প্রথম অধ্যায়…

দ্বিতীয় অধ্যায়ঃ অনুলিপিকারক

আদিতে ছিল সরলতা। একটা সাধারণ মহাবিশ্ব কেমন করে তৈরি হলো, তা ব্যাখ্যা করা এমনিতেই কঠিন। আমি মেনে নিচ্ছি যে প্রাণের এই চকিত উৎকলন, সুসজ্জিত ও দুর্বোধ্য এই সংস্থান যা নতুন প্রাণের উৎস হিসেবে কাজ করে, তাকে ব্যাখ্যা করা আরো জটিল। ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাহায্যে বর্ণিত বিবর্তন তত্ত্ব একটি সন্তোষজনক সূত্র, কারণ তা এই জটিল বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করে। কীভাবে সরলতা থেকে জটিলতা এলো, কীভাবে বিশৃঙ্খল অণুসমূহ শৃঙ্খলায় সজ্জিত হয়ে যৌগিক কণা তৈরি করলো, কীভাবে সেখান থেকে মানুষের উৎপত্তি হলো এসবের যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিয়েছে এই তত্ত্ব। ডারউইন এখন পর্যন্ত আমাদের অস্তিমানতার একমাত্র গ্রহণযোগ্য সমাধানটা দিয়েছেন। এই অসামান্য তত্ত্বটিকে সাধারণত যতোটা দুর্বোধ্যভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, আমি তার চেয়ে অধিকতর সহজভাবে ব্যাখ্যা দিবো। বিবর্তন শুরু হবার আগের সময় থেকে আমাদের শুরু করতে হবে।

ডারউইনের ‘যোগ্যতমের উত্তরজীবীতা’ একটি বিশেষ অবস্থা বুঝায়, যা মূলত আরেকটি সাধারণ বাক্যবন্ধ থেকে এসেছে, সেটা হলো ‘সুস্থিতের উত্তরজীবীতা’। মহাবিশ্ব অসংখ্য সুস্থিত বস্তুতে ভরে আছে। একটি সুস্থিত বস্তু হলো কিছু অণুর স্থায়ী বা সাধারণ সমষ্টি যাকে একটা নাম দেয়া যায়। তা হতে পারে ম্যাটারহর্নের মতো কিছু অনন্য অণুর সমষ্টি, যা নামকরণের মতো স্থায়িত্ব ধারণ করে। হতে পারে একই ধরণের কিছু বস্তুর গুচ্ছ, যেমন বৃষ্টিবিন্দু, যেগুলো গুচ্ছাকারে একটা বেশ লম্বা সময়ের জন্যে অস্তিত্ব নিয়ে থাকে, যদিও এককভাবে তারা ক্ষণস্থায়ী। আমাদের চারপাশে আমরা যা দেখি, যাদেরকে বর্ণনা করা যায়, তেমন সবকিছু – পর্বত, নক্ষত্রপুঞ্জ, সাগরের ঢেউ – এগুলো সবই কম বেশি সুস্থিত অণুর বিন্যাস দিয়ে তৈরি। সাবানের বুদবুদ গোলাকার হয় কারণ সেটাই গ্যাসভর্তি সরু ফিল্মের স্থিতাবস্থা। মহাকাশযানে পানির অণুর স্থিতিশীল আকার গোলাকৃতি হয়, কিন্তু পৃথিবীপৃষ্ঠে মাধ্যাকর্ষণ বলের কারণে পানির অণুর স্থিতিশীল আকার হলো আনুভূমিক। যেমন, লবণ স্ফটিকের কণা ঘনক আকৃতির হয় কারণ সোডিয়াম ও ক্লোরিনের আয়নের প্যাকিংয়ের সবচেয়ে সুস্থিত গঠন হচ্ছে ঘনক। সূর্যের ভেতরে সরলতম পরমাণু হাইড্রোজেন থেকে ফিউশন বিক্রিয়ায় হিলিয়াম পরমাণু তৈরি হচ্ছে কারণ সূর্যের ঐ পরিবেশে হিলিয়ামের পারমাণবিক গঠন সবচেয়ে স্থায়ী। পুরো মহাবিশ্বের অসংখ্য নক্ষত্রের ভেতর বহু জটিল পরমাণু তৈরি হচ্ছে আরো অনেক ভিন্ন ভিন্ন পরমাণু থেকে। বর্তমানে প্রমাণিত তত্ত্বমতে মহাবিস্ফোরণের পর থেকে এই প্রক্রিয়া চলমান। আমাদের বিশ্বজগতের সকল উপাদান এই মহাবিস্ফোরণ থেকেই এসেছে।

