একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি জীবন্ত পোস্টার মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে সাঁটানো হয়েছিল। তৎকালীন পাকিস্তানের সামরিক শাসক ইয়াহীয়ার মুখাবয়বের উপর এক হায়ওনার ছবি-যার উদ্গত সূচাগ্র দন্তপাটি থেকে ছিটকে পড়ছে রক্ত। ছবির ক্যাপশান ছিল- এ জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতীতযশা পটুয়া কামরুল হাসান সে ঐতিহাসিক পোস্টারের সে ছবি অঙ্কন করেছিলেন। সে পোস্টার সেদিন আমাদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। মানুষরূপী জানোয়ার হননের জিঘাংসায় আমরা উম্মত্ত হয়ে ওঠেছিলাম।

সেই কামরুল হাসানই তার জীবন অবসানের কয়েক মিনিট পূর্বে আরো একটি যুগান্তকারী ছবি একেঁছিলেন, যাতে ছিল তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদের মুখাবয়ব এবং সে ছবির ক্যাপশান ছিল-দেশ আজ বিশ্ব বেহায়ার খপ্পরে । একটি অনুষ্ঠানের মঞ্চে বসে এ ছবি আকাঁর কয়েক মিনিট পর তিনি মৃত্যুর হিমশীতল কোলে ঢলে পড়েন-সম্ভবত: বিশ্ব-বেহায়া কবলিত দেশ ত্যাগ করে সকল প্রকার লজ্জা থেকে নিষ্কৃতি পেতে।

বিষন্ন মনে আজ ভাবি, কামরুল হাসান বেঁচে থাকলে হয়ত তিনি এখনো একটি ছবি আঁকতেন, হয়ত যার ক্যাপশান হত-বেহায়াদের খপ্পরে আজ দেশের রাজনীতি।
ওয়ান ইলেভেন এর পর আমরা প্রতিদিন দেখেছি দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য জীবন উৎসর্গকারী আমাদের জাতীয় নেতা নেত্রীরা নিজের এবং নিজেদের আত্মীয় স্বজনের মুক্তির জন্য কি অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়ে ছিলেন। তাদের অনেকের বাগান বাড়িতে হরিণের সাথে অজগর সাপও পাওয়া গিয়েছিল। রিলিফের শীল মারা টিন, বিস্কিট, কাপড়, কি পাওয়া যায় নি তাদের বাড়ি ঘরে। হাট দখল, ঘাট দখল, ভূমি দখল, হাউর-বাউর দখল, শত শত কোটি টাকা নামে বেনামে ব্যাংকে জমা, হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার, বিদ্যুতের খাম্বা বিক্রি করে হাজার কোটি টাকা লুঠপাট। দেশের মূল্যবান গ্যাস সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়া, এ সকল অপকর্ম তারা একা করে নি, তাদের আত্মীয়-স্বজন মিলে করেছে। আজ তারা যখন গ্যাস ও বিদ্যুতের দাবীতে রাজ পথে মিছিল করে, তখন যে কোন বিবেকবান মানুষ কি লজ্জা পেতে পারে না? নিজ দলের নেতা-কর্মীদের নির্বিচারে দুর্নীত-খুন-ধর্ষণ এর মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া, পুরাতন কায়দায় দুর্নীতি ও দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখে ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্লোগান কি জাতির সাথে মশকারা নয়?

ভাবতে অবাক লাগে কিভাবে একটি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী খুনের আসামীকে বাঁচিয়ে দেওয়ার জন্য ৪০ কোটি টাকার চুক্তি করে এবং তা স্বীকার করে টাকা ফেরত দেয় এবং যে অর্থমন্ত্রীর ধমকে এনবিআর এর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা থরহরি করে কাঁপত, সে অর্থমন্ত্রী জরিমানা দিয়ে তার অবৈধ আয়কে বৈধ করে, এসব ভেবে সে দলের বাকি নেতা-নেত্রীদের কি একটু ও লজ্জা লাগে না?

