প্রারম্ভিক মুখব্যাদান : আমার দাদা মলয় রায়চৌধুরী লেখার কপিরাইটে বিশ্বাস করেন না। আমিও না। আমার কাছে বিষয়টাই প্রধান। বিষয় হল বিষ। গরল। আবার এই বিষয়ের মধ্যেই কেউ কেউ অমৃত খুঁজে পান। আমরা কোন দলে? কোন্দলে? তাই তো মনে হয় মাঝে মাঝে বাক্যবান শুনে। তবে ভাই, আমার অবস্থা রসে ভেসে যাই টাইপের। পুরো তাল রস। তাজা খাইলে মাথা ঠাণ্ডা। মাজা খাইলেই মাথা আউলা। বীর রস ছোটে মুখে। শুদ্র মানুষের এই অক্ষমতা আশা করি ক্ষ্যামা চোখে দেখাই সঙ্গত।
অন্য আলোয় দেখা রবীন্দ্রনাথ নিয়ে কিছু মুখব্যাদান (Introduction) শুনতে হয়েছে। সেকারণে কিঞ্চিত দেহে ও আত্মায় একটু চেঞ্জ আনার কোশেস করা হল। কোশেস শব্দটির মানে হল টেরাই–বা চেষ্টা করা। আর সাজিস মানে হল ষড়যন্ত্র। সুতরাং সাধু সাবধান। বিষয়ের মধ্যে বিষ না আমিত্তি– এইটা নেড়ে চেড়ে দেখাই আমাদের এই সময়ের কাজ। এই কাজটি অনুধাবন করতে না পারলে অনেক প্রাপ্ত বিপ্লব ছিনতাই হয়ে যাইলেই যাইতে পারে। (এই বাক্যটি সুফি দার্শনিক ফরহাদ মজহারীয় এবং মহাত্মা সলিমউল্লাহ খান হইতে চুরিকৃত)। আসেন, রসপান করি। তাজা বা মাজা—উহা কইতে পারি না। আমেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………
ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা :
রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগটি এনেছিলেন প্রয়াত প্রফেসর আহমদ শরীফ। তিনি বলেছিলেন—তিনি প্রজাপীড়ক জমিদার ছিলেন। ফরহাদ মজহার মশকরা করে বলেছিলেন—

আমাদের রবিবাবু মস্তবড় কবি, সাহেবেরা
নোবেল প্রাইজ দিয়ে হক তার সাহিত্য কীর্তির
করেছে কদর। ইংরেজের ঘেঁটু হয়ে তার বাপ-দাদা
মালপানি কামিয়েছে, বনেছে স্বঘোষে জমিদার
(দৈনিক ইনকিলাব,৬ আগস্ট, ২০০০।

