ক্লাসিক্যাল পর্ব:
বাংলা কবিতায় ক্লাসিক্যাল বা মহাকাব্যিক যুগটি তেমন দীর্ঘ নয়। আনুমানিক ১৮৩০ থেকে ১৮৮০-র মধ্যেই এর অবস্থান, অনেকাংশে মাইকেল মধুসূদন দত্তর (১৮২৪-১৮৭৩) জীবতকালই এ পর্বের সময় নির্ধারক। অথচ এই স্বল্প সময়েই বাংলা কবিতা বন্ধন মুক্ত হয়; পয়ারের নাগপাশ থেকে বেরিয়ে এসে তৈরী করে অমিত্রাক্ষরের প্রবহমান দোলা। এতে যেমন লাইন শেষে দাড়ি পড়ার বাধ্যবাধকতা রহিত হয়, তেমনি কবিতা পেয়ে যায় শক্ত গাঁথুনি। এই কালের উজ্জ্বলতম কবি মধুসূদন দত্ত হলেও, তাঁর সমসামায়িক নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্রকে অনায়াসে আলোচনায় নিয়ে আসা যায়। কারণ, নাটক রচনার নানা পর্যায়ে দীনবন্ধু নিজেও সফলতার সাথে অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রয়োগ করেছেন এবং মধুসূদনের মতোই মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের চালকে এগিয়ে নিয়েছেন।

১.
দেখিলা রাক্ষসেশ্বর উন্নত প্রাচীর
অটল অচল যথা; তাহার উপরে,
বীরমদে মত্ত, ফেরে অস্ত্রীদল, যথা
শৃঙ্গধরোপরি সিংহ। চারি সিংহদ্বার
(রুদ্ধ এবে) হেরিলা বৈদেহীহর; তথা
জাগে রথ, রথী, গজ, অশ্ব, পদাতিক
অগণ্য। দেখিলা রাজা নগর বাহিরে,
রিপুবৃন্দ, বালিবৃন্দ সিন্ধুতীরে যথা,
নক্ষত্র-মণ্ডল কিম্বা আকাশ মণ্ডলে।
(মেঘনাদবধ/মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

অক্ষরবৃত্তের আট-ছয় বুননে অন্ত্যমিল না রেখে, লাইন শেষে দাড়ি তুলে দিয়ে মধুসূদন দত্ত বাংলা কবিতাকে স্বাধীনতাই শুধু দিলেন না, একাধিক লাইন দিয়ে পঙক্তি নির্মাণেরও ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করলেন। লাইন শেষে ভাবের পরিসমাপ্তি রহিত হওয়ায়, চিন্তার পরিধিকে বিস্তৃত করার সুযোগ এলো। এই উদাহরণে কবিতার প্রথম পঙক্তি শেষ হয়েছে সাড়ে তিন লাইনে, যা মধ্যযুগে ছিলো কল্পনাতীত। অন্যদিকে ভাষাকে বেগবান করতে অনেক ক্ষেত্রে লাইনের অন্ত্য থেকে যতি চিহ্ন তিন অথবা চার মাত্রা দূরে সরিয়ে দিলেন, যেমন সপ্তম লাইনের শুরুতে ব্যবহৃত “অগণ্য” শব্দটি; পরবর্তী পঙক্তি বা পঙক্তিখণ্ড একই মাপের শব্দ দিয়ে শুরু করলেন যেমন, “দেখিলা”। অর্থাৎ “অগণ্য। দেখিলা রাজা” তৈরী করলো একটি আট মাত্রার পর্ব, যদিও মাঝে একটি দীর্ঘচ্ছেদ পড়েছে।

২ক.
মুদিলা সরসে আঁখি বিরসবদনা
নলিনী; কূজনি পাখী পশিল কুলায়ে;
(মেঘনাদবধ/মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

খ.
বসিলেন দেবপতি দেবসভা মাঝে,
হেমাসনে; বামে দেবী পুলোম-নন্দিনী
চারুনেত্রা। রজ-ছত্র মণিময় আভা…
(মেঘনাদবধ/মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

উদাহরণ ২(ক)-এর দ্বিতীয় লাইনে “নলিনী” শব্দটি আগের লাইনের সম্প্রসারণ, ছন্দের শুদ্ধতা রক্ষায় পরবর্তী পঙক্তিখণ্ড শুরু হয়েছে “কূজনি” দিয়ে। উদাহরণ ২(খ)-এ একই রকম সম্প্রসারণের চিহ্ন পাওয়া যায় “হেমাসনে” ও “চারুনেত্রা” শব্দদ্বয়ের ব্যবহারে।