যখন একাধিক পরমাণুর মাঝে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে, তখন সেগুলো মিলে কমবেশি সুস্থিত অণু সৃষ্টি হয়। এরকম অণুগুলো আকারে অতি বৃহৎ হতে পারে। যেমন, হীরকের একটি স্ফটিক যা কিনা নিজেই একটি বৃহৎ অণু, একই সাথে এর স্থায়িত্বও অনবদ্য। অন্তঃআণবিক গঠনের দিক থেকে হীরক খুবই সরল কারণ এটি অসংখ্যবার পুনরাবৃত্তি হয়ে গঠিত হয়। এখনকার জীবিত প্রাণীসত্তার মধ্যে এমন অনেক অণু পাওয়া যায় যেগুলোর গঠন খুবই জটিল এবং বেশ কয়েকটি পর্যায়ে তাদের গঠনের এই জটিলতা দেখা যায়। যেমন আমাদের রক্তের হিমোগ্লোবিন একটি সাধারণ প্রোটিন অণু। ছোট ছোট অ্যামাইনো এসিডের শেকল দিয়ে এটি গঠিত। এই শেকলের প্রতিটিতে কয়েক ডজন পরমাণু একটি নির্দিষ্ট বিন্যাসে সজ্জিত আছে। একটি হিমোগ্লোবিন অণুতে ৫৭৪ টি অ্যামাইনো এসিডের অণু আছে। সেগুলো চার ধরণের শেকলে সাজানো থাকে, শেকলগুলো একে অপরকে পেঁচিয়ে একটি গ্লোবিউলার বা বর্তুলাকার গঠন তৈরি করে। এই অণুর গঠন বিস্ময়কর রকমের জটিল। একটা হিমোগ্লোবিনের মডেল দেখতে অনেকটা ঘন কাঁটাঝোপের মতোন। পার্থক্য হলো হিমোগ্লোবিন অণু সত্যিকারের কাঁটাঝোপের মতো হিজিবিজিভাবে তৈরি হয় না। একজন সাধারণ মানুষের শরীরে ৬ কোটি কোটি কোটি হিমোগ্লোবিনের অণু একটা সুনির্দিষ্ট গঠন মেনে চলে, অন্তহীনভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটে এই অণুর শেকগুলোর, যেগুলোর মাঝে একটা ডাল বা একটা প্যাঁচও এদিক ওদিক হবে না। এই নির্দিষ্ট কাঁটাঝোপের মতোন হিমোগ্লোবিনের অণুকে আমরা সুস্থিত বলতে পারি কারণ একই বিন্যাস মেনে গঠিত যে কোন দুইটি অ্যামাইনো এসিডের শেকল স্প্রিংয়ের মতো প্যাঁচিয়ে একটি নির্ধারিত গঠনের ত্রিমাত্রিক কয়েলই তৈরি করবে। আমাদের শরীরে হিমোগ্লোবিনের এই ‘নির্ধারিত’ কাঁটাঝোপ অণু প্রতি সেকেন্ডে তৈরি হচ্ছে মোট চার কোটি কোটি, এবং একই সংখ্যক অণু প্রতি সেকেন্ডে ধ্বংসও হয়ে যাচ্ছে।

অণুসমূহের সুস্থিত আচরণের উদাহরণ হিসেবে হিমোগ্লোবিন একটি বেশ আধুনিক অণু। এখানে যে বিষয়টি প্রাসঙ্গিক তা হলো পৃথিবীতে প্রাণের উন্মেষের আগে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নবিদ্যার এরকম কিছু সাধারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অণুসমূহের এক ধরনের প্রাথমিক বিবর্তন ঘটে থাকতে পারে। এখানে কোন নকশা, কোন উদ্দেশ্য বা কোন তত্ত্বাবধানের কথা ভাবার প্রয়োজন নেই। যে কোন শক্তি উপস্থিতিতে কিছু পরমাণু যদি একত্রিত হয়ে কোন স্থায়ী অণু তৈরি করে, তাহলে সেটি অপরিবর্তিত থাকবে। প্রাকৃতিক নির্বাচনের আদিতম ঘটনাগুলো মূলত এই স্থায়ী ঘটনাগুলোর নির্বাচন আর অস্থায়ীগুলোকে বর্জনের মাধ্যমেই ঘটেছে। এর মাঝে কোন রহস্য নেই। সংজ্ঞানুযায়ী, এটা ঘটতোই।

অবশ্যই এর মানে এই না যে মানুষের মতো যৌগিক ও জটিল জীবের অস্তিত্ব আমরা সরাসরি এই নিয়মের কথা বলে ব্যাখ্যা করতে পারবো। সমান সংখ্যক অণু পরমাণু নিয়ে নির্দিষ্ট শক্তি দিয়ে ঝাঁকালে কোন লাভ নেই। সেখান থেকে আদম টপ করে নাজিল হবে না! কয়েক ডজন পরমাণু নিয়ে এভাবে হয়তো একটা অণু তৈরি করা সম্ভব, কিন্তু একজন মানুষের শরীরে দশ লাখ কোটি কোটি কোটির চেয়েও বেশি অণু থাকে। এভাবে কোন জৈবরাসায়নিক ককটেল-মিক্সারে মানুষ তৈরি করতে গেলে আপনার যে সময় লাগবে তাতে মহাবিশ্বের পুরো সময়কাল এক পলকেই শেষ হয়ে যাবে। এমনকি তার পরেও আপনি সফল হবেন এই ব্যাপারে কোন নিশ্চয়তা নেই। আর এখানেই ডারউইনের তত্ত্বের সবচেয়ে সাধারণ রূপটি কাজে আসে। এই ধীর প্রক্রিয়ায় অণু সৃষ্টির গল্পের চালকের আসন এর পরে ডারউইনের তত্ত্বই নিয়ে নিয়েছে।

