ধারণা ছিল, মানুষের অস্তিত্বের মূল উপাদান হল আত্মা বা মন বা soul, যা নিয়িন্ত্রন করে মানুষের আচরণ। তার মতে আত্মা অনন্ত, দেহের মৃত্যু হলেও আত্মা অক্ষয়, পুনঃপূনর্বার নতুন করে দেহ দেহান্তরে অস্তিত্বশীল হয়। প্লেটোনীয় আত্মার ছিল তিনটি অংশঃ
১. লোগোস বা মন বা সাধারণ বোধ।
২. থাইমোস বা আবেগ।
৩. ইরোস বা আকাঙ্খা বা ইচ্ছা।

এরিস্টটলের মতামত প্লেটোর অনুগামীই ছিল, কিন্তু সে আত্মার দেহভিন্ন কোন আলাদা অস্তিত্বে বিশ্বাস রাখেনি, যা দেহান্তরে ভ্রমন করতে পারে। এরিস্টটলের ধারনা ছিল, আত্মা বা মন হল প্রাণের যথার্থতা। কোন চোখে যদি প্রাণ থাকে তবে আত্মার কাজ হল চোখ দিয়ে দেখা। এই ধর্মই আত্মার স্বরূপ। তার মতে, আত্মার দুইটি অংশ ছিল, একটি যুক্তিবাদী বা চিন্তাশীল অংশ আরেকটি তাত্ত্বিক অংশ। তার “De Anima” তে আত্মা বা মন সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায়। তবে আত্মার অমরত্ব সম্পর্কে তার স্ববিরোধীর ধারণার প্রমান ও আছে, যা বেশ বিতর্কিত। প্লেটো থেকে শুরু করে এরিস্টটলে যে মন বা soul বা আত্মার ধারণা, এই হাইপোথেসিসকে বলা হয়, মেন্টালিজম।

দ্বৈতবাদ বা ডুয়ালিজম
সক্রেটিস-প্লেটো-এরিস্টটলের এই মন বা আত্মা সঙ্ক্রান্ত ধারণার ব্যবচ্ছেদ করেই ১৬৬৪ সালে দেকার্তে “Treaties of Man” এ প্রবর্তন করে দ্বৈতবাদের বা ডুয়ালিজম এর ধারণা। তিনি বলতে চেয়েছেন, মন এবং দেহ আলাদা কিন্তু অবশ্যই সম্পর্কযুক্ত এবং এই সম্পর্কটা তার মতে মস্তিষ্কের মাধ্যমেই হয়। ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয় দুইটি স্বত্তার মাধ্যমে, সে দুটো হল, মন এবং দেহ। দেকার্তে তার “Meditation on First Philosophy” তে দেখান, তিনি দ্বিধান্বিত হতে পারছেন তার দেহের অস্তিত্ব সম্পর্কে, কিন্তু তখনও তিনি বুঝতে পারছেন তার মনের বা চিন্তার অস্তিত্ব আছে, সে ব্যাপারে তিনি দ্বিধাহীন। এখান থেকেই দেকার্তে এই সিদ্ধান্তে আসেন, মন এবং দেহ দুটি আলাদা ব্যাপার।


রেনে দেকার্তের ডুয়ালিজমের ইলাস্ট্রেসন। ইনপুট সেন্সরী অরগ্যানের মাধ্যমে যাচ্ছে মস্তিষ্কে এবং সেখানে অবস্তুগত অস্তিত্বে (spirit, essence of life)পরিনত হচ্ছে।

দেকার্তের মন-দেহের ডুয়ালিজমের ধারণায় আছে তিনটি ভাগ, যা ভিন্ন ভিন্ন ধারণার প্রবর্তন করে।
১. Substance dualism যা বিবৃত করে, দেহ ও মন দুটি আলাদা অস্তিত্ব।
২. Property dualism যা বিবৃত করে দেহ ও মনের ধর্মে Ontological distinction বিদ্যমান।
৩. Predicate dualism যা বিবৃত করে মনের স্বাতন্ত্র দেহের স্বাতন্ত্রের চেয়ে অন্যূন।

বস্তুবাদ বা ম্যাটেরিয়ালিজম
এরপর আসে মনস্তত্ত্বে ডারউইন এবং ওয়ালেস যুগ, যারা উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বস্তুবাদের প্রবর্তন করে। বর্তমানের কালের বিজ্ঞান আচরণের যৌক্তিক ব্যখ্যাকেই মেনে নিয়েছে। বস্তুবাদ বলে এমন এক দার্শনিক অবস্থার কথা, যাতে ব্যবহার নিয়ন্ত্রিত হয়, নার্ভাস সিস্টেমের কার্যকারিতা দিয়ে, যাকে মনের অনুপস্থিতি দিয়েই ব্যাখা করা যায়। স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের মনস্তত্ত্ব ব্যাখায় স্থান করে নেয় ডারউইনের ন্যাচারাল সিলেকশন থিওরী।

