শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান এখন আদর্শিক সংঘাতের ক্ষেত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে চলেছে। বাংলাদেশে সরকার বদলের সাথে সাথে ইতিহাস বদলায়, আর ধর্মশিক্ষা তো বেশ অনেকদিন ধরেই প্রচলিত। রাষ্ট্রই বলে দিচ্ছে নাগরিকের রাজনৈতিক দর্শন কি হওয়া উচিত, কোন ধর্মটি পালন করা উচিত। ভয়ের বিষয় হল, এই চিত্রটি কমবেশি সার্বজনীন। যুক্তরাজ্যে এখন প্রতি তিনটি বিদ্যালয়ের মধ্যে অন্তত একটি আনুষ্ঠানিকভাবে কোন না কোন ধর্মের সাথে সম্পৃক্ত, এবং একারণে অন্যসব বিদ্যালয় থেকে এসব প্রতিষ্ঠান কিছু বিশেষ রাষ্ট্রীয় সুবিধা উপভোগ করে। এরকম পরিস্থিতিতেই রিচার্ড ডকিন্স চ্যানেল ফোরের জন্য তৈরী করেছেন একটি নতুন ও বিতর্কিত তথ্যচিত্র- “Faith School Menace?”

চার বছর বয়স থেকে শুরু করে টিন এজ বয়সের শেষভাগ পর্যন্ত্য মানুষের মস্তিস্ক কাজ করে একটা স্পঞ্জের মত, গুরুজনেরা যাই বলেন তাই তারা শুষে নেয়। বলাই বাহুল্য, স্কুল-কলেজ(বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো) ধর্মব্যবসায়ীদের খুবই প্রিয়। আমাদের সমাজে এখনও মানুষ বিশ্বাস করে যে ধর্ম সাথে নৈতিকতার একটা বৈবাহিক সম্পর্ক আছে, একটা নীতিবান জনগোষ্ঠী তৈরী করার জন্য বলে ধর্মশিক্ষার কোন বিকল্প নেই। ব্যাপারটা খুব আইরনিক, বিশেষ করে এই দেশের ইতিহাসের একটা কালো অধ্যায়ের পিছনে ধর্মবাদীদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল এবং বর্তমানে এরাই দেশবাসীকে দ্বীনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য গন্ডায় গন্ডায় বই প্রকাশ করছে এবং টিভিতে অনুষ্ঠান সম্প্রচার করছে(কুখ্যাত “কমলা দাড়ি” এর কাহিনী তো ব্লগ কমিউনিটিতে কমবেশি সবাই জানে)। আমাদের দেশে ধর্মশিক্ষার পক্ষে এই নৈতিকতার ভাঙ্গা রেকর্ডই বারবার বাজানো হয়, বিপক্ষের মতামতের উপর একদমই আলোকপাত করা হয় না(অবশ্য পত্র-পত্রিকায় ধর্মশিক্ষার বিপক্ষে লেখালেখি করার মত পরিবেশ এখনও এদেশে তৈরী হয়নি)। পশ্চিমে বিতর্কটা একটু ভিন্ন ধাচের। ডানপন্থীরা ধর্মশিক্ষার পক্ষে যুক্তি দেখান যে সন্তানের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নির্ধারণ করার অধিকার অভিভাবকদের আছে। এর বিপক্ষে রিচার্ড ডকিন্সের মত বিরোধী শিবিরের ব্যক্তিরা যুক্তি দেখান যে রাজনৈতিক দর্শনের মত ধর্মীয় দর্শন নির্বাচন করাও একটা শিশুর মৌলিক অধিকার। এই অধিকারের দ্বন্দ্ব নিয়ে একটি তুলনামূলক আলোচনা করাই এই তথ্যচিত্রের উদ্দেশ্য।

