রোমান্টিক পর্ব
মাত্রাবৃত্তের ব্যবহার রোমান্টিক যুগে কবিতার দিগন্ত খুলে দেয়। বিশেষত এই ছন্দের ছয় মাত্রার পর্ব দিয়ে এই যুগ নিয়ন্ত্রিত হলেও, চার পাঁচ ছয় সাত ও আট মাত্রার পর্বের চাল, স্তবক বিন্যাসের অভিনবত্ব, অন্ত্যমিল প্রয়োগের বিভিন্ন কৌশল বাংলা কবিতাকে শক্তিশালী করে তোলে। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক অক্ষরবৃত্তের আট-ছয় এর চালকে বর্ধিত করে আট-দশের চালে পরিণত করা, অর্থাৎ মহাপয়ার তৈরী, সময়ের দাবী মেটাতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে মাত্রাবৃত্তের চিরাচরিত মন্থরতায় অপূর্ব গতি সঞ্চারের মাধ্যমে কাজী নজরুল ইসলাম ‘ভাষার-নাচন-তোলা’র মতো দ্যোতনা সৃষ্টি করেন। সংস্কৃত ছন্দের আদলে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত কর্তৃক মন্দাক্রান্তা সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ চাল সংযোজনও হয় এই পর্বে এসে। একদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কর্তৃক স্বরবৃত্তকে ভাবগম্ভীর কবিতার শরীর নির্মাণে ব্যবহার করা, অন্যদিকে কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক এই ছন্দে বীর রসের সংযোজনও বাংলা কবিতাকে উল্লেখ করার মতো সমৃদ্ধি এনে দেয়।

অক্ষরবৃত্ত ছন্দ:

১.
সংসারে সবাই যবে সারাক্ষণ শত কর্মে রত,
তুই শুধু ছিন্নবাধা পলাতক বালকের মতো
মধ্যাহ্নে মাঠের মাঝে একাকী বিষণ্ণ তরুচ্ছায়ে
দূরবনগন্ধবহ মন্দগতি ক্লান্ত তপ্ত বায়ে
সারাদিন বাজাইলি বাঁশি। ওরে, তুই ওঠ্ আজি।
(এবার ফিরাও মোরে/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

সমিল প্রবহমান মহাপয়ার। আট-দশ এর এই বুননে লক্ষণীয় যে অন্ত্যমিল বিদ্যমান, অর্থাৎ পয়ারের অন্ত্যমিল আর অমিত্রাক্ষরের চলমানতা এই দুটিকে ধারণ করে প্রতি লাইনে সংযোজিত হয়েছে অতিরিক্ত চারটি করে মাত্রা। পঞ্চম লাইনে অবশ্য দশ-আট এর পর্ব এসেছে, যা মহাপয়ারের অন্য একটি সিদ্ধ উপায়।

২.
দেখিলাম─অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়
দেহ মোর ভেসে যায় কালো কালিন্দীর স্রোত বাহি
নিয়ে অনুভূতিপুঞ্জ, নিয়ে তার বিচিত্র বেদনা,
চিত্র-করা আচ্ছাদনে আজন্মের স্মৃতির সঞ্চয়,
নিয়ে তার বাঁশিখানি। দূর হতে দূরে যেতে যেতে
ম্লান হয়ে আসে তার রূপ;…
(অবসন্ন চেতনার গোধূলিবেলায়/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

অমিল পবহমান মহাপয়ার। আট-দশ এর চালে কোনো অন্ত্যমিল না রেখে স্রোতের মতো বুনে গেছেন কবিতার লাইন। বেগ এসেছে ছন্দে।

৩.
…ভারতের পূর্বশেষে
আমি বসে আছি সেই শ্যামবঙ্গদেশে
যেথা জয়দেব কবি কোন্ বর্ষাদিনে
দিখেছিলো দিগন্তের তমালবিপিনে
শ্যামচ্ছায়া, পূর্ণ মেঘে মেদুর অম্বর।
(মেঘদূত/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

