লিখছিলাম আসলে সহিংসতা নিয়ে একটি সিরিজ – ‘জীবন মানে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা’। ধুমধারাক্কা সেই সিরিজটিতে সহিংসতার একটি নৃতাত্ত্বিক, সামাজিক বিশ্লেষণ হাজির কারার চেষ্টা ছিলো আধুনিক বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের পটভূমিকায়। তিনিটি পর্ব এ পর্যন্ত দেয়া হয়েছে। এটি চতুর্থ পর্ব। তবে সহিংসতা নিয়ে গুতাগুতি করতে গিয়ে দেখি নানা ধরণের আকর্ষনীয় উপাদান উঠে আসছে সহিংসতাকে ঘিরে। বয়সের সাথে যেমন সহিংসতার একটা সম্পর্ক পাওয়া যাচ্ছে, তেমনি কখনো আবার সহিংসতা আর প্রতিভা আবার এক সুতোয় বাঁধা পড়তে চাইছে। কখনো আবার সহিংসতা কিংবা প্রতিভা বিয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়ছে। কী মুশকিল! এদিকে আবার আমাদের মুক্তমনার সবার প্রিয় লেখক মইনুল রাজু বাংলাদেশ থেকে বিয়ে সেরে এসেছেন। শিরোনাম দেখেই নিশ্চয় বোঝা যাচ্ছে যে এই পর্বটি এই মুহূর্তে উৎসর্গ করার মত যোগ্য ব্যক্তি মইনুল রাজু ছাড়া আর কেউ হতে পারবেন না। পরলোকগত থুড়ি সদ্য বিবাহিত রাজুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে লেখাটি উৎসর্গীকৃত হল।

এই পর্বটিতে বিজ্ঞানের চেয়ে ফ্যান্টাসিই হয়তো বেশি পাবেন পাঠকেরা। তাই পাঠকদের এই পর্বটি খুব বেশি সিরিয়াসলি না নেবার অনুরোধ করছি।

:line:

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব

বয়সের দোষ!

জৈবিকভাবে পুরুষেরা যে নারীদের তুলনায় অধিকতর সহিংস – এটা আমরা আগের বিভিন্ন আলোচনা থেকে জেনেছি। কিন্তু কথা হচ্ছে, পুরুষেরা সব বয়সেই একইরকম সহিংসতা প্রদর্শন করে? না তা কিন্তু নয়। বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে ভায়োলেন্স ব্যাপারটা পুরুষদের মধ্যে সার্বজনীন হলেও এর ব্যপ্তি বয়সের সাথে উঠা নামা করে। যে কোন দেশেই দেখা গেছে গড়পরতা সবচেয়ে বেশি হত্যাকান্ড এবং সহিংসতা পুরুষেরা করে থাকে যখন তাদের বয়স থেকে পনের থেকে উনত্রিশের মধ্যে[1]। তারপর যত বয়স বাড়তে থাকে সহিংসতা কমে আসে। এমনকি সিরিয়াল কিলাররাও একটা নির্দিষ্ট বয়েসের পরে সেভাবে আর হত্যা করে না। এর কারনটাও স্পষ্ট। কারণ এই বয়সের পরিসীমাতেই পুরুষেরা রিপ্রোডাক্টিভ কম্পিটিশনের চূড়ায় থাকে। আমেরিকায় করা সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, পনের বছর বয়সের দিকে যখন ছেলেদের বয়ঃপ্রাপ্তি শুরু হয় তখনই খুন খারাবির হার বাড়তে থাকে, বিশ বছরের দিকে একদম শীর্ষে পৌঁছায় এবং ত্রিশ চল্লিশ বছর বয়সে পৌঁছানো পর্যন্ত খুন খারাবি চলতেই থাকে[2]। খুন খারাবির শিকার যারা হন, তারাও বেশি হন বিশ বছর বয়সের দিকেই। দেখা গেছে প্রতি বছরে আমেরিকায় প্রতি এক লক্ষ জনে খুনের হার দশ থেকে চোদ্দ বছরে যেখানে মাত্র ১.৬, কিন্তু পনের থেকে উনিশ বছরের সময় সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ এ, আর বিশ থেকে চব্বিশ বছর বয়সে তা ১৭.৮[3]। তারপর পচিশ থেকে উনত্রিশ বছর বয়সের পরিসীমায় তা দাঁড়ায় ১৬.৩; বত্রিশ থেকে চৌত্রিশে ১৩.৯; আর পয়ত্রিশ উনচল্লিশ বছরের মধ্যে ১২। সেজন্যই ডেভিড বাস তার ‘মার্ডারার নেক্সট ডোর’ গ্রন্থে বলেছেন[4],

এই সংখ্যাগুলো থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে,পুরুষেরা যে সময়টাতে প্রজননগত প্রতিযোগিতার সময়ে প্রবেশ করে, সেই সময়েই খুন খারাবির প্রকোপ নাটকিয় ভাবে বেড়ে যায়।

আমরা বাংলাদেশে আমাদের বাপ দাদাদের ঘার ত্যারা আর রগচটা ছেলেপিলেদের দিকে দেখিয়ে বলতে শুনেছি – ‘তরুণ বয়স তো, তাই ছেলের রক্ত গরম। দেখবেন বয়স হলে রক্তও ঠাণ্ডা হয়ে আসবে’। উনারা হয়তো চারপাশের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে এই কথাগুলো বলেন। আসল কারণ হল, যৌনতার প্রতিযোগিতাসূচক ব্যাপারগুলো যখন কমে আসে, তখন এমনিতেই সহিংসতা আর সেভাবে ব্যবহারে প্রকাশিত হয় না। এটাকেই হয়তো চলতি কথায় ‘রক্ত ঠাণ্ডা’ হয়ে যাওয়া বলে ভেবে নেয়া হয়।