ষাট বছর আগে গীর্জা পরিচালিত বিদ্যালয়গুলো ছাত্র ও শিক্ষক নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় মনের সুখে বৈষম্য করতে পারত এবং তাদেরকে নিজস্ব পাঠ্যসূচি পড়ানোর স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, এসব বিদ্যালয়ে কি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তা রাষ্ট্রের পক্ষে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হত না। ষাট বছর আগের সব বৈশিষ্ট্য এখনও এ যুগের ফেইথ স্কুলগুলোতে পরিলক্ষিত হয়, তবে এখন সাধারণ মানুষকে এসব বিদ্যালয় পরিচালনার পূর্ণ খরচ দিতে হয়। মজার ব্যাপার হল, আপনি এসব স্কুলের খরচ বহন করলেও আপনার সন্তানকে ভর্তি করানোর কোন বাধ্যবাধকতা স্কুলগুলোর নেই। শিক্ষার্থী ভর্তি করানোর সময় স্কুলগুলো অভিভাবকের ধর্মবিশ্বাস ও গীর্জায় উপস্থিতির হারও চেক করে। আপনি ক্যাথলিক হলে প্রোটেস্ট্যান্ট স্কুলে পড়াতে পারবেন না(এবং ভাইস-ভারসা), গীর্জায় নিয়মিত উপস্থিত না থাকলেও আপনার সন্তানের ভর্তির আবেদন নাকচ করে দেওয়া হতে পারে। ব্যাপারটা খুবই বিপত্তিকর হয়ে যায় যখন আপনার বাসার কাছাকাছি আপনার ধর্মীয় গোত্রের পরিচালিত কোন স্কুল থাকে না এবং এলাকাটির একমাত্র সেকুলার স্কুল অনেক দূরে অবস্থিত থাকে, অক্সফোর্ডেরই একটি ম্যাপে ডকিন্স চিত্রটি তুলে ধরেন। অনেক অভিভাবককে সন্তানের জন্য নিজেদের বিশ্বাসকে বিসর্জন দিয়ে নতুন কোন ধর্মমত গ্রহণ করতে হয়, তথ্যচিত্রটিতে এরকমই এক দম্পতির সাক্ষাৎকার নেন অধ্যাপক ডকিন্স, যাঁরা প্রথমে প্রোটেস্ট্যান্ট হলেও পরে সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য ক্যাথলিক ধর্মমত গ্রহণ করেন। অনেক সময় শুধু ধর্মমত পরিবর্তন করেও লাভ হয় না, এলাকার ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে বাম হাতে উপঢৌকন দেওয়াও লাগে।

টনি ব্লেয়ারের আমলে ব্যাঙের ছাতার মত ফেইথ স্কুল গজিয়েছিল, সব ধর্মের ফেইথ স্কুলই গজিয়েছিল। ব্রিটিশ সমাজ বহুত্ববাদী সমাজ, বিষবাষ্প ছড়াতে চাইলে সব ধর্মমতের মানুষকেই বিষবাষ্প ছড়ানোর অধিকার দিতে হবে। যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিশ্বাস ছড়ানোর গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন সাবেক শিক্ষাসচিব চার্লস ক্লার্ক। তিনি পূর্বে ফেইথ স্কুলের বিপক্ষে থাকলেও পরে ভোটের মায়ায় নৌকা বদল করেন। এখন ফেইথ স্কুলের পক্ষে তাঁর যুক্তি হল অভিভাবকদের পূর্ণ স্বাধীনতা আছে সন্তানের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা। তাছাড়া ফেইথ স্কুল নাকি জনগণের প্রাণের দাবি। যুক্তরাজ্যের আইসিএমের পরিচালিত একটি জরিপে কিন্তু দেখা গিয়েছে যে দেশের ৫৯% মানুষ বিশ্বাস করে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবার জন্য উন্মুক্ত থাকা উচিত, ফেইথ স্কুলগুলোকে অর্থায়ন করা সরকারের একদমই উচিত না। তাছাড়া যেই দেশে মাত্র ৭% মানুষ গীর্জায় নিয়মিত প্রার্থনা করে এবং ৩৬% প্রাথমিক বিদ্যালয় গীর্জা দ্বারা পরিচালিত হয় এবং এই ৩৬% বিদ্যালয়গুলো যখন শিক্ষার্থী ভর্তির সময় অভিভাবকের ধর্মীয় ব্যাকগ্রাউন্ড অনুযায়ী আবেদনকারী ফিল্টার করে, তখন অভিভাবকদের কি আসলেই বিকল্প কোন মাধ্যম খোজার সুযোগ থাকে? যারা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়াতে চান না, তারা আসলে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে পড়ানো হতে বঞ্চিত হচ্ছেন, যদিও এসব বিদ্যালয় পরিচালনার টাকা ঠিকই তাদেরকে দিতে হচ্ছে। Mumsnet নামে একটি অনলাইন ফোরামে ব্রিটিশ অভিভাবকরা ছদ্মনামে সন্তান লালন-পালনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। সেই ফোরামে ডকিন্স ফেইথ স্কুল নিয়ে অভিভাবকদেরকে তাদের অভিজ্ঞতার ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। সবাই প্রায় একই রকম উত্তর দিয়েছিলেন। এক অভিভাবক বললেন যে তাঁর এলাকার তিনটি ফেইথ স্কুলের মধ্যে তিনটিই তাঁর সন্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে কারণ তিনি গীর্জায় যান না। বর্ণবৈষম্য হারাম, কিন্তু ধর্মের উপর ভিত্তি করে বৈষম্য করা ব্যাপক সওয়াবের কাজ!