সমিল প্রবহমান পয়ার। রোমান্টিক যুগ অন্ত্যমিলের যুগ, এখানে আট-ছয় এর চালে অন্ত্যমিল পাওয়া যায়। “শ্যামচ্ছায়া” শব্দটি দিয়ে বাক্য সম্প্রসারণ করার এই ধরণ আগেই লক্ষ্য করা গেছে মধুসূদন দত্তের কবিতায়। তবে রবীন্দ্রনাথ এই প্রসারণ ঘটিয়েছেন জোড় সংখ্যক মাত্রা দিয়ে; মধুসূদনের কালে বেজোড় সংখ্যক মাত্রায়ও যা অহরহ করা হতো।

৪.
বেদনা হলুদ-বৃন্ত কামনা আমার
শেফালীর মত শ্রভ্র সুরভি-বিথার
বিকশি উঠিতে চাহে, তুমি হে নির্মম
দল বৃন্ত ভাঙ শাখা কাঠুরিয়া-সম।
(দারিদ্র্য/কাজী নজরুল ইসলাম)

প্রবহমান সমিল পয়ারের এই বুনন রোমান্টিক কালের অনেক কবির ভেতরেই পাওয়া যায়। আট-ছয় এর চালে অন্ত্যমিল রেখে নজরুলও প্রচুর কবিতা রচনা করেন। অক্ষরবৃত্তের আরো বিচিত্র ব্যবহার এই সময়ের রচনায় চোখে পড়ে।

মাত্রাবৃত্ত ছন্দ:

মাত্রাবৃত্তের নানা রকম ব্যবহারে রোমান্টিক কাল পর্বটি হয়ে উঠেছে আলো-ঝলমল। যদি এভাবে বলা হয় যে রোমান্টিক যুগ মাত্রাবৃত্তের যুগ, তবে এতোটুকু অপলাপ হবে না। রোমান্টিক কবিতা ধীর লয়ের এক রকম মাদকতা তৈরী করে; অক্ষরবৃত্তের মতো গাম্ভীর্যপূর্ণ না হয়ে মিষ্টি ভাষায় বিলম্বিত স্রোতের মতো এর চলা। আর সেই রোমান্টিক যুগের প্রাণ পুরুষ রবীন্দ্রনাথের হাতেই মাত্রাবৃত্ত বিচিত্র রকম শারীরীক অবয়ব ধারণ করে।
কথিত আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বউদিকে একদা বলেছিলেন যে তিনি বিহারীলালের মতো কবি হতে চান। সেই সময়কার পরিচিত কবি বিহারীলালকে অনুসরণ করা তরুণ রবির জন্যে অনুচিতও ছিলো না। এবং তিনি যে কাব্য বুননের ক্ষেত্রে কিছু কাল এই কবির স্মরণাপণ্য ছিলেন তার প্রমাণও পাওয়া যায়। বিহারীলাল যেমন মাত্রাবৃত্ত ঘেষা অক্ষরবৃত্তে কবিতা লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথেও শুরুর দিকে এই ধরণের কবিতার উদাহরণ রয়েছে। বিহারীলাল চক্রবর্তীর একটি কবিতা:

৫.
মধুর মদির স্বর
উঠিতেছে তর তর
আসিয়া নিঝর যেন উথলি উথলি ধায়
চারিদিকে সংগীতের কি এক মুরতি ভায়।
(প্রভাত/ বিহারীলাল চক্রবর্তী)

অক্ষরবৃত্তে পর্ব গঠিত হয়েছে আট মাত্রায়। কিন্তু “চারিদিকে সংগীতের” এই পর্বটি যুক্ত না হলে, কিম্বা “সংগীতের” শব্দটিকে “বাতাসের” অথবা “সুবাসের” এই জাতীয় একটি শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করলে কাব্যাংশটুকু মাত্রাবৃত্তে রচিত বলে অনায়াসে চালিয়ে দেয়া যেতো।
এবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কবিতার ছন্দ বিশ্লেষণ করা যাক।

৬.
আকাশের পানে চাই সেই সুরে গান গাই
একেলা বসিয়া।
একে একে সুরগুলি অনন্তে হারায়ে যায়
আঁধারে পশিয়া।
(দৃষ্টি/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