স্বভাবতই, আমি যে তথ্য দিয়ে প্রাণের উদ্ভব বর্ণনা করবো, তা অনুমানভিত্তিক। সংজ্ঞামতেই, সে সময়ে পৃথিবীতে প্রক্রিয়াটি দেখার জন্যে কেউই বেঁচে ছিলো না। আরো বেশ কিছু একইরকমের তত্ত্ব রয়েছে, যা বিবর্তন তত্ত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু এই সব তত্ত্বের মাঝেই নির্দিষ্ট কিছু বিষয় একেবারে মিলে যায়। আমি যে সাধারণ বর্ণনা দিবো, মূল সত্য থেকে তা খুব বেশি দূরের নয়। [১]

পৃথিবীতে প্রাণ সৃষ্টির সময়ে ঠিক কোন রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া যেতো তা আমরা জানি না। তবে সম্ভাব্য পদার্থগুলো হলো পানি, কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, এবং এমোনিয়া: সবগুলো খুব সাধারণ প্রাকৃতিক যৌগ, যেগুলো সৌরজগতের অন্য কয়েকটি গ্রহেও পাওয়া যায়। রসায়নবিদেরা আদি পৃথিবীর রাসায়নিক পরিবেশ পুনরায় তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। পরীক্ষাগারে এই সাধারণ যৌগগুলোকে একটা ফ্লাস্কে ভরে তার ভেতরে নির্দিষ্ট শক্তি উৎস দেয়া হলো অতিবেগুনি রশ্মি বা বৈদ্যুতিক ক্ষরণের (আদি পৃথিবীর বিদ্যুৎচমকের কৃত্রিম সিমুলেশানের) মাধ্যমে। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে ফ্লাস্কের ভেতরে মূল অণুগুলোর চাইতেও অনেক জটিল গঠনের কিছু যৌগের অণুর এক ধরণের হাল্কা খয়েরি স্যুপ পাওয়া গেলো। আরো নির্দিষ্ট করে বললে, ফ্লাস্কে এমাইনো এসিড পাওয়া গেলো – যা প্রোটিনের গাঠনিক একক, জৈবিক অণুর দুই মহান শ্রেণীর একটি। এই পরীক্ষার আগে মনে করা হতো এমাইনো এসিডই কেবল প্রাণের সনাক্তকারী চিহ্ন। এই অণুটি যদি মঙ্গল গ্রহে পাওয়া যায়, তাহলে ধরে নেয়া যাবে যে অচিরেই সেই গ্রহে প্রাণের উদ্ভব ঘটবে। যাক, এই পরীক্ষা থেকে বলা যায় যে আদি পৃথিবীতে এমাইনো এসিডের উপস্থিতি প্রমাণের জন্যে সেই সময়ের পরিবেশে কিছু সরল গ্যাস, আগ্নেয়গিরি, সূর্যালোক বা ঝড়ো অবহাওয়া থাকলেই চলবে। অতি সম্প্রতি, পরীক্ষাগারে রসায়নবিদেরা আদি পৃথিবীর পরিবেশ সিম্যুলেট করে একইভাবে পিউরিন এবং পাইরিমিডিন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন, যা কিনা ডিএনএ’র গাঠনিক একক।

একই ধরণের প্রক্রিয়ায় নিশ্চয়ই সেই ‘আদি স্যুপ’ তৈরি হয়েছিলো, জীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদেরা মনে করছেন, ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার লক্ষ বছর আগের সমুদ্রে এই স্যুপ পাওয়া যেতো। এই জৈবিক পদার্থ ধীরে ধীরে সম্পৃক্ত এবং ঘন হয়ে, মূলত সমুদ্রের তীরে শুষ্কভূমিতে ছোট ছোট বিন্দুকণায় জমা পড়তো। অতিবেগুনি রশ্মির মতো শক্তির উপস্থিতিতে এই বিন্দুগুলো জড়ো হয়ে আরো বৃহৎ অণু তৈরি করতো। এখনকার সময়ে এমন বৃহৎ অণু খুব বেশিক্ষণ টিকবে না বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কারণে। কিন্তু ব্যাকটেরিয়া বা অন্যান্য জীবাণু সেই সময়ে প্রকৃতিতে ছিলো না, এবং এই বৃহৎ অণুগুলো ধীরে ধীরে জমা হবার সুযোগ পেতো।