ধার্মিক না হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সন্তানকে ভর্তি করানোর জন্য অভিভাবকেরা যে এত কাঠ-খড় পোড়ান, তার পেছনে আরেকটা কারণ হল প্রতিষ্ঠানগুলোর ফলাফল। একটি জরিপে দেখা গিয়েছে যে গত বছর স্যাট পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশই গীর্জা দ্বারা পরিচালিত। আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে বেশি বেশি বিশ্বাস করার কারণে ছেলে-মেয়েরা ভাল ফলাফল করছে, কিন্তু লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সের ডঃ স্টিভ গিব্বনস অর্ধেক মিলিয়ন শিক্ষার্থীর উপর গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে পাশাপাশি বাড়িতে থাকা ফেইথ স্কুলের শিক্ষার্থী ও সেকুলার স্কুলের শিক্ষার্থীর পারফরম্যান্সে তেমন একটা পার্থক্য নেই। ফেইথ স্কুলগুলোর ভাল ফলাফলের পেছনে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার প্রভাব রয়েছে।

ধর্ম মানুষের সমাজ ও সংস্কৃতিরই ফসল, তাই সমাজ-সংস্কৃতিকে বুঝতে চাইলে ধর্ম সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা দরকার। এর জন্য ধর্মগ্রন্থের একটা নির্মোহ বিশ্লেষণ দরকার, যেমন করে আমরা গ্রীক পুরাণের কাহিনীগুলো বিশ্লেষণ করি ঠিক সেভাবেই কোরান-বাইবেল-তোরাহ-গীতা বিশ্লেষণ করা উচিত। গ্রীক পুরাণের পক্ষে যেমন কোন প্রমাণ নেই, কোরান-বাইবেলের পক্ষেও ঐতিহাসিক-বৈজ্ঞানিক কোন প্রমাণ নেই। কিন্তু ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো ধর্মগ্রন্থের ক্রিটিকাল এনালাইসিসের ধারে কাছেও যায় না, তারা কচি শিশুদেরকে একটি প্রাচীন গ্রন্থের পূজো করা শেখায়। ইহুদি ও ক্যাথলিক বিদ্যালয়গুলোর ভেতরে ডকিন্স ও তাঁর ক্র্যুকে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি দেখে শেষ পর্যন্ত্য পরিসংখ্যানের জন্য ডকিন্সকে ব্রিটিশ হিউম্যানিস্ট এসোসিয়েশনের শরণাপন্ন হতে হয়েছিল। তাদের হিসাব থেকে জানা যায়, ব্রিটেনের ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক পক্ষকালে ৮ ঘন্টা ধর্মীয় শিক্ষা, ৬ ঘন্টা বিজ্ঞান শিক্ষা এবং মাত্র চার ঘন্টা খেলাধূলা, শিল্প, সংস্কৃতি প্রভৃতি অন্যসব সেকুলার বিষয়াদির শিক্ষা দেওয়া হয়। খ্রীষ্টান-ইহুদি বিদ্যালয়গুলো এই তথ্যচিত্রের শ্যুটিংয়ের জন্য তাদের দ্বার বন্ধ রাখলেও আশ্চর্যজনকভাবে মাদানী হাইস্কুল নামের মুসলমানদের জন্য লাইসেস্টারে অবস্থিত একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ডকিন্স ও তাঁর ক্র্যুকে স্কুলের ভেতরে ঢোকার অনুমতি দেয়। বিদ্যালয়টি অত্র অঞ্চলে ফেইথ স্কুলগুলোর জন্য একটি আদর্শ হিসেবে পরিগণিত হয়। অমুসলমান ছাত্রীদেরকে বোরখা পড়তে বাধ্য করার জন্য অবশ্য বিদ্যালয়টি সমালোচিত হয়েছে। বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষ ডঃ মোহাম্মদ মুকাদাম মুসলিম স্কুল এসোসিয়েশনের প্রধান। অধ্যক্ষ সাহেবের সাথে কথা বলার সময় ডকিন্স প্রশ্ন করেন যে ফেইথ স্কুলের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হল যে