অপবাদ থেকে মুক্ত
উত্তর পুরুষ
ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ ছিলেন একজন উত্তম দার্শনিক। তিনি দার্শনিকতার উত্তম বিবেকটি সৃষ্টিকর্তার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন অতি সুন্দরভাবে যা আর কারো দ্বারা সম্ভব হয়নি। আর সেটি হলো দয়াময় আল্লাহতায়লাকে তিনি সকল প্রকার কলুষতা ও অপবাদ থেকে মুক্ত রেখেছেন। রোগ, দুর্ঘটনা, অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কিংবা আশ্চর্য হওয়ার মত যে কোন ঘটনার জবাবে বলা হয়েছে সেটা কপালের লিখন বা ভাগ্যের মন্দ। আবার কখনও কখনও অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে ওটা আল্লাহর ইচ্ছে, আল্লাহর খুশী, আল্লাহর মেহেরবানী। তিনি যা করেন তা মঙ্গলের জন্য করেন। কি রকম মঙ্গল তার কোন জবাব নেই। যে কোন দুর্ঘটনা বা বিপদ আপদের জন্য সৃষ্টিকর্তাকে দায়ী করা যায়না। দায়ী করা যায় তকদির বা ভাগ্যকে। এছাড়া আত্মশান্তনার কোন পথ্য মানুষের কাছে নেই। আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তা মহাশক্তিমান সুতরাং তাঁর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ, রাগ দেখানো, বা অভিমান করা নিতান্তই বোকামী, কারণ তিনি সর্বদাই ধরা ছোয়ার বাইরে। মানুষ জন্ম থেকেই দুর্বল এবং প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। তার জীবনে যা ঘটে, তা তাকে মেনে নিতে হয়। মানুষ যখন ছোট্ট-খাটো বিপদে পতিত হয় সে তখন কৃতজ্ঞতার সুরে বলতে থাকে ” ভাগ্যিস আমার হাতের আঙুল কাটা গেছে যাক কিন্তু চোখটা যে রক্ষা পেয়েছে, সেটাইতো আল্লাহর বড় মায়া”। মানুষ এভাবেই একটা আত্মশান্তনার ভিত্তি খুঁজে পায়। আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ করে কেউ কোন দিন লাভবান হয়নি বরং তার নিজের চরিত্রটাই কলুষিত হয়ে পড়ে। তাওরাত বাইবেল ও কোরআনের চতুর ধর্ম অবতারগণ নিজেদেরকে রক্ষার জন্য আল্লাহ বা সৃষ্টিকর্তাকে জড়িয়ে তাঁর সৃষ্ট এক অদ্ভূত অদৃশ্য জীব “শয়তানের” অস্তিত্ব ও চরিত্র তৈরী করেছেন নিজ মগজ থেকে। এতে কারো লাভ হোক বা না হোক, তাঁদের কওমের বা নিজের ভুল পদক্ষেপকে যে কোন সময় শয়তানের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে কলুষমুক্ত রাখার একটা সুযোগ চিরস্থায়ী করে রেখেছেন। জ্ঞানী মাত্রই বুঝেন মানুষকে আল্লাহ ভাষা ও জ্ঞান দিয়ে যেমন এক স্বতন্ত্র প্রাণী হিসেবে তৈরী করেছেন তদ্রূপ তার মনটাও সেরকম এক স্বতন্ত্র সত্ত্বা, স্বতন্ত্র গুণাবলী দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যার ফলে সে ভাল মন্দ বুঝতে পারে, তার মনে প্রলোভন জাগে, ইচ্ছা জাগে। সুতরাং সে ইচ্ছাকৃত ভাবে তার মনটা এদিক ওদিক চালাতে পারে। এখানে শয়তানের কোন ভূমিকা নেই। মানুষ শয়তানের অস্তিত্বকে স্বীকার করে এজন্য যে ওটা স্বীকার না করলে তাদের ধর্মগ্রন্থের ইজ্জৎ খাটো হবে। আর ধর্মগ্রন্থের ইজ্জৎ খাটো হওয়া মানেই নিজের নবীগণের প্রতি অপমান। এভাবে অপমান চলতে থাকলে ভবিষ্যতে ধর্মগ্রন্থ আরও সমালোচনার মুখে জবাবহীনতায় ধ্বসে পড়বে। সুতরাং আগে থেকেই যদি সতর্ক হয়ে চলা যায়, তাহলে ওটায় ফাটল ধরার বা ধ্বসে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই।
ধর্মের অনেক কাহিনী সত্য নয় বলে অপমান করা হবে,(যা যুগ যুগ ধরে জিয়ে আছে) এটা মানুষের কাছে অসহ্য। এজন্য প্রয়োজন হলে মানুষ জীবন বাজি রাখতে প্রস্তুত। প্রিয়তমার বুকে ধারালো অস্ত্র বসাতে ও দ্বিধা বোধ নেই। এটা এমনই এক আফিম, যার তুলনা বিশ্বব্রম্মান্ডের কোথাও নেই। এজন্য সকল প্রকার ধর্মীয় সমালোচনা সর্বশক্তি প্রয়োগ করে প্রতিহত করা হয়। ধর্ম এবং ধর্মীয় বিশ্বাস কারো পৈতৃক সম্পত্তি নয়। ওটা যদি আল্লাগর সম্পত্তি হয়ে থাকে তবে তা রক্ষা করার দায়িত্ব ও তাঁর নিজের। কারো সমালোচনাতে এত ব্যথিত হওয়া বা বদরাগী হওয়ার কোন কারণ নেই। মাটির মানুষ আল্লাহর একচুল পরিমাণ ক্ষতি করতে পারবে না, এই বিশ্বাস যেসব বিশ্বাসীদের (ঈমানদারদের) আছে তাদের বুঝা উচিৎ আল্লাহকে খুঁজে পাওয়ার অধিকার সমালোচনাকারীর ও আছে।