ব্যাপারগুলো ‘কমন সেন্স’ হিসেবে জানা ছিলো অনেক আগে থেকেই কিন্তু বিবর্তন মনোবিজ্ঞান রঙ্গমঞ্চে আসার আগ পর্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এ নিয়ে কোন গবেষণা ছিলো না। ১৯৮৩ সালে দুই গবেষক ট্রাভিস হির্শি এবং মাইকেল গডফ্রেসন “Age and Explanation of Crime” নামক প্রবন্ধের মাধ্যমে দেখালেন বয়স এবং অপরাধপ্রবনতার এই ধারাটি সংস্কৃতি নির্বিশেষে একইরকম পাওয়া যাচ্ছে[5]। অর্থাৎ, যে কোন সংস্কৃতিতেই দেখা যায় বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই পুরুষদের মধ্যে ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকে, আর তা একেবারে শীর্ষে পৌঁছায় যৌবনের প্রারম্ভে, বিশ থেকে ত্রিশের দশকের সময়টায় তা দ্রুতগতিতে কমতে থাকে, আর মধ্যবয়সে তা আনুভূমিক হয়ে যায়। নীচের রেখচিত্রটি দেখলে ব্যাপারটি আরো ভালভাবে বোঝা যাবে –

age-crime_curve

ছবি – ট্রাভিস হির্শি এবং মাইকেল গডফ্রেসন তাদের গবেষনায় দেখিয়েছেন যে, বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই পুরুষদের মধ্যে অপরাধ-প্রবণতা বাড়তে থাকে, আর তা একেবারে শীর্ষে পৌঁছায় যৌবনের প্রারম্ভে, বিশ বছরের পর থেকে তা দ্রুতগতিতে কমতে থাকে, আর মধ্যবয়সে তা আনুভূমিক হয়ে যায়

দু-চারটি ক্ষেত্রে এই গ্রাফের ব্যতিক্রম পাওয়া গেলেও সার্বজনীনভাবে এই গ্রাফের গড়নের সাথে প্রায় সকল অপরাধ-বিশেষজ্ঞই এখন একমত পোষণ করেন[6],[7]।

অপরাধপ্রবণতা আর প্রতিভা কি তবে এক সূত্রে গাঁথা?

এই অংশের শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো আঁতকে উঠবেন। কোথায় অপরাধপ্রবণতা আর কোথায় প্রতিভা! কোথায় বাঘেরহাট আর কোথায় সদরঘাট! কিন্তু বাগের হাট থেকে সদরঘাট যাবার রাস্তা যেমন একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়, তেমনি অনেক গবেষক মনে করেন অপরাধপ্রবণতার সাথেও প্রতিভার একটা অলিখিত সম্পর্কও পাওয়া যাবে একটু নিবিষ্ট মনে খুঁজলেই। আগের অংশেই অপরাধ প্রবণতা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি যে, বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই পুরুষদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকে, আর তা একেবারে শীর্ষে পৌঁছায় যৌবনের প্রারম্ভে, বিশ থেকে ত্রিশের দশকের সময়টায় তা দ্রুতগতিতে কমতে থাকে, আর মধ্যবয়সে তা আনুভূমিক হয়ে যায়। বিজ্ঞানীরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছেন ঠিক একই ধারা পাওয়া যাচ্ছে বয়স এবং মানব প্রতিভার মধ্যেও। বিভিন্ন বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, শিল্পীদের জীবনী বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে অধিকাংশরই প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে যৌবনের প্রারম্ভেই, আর যৌবনের শেষ হতে না হতেই অতিদ্রুত প্রতিভার মৃত্যু ঘটে যায়। আসলে বয়স হলে প্রতিভাধরদের মাথা যে আগের মত কাজ করে না, এর অনেক উদাহরণই তুলে ধরা যায়। পল ম্যাকার্টনি সেই কবে বিটলসের সময় জনপ্রিয় ছিলেন,ব্যতিক্রমধর্মী বহু গান লিখে সঙ্গিত পিপাসুদের পাগল করে দিয়েছিলেন যাট সত্তুরের দশকে। অবধারিতভাবে তিনি তখন ছিলেন যৌবনের প্রারম্ভে। তার পর বহু বছর পার হয়েছে, গঙ্গা যমুনা দিয়ে বহু জল গড়িয়ে গেছে, তিনি একটিও ‘জনপ্রিয় সঙ্গীত’ দর্শকদের জন্য লিখতে পারেননি। তার অধিকাংশ সময় এখন নাকি ছবি আঁকাতেই কেটে যায়। বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন মহাকর্ষ, আলোর বিচ্ছুরণ সহ তার সফল এবং বিখ্যাত আবিস্কারগুলো তরুণ বয়সেই করে ফেলেছিলেন।আরো পরিস্কার করে বললে তার ২৪ বছর বয়সের মধ্যেই। বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের জীবনীর দিকে তাকাই। তার প্রায় সবগুলো আবিস্কারই হয়েছে তাঁর ‘বিস্ময় বছর’ যাকে আমরা অভিহিত করি Annus Mirabilis হিসবে -সেই বছরটিকে কেন্দ্র করে। সে বছরের প্রথমভাগে আইনস্টাইন প্রকাশ করেছিলেন ব্রাউনীয় গতির উপর একটা গবেষণাপত্র- যেটি সে সময় দিয়েছিলো অনুর অস্তিত্বের বাস্তব প্রমাণ, বানিয়েছিলেন আলোর কনিকা বা কোয়ান্টাম তত্ত্ব, আর সে সময়েই প্রকাশ করেছিলেন সবচাইতে জনপ্রিয় আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্বটি (Special Theory of relativity)। তার বিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 সেসময় বাজারে এসেছিলো একটি অতিরিক্ত (সংযোজনী) তিন পৃষ্ঠার পেপার হিসেবে। একটি পেপারের জন্য আবার পরবর্তীতে পেয়েছিলেন নোবেল। তখন তার বয়স চল্লিশও পেরোয়নি। মূলতঃ সার্বিক অপেক্ষিক তত্ত্ব (General Theory of Relativity) আবিস্কারের পর আইনস্টাইন আরো পঞ্চাশ বছর বেঁচেছিলেন কিন্তু আর কোন বড় ধরনের আবিস্কার করতে পারেননি। মূলতঃ মধ্যবয়স থেকে শুরু করে বার্ধক্যের পুরোটা সময় জুড়েই আইনস্টাইন চেষ্টা করেছেন কোয়ান্টাম বলবিদ্যাকে অসম্পূর্ণ বা ভুল প্রমাণ করতে আর প্রকৃতি জগতের বলগুলোকে একটিমাত্র সুতায় গাঁথতে। তার সেই উচ্চাভিলাসী চেষ্টা কিন্তু সফল হয়নি। বরং জীবনের শেষ বছরগুলোতে তিনি পদার্থবিজ্ঞানের মূল ধারার গবেষণা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ‘নিঃসঙ্গ গ্রহচারী’তে পরিণত হন[8]। বিজ্ঞানীদের প্রতিভা আর বয়সের সম্পর্ক নিয়ে আইনস্টাইন নিজেই করে গেছেন মজার এক উক্তি[9] –

