অস্তিত্বের রহস্য

আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্বই খুবই কম সময়ের জন্য। আর এই ক্ষণিকের অস্তিত্বে এই মহাবিশ্বের খুব কম অংশই আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব। কিন্তু মানুষ খুবই কৌতুহলী প্রজাতি। সে জানতে চায়, উত্তর খোঁজে। এই কোমল-কঠোর পৃথিবীর বুকে জন্ম গ্রহন করে উপরের সুবিশাল মহাকাশ আর নক্ষত্রপুঞ্জ দেখে যুগে যুগে আমাদের মত মানুষ হাজারো প্রশ্ন করে গেছে: এই যে মহাবিশ্বে আমরা আছি, একে বোঝার উপায় কী? এই মহাবিশ্বের আচরণ কেমন? বাস্তবতার প্রকৃতিই বা কেমন? সবকিছু কোথা থেকে এলো? মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে কি কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন আছে? আমাদের বেশির ভাগই এসব প্রশ্ন নিয়ে সারাক্ষণ মাথা ঘামায় না, কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই কখনো না কখনো এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে।

সাধারণত এ প্রশ্নগুলো ছিলো দর্শনে এখতিয়ারে, কিন্তু দর্শনের মৃত্যু ঘটেছে। দর্শন ব্যর্থ হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক সব উন্নয়নের সাথে তাল রাখতে । এখন বিজ্ঞানীরাই সত্যের সন্ধানে আমাদের একমাত্র আলোকবর্তিকা। এই বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার এবং তাত্ত্বিক অগ্রগতির আলোকে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। এসব বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আমাদের মহাবিশ্বের এবং তাতে আমাদের অবস্থানের এক নতুন চিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছে যেটা গতানুগতিক চিত্র থেকে অনেকটাই আলাদা, এমনকি দুয়েক দশক আগের চিত্র থেকেও অনেক খানিই ভিন্ন। অবশ্য, এই নতুন ধারণার খসড়ার ইতিহাস প্রায় এক শতাব্দী পুরানো।

মহাবিশ্ব সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণা অনুযায়ী যে কোনো বস্তু সুনির্ধারিত পথে পরিভ্রমন করে এবং তার একটা সুনির্দিষ্ট অতীত থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা তার অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নির্ধারণ করতে পারি। যদিও দৈনন্দিন অনেক কাজেই এই ধারণা দারুণ কার্যকর, কিন্তু ১৯২০ র দিকে দেখা যায় এই ‘ক্লাসিক্যাল’ ধারণা দিয়ে ভৌত জগতের পারমাণবিক ও অতিপারমাণবিক স্তরে যেসব আপাত উদ্ভট ঘটনাসমূহ ঘটে সেসবের কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। তাই এর বদলে তখন একটা ভিন্ন তাত্ত্বিক কাঠামোর আশ্রয় নিতে হয় যার নাম কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা। এসব অতিপারমানবিক ঘটনার বর্ণনায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনুমানগুলো খুবই নির্ভুল এবং এদেরকে যখন বৃহত্তর বস্তুসমূহের উপর প্রয়োগ করা হয় তখন ক্লাসিকাল তত্ত্বের অনুমানসমূহের সাথে মিলে যায়। কিন্তু কোয়ান্টাম এবং ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যা ভৌত বাস্তবতার সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধারণার উপর অবস্থিত।

কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বিভিন্ন ভাবেই বর্ণনা করা সম্ভব, তবে সবচেয়ে সহজাত(ইনটুইটিভ) বর্ণনাটা দিয়েছেন রিচার্ড (ডিক) ফাইনম্যান, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনলজির একজন বর্ণিল চরিত্রের অধিকারী বিজ্ঞানী, যিনি কখনো কখনো কাছেরই একটা স্ট্রিপ বারে বঙ্গো ড্রাম বাজাতেন। ফাইনম্যানের মতে, একটা সিস্টেম শুধু মাত্র একটাই ঘটনাপ্রবাহ নয় বরং সম্ভাব্য সকল ঘটনাপ্রবাহের সমষ্টি। আমাদের উত্তর খোঁজার পথে আমরা ফাইনম্যানের এই পদ্ধতিকে বিশদে ব্যাখ্যা করব এবং এটা প্রয়োগ করে দেখবো যে মহাবিশ্বের কোনো একক ঘটনাপ্রবাহ (ইতিহাস) নেই, এমনকি এর কোনো স্বাধীন অস্তিত্বই নেই। অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছেও এটা বৈপ্লবিক কোনো ধারণা মনে হতে পারে। আধুনিক বিজ্ঞানের অন্য অনেক ধারণার মত এটাও আমাদের সাধারণজ্ঞানের সাথে মেলে না। কিন্তু সাধারণজ্ঞান তো তৈরি হয় দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার আলোকে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দেখা পারমানবিক জগৎ বা আদি মহাবিশ্বের চিত্রের উপর ভিত্তি করে নয়।