ঘটনাক্রমে, এক পর্যায়ে একটি বিশেষ অণু সৃষ্টি হয়েছিলো। আমরা এই অণুটিকে বলবো অনুলিপিকারক। এই অণুই যে সবচেয়ে জটিল গঠনের বা সবচেয়ে বৃহদাকারের ছিলো তেমন না, তবে এটার বিশেষত্ব ছিলো যে তা নিজেই নিজের কপি তৈরি করতে পারতো। মনে হতে পারে যে এই ধরণের ‘ঘটনা’ ঘটার সম্ভাবনা খুবই কম। এবং আদতেই তা সত্যি। এই ঘটনাটি খুবই ‘অসম্ভাব্য’ ঘটনা। একজন মানুষের জীবনকালে যদি এর সম-সম্ভাবনার কোন ঘটনাকে তুলনা করা হয় তাহলে তাকে বাস্তবিকভাবেই অসম্ভব বলে রায় দেয়া যায়। এজন্যেই আপনি কোন ফুটবল পুলের লটারিতে কোন বড়ো পুরষ্কার কখনো জিতবেন না। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিগত সম্ভাবনার হিসাবে অভ্যস্ত মস্তিষ্ক সাধারণত লাখ লাখ বছর সময়ে ঘটা সম্ভাবনা নিয়ে কল্পনা করতে পারে না। যদি আপনি কয়েক হাজার লক্ষ বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে ফুটবল কুপন পূরণ করতে থাকেন, তাহলে বেশ কয়েকবার পুরষ্কার জেতা খুবই স্বাভাবিক।

একটা অণু যা কিনা নিজে নিজেই কপি হতে থাকে, সেটাকে প্রথমে বেশ কষ্টকল্পনা মনে হলেও আসলে তা নয়, আর এই ঘটনাটা কেবল একবারই ঘটতে হবে। মনে করুন এই অনুলিপিকারক একটা ছাঁচ বা টেমপ্লেট। মনে করুন এটা একটা বিরাট অণু যার ভেতরে নানারকম একক অণুর জটিল শেকল রয়েছে। ছোট ছোট শেকলগুলো সেই আদি স্যুপে অনুলিপিকারকের চারপাশে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান ছিলো। এখন ধরে নিন যে প্রতিটা একক অণুতে নিজের সমপ্রকৃতির অণুর প্রতি একটা আকর্ষণ আছে। তাহলে যখনই অণুটি অনুলিপিকারকের কোন অংশে নিজের গঠনের সাথে মিল পাবে, তখনই সেটা সেখানে যুক্ত হয়ে যাবে। যুক্ত হবার সাথে সাথেই অণুটি অনুলিপিকারকের মূল গঠনের সাথে খাপে খাপে মিলে যাবে। তারা তখন যুক্ত হয়ে মূল অনুলিপিকারকের সদৃশ একটা সুস্থিত শেকল তৈরি করবে, এটাও সহজে ভাবা যায়। এই প্রক্রিয়া স্তরে স্তরে বেড়ে উঠতে পারে। এভাবেই বিভিন্ন স্ফটিক তৈরি হয়। অপরদিকে ঐ দুটো শেকল বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা দুটো অনুলিপিকারক পাবো যা কিনা একইভাবে অনুলিপি তৈরি করতে থাকবে।

এর চাইতে একটু জটিল সম্ভাবনার দিকে যাওয়া যাক। ধরে নেয়া যায় যে প্রতি একক অণুর নিজের সদৃশ এককের সাথে নয় বরং নিজের পরিপূরক আরেকটি এককের প্রতি আসক্তি আছে। তখন এককটি নিজের সদৃশ কপির ছাঁচ হিসেবে কাজ করবে না, বরং নিজের ‘নেগেটিভ’ ছাঁচ হিসেবে কাজ করবে, যা অনুলিপি তৈরির সময়ে মূল পজেটিভ এককের মতো ঠিক আরেকটি একক তৈরি করবে (পজেটিভ-নেগেটিভ প্রক্রিয়া)। আমাদের হিসাবের জন্যে অনুলিপিকরণ প্রক্রিয়া পজেটিভ-পজেটিভ নাকি পজেটিভ-নেগেটিভ ছিলো সেটা জরুরি না। যদিও এখানে উল্লেখ করা ভালো যে প্রকৃত অনুলিপিকারকের আধুনিক সংস্করণ, বা ডিএনএ অণু, উল্লেখিত পজেটিভ-নেগেটিভ প্রক্রিয়ায় অনুলিপি তৈরি করে। যে বিষয়টি জরুরি তা হলো তখন হঠাৎ করেই আদি প্রকৃতিতে এক নতুন ধরনের ‘স্থায়িত্ব’ চলে এসেছিলো। এর আগে স্যুপের ভেতরে কোন বিশেষ ধরনের জটিল অণুর সংখ্যা ছিল অপ্রতুল, কারণ প্রতিটি অণু তার গাঠনিক একক ভাগ্যক্রমে সৃষ্টির সম্ভাবনার ওপর নির্ভরশীল ছিলো। কিন্তু যখনই অনুলিপিকারকের সৃষ্টি হলো, তখনই অবধারিতভাবে সেটি অতি দ্রুত নিজের অসংখ্য কপি তৈরি করেছে, যতক্ষণ না গাঠনিক ক্ষুদ্র অণুগুলো একেবারে কমে যায়। অনুলিপিকারক ছাড়া অন্যান্য বৃহৎ অণু এর পরে খুব কমই তৈরি হচ্ছিলো।