এগুলো শিক্ষার্থীদেরকে খোলা মনে পৃথিবীকে বুঝতে সাহায্য করে না, এরা শিক্ষার্থীদের শিখায় যে তাদের ধর্মগ্রন্থেই পৃথিবীর সব সত্য লুকায়িত রয়েছে। অধ্যক্ষ সাহেব এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেন যে তাঁর প্রতিষ্ঠানে নিজেদের জন্য সিদ্ধান্ত নিতে উৎসাহিত করা হয়, সবার বলে নিজস্ব মত লালনের অধিকার আছে। স্কুলের ছাত্রীদের সাথে কথা বলার সময় এক ছাত্রীও একই কথা বলল। তো ইসলামী মুক্তচিন্তার একটা পরীক্ষা হয়ে যাক। ডকিন্স তাদের প্রশ্ন করলেন যে তাদের কেউ মানুষ আর শিম্পাঞ্জীর আত্মীয়তার বৈজ্ঞানিক ফ্যাক্টটা গ্রহণ করে কিনা। ৩৬ জন ছাত্রীর সবাই কনফিডেন্সের সাথে বলল যে তারা বিবর্তনবিদ্যাকে গ্রহণ করে না। রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে পরিচালিত হওয়ায় বিদ্যালয়টিতে বিজ্ঞানের রাষ্ট্রীয় পাঠ্যসূচীই পড়ানো হয়ে থাকে এবং সেই সূত্রে তাদের জৈববিবর্তন সম্পর্কে শিক্ষা পাওয়ারই কথা। বিদ্যালয়ের এক বিজ্ঞান শিক্ষিকা বললেন যে রাষ্ট্রীয় পাঠ্যসূচি অনুযায়ী বিবর্তনবিদ্যা শিক্ষা দেওয়ার সময় তাঁরা শিক্ষার্থীদের এও মনে করিয়ে দেন যে ইসলাম জৈববিবর্তনকে গ্রহণ করে না। মজার বিষয় হল, দশম শ্রেণীর ষাটজন শিক্ষার্থীর মধ্যে ষাটজনই নিজে নিজে চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে বিবর্তনবিদ্যা আসলে ভুল। সমগ্র বিশ্বের জীববিজ্ঞানের সাময়িকীগুলোতে যেখানে নিয়মিতভাবে বিবর্তন সম্পর্কিত গবেষণাপত্র ছাপা হচ্ছে সেখানে একটি মুসলমান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ষাটজন শিক্ষার্থী বিবর্তনবিদ্যাকে ভুল প্রমাণ করে ফেলেছে। কি তাদের যুক্তি? “আমরা যদি এইপ থেকে বিবর্তিত হই, তাহলে এখনও এইপ দেখা যায় কেন?”, একজন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী(এবং একই সাথে হোমো সেপিয়েন্স, অর্থাৎ, এইপ) অধ্যাপক ডকিন্সের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়। ডকিন্স শিক্ষার্থীর শিক্ষিকাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন যে তাঁরা আদৌ বিবর্তনবিদ্যা পড়ান কিনা। শিক্ষিকা বেচারী আক্ষরিক অর্থেই তোতলাতে তোতলাতে বললেন যে তাঁরা নাকি ক্লাসে “মানুষ প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে” শিক্ষা দেন। এহেন শিক্ষা পাওয়ার পরও যদি কেউ উপরোক্ত প্রশ্ন করে, তাহলে তো সেটা সারা রাত কোরান পড়ে সকালবেলা “আচ্ছা ইসলামে কি হলি ত্রিনিটি আছে?” জিজ্ঞেস করার মত হয়ে গেল। এই ব্যাপারে অধ্যক্ষ সাহেবকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি সরাসরিই বলে বসলেন যে তাঁদের জানামতে কোন বৈজ্ঞানিক প্রকাশনায় বলে বিবর্তনকে সঠিক স্বীকার করা হয়নি, বিজ্ঞানীরা নাকি বিবর্তনবিদ্যা প্রত্যাখ্যান করেছেন। যেই বিদ্যালয়টি দাবি করছে যে তারা শিক্ষার্থীদেরকে নিজেদের মত করে চিন্তা করা শিখায়, সেই বিদ্যালয়টিই নগ্নভাবে বহু আগে প্রতিষ্ঠিত একটি বৈজ্ঞানিক কনসেন্সাসকে অস্বীকার করছে। এরকম ভন্ডামো আসলে সব ফেইথ স্কুলেরই সামগ্রিক চিত্র।