দুর্নীতির মামলায় জামিন নিয়ে জেল থেকে বের হয়ে আসতে ভি চিহ্ন দেখানোর যুক্তি কি ? , ছেলে, ভাই-ভাগ্নেদের সীমাহীন দুর্নীতির সাফাই গাইতে বিবেক কি একটু কাঁপে না? এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে মামলা থেকে অব্যাহতি নেওয়া, অত:পর জনগণের মুক্তির জিগীর তুলা, এসব দেখে কামরুল হাসান, এর চেয়ে ভাল কোন ক্যাপশান কি খুঁজে পেতেন?

সর্বোপরী তিনি যদি দেখতেন, বিশ্ব বেহায়া হিসাবে যাকে তিনি খেতাব দিয়েছিলেন, আমাদের নেতা-নেত্রীদের কাছে সে স্বৈরাচারী এরশাদের কী কদর এবং পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ের পরও তাকে শাস্তি থেকে বাঁচানোর জন্য কী কসরত, তখন তিনি হয়ত মুর্চ্ছা যেতেন।

মজার ব্যাপার হল বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের সম্পর্ক যেখানে এহেন অহিনকুল যে, বিরোধী দল পারলে আজকেই এ সরকারকে উৎখাত করে। অথচ এরশাদের ব্যাপারে তাদের মধ্যে ঐকমত্য। তাই যেখানে সরকার রাত বললে বিরোধী দল বলে দিন, সেখানে সরকার এরশাদের বিচারের ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করলেও বিরোধী দলও চুপ হয়ে আছে। তারাও কোন বক্তব্য বিবৃতি দিচ্ছে না। কারণ এরশাদের কিছু ভোট আছে। বিগত নির্বাচনের পূর্বে উভয দল যেমন এরশাদকে নিয়ে টানাটানি করেছে, আগামী নির্বাচনেও তা করবে। তাদের কাছে রাজনীত মানে হল ক্ষমতায় যাওয়া। জনগণ তথা দেশ ও জাতির মুক্তি এসব ফাঁকা বুলি। দুর্ভাগ্য হল দেশের গরীব আমজনগণ বারংবার এদেরই নির্বাচিত করে ক্ষমতায় পাঠিয়ে প্রতারিত হচ্ছে।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বৈরশাসক এরশাদের ক্ষমতা দখল হতে শুরু করে তার জারী করা যাবতীয় ফরমান, যা সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে জায়েজ করা হয়েছিল, তা বাতিল ঘোষণা করেছেন। সপ্তম সংশোধনী বাতিলের রায় প্রদান করতে গিয়ে আদালত এরশাদের ক্ষমতা দখলের কঠোর সমালোচনা করে তাকে সম্পূর্ণ বে-আইনী ও ঘোরতর অপরাধ বলে বর্ণনা করেছেন। পাশাপাশি আইন করে তাকে শাস্তি প্রদানের কথাও বলেছেন। আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় এখনো প্রকাশিত হয় নি। যতটুকু পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তা থেকে জানা যায়, আদালত এরশাদকে শাস্তি প্রদানের জন্য আইন করার কথা নাকি বলেছেন। আদালত এমনটি কেন বলবেন, তা বোধগম্য হচ্ছে না। আজকে আইন করেত পুরানো দিনের ফৌজদারী অপরাধের বিচার করা যাবে না। যেখানে আদালত সুস্পষ্টভাবে তার ক্ষমতা দখলকে অবৈধ বলেছেন, সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে বর্তমানে প্রচলিত ফৌজদারী দণ্ডবিধির ১২৪ ও ১২৪ক ধারায় কেন তার বিচার করা যাবে না? তাছাড়া শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য সেনা আইন অনুসারেও তার বিচার করার সুযোগ রয়েছে। এসব ব্যাপারে দেশের প্রতীতযশা অনেক আইনজীবিরা ইতোমধ্যে একই মতামত ব্যক্ত করেছেন।