তো এখন আমরা বেশ বড়োসংখ্যক সদৃশ অনুলিপির একটা সমষ্টি পেলাম। কিন্তু এখানে অনুলিপিকরণের একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে রাখা ভালোঃ এটা নিখুঁত নয়। কপি তৈরির সময়ে ভুল হবেই। যেমন আমি আশা করছি এই বইটায় কোন বানান-বিভ্রাট নেই, তবে আপনি যদি খুব খেয়াল করে পড়েন, তাহলে হয়তো একটা বা দুটো ভুল পেতেও পারেন। সেগুলো হয়তো বাক্যের অর্থ খুব বেশি বদলে দিবে না, কারণ সেগুলো হচ্ছে ‘প্রথম প্রজন্মে’র ভুল। কিন্তু মুদ্রণব্যবস্থার আগের কথা চিন্তা করুন, যখন হাতে লিখে গসপেলের মতো বই কপি করা হতো। যতোই সচেতন থাকুক না কেন সব লিপিকারই কোন না কোন ভুল করেছেন, আবার কেউ কেউ হয়তো স্বেচ্ছায় ছোটখাট ‘সংশোধন’ও করেছেন। যদি তারা সবাই একটা আদি সংস্করণ থেকে কপি করে থাকেন, তাহলে হয়তো বাক্যের অর্থের খুব একটা বিকৃতি ঘটবে না। কিন্তু যদি মূল সংস্করণ থেকে না হয়ে কপি থেকে কপি করা হতে থাকে, আবার সেই কপি থেকে আরো কপি করা হতে থাকে, তাহলে ভুলের সংখ্যা যোগানুপাতে বাড়তেই থাকবে, এবং ভুলগুলো হবে গুরুতর। এমন অসাবধানী কপি করাকে আমরা খারাপ বলেই বিবেচনা করি, আর মানুষের বেলায় এমন অনুলিপিকরণে ভুলগুলোকে উন্নয়ন মনে করা কষ্টকল্পনা। আমি মনে করি সেপ্টুয়াজিন্ট-এর পণ্ডিতেরা যখন তোরাহের অনুবাদ করতে গিয়ে হিব্রু ভাষার ‘তরুণী’ শব্দের গ্রীক ভাষান্তর করলেন ‘কুমারী’, তখন বড়োসড়ো গড়বড় ঘটে গছে। তাদের অনুবাদের ফলে ঐশীবাণীটির চেহারা দাঁড়ালোঃ “ শোনো, এক কুমারীর গর্ভে ভ্রূণসঞ্চার হবে আর জন্ম নিবে এক ছেলে…” (Isaiah 7:14)। [২] যাই হোক, আমরা দেখাবো যে জৈবিক অনুলিপিকারকগুলোর মধ্যে এমন অসাবধানী নকলের প্রবণতা থেকে সত্যিকার অর্থেই উন্নতি ঘটে, আর প্রাণের ক্রমবিবর্তনের ধারায় এই ভুলগুলোর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিলো। ঠিক কতোটা নিখুঁতভাবে প্রাথমিক অনুলিপিকারকগুলো নকল তৈরি করতো তা আমরা জানি না। তাদের বর্তমান বংশধর, অর্থাৎ ডিএনএ অণু এই কাজে অবিশ্বাস্য মাত্রায় নিখুঁত, সবচাইতে বিশ্বস্ত মানুষের চাইতেও তারা শ্রেয়। কিন্তু সেখানেও মাঝে মাঝে ভুলচুক হয়ে যায়। এই হুট করে ঘটা ভুলগুলোতেই মূলত বিবর্তন ঘটে। সম্ভবত প্রাথমিক অনুলিপিকারকগুলো অতিমাত্রায় বেখেয়ালী ছিলো, যেটাই হোক না কেন, সেই সময়ে ভুল হয়েছিলো এই ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত, আর সেই ভুলগুলো যথারীতি ক্রমাগত ঘটেছিলো ভাবাটাই যৌক্তিক।

যখন এই ক্রমান্বয়ে ঘটে চলা ভুল যতো বেড়েছে, তখন সেই আদিম স্যুপে নানারকমের অনুলিপিকারকের সংখ্যা বেড়েছে। এই বিচিত্রতা সহজেই অনুমেয়, আর একই প্রকৃতির অনুলিপিকারক না থাকাটাও স্বাভাবিক। এই সকল ‘উত্তরবংশ’ আসলে এক আদিম পূর্বপুরুষ থেকেই উৎপন্ন। কোনো কোনো ধরণের অনুলিপিকারক কি অন্যগুলোর চাইতে বেশি তৈরি হয়েছিলো? অবশ্যই হ্যাঁ। কিছু কিছু অনুলিপিকারক অন্যগুলোর চাইতে বেশি সুস্থিত ছিলো, কিছু কিছু অণুর সৃষ্টির পরে ভেঙে যাবার সম্ভাবনা অন্যান্য অণুর চাইতে কম ছিলো। এই ধরণের অণুর সংখ্যা খুব কম সময়েই স্যুপে বেড়ে যাওয়ার কথা। চিন্তা করলে, সেগুলোর দীর্ঘায়ু যেমন সংখ্যা বৃদ্ধির কারণ, তেমনি দীর্ঘ আয়ুকালে তারা বেশি বেশি অনুলিপি তৈরি করতে পারতো এটাই বড়ো কারণ। সুতরাং দীর্ঘায়ুর অনুলিপিকারকের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেলো, তেমনি বাকি সবকিছু ঠিক থাকলে সেই অণুর জনসংখ্যায় এই দীর্ঘ আয়ুর একটি ‘বিবর্তনিক প্রবণতা’ও তৈরি হলো।