যে ব্যক্তি ত্রিশ বছর বয়সের আগে বিজ্ঞানে কোন অবদান রাখতে পারেনি, সে আর কখনোই পারবে না।

আইনস্টাইনের এই উক্তির সত্যতা আমরা পাই শুধু তার নিজের জীবনেই নয় পাশাপাশি বহু প্রতিভাধরদের জীবনেই। গনিত এবং পদার্থিবিজ্ঞানের মতো বিষয়গুলোকে বহুদিন ধরেই ‘ইয়ং ম্যান্স গেম’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে[10]। গনিতবিদ জন ভন নিউম্যান গনিতে যে অবিস্মরনীয় অবদানগুলো রেখে গেছেন, তার প্রায় সবগুলোই ২৫ বছর বয়সের মধ্যে। এর পর থেকে শুরু হয়েছিল মূলত প্রতিভার পতন[11]। জেমস ওয়াটসন যে ডিএনএ তথা যুগল সর্পিলের রহস্যভেদ করার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, তিনিও তা করেছিলেন ২৫ বছর বয়সে (সেই আবিস্কারটির জন্য ওয়াটসন পরবর্তীতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন)। তারপর থেকে যত দিন গেছে তার ক্যারিয়ারে আর কোন সফলতার পালক যোগ করতে পারেননি। এধরণের অনেক উদাহরণই দেয়া যায়। বিল গেটস তরুণ বয়সে ‘কম্পিউটার উইজার্ড’বালক হিসেবে পরিচিত ছিলেন, আজকে প্রৌঢ় বয়সে তিনি হাতে কলমে প্রোগ্রামিং টোগ্রামিং বাদ দিয়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে নিরাপদ জীবন যাপন করছেন।

বিভিন্ন সময়ে গবেষকেরা বিভিন্ন বিজ্ঞানীদের বয়স এবং তাদের জীবনের সাফল্যমণ্ডিত স্বর্ণালী সময়গুলোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ হাজির করেছেন। এইচ. সি. লেহমান ১৯৫৩ সালেই তার একটি গবেষণায় দেখিয়েছিলেন দুনিয়ার অধিকাংশ সফল বৈজ্ঞানিক আবিস্কারগুলোই মূলত তরুণ বিজ্ঞানীরা করেছিলেন, বয়স্ক বিজ্ঞানীরা নয়[12]। ১৯৭৯ সালে এস. কোল[13] এবং ১৯৯১ সালে লেভিন এবং স্টিফেন তাদের গবেষণায় আলাদাভাবে দেখিয়েছেন যে, পিএইচডি করার সময় এবং তার পর পরেই বিজ্ঞানীদের উৎপাদনশিলতা এবং কর্মমুখরতা হু হু করে বাড়তে থাকে,আর তারপর থেকেই আবার তা লক্ষ্যনীয়ভাবে কমে আসতে থাকে[14]। ২০০৩ সালে সাতোশি কানাজাওয়া ২৮০ জন প্রোথিতযশা সমসাময়িক বিজ্ঞানীর উপর গবেষণা চালিয়ে দেখান যে,বয়স-অপরাধ রেখচিত্রের মতই (আগের অংশে আলোচিত) প্রতিভার ক্ষেত্রেও বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই পুরুষদের মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ বাড়তে থাকে, আর তা একেবারে শীর্ষে পৌঁছায় যৌবনের প্রারম্ভে, ত্রিশ বছরের পর থেকে তা দ্রুতগতিতে কমতে থাকে, আর তারপরে তা একেবারেই আনুভূমিক হয়ে যায়। তার গবেষণাপত্র থেকে পাওয়া ফলাফল নীচে রেখচিত্রের সাহায্যে পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল –

age-genius_curve

ছবি – সাতোশি কানাজাওয়া সমসাময়িক বিজ্ঞানীদের জীবন নিয়ে গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই তাদের মধ্যে প্রতিভার স্ফুরণ বাড়তে থাকে, আর তা একেবারে শীর্ষে পৌঁছায় যৌবনের প্রারম্ভে, ত্রিশ বছরের পর থেকে তা দ্রুতগতিতে কমতে থাকে, আর তারপরে তা একেবারেই আনুভূমিক হয়ে যায়।

অধ্যাপক কানাজাওয়া তার ফলাফল সম্পর্কে গবেষণাপত্রে বলেছেন এভাবে[15] –

Fig presents the distribution of the peak age among the 280 scientists in my sample. It is apparent from the histogram that scientific productivity indeed fades very rapidly with age. Nearly a quarter (23.6%) of all scientists makes their most significant contribution in their career during the five years around age 30. Two-thirds (65.0%) will have made their most significant contributions before their mid-thirties; 80% will have done so before their early forties.

