ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮] [০৯] [১০][১১][১২][১৩][১৪][১৫][১৬][১৭][১৮][১৯][২০]

২১
০২ আগস্ট ১৯৯৮ রবিবার

মেলবোর্নে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় নাকি তিনটি জিনিস সাথে রাখতে হয়- ছাতা, জ্যাকেট আর খুচরো পয়সা। যখন তখন বৃষ্টি হতে পারে- তাই ছাতা, প্রচন্ড গরমের সময়েও তাপমাত্রা হঠাৎ দশ ডিগ্রি নেমে যেতে পারে তাই জ্যাকেট। আর খুচরো পয়সা- নানাবিধ প্রয়োজনেঃ গাড়ি পার্ক করতে গেলে, পাবলিক ফোন ব্যবহার করতে হলে, ট্রামের টিকেট করতে হলে, ভেন্ডিং মেশিন থেকে কিছু কিনতে হলে ইত্যাদি ইত্যাদি। আজ আমার সাথে ছাতা, জ্যাকেট, খুচরো পয়সা সব ছিল। তারপরও ভিজে চুপসে বাসায় ফিরেছি একটু আগে- রাত সাড়ে বারোটায়।

কাল রাতে চিঠি লিখতে লিখতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আলী সাহেব দেশে যাবার সময় চিঠিগুলো নিয়ে যাবেন। এই সুযোগে বন্ধু-বান্ধবদের সবাইকে লিখে জানানো যে এদেশে কত ভালো আছি আমি। সকালে ঘুম ভেঙেছে অনেক দেরিতে। দরজায় ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দটা না হলে আরো কতক্ষণ ঘুমাতাম জানি না। ভেতর থেকে বন্ধ করার জন্য কোন ছিটকিনি নেই দরজায়। জানি না এদেশের এটাই নিয়ম কী না। আমি ঘুমানোর সময় চেয়ার দুটো টেনে নিয়ে দরজায় লাগিয়ে রাখি। অন্তঃত একদম নিঃশব্দে কেউ ঢুকতে পারবে না।

দরজা খুললাম। দরজার সামনে ডেভিড। কাল রাতে জোয়ানাকে সাথে নিয়ে বিয়ারের বোতল হাতে ডেভিড এসেছিলো আমার রুমে। এটা-ওটা গল্প করে গেছে। আমাকে একটা টেবিল দিতে চেয়েছে, দরকার নেই বলে নিতে রাজী হইনি। জোয়ানা আর ডেভিডকে ক্রমশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। বুঝতে পারছি অস্ট্রেলিয়ানরা আসলেই বেশ ফ্রেন্ডলি। আরো অনেকক্ষণ হয়তো আড্ডা মারতো- কিন্তু ফিল এসে জোরে ধমক লাগায় ডেভিডকে। বলে- “লিভ হিম এলোন ডেরেল”। ডেভিডের ডাকনাম তাহলে ডেরেল। বাপের বকুনি খেয়ে দ্রুত চলে যাবার সময় কি কিছু ফেলে গেছে আমার রুমে?

“গুড মর্নিং প্রাডিব”
“মর্নিং ডেভিড”
প্রশ্নবোধক চোখে তার দিকে তাকাতেই সে বললো- “বাবা বলেছে ঘরভাড়ার টাকাটা দিতে”
প্রতি দু’সপ্তাহের ভাড়া নগদ অগ্রিম দেবার কথা আছে। ২০ তারিখ এসেছিলাম, আজ দু’সপ্তাহ পূর্ণ হচ্ছে।
“জাস্ট এ মিনিট” বলে ওয়ালেট খুলে দুটো পঞ্চাশ ডলারের নোট তুলে দিলাম ডেভিডের হাতে।
“থ্যাংক্‌স। বাবা পরে তোমার রসিদ দিয়ে দেবেন”
“ও-কে ডেভিড”।

এগারোটা বেজে গেলো ঘর থেকে বের হতে। শীতের আকাশ যথারীতি মেঘলা। আমার প্রিয় ঋতু শীত, অথচ মেলবোর্নের শীতকাল অসহ্য লাগছে। সারাদিন যখন তখন বৃষ্টি ভালো লাগে? ইউনাইটেড চার্চের সামনে বেশ ভীড়। প্রতি রবিবার এখানে ফ্রি খাবার দেয়া হয়। লম্বা লাইনে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁদের জামাকাপড় দেখে ঠিক গরীব বলে মনে হচ্ছে না।

হাঁটতে হাঁটতে শহরের অলিগলি পেরিয়ে ইয়ারার তীরে। ব্রিজের নিচে রবিবারের খোলাবাজার আমাকে টানছে। কত রকম মানুষ আর কত রকমের জিনিস-পত্র। হাঁটতে হাঁটতে দেখতে দেখতে কেটে গেল সারা দুপুর। আর্ট-সেন্টারের সামনে বিশাল ঘোড়াটার কাছে জাদু দেখাচ্ছে একজন জাদুকর। যতটা কারসাজি তার চেয়ে বেশি চিৎকার চেঁচামেচি। এই ঠান্ডায়ও অসংখ্য মানুষ চলে এসেছে তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে। সারা সপ্তাহ চরম ব্যস্ত থাকতে হয় বলেই সপ্তাহান্তের ছুটিতে এত আনন্দ।

দুটোর দিকে চলে এলাম ইউনিভার্সিটিতে। আরো কিছু চিঠি লেখা বাকি ছিল। লিখতে লিখতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। তারপর কম্পিউটার খুলে বসলাম। একটু পর পর ‘মেইল’ কমান্ড দিই- আর সাথে সাথে স্ক্রিনে রেসপন্স আসে- ‘ইউ হ্যাভ নো নিউ মেইল’।

অবশেষে সোয়া ন’টার দিকে টেলিফোন বেজে উঠলো। তড়িঘড়ি করে ফোন ধরলাম। ওপ্রান্তে অজিত।
“খবর বল আগে”
“স্টার, ছয়টি লেটার”
“এতক্ষণ দেরি করলি!”
“রেজাল্ট দিয়েছে চারটার পর। দিদিভাই রেজাল্ট নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে আমাকে জানিয়েছে একটু আগে”
“আমি ভেবেছিলাম ই-মেইল করবি। ফোনে তো নাও পেতে পারতি”
“আমি জানি যে তুই ভাগ্নির খবরের জন্য বসে থাকবি”

দিঠুন আজ এস-এস-সি পাস করে ফেললো। এই আনন্দ আমাকে এখানে একা একা সহ্য করতে হবে। কষ্ট একাকী সহ্য করা যায়। কিন্তু শেয়ার করতে না পারলে আনন্দও কেমন যেন কষ্টকর হয়ে ওঠে। দিদিভাইর বাসায় ফোন করা দরকার, দিঠুনকে অভিনন্দন জানাতে হবে।

