প্রাক্-কথন:
আজ থেকে প্রায় চার দশক পূর্বে আমরা বাঙালি জাতি নজিরবিহীন ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম। বলা বাহুল্য তৎপূর্বেও আমাদের এ ভূ-খণ্ডের অস্থিত্ব বিশ্বের ভৌগোলিক মানচিত্রে ছিল এবং পদ্মা-মেঘনা-যমুনার অববাহিকায় আর্য-দ্রাবিড়-অস্ট্রিক জাতির সংমিশ্রনে গড়ে ওঠা শংকর যে বাঙালি নৃ-গোষ্ঠী, তার অস্থিত্বও পৃথিবীতে বিদ্যমান ছিল । তবে ঊনিশ’শ একাত্তুরের পূর্বে বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলাদেশ নামক কোন জাতিরাষ্ট্র ছিল না এবং একটি স্বাধীন জাতি হিসাবে বাঙালি জাতির পরিচয়ও সুবিদিত ছিল না। কিন্তু দু’যুগের একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং একাত্তুর সালের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতি প্রথম বারের মত একক একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্রের জন্ম দিল। এ জাতি-রাষ্ট্র অর্জনের আকাক্সক্ষা যুগ যুগ ধরে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা-উপ-ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালির মানসপটে তিলে তিলে ধানা বাঁধে। সর্বপ্রথম বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রাক্কালেও একটি স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা সৃষ্টির এক নিদারুণ সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল। ইতিহাসের এ ফুটনোটটি হয়ত অনেকের জানা নেই যে, অবিভক্ত ভারতের বাংলা প্রদেশের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ও ভারতের বাহিরে একটি অবিভক্ত আলাদা বাংলাদেশের ব্যাপারে ঐকমত্য পৌছে একটি খসড়া সংবিধানও রচনা করেছিল। এ ব্যাপারে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ-বিশেষভাবে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লেয়াকত আলী সম্মতিও প্রদান করেছিলেন। কিন্তু নিখিল ভারত কংগ্রেস এর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কূটকৌশল, বিশেষভাবে গান্ধী, নেহেরু, প্যাটেল, ঘনশ্যাম দাশ বিড়লা প্রভৃতি নেতৃত্বের কূটকৌশল, ক্ষমতা লিপ্সা ও মারোয়াড়ী ব্যবসায়ী স্বার্থের কারণে সেটা আজ ইতিহাসের বিষয় হয়ে আছে। ফলত: দ্বি-খণ্ডিত বাংলার এক অংশ বিভক্ত ভারতে আর এক অংশ পাকিস্তানে যুক্ত হল। এভাবে ধর্মীয় জাতীয়তার বাতাবরণে পাকিস্তানের কাঠামেরা মধ্যে বসবাস করে বাঙালির স্বকীয় জাতি পরিচয় ও তার আবাস ভূমি নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র কামনাটা কিন্তু স্বত:স্ফূর্ত ছিল না। নতুনভাবে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ বাঙালিকে ক্রমে প্রতিবাদী করে, ধর্মীয় জাতীয়তার ব্যাপারে তার মোহভঙ্গ ঘটায় এবং তাদের উপলব্ধিতে আসে এ বিজাতীয় শোষণ-শাসনের নিগড় ভাঙ্গতে না পারলে সে তার আত্মবিকাশের সুযোগ পাবে না কখনো। তাই সে পথ খুঁজতে থাকে আত্মপ্রকাশ ও আত্মবিকাশের। সুদীর্ঘ আড়াই শ’ বছর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের চেতনাতেও বাঙালি তার বাঙ্গালীত্ব নিয়ে কিংবা বাঙালি জাতি হিসাবে বিকাশের আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত ছিল এমন কোন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। বরং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে ভারতকে মুক্ত করাই ছিল সেদিনের বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মূল চেতনা। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে এসে যখন জিন্নাহের দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব ওঠল, তখনো অবিভক্ত বাংলার মুসলিম বাঙালিরা ও একটি অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল, যার উল্লেখ আমরা পূর্বে করেছি। সেদিন তাদের এ অবস্থান বস্তুত: ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের আলোকে সঠিক ছিল, কারণ ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবে সমগ্র ভারতে সকল মুসলমান জনগোষ্ঠী একটি রাষ্ট্রে একীভূত হবে এমন কথা ছিল না; বরং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠির ভিত্তিতে ভৌগোলিকভাবে সংলগ্ন ভূখণ্ড নিয়ে আলাদা রাষ্ট্রসমূহ গঠিত হওয়ার কথাই বিধৃত ছিল সে প্রস্তাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে প্রস্তাব সে ভাবে বাস্তবায়িত না করে আকাশ পথে এগার শ’ মাইল দূরের ভূখণ্ড পূর্ব বাংলা সংযোজিত হল পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সাথে। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হযে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হল, ভৌগোলিকভাবে অবিভাজ্য বাংলার খণ্ডিত পূর্বাংশ সংযোজিত হল পাকিস্তানের অন্যতম প্রদেশ হিসাবে । পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পর পাকিস্তানী শাসকেরা বাংলা ও বাঙালিকে রাজনৈতিক ভাবে শাসন ও অর্থনৈতিকভাবে শোষণ করা শুরু করল-এক্ষেত্রেও তাদের অস্ত্র ধর্ম। তখনি বাঙালির মোহভঙ্গ ঘটতে লাগল। জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা উপলব্ধি করতে লাগল-ধর্ম এক হলেও, জাতি এক হয় না। সেদিন নতুন করে তারা তাদের আত্মপরিচয়ের সন্ধান করতে লাগল। তারা বুঝতে পারল-নৃ-তাত্ত্বিকভাবে তারা একটি আলাদা জাতি-বাঙালি। বঙ্গদেশ তাদের মাতৃভূমি। অতএব, আলাদা রাষ্ট্র চাই। ব্যাপার শুধু আলাদা আত্মপরিচয়ের আকাক্সক্ষাজাত নয়। এর মূলে ক্রিয়া করেছে বিজাতীয় শোষণমু্র মাধ্যমে তার আত্মবিকাশের স্বপ্ন। এ আকাক্সক্ষার পথ ধরেই বাঙালির নিরলস সংগ্রাম পরিশেষে স্বাধীন আবাসভূমির জন্ম-যা আজকের বাংলাদেশ।
জাতীয় মুক্তি কী
জাতীয়-মুক্তি’ সমাসবদ্ধ শব্দটি অত্যন্ত ব্যাপক। বস্তুত: যার অর্থ আর্থ-সামাজিক মুক্তির সাথে যুগপৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক মুক্তি-যা একটি জাতিকে কেবল অর্থনৈতিক মুক্তি দেয় না, মুক্ত করে সকল প্রকার পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা-মূল্যবোধ থেকে। এমন একটি সমাজের স্বপ্ন-আকাক্সক্ষা বক্ষে ধারণ করেই বাঙালি জাতি আজ থেকে প্রায় চার দশক আগে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ করেছিল। কিন্তু বিশদ ব্যাখা না করেই এ কথা বলা যায় যে, আমাদের সে কাক্সিক্ষত মুক্তি এখনো সুদূরপরাহত।