পৃথিবীর বয়স প্রায় সাড়ে চার বিলিয়ন বছর, আর প্রথম প্রাণের সূচনা, তারও প্রায় এক বিলিয়ন বছর পরে। প্রথম ব্রেইন সেলের উদ্ভব হয় প্রায় ৭০০ মিলিয়ন বছর আগে এবং ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে তা মস্তিষ্কের রূপ ধারন করে। মানব সদৃশ মস্তিষ্ক সৃষ্টি হয় মাত্র তিন থেকে চার মিলিয়ন বছর আগে যাকে পৃথিবীর বয়সের তুলনায় চোখের পলক ফেলার মত সময় বলা যায়। মানুষের মস্তিষ্ক বর্তমান রূপ পেয়েছে প্রায় এক থেকে দুই লক্ষ বছর আগে। আর এই রূপে সে এসেছে বহু বিবর্তনের পথ ধরে।

ডারুইনের ন্যাচারাল সিলেকশন থিওরীর মস্তিষ্ক এবং আচরণের গবেষণায় তিনটি গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রয়োগ আছে।

১। যেহেতু প্রত্যেক প্রাণীর পরস্পরের সাথে যোগসূত্র আছে, তাই তাদের নিউরন এবং মস্তিষ্কেও অবশ্যই সেই যোগাসূত্র আছে। এইকারণেই বিজ্ঞানীরা বানর, ফ্রুটফ্লাই, ইঁদুর ইত্যাদির উপর গবেষনা করে, যা থেকে প্রাপ্ত ফলাফল হয়তো কোন না কোন ভাবে মানুষের কাজে লাগবে।

২। যেহেতু সব প্রানী পরষ্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তেমনি তাদের আচরণও। একই ধরণের ব্যবহার, একই আদিপুরুষ থেকে উদ্ভবের ইঙ্গিতবহ। যেমন পৃথিবীর যে প্রান্তেই বসবাস করুক না কেন, সবাই আনন্দের বহিঃপ্রকাশে হাসে, যা একই আদিপুরুষের ইঙ্গিত বহন করে।

৩। মস্তিষ্ক এবং আচরণ একটু একটু করে পরিবর্তিত হয়েছে যা তাদেরকে ক্রমাগত জটিল করে তুলেছে। মানুষের নার্ভাস সিস্টেম নার্ভ ফাইবারের একটা সরল, জালিকার মত বিন্যাস থেকে স্পাইনাল কর্ড সমেত জটিল কাজ করতে সক্ষম মস্তিষ্কে পরিণত হয়েছে যা পরিপূর্ণভাবে মানুষকে টিকে থাকার উপযোগী করে তুলেছে।

মস্তিষ্কের আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ এখন এতোটাই সহজবোধ্য যে, ১৯৪৯ সালে ডোনাল্ড ও হেব্ব, তার প্রভাব বিস্তারকারী বই, The Organization of Oehavior এ প্রকাশ করেছেন ব্রেইন থিওরী,
“Modern psychology takes completely for granted that behavior and neural function are perfectly correlated, that one is completely caused by the other. There is no separate soul or life force to stick a finger into the brain now and then and make neural cells do what they would not otherwise” (Hebb, 1949, p.xiii)
[অনুবাদ]
“আধুনিক মনোবিজ্ঞান এটা নিঃশঙ্কোচে মেনে নিয়েছে যে আচরণ এবং স্নায়বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পুরোপুরি সম্পর্কযুক্ত অর্থাৎ, একটি অন্যটির দ্বারাই ঘটে। মাথার মধ্যে আলাদা কোনো আত্মা বা প্রাণশক্তি নেই যেটা একবার এখানে আরেকবার ওখানে বোতাম চেপে স্নায়ুকোষগুলোকে এটা-ওটা করার নির্দেশ দেবে।” (হেব্ব‌, ১৯৪৯,p.xiii)

কিছু মানুষ এই ব্রেইন থিওরীকে প্রত্যাখান করেছে, কারন তারা ধর্মের প্রভাবে অবগুন্ঠিত হয়ে আছে। তাদের ধারণা, ব্রেইন থিওরী বাতিল করে দিচ্ছে তাদের ধর্ম বিশ্বাসের মানব আচরণ নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতাকে। কিন্তু এর জীববৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ধর্মের উর্ধে। এই ব্রেইন থিওরী ইঙ্গিত করে মানুষের আচরণের ব্যাপারে ধর্মীয় বিশ্বাস গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষের আচরণের জন্য দায়ী তার মস্তিষ্ক, ধর্মের বিধি নিষেধ মানুষের আচরণ নিয়ন্ত্রনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারে না।