সাড়ে ন’টার দিকে ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরোলাম ফোন-কার্ডের খোঁজে। কিন্তু আমি ভুলেই গিয়েছিলাম যে রোববারের মেলবোর্ন শহর বিকেল পাঁচটার পরেই মরে যায়। টেলেস্ট্রা ফোন-ওয়ে কার্ড খুঁজতে খুজঁতে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত গিয়েও কোন কাজ হলো না। সেভেন ইলেভেন স্টোর গুলো 24/7 অর্থাৎ সপ্তাহের সাতদিনই চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে। ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে ফ্লিন্ডার স্ট্রিট পর্যন্ত চার-পাঁচটা সেভেন-ইলেভেনে ঢু মারলাম। কারো কাছেই টেলেস্ট্রা ফোন-ওয়ে কার্ড নেই। ট্রেলেস্ট্রা কার্ড যেগুলো আছে সেগুলো লোকাল অন্তঃরাজ্যে ফোন করার জন্য। ইন্টারন্যাশনাল অন্যান্য যে কার্ডগুলো আছে সেগুলো কেনার সাহস পেলাম না। কারণ এরকম একটা কার্ড যে নাকানি-চুবানি খাইয়েছে তা এখনো ভুলিনি।

মাথার ওপর রেয়াজুদ্দিন বাজারের ছাতা থাকা সত্ত্বেও প্রায় পুরোপুরি ভিজে লাইগন স্ট্রিটে এসে ঢুকে পড়লাম একটা পাবলিক ফোন বুথে। কয়েন আছে মাত্র তিন ডলারের। মাত্র দু’মিনিট কথা বলতে না বলতেই শেষ। ছয়টি লেটার পেয়েও আমার কন্যাটি খুশি নয়, সামাজিক-বিজ্ঞানে পায়নি বলে আফসোস করছে। আর আমি আফসোস করছি এ মুহূর্তে আমার আরো অনেক কয়েন নেই বলে।

০৩ আগস্ট ১৯৯৮ সোমবার

সকাল সাতটায় উঠবো বলে এলার্ম দিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু এলার্ম বাজার আগেই উঠতে হলো। এমন কর্কশ ভাবে দরজা নক্‌ করে কেউ? বিরক্ত হয়ে দরজা খুলে দেখি- হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন ফিল। হাতে একটা রসিদ। কাল ডেভিড বলেছিলো যে ফিল ঘরভাড়ার রসিদ দিয়ে দেবে। কিন্তু সেটার জন্য এত সকালে ঘুম ভাঙিয়ে দেবার কোন দরকার ছিল?

“গুড মর্নিং প্রাডিব”
“মর্নিং ফিল। হোয়াট হ্যাপেন?”
“আজ ঘরভাড়া দেবার দিন, মনে নেই?”
“কী বলছেন! ঘরভাড়া! কাল সকালেই তো ডেভিড এসে নিয়ে গেলো। আপনাকে বলেনি?”
“ডেভিড? ডেভিডকে কেন ভাড়া দেবে তুমি? এটা কি ডেভিডের ফ্ল্যাট?”
“না, আপনার ফ্ল্যাট। ডেভিড আপনার ছেলে। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করুন আমার কাছ থেকে একশ’ ডলার নিয়ে গেছে কি না”
“ডেভিডকে জিজ্ঞেস করবো? এসো আমার সঙ্গে”

ফিলের পেছন পেছন গেলাম বাথরুমের পাশে ডেভিডের রুমের দিকে। নক না করেই সশব্দে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন ফিল। “এসো দেখো, কোথায় ডেভিড?”

ঘর ফাঁকা। কোথাও কেউ নেই। ঘরের মাঝখানে একটা খালি বিছানা, এক কোণায় একটা খালি টেবিল আর দুটো চেয়ার। ডেভিড বা জোয়ানার চিহ্নও নেই কোথাও। এত বড় প্রতারণা করলো সে আমার সাথে? মাত্র একশ’ ডলারের জন্য এমন মিথ্যে কথা বললো? ঘর ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাবার প্ল্যান নিশ্চয় অনেক দিন আগে থেকেই ছিল তাদের। যাবার আগে ছোট্ট একটা দাও মেরে গেল।

বোকামী যা হবার হয়ে গেছে। ফিলের সাথে কথা বাড়িয়ে ওটা আর বাড়ানোর কোন মানে হয় না। চুপচাপ একশ’ ডলার তুলে দিলাম ফিলের হাতে। তিনি রসিদ লিখেই এনেছিলেন।

দিনটা বড় বিশ্রীভাবে শুরু হলো। খচখচে মন নিয়ে ডিপার্টমেন্টে এলাম। অফিসে ঢোকার সময় দেখলাম কেন্‌ একটা কোকের খালি বোতলে ফুঁ দিয়ে বাজানোর চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখে বললেন, “ট্রাইয়িং টু ফাইন্ড দি রেজোনেন্স”। ক্লাস নিতে যাবার আগে কত রকমের প্রস্তুতি যে নেন তিনি।

সাড়ে বারোটার দিকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম স্পেন্সার স্ট্রিট স্টেশনে। বিশাল স্টেশন। ইন্টার-স্টেট বাস আর ট্রেন ছাড়ে এখান থেকে। বিশাল বিশাল ‘গ্রে-হাউন্ড’ বাস- মেলবোর্ন টু সিডনি, মেলবোর্ন টু এডেলেইড, এমনকি ব্রিসবেনও। এয়ারপোর্টে যাবার ‘স্কাই-বাস’ও এখানে। অনেক লোকজন, ব্যস্ততা। কিন্তু কোথাও হৈ-চৈ চিৎকার চেঁচামেচি নেই। কিছুক্ষণ পরেই আলী সাহেব এলেন। লাগেজ সামলে আমার খামটা নিয়ে দ্রুত উঠে গেলেন স্কাই-বাসে। কালকের মধ্যেই আমার চিঠিগুলো পৌঁছে যাবে বাংলাদেশে।

০৪ আগস্ট ১৯৯৮ মঙ্গলবার

বিট্টু বলেছিল তিনটার দিকে তিন তলায় স্টুডেন্ট সেন্টারের ওখানে থাকতে। আমি আড়াইটায় চলে এসেছি। রয়েল মেলবোর্ন ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি সংক্ষেপে আর-এম-আই-টি’তে আগে আসিনি কখনো। এই ইউনিভার্সিটির বিশাল বিশাল সব বিল্ডিং মনে হচ্ছে গায়ে গায়ে লাগানো। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির সাথে আর-এম-আই-টি ইউনিভার্সিটির গুণগত পার্থক্য কী তা জানি না, তবে বস্তুগত পার্থক্য অনেক।

সোয়া তিনটার দিকে বিট্টু এলো। সাথে তার ক্লাসমেট টনি। পরিচয় হলো টনির সাথে। টনির কথ্য-ইংরেজির অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। “আই গো ইয়েস্টারডে” “হি গো টুমরো”- ক্রিয়া-পদের এমন যথেচ্ছ ব্যবহার বাংলাদেশের কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েই সোয়ান্সটন স্ট্রিট, আর তার ওপারেই মেলবোর্ন সেন্ট্রাল। চলমান সিঁড়ি বেয়ে তাদের পিছু পিছু উঠে এলাম দোতলার ফুডকোর্টে। নানা দেশের নানা রকম খাবারের সমাবেশ। টনির জন্যই ফুডকোর্টে আসা। সে নাকি লাঞ্চ করেনি। কিন্তু সে যে পরিমাণ খাবার নিলো এবং যেভাবে খাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে তিনদিনের উপোসী। বিট্টুর চোখাচোখি হতেই সে হাসিমুখে টনির উদ্দেশ্যে ইংরেজিতে বললো- “ভালো করে খেয়ে নাও টনি। একটু পরেই তো বুঝবে মজা। রবিবারের সব ডেক্‌সি-পাতিল আজ তোমাকেই মাজতে হবে”। শুনে ঠোঁট উল্টে বিশ্রী একটা গাল দিলো টনি। ইংরেজি ক্রিয়াপদ ঠিকমত শিখতে না পারলে কী হবে, গালাগালিগুলো ঠিকই শিখে নিয়েছে।

