কম্পিউটারের কারিগরি সম্পর্কে একটু যাদের ধারণা আছে তারা নিশ্চই ডিজিটাল সিসটেমের একটা সীমাবদ্ধতার কথা জানেন? সেটা হচ্ছে রেজলিউশন। মনে করেন আমার কম্পিউটার স্ক্রীন ৮০০ বাই ৬০০ এর মানে হলো আমার কম্পিউটার স্ক্রীনে মোট ৮০০x৬০০ টি পিক্সেল আছে। এখন আমি যদি চাই স্ক্রীনে একটা ডট আকতে। যেটা এক পিক্সেল সাইজের তখন আমাকে এই ৪৮০ হাজার বিন্দু থেকে যেকোনো একটা কে বেছে নিতে হবে। তার মানে কোনো একটা কলামে আমি বড়জোর ৬০০ টা স্থান বেছে নিতে পারি।

এখন আমি যদি একটা আনিমেশন করতে চাই যেখানে এরকম কিছু বিন্দু উপর থেকে নিচে নামছে। অনেকটা বৃষ্টির ফোটার মত। তখন চাইলেও আমি এই বৃষ্টিকে স্মুথ করতে পারবো না। স্ক্রীনের উপর একটা আতশ কাচ ধরলেই দেখা যাবে যে বিন্দুগুলো এক পিক্সেল থেকে আরেক পিক্সেলে লাফিয়ে চলে যাচ্ছে। স্ক্রীনের দুইটা পিক্সেলের মধ্যবর্তি স্থানে তাই কারো পক্ষে একটা বিন্দু দেখানো সম্ভব না। স্ক্রীন রেজোলিউশন অনেক বাড়িয়ে এ অসুবিধাকে আপাত দৃষ্টিতে কমানো গেলেও আমি যদি আরো শক্তিশালী আতশ কাচ ধরি তাহলে আবারো আমি পিক্সেলগুলোকে আলাদা আলাদা দেখতে পাবো।

কম্পিউটারের মেমরীতেও সব কিছু এরকম ডিজিটাইজড। মানে ছাড়াছাড়া আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন। বাস্তব জগতের মত ‘নিরবিচ্ছিন্ন’ নয়। তাই কম্পিউটারে ফ্লুইড সিমুলেশন করলেও সেটা তার নাম্বারের প্রিসিশন, ও অন্যান্য রেজলিউশন দ্বারা সীমিত থাকে। শেষ মেশ মাইক্রো স্কেলে সেটা হয়ে যায় বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমষ্টি। যাক গে আমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছিলাম সেটা মনে হয় আপনারা বুঝেই গেছেন। এখন কথা বাড়ালে আবার গুলিয়ে যেতে পারে সব। তার চে মূল কথায় আসি।

আগের প্যারাতেই লিখলাম ‘বাস্তব জগতের মত নিরবিচ্ছিন্ন নয়’ আসলেই কি বাস্তব জগত নিরবিচ্ছিন্ন?

আমাদের অভিজ্ঞতা বলে নিরবিচ্ছিন্ন। একটা বল যখন গড়িয়ে যেতে থাকে তখন সে ছোটো ছোট জাম্প করে যায় না। বরং ধারাবাহিক ভাবে সরে সরে যায়। আমাদের ধারণা মতে বাস্তব জগতে কোনো কিছু সরে যাওয়া আর ডিজিটাল জগতে কোনো কিছু সরে যাওয়াতে তাই বিস্তর ফারাক। কিন্তু এখন যদি বলি বাস্তব জগতেও আসলে সব বস্তু এরকম ছোটো ছোটো ধাপে সরে যায়? যদি বলি বাস্তব জগতেও রেজুলেশন নির্দিষ্ট। এর চেয়ে সুক্ষ কোনো কিছু নড়াচড়া করতে পারে না। নড়লে সেই ঐটুকু নাইলে নাই! খুব অবাস্তব শোনাবে কি তখন?

কোয়ান্টাম মেকানিক্স আমাদের এটাই বলছে। যেমন দৈর্ঘ্যের একটা মিনিমাম লিমিট আছে। তার চেয়ে ছোটো কিছু থাকতে পারে না। কোনো কিছু যখন সরে তখন এই ছোটো ধাপে লাফ দিয়ে দিয়ে সরে। যেন সে আমার কম্পিউটার স্ক্রীনের একটা পিক্সেল! এই সর্বনিম্ন দৈর্ঘ্যকে বলে ‘প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্য’

তেমনি ভাবে আমরা অনেকে লাটিম ঘুরিয়েছি। একটা লাটিম যখন ঘুরতে ঘুরতে থেমে যায়। আমরা ভাবি তার কৌনিক গতি বা কৌনিক ভরবেগ ধারাবাহিক ভাবে কমতে কমতে শূন্য হয়ে গেল। কিন্তু কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল জগতে তাকালে আমরা দেখতে পাবো এমনটা হয় না। কৌনিক ভরবেগের নিরধারিত কিছু মান থাকে। এবং কোনো কণার কৌনিক ভরবেগ লাফ দিয়ে লাফ দিয়ে এক মান থেকে আরেক মানে চলে যায়। মাঝা মাঝি কোনো মানের অস্তিত্বই নেই! এ যেন কম্পিউটারে করা সিমুলেশন। নির্দিষ্ট প্রিসিশনের কমে আর কিছু সম্ভব না!

পড়ছিলাম বোসন আর ফার্মিওন কণা নিয়ে। এদের স্পিন এমন হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায় ইলেক্ট্রনের কথা ইলেকট্রনের স্পিন সম্ভাব্য স্পিন (ক্লাসিকালি বললে কৌনিক ভরবেগ) দুই মানের $latex {-\hbar \over 2}$ এবং $latex {\hbar \over 2}$ এই দুই মান ব্যতিত ইলেকট্রনের অন্য কোনো মানের স্পিন সম্ভব নয়। একই ভাবে সব অনু পরমানুর ও স্পিন বের করা যায়। এখন বাস্তব জগতের বস্তুসমূহ যেহেতু এসব অনুপরমানূ দিয়েই তৈরি। তাদের কৌনিক ভরবেগও এ ধরনের নির্ধারিত মান মেনে চলে। মানে বড় করে ভাবলে যদি এই কোয়ান্টার সাইজ হতো পাঁচ, তাহলে আমরা দেখতাম লাটিমের ভরবেগ ২৫ থেকে হূঠ করে ২০ এর পর লাফ দিয়ে কমে ১৫ এভাবে বিচ্ছিন্ন ধাপে ধাপে ০ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাগ্যিস প্লাঙ্ক ধ্রুবক h এর মান এতই কম যে এ ধরনের লাফ, যেটা বাস্তব সব বস্তুই দেয়, তা আমরা অনুভব করতে পারিনা। অনুভব করতে পারিনা মানে যে হয় না তা নয়। পরীক্ষাগারে এটা নির্নয় করার উপায় আছে! জাস্ট আরো ‘শক্তিশালী আতশ কাচ‘ লাগবে।

এরকম কিছু অদ্ভুত কারণেই কোয়ান্টাম মেকানিক্স এত ইন্টারেস্টিং!

[সঙ্গত কারণেই লেখাটি অতিসরলীকরণদোষে দুষ্ট]