সিলেটে শাহ্ জালাল বিশ্ব বিদ্যালয় গড়ে তোলার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টির নাম করনের বিরোধীতা করে একটি প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।আন্দোলনের নেতৃত্বে কারা ছিল তা এখন আর মনে করতে পারছিনা তবে নাম গুলো নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল ব্যক্তি বর্গের ছিল। তাদের দাবী ছিল সাম্প্রদায়িক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব শাহ্ জালালের নামে যাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টির নাম করন না করে অসাম্প্রদায়িক কোন নাম দেওয়া হোক। ছোট বেলায় লোক মুখে শাহ্ জালালের অনেক কেরামতির কথা শুনেছি, বাস ভর্তি করে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে শাহ‌্ জালালের মাজারেও যেতে দেখেছি, পত্রিকায় আরো দেখেছি অনেক রথী মহা রথীদের ভোটের আগে পরে শাহ্ জালালের মাজার জিয়ারত করে তার দোয়া নেওয়ার খবর, আর সাধারণ মানুষের ভক্তি শ্রদ্ধার ঘাটতির তো প্রশ্নই উঠে না! চারিদিকে ভক্তির এত অহ রহ আয়োজন দেখে শুনে সুদূর চট্টগ্রামে থেকেও আমার মনে শাহ‌্ জালাল সম্পর্কে বিনম্র ভক্তি শ্রদ্ধার আসন তৈরী হয়ে গিয়েছিল।ধর্মীয় পরিবেশে বড় হয়েছি, নিজেও ধর্ম কর্ম করেছি কিছুটা তাই স্বাভাবিক ভাবে পবিত্র পুরুষ শাহ‌্ জালাল(!)নাম করন বিরোধী আন্দোলনটা আমাকে বিস্মিত করেছিল অনেক।একই সঙ্গে একটা ধাক্কাও অনুভব করেছি মনে।এই লোকগুলো বিনা কারনে নিশ্চই বিরোধীতা করছেনা, মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে সেই পেছনের কারন টা আমাকে জানতে হবে।পরে ইতিহাসের পাঠ থেকে আমি যা জানলাম ও বুঝলাম পাঠকদের বিবেচনার সুবিধার্তে তা নীচে তুলে ধরলাম।
শাহ‌্ জালালার জন্মস্থান সম্পর্কে স্বচ্ছ কোন ধারনা পাওয়া যায় না। কোন কোন ইতিহাসবিদ দের মতে উনি ১২৭১ সালে তার্কির কৌনাতে জন্ম গ্রহণ করেন, পরে তিনি ইয়ামেন গমন করেন।আবার কারো কারো মতে তিনি ইয়ামেনেই জন্ম গ্রহণ করেন। উনার বাবা জালাল উদ্দীন মুহাম্মদ রুমির সম সাময়িক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তিনিও পরিচিত ছিলেন পার্সিয়ান কবি ও সুফি আদর্শের অনুসারি একজন পীর রূপে। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় জালাল উদ্দীন বিন মুহাম্মদ।অবশ্য পরে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান শায়েক উল মাশায়েক হযরত শাহ‌্ জালাল মুজাররেদ নামে। চাচা সায়েদ আহমেদ কবিরের কাছেই তার ইসলামীক শিক্ষার হাতে কড়ি।পরে হন কোরানে হাফেজ।

সেই সময়ে শিক্ষা দীক্ষা, ধন সম্পদ, উর্বর জমি, জীবন যাপনের মান সব দিক বিবেচনা সাপেক্ষে ভারত বর্ষের খ্যাতি ছিল সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। আরবের নিয়ত সংগ্রাম রত রুক্ষ্ম, কঠিন, বেপড়োয়া যাযাবর জীবন, গোত্রে গোত্রে কোন্দল রত জীবনের চেয়ে ভারত বর্ষের শান্ত, স্নিগ্ধ, সবুজ, সুশীতল জীবন তাদের কাছে ছিল স্বপ্ন রাজ্য।উন্নত ও নিরাপদ জীবন যাপন এবং অন্ন সংস্থানের লোভেই তারা এসে ভীড় করত ভারতবর্ষে।