কেন জাতীয় মুক্তি এখনো অর্জিত হল না
স্বাধীনতা অর্জনের পর আজ প্রায় চার দশক অতিক্রান্ত হতে চলেছে, কিন্তু আমরা আমাদের সে কাঙ্ক্ষিত আর্থ-সামাজিক মুক্তি অজর্ন করতে পারি নি।
কিন্তু কেন ?
তার কারণ বহুবিধ।
প্রথমত: দেশের প্রত্যেক মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকার এর নিশ্চয়তা দিতে হলে যে অর্থনৈতিক সংগতি দরকার-যাকে বলা যায় স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বস্তুগত ভিত্তি-তা আমাদের দেশ এখনো অর্জন করতে পারে নি।
দ্বিতীয়ত: যতটুকু সম্পদ আমাদের দেশে আছে এবং যতটুকু পণ্য আমরা ফি বছর উৎপাদন করে থাকি, তার ভোগ-বণ্ঠনও অত্যন্ত অসম।
তৃতীয়ত: বিশ্ব-অগ্রগতির প্রেক্ষাপটে ‘উপছে পড়া’ (trickle down benefit) তত্ত্ব অনুসারে দেশের যতটুকু উন্নয়ন অগ্রগতি হয়েছে, তার সিংহ ভাগ ভোগ করছে নগরবাসী, গ্রামে সে উন্নয়নের ছোঁয়া তেমনটি লাগে নি।
চতুর্থত: আমাদের দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো শিক্ষার আলো বঞ্চিত।
পঞ্চমত: আমাদের দেশ পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ-একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে যা সম্ভব-এবং সুশাসন ও আইনের শাসন, যা একটি কল্যাণধর্মী রাষ্ট্রের অনিবার্য অনুসঙ্গ, তা বিদ্যমান রুগ্ণ রাজনীতির কারণে এখনো আমাদের দেশে বিকশিত হয়নি।
সব মিলিয়ে সার্বিক পশ্চাৎপদতার ভয়াবহ এক অচলায়তনে বন্দী হয়ে আছে আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা।
এখন মৌলিক প্রশ্ন-এ অচলায়তন ভেঙ্গে বের হয়ে আসার উপায় বা পথ কি?