অথচ সেখানে বাকি সব কিছু সম্ভবত ঠিক ছিলো না। আর অনুলিপিকারক বৈচিত্র্যের বিশ্লেষণে তাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্যও গোনায় ধরতে হবে। অনুলিপিকারক বৈচিত্র্যের মাঝে দ্রুত বিস্তার ও বৃদ্ধির একটি জরুরি বৈশিষ্ট্য হলো উর্বরতা (fecundity)। যদি অনুলিপিকারক নিজের অনুলিপি তৈরি করতে কয়েক সপ্তাহ লাগায়, আর অনুলিপিকারক নিজের অনুলিপি কয়েক ঘন্টায় তৈরি করে ফেলে, তাহলে সহজেই বুঝা যায় যে খুব তাড়াতাড়িই -এর অণুর সংখ্যা -এর অণুর তুলনায় নগণ্য হয়ে যাবে (এমনকি সেগুলো ‘দীর্ঘায়ু’ হলেও)। তাহলে এটা বলা যায় যে সেখানে ‘উর্বরতা’র গুণের দিকেও একটা ‘বিবর্তনিক প্রবণতা’ সেই স্যুপে তৈরি হয়েছিলো। তৃতীয় আরেকটি বৈশিষ্ট্য অনুলিপিকারকের মাঝে দরকারী ছিলো, সেটি হচ্ছে অনুলিপি তৈরির শুদ্ধতা। যদি অনুলিপিকারক এবং একই হারে অনুলিপি তৈরি করে, আর তাদের আয়ুও সমান হয়, সেক্ষেত্রে এই বৈশিষ্ট্য নির্ধারক হয়ে দাঁড়ায়। -এর অনুলিপির প্রতি দশম ধাপে যদি একটা করে ‘ভুল’ হতে থাকে আর -এর অনুলিপির প্রতি একশতম ধাপে একটা করে ভুল হয়, তাহলে অবশ্যই -অণুর সংখ্যা বেশি হবে। -অণুগুলো কেবল যে নিজের ভুলভাল ‘সন্তান’গুলোকেই হারাবে না তা নয়, তাদের ভবিষ্যত প্রকৃত ও সম্ভাব্য বংশধরও হারিয়ে যাবে।

আপনি যদি বিবর্তন সম্পর্কে একটু ধারণা রাখেন তাহলে শেষ পয়েন্টটা হয়তো স্ববিরোধী মনে হবে। “উচ্চ অনুলিপি-শুদ্ধতার দিকে প্রাকৃতিক নির্বাচন পক্ষপাতী” এই বক্তব্যের সাথে “ভুল অনুলিপি বানানো বিবর্তন ঘটার একটি জরুরি পূর্বশর্ত” – এই দাবির কোনো সামঞ্জস্য কি আমরা আনতে পারি? এর উত্তর হলো, যদিও ভাসাভাসাভাবে দেখলে বিবর্তন প্রক্রিয়াটিকে ‘ভালো ঘটনা’ বলে মনে হয়, যেহেতু আমরা সবাই এই প্রক্রিয়ার উপজাত, আসলে কেউই বিবর্তিত হতে ‘চায়’ না। চান বা না চান, বিবর্তন এমন এক প্রক্রিয়া যা ঘটবেই, সব অনুলিপিকারকের (এখনকার ডিএনএ’র) সব ধরণের বিরোধিতা সত্ত্বেও। এই বিষয়টি Jacques Monod তার হার্বার্ট স্পেন্সার বক্তৃতায় খুব পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করেছেন। তার ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্যটা ছিলোঃ ‘বিবর্তনের ব্যাপারে আরেক মজার কথা হলো সবাই মনে করে যে সে বিবর্তন খুব ভালো বুঝে!’

তো, চলুন আবার সেই আদিম স্যুপের কাছে ফিরে যাই। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই নানান বৈচিত্র্যে ভরা সুস্থিত অণুতে গিজগিজ করছে। সুস্থিত এ অর্থে বললাম, যে হয় সেগুলো দীর্ঘসময় টিকে আছে, অথবা সেগুলো দ্রুত অনুলিপি তৈরি করছে, অথবা সেগুলো নিখুঁতভাবে অনুলিপিত হচ্ছে। বিবর্তনগত প্রবণতা এই তিন ধরনের স্থায়িত্বের উপর নির্ভর করে নিম্নরূপেঃ যদি দুটা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে এই স্যুপ থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হয়, তাহলে পরের নমুনাটিতে বেশি দীর্ঘ/বেশি উর্বর/বেশি নকল-বিশ্বস্ত বৈশিষ্ট্যের অণু অধিক পরিমাণে পাওয়া যাবে। এই একই কথা একজন জীববিজ্ঞানীও বিবর্তন নিয়ে বলে থাকেন যখন তিনি জীবিত প্রাণিজগত নিয়ে আলোচনা করেন, আর দুইক্ষেত্রেই মূল পদ্ধতি একই – প্রাকৃতিক নির্বাচন।