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের উদভবের আগে সাধারণত ভাবা হত বিশ্বের সকল জ্ঞানই সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব অর্থাৎ কোনো একটা বস্তুকে আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের মাধ্যমে আমরা যেভাবে অনুভব করি বস্তুগুলি তেমনই। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের চমকপ্রদ সাফল্য- যেটা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা নয়, বরং ফাইনম্যানের ধারণার মত ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত- থেকে দেখা যায় যে বাস্তবতা তেমন নয়। তাই বাস্তবতার প্রচলিত সরল চিত্র আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সাথে সুসঙ্গত নয়। এ ধরণের বিভ্রান্তি মোকাবেলা করতে আমরা যে কৌশলের আশ্রয় নিই তাকে বলে রূপায়ননির্ভর বাস্তবতা। এই কৌশলটার পিছনে মূল ধারণা হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক ইন্দ্রিয়সমূহ থেকে পাওয়া প্রেসনার সাপেক্ষে বাস্তব জগতের একটি কাল্পনিক রূপ বা কাঠামো তৈরি করে। যখন এমন একটা কাঠামো বিভিন্ন ঘটনাকে সফল ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে তখন আমরা এই কাঠামোকে এবং এই কাঠামোর সকল গাঠনিক ও ধারণাগত উপাদানকে বাস্তবতার বৈশিষ্ট বা পরম সত্য হিসাবে গ্রহন করি। কিন্তু এই একই ভৌত ঘটনাকে হয়তো অন্য কোনো ভাবেও কাঠামোবদ্ধ করা যায়, যেখানে ভিন্নতর মৌলিক উপাদান এবং ধারণাসমষ্টি ব্যবহৃত হবে। এমন দুইটি ভিন্ন কাঠামো যখন কোনো ভৌত ঘটনাকে নিখুত ভাবে অনুমান করতে পারে তখন আর এদের একটিকে অপরটিচ চেয়ে বেশি বা কম বাস্তব হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না; বরং তখন আমরা নিজের সুবিধামত যেকোনো একটি কাঠামোকে ব্যবহার করার স্বাধীনতা পেয়ে যাই।

বিজ্ঞানের ইতিহাসে আমরা একের পর এক উন্নততর তত্ত্ব এবং ধারণা-কাঠামো আবিষ্কার হতে দেখেছি, সেই প্লেটো থেকে শুরু করে নিউটন হয়ে আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে, এই ধারা কি চলতেই থাকবে নাকি একটি পরম তত্ত্বে গিয়ে থামবে, যে পরম তত্ত্বের সাহায্যে মহাবিশ্বের সকল বল, সকল পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে? নাকি আমরা একের পর এক উন্নততর তত্ত্ব আবিষ্কার করে যেতেই থাকবো, অর্থাৎ এমন কোনো পরম তত্ত্বই আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না যেটার আর উন্নয়ন সম্ভব নয়? এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর আমাদের হাতে এখনো নে।ই কিন্তু আমাদের হাতে এমন একটি তত্ত্ব আছে যেটি নিজেকে সকল কিছুর পরম তত্ত্ব হিসাবে দাবী করতে পারে; যার নাম এম-তত্ত্ব। এম-তত্ত্বই এখনো পর্যন্ত একমাত্র ধারণা-কাঠামো যার সেই সকল বৈশিষ্টই আছে একটি পরম তত্ত্বের যে বৈশিষ্টগুলো থাকার কথা। আমাদের পরবর্তি আলোচনার অনেক অংশই পরিচালিত হবে এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে।