জানা গেলো টনি আর বিট্টু একই রেস্টুরেন্টে কাজ করে। কিচেন-হ্যান্ড। টনি কাজ করে মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র আর শনিবার সন্ধ্যায় আর বিট্ট কাজ করে বুধবার আর রবিবার সন্ধ্যায়। যা পায় তা নাকি টনির মদ-সিগারেট আর বিট্টুর টেলিফোনের পেছনেই চলে যায়।

বিট্টু যে রেস্টুরেন্টে কাজ করে আজ আমাকে নিয়ে যাবে সেখানে। রেস্টুরেন্টের মালিকের এক বন্ধুর রেস্টুরেন্টে লোক দরকার। আমাকে ঠিকানা দিয়ে দেবেন। শুধু ঠিকানা দেবার জন্য ডেকে নিয়ে যাবার দরকার কী? বন্ধুর কাছে পাঠাবার আগে নিজেও একবার দেখে নিতে চান হয়তো।

কাজে যাবার জন্য ট্রামে উঠে গেল টনি। বিট্টুও যাবে সেখানে আমাকে নিয়ে- তবে একটু পরে। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি কম্পিউটারের ব্যবসাও শুরু করেছে বিট্টু। কমদামে কম্পিউটার সাপ্লাই দেয় সে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় বিজ্ঞাপন-বোর্ড আছে। সেখানে পিন দিয়ে আটকে দিলো তার বিজ্ঞাপন। এরপর আমাদের ক্যাম্পাসে এসেও কিছু বিজ্ঞাপন লাগালো। মানুষের কত রকমের ব্যবসায়িক বুদ্ধি থাকে। বিট্টুর কম্পিউটার ব্যবসায় নাকি কোন মূলধনই লাগে না। কৈ-এর তেলে কৈ ভেজেই নাকি অনেক লাভ। আমার ব্যবসায়িক বুদ্ধি এবং আগ্রহ দুটোই শূন্য। সুতরাং এ ব্যাপারে আলোচনা খুব একটা এগোলো না।

সাউথ মেলবোর্ন বিচগামী ১নং ট্রামে উঠে রওনা দিলাম। ট্রাম ইয়ারা নদী পার হয়ে মেলবোর্ন আর্ট সেন্টার পর্যন্ত এসে ডানে মোড় নিলো। এদিকে আগে আসিনি কখনো। আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার সংমিশ্রণ এদিকে। ট্রামে বেশ ভীড়। অফিস শেষে অনেকেই যেমন বাড়ি ফিরছেন, তেমনি অনেকেই যাচ্ছেন সান্ধ্যকালীন খন্ডকালীন কাজে। বিট্টুকেও এই ট্রামে যাতায়াত করতে হয়।

প্রায় আধঘন্টা পর বিট্টুকে অনুসরণ করে নেমে গেলাম একটা স্টপে। শহরতলীর মত জায়গা। মূল রাস্তার দু’পাশে অনেকগুলো রেস্টুরেন্ট। রাস্তা পেরিয়ে একটা বেকারি, তারপর ফুলের দোকান, তার পাশে ডোমিনোজ পিৎজার ঠিক পাশের রেস্টুরেন্ট-ই আমাদের গন্তব্য।

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢোকার আগে হঠাৎ আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বিট্টু বললোঃ “খবরদার, ভুলেও বলবে না যে পি-এইচ-ডি করছো। জিজ্ঞেস করলে বলবে- মাস্টার্স করতে এসেছো। এখানে পি-এইচ-ডি’র কোন চাকরি নেই”

কাচের দেয়ালে লেখা “ইরাবতী কারি হাউজ” “অথেন্টিক ইন্ডিয়ান কুজিন” “B-Y-O”। কাচঘেরা সুদৃশ্য কাউন্টারে সাজানো নানারকম ইন্ডিয়ান তরকারি। ছোট ছোট স্টিকারে লেখা ‘বিফ ভিন্ডালু’, ‘রগেন জোস’- ইত্যাদি- যাদের নামও শুনিনি আগে কখনো। কাউন্টারের পেছনের দেয়ালজুড়ে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি। ভারতীয় রেস্তোরায় দেব-দেবীর ছবি না থাকলে মনে হয় ঠিক আবহ তৈরি হয় না। মৃদু যন্ত্রসঙ্গীত ভেসে আসছে কোথাও লুকোনো সাউন্ডবক্স থেকে।

কাউন্টারের পেছনে দাঁড়ানো কালো-শার্টপ্যান্ট পরা ভারতীয় মেয়েটি বিট্টুর দিকে তাকিয়ে পরিচিতের হাসি হাসলো। বড় সুন্দর সে হাসি। দশ বারোটা টেবিলের ছোট-খাট রেস্টুরেন্ট। খুব বেশি ভীড় নেই, একটা টেবিলে দু’জন মধ্য বয়সী নারী-পুরুষ গভীর মনযোগে একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। তাদের সামনে রাখা মদের পাত্র এখনো ভর্তি।

বিট্টু দ্রুত চলে গেল রেস্টুরেন্টের ভেতরের দিকে। তিন ধাপের ছোট্ট একটা সিঁড়ি আছে এদিকে। দুটো বড় বড় ফ্রিজ ভর্তি কোমল পানীয় রাখা আছে এখানে। ছোট্ট পরিসরের একটা টেবিলও আছে এক কোণায়। বিট্টুকে অনুসরণ করে এ পর্যন্ত আসার পর বিট্টু বললো, “তুমি এখানে অপেক্ষা করো। আমি মালিকের সাথে কথা বলে আসি”।

এখান থেকে রান্নাঘরের অংশবিশেষ দেখা যাচ্ছে। দুই ফুট বাই তিন ফুটের একটা কাউন্টার আছে কিচেনের এদিকের দেয়ালে। অর্ডার দেয়া খাবার রেডি হলে ওখানেই রেখে দেয়া হয়। বিট্টু ঢুকে গেলো রান্নাঘরের ভেতরে। টনিকে দেখা গেলো। সিঙ্কের ওপর বিশাল একটা ডেক্‌সির ভেতর মাথা ঢুকিয়ে সম্ভবত মাজার চেষ্টা করছে।

একটু পর বেরিয়ে এলো বিট্টু, তার পেছনে মাঝারি উচ্চতার বেশ স্বাস্থ্যবান একজন মানুষ। ঝাঁকড়া চুল, ফুটবলের মত গোল মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি, গায়ে অনেকগুলো বোতাম লাগানো এপ্রোন টাইপের একটা শার্ট- বাবুর্চির পোশাক।