৩.
কি যাতনা অনুভব অভাগা অবলা
বিষন্ন হৃদয়ে করে দিবা বিভাবরী
যে জেনেছে সেই বিনা কে বলিতে পারে!
পূর্ণিমায় অন্ধকার; পূর্ণ সরোবরে
শুষ্ককণ্ঠে শীর্ণ মুখে মরে পিপাসায়;
সুখশূন্য সুলোচনা শূন্য মনে বসি
বিজনে বিষাদে কাঁদে যেন বিরাগিণী
দীননেত্রে নীরধারা বহে অবিরাম।
নারায়ণে সাক্ষী করি, আনন্দ আশায়
আবার দিলাম মালা স্বামীর গলায়।
যুবতীজীবন পতি সংসারের সার;
এবার একান্ত নিধি একান্ত আমার।
(কমলে কামিনি, তৃতীয় গর্ভাঙ্ক/ দীনবন্ধু মিত্র)

মধুসূদন দত্তের ধ্রুপদী শব্দের ব্যবহারকে পাশ কাটিয়ে কবিতাকে মানুষের দৈনন্দিন ভাষার ভেতরে এনে দীনবন্ধু মিত্র অমিত্রাক্ষর ছন্দের অসাধারণ প্রয়োগ দেখিয়েছেন। অবশ্য শেষের চার লাইনে মিত্রাক্ষর বা অন্ত্যমিল রেখে নাটকের মাধুর্য বাড়ানোর চেষ্টায়ও ত্র“টি করেননি।
৪.
সেই পূর্ণ শশধরে, সেই রূপ শোভা ধরে,
সেই মত পিকবরে, স্বরে হরে মন।
সেই এই ফুলবনে, মলয়ার সমীরণে,
সুখোদয় যার সনে, কোথা সেই জন?
প্রাণনাথে নাহি হেরি, নয়নে বরিষে বারি,
এত দুঃখে আর নারি ধরিতে জীবন।।
(শর্ম্মিষ্ঠা/ মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

আট-আট-আট-ছয় এর চাল। পাশাপাশি তিনটি আটমাত্রার পর্বে পরে একটি ছয় মাত্রার পর্ব জুড়ে একাধিক মধ্যমিল ও অন্ত্যমিলের ব্যবহারের সফল পরীক্ষাও করেছেন মধুসূদন দত্ত।

মধুসূদন দত্তের আরেকটি কালজয়ী সংযোজন হলো পেট্রারকান সনেটের আঙ্গিক। আট-ছয় এর চালে চোদ্দ লাইনের কবিতায় বিশেষ ধরনের অন্ত্যমিল ব্যবহার বাংলা ভাষায় এই প্রথম। যদিও এই ধরনের সনেট মধুসূদন দত্তের আবিষ্কার নয়, তথাপি তাঁর হাত ধরেই ইটালি থেকে বাংলায় এলো চোদ্দ লাইনের এই বুনন কৌশল। বাংলা কবিতা উত্তীর্ণ হলো একটি নতুন ধাপে। অন্যদিকে সমিল প্রবহমান পয়ার তৈরীর ক্ষেত্রে সনেটগুলো থাকলো মাইল ফলক হয়ে ।

৫.
কে তোর তরিতে বসি, ঈশ্বরী পাটনি?
ছলিতে তোরে রে যদি কামিনী কমলে,─
কোথা করী, বাম করে ধরি যারে বলে,
উগরি, গ্রাসিল পুনঃ পূর্ব্বে সুবদনী?
রূপের খনিতে আর আছে কি রে মণি?
এর সম? চেয়ে দেখ, পদ-ছায়া-ছলে,─
কনক কমল ফুল্ল এ নদীর জলে─
কোন্ দেবতারে পূজি, পেলি এ রমণী?