উত্তরণের বিকল্প নিয়ে ভাবনা:
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর রাষ্ট্র পরিচালনার কিছু মূলনীতিমালা আমাদের সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল । তৎমধ্যে অন্যতম ছিল সমাজতন্ত্র। কিন্তু বাংলাদেশে তখন পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি। তাই অধনবাদী বিকাশের মাধ্যমে; অর্থাৎ পুঁজিবাদী বিকাশকে পাশ কাটিয়ে (by passing capitalism) সমাজতন্ত্রে উত্তরণ-যা সমসাময়িক বিশের অনুন্নত দেশগুলোতে-যেখানে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেনি-উন্নয়নের একটি বিকল্প পথ হিসাবে গৃহীত হচ্ছিল, সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশও সে পথে এগুতে চাইল। অধনবাদী বিকাশের পথে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে দেশের বৃহৎ, মাঝারি-ক্ষুদ্র শিল্পকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নিয়ে আসা হল; পুঁজি বিনিয়োগের শিলিং নির্ধারণ সহ সর্বোচ্চ ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমি মালিকানার শিলিং নির্ধারণ, আমদানী রপ্তানী বাণিজ্য সরকারী খাতে নিয়ে আসা, ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করা হল। ইত্যাকার অর্থনৈতিক পদক্ষেপগুলো সমাজের অধনবাদী বিকাশের জন্য উপযোগী হলেও কিন্তু বাস্তবে কার্যকর ভাবে তার প্রয়োগ নানা কারণে সম্ভব হয়নি।

আমদানী রপ্তানী ব্যবসা, ব্যাংক-বীমা সহ প্রায় সকল শিল্প কারখানা রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনার মত একটি বৈপ্লবিক কাজ সম্পাদন করার পরও সে গুলোর ব্যবস্থাপনায় চরম ব্যর্থতা সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় চরম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করল । উপরোক্ত অর্থনৈতিক কর্মসূচীকে সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একক একটি জাতীয় দল ‘বাকশাল’ গঠনের মাধ্যমে সর্বশেষ যে চেষ্টা, তাও সফল হল না; কারণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পূর্বেই এক মর্মান্তিক সামরিক ক্যূ-দ্যেতার মাধ্যমে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা চলে গেল। অত:পর এবার উল্টোপথে যাত্রা।

