আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ। আমি বরিশালের লোক। বরিশালে না গেলে বুঝতেই পারতাম না পৃথিবীর সুন্দর জায়গাটি হল বরিশাল। এখানে জল পড়ে পাতা নড়ে। তার কথা মনে পড়ে। বরিশালের লোক ছিলেন বলেই জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন–

কোথাও দেখিনি, আহা, এমন বিজন ঘাস–প্রান্তরের পারে
নরম বিমর্ষ চোখে চেয়ে আছে–নীল বুকে আছে তাহাদের
গঙ্গা ফড়িঙের নীড়, কাঁচপোকা, প্রজাপতি, শ্যামাপোকা ঢের,
হিজলের ক্লান্ত পাতা,–বটের অজস্র ফল ঝরে বারে-বারে
তাহাদের শ্যাম বুকে;–পাড়াগাঁর কিশোরেরা যখন কান্তারে
বেতের নরম ফল, নাটা ফল খেতে আসে, ধুন্দুল বীজের
খোঁজ করে ঘাসে-ঘাসে–বক তাহা জানেনাকো, পায়নাকো টের
শালিখ খঞ্জনা তাহা;–লক্ষ লক্ষ ঘাস এই নদীর দু’ধারে…

বরিশাল ছাড়া এই ঘাস কোথায় বিজন হয়ে ওঠে? অসম্ভব। এ ব্যাপারে আমি বাজি ধরতে রাজী আছি। আর কেউ আছেন গো ভাই -বেরাদরগণ? থাকলে হাত তোলেন।

২.
প্রকৃত বরিশাইল্যা হলেন তপন কুমার রায়চৌধুরী। তিনি বরিশালের কীর্তিপাশায় জন্মেছিলেন ১৯২৬ সালে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় ইতিহাস ও সভ্যতার অধ্যাপক। ইত্যাদি ইত্যাদি। তার বিখ্যাত বইটার নাম রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা। হেয়ার উপরে আর বাঙালনামা হয় না। ১০০% সহি।

শুনুন, তিনি লিখেছেন–
লোকে বলত এক সময়ের ভাল ছেলে কচি গাঁজা খেয়ে পাগল হয়ে গেছে। আমার মনে হয় কথাটা ভুল। আক্ষরিক অর্থেই গাঁজার ধোঁয়ার পর্দা টেনে তার আড়ালে উনি নিজের ব্যক্তিসত্ত্বা এবং স্বাধীনতা বজায় রেখেছিলেন। উনিই এ যুগের হিপিদের আদর্শ পিতামহ। ওঁর পাগলামি গতানুগতিক জীবনযাত্রাকে জিভ ভেঙান ছাড়া কিছু না। জমিদার যোগেন সেন মশায়ের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে উনি বক্তৃতার সুরে বলতেন,”শুইন্যা রাখো, শুইন্যা রাখো, বিলম্বে হতাশ হবা। যোগেন স্যার, সুরেন স্যার, ধীরেন স্যার–তিন ভাই। তো পাঁচা পানের পয়সা, পৌনে চান আনা’। এই মূল্যায়নে উক্ত তিন ভাই এবং পরিবারস্থ ব্যক্তিরা সন্তুষ্ট হতেন মনে হয় না। সর্বজনপ্রিয় কালাভাই নতুন রেস্তোরাঁ খুললেন, ‘Baron Restaurant’ । কচি নিজেকে তার অবৈতনিক প্রচারাধ্যক্ষ নিয়োগ করলেন,”এই ব্যারন রেস্টুরেন্টে উৎকৃষ্ট গাঁজা পাওয়া যায়। আমি প্রত্যহ খাই। আপনারাও খাইবেন। শরীর মন ভাল থাকবে। চরিত্রের উন্নতি হইবে।” কি উপায়ে তাকে শেষ অবধি নিরস্ত করা হয় জানি না। কয়েক বছর অদর্শনের পর হঠাৎ একদিন বিবির পুকুরের পাড়ে কচিদার সঙ্গে দেখা। মুখটা কানের খুব কাছে এন ফিস ফিস করে তিনি জিজ্ঞেস করলেন,”বোZলা’ কিছু?
বিনা দ্বিধায় উত্তর দিলাম,’না’।
কচিদা গলা আরও নামিয়ে বললেন, ‘আমিও না।’ তারপর ‘আমিও না’ বলে হুঙ্কার দিয়ে এক লাফে অদৃশ্য হলেন। কচিদা যেখানেও থাকুন শুনে রাখুন, ‘কিছুই বোZলাম না, বোZবার আর ভরসাও রাখি না।”

৩.
ভরসা আর কার কাছে রাখব। চারিদিকে এত সব অহংকারী আর লোভী মানুষের ভিড়–কারো উপরে ভরসা রাখার আর উপায় নাই।