অবাক করার মতো হলেও একটি মাত্র শব্দ এই কাব্যাংশটুকুকে অক্ষরবৃত্ত করে রেখেছে। অক্ষরবৃত্তের আট-আট-ছয় চালের এই বুনন, যা মধ্যযুগেও প্রত্যক্ষ করা গেছে, অনায়াসে মাত্রাবৃত্তে ফেলে দেয়া যেতো যদি “অনন্তে” শব্দটিকে “অসীমে” অথবা “আকাশে” জাতীয় শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যেতো। তবে সুখের কথা হলো, মানসী কাব্যগ্রন্থের শেষ দিকে এসে রবীন্দ্রনাথ অক্ষরবৃত্তের এই বাধা অতিক্রম করে পুরোপুরি মাত্রাবৃত্তে ঢুকে যান। জলের স্রোতের মতো প্রসারিত হতে থাকে মাত্রাবৃত্তের চাল।

৭.
ঢাকো ঢাকো মুখ টানিয়া বসন, আমি কবি সুরদাস।
দেবী, আসিয়াছি ভিক্ষা মাগিতে, পুরাতে হইবে আশ।
অতি অসহন বহ্নিদহন
মর্ম-মাঝারে করি যে বহন
কলঙ্করাহু প্রতি পলে পলে জীবন করিছে গ্রাস।
(সুরদাসের প্রার্থনা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মাত্রাবৃত্তের ছয় মাত্রার চালে এইসব পর্ব নির্মাণে অক্ষরবৃত্ত আর কোনো বাধার সৃষ্টি করতে পারেনি। প্রতিটি বদ্ধস্বরই দুইমাত্রা নিয়ে অগ্রসর হয়েছে।

৮.
নিশীথের তল হতে/ তুলি
লহো তারে প্রভাতের/ জন্য
আঁধারে নিজেকে ছিল/ ভুলি
আলোকে তাহারে করো/ ধন্য।
(শুকতারা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আট মাত্রার পর্ব। লাইন শেষের অবস্থান ঠিক রেখে অতিপর্বে কখনো দুই কখনো তিন এসেছে।

৯.
গগনে গরজে মেঘ,/ ঘন বরষা
কুলে একা বসে আছি,/ নাহি ভরসা।
রাশি রাশি ভারা ভারা/ ধান-কাটা হল সারা,/
ভরা নদী ক্ষুরধারা/ খরপরশা─
কাটিতে কাটিতে ধান/ এল বরষা।।
(সোনার তরী/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

আট মাত্রার পর্ব ও পাঁচ মাত্রার অতিপর্ব রেখে কবিতাটি রচিত। এখানে অন্ত্যমিল ও মধ্যমিল বিন্যাসের অভিনবত্ব আছে।
১০.
বন্ধুর মুখ চাও,/ সখা হে যেথা যাও,/ দুঃখ দুস্তর/ তরাও ভাই,
কল্যাণ-সংবাদ/ কহিয়ো কানে তার,/ হায়, বিলম্বের/ সময় নাই,
বৃন্তের বন্ধন/ আশাতে বাঁচে মন,/ হায় গো, বল্ তার/ কতই আর?
বিচ্ছেদ-গ্রীষ্মের/ তাপেতে সে শুকায়,/ যাও হে দাও তায়/ সলিল্-ধার।
(যক্ষের নিবেদন/ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

লাইনের শুরুতে আট মাত্রার একটি পর্বের পরেই সাত মাত্রার দু’টি পর্ব এবং শেষে পাঁচ মাত্রার একটি অতিপর্ব। বিশ শতকের শরুর দিকে এটি ছিলো সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের উদ্ভাবিত নতুন পদ্ধতি; অনেকটা সংস্কৃত মন্তাক্রান্তার মতো। তবে প্রথম পর্বটি সাত এর পরিবর্তে আট মাত্রায় রচিত। তাছাড়া প্রথম পর্বে চারটি করে বদ্ধস্বর রাখা হয়েছে। উল্লেখ্য যে এই কবি বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে সংস্কৃতের আদলে বেশ কয়েকটি ছন্দের নমুনা বাংলায় এনেছিলেন। সম্ভবত স্বরমাত্রিক ছন্দে প্রথম কবিতা তিনিই লেখেন। মাত্রাবৃত্তে ছয়-পাঁচ চালে কবিতা লিখে তিনি এর নাম দিয়েছিলেন মঞ্জুশ্রী। তবে দুঃখের বিষয় কেবল মন্দাক্রান্তা ও স্বরমাত্রিক ছন্দ ছাড়া তার উদ্ভাবিত কোনো ছন্দই পরবর্তী সময়ের কবিরা তুলে নেননি। মন্দাক্রান্তা বিস্তার লাভ করেছে স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্ত উভয় ছন্দে।