ঊনিশ শ’ পঁচাত্তুর সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাসীন চক্র উন্নয়নের গতিধারা পাল্টিয়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির শ্লোগানকে সামনে নিয়ে আসল। অতঃপর পঁচাত্তুর পরবর্তী সময়ে মুক্তবাজার অর্থনীতির ডামাঢোলের মধ্যে জাতীয়করণকৃত শিল্পকারখানা, ব্যাংক-বীমা আবার ব্যক্তি মালিকানায় হস্তান্তর, ব্যাংক থেকে ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের অঢেল ঋণ প্রদান, ইত্যাকার পদক্ষেপের মাধ্যমে পুঁজিবাদী বিকাশের পথ গ্রহণ করা হল। কিন্তু নির্মম সত্য হলো, এতদসত্ত্বেও আমাদের দেশে কাঙিক্ষত শিল্প বিকাশ ঘটে নি। পানির দামে শ্রম পাওয়ার কারণে গার্মেন্টস শিল্পে যে বিদেশী বিনিয়োগ তা যে কারণে এ দেশে এসেছে সে কারণেই যে কোন সময়ে দেশ পরিবর্তন করতে পারে। কৃষিতেও এখনো সামন্তবাদী ও আধা-সামন্তবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা বিদ্যমান। উৎপাদন অপর্যাপ্ত, উৎপাদিত সম্পদের অসম বন্ঠন ইত্যাকার অবস্থার ফলে স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরও দারিদ্র্য আমাদের জনগোষ্ঠীর স্থায়ী ললাট লিপি হয়ে আছে ।

তাহলে আমরা কোন পথে এগুবো?
সে পরিকল্পিত ও রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, নাকি চিরায়ত (classical) পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতি, নাকি লুম্পেন বুর্জোয়া অর্থনীতি-লুটপাঠ, দুর্নীতি, যার মূল ভিত্তি-দুর্ভাগ্যজনকভাবে যা এখন আমাদের দেশের অর্থনীতির মূলধারা।

বস্তুত: অধনবাদী বিকাশের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের লক্ষ্যে উপরোল্লিখিত যে সকল কর্মপন্থা বা অর্থনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছিল, সে সকল কর্মসূচী-কারণ যাই হোক-সফলতার মুখ দেখে নি। একই ভাবে পঁচাত্তুর পরবর্তী সময় হতে এ দেশে লুম্পেন বাজার অর্থনীতিই চলছে। সে লক্ষ্যে বৃহৎ-ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প পানির দামে ব্যক্তি মালিকদের হস্তান্তর করার পাশাপাশি সহজ শর্তে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যক্তি মালিকদের ঋণও দেওয়া হয়েছে। এভাবে রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েও ব্যক্তিখাতে শিল্পকারখানার বিকাশ কাক্সিক্ষত পর্যাযে উপনীত হয় নি। পরিণামে বেড়েছে বেকারত্ব, বেড়েছে দারিদ্র্য, সম্পদ পুজ্ঞিভূত হয়েছে মুষ্ঠিমেয় লুঠেরা ব্যবসায়ীদের হাতে এবং বেড়েছে গ্রাম শহরের বৈষম্য।
সুতরাং অনুসিদ্ধান্ত হল, বিদ্যমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থায়ও আমাদের জাতীয় মুক্তি অর্জন সম্ভব হয় নি এবং অদূর ভবিষ্যতে হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
ম্যাক্রো-বিবেচনায় জাতীয় উৎপাদনের কিছু প্রবৃদ্ধি ঘটলেও বস্তুত: তার সুফল থেকে দেশের ব্যাপক জনগোষ্ঠী নিদারুণ ভাবে বঞ্চিত।

অপর যে বিকল্প থাকে, তা হল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গ্রহণ।
কিন্তু বিষয়গত ও বিষয়ীগত কারণে (subjective & objective condition) তার সম্ভাব্যতা কতটুকু তা আজ খতিয়ে দেখতে হবে।