বলাবাহুল্য সপ্তম সংশোধনী বাতিল হলে এরশাদের ক্ষমতা দখল অবৈধ হয়ে পড়ে এবং একই সাথে রায়ে বিশেষভাবে অব্যাহতি দেওয়া কর্মগুলি ছাড়া বাকী সকল কর্ম অবৈধ হযে পড়ে। ফলত: বিদ্যমান ফৌজদারী আইনে কিংবা সশস্ত্র বাহিনী আইনে তার বিচার সম্ভব। আজ যারা আইন করে সামরিক শাসন জারী করা বন্ধ করতে চাইছেন, তাদের কি জানা নেই যে, সামরিক শাসন জারী করার কোন বিধান ইতিপূর্বের সংবিধানেও ছিল না। আমাদের সংবিধানে প্রদত্ত সংজ্ঞানুসারে সামরিক আইন কোন আইনই নহে। সামরিক শাসন, কি পাকিস্তান আমলে কি বাংলাদেশ আমলে, কখনো সাংবিধানিক পন্থায় আসে নি-তার সুযোগও নেই। বন্দুকের জোরেই ক্ষমতা দখল করে সেনা কর্মকর্তারা সামরিক শাসন জারী করেছেন। তাই সামরিক শাসনকে চিরতরে রুখতে হলে নতুন আইন করলে কোন লাভ হবে না। কারণ বন্দুকের জোরে যারা ক্ষমতা দখল করতে চাইবে, আইন তাদের ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

স্মর্তব্য যে, ১৯৭৩ ইং সালে পাকিস্তানের সংবিধানে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে চরম বিশ্বাসঘাতকতা বলে লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল এবং সে দেশের পার্লামেন্টে পাশ করা হয়েছিল “দি হাইট্রিজন (পানিশমেন্ট) এ্যাক্ট-১৯৭৩। তারপরও তো জেনারেল জিয়াউল হক ১৯৭৭ সালে বন্দুকের জোরে পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারী করেছিলেন। যে সংবিধানে সামরিক শাসন জারীর সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড সে সংবিধানকে জিয়াউল হক স্থগিত ঘোষণা করলেন। তারই পথ ধরে পারভেজ মোশাররফ ক্ষমতায় আসলেন ১৯৯৯ ইং সালে । সংবিধান আইন থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে রুখতে পারে নি।
তাই কেবল আইন করে অবৈধ ক্ষমতা দখলকে রোখার চিন্তা অবাস্তব। স্বৈরাচারী এরশাদ ও সে কথা বলেছে। কারণ সে তো জানে, কোন আইন বলে সে ক্ষমতা দখল করে নি।

আজ আদলত যে কাজটি করার সুযোগ সৃর্ষ্টি করে দিয়েছে, তাহল এসকল অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী এবং একমপ্লেসী (অপরাধের সহযোগী) হিসাবে তাদের সহযোগীদের বিদ্যমান ফৌজদারী আইনে বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা। তখনই সংবিধানে সংশোধন করে লাভ হবে, যদি যারা সামরিক শাসন জারী করেছিল তাদের এবং তাদের সহযোগীদের-বর্তমানে মৃত কিংবা জীবিত-ফৌজদারী দণ্ডবিধি মোতাবেক দৃষ্টান্ত মূলক শাস্তি দেওয়া হয়। তা না করে আজ সেদিনের খলনায়ক, স্বৈরশাসক এরশাদকে বাঁচানোর যে পাঁয়তারা চলছে, তা কেবল দু:খ জনক ও লজ্জাস্কর নয়, রীতিমত দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর।