ভিন দেশী যে কোন মানুষের নতুন দেশে আবাস গড়ার ক্ষেত্রে মোকাবেলা করতে হয় ভাষা সমস্যা, জীবিকা অর্জনের উপায় ও পারিপ্বার্শিক অবস্থার সাথে।পর্যাপ্ত ভাষা জ্ঞানের অভাবে তাদের পক্ষে ভালো কোন কাজের সুযোগ ঘটতো না, আবার ব্যবসা বানিজ্য করার মত প্রয়োজনীয় অর্থ কড়ি ও এই সব দেশান্তরি লোকদের ছিল না।তাছাড়া দেশান্তরি এই সব আরবের লোকেরা ছিল খুবি দরিদ্র শ্রেনীর।সমস্যা সমাধানে দুটো সহজ রাস্তা তারা খুজে পেয়েছিল (১) রাজ্য দখল করা (২)বিনা পয়সায় ধর্ম ব্যবসা করা। তবে ধর্ম ব্যবসার পূর্ব শর্ত রাজ্য দখল ও শাসন ক্ষমতা্র আনুকুল্য।

হিন্দু রাজাদের আয়েশী জীবন যাপন, অরক্ষিত রাজ্য সীমান্ত, যুদ্ধ বিদ্যায় অপারদর্শীতা এবং সর্বপরি মুসলমান ভীতিকে কাজে লাগিয়ে যুদ্ধ বিগ্রহ, মার দাঙ্গা ও পর রাজ্য দখলে সিদ্ধ হস্ত আরবের মুসলমানদের পক্ষে ভারত বর্ষ দখল করে নিতে খুব একটা বেশী বেগ পেতে হয়নি।তারি ফলশ্রুতিতে রাজ ক্ষমতার প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সহ যোগিতায় তথা কথিত ইসলামী পীর দরবেশ দের ধর্ম প্রচারের আড়ালে নিজেদের অবস্থা পরিবর্তনের দুয়ার সম্পূর্ন খুলে যায়।তারা হিন্দুদের ঘৃণ্য জাতি ভেদ প্রথা, কুসংষ্কারের বেড়া জালে আবদ্ধ নিম্ন বর্ণের নির্যাতিত অশিক্ষিত হিন্দু ও হিন্দুদের নিকট সমাজে অবহেলিত বৌদ্ধদের কাছে ইসলাম ধর্মের বীরত্ব, সাম্যবাদ ও পর কালের লোভ সম্বলিত নতুন মতবাদ প্রচার করে তাদের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে সহজেই এক এক জন বড় বড় পীর দরবেশ রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় তাদের জীবদ্দসায়। কারো কারো ক্ষেত্রে মরনের পরেও তাদের অবস্থান হয়েছে আরো শক্তিশালী। প্রমাণ অসংখ্য কবরকে মাজারে রূপান্তর করে রম রমা ব্যাবসা চালিয়ে যাচ্ছে তাদের অনুসারী আরেক শ্রেণীর ধর্ম ব্যবসয়ীরা বাংলাদেশ সহ ভারত বর্ষের বিভিন্ন জেলায়।
যা হোক আবার মূল কথায় আসি, যৌবনে শাহ্ জালাল বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিয়ে অবশেষে স্বপ্ন রাজ্য ভারতে আসেন ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দে।এর পর চলে যান আজমীরে সেখানে পান ইসলাম প্রচারক পীর খাজা গরীবে নেওয়াজ মঈন উদ্দীন হাসান চিস্তিকে।পরে যান দিল্লী সেখানে সংস্পর্শে আসেন আরেক ইসলামী চিন্তাবিদ ও ইসলাম প্রচারক নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার সাথে।তাদের ইসলাম প্রচারের মহীমা, কলা কৌশল এবং তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি শাহ জালালকে বিশেষ প্রভাবিত করে। মনে মনে কামনা করতে থাকেন যদি তাদের মত প্রভাব প্রতিপত্তি শালী হওয়া যেত! অপেক্ষায় রইলেন উপযুক্ত সময় ও সুযোগের।
তখন সিলেট শাসন করতেন হিন্দু রাজা গৌড় গোবিন্দ।কথিত আছে তার রাজ্যে বাস করতেন সৈয়দ বুরহান উদ্দীন নামের এক মুসলমান।তিনি পুত্র সন্তান লাভের খুশিতে গরু জবাই করে ভুরি ভোজের আয়োজনে ব্যস্ত, ঠিক সে সময় এক ক্ষুদার্ত বেরসিক চিল এক টুকরা গরুর মাংস চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় ঠোঁট ফসকে ফেলে দেয় এক ব্রাহ্মনের ঘরে, আবার অন্য এক মতে মাংসের টুকরা টি গিয়ে সোজা পড়ে গৌড় গোবিন্দের মন্দিরে।ধর্মীয় অপমানে রাজা অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে আদেশ দিলেন যখানেই পাও বুরহান উদ্দীন কে ধরে তার হাত দুটি কেটে ফেলা হউক আর তার পুত্র সন্তান কে হত্যা করা হউক।