“হ্যালো” বলে হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। তাঁর হাতে এখনো ময়দা লেগে আছে। বিট্টু পরিচয় করিয়ে দিলো। ইনিই ইরাবতী কারি হাউজের মালিক কাম শেফ আন্‌সু মালহোত্রা। আন্‌সুকে বেশ হাসিখুশি মানুষ বলে মনে হলো। প্রাথমিক সম্ভাষণের পরেই সরাসরি কাজের কথায় চলে এলেনঃ “সাউথ হ্যাম্পটনের ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মালিক হারিশ দেশাই-কে গিয়ে বলবে যে আমি তোমাকে পাঠিয়েছি। তার একজন লোক দরকার বলেছিল আমাকে। এখন সব নির্ভর করছে তার আর তোমার ওপর। এই নাও তার ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বার। গুড লাক”

আন্‌সুর সরাসরি কথাবার্তা ভালো লাগলো। একটু পরেই শহরমুখী ট্রামে উঠে পড়লাম। সাউথ হ্যাম্পটন কীভাবে যেতে হয় জানি না। বিট্টুও যায় নি ওদিকে কখনো। বললো “সম্ভবত স্যান্ড্রিংহাম লাইনে। ট্রেন-স্টেশন থেকে খবর নেয়া যাবে”। আজ আর সময় নেই। বিট্টুকে জিজ্ঞেস করলাম- “B-Y-O মানে কী?”
“ব্রিং ইওর অউন। আন্‌সুর তো লিকার লাইসেন্স নাই। তাই রেস্টুরেন্টে মদ বিক্রি করতে পারে না। কিন্তু কাস্টমাররা নিজেদের মদ নিজেরা নিয়ে আসে”।

ফ্লিন্ডার স্ট্রিটে এসে বিট্টু নেমে গেল। ট্রেন ধরে বাসায় যাবে। আমি নামলাম লাইগন স্ট্রিটে, কার্লটন হাউজিং এস্টেটের সামনে। ওখান থেকে একশ’ মিটার হাঁটলেই উইলির ফ্ল্যাট।

০৫ আগস্ট ১৯৯৮ বুধবার

জিনেট আসার পর থেকেই দেখছি আমাদের ৬১২নং রুমের টেলিফোনটা বড় বেশি ঘন ঘন বাজতে শুরু করেছে। বেশির ভাগ কল তার কাছেই আসে। তাই টেলিফোন সেট-টা ইদানিং তার ডেস্কেই থাকে। রুমে অন্য কেউ থাকলে আমার টেলিফোন ধরার প্রশ্নই ওঠেনা। রুমে আর কেউ না থাকলেও যখন টেলিফোন বাজে- ইচ্ছে করে ছুটে পালিয়ে যেতে। টেলিফোন-ফোবিয়ার কারণ আর কিছুই নয়- অন্য প্রান্তের দুর্বোধ্য ইংরেজি।

পিটার আর কেন্‌ ইউরোপীয় কনফারেন্সের জন্য পেপার তৈরি করছেন। পিটার বেশির ভাগ সময় কেনের অফিসেই থাকেন। ম্যান্ডিকেও দেখছি না ক’দিন থেকে। জিনেট আর ইমাজিন যতক্ষণ রুমে থাকে অনবরত কথা বলতে থাকে- যার বেশির ভাগই আমি বুঝতে পারি না।

ইমাজিন ক্লাসের জন্য বেরিয়ে যাবার পর জিনেট কিছুক্ষণ তার ডেস্কে বসে টেলিফোনে আড্ডা মারলো কারো সাথে। তারপর খট্‌ খট্‌ করে বেরিয়ে গেলো। ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠলো। দ্রুত উঠে বাইরে গিয়ে দেখলাম জিনেটকে দেখা যায় কি না। না- চলে গেছে। বাধ্য হয়ে ফোন ধরলাম। ওপ্রান্তে মহিলার কন্ঠস্বর। কাকে চাচ্ছেন ঠিক বুঝতে পারলাম না। বললাম, “সরি, শি ইজ নট হিয়ার নাউ’
“নট শি। হি- হি ইজ এ হি, পিটার ইজ এ ম্যান”

বুঝতে পারছি বেশ রেগে গেছেন মহিলা। চুল লম্বা হলেও পিটার যে একজন পুরুষ তা তো আমি জানি। ভয়ে ভয়ে বললাম, “সরি ম্যাডাম। পিটার ইজ নট হিয়ার”। ভদ্রমহিলার রাগ কমলো কি না জানি না। তবে যা বললেন তাতে বুঝলাম পিটার এলে যেন বলি যে লিজ ফোন করেছিল। কিন্তু ঠিক বুঝলাম তো? মহিলার নাম কি লিজ? নাকি কোন কিছু লিজ নেয়া অর্থে লিজ?

“হোয়াট লিজ?” প্রশ্ন করেই বুঝতে পারলাম ভুল হয়ে গেছে। মহিলার কন্ঠ আরো ঝাঁঝালো হয়ে উঠলোঃ “ইয়েস, লিজ, লিজ। মাই নেম ইজ লিজ। পিটার’স ওয়াইফ”।

লিজের রেগে যাওয়ার কারণ বুঝলাম। স্বামীকে ‘শি’ বললে স্ত্রী তো রেগে যাবেই। কিন্তু পিটার যে বিবাহিত তা তো জানতাম না। পিটারের জন্য ম্যাসেজটা লিখে আর কোন ফোন আসার আগেই চুপচাপ বেরিয়ে পড়লাম। ফার্স্ট ইয়ার ল্যাবে গিয়ে ইলেকট্রিসিটি-ম্যাগনেটিজমের এক্সপেরিমেন্টগুলো একবার দেখে আসা উচিত। কাল সকাল দশটায় আমার প্রথম ল্যাব ক্লাস।

চারটার দিকে ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে সোয়ান্সটন স্ট্রিট ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম ট্রাম লাইনে জ্যাম লেগে গেছে। লাইনের উপর বিশ-পচিঁশটা ট্রাম একটার পেছনে আরেকটা পর পর দাঁড়িয়ে আছে। কোথাও গন্ডগোল হলো নাকি? ফুটপাত ধরে হাঁটছে সবাই। মেলবোর্ন সেন্ট্রালের কাছে এসে দেখলাম নীল পোশাকের অনেক পুলিশ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। লা-ট্রোব স্ট্রিটে সোয়ান্সটন স্ট্রিটের ট্রামের দিক-পরিবর্তন করা হচ্ছে। স্টেট লাইব্রেরির সামনে একটা গাড়ির সংঘর্ষ হয়েছে ট্রামের সাথে। ঝকঝকে নতুন গাড়িটির সামনের অংশ ট্রামের নিচে ঢুকে গেছে। হলুদ পোশাক পরা লোকজন যন্ত্রপাতি নিয়ে গাড়িটিকে বের করার চেষ্টা করছে। এরকম একটা ঘটনা- অথচ কৌতূহলী জনতার ভীড় নেই মোটেও। সবাই যার যার গতিতে চলে যাচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে কলিন স্ট্রিটের ইনফরমেশান সেন্টারে ঢুকলাম। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ রেস্টুরেন্টের ঠিকানাটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাম কীভাবে যেতে হবে। ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশন থেকে স্যান্ড্রিংহাম লাইনের ট্রেনে উঠতে হবে। লাস্ট স্টেশনের আগের স্টেশন হ্যাম্পটন।