ফেইথ স্কুলের সমর্থনকারীরা প্রায়ই যুক্তি দেখায় যে প্রজন্মান্তরে ধর্মশিক্ষার মাধ্যমে তাদের সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখাটা তাদের মানবিক অধিকার। তাদের ধর্মই তাদের পরিচয়। সমস্যা হল, এই ধর্মীয় পরিচয়ের কারণেই একটি গোত্র আরেকটি গোত্র থেকে দূরে সড়ে যায় এবং সাম্প্রদায়িক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। আমি যে দেশের খাব, যে দেশের পড়ব, সেই দেশের জাতীয়তাই হওয়া উচিত আমার পরিচয়- একে বলে “কৃতজ্ঞতা”। যুক্তরাজ্যের খেয়ে-পড়ে মধ্যপ্রাচ্যের চেতনা ও পরিচয় বুকে ধারণ করাটা ভন্ডামো এবং অকৃতজ্ঞতার নিকৃষ্ট রুপ। খ্রীষ্টান-ইহুদি-ইসলাম ধর্ম মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্রীক, এগুলো “নাযিল” হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে এবং এগুলোর আনুগত্যও মধ্যপ্রাচ্যের প্রতি। ব্রিটিশ সমাজে জন্ম নিয়ে, ব্রিটিশ সমাজে বড় হয়ে, ব্রিটিশ সুযোগ-সুবিধার কল্যাণে একটি সুন্দর জীবন যাপন করে একজন মানুষের আনুগত্য কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যে পড়ে থাকে, তা কিছুতেই এই কুফরী ভরা মনে ঢুকে না। পৃথিবীতে ধর্মের অভাব নাই, ধর্মের মধ্যে আবার বিভিন্ন গোত্রেরও অভাব নেই, এসব গোত্রের মধ্যে আবার সাপে-নেউলে সম্পর্ক বিদ্যমান। ফেইথ স্কুলগুলো মুসলমান, ইহুদি ও খ্রীষ্ট ধর্মের অজস্র গোত্রের শিশু-কিশোরদের আলাদাভাবে শিক্ষা দিয়ে এদের মধ্যে “আমরা বনাম তারা” মানসিকতার বীজ বপন করছে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট বিভাজনই এর উজ্জ্বল সাক্ষী।