প্রাণ ভয়ে বুরহান উদ্দীন পালিয়ে বিচার চাইলেন গৌড়ের সুলতান শামসুদ্দীন ফিরোজ শাহর কাছে। সুলতান এই কথা শুনে তার ভাতিজা সিকান্দার খান গাজীর নেতৃতে এক দল সৈন্য বাহিনী পাঠালেন গৌড় গোবিন্দ শাস্তি দিতে।

এই চালু গল্পটা কে আমরা যদি সাদা চোখেও একটু বিশ্লেষণ করি, তাহলে বুঝব শুধু মাত্র বুরহান উদ্দীনের হাত কাটার নির্দেশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে সুলতানের সিলেট আক্রমন যুক্তি যুক্ত মনে হয় না মোটেই।আর হাত কাটার বিষয়টা বরং ইসলামী রীতির সাথেই বেশ সম্পর্ক যুক্ত। গরুর মাংস এবং হাত কাটার বিষয় গুলো পরষ্পরের সাথে যুক্ত হওয়ায় গল্পটার অসাড়ত্বই প্রমাণ করে বৈকি।তাছাড়া যুদ্ধ মানেই তো অর্থনৈতিক প্রভূত ক্ষতি, ধ্বংস, অনেক লোকের প্রাণ হানি- এ সামান্য কথা না বুঝার মত সুলতান নিশ্চই বোকা নন।বরং বিনা উস্কানিতে কাফের হিন্দু রাজাকে বিতারিত করে সিলেটে মুসলমানের বিজয় পতাকা ওড়ানোটাই ছিল ফিরোজ শাহর মুখ্য উদ্দেশ্য এ কথা ভাবা সমীচিন নয় কি? পরবর্তি ঘটনা বলি তার প্রমাণ আরো স্পষ্ট করে।

১ম বার যুদ্ধে সিকান্দার খান গোবিন্দের কাছে হেরে যান।এই পরাজয় সুলতান ফি্রোজ শাহর পক্ষে সহজভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি।তিনি বুঝতে পারলেন গৌড় গোবিন্দের শক্তি কে খাটো করে দেখা তার মোটেই উচিত হয়নি, তাই পরবর্তী আক্রমনের জন্য বেশ আট ঘাট বেঁধেই মাঠে নামলেন। তিনি তার সেনাপতি নাসির উদ্দীন কে আদেশ দিলেন পুনঃরায় গৌড় আক্রমনের জন্য তৈরী হতে। যুদ্ধ জয়ের চুড়ান্ত প্রস্তুতি হিসাবে সুলতান ফিরোজ শাহ্ ইসলামিক চিন্তাবিদ নিজাম উদ্দীন কে আদেশ দিলেন সিলেট যুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে।নিজাম উদ্দীন অনুরোধ করলেন শাহ‌্ জালাল কে।শাহ‌্ জালাল তার সাথে ইয়েমেন, তুর্কিস্তান, আলরুম, তুরফান, বুখারা, তিরমিজ সহ আরবের বিভিন্ন আঞ্চল থেকে আসা আরো ৩৬০ জন ভাগ্যন্বেষী যুবক কে সাথে নিয়ে ফিরোজ শাহর মুসলমান সৈন্য দলের সাথে যোগ দিলেন হিন্দু রাজা গোবিন্দকে সিলেট থেকে উৎখাত করার লক্ষ্যে।এই ৩৬০ জনের মধ্য তার ভাগ্নে শাহ্‌ পরান ও ছিল।