প্রবন্ধকার সাদ কামালী তার সম্পাদিত পত্রিকা অগ্রবীজের প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যায় (ডিসম্বর, ২০০৭) ”রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে ও গদ্যে মুসলমানের কথা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’’ প্রবন্ধে আহমদ শরীফের উল্লিখিত প্রবন্ধের অন্তর্ভূক্ত একটি ব্যক্তিগত চিঠি পুরোটা তুলে দিয়েছেন। আহমদ শরীফ লেখক আবুল আহসান চৌধুরীকে একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ যে প্রজাপীড়ক ছিলেন সে বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে বলেছিলেন। কুষ্টিয়ায় অবস্থান জনাব চৌধুরী সে চিঠির উত্তরে প্রথমেই জানাচ্ছেন—ঠাকুর জমিদারদের প্রজাপীড়নের সংবাদ কাঙাল হরিনাথের গ্রাম বার্তা প্রকাশিকা’র কোন বর্ষে কোন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল তা আমাদের সঠিক জানা নেই। আমাদের কাছে ‘গ্রামবার্তার যে ফাইল আছে, তাতে এই সংবাদ নেই। কাঙাল হরিনাথ কুমারখালি বাংলা পাঠশালার প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ১৮৬৩ সালে গ্রামবার্তা প্রকাশিকা পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত পত্রিকাটি মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক ইত্যাদির চেহারায় অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়ে লুপ্ত হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথের প্রজাপীড়ণের কোন সংবাদ এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় নি। কিন্তু ধারণার উপর ভিত্তি করে গুরুকে খুশী করে লেখা চিঠির উত্তর থেকে সাদ কামালী এই যুগে এটা তার প্রবন্ধে ব্যবহার করে বলেছেন—রবীন্দ্রনাথ প্রজাপীড়ক ছিলেন। পরবর্তীতে আবুল আহসান চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে একাধিক প্রবন্ধ-বই লিখেছেন। তিনি কোথাও দাবী করেন নি যে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে আনীত প্রজাপীড়নের অভিযোগটি সঠিক।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক গোলাম এবনে সামাদ দৈনিক সংগ্রামে মাঝে মাঝে এ ধরনের কলাম লিখে থাকেন। তিনিও প্রজাপীড়ক জমিদার হিসাবে রবীন্দ্রনাথকে চিহ্ণিত করে থাকেন। এবনে সামাদ একাত্তরে পাক বাহিনীর দোসর ছিলেন। একাত্তরের পরে এই অপরাধে তাঁকে চাকরীচ্যুত করা হয়। জিয়াউর রহমান তাঁকে চাকরী ফিরিয়ে দেয়। সুতরাং এই প্রজাপীড়কের অপপ্রচারকরা কী মাল সেটা জানানোর জন্যই এই সব ছোট খাট তথ্য বলা হল।

খুল খুল সীম যা : জমিদার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুর ছিলেন ব্যবসায়ী। তার পুত্র রামলোচন ঠাকুর বিরাহিমপুর পরগনা (যার সদর কাছারি ছিল শিলাইদহে) জমিদারী কিনেছিলেন। তিনি ছিলেন প্রখর বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি। জমিদারী কিনে পীরালী ঠাকুরদের মধ্যে তিনি কিছুটা আভিজাত্য অর্জন করেছিলেন।

রামলোচন ঠাকুর মৃত্যুর আগে তার দত্তকপুত্র দ্বারকানাথ ঠাকুরকে ১৮০৭ সালে এ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী করে যান। তখন তাঁর বয়স মাত্র তের বছর। তার বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত এ সম্পত্তি রামলোচন ঠাকুরের স্ত্রী অলকা দেবী ও দ্বারকানাথের জেষ্ঠ্য ভ্রাতা রাধানাথ দেখাশুনা করতেন। সে সময় শিলাইদহ এলাকাটির সুনাম ছিল না। প্রজারা ‘দুর্বৃত্ত বলিয়া প্রসিদ্ধ’ ছিল। এ জন্য জমিদারী পরিচালনার আইন-কানুন সুপ্রীম কোর্টের ব্যারিস্টার ফার্গুসনের কাছে ভাল করে জেনে নেন।

আইন বিশেষজ্ঞ হওয়ার কারণে ১৮১৮ সালে তিনি চব্বিশ পরগনার কালেক্টরের শেরেস্তাদার নিযুক্ত হন। ১৮২৮ সালে শুল্ক ও আফিং বোর্ডের দেওয়ান হন।

১৮৩০ সালে কালীগ্রাম পরগনা কিছিলেন। এ ছাড়া উড়িষ্যার পাণ্ডুয়া ও বালিয়া তালুক তাঁর ছিল।

সাজাদপুরের জমিদারিটি কিনেছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর, রানী ভবানীর নাটোরের জমিদারীর নীলাম থেকে। দাম পড়েছিল ১৩ টাকা ১৩ আনা। এর আসল মালিক ছিলেন গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার অবর্তমানে গগনেন্দ্র সমরেন্দ্র অবনীন্দ্র। কিন্তু গিরীন্দ্রনাথের অকালমৃত্যুর পরে দেবেন্দ্রনাথ, এবং তারও পরে গগন্দ্রেনাথরা নাবালক ছিলেন বলে রবীন্দ্রনাথ এই জমিদারী দেখাশুনা করেছেন ১৯০৩ সাল পর্যন্ত।