বয়সের সাথে প্রতিভার প্যাটার্নটি শুধু বিজ্ঞানে নয়, শিল্প, সাহিত্য,সঙ্গীত কিংবা খেলাধুলার ক্ষেত্রগুলোতেও একই রকম পাওয়া গেছে। যদিও সাহিত্যের সাথে হার্ডকোর গণিত/ বিজ্ঞানের একটু পার্থক্য আছে। সাহিত্যের ক্ষেত্রে দেখা গেছে বহু সাহিত্যিকদেরই প্রতিভার চূড়া স্পর্শ করে মধ্য বয়সে এসে (৪০ থেকে ৫০ বছর বয়েসের মধ্যে) এবং অধিকাংশ সাহিত্যিকেরাই অল্প বয়সে ফুঁরিয়ে যান না, বরং বহুদিন ধরে সাহিত্য চর্চা চালিয়ে যেতে পারেন[16]।রবীন্দ্রনাথ তার বার্ধক্যে এসেও অবলীলায় কবিতা গল্প নাটক উপন্যাস লিখেছেন তরুণ সাহিত্যিকদের সাথে পাল্লা দিয়ে। শওকত ওসমান, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান সহ অনেকেই থাকবেন উদাহরণে। পাশ্চাত্যেও এমন উদাহরণ বিরল নয়। মার্কটোয়েন কিংবা আলফ্রেড হিচককের মতো সাহিত্যিক কিংবা শিল্পীরা জীবনের প্রান্তসীমাতে এসেও আমাদের জন্য অসাধারণ সাহিত্য বা শিল্পকর্ম উপহার দিয়েছেন। অবশ্য বিপরীত উদাহরণও খুঁজলে পাওয়া যাবে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র ২১ বছর বয়সে অকাল প্রয়াণের আগেই তার সমস্ত ক্ষুরধার কবিতাগুলো লিখে ফেলেছিলেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার বিদ্রোহী কবিতাটি লেখেন তার মাত্র ২৩ বছর বয়সে। আসলে নজরুলের সকল সাহিত্যকর্মই তরুণ বয়সের প্রতিভার বিচ্ছুরণ। ১৯৪২ সালে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত হবার পরে পরবর্তী দীর্ঘ চৌত্রিশ বছর কোন সাহিত্যচর্চা করতে পারেননি, বরং একেবারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায় জীবণ অতিবাহিত করেন, এবং সেভাবেই মৃত্যুবরণ করেন। পশ্চিমেও এ ধরণের উদাহরণ আছে। প্রথম জীবনে অত্যন্ত সফল সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচিত হলেও পরবর্তীকালে প্রতিভার স্ফুরণ আর সেভাবে দেখা যায় নি। এমনি একজন আমেরিকান সাহিত্যিক ছিলেন জ়ে ডি. স্যালিঙ্গার (J. D. Salinger), যিনি তরুণ বয়সে The Catcher in the Rye উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হয়েছিলেন, কিন্তু জীবনের শেষ তিন দশক ধরে আক্ষরিক অর্থে কিছুই প্রকাশ করতে পারেননি। তবে ক্ষেত্রবিশেষে বিচ্ছিন্ন ভাবে ফলাফল যাই পাওয়া যাক না কেন,গড়পরতা রেখচিত্রের আকার এবং ট্রেন্ড মোটামুটি একইরকমের পাওয়া গেছে। সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর এবং সাহিত্যিকদের বয়স-প্রতিভার তুলনামুলক রেখচিত্র নীচে দেওয়া হল –

age-genius_jazz

age-genius_painter_author

ছবি- সঙ্গীতজ্ঞ, চিত্রকর এবং সাহিত্যিকদের বয়স-প্রতিভার তুলনামুলক রেখচিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে তারা একই ধরণের প্যাটার্ন অনুসরণ করে।

উপরের রেখচিত্রগুলো নিয়ে খুব বেশি জটিল আলোচনায় না ঢুকেও কেবল সাদা চোখেই বলে দেয়া যায় যে,বয়স-অপরাধ রেখচিত্রের (age-crime curve) সাথে বয়স -প্রতিভা রেখচিত্রের (age-genius curve) অদ্ভুত ধরণের মিল পাওয়া যাচ্ছে। দুটোর ক্ষেত্রেই দেখা যায় মূলত বয়ঃসন্ধির পর থেকেই গড়পরতা এ বৈশিষ্টগুলোর স্ফুরণ ঘটতে থাকে, শীর্ষে পৌঁছায় যৌবনের প্রারম্ভে, আর মধ্যবয়সের পর থেকে তা দ্রুতগতিতে কমতে থাকে। হয়তো সাধারণ পাঠকদের কাছে পুরো ব্যাপারটি কাকতালীয় মনে হতে পারে,কিন্তু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন জৈববৈজ্ঞানিক কারণেই এদের মধ্যে একটা অলিখিত সম্পর্ক থেকে যায়।

আমরা আগের আলোচনা থেকে কিছুটা আলামত পেয়েছি যে, বয়ঃসন্ধি বা পিউবার্টির সময় থেকেই সবার মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে,তারা অধিকতর ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয়, কারো কারো মধ্যে সহিংসতা বৃদ্ধি পায়, কারো বা মধ্যে প্রতিভা। জৈবিকভাবে চিন্তা করলে, বয়ঃসন্ধির আগে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের কোন প্রজননগত উপযোগিতা নেই। কারণ সেই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবকে প্রজননগত সফলতায় স্থানান্তরিত করা সেই সময় সম্ভব হয় না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকাল স্পর্শ করার সাথে সাথে প্রতিযোগিতামূলক অভিব্যক্তিগুলো যেন ধাবমান অশ্বের মতোই দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে। যখন থেকে দেহ সর্বপোরি প্রজননের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠে তখন থেকেই প্রতিটি প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র (সেটা সহিংসতাই হোক, অথবা হোক বিশেষ দিকে প্রতিভাময় দীপ্তি) স্ফুরিত হতে থাকে তীব্র বেগে। মধ্য বয়সের পর সেই আকাঙ্ক্ষা স্তিমিত হয়ে আসে জৈবিক নিয়মেই। অর্থাৎ, এই তত্ত্ব অনুযায়ী[17]-

অপরাধপ্রবণতা আর মেধা দুটোই আসলে তারুন্যের প্রতিযোগিতামুলক অভিব্যক্তির ফসল, আদিম শিকারী-সংগ্রাহক পরিস্থিতিতে যার চূড়ান্ত নিয়ামক ছিলো প্রজননগত সাফল্য।এই ধারার প্রভাব আজকের সমাজেও একটু চেষ্টা করলেই লক্ষ্য করা যাবে। মারামারি কাটাকাটি এবং সহিংসতায় কম পরিমাণে নিজেকে নিয়োজিত করে বরং বহু পুরুষ তার উদ্দীপনাকে কাজে লাগায় প্রতিভার নান্দনিক (কেউ বৈজ্ঞানিক আবিস্কার, কেউ সঙ্গিত সাধনা, কেউ খেলাধূলা, কেউ শিল্প সাহিত্য সৃষ্টি, কেউবা অর্থোপার্জন) বিকাশে।আসলে এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে সে নিশ্চিত করে অধিক নারীর দৃষ্টি, এবং সময় সময় তাদের অর্জন এবং প্রাপ্তি।