কারণ সুদীর্ঘ নয় বছরের শাসনামলে এরশাদ কী কী অপকর্ম করেছেন, তার ফিরিস্তি দিতে গেলে একটি বিষাদ সিন্ধু লিখতে হবে। আমার বিশেষভাবে মনে পড়ছে সে ২৪ সে জানুয়ারী, ১৯৮৮ ইং সালের ঘটনা। অনেকের সাথে আমিও সেদিন চট্টগ্রামের কারান্তরালে। লালদিঘীর মাঠে ১৫ দলীয় জনসভা। মানুষের ঢল মাঠে। সেদিন শেখ হাসিনাসহ ১৫ দলীয় নেতৃবৃন্দকে বহনকারী গাড়ীতে এরশাদের নির্দেশে পুলিশ-বিডিআর যে ভাবে গুলি চালিয়েছিল, তা যদি লক্ষ্যভেদ করত, তা হলে আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ অনেক জাতীয় নেতৃবৃন্দ পরপারের যাত্রী হতেন এবং মাননীয়া শেখ হাসিনা আজকে প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। নাম না জানা জনৈক কর্মী ঢাল হয়ে তার জীবন বলি দিয়ে শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছেন। নাম জানা-না-জানা ২৯ জন লোক সেদিন লাশ হয়েছিল। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সে লাশগুলোকে চট্টগ্রামস্ত অভয়মিত্র শশ্মনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। তার সীমাহীন দুর্নীতি, রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য ছাত্রদের হাতে গোয়েন্দ সংস্থার মাধ্যমে অস্ত্র তুলে দেওয়া, দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় থেকে নারী কেলেঙ্কারী, মমতাজ মেরী,জিনাত বিদিশা উপাখ্যান, আরো কত কি।

দেশের সর্বোচ্চ আদালত আজ এরশাদের ক্ষমতা দখলকে বেআইনী ঘোষণা করে তাকে বিচার করার কথা বলেছেন। কিন্তু এরশাদের বিচারের ব্যাপারে সরকারী অনীহা সুস্পষ্ট। আদালতের রায়ের পরও দেশের প্রধানমন্ত্রী তার সাথে ঘন্টা ব্যাপী আলাপ করে সম্ভবত তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, তার বিচার করা হবে না। তাই এরশাদ তার ক্ষমতারোহনকে সর্বোচ্চ আদালত বেআইনী ঘোষণার পরও, ‘চোরের মার বড় গলা’র মত একদিকে পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়কে স্বাগত জানাচ্ছে, অন্যদিকে গলা উঁচিয়ে দাবী করছে, কোন আইন করে তার বিচার করা যাবে না।
বিশ্ব বেহায়া বটে!
বঙ্গবন্ধু তনয়া, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
আপনি যেমন আপনার পিতৃহন্তার বিচার চেয়েছেন অহৱনিশ, বিচার করেছেন, হত্যাকারীদের শাস্তি দিয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছেন, স্বজন হারানোর বেদনা কিছুটা লাঘব করেছেন, ঠিক আজ আওয়ামী লীগ নেতা ময়েজউদ্দিন, শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলাম, জাতীয় ছাত্রলীগ নেতা রাউফুন বসুনিয়া, দৌলত, ছাত্রলীগ নেতা সেলিম, দেলোয়ার, মোজাম্মেল, দিপালী শাহা, ডাক্তার মিলন, নুর হোসেন সহ আরো অনেক শহীদের স্বজনেরাও তাদের স্বজন হন্তার বিচার চাইতে পারে এবং সে বিচার আপনাকে করতে হবে। কারণ এটা তাদের সাংবিধানিক অধিকার। তাদের মনোবেদনা আপনার চেয়ে অন্য কেহ বেশি উপলদ্ধি করতে পারার কথা না।

তা না হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার পিতৃহন্তা ও তাদের রক্ষাকারীদের ইতিহাস যেমন ক্ষমা করেনি, মনে রাখবেন, এরশাদকে বিচার থেকে রক্ষাকারীদেরও ইতিহাস ক্ষমা করবে না।