এখানে শাহ জালালের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখি শাহ জালাল যদি সত্যি কোন পীর, দরবেশ, আওলিয়া বা এ জাতীয় নিরীহ শান্ত গোছের কিছু হয়ে থাকতেন তাহলে ধারালো তরবারি হাতে আরো ৩৬০ জন সৈন্য জোগাড় করে দখলদার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তেন না অবশ্যই বরং বিনা রক্তপাতে কোন সমাধানে আসা যায় কিনা সুলতানকে সে পরামর্শ দিতে পারতেন।

শাহ্‌ জালাল সম্পর্কে বিশ্বাসীদের বিশ্বাস পাকা পোক্ত করতে ধর্ম ব্যাবসায়ীরা সুনিপুন ভাবে আরো কিছু ধর্মীয় রূপকথার অলংকার জুড়ে দিলেন তার সিলেট দখলের পর। যেমন- গৌড় গোবিন্দ যখন জানতে পারলেন শাহ জালাল সিলেট আক্রমন করতে আসছে তখন তিনি সুরমা নদীর ঘাট থেকে সব নৌকা সরিয়ে ফেলেন যাতে শত্রু পক্ষ নদী পার হয়ে সিলেটে প্রবেশ করতে না পারে।শাহ্ জালাল ও ক্যারিশমা দেখানোর সুযোগ পেয়ে গেলেন তিনি মুচকি হেসে জায়নামা্যে চড়ে সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে দিলেন মূহুর্তে যা তাঁর গুরু স্বয়ং নবিজীর পক্ষেও কোন দিন সম্ভব হয়নি। নদীর অপর পাড়ে পৌঁছেই তিনি বিকট শব্দে আযান দিয়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ শুরু করলেন, তাতেই গৌড় গোবিন্দের প্রাসাদ ধসে ধসে পড়তে শুরু করল।

আযানের শব্দে ধসে পড়ল না আক্রমনের তীব্রতায় ধসে পড়ল তা সচেতন পাঠক মাত্রই বুঝতে সক্ষম ।
শুরু হল দখলদার বনাম অস্তিত্ব রক্ষার রক্তক্ষয়ি যুদ্ধ তাতে গৌড় গোবিন্দ পরাজিত হয়ে সিলেট ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

সিলেট আসল মুসলমানদের দখলে।পক্ষান্তরে বলা চলে শাহ্ জালালের দখলেই সেই সাথে পূর্ণ হল আজমীরের মঈন উদ্দীন হাসান চিস্তি বা দিল্লীর নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার মত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্ন।যুদ্ধ জয়ের পর তিনি তার ৩৬০ জন সহ যোগীকে বিয়ে করে সংসারী হওয়ার নির্দেশ দেন। তখনো ইসলামের প্রচার প্রসার সিলেটে তেমন শুরু হয়নি।তাই তারা কাদের কে কিভাবে বিয়ে করেছিলেন তা সহজেই অনুমেয়। একজনে যদি একটা করেও বিয়ে করে তাহলে ৩৬০ জন হিন্দু/বৌদ্ধ মেয়ের গায়ে ইসলামী আঁচড়ের দাগ পড়েছিল নিঃসন্দেহে।

আজ এক বিংশ শতাব্দীর মুক্ত চিন্তা ও মানব ঐক্য প্রতিষ্ঠার দ্বার প্রান্তে এসেও উগ্র সাম্প্রদায়িক চেতনা বোধ সম্পন্ন শাহ্ জালালের নামে অসাম্প্রদায়িক বিদ্যা অর্জনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠের নাম করন করে জাতি হিসাবে আমাদের জ্ঞানের দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ করা হয়েছে নয় কি?