প্রতিভা ব্যাপারটাকে কেবল সঙ্গমী মননের অভিব্যক্তি ভাবতে হয়তো অনেকেরই মন সায় দেবে না। কিন্তু আমরা আগের অংশের আলোচনায় দেখেছি যে, অর্থ-প্রতিপত্তি আর ক্ষমতায় বলীয়ান পুরুষেরাই বেশি পরকীয়ায় বেশি আসক্ত হন বেশি। আমরা দেখেছি যে, কেতাদুরস্ত কাপড় চোপড়, দামি গাড়ি, বাড়ি, ঘড়ি এমনকি কথাবার্তা, চালচলন, স্মার্টনেস, শিক্ষাগত যোগ্যতা, রাজনৈতিক বা সামাজিক ক্ষমতা বা প্রতিপত্তি সবকিছুকেই পুরুষেরা ব্যবহার করে নারীকে আকর্ষণের কাজে। তাহলে প্রতিভাই বা তালিকা থেকে বাদ যাবে কেন? নিজের প্রতিভাকে কিভাবে নারীদের আকর্ষণের কাজে ব্যবহার করা যায় তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ বিজ্ঞানী সম্রাট আলবার্ট আইনস্টাইন। প্রতিভাধর এই বিজ্ঞানী শুধু বিজ্ঞানের জগতেই অসাধারণ ছিলেন না, নারীলিপ্সায়ও ছিলেন অনন্যসাধারণ। মেরী, মিলেইভা, এলসা, আইলস্‌, বেটি নিউম্যান, মার্গারেট লেনবাখ, টনি মেণ্ডেল, হেলেন ডুকাস – কত নারী যে এসেছে তার জীবনে, কোন ইয়ত্তা নেই। একবার আবার একই সাথে প্রেম করেছেন মা (এলসা) এবং মেয়ের (আইলস) সাথে একই সময়ে, এমন উদাহরণও আছে। আইনস্টাইনের প্রেমময় জীবন নিয়ে ড.প্রদীপ দেব একবার একটি চমৎকার প্রবন্ধ লিখেছিলেন মুক্তমনায় ‘প্রেমিক আইনস্টাইন‘ শিরোনামে[18]। সেই প্রবন্ধটি পাঠ করলে পাঠকেরা বুঝতে পারবেন কী ভাবে নিজের প্রতিভা, যশ এবং খ্যাতিকে আইনস্টাইন প্রতিটি ক্ষণে ব্যবহার করেছেন নারীদের আকর্ষণের উদ্দেশ্যে। একাধিক নারীপ্রীতির ব্যাপারটা শুধু আইনস্টাইনের একচেটিয়া ছিল ভাবলে ভুল হবে।

einstein_schrodinger_tiger

ছবি- আইনস্টাইন, শ্রোডিংগার কিংবা টাইগার উডস সহ বহু প্রতিভাধরদের জীবন পর্যলোচনা করলেই দেখা যাবে, তারা তাদের স্বীয় প্রতিভার মাধ্যমে আকৃষ্ট করতে পেরেছিলেন একাধিক নারীর সঙ্গ এবং সান্নিধ্য।

বহু বিখ্যাত বিজ্ঞানীরাই নিজের প্রতিভার স্ফুরণ ঘটিয়েছিলেন নারীসঙ্গ কামনায়, কিংবা আরো পরিস্কার করে বললে – অনেক সময় নারীসঙ্গের মাধ্যমে। অরভিন শ্রোডিংগারের নাম আমরা প্রায় সবাই জানি। কোয়ান্টাম বলবিদ্যা কেউ পড়ে থাকলে তিনি শ্রোডিংগারের সমীকরণ পড়েছেনই। শ্রোডিংগার গত হয়েছেন সেই কবে, কিন্তু ‘শ্রোডিংগারস ক্যাট’ এতদিন বাদেও পদার্থবিজ্ঞানের জগতে দার্শনিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না যে, সেই নোবেল বিজয়ী শ্রোডিংগার তার জগদ্বিখ্যাত তরঙ্গ সমীকরণটি তৈরি করেছিলেন যখন তিনি তার এক রক্ষিতাকে নিয়ে নির্জনে ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন। একটি মাত্র রক্ষিতা থাকলে তাও না হয় কথা ছিলো, তিনি আবার পুরোটা সময়েই আরেক নারীর সাথে সম্পর্ক রেখেছিলেন, যিনি তার এক বন্ধু আর্থার মার্চের (Arthur March) স্ত্রী। আর এগুলোর বাইরে তার নিজের স্ত্রী তো ছিলোই। বিজ্ঞানীদের বাইরে প্রতিভাধর কবি, সাহিত্যিক শিল্পী, আর খেলোয়াড়দের মধ্যে নারীলিপ্সার ব্যাপারটা এতটাই প্রকাশ্য যে এটা নিয়ে আলদা করে কিছু লেখার কোন মানে হয় না। মোজার্ট, লুইস ক্যারল, রুশো, দালি, ফিটজেরাল্ড, জেমস জয়েস প্রমুখের বিরুদ্ধে শুধু নারী সঙ্গ নয়, এমনকি বিকৃত যৌনরুচিরও নানা অভিযোগ আছে। সেগুলোতে না হয় নাই বা গেলাম এখানে। আর খেলোয়াড়দের মধ্যে? এই তো কিছুদিন আগেই (ফেব্রুয়ারী, ২০১০) প্রতিভাধর গলফ খেলোয়াড় ‘বিবাহিত’ টাইগার উডসের প্রায় একডজন ‘পরনারীর’ সাথে যৌন সম্পর্ক থাকার কেলেঙ্কারী নিয়ে মিডিয়ায় আলোচনার ঝড় বয়ে যায়। এসব কিছু থেকে অনেকেই অনুমান করেন যে, খ্যাতিমানদের প্রতিভা, অপরাধীদের সহিংসতা এবং তাদের প্রজননগত চাহিদা বা সাফল্য এ সবকিছুই হয়তো আসলে একসূত্রে বাঁধা।