মহামতি মার্কস-এঙ্গেলস সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির প্রণেতা। তারা প্রথম চিহ্নিত করেন পুঁজিবাদী সমাজে কিভাবে বুর্জোয়া শ্রেণী শ্রমিক শ্রেণীকে শোষণ করে তাদের সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। তারা তাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে কিভাবে শ্রমিকশ্রেণী উদ্বৃত্ত উৎপাদন করে এবং তা মালিক আত্মসাৎ করে তার হিসাব প্রকাশ কষে দেখিয়েছেন। তারা বলেন-এ উৎপাদক শ্রেণীকে বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নিতে হবে, অত:পর উৎপাদন যন্ত্রের সামাজিক মালিকানা স্থাপন করে সাম্যবাদী শোষণহীন সমাজ কায়েম করতে হবে। তারা কিভাবে শ্রমিক শ্রেণী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করবে, সে ব্যাপারে দিগনির্দেশণা প্রদান করেছেন। মার্কস-এঙ্গেলস্ এর প্রদর্শিত পথ ধরে লেনিন সর্ব প্রথম সোভিয়েত রাশিয়াতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করেন। সুদীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশে বাম রাজনৈতিক দলগুলো মার্কসবাদ-লেনিনবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজ কায়েমের স্বপ্ন নিয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন-যদিও নানা টেকনিক্যাল প্রশ্ন নিয়ে তারাও বহুধা বিভক্ত। বিভিন্ন জাতীয় ইস্যূতে, বিশেষভাবে স্বৈরাচার বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, তেল-গ্যাস-বন্দর-বিদ্যুৎ সহ জাতীয় সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, প্রভৃতি ক্ষেত্রে অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা তারা রেখে আসছেন। কিন্তু যখনই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তখন তারা সে নির্বাচনে প্রথমত: সকল আসনে প্রার্থী দিতে পারে না, দ্বিতীয়ত: তাদের দলের যে সকল প্রার্থী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন, তাদের প্রায় সকলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। অথচ অনেক ক্ষেত্রে এ সমস্ত দল থেকে ত্যাগী, সৎ ও যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিরা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে থাকেন। কিন্তু নির্বাচনী ফলাফলে বুঝা যায়, আমজনগণের কাছে তারা এখনো জনপ্রিয় হতে পারেন নি। এর জন্য কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন ও বিদ্যমান নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অনেকাংশে দায়ী করা যায় বটে, কিন্তু বাস্তবতা হল তৃণমূলে এসব সংগঠনের কোন কর্মী ও সমর্থক গোষ্ঠী এখনো গড়ে ওঠেনি। আবার তারা অনেকে এখনো মার্কসীয় দর্শন হুবহু অনুসরণ করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার চিন্তা আকঁড়ে আছেন। কিন্তু পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে শ্রেণী সংগ্রাম করে সমাজতন্ত্র কায়েমের বাস্তব (সাবজেক্টিভ ও অবজেক্টিভ) শর্ত আছে কিনা, তা আজ গভীর ভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।

আমরা জানি বিশ্বে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটে মহামতি লেনিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়ায়-যার আয়তন ছিল পৃথিবীর এক-ষষ্টাংশ। দীর্ঘ প্রায় সাত দশক ধরে নানা অনুশীলন, পরীক্ষা-নিরিক্ষার পর দেশের অনেক উন্নতি-অগ্রগতি সম্পন্ন করেও নব্বই এর দশকে এসে সে সমাজ যেন ঘুণেফোকা খাওয়া কাঠের কাঠামোর মত হুড়মুড় করে ভেঙ্গে পড়ল। অথচ ইতোমধ্যে সোভিয়েত সমাজতন্ত্র বিশ্ব দু’ মেরুতে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং এ কথা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মত বিশ্বের সকল মুক্তিকামী জাতির পাশে দাঁড়াত সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন। সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপ্রেরণায়, কখনো প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগিতায় বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ দেশে গড়ে ওঠেছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা । অথচ সে সোভিয়েত সমাজ যখন ভেঙ্গে গেল তার অভ্যন্তর থেকেই, তখন একে একে ভেঙ্গে যেত লাগল পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশ গুলো সহ অপরাপর সমাজতান্ত্রিক সমাজ কাঠামো। এখনো যে সকল দেশে সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী কমিউনিষ্ট পার্টি ক্ষমতায় আছে, যেমন চীন, উত্তর কোরিয়া, কিউবা ইত্যাদি দেশের সমাজকাঠামো, সে চিরায়ত সমাজতান্ত্রিক আদলে যে ঠিকে নেই, তা নিয়ে কোন বিতকের্র অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। সর্বোপেরি এক দিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের যে অপরিহার্য পূর্ব শর্ত-সমাজতন্ত্রের বস্তুগত ভিত্তি-শিল্পায়ন, কৃষির আধুনিকীকরণ-তা যেমন আমাদের সমাজে সৃষ্টি হয় নি, অপরদিকে সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের যে রাজনৈতিক শক্তি, তাও গড়ে ওঠেনি। এহেন দেশীয় ও বিশ্বপ্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব কিংবা শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র কায়েম করার চিন্তা একধরণের ডগমা বা মতান্ধতা বৈকি।