“Catholicism is more than a religion, it is a political power. Therefore, I’m led to believe there will be no peace in Ireland until the Catholic Church is crushed”- Oliver Cronwell

আয়ারল্যান্ডের রাস্তার একটি পোষ্টারে এই কথাটা লেখা। আয়ারল্যান্ডের রাস্তা-ঘাটের এরকম আরও অনেক চিত্র তথ্যচিত্রটিতে পাবেন। আয়ারল্যান্ডের রাজনীতিবিদরা ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে একসাথে কাজ করার ইঙ্গিত দিলেও ধর্মীয় শিক্ষা পুরনো সেই কোন্দলকে নতুন করে জাগিয়ে তোলার পায়তারা করছে। দেশটিতে সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা শুরু হয় নারসারী ক্লাস থেকেই। ২০১০ সালে জুলাই মাসের একটি দাঙ্গায় ১০ বছর বয়সী বাচ্চারা পর্যন্ত্য সহিংসতা প্রদর্শন করেছিল। ৯৫% আইরিশ শিশু হয় ক্যাথলিক নয়ত প্রোটেস্ট্যান্ট বিদ্যালয়ে গমন করে, তারা কেউ বিপরীত ধর্মমতের কারও সাথে কথা বলার সুযোগ পায় না। তারা বিয়েও করে নিজেদের মধ্যে, কর্মক্ষেত্রে বিপরীত ধর্মমতের কারও সাথে যদি দেখাও হয়, সেটা সমতা নিশ্চিত করার জন্য কর্মক্ষেত্রের বিধি-বিধানের কারণেই হয়। ধার্মিকদের মধ্যে নিজ সন্তানকে নিজের সম্পত্তি ভাবার একটি প্রবণতা থাকে, একারণে নিজেদের আদর্শিক পার্থক্যগুলোও তারা সন্তানের উপর চাপিয়ে দেয়। অভিভাবকদের অধিকার আছে সন্তানের জন্য শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা। কিন্তু সন্তানেরও অধিকার আছে নিজের ধর্ম, নিজের আদর্শ নিজে নির্বাচন করা। সন্তানের অধিকার হরণ করে অভিভাবকের অধিকার রক্ষা করতে গেলে আয়ারল্যান্ডের মত ভবিষ্যতে আমরা পৃথিবীর আরও অনেক ধার্মিক রাষ্ট্রেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শিশুদের ব্যবহৃত হতে দেখতে পাব। বাংলাদেশে হরতাল-মিছিলে পথশিশুরা কিছু টাকা-পয়সা পাওয়ার আশায় অংশগ্রহণ করে, সেখানে আদর্শের ব্যাপার থাকে না। আয়ারল্যান্ড বাংলাদেশের মত অভাবী না, সেখানে শিশুরা আদর্শিক কারণেই দাঙ্গার সময় প্রতিপক্ষের প্রতি ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করেছিল।