উপচে পড়া ভিড় ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনে। টিকেট মেশিনে কয়েন ঢুকিয়ে একটা দু’ঘন্টার টিকেট কিনলাম। স্টেশনের প্রবেশ-পথে বসানো স্বয়ংক্রিয় টিকেট-চেকারে টিকেট ঢোকাতেই দরজা খুলে গেল। গেট পেরিয়ে ওপাশ থেকে টিকেটটা নিয়ে দেখলাম টিকেটের গায়ে টিকেটের মেয়াদ প্রিন্ট করা হয়েছে- রাত আটটা পর্যন্ত। এখন সোয়া পাঁচটা। তার মানে দু’ঘন্টার টিকেটে সময়ের ভগ্নাংশ হিসেব করা হয় না।

বিশাল স্টেশন ফ্লিন্ডার স্ট্রিট। অফিস ছুটির ব্যস্ত-সময় বলেই হয়তো- প্রচন্ড ভীড় চৌদ্দটা প্লাটফর্মের সবগুলোতে। ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে ট্রেনের সময় আর প্লাটফর্ম নম্বর দেখে ছুটলাম। পরের ট্রেন পাঁচটা সাঁয়ত্রিশে পাঁচ নম্বর প্লাটফর্মে।

পাঁচটা তিরিশে ট্রেন এলো প্লাটফর্মে। এই প্রথম চড়ছি মেলবোর্নের ট্রেনে। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন সুন্দর ট্রেন। আধুনিক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম এরকমই হওয়া উচিত। ঠিক পাঁচটা সাঁয়ত্রিশে ট্রেন ছাড়লো। ট্রেনের ভেতর ডিজিটাল ডিসপ্লেতে ভেসে উঠছে পরবর্তী স্টেশনের নাম। সাথে যান্ত্রিক ঘোষণা “দি নেক্সট স্টেশান ইজ …” “উই আর এপ্রোচিং …” ইত্যাদি। রিচমন্ড স্টেশনে আসার পর কম্পার্টমেন্ট প্রায় খালি হয়ে গেলো। ট্রেনের বাইরে জমাট অন্ধকার। জানালা দিয়ে তেমন কিছু দেখা গেলো না। রেল লাইনের আশে-পাশের ছোট-ছোট টাউনশিপগুলোর সব প্রায় একই ধাঁচে তৈরি। বহুতল ভবন খুব একটা চোখে পড়ে না।

আধঘন্টার মধ্যে হ্যাম্পটন পৌঁছে গেলাম। টুপ টুপ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে আবার। ছাতা খুলতে হলো। স্টেশন থেকে বেরোবার পথে টিকেট চেক করার কোন মেশিন বা মানুষ দেখলাম না। যত প্রতিবন্ধক তাহলে শুধু সিটিতে।

শহরের বাইরের উপশহরগুলো সব একই ধাঁচে তৈরি। একটা বা দুটো প্রধান সড়ককে কেন্দ্র করে একটা সাবার্বের বাসিন্দাদের যা যা লাগে তার সবকিছুর দোকান। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস’ খুঁজে বের করতে বেশি বেগ পেতে হলো না। স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথ।

ঠিক সোয়া ছ’টায় প্লাস্টিকের দড়ির মত পর্দা ঠেলে ঢুকলাম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে। টুং-টাং করে কিসের যেন শব্দ হলো ঢোকার সময়। ইরাবতী কারি হাউজের চেয়েও আয়তনে অনেক ছোট রেস্টুরেন্ট ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। এবং কিছুটা অগোছালো বলেও মনে হলো। প্রায় একই রকমের কাচঘেরা কাউন্টারে সাজানো তরকারি। ক্যাশ-রেজিস্ট্রার, পাশে টেলিফোন আর পেছনের দেয়ালে সিদ্ধিদাতা গণেশ। এখানে আরো একটা জিনিস বেশি আছে- তা হলো একটা বড় হনুমানের ছবি। বজরং বলী’র বেশ কদর আছে ভারতের বিশেষ বিশেষ অঞ্চলে। তবে হনুমানের সাথে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার সম্পর্কটা ঠিক পরিষ্কার নয় আমার কাছে।

কাউন্টারে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কিচেনের একটা অংশ দেখা যাচ্ছে বাইরে থেকে। পাশে একটা মাঝারি আকারের তন্দুর। একজন আধ-বয়সী মহিলা লোহার লম্বা শিক হাতে তন্দুরের ভেতর থেকে রুটি বের করে আনছেন। আমাকে দেখে এগিয়ে এলেন মহিলা। তাঁর কালো এপ্রোনে সাদা ময়দার দাগ স্পষ্ট। তিনি হয়তো আমাকে কাস্টমার ভেবেছেন। বললেন, ‘গুড ইভিনিং। এনি অর্ডার?”

বেশির ভাগ ভারতীয়দের ইংরেজি উচ্চারণে অদ্ভুত একটা টান থাকে। তাঁর মধ্যে সেই টানটা প্রকট। তিনি কিছু বলার আগেই বললাম, “আমি মিস্টার হারিশ দেশাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি”।

“ওয়ান মিনিট” বলে ভেতরের দিকে চলে গেলেন তিনি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টেলিফোন বাজলো। মহিলা আবার এসে ফোন ধরলেন। লোকে টেলিফোন করে খাবারের অর্ডার দেয়। বিশ-পঁচিশ মিনিট পরে এসে দাম দিয়ে খাবার নিয়ে যায়। খুব বেশি ব্যস্ততা দেখতে পাচ্ছি না এখনো। হয়তো এখনো ডিনারের সময় হয়নি। ভদ্রমহিলা কাগজে অর্ডার লিখে ভেতরে চলে গেলেন। হারিশ দেশাইকে হয়তো খবর দেয়া হয়েছে।

মাত্র চার পাঁচটা টেবিল এই রেস্টুরেন্টে। সাদা টেবল-ক্লথের উপর সাদা-কাগজ বিছানো। খাওয়ার পর কাগজটা ফেলে দিলেই টেবিল আবার পরিষ্কার। পাঁচ মিনিট পরেও হারিশ দেশাই’র দেখা নেই। ভদ্রমহিলা রুটি বেলতে শুরু করেছেন। আমার দিকে একবারও তাকাচ্ছেন না। আরো মিনিট সাতেক পরে বেশ বড় একটা গামলা হাতে নিয়ে খর্বাকৃতি একজন মানুষ বেরিয়ে এলেন রান্নাঘরের পেছন থেকে। গামলার মধ্যে হলুদ মাখানো বড় বড় চিকেন দেখা যাচ্ছে। তন্দুরের পাশে গামলাটা রেখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “ইয়েস?”
“গুড ইভনিং স্যার। আমি মিস্টার হারিশ দেশাই’র সঙ্গে দেখা করতে এসেছি”
“ইয়েস?”