দ্বারকানাথের পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ধর্মাচরণে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় ব্যবসাপাতি ও জমিদারী পরিচালনায় অমনোযোগী ছিলেন। তখন আয়ের উৎস দাঁড়িয়েছিল শুধুমাত্র প্রজাপ্রদত্ত খাজনা ও অন্যান্য আদায়। বাড়ির পুরুষরা প্রায় কেউই জমিদারী পরিচালনায় অংশ নেন না, কালে ভদ্রে মহালে যান। সেখান থেকে অর্থ আসে। তাঁরা ছিলেন জমিতে অনুপস্থিত জমিদার। পরিবারের সদস্যদের অনেকে সে সব অঞ্চল চোখে পর্যন্ত দেখেন নি। তাঁরা বিলাসী জীবন আর নানাপ্রকার সাংস্কৃতিক কার্যক্রম নিয়ে ব্যস্ত থাকতে ভালবাসতেন। তবে দেবেন্দ্রনাথ মাঝে মাঝে জমিদারী দেখতে গেছেন।

১৮৪৬ সালে দ্বারকানাথের মৃত্যুর পরে তাঁদের হাউসের দেনা এক কোটি টাকা, পাওনা সত্তর লক্ষ টাকা। ৩০ লক্ষ টাকার খবর নাই। ঠাকুর পরিবার গরীব হয়ে গিয়েছিল। সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী লিখেছেন—যাঁহার পিতার ডিনার তিনশত টাকার কমে হইত না, তিনি চারি আনা মূল্যের ডিনার খাইয়া তৃপ্ত হইতেন। সেসময় ১৮৫৫ সালে ঋণের দায়ে দেবেন্দ্রনাথ কারারুদ্ধ হওয়ার পথে। তিনি সংকল্প করলেন দেনা তিনি শোধ করবেন। দেউলিয়া ঘোষিত হবেন না। ছয়মাসের মধ্যেই অবস্থা সামলে ওঠেন। তাঁদের কোনো ব্যবসা বানিজ্য রইল না। শুধু জমিদারীটি টিকে ছিল। তিনি গরীব হওয়ার কারণে বিষয় সম্পত্তিতে মনোযোগী হলেন। শিলাইদহে গিয়ে নিজেই জমিদারী পরিচালনা করা শুরু করলেন। সম্পত্তি এজমালি হওয়ায় সবগুলোই তাঁকে দেখা শুনা করতে হত।

সমীর সেনগুপ্ত লিখছেন—দেবেন্দনাথের চরিত্রের মধ্যে দার্শনিকতা ও বৈষয়িকতার অদ্ভুত পরস্পরবিরোধী সহাবস্থান ছিল। সব কিছু থেকে দূরে থেকেও তিনি তাঁর জমিদারী, আদি ব্রাহ্মসমাজ ও পরিবারকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন।

১৯০৫ সালে দেবেন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়ির সমস্ত জমিদারী সম্পত্তির মোট খাজনা আসত ৩৬৮,৫০৯ টাকা এবং রাজস্ব ও আদায় খরচ বাদে তা থেকে মোট আয় ছিল ২৩৪,৩১০ টাকা।

১৮৬১ সালের দিকে দেবেন্দ্রনাথ জমিদারির প্রত্যক্ষ কার্যভার ক্রমে ছেড়ে দিলেন, প্রথমে পঞ্চমপুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথের উপর। তারপর জ্যেষ্ঠ জামাতা সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপর। রবীন্দ্রনাথ যেদিন বিয়ে করেন সেদিন সারদাপ্রসাদ আকস্মিকভাবে মারা যান। এরপর জমিদারির দায়িত্ব পড়ে রবীন্দ্রনাথের উপর।

এডওয়ার্ড সাহেব নামে জমিদারির এক ম্যানেজার ছিলেন। তিনি শিলাইদহ ছেড়ে যাওয়ার সময় আমলাবাবুদের করমর্দন করে বিদায় অভিবাদন জানিয়ে বলেছিলেন, পোয়েট টেগোরের জমিদারিটা মোটেও তাঁর কবিতার মত নয়। এ বড় বিষম ঠাঁই, এখানে কবিকে খুব ভুগতে হবে।