আমরা কি তবে আদি অনুলিপিকারক অণুগুলোকে ‘জীবিত’ বলতে পারি? হু কেয়ারস? আমি হয়তো আপনাকে বললাম ‘ডারউইন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ’, আর আপনি হয়তো বললেন, ‘না, নিউটন’। আশা করি আমরা সেই তর্ক বেশিক্ষণ চালাবো না। কথা হলো আমাদের তর্ক মীমাংসায় কোন উপসংহার বা সিদ্ধান্তই প্রভাব রাখে না। আমরা তাঁদেরকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বলে মানি বা না মানি, নিউটন এবং ডারউইনের জীবন ও অর্জনের প্রকৃত তথ্য তাতে বদলায় না। ঠিক তেমনি, আমি যেভাবে বললাম সেভাবেই অনুলিপিকারক অণুর গল্পটা ঘটেছিলো বলে প্রমাণিত, আমরা সেগুলোকে ‘জীবিত’ বলি বা না বলি, তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের এতো জ্বালা-যন্ত্রণার কারণ আমরা মেনে নিতেই পারি না যে শব্দ আসলে আমাদের ব্যবহৃত প্রকাশ মাধ্যম ছাড়া কিছুই না, আমরা বুঝতে চাই না যে অভিধানে ‘জীবিত’ শব্দ থাকা মানে এই না যে সেটা এই পৃথিবীতে কোন রক্তমাংসের অর্থ বুঝায়। প্রাথমিক অনুলিপিকারকদের আমরা জীবিত বলি আর না বলি, এতে কোনো সন্দেহ নাই যে তারাই প্রাণের পূর্বপুরুষ; তারাই আমাদের আদি-পিতা।

এই প্রসঙ্গে পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হলো প্রতিযোগিতা, যা নিয়ে খোদ ডারউইন প্রচুর আলোচনা করেছেন (যদিও তিনি প্রাণী ও উদ্ভিদ নিয়ে কথা বলেছেন, অণু নিয়ে না)। আদিম স্যুপে অসীম সংখ্যক অণুর জায়গা হতে পারে না। প্রথমত, পৃথিবীর মোট আয়তন সীমিত, তবে এর চাইতেও বড়ো প্রভাবক উপাদান ছিলো। আমরা যেভাবে এই অনুলিপিকারকের ধারণা তৈরি করছি, যা একপ্রকারের ছাঁচ বা টেমপ্লেট হিসেবে কাজ কছে, সেগুলো প্রথমে নিশ্চয়ই প্রচুর ছোট ছোট গাঠনিক একক অণুর সাগরে ভাসছিলো। কিন্তু যখন দ্রুত অনুলিপিকরণ চালু হলো, তখন ধীরে ধীরে সেই ক্ষুদ্র গাঠনিক এককের সংখ্যা কমে যাবেই। বিভিন্ন ধরণের অনুলিপিকারক তখন সেগুলোর জন্যে প্রতিযোগিতা করেছে। অধিক সুস্থিত প্রকারের শ্রেণীগুলো যে যে ভাবে পক্ষপাত পায় সেগুলো আমরা এতোক্ষণ দেখেছি। আর এখন দেখা যাচ্ছে যে কম-সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীগুলো প্রতিযোগিতার কারণে অপেক্ষাকৃত কম পক্ষপাত পাবে, এবং শেষ পর্যন্ত অনেকেরই ধারা বিলুপ্ত হবে। অনুলিপিকারকের বৈচিত্র্যের শ্রেণীগুলোর মাঝে টিকে থাকার লড়াই ছিলো। তারা জানতো না যে তারা লড়াই করছে, কিংবা এ নিয়ে দুশ্চিন্তাও করতো না; একেবারে বিদ্বেষ ছাড়াই এই লড়াই চলেছিলো, এমনকি আদৌ কোন ধরণের অনুভূতিই সেখানে ছিলো না। কিন্তু তারা লড়ছিলো নিশ্চয়ই, এতোটাই যে কোনো ভুল-নকলীকরণের ফলে যদি নতুন অধিক-স্থায়ী গঠন পাওয়া যায়, বা কোনোভাবে তা প্রতিদ্বন্দ্বীদের স্থায়িত্ব হ্রাস করে, তাহলে সেই ভুলটাই সংরক্ষিত হবে এবং গুণাকারে বেড়ে যাবে। এই প্রক্রিয়ার উন্নতি ছিলো ক্রমবর্ধিষ্ণু। নিজের স্থায়িত্ব বৃদ্ধি বা প্রতিদ্বন্দ্বীর স্থায়িত্ব হ্রাসের নানান পথ ধীরে ধীরে বাড়লো। কেউ কেউ হয়তো প্রতিদ্বন্দ্বী অণুকে ভেঙে ফেলার কায়দা-কানুনও ‘আবিষ্কার’ করে ফেললো, আর ভেঙে ফেলার পরে সেগুলোর গাঠনিক একক কাজে লাগিয়ে নিজের কপি তৈরি করলো। এই আদি-মাংশাসীরা একইসাথে নিজেদের খাবার জোগাড় করলো আর প্রতিদ্বন্দ্বীদের বিলুপ্তি ঘটালো। অন্যান্য অনুলিপিকারকেরা হয়তো নিজেদের রক্ষা করার উপায় বের করে ফেলেছিলো, হয় রাসায়নিকভাবে, নয়তো নিজেদের চারিদিকে প্রোটিনের দেয়াল তৈরি করে। হয়তো এভাবেই প্রথম জীবিত কোষের জন্ম হয়। অনুলিপিকারকেরা শুধু টিকে থাকাই শুরু করলো না, ধীরে ধীরে নিজেদের জন্যে ধারক তৈরি করলো, যে ধারক বা বাহকে তাদের অস্তিত্ব বহাল থাকবে। সেই অনুলিপিকারকগুলোই টিকে গেলো যারা নিজেদের বসবাসের জন্যে উত্তরজীবীতার যন্ত্র বানাতে পেরেছিলো। এরকম যন্ত্রের প্রথমটার হয়তো একটা সুরক্ষা-আবরণ ছাড়া কিছুই ছিলো না। কিন্তু যতোই নতুন ও কার্যকর উত্তরজীবীতার যন্ত্র নিয়ে নতুন নতুন প্রতিস্বন্দ্বী তৈরি হতে থাকলো, ততোই টিকে থাকা কঠিন হয়ে উঠলো। এই যন্ত্রগুলোও হয়ে উঠলো আরো বড়ো ও আরো সুনির্মিত, এই প্রক্রিয়াটিও ছিলো ক্রমবর্ধমান এবং প্রগতিশীল।