ধর্মগ্রন্থ আল-কোরআনে অনেক অবিশ্বাসী, রাজা, বাদশাহ, জালিম ও বহু নবীগণের জীবন কাহিনীর নানা ঘটনার কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু একটি ঘটনার ব্যাপারেও সন তারিখ ইত্যাদির উল্লেখ নেই। এমনকি জুলকারনাইন, তালুত, আদ সামুদ জাতি, মিশরের পিরামিড ইত্যাদির ও স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে এবং কোরআনে বার বার বলা হয়েছে “আল্লাহ হিসেব গ্রহণে অত্যন্ত তৎপর”। অথচ একটি ঘটনারও স্থান তারিখ কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে এসব বক্তব্য আল্লাহর দেয়া বুদ্ধিমান নবীগণের বা আউলিয়াগণের কৌশলী কাজ। আমরা (মানুষ) এক তরফা ভাবে একদিকে চিন্তা ও যুক্তি নিয়ে যখন ব্যস্ত থাকি তখন অপর দিকটাকে তলিয়ে দেখিনা, তা অবশেষে আধারে পরিণত হয়। আমরা ধর্মীয় কিচ্ছা কাহিনীর সত্যতা যাচাই দূরে থাক, ঐ সম্বন্ধে কোন কথা বলার ও চিন্তা করিনা। সুতরাং আমাদের মুক্ত চিন্তার প্রবাহ এখানেই মৃত হয়ে যায়। তুলনামুলক যাচাই না করা পর্যন্ত সত্য উদ্ভাসিত হয়না। মুক্ত চিন্তার অপর নাম সত্যের সন্ধান, নিরপেক্ষতা ইত্যাদি। আমরা কি নিরপেক্ষ মন ও চিন্তাধারা নিয়ে পৃথিবীর অন্যান্য মানবগোষ্ঠীকে বিচার করেছি ? নিজেদের জাতি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ এই হিসেবে আমরা পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে জাতিকে বিচার করি, তা থেকে সব সত্য বেরিয়ে আসেনা।

আজকের পৃথিবীতে এমন কোন দিক নেই, যেদিক নিয়ে মানুষ গবেষণা করেনা। গবেষণার জন্য পৃথিবীতে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচা হচ্ছে, প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। বহু সত্য আবিস্কৃত হয়ে বাস্তবতার কাঠামোয় জীবন চলছে। অথচ আমাদের গবেষণাগার হচ্ছে একটি মসজিদ না হয় মন্দির, যেখানে গবেষণা দূরে থাক পুরানো কেচ্ছা-কাহিনীর পোড়া মড়া শিকড় নিয়ে নাড়াচাড়া করা ছাড়া আর কিছুই নেই। একই বিষয়কে বার বার ঘুরে ফিরে নানা নমুনায় বলা হয়েছে যা পাঠক মাত্রই বুঝতে সক্ষম। (যদি তা মাতৃভাষায় অনুবাদ হয়ে থাকে) যে আল্লাহর সৃষ্টির স্তরে স্তরে রয়েছে জ্ঞান আহরণের ভাণ্ডার আমরা সেদিকে তাকাইনে। সৃষ্টিকর্তার কত রূপ, কত মহিমা তা জানতে ও দেখতে চাইনে। আমরা শুধু চাই ভাষার বুলিতে কতকগুলো অবোধগম্য শব্দ বা বাক্যের বহুজাতীয় অর্থ আছে কি’না তা যাচাই করে দেখা। এই উদ্দেশ্যে সুযোগ পেলেই বলে উঠি এইতো পেয়েছি, এই কথাটির মানে হচ্ছে এই, যা আমার দ্বীনের নবী চৌদ্দশো বছর আগে ইঙ্গিতে বলে গেছেন, এখন তার ফল হাতে নাতে পাওয়া যাচ্ছে (নিচের উদাহরণ দেখুন) এর চেয়ে আর চরম সত্য কি হতে পারে ? এজন্য আবেগে গদ গদ হয়ে আসমানী কিতাবে চুমু খেতে খেতে বিভোর হয়ে যাই। একটি উদাহরণ : যা আমি একজন অতিরক্ষণশীল ব্যক্তির কাছ থেকে শুনেছি। আজকের যুগে বহুদেশে বহু ধরনের জঙ্গী বিমান তৈরি হচ্ছে। ঐসব বিমানের মধ্যে আমেরিকান একটি বিশেষ বিমান যা তিনটি বৃহৎ বোমা একত্রে বহন করে লক্ষ্যস্থলের উপর তা নিক্ষেপ করতে পারে। বোমাগুলোর অবস্থান হলো বিমানের দু ডানার নীচে দু’টি এবং সম্মুখের ককপিটের ঠিক নীচে একটি। এই তিনস্থানে তিনটি বোমা বহন করে নিয়ে যাওয়া এবং নিক্ষেপ করার পদ্ধতি ও সুত্রটি নাকি কোরআন থেকে নেয়া হয়েছে। আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করি কি ভাবে ? তিনি বলেন জানেন না ? ঐ যে ছুরা ফীল এ (আলামতারা কাইফাফা) আবাবিল পাখির উল্লেখ আছে। ঐ পাখিতো দু’ডানার নীচে দু’টি কঙ্কর এবং ঠোটের মধ্যে ধারণ করে নিয়েছিল একটি কঙ্কর, তারপর তা কাবাঘর ধবংসকারী বাদশা আবরাহার দলবলের উপর নিক্ষেপ করেছিল। ঐ সুত্র থেকেই তো এই জঙ্গী বিমানের আবিষ্কার। আমি কথা বাড়াইনি, শুধু মনে মনে বলেছি “ধরিত্রী দ্বিধা হও”। ধৃষ্টতা আর কা’কে বলে ?