শিশুরা আসলে জন্মগতভাবেই “সৃষ্টিবাদী”, তারা এমন সব জায়গায় “উদ্দেশ্য” খুজে যেখানে আসলে কোন উদ্দেশ্যই নেই। ক্যামেরার সামনেই বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ ডেবোরাহ কেলেম্যান দু’টো পরীক্ষা করে দেখান। একটি শিশুকে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “পাথর কেন এত ধারালো হয়? একজন বলেছেন যে ছোট ছোট অনেকগুলো জিনিস দীর্ঘ সময় ধরে একটা আরেকটার উপর স্তূপীভূত হয়ে পাথরকে ধারালো করে। আবার আরেকজন বলেছেন যে পাথর ধারালো হলে পশুপাখিরা সেগুলোর সাথে ঘেষাঘেষি করে গা চুলকে নিতে পারে। তোমার কাছে কোনটা ঠিক মনে হয়?”। আরেকটা শিশুকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “হ্রদের পানি কেন স্থির থাকে? একজন বললেন যে হ্রদের পানি স্থির থাকলে পশুপাখিরা নির্ভয়ে সেখানে গোসল করতে পারে, তারা ভেসে চলে যায় না। কিন্তু আরেকজন বললেন যে হ্রদে গতিশীল পানি প্রবেশ করতে পারে না বলেই হ্রদের পানি স্থির থাকে। তোমার কাছে কোনটা সঠিক মনে হয়?”। দু’টো ক্ষেত্রেই শিশুরা টেলিওলজিকাল উত্তরটা বেছে নেয়, অর্থাৎ, যেসব উত্তর কোন বিশেষ “উদ্দেশ্য” প্রকাশ করে সেসব উত্তরই তাদের কাছে অধিক যৌক্তিক মনে হয়। যে বয়স থেকে একটি শিশু তার আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হয়, যে বয়সে সে বুঝতে পারে মানুষ টেলিফোন, টিভি, গাড়ীর মত বস্তু কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনের জন্য তৈরী করেছে, সেই বয়সেই সে বস্তুজগতকে ব্যাখ্যা করার জন্য একটি টেলিওলজিকাল মডেল গ্রহণ করে। সঙ্গত কারণেই শিশুদেরকে মগজধোলাই দেওয়া খুবই মামুলি একটা ব্যাপার। শিশুদের মগজধোলাই দেওয়াটা মানব সংস্কৃতির এত গভীরে প্রোথিত যে “মুসলিম শিশু”, “খ্রীষ্টান শিশু” শুনলে মানুষের কোন ভাবোদয় না হলেও “মার্ক্সবাদী শিশু”, “আওয়ামীপন্থী শিশু”, “বিএনপিপন্থী শিশু”, “অস্তিত্ববাদী শিশু”, “নৈরাজ্যবাদী শিশু” শুনলে মানুষ অবাক হতে বাধ্য হয়। রাজনৈতিক অথবা দার্শনিক আদর্শ ধারণ করার মত বৌদ্ধিক ক্ষমতা তো শিশুদের নেই, একারণে আমরা তাদের শৈশবে নিজেদের রাজনৈতিক-দার্শনিক আদর্শ গলাধঃকরণ না করিয়ে নিজের রাস্তা নিজে মাপার সুযোগ দেই। অথচ কোন এক অদ্ভুত কারণে মানুষ মনে করে শিশুদের আল্লাহ-খোদা, সৃষ্টিরহস্য নিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা আছে। আসলে বিষয়টা মোটেই অদ্ভুত না, শিশুবয়সে যদি ধর্ম দিয়ে মগজধোলাই করানো যায় তবে প্রাপ্তবয়সে একটি বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শের প্রতি তাদের অন্ধ আনুগত্য খুব সহজেই আশা করা যায়। ধর্ম শিক্ষা আসলে একটি ওরওয়েলীয় রাষ্ট্র গঠণের প্রাথমিক ধাপ, শুধু স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় ধর্মজীবি গোষ্ঠী। এই “শিক্ষা” পশ্চিমা বহুত্ববাদী সমাজে নির্মাণ করে বিভাজন, আর আমাদের এমনিতেই রক্ষণশীল সমাজে প্রশ্রয় দেয় মৌলবাদের। “Faith School Menace” এর মত সাহসী ও সময়োপযোগী তথ্যচিত্রই হয়ত একটি খুব প্রয়োজনীয় সামাজিক বিপ্লবকে পরিচালনা করতে সাহায্য করবে।

তথ্যসূত্র:-

১) http://www.secularism.org.uk/andhowdoesmadanihighschoolfitthe.html

২) http://www.bbc.co.uk/news/10624559

আরও দেখুন- ধর্মানুভূতিতে মারাত্মক আঘাত পেয়ে লাইফ-সাপোর্টে থাকা এক সাংবাদিকের রিভিউ- http://richarddawkins.net/articles/502261-guardian-review-faith-schools-menace । মন্তব্যগুলোও পড়তে পারেন, সাইটটির মন্তব্যের ঘরের বিতর্কগুলো বেশ প্রাণবন্ত ও শিক্ষণীয় হয়।