১১.
খাঁচার পাখি ছিল/ সোনার খাঁচাটিতে/
বনের পাখি ছল/ বনে।
একদা কি করিয়া/ মিলন হল দোঁহে,/
কী ছিলো বিধাতার/ মনে।
(দুই পাখি/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

মন্তাক্রান্তায় রবীন্দ্রনাথ এখানে সত্যেন্দ্রনাথ রচিত প্রথম পর্বটি বাদ দিয়ে সাত মাত্রার বুনন নিয়ে এসেছেন। এটিই বাংলা কবিতায় পরবর্তী সময়ে ব্যাপকতা পেয়েছে।

১২.
রাখাল বলিয়া/ কারে করো হেলা,/ ও-হেলা কাহারে/ বাজে।
হয়তো গোপনে/ ব্রজের গোপাল/ এসেছে রাখাল/ সাজে।
(মানুষ/ কাজী নজরুল ইসলাম)

প্রতি লাইনে ছয় মাত্রার তিনটি করে পর্ব সংযোজিত হয়েছে।

১৩.
দিন যে ফুরালো,/ রবে না এ আলো,/ আসিছে নিশুতি/ রাতি─
সে আঁধারে সখী/ কেহ যে হবে না/ কাহারো বাসর/-সাথী।
নিশীথ আকাশে/ আসিবে যে তারা,/
চোখে চোখে শুধু/ করিবে ইসারা/
সে কি কৌতুকে/ মাতি─
এত প্রেম, প্রাণ/ সব নির্বাণ!/ শেষ এল সেই/ রাতি!
(দিনশেষে/ মোহিতলাল মজুমদার)

ছয় মাত্রার পর্ব। এই উদাহরণটি একটি দীর্ঘ কবিতার স্তবক। এ সময়ে দীর্ঘ কবিতায় একই রকম স্তবক বিন্যাসের প্রচলন ছিলো।

১৪.
চিত চুম্বন/-চোর-কম্পন/ [আমি] থর থর থর/ প্রথম প্রকাশ/ কুমারীর!
আমি গোপন প্রিয়ার/ চকিত চাহনি,/ ছল-ক’রে-দেখা/ অনুখন,
আমি চপল মেয়ের/ ভালোবাসা, তার/ কাঁকন-চুড়ির/ কন্-কন্।
আমি চির-শিশু চির-/ কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু/ পল্লীবালার/ আঁচর কাঁচলি/ নিচোর!
আমি উত্তর-বায়ু/ মলয়-অনিল/ উদাস পূরবী/ হাওয়া,
আমি পথিক-কবির/ গভীর রাগিণী/ বেণু-বীণে গান/ গাওয়া।

আমি তুরীয়ানন্দে/ ছুটে চলি, এ কি/ উন্মাদ আমি/ উন্মাদ!
আমি সহসা আমারে/ চিনেছি, আমার/ খুলিয়া গিয়াছে/ সব বাঁধ! (বিদ্রোহী/ কাজী নজরুল ইসলাম)

যে ছন্দটিকে মন্থর মনে করা হতো, তাতে এলো বেগ। এলো নাচের মুদ্রা। কলকল করে এই ভাবে যৌবনের ধ্বনি শোনালেন নজরুল তাঁর “বিদ্রোহী” কবিতায়। মাত্রাবৃত্তের ছয় মাত্রার চালে এলো নতুন জোয়ার। কখনো বা শোনা গেলো যুদ্ধের বাজনা। ভাষার নাচন ছাড়া একে আর কিই বা বলা যায়! অথচ লাইনের ভেতরেও গুঁজে দেয়া হলো উপপর্ব, যেমন “চিত চুম্বন-চোর-কম্পন আমি থর থর থর প্রথম প্রকাশ কুমারীর!” এই পঙক্তির মাঝে ব্যবহৃত “আমি” শব্দটি দুই মাত্রার উপপর্ব যারা অন্যান্য লাইনের আগে বসেছে। অন্যদিকে কখনো চার, কখনো তিন, কখনো দুই মাত্রার অতিপর্ব আনা হয়েছে।

