রনিনের বাংলাদেশ (১)

দু’হাতে দুই হাঁটু শক্ত করে চেপে ধরে,খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁপাতে থাকে রনিন।ভারী বোঝাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে একটু একটু করে,পায়ের থাবায় হরিণীকে ধরে রেখে ক্লান্ত-বিজয়ী চিতা যেমন করে হাঁপাতে থাকে,ঠিক তেমন করে হাঁপাতে থাকে সে।যে দিকে দু’চোখ যায়,শুধু উঁচু নিচু পর্বতের সারি।বিকেলের নিষ্প্রভ সূর্যের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে যায় রনিন;সবচেয়ে উঁচু পর্বতের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সে।ঠিক এই মুহূর্তে,পৃথিবীর একটি প্রাণীও তার থেকে উঁচুতে দাঁড়িয়ে নেই।কিছুক্ষণ দম নিয়ে ‘মাউন্ট রাধানাথ’এর সর্বোচ্চ বিন্দুতে এবার সটান হয়ে দাঁড়ায় সে।তারপর দু’হাত উপরে তুলে দিয়ে নিজের মনেই হাসতে থাকে,শব্দ করে হাসতে থাকে,পার্বত্য উপত্যকার নির্জনতা চুরমার করে ভেঙ্গে দিয়ে।

সে এসেছে প্রতিনিধি হয়ে,এক রুগ্ন জনগোষ্ঠির প্রতিনিধি।জীবনকে যেখানে কেউ সন্মান করে না,অথচ পূজো করে মৃত্যুকে।জীবনের কথা বললে যেখানে মূল্য নেই,করুণ মৃত্যু যেখানে দারুণ অমূল্য।মরে গেলে কিংবা মরতে গেলে সেখানে সন্মানের অভাব হয় না। অদ্ভুত এক জাতির মধ্য থেকে উঠে এসেছে সে,উঠে এসেছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখরে। হুজুগে সেই জাতি।মনের দিক থেকে সমস্ত মানুষই সেখানে ‘গণি মিয়া’।তাদের নিজের জমি নেই,অন্যের জমি চাষ করে;তারা নিজে নাচে না,অন্যরা তাদের নাচায়; তারা নিজে বলে না,অন্যরা তাদের বলায়;তারা নিজে বুঝেতে চায় না,অন্যরা তাদের বুঝায়।হুজুগে সে-জাতির হুজুগ আবার এমনি এমনি উঠানো যায় না;মাধ্যম লাগে, মিডিয়া লাগে,লাগে একটা পত্রিকা।কেউ একজন হুজুগের চাবি ঘুরিয়ে দিতে হয়। তারপর সব কিছু স্টার্ট নেয়।স্টার্ট নেয়ার সাথে সাথে কেঁপে উঠে।কেঁপে উঠে স্কুল, কেঁপে উঠে কলেজ,কেঁপে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়,কেঁপে উঠে মাদ্রাসা,কেঁপে উঠে পতিতালয়।এরপর অন্য চাবিগুলোও ঘুরে উঠে তালে তালে,হুজুগে হুজুগে।তারাও কাঁপিয়ে দেয়।কাঁপিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়,কাঁপিয়ে দেয় সংবাদ শিরোনাম,কাঁপিয়ে দেয় এফএম রেডিও,কাঁপিয়ে দেয় চৌরাস্তার মোড়।