কাঠের সেঁউতি তোর, পদ-দরশনে
হইতেছে স্বর্ণময়! এ নব যুবতী─
নহে রে সামান্যা নারী, এই লাগে মনে;
বলে বেয়ে নদী-পারে যা রে শীঘ্রগতি।
মেগে নিস্, পার করে, বর-রূপ ধনে
দেখায়ে ভকতি, শোন্, এ মোর যুকতি!
(ঈশ্বরী পাটনী/মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

এই কবিতায় অন্ত্যমিলের ধরণ, কখখককখখক গঘগঘগঘ, যেটি পেট্রার্কান ধারার একটি নিখুঁত সনেট; একদিকে যেমন নতুন আঙ্গিকের সংযোজন, তেমনি স্বল্প পরিসরে কবিতাকে পক্ত করারও সফল প্রচেষ্টা।

অক্ষরবৃত্তই ছিলো ক্লাসিক্যাল পর্বের কবিতা রচনার প্রধান বাহন, তবে স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তে এ সময় বেশ কিছু কবিতা রচিত হয়। কোথাও কোথাও অক্ষরবৃত্তের চালে মাত্রাবৃত্ত ঢুকে যাবার প্রবণতা একালেও পরিলক্ষিত হয়।

মাত্রাবৃত্তের চাল:

৬.
কেনে এত ফুল তুলিলি স্বজনি─
ভরিয়া ডালা?
মেঘাবৃত হয়ে পরেকি রজনী
তারার মালা?
আর কি যতনে কুসুম রতনে
ব্রজের মালা?
(মধুসূদন দত্ত)

কাঠামো:
৬ + ৬

পঙক্তিতে মাত্রাবৃত্তের দু’টি করে ছয়মাত্রার পর্ব এবং পাঁচমাত্রার অতিপর্বের সুখকর চাল; উপরন্তু রাখা হয়েছে মধ্যমিল ও অন্ত্যমিল।

৭.
অথবা যেমন পাথরের দল মেজে

যেন বরে বেড়ে ফিরিতেছে সাত পাক।
(দীনবন্ধু মিত্র)

কাঠামো:
৬ + ৬ + ২
৮.
কহিও গোকুল কাঁদে হারাইয়া শ্যামচাঁদে
রাধার রোদনধ্বনি দিও তারে লয়ে।
(দীনবন্ধু মিত্র)

কাঠামো:
৮ + ৮
৮ + ৬

আটমাত্রার তিনটি পর্ব এবং ছয় মাত্রার অতিপর্ব রেখে মাত্রারবৃত্তের একটি নিখুঁত পঙক্তি।

স্বরবৃত্তের চাল:

৯.
এখন কি আর নাগর তোমার
আমার প্রতি, তেমন্ আছে।
নূতন্ পেয়ে পুরাতনে
তোমার সে যতন গিয়েছে।
(মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

পর্ববিন্যাস:

এখন কি আর/ নাগর তোমার/
আমার প্রতি,/ তেমন্ আছে।/
নূতন্ পেয়ে/ পুরাতনে/
তোমার সে য/তন গিয়েছে।/

১০.
লোকে বলে রাধা কলঙ্কিনী।
তুমি তারে ঘৃণা কেনে কর সীমন্তিনি?
(মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

পর্ববিন্যস:

লোকে বলে/ রাধা কলং/ কিনী।
তুমি তারে/ ঘৃণা কেনে/ কর সীমন/ তিনি?

১১.
চেয়ে দেখ, প্রিয় সখি, কি শোভা গগনে!
ভ্রমিতেছে মন্দগতি প্রেমানন্দ মনে!
(মাইকেল মধুসূদন দত্ত)

পর্ববিন্যাস:

চেয়ে দেখ,/ প্রিয় সখি,/ কি শোভা গ/ গনে!
ভ্রমিতেছে/ মন্দগতি/ প্রেমানন্দ/ মনে!

১২.
সোনার শেকল লোহার খাঁচা,
এর বেলাটি বিষম কাঁচা।
(দীনবন্ধ মিত্র)

পর্ববিন্যাস:

সোনার শেকল/ লোহার খাঁচা,/
এর বেলাটি/ বিষম কাঁচা।/

১৩.
হাতীর মাথায় মুক্তা থাকে,
বার করে লয় মানুষ তাকে।
(দীনবন্ধু মিত্র)

পর্ববিন্যাস:

হাতীর মাথায়/ মুক্তা থাকে,/
বার করে লয়/ মানুষ তাকে।/

এই ভাবে বিভিন্ন উদাহরণের মধ্য দিয়ে দেখা যায় যে অমিত্রাক্ষর ছন্দের উদ্ভাবন ও প্রচলিত ছন্দের নানামুখি ব্যবহারে নাতিদীর্ঘ এই কালপর্বটি বাংলা কবিতাকে বিভিন্ন ভাবে উজ্জ্বল করে তুলেছে।