১৫.
চল্ চল্ চল্/
ঊর্ধ্ব গগনে/ বাজে মাদল,
নিম্নে উতলা/ ধরণী-তল
অরুণ প্রাতের/ তরুণ দল
চল্ রে চল্ রে/ চল্।
চল্ চল্ চল্।/
(চল্ চল্ চল্/ কাজী নজরুল ইসলাম)

ছয়-পাঁচ এর বুনন, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত যার নাম দিয়েছিলেন মঞ্জুশ্রী, সেই দোলায় এবার এলো রণ-দামামা। কী সহজে বাজনার তালে তালে ছুটে এলো গগন বিদারী আওয়াজ!

১৬.
অতনু আকাশে/ যাঁর বিহার/
যাঁর প্রকাশ/ চিত্তে ভায়/
সবিতা বারতা/ বয় যাঁহার/
আজ প্রণাম/ তাঁর দু’পায়।/
(প্রণাম/সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের এই আদি মঞ্জুশ্রীতে ছিলো চার পর্বের পঙক্তি: ছয়-পাঁচ-পাঁচ-পাঁচ। প্রথম ও দ্বিতীয় পঙক্তিতে মুক্ত ও বদ্ধ স্বরের অবস্থান ছিলো একই সমান্তরালে।

১৭.
এই লভিনু/ সঙ্গ তব,/ সুন্দর হে/ সুন্দর!
পূণ্য হল/ অঙ্গ মম,/ ধন্য হল/ অন্তর,
সুন্দর হে/ সুন্দর!
(সুন্দর/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

পাঁচ মাত্রার চাল, অতিপর্বে আছে চারমাত্রা।

১৮.
ভুলি কেমনে/ আজো যে মনে/ বেদনা-সনে/ রহিল আঁকা।/
আজো সজনী/ দিন রজনী/ সে বিনে গণি/ তেমনি ফাঁকা॥/
(গান/ কাজী নজরুল ইসলাম)

পাঁচ মাত্রার চাল। কোনো অতিপর্ব নেই। পঙক্তিতে আছে চারটি করে পূর্ণ পর্ব।

১৯.
ক.
নিরজন/ নিদ্পুর/─
নিকেতন/ মৃত্যুর,/
বায়ু হায়/ মূরছায়/
ঢেউ নাই/ সিন্ধুর।/
(জিন/সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

খ.
তুমি বল/─“আমি হায়/
ভালবাসি/ মাটি-মায়,/
চাই না এ/ অলকায়/
ভালো এই/ পথ ভুল।”/
(ঝিঙে ফুল/ কাজী নজরুল ইসলাম)

চার মাত্রার পর্ব। প্রতিলাইনে দু’টি করে পর্ব এসেছে। কোনো অতিপর্ব নেই। মাত্রাবৃত্তে এই ধরনের কবিতাকে আট মাত্রার পর্ব বলে মনে হয়। এই চাল সাধারণত ছড়ায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

স্বরবৃত্ত ছন্দ:

স্বরবৃত্ত প্রধানত চার মাত্রার পর্ব গঠন করে। বিশেষ উপায়ে এটাকে কেবল সাতমাত্রার পর্বে উত্তীর্ণ করা যায়। লাইনে পর্ব সংখ্যা এবং অতিপর্বে মাত্রা সংখ্যা বাড়িয়ে কমিয়ে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপপর্ব রেখে এই ছন্দে বিভিন্ন ধরণের শ্রুতি-ব্যঞ্জন গড়ে তোলা হয়েছে। এই ছন্দে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ভাবগাম্ভীর্যময় কবিতা আর কাজী নজরুল সংযোজন করেছেন বীর রস।