ইনিই তাহলে হারিশ দেশাই। কালো প্যান্ট আর নীল গেঞ্জি। একটু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন, মনে হচ্ছে দুটো পায়ের দৈর্ঘ্যে সামান্য অসামঞ্জস্য আছে।

“আমাকে ইরাবতী কারি হাউজের মালহোত্রা সাহেব পাঠিয়েছেন। আপনার নাকি কিচেন-হ্যান্ড দরকার?”
“হুঁ” বলেই চুপ করে গেলেন মিস্টার হারিশ দেশাই। আমাকে আর কিছুই না বলে গামলা থেকে একটা করে হলুদ চিকেন তুলছেন আর লোহার শিকে গেঁথে তন্দুরের মধ্যে ঢুকিয়ে দিচ্ছেন। আমি দাঁড়িয়ে আছি তো আছিই। টেলিফোন বাজছে, ভদ্রমহিলা টেলিফোনে অর্ডার নিচ্ছেন। দেশাই মশাই তন্দুরে চিকেন ঢুকানো শেষ করে অর্ডার অনুযায়ী খাবার তৈরি করছেন। একজন দু’জন করে কাস্টমার এসে অর্ডার দেয়া খাবার নিয়ে চলে যাচ্ছেন।

রেস্টুরেন্টের ব্যবসায় লাভের পরিমাণ যে অনেক বেশি তা চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি। আড়াইশ’ মিলিলিটারের এক কৌটো ভাতের দাম নিচ্ছে দুই ডলার। অথচ এক কেজি বাসমতি চালের দাম এক ডলার। এক কেজি চাল রান্না করলে কমপক্ষে আট কৌটো ভাত হবে। তার মানে এক ডলার বিনিয়োগ করে ষোল ডলার উপার্জন। আড়াইশ’ মিলিলিটারের এক কৌটো চিকেন কারির দাম ছয় ডলার। অথচ এক কেজি চিকেনের দাম মাত্র আড়াই ডলার।

হারিশ দেশাই কি আমার কথা একেবারেই ভুলে গেলেন? তাঁর চোখের সামনে কাউন্টারের পাশে প্রায় এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে আছি- অথচ তিনি চোখ তুলে তাকাচ্ছেনও না আমার দিকে। ভদ্রতা করে বসতেও তো বলতে পারতেন। মানুষ তো মশা-মাছিকেও এরকম উপেক্ষা করে না। চাকরি চাইতে এসেছি জেনেই কি ধরে নিয়েছেন যে আমার কোন মান-মর্যাদা নেই!

রেস্টুরেন্টে এমন কোন ব্যস্ততা নেই। টেলিফোন অর্ডারও আসছে না অনেকক্ষণ। হারিশ দেশাই ধীরে সুস্থে তন্দুরির ভেতর থেকে একটা করে লোহার শিক বের করে চিকেন চেক করছেন। টিপে-টুপে দেখে আবার ঢুকিয়ে দিচ্ছেন তন্দুরের ভেতর। তিনি কি আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছেন? একটু অধৈর্য হলেই ফেল করিয়ে দেবেন?

ঘড়ি দেখলাম। সোয়া ছ’টায় ঢুকেছি, এখন সোয়া সাতটা বেজে গেছে। আটটায় আমার টিকেট শেষ হয়ে যাবে। আটটার আগে ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনে পৌঁছাতে না পারলে স্টেশন থেকে বেরোবার জন্য আবার টিকেট কিনতে হবে। ধৈর্য শেষ। বললাম, “এক্সকিউজ মি স্যার”

যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে দেশাই সাহেব ফিরে তাকালেন আমার দিকে।
“ইয়েস? ও ইয়েস”

আবার মনযোগ দিলেন আধ-পোড়া চিকেনের দিকে। আমি বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়াতেই তিনি বললেন, “হোয়ার ইউ ফ্রম?”
“কার্লটন”
“তা জানতে চাচ্ছি না আমি। দেশ কোথায় তোমার?”
“বাংলাদেশ”
“এদেশে এসেছো কতদিন হলো?”
“আটাশ দিন”
“স্টুডেন্ট ভিসা?”
“হ্যাঁ”
“আন্‌সুর সাথে কীভাবে পরিচয়?”
“আমার বন্ধু কাজ করে সেখানে”
ভদ্রলোক কথা বলার সময় আমার দিকে তাকাচ্ছেনও না। আমার চেয়েও তন্দুরিস্থ মুরগির দাম অনেক বেশি তাঁর কাছে।

“এখানে বর্তমানে একজন ট্রায়াল দিচ্ছে। সে যদি না টিকে তবে জানাবো তোমাকে। তুমি শনিবার রবিবারের দিকে একবার ফোন করো”
এই মহার্ঘ্য কথাগুলো তিনি একঘন্টা আগেই বলতে পারতেন আমাকে।
“সো কাইন্ড অব ইউ স্যার। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ স্যার” বলে চলে এলাম। এক দৌড়ে স্টেশন। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফ্লিন্ডার স্ট্রিট অভিমুখী ট্রেন এলো।

ট্রেনের জানালায় চোখ রেখে লক্ষ্যহীন তাকিয়ে আছি বাইরের অন্ধকারের দিকে। একটু পরপর স্টেশনে ট্রেন থামছে। যাত্রী উঠানামা করছে। একটু পর হঠাৎ কানে এলোঃ “শো ইওর টিকেট প্লিজ”। চমকে তাকিয়ে দেখি হাতে একটা ধাতব পরিচয় পত্র দেখিয়ে টিকেট চেক করতে শুরু করেছেন চার জনের একটা টিম। পকেট থেকে টিকেট বের করে দিতেই টিকেটের ভ্যালিডিটি দেখে ‘থ্যাংক ইউ স্যার’ বলে ফেরত দিলেন মহিলা অফিসার।

আমার সামনের আসনে বসা দু’জন অল্পবয়সী মেয়ে এতক্ষণ উচ্চস্বরে গল্প করছিলো। তারা এখন নিম্নস্বরে অফিসারকে বোঝানোর চেষ্টা করছে কেন তাদের কাছে টিকেট নেই। বিনা টিকেটে ভ্রমণের জরিমানা একশ’ ডলার। চোখের সামনে এরকম একটা ঘটনা ঘটছে দেখে উৎসাহিত হয়ে উঠলাম।

অফিসারটি খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না তাদের কথায়। জানতে চাইলেন তাদের সাথে কোন ফটো-আইডি আছে কি না। তারা জানালো- এখনো ড্রাইভার্‌স লাইসেন্স পায়নি। অফিসারটি ইশারায় অন্য একজন অফিসারকে ডাকলেন। অন্য অফিসারটি এসে একটা ছাপানো খাতা বের করে কিছু একটা লিখতে লিখতে মেয়ে দু’জনের একজনকে ডেকে নিয়ে একটু দূরে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। মহিলা অফিসারটি মেয়েটির কাছ থেকে তার ও তার সাথের মেয়েটির বাসার ঠিকানা আর টেলিফোন নাম্বার জেনে নিলেন। মোবাইল ফোন বের করে মেয়েটির দেয়া নম্বরে ফোন করে নিশ্চিন্ত হলেন যে ঠিকানা ঠিক আছে। তারপর একটা রসিদ দিয়ে বললেন, “এটা তোমার আজকের টিকেট। মেয়াদ আজ মধ্যরাত পর্যন্ত”। অফিসারটি চলে গেলেন অন্য অফিসারের কাছে। অন্য মেয়েটি ফিরে এসে বসলো তার সঙ্গীর পাশে। তার হাতেও একটা বিকল্প-টিকেট। জরিমানার নোটিশ পৌঁছে যাবে তাদের বাড়ির ঠিকানায়।