পোলার বিয়া দাও – মাথা ঠাণ্ডা হইবো

আমাদের বয়োজ্যোষ্ঠদের এলাকার ঘার ত্যারা আর রগচটা ছেলেপিলেদের দিকে দেখিয়ে বলতে শুনেছি – ‘তরুণ বয়স তো, তাই ছেলের রক্ত গরম। দেখবেন বয়স হলে রক্তও ঠাণ্ডা হয়ে আসবে’। বয়োজ্যোষ্ঠদের এই মন্তব্যের যৌক্তিকতা নিয়ে উপরে ‘বয়সের দোষ’ অংশে এ নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি। পাশাপাশি আরেকটি কথাও বাংলাদেশে খুব শোনা যায় । বিশেষ করে উড়নচণ্ডী ছেলের উন্মাদনা যখন অসহীয় পর্যায়ে চলে যায়, তখন প্রায়ই অন্য অভিভাবকেরা ভাগ্য বিরম্বিত পিতাকে উপদেশ দেন – ‘পোলার বিয়া দিয়া দাও – মাথা ঠাণ্ডা হইবো’। সবক্ষেত্রে যে উপদেশ কাজ করে তা নয়, বরং অনেক সময় অযাচিতভাবে আরেকটি নিরীহ মেয়ের জীবন নষ্ট করা হয়। গ্রামের দিকে অশিক্ষিত জনগোষ্ঠির মধ্যে এই ‘পাগল চিকিৎসার’ দাওয়াই হিসেবে পাগলের বিয়ে দেয়াটা খুবই জনপ্রিয়। ছোটবেলায় শুনেছিলাম, আমাদের গ্রামের ‘দীনু পাগলা’ নামে বদ্ধ উন্মাদকে একবার জোর করে মমতাজ বেগমের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তারপর দেখা গেল পাগলামি তো কমেইনি, বরং বউয়ের জীবনও দীনু পাগলা অতীষ্ট করে তুলেছে। শেষ মেষ শুনেছিলাম দীনুকে গাছের সাথে বেঁধে রেখে নাকি ‘পাগলের বউ’ মমতাজ বেগম কাজের সন্ধানে বের হত।

কিন্তু কথা হচ্ছে মেয়ের জীবন নষ্ট করা সংক্রান্ত এই ক্ষতিকর ব্যাপারগুলো জানা সত্ত্বেও কেন অভিভাবকেরা অনেক সময়ই ছেলের পাগলামি সারানোর জন্য বিয়ের দাওয়াই বাৎলে দেন? কারণ হচ্ছে কিছু ক্ষেত্রে তারা লক্ষ্য করেছেন আসলেই বিয়ে দিলে ছেলের ‘মাথা ঠাণ্ডা হয়’ (অবশ্য দীনু পাগলার মতো বদ্ধ উন্মাদ – যাদের পাগলা গারদে রেখে চিকিৎসা প্রয়োজন, তাদের কথা এখানে বলা হচ্ছে না)! একটি উদাহরণ দেয়ার লোভ সামলাতে পারছি না। মুক্তমনায় জাহেদ আহমদ নামে আমাদের এক বন্ধু লেখালিখি করতেন, শুধু লেখালিখি নয়- এক সময় আমাদের সাইটে ছিলেন খুবই সক্রিয়, মুক্তচিন্তা এবং মানবতার প্রসারে ছিলেন অন্তপ্রাণ। গত বছর জোর করে বড়ভাই তার ‘পাগলামি সারানোর’ জন্য বিয়ে দিয়ে দিলেন। তারপর থেকেই জাহেদ দেখি উধাও! ঘর সংসার করে নিপাট ভাল মানুষ হয়ে গেছেন। হয়েছেন স্ত্রীর অনুগতভাজন আদর্শ স্বামী। চাকরি-বাকরি, ঘর সংসার, সপ্তাহান্তে বউকে নিয়ে মল-এ ঘরাঘুরি, কিংবা নির্জনে কোথাও একটু বেরিয়ে আসা। মুক্তচিন্তা আর মানবতাভিত্তিক সমাজ গড়ার ‘পাগলামি’ মাথা থেকে বিদায় হয়েছে তা বলাই বাহুল্য।

আসলে বিয়ের পরে ‘জাহিদ পাগলা’র মত কারো কারো মাথা ঠাণ্ডা হবার ব্যাপারটি কিন্তু বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোন থেকে সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। আগেই আভাস দেয়া হয়েছে যে, পুরেষেরা তাদের অর্থ, প্রতিপত্তি, সম্মান, প্রতিভা সহ অনেক কিছুই বিনিয়োগ করে মূলতঃ নারীকে আকর্ষণের কাজে। পরুষদের অপরাধপ্রবণতা কিংবা তাদের পাগলামিকেও সেই দৃষ্টিকোন থেকেই দেখতে হবে। বহুক্ষেত্রেই দেখা গেছে বিয়ের পরে পুরুষেরা আগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত হয় না। এমনকি দাগী অপরাধীদেরও অপ্রাধপ্রবণতা কমে আসে বিয়ের পরে, বহুক্ষেত্রে অপরাধজগৎ থেকে অবসর নেয় বহু অপরাধী[19]। এর কারণ হচ্ছে, বিয়ের পর নারীকে আকর্ষণের সেই প্রবৃত্তিগত তাড়না সে আর সেভাবে অনুভব করে না, স্বাভাবিকভাবেই এ ধরণের চাহিদা অনেক কমে আসে। ফলে বিবাহিত পুরুষদের অনেকেই ঝুঁকিপূর্ন কাজ একেবারে বাদই দিয়ে দেয়; ফলে প্রতিভার স্ফুরণ হোক, অপরাধ প্রবণতা হোক, কিংবা হোক কোন নির্দোষ পাগলামি – সবই কমে আসে। সেটাকেই বোধ হয় ‘পাগলা মাথা’কে ‘ঠাণ্ডা করে’ বলে ধরে নেয়া হয়, আর কিছু নয়। গাড়ির ইনসুরেন্স সংক্রান্ত বেশ কিছু জরিপে দেখা গেছে যে, বিবাহিত চালকেরা অবিবাহিত চালকদের চেয়ে অনেক কম দূর্ঘটনায় পতিত হয়। বলাই বাহুল্য, বিবাহিত ড্রাইভাররা অবিবাহিতদের চেয়ে অনেক কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং আগ্রাসী ড্রাইভিং করে বলেই তারা তুলনামূলকভাবে কম দুর্ঘটনার শিকার হয়।