এমতাবস্থায় অপরিহার্যভাবে যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসে তা হলো-আমাদের সামনে কি কোন বিকল্প নেই ??

বিকল্পের সন্ধানে একটি প্রস্তাবনার খসড়া
বিদ্যমান বাস্তবতার প্রেক্ষিতে ও স্বাধীনতা উত্তর চার দশকের অভিজ্ঞতার আলোকে পরিবর্তনের এমন একটি রূপরেখা আজ প্রণয়ন করতে হবে, যা ন্যূনপক্ষে জাতিকে দ্বি-দলীয় ব্যবস্থার আড়ালে পরিবারতান্ত্রিক অপশাসন থেকে মুক্তি দিয়ে একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক, সেক্যুলার, আধুনিক ও বিজ্ঞানমনস্ক রাষ্ট্র উপহার দেবে-যে রাষ্ট্রে নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ হবে সম্পূর্ণ পৃথক, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা থাকবে প্রশ্নাতীত। শক্তিশালী ও স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশণ গঠনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সকল প্রকার দুর্নীতি ও অপশাসন থেকে রেহাই পাবে। সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, ভূমি দখল, ইত্যাদি চিরতরে বন্ধ হবে। রাজনীতি ও নির্বাচন সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হবে কালটাকার দৌরাত্ব্য থেকে। সর্বোপরি নিশ্চিত হবে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার । এমন একটি অর্থনৈতিক কর্মসূচী গ্রহণ করতে হবে যার লক্ষ্য হবে দেশের তেল-গ্যাস সহ জাতীয় সম্পদ সংরক্ষণ, শিল্প-কারাখানার বিকাশ, কৃষির আধুনিকায়ন এর মাধ্যমে কর্ম সংস্থান বৃদ্ধি করে বেকারত্ব দূরীকরণ এবং গ্রাম শহরের বৈষম্য দূরীকরণের কার্যকর পদক্ষেপ।
কিন্তু জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে যে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বা পরিবর্তন অপরিহার্য, তা বাস্তবায়নের অনিবার্য পূর্বশর্ত হচ্ছে, সে পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক শক্তির উত্থান।

যেহেতু স্বাধীনতার অব্যবহিত পর হতে অদ্যাবধি বিভিন্ন দলে বিভক্ত যে শাসকগোষ্ঠী বিভিন্ন মেয়াদে দেশ শাসন করেছে এবং যেহেতু তারা দেশ ও জাতিকে কাক্সিক্ষত মুক্তির পথে নিতে পারে নি, সেহেতু গতানুগতিক রাজনীতির ধারক-বাহক রাজনৈতিক শক্তির বিপরীতে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিবিন্যাস ঘটাতে হবে।

বিদ্যমান রাজনৈতিক শক্তিবিন্যাস বা মেরুকরণের বিপরীতে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলার আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করতে হলে আপাতত: বাম, উদারপন্থী ও গণতান্ত্রিক দেশপ্রেমিক দল, ব্যক্তি বা ব্যক্তিগোষ্ঠীকে উপরোক্ত একটি ন্যূনতম সাধারণ কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি তৃতীয় বিকল্প গড়ে তুলতে হবে।
এর কোন বিকল্প আপাতত: পরিলক্ষিত হচ্ছে না।