আটটা বাজার দু’মিনিট আগে ট্রেন এসে থামলো ফ্লিন্ডার স্ট্রিট স্টেশনের প্লাটফর্মে। চলমান সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে এক্সিট গেটে টিকেট ঢোকালাম। গেট খুলল না। টিকেট বেরিয়ে এলো গায়ে “এক্সপায়ার্ড” ছাপ নিয়ে। আটটা বেজে গেছে এক মিনিট আগে। এবার? আরেকটা টিকেট কিনতে হবে? গেটের পাশে দাঁড়ানো একজন অফিসার এগিয়ে এসে আমার টিকেট দেখতে চাইলেন। টিকেট দেখিয়ে বললাম- “এক মিনিট আগে মেয়াদ চলে গেছে”। তিনি বললেন, “নট এ প্রোব্লেম। ওপাশের গেট দিয়ে চলে যান”।

হেঁটে হেঁটে রাতের মেলবোর্ন দেখতে দেখতে বাসায় ফিরতে আরো চল্লিশ মিনিট।

০৬ আগস্ট ১৯৯৮ বৃহস্পতিবার

“প্রাডিব, আই থিংক আই নিড ইওর হেল্প”
“প্রাডিব, ক্যান ইউ চেক আওয়ার সার্কিট প্লিজ”
“প্রাডিব, ইজ দিস দি রাইট রেজিস্ট্যান্স?”
শিক্ষকদের নাম ধরে ডাকাটা অনেকটা আয়ত্বে এসে গেছে এ ক’দিনে। কিন্তু ক্লাসের মধ্যে আমার শিক্ষার্থীরা যখন আমাকে আজ নাম ধরে ডাকছিল বেশ অন্যরকম লাগছিলো। সত্যি বলতে কী- বেশ ভালই লাগছিলো।

ইঞ্জিনিয়ারিং ফিজিক্সের ইলেকট্রিসিটি ল্যাব। দশটা থেকে একটা পর্যন্ত ক্লাস। আমি পৌনে দশটায় ল্যাবে চলে গেলাম। শিক্ষার্থীদের জন্য দরজা খোলা হলো ঠিক দশটায়। আমাদের বাংলাদেশের ল্যাবের সাথে এদের ল্যাবের পার্থক্য অনেক। এদের ক্লাস-সাইজ ছোট। মাত্র চৌদ্দ জনের ক্লাস। চৌদ্দ জনের জন্য সাতটা ডেস্কে সাতটা কম্পিউটার। দু’জন করে গ্রুপ করা হলো। শিক্ষার্থীরাই যার যার ল্যাব-পার্টনার বেছে নিয়ে কাজ শুরু করে দিলো। প্রতি ডেস্কেই পর্যাপ্ত পরিমাণ যন্ত্রপাতি রাখা আছে। ল্যাব ম্যানুয়েল দেখে দেখে যন্ত্রপাতি সেট করা, ডাটা সংগ্রহ করা। পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়া। ডাটা বিশ্লেষণ ও গ্রাফের জন্য এরা এক্সেল ব্যবহার করে। ক্লাসে বসেই ল্যাব রিপোর্ট তৈরি করে শিক্ষার্থীরা। ল্যাবেই প্রিন্টার আছে। ল্যাব-বুক ল্যাবেই রেখে যেতে হয়। তাদের ল্যাব-রিপোর্ট দেখে মার্ক দেয়া হয়। প্রত্যেক ল্যাবের জন্যই আলাদা আলাদা মার্ক থাকে। আমাদের মত বছর শেষে আলাদা করে প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষা দিতে হয় না। সিস্টেমটা বেশ ভাল লাগল।

আমার ভয় ছিল তাদের ঠিকমত বোঝাতে পারবো কি না, আমার ইংরেজি তারা বুঝতে পারবে কি না। অবশ্য ভয়টা কেটে গেছে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই। ঘুরে ঘুরে তাদের কাজ দেখা, প্রশ্নের উত্তর দেয়া, আটকে গেলে দেখিয়ে দেয়া। বেশ ভালো লেগেছে সব কিছুই।

একজন শিক্ষার্থীর নাম পিয়া হায়াত। চেহারা আর নাম দেখে মনে হলো বাংলাদেশী। ক্লাস শেষে ল্যাব-বুক জমা দিয়ে চলে যাবার সময় কৌতূহল সামলাতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম “তুমি কি বাংলাদেশী?” খাঁটি অস্ট্রেলিয়ান ইংরেজিতে সে যা বললো তাতে জানলাম সে বাংলাদেশে জন্মালেও বাংলা জানে না। সেই ছোটবেলায় এদেশে চলে এসেছে বাবা-মায়ের সাথে। অস্ট্রেলিয়ান আবহাওয়ায় বেড়ে ওঠা পিয়া হায়াত এখন পুরোপুরি অস্ট্রেলিয়ান।

ক্লাস শেষে স্টাফরুমের কম্পিউটারে আমার পাস-কোড দিয়ে ঢুকে ক্লাস এনট্রি করতে হলো। এটা দেখেই আমাকে বেতন দেয়া হবে। ল্যাব-বুক মার্কিং এর পর স্টুডেন্টদের গ্রেড-বুকে মার্কস এন্ট্রি করলে মার্কিং এর জন্য আলাদা বেতন।

চৌদ্দটা ল্যাব-বুক সাথে নিয়ে অফিসে এসে বিকেলের মধ্যেই মার্কিং করে ফেললাম। আর চারটার দিকে ল্যাবে গিয়ে কম্পিউটারে এন্ট্রি করে ফেললাম। আসলে অনেক দিন পর কাজ করতে শুরু করেছি তো- তাই কাজের উৎসাহটা এখন একটু বেশিই মনে হচ্ছে। জানি না এ উৎসাহ কতদিন থাকবে।

০৭ আগস্ট ১৯৯৮ শুক্রবার

ডিপার্টমেন্টে গিয়ে আজ কেমন যেন অন্যরকম লাগলো। এই প্রথম দেখলাম সকালবেলা কেনের দরজা বন্ধ। পিটারও নেই। দু’জনই এখন ইউরোপে। কেন্‌ ফিরবেন চার সপ্তাহ পর। কাল বিকেলে কেনের সাথে কথা হয়েছে অনেকক্ষণ। বলে গেছেন কোন কিছুর দরকার হলে যেন ই-মেইল করে জানাই।

দশটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে লেসের ক্লাসে যাবার জন্য বেরিয়েছি, এসময় করিডোরে লেসের সাথেই দেখা হয়ে গেলো।
“তুমি কালকের ক্লাস মিস করেছো”
“আমি ফার্স্ট ইয়ার ল্যাবে ছিলাম”
“ঠিক আছে। এই নাও কালকের লেকচার নোট”

শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের যত্ন-আত্তি একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে না এখানে? সব শিক্ষার্থীর প্রতিই কি এরকম আচরণ করেন এঁরা? নাকি কেনের ছাত্র বলে কিছুটা বিশেষ সুবিধে পাচ্ছি আমি?