পুরুষ মানুষ দুই প্রকারের – জীবিত আর বিবাহিত

নচিকেতার একটা গান আছে –

জনতা জনার্দন শুনে হবেন বড় প্রীত
পুরুষ মানুষ দু’প্রকারের, জীবিত ও বিবাহিত।
পুরুষ মানুষ বেঁচে থাকে বিয়ে করার আগে গো
বিবাহিত মানে প্রকারন্তরেতে মৃত –
পুরুষ মানুষ দু’প্রকারের, জীবিত ও বিবাহিত।

বিবাহিত মানে যে প্রকারন্তরে মৃত -উপরে আমাদের বন্ধু জাহেদের ঘটনাটি এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জাহেদ বিয়ের পর লেখালিখি একদমই ছেড়ে দিয়েছে, হয়ে উঠেছে ঘোর সংসারী। লেখক লেখা ছেড়ে দিলে তো এক অর্থে প্রতিভার সমাপ্তি, আর সমাপ্তি মানেই প্রকারান্তরে মৃত, কী বলেন! তবে সবাই যে বিয়ে করে জাহেদের মত মৃত হয় তা নয় অবশ্য, আমার মত ‘অর্ধ্মৃত’ হয়েও বেঁচে থাকে অনেকে!

আসলে যে কারণে বিয়ের পর ‘পাগল ছাগলদের মাথা ঠাণ্ডা হয়’, ঠিক একই কারণে প্রতিভার স্ফুরণও ধীরে ধীরে লোপ পেতে থাকে। এটাকে হাল্কা কথা বলে উড়িয়ে দিলে কিন্তু ভুল হবে। আমরা আগের একটি অংশে বিজ্ঞানীদের বয়স -প্রতিভা রেখচিত্রের (age-genius curve) সাথে পরিচিত হয়েছি। আমরা সেখানে দেখেছি যে, বয়সের সাথে সাথে বিজ্ঞানীদের প্রতিভা প্রদর্শনের হার কমতে থাকে। তবে একটি জায়গায় একটু ব্যতিক্রম পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানী যদি অবিবাহিত হন, তবে তার প্রতিভা বয়সের সাথে সাথে অন্য সবার মতোই একটু কমে আসলেও প্রতিভার ঝিলিক কম বেশি বিচ্ছুরিত হতে থাকে পুরো জীবনকাল জুড়েই। উদাহরণ চান? হাতের সামনেই একটা বিখ্যাত উদাহরণ আছে – স্যার আইজ্যাক নিউটন। চিরকুমার এই বিজ্ঞানীকে নিয়ে আমরা আগেও দু’চারটি কথা বলেছি। তার সফল এবং বিখ্যাত আবিস্কারগুলো তরুণ বয়সেই (চব্বিশ বছরের মধ্যেই) করে ফেললেও এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, তার প্রতিভা কিন্তু লোপ পায়নি। ত্রিশ বছর বয়সে রিফলেক্টিং টেলিস্কোপ আবিস্কার করেন, ৪৪ বছর বয়েসের সময় তিনি বিখ্যাত গ্রন্থ প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের জন্য রয়েল সোসাইটিতে পাঠিয়েছিলেন (সেখানেই তিনি মাধ্যাকর্ষণ সূত্র এবং তিনটি গতিসূত্রের ব্যাখ্যা প্রথমবারের মত হাজির করেছিলেন), ৬২ বছর বয়সে প্রকাশ করেন অপটিক্স। অপ্টিক্সের তৃতীয় সংস্করণ নিউটন প্রকাশ করেছিলেন ৮৪ বছর বয়সে, মৃত্যুর মাত্র এক বছর আগে। পচাশি বছর বয়সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ পুরো জীবনকাল জুড়েই নিউটন কর্মক্ষম ছিলেন – গনিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, এমনকি জীববিজ্ঞান সহ এমন কোন শাখা নেই নিউটনের পাদস্পর্শে ধন্য হয়নি। নিঊটন যে এত কর্মক্ষম একটা সময় অতিবাহিত করতে পেরেছিলেন – এর একটা কারণ অনেকেই মনে করেন – তিনি অবিবাহিত ছিলেন।; ফলে ‘প্রকারন্তরে মৃত’ হবার হাত থেকে বেঁচে গেছেন।

ব্যাপারটি কিন্তু কেবল নিউটনের ক্ষেত্রেই সত্য বলে ভাবলে ভুল হবে। গবেষকেরা দেখেছেন যে, অন্ততঃ শতকরা পঞ্চাশভাগ (৫০%) ক্ষেত্রে অবিবাহিত বিজ্ঞানীরা তাদের সবচেয়ে বড় আবিস্কারগুলো যেমন জীবনের প্রাথমিক সময়ে (বিশ বছর বয়সের দিকে) করেন, ঠিক তেমনি পুনর্বার সেরকম কিছু করে দেখাতে পারেন যখন বয়স পঞ্চাশ পেরোয়, কিন্তু বিবাহিত বিজ্ঞানীদের মধ্যে সে ধরণের সফলতার হার শতকরা মাত্র ৪.২ ভাগ[20]। নীচে গবেষণাপত্র থেকে বিবাহিত এবং অবিবাহিত বিজ্ঞানীদের সফলতার একটা তুলনামূলক চিত্র দেয়া হল –

married_unmarried_scientists

ছবি- বিবাহিত এবং অবিবাহিত বিজ্ঞানীদের প্রতিভা স্ফুরনের তুলনামূলক রেখচিত্র।

গ্রাফগুলোর ট্রেণ্ড দেখলে সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন যে, বিবাহিত বিজ্ঞানীরা আসলে ‘প্রকারন্তরে মৃত’! তারপরেও আমার কথা বিশ্বাস না হলে পড়ুন এই  ইংরেজী লেখাটি –