২০.
এইতো তোমার আলোক-ধেণু সূর্যতারা দলে দলে─
কোথায় বসে বাজাও বেণু, চরাও মহাগগন-তলে।
(আলোক ধেণু/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

চারটি করে পর্ব, কিন্তু কোনো অতিপর্ব নেই।

২১.
তুই কি ভাবিস দিনরাত্তির খেতে আমার মন?
কক্ষনো তা সত্যি না মা, আমার কথা শোন!
(খেলাভোলা/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

তিনটি করে পর্ব এবং একমাত্রার একটি অতিপর্ব সংযোজিত হয়েছে।

২২.
একটা কি সুর গুনগুনিয়ে কখন আমার বাজে
মায়ের কথা মিলায় যেন আমার কথার মাঝে।
(মনে-পড়ে/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)

লাইনে তিনটি করে পর্ব এবং দুইমাত্রার অতিপর্ব সংযোজিত হয়েছে।

২৩.
নেইকো দ্বন্দ্ব দু’ইচ্ছাতে,─
নেইকো লোকের নিন্দাভয়।
─হাসছ? হাস। কিন্তু প্রিয়ে
করব বিয়ে সুনিশ্চয়।
(ফুল-সাঞ্চি/ সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত)

তিনটি করে পর্ব এবং তিন মাত্রার অতিপর্ব সংযোজিত হয়েছে।

২৪.
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে।

গগন ফেটে চক্র ছোটে, পিনাক-পাণির শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে উল্টাতে,…
(আজ সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে/ কাজী নজরুল ইসলাম)

পর্ববিন্যাস:

আজ সৃষ্টি-সুখের/ উল্লাসে
মোর মুখ হাসে মোর/ চোখ হাসে মোর/ টগবগিয়ে/ খুন হাসে
আজ সৃষ্টি-সুখের/ উল্লাসে।

গগন ফেটে/ চক্র ছোটে,/ পিনাক-পাণির/ শূল আসে!
ঐ ধূমকেতু আর/ উল্কাতে
চায় সৃষ্টিটাকে/ উল্টাতে,…

স্বরবৃত্তে এখানে বীর-রস এসেছে। এসেছে বাঁধ ভাঙার আওয়াজ। লাইনে এসেছে অসম পর্ব, এবং রাখা হয়েছে একমাত্রার উপপর্ব ও তিনমাত্রার অতিপর্ব।

২৫.
মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই
বিষম চলার ঘায়!
যুগে যুগে রক্তে মোদের
সিক্ত হ’ল পৃথ্বীতল!

মোদের চক্ষে জ্বলে জ্ঞানের মশাল
বক্ষে ভরা বাক,
কণ্ঠে মোদের কুণ্ঠাবিহীন
নিত্য কালের ডাক
আমরা তাজা খুনে লাল করেছি
সরস্বতীর শ্বেত কমল।
(ছাত্রদলের গান/ কাজী নজরুল ইসলাম)

আছে উপপর্ব এবং অতিপর্ব। এখানে এসেছে রক্তে আগুন লাগা সময়ের ডাক। স্বরবৃত্তে লেগেছে বীরত্বের ছোঁয়া।

২৬.
পুকুরের ওই কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না,
হোতা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গ্যে যেই চ’ড়েছি
ছোট এক ডাল ধ’রেছি
ও বাবা মড়াৎ করে
প’ড়েছি সড়াৎ জোরে!
(লিচু-চোর/কাজী নজরুল ইসলাম)

সাত মাত্রার একটি করে পর্ব দিয়ে গঠিত হয়েছে প্রতিটি লাইন। এটি স্বরবৃত্তে মন্দাকান্তা ছন্দের উদাহরণ।

স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত এই তিন প্রকার ছন্দই রোমান্টিক কালপর্বে ব্যবহৃত হয়ে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। লাভ করেছে নানামুখি বিস্তৃতি। তথাপিও এই যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সবচে বেশী চলেছে মাত্রাবৃত্তের চাল। মাত্রাবৃত্ত একদিকে যেমন জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা ও শান্ত স্রোতের মহিমা দিয়েছে, অন্যদিকে দিয়েছে রক্তে চাঞ্চল্য ও ঝড়ের তিব্রতা।