পৃথিবীতে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে অনুলিপিকারকদের এই কৌশল আর চাতুর্যের সাথে ক্রমশ উন্নত হয়ে ওঠার কি কোন শেষ ছিলো? এরকম উন্নতির জন্যে তো অনেকটা সময় পড়ে আছে। স্বরক্ষার কোন উদ্ভট উপায়, কৌশল সামনের হাজার হাজার বছর নিয়ে এসেছিলো? প্রায় চল্লিশ হাজার লক্ষ বছর পরে সেই আদি অনুলিপিকারকের ভাগ্যে কি ঘটেছিলো? তারা তো নিশ্চয়ই বিলুপ্ত হয়ে যায় নি, কারণ তারাই টিকে থাকার লড়াইয়ের আদি-যোদ্ধা। কিন্তু তাদেরকে সাগরে খুঁজতে যাবেন না; তারা সেই শৌখিন স্বাধীনতা বহু আগেই বিসর্জন দিয়েছে। তারা এখন বৃহৎ উপনিবেশে দলবেঁধে সাঁতরে বেড়ায়, বিশাল জগদ্দল রোবোটের ভেতরে, [৩] বাইরের পৃথিবীর সাথে এখন তাদের সংশ্রব নেই, তেমন যোগাযোগের জন্যে আঁকাবাঁকা বক্র কুটিল পথের প্রয়োজন পড়ে, রিমোট কন্ট্রোল কাজে লাগাতে হয়। তারা আমার ভেতরে আছে, তারা রয়েছে আপনার ভেতরেও; তারাই আমাদের সৃষ্টি করেছে, আমাদের দেহ আর আমাদের মন; আর তাদের সংরক্ষণশীলতাই আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত মৌলিক যুক্তি। ওই অনুলিপিকারকেরা এক দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। এখন তাদেরকে জিন বলে ডাকা হয়, আর আমরা হলাম তাদের উত্তরজীবীতার যন্ত্র।

*****

[নোট – বেশ দীর্ঘ বিরতির পর দ্বিতীয় পর্ব লিখে শেষ করতে পারলাম। লেখাটা পেশা হলে বেশ উপকার হতো, হয়তো আরো দ্রুত লিখতে পারতাম। (আফসুস)

প্রথম পর্বের তুলনায় এই পর্বটি বেশ ‘টেকনিক্যাল’। নিজে জীববিজ্ঞানের পড়াশোনা ছেড়েছি আট বছর আগে, সুতরাং শম্বুক গতি আর নিরেট মাথায় ভর করে এগুতে হলো। ছোটখাটো বা বড়োসড়ো প্রশ্নগুলো ঝালিয়ে নিতে পোস্টের অবতারণা।

অনুবাদ, ভাষাভঙ্গি এবং তথ্য সব দিক নিয়ে সকলের মতামত জানতে ‘হা’ করে বসে রইলাম!]

এই অধ্যায়ের তিনটা ফুটনোট দিয়েছেন লেখক। সেগুলো মন্তব্য সেকশনে হুবহু তুলে দিচ্ছি বোঝার সুবিধার্থে। আগ্রহী যে কেউ নোটগুলোকে অনুবাদ করতে পারেন, অশেষ কৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো! 🙂