তিনি প্রথমে এসেই তার কাছারি থেকে হিন্দুদের জন্য আলাদা হুকো—মুসলমানদের আলাদা হুকো এটা বাতিল করে দেন। সবাইকে এক সঙ্গে বসালেন তার কাছারিতে। কখনো তিনি একা, কখনো তিনি সপরিবারে শিলাইদহে, সাহাজাদপুরে থেকেছেন, বোটে করে ঘুরেছেন—পদ্মায়, গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। কুষ্টিয়ার গড়ুই নদীটি তখন শুকিয়ে গিয়েছিল। লোকজনের চলাচলের জন্য কুষ্টিয়া থেকে শিলাইদহ পর্যন্ত ৬ মাইল রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। প্রজাদের সঙ্গে মিশতেন সহজ মানুষের মত। বাউল ফকিরদের ডেকে গান শুনতেন। আলোচনা করতেন। লালন ফকিরের গান তিনিই সংগ্রহ করেছিলেন। কাঙাল হরিনাথের বন্ধু গগণ হরকরার কাছ থেকে আমি কোথায় পাব তারে/ আমার মনের মানুষ যে রে –গানটি শুনে লিখলেন আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি গানটি।

তখন ছিল সাহাবাবুদের সুদের ব্যবসা। তার জমিদারীর দরিদ্র প্রজাদের অধিকাংশই ছিল জোলা বা তাঁতী সম্প্রদায়ভুক্ত। তিনি সাহাদের হাত থেকে শেখদের বাজানোর জন্য পতিসরে কৃষি ব্যাংকের পত্তন করেছেন। মহাজনদের কাছ থেকে মাসে ১০ টাকা হার সুদে ঋণ নিত চাষীরা—আর রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত কৃষি ব্যাংক থেকে তারা ঋণ নিত বার্ষিক ১২ টাকা সুদে। (আজ ডঃ ইউনুসেরগ্রামীন ব্যাংক কৃষকদের কাছ থেকে বার্ষিক ৩৭ শতাংশ সুদে ঋণ প্রদান করে।) রবীন্দ্রজীবনীকার প্রশান্তকুমার পাল লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথ আত্মীয়-বন্ধুদের এখানে টাকা জমা রাখতে প্ররোচিত করতেন, নিজেও নোবেল প্রাইজের বৃহদংশ নিয়োগ করেছিলেন এই ব্যাংকে। কৃষি ব্যাংকের অর্থ প্রজাকল্যাণ ব্যতীত অন্য কাজে ব্যবহার হোক রবীন্দ্রনাথ আদৌ ইচ্ছা করেন নি।

১৯০৫ সালে খ্রীস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও বিলিতি জিনিস বর্জন আন্দোলনের পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথ প্রতিযোগী দেশীয় শিল্প গড়ে তোলার চিন্তাও করেছিলেন। তারই একটি প্রকাশ হল কুষ্টিয়ায় তাঁতের কারখানা স্থাপন। কুষ্টিয়ায় তাতেঁর কারখানা স্থাপন করেন। দুটি ‘কুষ্টিয়া উইভিং স্কুল’ স্থাপন করে গ্রামের লোকজনদের তাঁতকৌশল শেখানো হত। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন—নিম্নমানের সুতো সরবরাহ করা থেকে আরম্ভ করে বহু রকম অসাধুতার সঙ্গে যুদ্ধ করে কয়েক বছরের মধ্যেই উদ্যোগটির অপমৃত্যু ঘটে। ছেলে রথীন্দ্রনাথকে মার্কিন দেশ থেকে কৃষিবিদ্যায় শিক্ষিত করে এনে ১৯০৯ সালে রবীন্দ্রনাথ পুত্রকে সদর শেরেস্তার জমিদারী কাজ বুঝিয়ে দিলেন। বাবার সঙ্গে ছেলে বোটে তখন ঘুরেছেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন—মাঝে মাঝে যখন তিনি ( রবীন্দ্রনাথ) নিজে কিছু বলতেন, তাঁর বিষয় হত দেশের প্রজাসাধারণের সামাজিক ও আর্থিক দুরাবস্থা এবং তার প্রতিকার কল্পে তাঁর অভিজ্ঞতালদ্ধ জ্ঞান।…