সারা দুপুর-বিকেল বসে বসে ই-মেইল করলাম অনেকগুলো। কলেজের সহকর্মীদের সবাইকে লিখে রুবায়েতের ঠিকানায় পাঠিয়ে দিলাম। প্রিন্ট করতে করতে রুবায়েতের প্রিন্টারের কালি শেষ হয়ে যাবে। বেচারা রুবায়েৎ ভাববে- “কোন কুক্ষণে যে প্রদীপ স্যারকে বলেছিলাম আমার ঠিকানায় অন্যের ই-মেইল পাঠাতে!” আর আমার সহকর্মীরা? সাঈদ ভাই তো প্রায়ই বলেন, “যে যত বেশি কষ্ট দেয়, মানুষ তাকেই তত বেশি মনে রাখে”। মনে রাখার জন্য যতটুকু কষ্ট দিতে হয়- ততটুকু কষ্ট দিতে পেরেছি কি না জানি না। তাই কয়েকদিন হয়তো মনে পড়বে আমার কথা, তারপর সবাই ভুলে যাবেন।

পাঁচটার দিকে জিনেট এসে বললো, “অল ওয়ার্ক নো প্লে- নট গুড। কম্পিউটার বন্ধ করো। চলো আমার সাথে”।
“কোথায়?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“গ্র্যাজুয়েট হাউজে। কিছুটা সামাজিকও হতে হয়, বুঝলে গুড বয়?”

আমার প্রতি জিনেটের হঠাৎ এরকম আন্তরিকতার কারণ কী জানি না। তবে ভালো লাগলো খুব। তার সাথে গিয়ে হাজির হলাম গ্র্যাজুয়েট হাউজের সামাজিক আসরে। গ্র্যাজুয়েট হাউজের পেছন দিকে যে একটা বার আছে আমি তা জানতামও না। জিনেটকে অনুসরণ করে ‘গ্র্যাজুয়েট বার’-এ ঢুকে দেখি ডিপার্টমেন্টের অনেকেই সেখানে। বিয়ার মদ কোক যার যা খুশি খাচ্ছে। ক্যামেরুন পরিচয় করিয়ে দিলো তার গার্লফ্রেন্ড অ্যানের সাথে। ঝকঝকে সুন্দর হাসিখুশি অ্যান ক্যামেরুনের চেয়ে কমপক্ষে চার ইঞ্চি লম্বা।

একটু পরে ভীড়ের মধ্য থেকে সুদর্শন এক যুবক এসে জিনেটের সামনে দাঁড়ালো, আর পর মুহূর্তেই দেখা গেলো জিনেট যুবকটির ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। আমি কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে অন্য দিকে চোখ ফেরালাম। কিছুক্ষণ পর কাঁধে ঝাঁকুনি খেয়ে ফিরে তাকালাম। জিনেট বলছে, “প্রাডিব, দিস ইজ মাইকেল, মাই বয়ফ্রেন্ড। এন্ড মাইক- দিস ইজ প্রাডিব”

শক্ত হাতে আমার হাত ঝাঁকিয়ে দিলো মাইকেল। জিনেটের সাথে বেশ মানিয়েছে মাইকেল-কে। কিছুক্ষণ কথা হলো মাইকেলের সাথে। সে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এখন চাকরি করছে। বেশ ভালো লাগলো মাইকেলকে। হঠাৎ মনে হলো ব্লন্ড জিনেট আর রেড-হেড মাইকেলের সন্তানদের ব্লন্ড হবার সম্ভাবনা শতকরা কত?

বিলিয়ার্ড টেবিলের কাছে আসতেই “হাই প্রাডিব” বলে এগিয়ে এলো নিকোল। সে যে আমার নাম জানে তা আমি জানতাম না। পার্টিক্যাল থিওরির উজ্জ্বল ছাত্রী নিকোল বেল। শিক্ষাজীবনের প্রত্যেক স্তরেই স্কলারশিপ পাওয়া নিকোল যে তুখোড় বিলিয়ার্ড প্লেয়ার তা চোখের সামনেই দেখলাম। জীবনে প্রথম বিলিয়ার্ড খেললাম আজ। নিকোল আর জিনেট দেখিয়ে দিলো কীভাবে খেলতে হয়। নিয়ম-কানুনও কিছু কিছু শিখে ফেললাম। গো-হারা হেরেও আনন্দ পেলাম খুব। পৌনে আটটার দিকে সবাই বেরিয়ে চলে এলাম লেবি থিয়েটারে।

আটটায় লেবি থিয়েটারে ফিজিক্স পাবলিক লেকচার। আজকের বক্তা এসোসিয়েট প্রফেসর রে ভল্‌কাস। বিষয়ঃ “Neutrino: the Cosmic messenger of the Earth, the Sun, and the Universe.” রে ভল্‌কাস পার্টিক্যাল থিওরি গ্রুপের সবচেয়ে কম বয়সী প্রফেসর। আমাদের ফ্লোরেই ৬১৫নং রুমে তাঁর অফিস। শিক্ষার্থীদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় প্রফেসর ভল্‌কাস। নিকোল তাঁর কাছেই পি-এইচ-ডি করছে।

আজও দারুণ মুগ্ধতায় কেটে গেলো নব্বই মিনিট। প্রফেসর ভল্‌কাস কত সহজ ভাবে বুঝিয়ে দিলেন পার্টিক্যাল ফিজিক্সের কত জটিল জটিল জিনিস। প্রায় নগণ্য ভরের চার্জ-নিরপেক্ষ মৌলিক কণা নিউট্রিনো- প্রতি সেকেন্ডে কয়েক কোটি হারে আমাদের শরীরের একদিকে ঢুকে অন্যদিকে বেরিয়ে যাচ্ছে কোন ধরনের ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া ছাড়াই। ভর এতো কম এবং কোন ধরণের বৈদ্যুতিক চার্জ না থাকাতে কঠিন জটিল ফাঁদ পেতেও যাদের ধরা যায় না- সেই জটিল নিউট্রিনোর গণিত আরো জটিল। অথচ এগুলো না বুঝলে পারমাণবিক স্তরের তত্ত্বগুলো সম্পূর্ণ বোঝা যায় না। গাণিতিক বাধার কারণে পদার্থবিজ্ঞানের সৌন্দর্য অনেকের কাছেই অধরা থেকে যায়। প্রফেসর ভল্‌কাসের বক্তৃতা আজ এই অধরাকে ধরতে সাহায্য করেছে অনেকখানি। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার যে সামাজিক দায়িত্ব বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের থাকে তার কতটুকু আমরা পালন করি?

রাত এগারোটার দিকে ফোন-কার্ড সাথে নিয়ে বেরোলাম ঘর থেকে। মাসের প্রথম শুক্রবার ফোন করার দিন। আমাদের সামনের বিল্ডিং এর নিচে একটা পাবলিক ফোনবুথ আছে। সেখান থেকে ফোন করলাম দিদিভাইর বাসায়। দিদিরাও এসেছে ওখানে। দশ ডলারের কার্ডে মাত্র ছয় মিনিট। সবার সাথে ‘কেমন আছিস?’ ‘ভালো আছি’ বলতে বলতেই সময় শেষ। শুধুমাত্র ওটুকুর জন্যই আবার এক মাসের অপেক্ষা। সীমিত সামর্থ্যের মানুষ আমরা। আমাদের ইচ্ছেঘুড়ির সুতো যে কত শক্ত করে টেনে বেঁধে রাখতে হয়!

আগামী পর্বে সমাপ্য__________