আচরণ কি?
Irenaus Eibil-Eibesfeldt এর ১৯৭০ সালে প্রকাশিত “Ethology: The Biology of Behavior” বইতে বলা হয়েছে, আচরণ সময়ের প্রথাগত সাঁচে বা অনুলিপিতে গড়া। এই অনুলিপিই নিয়ন্ত্রন করে চলন বলন সবকিছু। যেমন সারা পৃথিবীতে মানুষ হাসে, মোটামুটি একইভাবে। মানুষের মুখের একধরনের বিশেষ সংকোচন ও প্রসারনের প্রকাশ দেখেই আমরা বুঝতে পারি, সেই মানুষটা এখন আনন্দিত, এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশের নামই আমরা দিয়েছি হাসি। এই যে মানুষ হাসে, এটা একধরনের আচরণ। আচরণ বা ব্যবহারের ধরন নির্ভর করে সময়ের উপর। হয়ত, আজ থেকে অনেক বছর পরে আমরা আজকে হাসতে গিয়ে যে মুখভঙ্গিমা করছি, সেই ভঙ্গিমাকে আর আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ভাববো না। সময়ই ঠিক করে দেবে, তখন মানুষ কিভাবে আনন্দ প্রকাশ করবে।

আচরণের সাথে মস্তিষ্কের সম্পর্ক
আচরণ বা ব্যবহারেরও আছে রকমফের। কিছু আচরণ প্রাণী অর্জন করে উত্তরাধিকার সূত্রে আবার কিছু শিখে। সব কাঠঠোকরা পাখি কাঠ ঠোকরায়, এ আচরণটা তারা পায় উত্তরাধিকার সূত্রে। কাঠঠোকরার কাঠ ঠোকরানোর কারণ হল, উত্তরাধিকার সূত্রে সে এমন একটা স্নায়ুতন্ত্র পায় যা নির্দেশ করে কাঠঠোকরা কাঠ ঠোকরাবে। এমনি করে সব প্রাণীপ্রাজাতিরই ছকে বাঁধা কিছু আচরণ আছে যা সে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকে। কিন্তু যেসব আচরণে একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যে কিছুটা হলেও ভিন্নতা দেখা যায়, তা প্রাণীটির মস্তিষ্ক সময়ের সাথে শিখে অর্জন করে। যেমন আমার ভাষা আর চীনদেশের একজন নাগরিকের ভাষা আলাদা। এই ভাষার ভিন্নতা পরিবেশের ভিন্নতার ফলাফল। আমাদের মস্তিষ্কের গড়ন আমাদের উত্তরাধিকার সূত্রে কোন ভাষা দেয় নি, ভাষা ব্যবহার করতে আমরা শিখে নিয়েছি। এই আচরণটা আমাদের শেখা। সুতরাং আচরণ এবং মস্তিষ্ক পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ফাইনেজ গেজের মস্তিষ্কের আঘাতের ফলে তার ব্যক্তিত্বে এসেছিল অভাবনীয় পরিবর্তন। এই ধরনের ঘটনাই আমাদের বলে দেয়, আচরণের সাথে মস্তিষ্ক কতটা সম্পর্কযুক্ত। বর্তমানে গবেষকরা মস্তিষ্কের প্রতিটি অঞ্চলের কাজ বোঝার চেষ্টা করছে, কোন অংশ কোন আচরণকে কীভাবে প্রভাবিত করছে, তা বোঝার চেষ্টা করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনোবৈজ্ঞানিক আচরণ এবং এর অসামঞ্জস্য আমাদের কাছে এখনো অনেকটাই রহস্যময়। কিন্তু এই রহস্যের মূল লুকিয়ে আছে মস্তিষ্কের মাঝে। মস্তিষ্কের অস্বাভাবিকতা যেমন আচরণে প্রভাব ফেলে, তেমনি আচরণের অসংলগ্নতা বা অসামঞ্জস্যতাও আমাদের মস্তিষ্কের কাজে অসামঞ্জস্যতা বা ত্রুটির ইঙ্গিত দেয়। আর তাই আজ মানব মনের রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য, বিজ্ঞানীরা করে চলেছে মস্তিষ্কের গবেষণা। এমনকি, আমাদের সভ্যতা সংস্কৃতির গতিপথও লুকিয়ে আছে এই মস্তিষ্কের মাঝেই। মানবসভ্যতা আজ এই অবস্থানের এসে দাড়াতে পেরেছে তার শেখার এবং বোঝার ক্ষমতার জন্যই।

তথ্যসূত্রঃ
1. Introduction to Brain & Behavior by Bryan Kolb / Ian Q. Whishaw, 2001.
2. http://neurophilosophy.wordpress.com/2006/12/04/the-incredible-case-of-phineas-gage/
3. http://en.wikipedia.org/wiki/Dualism_(philosophy_of_mind)
4. http://en.wikipedia.org/wiki/Soul

[বানান সংশোধণ এবং ব্রেইন থিওরীর অনুবাদের জন্য কৃতজ্ঞতা তানভীরুল ইসলামকে।]
[এটা লার্নার্স নোট। পড়ছি, শিখছি এবং লিখছি। কোন ভুল চোখে পড়লে ধরিয়ে দিলে মহা উপকৃত হব। ]