এম-তত্ত্বকে ঠিক একক কোনো তত্ত্ব বলা যায় না। এটা অনেকটা এক গুচ্ছ তত্ত্বের একটা সমষ্টি যার প্রতিটি সদস্য তত্ত্ব ভৌত ঘটনা সমুহের কোনো নির্দিষ্ট অংশকে বর্ণনা করে। যেন একটা মানচিত্রের মত। এটা সবার জানা যে কোনো একক মানচিত্রে পুরো পৃথিবীর ভূ-তল কে দেখানো সম্ভব নয়। সমতল মানচিত্র তৈরিতে যে মারক্যাটর অভিক্ষেপ ব্যবহার করা হয়, তাতে যতই উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর দিকে যাওয়া হয় ততই ক্ষেত্রফলগুলো বিবর্ধিত করে আঁকা হতে থাকে। আর এ ধরণের মানচিত্রে কোনো ভাবেই উত্তর আর দক্ষিন মেরুবিন্দু দেখানো সম্ভব নয়। তাই পুরো পৃথিবীর একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিকৃতি তৈরি করতে হলে আমাদেরকে কোনো একক মানচিত্রের বদলে একগুচ্ছ ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্র ব্যবহার করতে হবে, যেখানে একেকটি মানচিত্র পৃথিবীর একেকটি অংশকে নির্ভুল ভাবে প্রকাশ করে। এবং মানচিত্রগুলোর কিছু অংশ একে-অপরের উপর আপতিত হলে এই আপতিত অংশও ঐ এলাকার ভূচিত্রকে নির্ভুল ভাবে বর্ণনা করবে। এম-তত্ত্ব অনেকটা এমন। এম-তত্ত্বের তত্ত্বগুচ্ছের বিভিন্ন সদস্য তত্ত্ব দেখতে অনেকসময় একে অপর থেকে ভিন্ন হলেও তাদেরকে আসলে একটি অন্তর্নিহিত একক তত্ত্বের বিভিন্ন অংশ হিসাবে দেখা যায়। এরা হচ্ছে মূল তত্ত্বের বিভিন্ন রূপ যার একেকটা একেক সীমায় প্রযোজ্য, উদাহরন স্বরূপ- যখন কিছু চলকের মান, যেমন শক্তির পরিমান, খুবই কম তার জন্য আছ একটি তত্ত্ব। এ যেন সেই মারকেটর প্রজেকশন থেকে পাওয়া পৃথিবীর মানচিত্রের বিভিন্ন অংশ, যে অংশে একাধিক মানচিত্র একে অপরের উপর আপতিত হবে সে অংশেও এই তত্ত্বসমূহের অনুমান পরস্পরের সাথে সুসংহত। আর পুরো ভূত্বকের যেমন কোনো ভালো সমতল প্রতিলিপি বা মানচিত্র নেই তেমনি তেমন কোনো একক তত্ত্ব নেই, যেটা একাই সকল অবস্থায় সব ধরণের পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

(missing image)

এম- তত্ত্ব কীভাবে সৃষ্টিবিষয়ক প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতে পারে সেটা আমরা বর্ণনা করব। এই তত্ত্ব মতে আমাদের মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব নয়। বরং, এম-তত্ত্ব বলছে একদম শূন্য থেকে বহু সংখ্যক মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে। তাদের সৃষ্টিতে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি বা ঈশ্বরের অংশগ্রহন প্রয়োজন নেই। বরং ভৌত সূত্রসমূহ থেকেই এই বহুসংখ্যক মহাবিশ্বের উদভব হয়। এদের উদভব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই। প্রতিটি মহাবিশ্বের ঘটনা প্রবাহেরই বহুসংখ্যক ইতিহাস আছে এবং পরবর্তি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে,(যেমন বর্তমান সময়টা হচ্ছে সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু করে অনেক পরের একটা সময়) এরা সম্ভাব্য অনেক অবস্থাতেই থাকতে পারে। এসব অবস্থার বেশিরভাগই আমরা যে মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করি তার থেকে সম্পুর্ণ আলাদা এবং কোনো ধরনের ‘জীবন’-এর জন্য একদমই প্রতিকুল। এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকেই আমাদের মত প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। তাই আমাদের অস্তিত্বই সম্ভাব্য আর সব মহাবিশ্ব থেকে শুধুমাত্র যেগুলোতে আমাদের অস্তিত্ব সম্ভব সেগুলোকেই নির্দিষ্ট করে দেয়। যদিও মহাজাগতিক স্কেলে আমরা অতিব ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বহীন কিছু, তারপরও এই যে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ঘটনা, এটাই আমাদেরকে বসিয়ে দিয়েছে অনেকটা সৃষ্টির কর্তার আসনে।

মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীরতম উপলব্ধি লাভের জন্য তাই আমাদেরকে শুধু সবকিছু ‘কীভাবে’ ঘটে জানলেই হবেনা, জানতে হবে ‘কেন’।

কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
কেন আমাদের অস্তিত্ব আছে?
কেন ভৌত সূত্র সমূহের ঠিক এই সেটটাই আমরা দেখছি, অন্যরকম নয় কেন?

এটাই জীবন, মহাবিশ্ব এবং সবকিছুর পরমতম প্রশ্ন। এই বইয়ে আমরা এই প্রশ্নেরই উত্তর দিতে চেষ্টা করব। ‘হিচহাইকারস গাইড টু গ্যালাক্সি’র মত আমাদের উত্তর শুধু “৪২” হবে না।

‘দ্য গ্রান্ড ডিজাইন’ < আগের পর্ব। পর্ব ১। পর্ব ২>

[স্টিফেন হকিং এবং লিওনার্ড ম্লদিনাও-এর লেখা এই বইটি কিনতে পারবেন এখান থেকে আর ফ্রী পেতে যোগাযোগ করুন]