শিলাই দহে আমার নতন জীবন শুরু হল–আমি যেন ইংলন্ডের-আমেরিকার পল্লী অঞ্চলের একজন সম্পন্ন কৃষাণ। অনেকখানি জায়গা জুড়ে ক্ষেত তৈরি হল, আমেরিকা থেকে আমদান হয়ে এল ভুট্টার বীজ ও গৃহপালিত পশুর জাব খাবার মত নানাবিধ ঘাসের বীজ, নৈনিতালের আলু। এ দেশের উপযগী করে নানারকম লাঙল, ফলা ও কৃষির অন্যান্য যন্ত্রপাতি তৈরি করা হল—এমন কি, মাটির গুণাগুণ পরীক্ষা করার জন্য ছোটোখাটো একটি গবেষণাগার পত্তন হল। পতিসরে ট্রাক্টরও আনা হয়েছেল। বাংলাদেশে ট্রাক্টর এর আগে কেউ আনে নি। রেশম চাষের ব্যবস্থাও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

রবীন্দ্রনাথ ১৯১১ সালে ১৮ ডিসেম্বর একটি উইল করে প্রায় সমস্ত স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির নির্ব্যূঢ় স্বত্ব দান করেন রথীন্দ্রনাথকে। তিনি উইলের সঙ্গে একটি চিঠিতে পুত্রকে লেখেন—

‘’জমিদারী সম্পত্তির আয় নিজের ভোগে না লাগাইয়া প্রজাদের হিতার্থে যাহাতে নিযুক্ত করেন রথীকে সে সম্বন্ধে বারবার উপদেশ দিয়াছি। তদনুসারে এইরূপ মঙ্গল অনুষ্ঠানে তিনি যদি তাহার পৈত্রিক সম্পত্তি প্রসন্নচিত্তে উৎসর্গ করিতে পারেন তবে আমার বহুকালের একান্ত ইচ্ছা পূর্ণ হয়।…’’।

যে-সমাজে রবীন্দ্রনাথ জন্ম নিয়েছিলেন, ধনী জমিদারদের সেই উনিশ-শতকী সমাজের প্রথাই ছিল জমিদারীতে না যাওয়া, কলকাতার প্রাসাদে শুয়ে বসে, টাকার দরকার হলে (অথবা না হলেও) দরিদ্র প্রজাদের শোষণ করে টাকা সংগ্রহ করা, অলস, উদ্দেশ্যহীন, শিশ্নোপরায়ন জীবন যাপন করে যাওয়া –তাদের নিজেদের পরিবারেই এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। অথচ রবীন্দ্রনাথ কেমনভাবে জমিদারি চালাতেন তাঁর বর্ণনা আছে আই.সি.এস ও’মালি সাহেবের লেখা গেজেটিয়ারে, যেখানে তিনি ঠাকুর জমিদারির পরিচালনব্যবস্থার সপ্রশংস বর্ণনা দিয়ে তারপর বলেছেন, বেশির ভাগ বাঙালি জমিদার যদি ‘কবি রবীন্দ্রনাথের’ মতো করে জমিদারি চালাতেন, তাহলে বাংলাদেশের চেহারা আমূল বদলে যেতে পারত। কোনো দরকার ছিল না তার সমস্ত সঞ্চিত অর্থ, পত্নীর গহনা, শখ করে তৈরি করা পুরীর বাড়ি, নিজের লাইব্রেরী, এমন কি উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া পিতামহের সোনার ঘড়ি, নিজের বইয়ের সত্ব—সব বিক্রি করে গ্রামের মানুষদের জন্য কিছু তার অর্ধেক জীবন অতিবাহিত করা।

…………………………………………………………………………….