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে খানিকটা দুঃখ প্রকাশ করে রনিন। চূড়া থেকে নিচে নামতে পারলে তাকে নিয়ে যে মাতামাতিটা হবে,সেটা ভেবে দুঃখ হয় তার।সপ্তাহের পর সপ্তাহ পত্রিকার পাতা সে ভরিয়ে তুলবে,চ্যানেলের পর চ্যানেল মাতিয়ে তুলবে। কিন্তু কেন? নিজের মনেই আবার উত্তর খুঁজে পায়।সমস্ত জাতিই তাকে সন্মান জানাবে,কারণ সে জীবনকে বাজী রেখেছিলো।আবারো সে টের পায়,মরে গেলে কিংবা মরতে গেলেই কেবল সে-জাতি সন্মান করবে। সে-দেশে মৃত মুক্তিযোদ্ধারা বীরশ্রেষ্ঠ,জীবত মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষুক। সে-দেশে জীবিত লেখকেরা ছোটলোক আর মৃত লেখকেরা সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্র।সে-দেশে প্রথাবিরোধীদের কেটে ফেলা হয়,ক্ষত-বিক্ষত করে ফেলা হয়।সবাই কাটতে দেয়,কাটা পর্যন্ত চেয়ে চেয়ে দেখে,অপেক্ষা করে।কাটা হয়ে গেলে,মরে গেলে কিংবা মরতে গেলে তারপর সে-জাতি তাঁর জন্য বামরুংগ্রাদে ভিক্ষা পাঠায়।

একটাই জীবন;সুন্দর,অপূর্ব সেই জীবন।আমি যখন জীবনকে ভালোবাসবো,কেউ আমাকে ভালবাসবে না।আমি যখন জীবনকে যত্ন করবো,কেউ আমাকে যত্ন করবে না। অথচ সে-জীবনকে যখন আমি ঝুঁকির ভেতর দিয়ে নিয়ে যাব,সবাই আমার পিঠে হাত বুলিয়ে দেবে।আমার জীবন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গেলে সবাই এত খুশি হবে, কেন? ভাবতে ভাবতে কিছুটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ে রনিন।

‘মাউন্ট রাধানাথ’ এর চূড়ায় দাঁড়িয়ে,দূর থেকে সে তাকিয়ে দেখতে চেষ্টা করে তার নিজের দেশকে,দেখা যায় না।তবু সে হাত নাড়িয়ে যায়,মনে মনে বলে,অপেক্ষা কর দেশ,আমি ফিরে আসছি।আর সাথে সাথে ভাবতে থাকে,কেন একসঙ্গে এতগুলো মানুষ ধ্বংসের পূজারী।কর্তব্যরত সৎ পুলিশ অফিসার পুরস্কৃত হয় না,অথচ গুলিবিদ্ধ হলেই পুরস্কৃত হয় অসৎ পুলিশ অফিসারও।গুলিবিদ্ধ হবার পর তার জীবন বিপণ্ণ হতে চলে, তাই বলেই কি খুশি হয়ে তাকে পুরস্কৃত করা হয়? ধর্ষণের ভয়ে আতঙ্কিত কলেজ ছাত্রীর দিকে কারো নজর নেই, ধর্ষিত হবার পর তাকে নিয়ে হয় সংবাদ সন্মেলন।কেন? তার জীবন বিপণ্ণ হতে চলে,তাই তার এত সমাদর।শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত গাড়ীতে চড়ে কোন সুখ নেই,যতক্ষণ পর্যন্ত না দেখা যায় গরমে ঘামে ভিজে ভিজে মিনিবাসে ঝুলে চড়ছে আরেকজন,বিপণ্ণ তার সুখ,বিপণ্ণ জীবন।

এই দূর্ভাগা জাতির দূর্ভাগ্যের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়ে এবার নামতে শুরু করবে রনিন। এখনও অনেক পথ।তারপর দেশের পথে।তারওপরে দুঃখের বোঝা কাঁধে করে ঘুরে বেড়াবে রনিন।ঘুরে বেড়াবে পত্রিকার পাতায়,চ্যানেলে চ্যানেলে।রনিন জানে, জীবনের কথা বলে সেখানে সুখ নেই, কেউ শুনবে না সে-কথা।সেখানে বলতে হবে মৃত্যুর কথা।রনিন জানে, সবার আগে তাকে উত্তর দিতে হবে,কোথায় কোথায় মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিলো-সে প্রশ্নের।এ-জাতি মৃত্যুকে বড় ভালোবাসে, এ-জাতি বিপণ্ণ জীবন দেখতে বড় ভালোবাসে- তবে নিজের নয়,অন্যের।

[email protected]
september 12, 2010