Scientists Discover Married Scientists Are Not As Productive As Single Ones

অবশ্য এ ধরণের ট্রেণ্ডের ফলাফল যাই হোক এর কারণ নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ আছে পুরোমাত্রায়। ‘কমন সেন্স’ থেকেই বোঝা যায় যে, পেশার বাইরেও বিবাহিত বিজ্ঞানীদের বড় একটা সময় সংসার, বাচ্চা কাচ্চা মানুষ করা সহ আণুষঙ্গিক পার্থিব কাজে ব্যয় করতে হয়। আর আধুনিক বিশ্বে পুরুষদের পাশাপাশি মেয়েদেরও কিন্তু নিজস্ব ক্যারিয়ার থাকে। ফলে গৃহস্থালীর কাজগুলো প্রায়শঃই স্বামী স্ত্রীতে ভাগাভাগি করে নিতে হয়; আর এগুলো করতে গিয়ে তাদের একাডেমিক গবেষনার সময় কমে আসে। অবিবাহিত বিজ্ঞানীরা যেহেতু পুরোটা সময় এসমস্ত ঝুট ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকেন সেহেতু তারা গবেষণায় প্রতিভা স্ফুরণের সুযোগ এবং সময় পান বেশি। কাজেই প্রতিভা লোপের ব্যাপারটা কতটা জৈবিক আর কতটা সামাজিক – তা নিয়ে সন্দেহ করার অবকাশ আছে। তারপরেও বিবর্তনীয় মনোবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণারর কিছু গবেষক দেখিয়েছেন যে, সত্তুরের দশকে কিংবা তার আগে মেয়েদের খুব একটা ‘নিজস্ব ক্যারিয়ার’ ছিলো না। সে সময় গৃহস্থালীর কাজগুলো মূলতঃ মেয়েরাই করতো। ফলে বিবাহিত পুরুষ বিজ্ঞানীদের তেমন একটা বাচ্চা কাচ্চা ঘর সংসার নিয়ে মাথা ঘামাতে হতো না। কিন্তু তারপরেও বিবাহিত বিজ্ঞানীদের প্রতিভার স্ফুরণে কোন উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন পাওয়া যায়নি। ভিক্টোরীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ হোক, আর আধুনিক জেণ্ডার সচেতন সমাজ হোক, ট্রেণ্ড একটাই – বিয়ের পর একইভাবে প্রতিভার স্ফুরণ কমে আসে একই ধারায়।

ধারার যে দু’একটি ব্যতিক্রম থাকে না তা নয়। আমাদের প্রিয় মইনুল রাজু নিঃসন্দেহে ব্যতিক্রম হিসেবে থেকে যাবেন। বিয়ের পরেও তিনি আগের মতো লিখে যেতে পারছেন, সেটাই ভরসা (যদিও দুর্মুখেরা বলবেন, তিনি তার স্ত্রীর থেকে বহুদূরে আছেন, সেটাই তার সফলতার কারণ; যে সামান্য কটি দিন একসাথে ছিলেন, প্রকারান্তরে মৃতই ছিলেন – একটিও লেখা বের হয়নি তার পেট থেকে)। তবু সেই ভরসাটুকুই বেঁচে থাক। আমাদের যেন রাজুকে দেখিয়ে বলতে না হয় – ‘আহা, ছেলেটা বড় ভাল ছেলে ছিল, কী অল্প বয়সেই …’

——————————————————————————–

তথ্যসূত্র :

[1] Alfred Blumstein, Youth Violence, Guns, And The Illicit-Drug Industry, Journal of Criminal Law and Criminology (Northwestern), Guns and Violence Symposium, vol 86, no. 1, 1995:10

[2] John M. MacDonald, The Murderer and His Victim, Charles C. Thomas, Publisher Ltd, 1986

[3] David Lester, Questions and Answers about Murder, Charles Press Pubs, 1991

[4] David M. Buss, The Murderer Next Door, পূর্বোক্ত, পৃঃ ২৩।

[5] Travis Hirschi and Michael Gottfredson, Age and the Explanation of Crime, American Journal of Sociology, v89 n3 p552-84 Nov 1983

[6] Alfred Blumstein, পূর্বোক্ত।

[7] Margo Wilson and Martin Daly, পূর্বোক্ত।

[8] অভিজিৎ রায়, আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী, অঙ্কুর প্রকাশনী, ২০০৫ (পরিবর্ধিত সংস্করণ ২০০৬)

[9] A person who has not made his great contribution to science before the age of thirty will never do so. – Albert Einstein (Brodetsky, 1942, p. 699)

[10] Mukerjee, M. Explaining everything. Scientific American, 274, 88–94, 1996.

[11] W. Poundstone, Prisoner’s dilemma. New York: Anchor, 1992, p 16.

[12] H. C. Lehman, Age and achievement . Princeton: Princeton University Press, 1953.

[13] S. Cole, Age and scientific performance. American Journal of Sociology, 84, 958–977, 1979.

[14] S. G. Levin, & , P. E. Stephan, Research productivity over the life cycle: Evidence for academic

scientists. American Economic Review, 81, 114–132, 1991.

[15] Satoshi Kanazawa, Why productivity fades with age: The crime–genius connection, Journal of Research in Personality 37, 257–272, 2003

[16] গবেষক ডেভিড গ্যালেনসনের মতে পদার্থবিজ্ঞান এবং গনিতের তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে যারা গবেষনা করেন তারা মুলতঃ ‘কনসেপচুয়াল ইনোভেটর’ (Conceptual innovators), আর শিল্প সাহিত্য নিয়ে সৃষ্টির খেলা যারা খেলেন তারা ‘এক্সপেরিমেন্টাল ইনোভেটর’ (experimental innovators)। তিনি তার গবেষণায় দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে, ‘কনসেপচুয়াল ইনোভেটর’রা তাদের জীবনের প্রাথমিক সময়ে বা তরুণ বয়সেই সবচেয়ে বেশি প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটান, আর অপরদিকে ‘এক্সপেরিমেন্টাল ইনোভেটর’রা ঘটান জীবনের মধ্যবয়সে বা শেষদিকে।

[17] Alan S. Miller and Satoshi Kanazawa, Why Beautiful People Have More Daughters: From Dating, Shopping, and Praying to Going to War and Becoming a Billionaire– Two Evolutionary Psychologists Explain Why We Do What We Do, Perigee Trade; Reprint edition, 2008

[18] প্রদীপ দেব, প্রেমিক আইনস্টাইন, মুক্তমনা

[19] Criminologists have long known that criminals tend to “settle down” and desist (stop committing crime) once they get married, while unmarried criminals continue their criminal careers.

[20] Satoshi Kanazawa, Why productivity fades with age: The crime–genius connection, Journal of Research in Personality 37, 257–272, 2003