যা হোক, লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আসমানী কিতাবের অনেক কথা বর্তমান বাস্তবের সাথে মিল খাচ্ছেনা। আবার আসমানী কিতাব ছাড়াও পৃথিবীর বহু সামাজিক কিতাবের বাণী জীবনের বহু পদে পদে মিলে যাচ্ছে। পৃথিবীতে বহু গবেষণার মাধ্যমে সত্য আবিষকৃত হচ্ছে অথচ অনন্তকাল মানুষ নরকে পুড়বে (ধর্মীয় কথা) এ ভয় কার নেই ? এভয় সবারই আছে। সামান্য মনকষ্ট না হওয়ার জন্য বা যৎসামান্য দৈহিক ক্ষতিগ্রস্থ না হওয়ার জন্য পৃথিবীর বহু দেশে কত আইন, কত ব্যবস্থা, কত বিচার পদ্ধতি প্রচলিত হয়েছে। অথচ মানুষ অনন্তকাল পুড়বে এই অসহায় অবস্থার মুক্তি চিন্তা কি জ্ঞানী ও গুণী জগতের মানুষের মাথায় নেই ? নিশ্চয়ই আছে। আছে বলেই তারা প্রতিনিয়ত গবেষণায় ব্যস্ত। কোটি কোটি টাকা এসবের পেছনে খরচা হচ্ছে, কিন্তু বাস্তব সত্য আজো ঠিক ঠিক মানুষের নাগালে আসেনি। পৃথিবীর সব জাতি কমবেশ বিশ্বাস করে সৃষ্টিকর্তা আছেন। কিন্তু কি তাঁর রূপ ? কি তার কার্যাবলী ? কি তাঁর ব্যস্ততা ? তা কেউ জানেনা। জানেনা বলেই উহা চির রহস্যময়। এজন্য আন্দাজ অনুমানের উপর গভীর ধ্যান সাধনা করে নিজের বিবেক থেকে তৈরি কথাবার্তাকে আল্লাহর দেয়া সমাধান বলে সব যুগে সব সমাজে চালিয়ে দেয়া যায়না। এতে শুধু দ্বন্দ্বের সুত্রপাত হয়। আদি যুগে সমাজবিধি ও সংসারবিধি তৈরী হয়েছিল বিভিন্ন ধাপে ধাপে। তখন সমাজের অবস্থা ছিল নবজাত সন্তানের মত। বসা, হামাগুড়ি দেয়া বা দাড়ানোর জন্য তাকে আশ্রয় খুঁজতে হয়েছে। কোলে কাঁখে করে সমাজ নামক শিশুটিকে বাড়তে দেয়া হয়েছে। এই শিশু এখন বয়সের বিপুল ধাপ অতিক্রম করে শুধু দৌড়ানো শিখেনি, শুন্যে বাতাসের বক্ষ ভেদ করে যথা ইচ্ছে যেতে পারে। সুতরাং এই শিশুকে অতীতের মত এখনও হামাগুড়ি কিংবা কোলে কাঁখে করে আগলে রাখার কোন যৌক্তিকতা নেই। মানব কল্যাণের জন্য যুগ উপযোগী যে কোন আইন বা সামাজিক প্রথাকে তৈরি করে নেয়া কোন অপরাধ নয়। বরং অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে মানুষ নতুনকে কাজে লাগালে আরও বেশী উপকৃত হবে।

বাক কৌশল
উত্তর পুরুষ
আল্লাহ কিংবা ইশ্বর সম্বন্ধে কেউ যদি কোটি কোটি শব্দ লিখে বই রচনা করে মানুষ সেটা বিশ্বাস করবে। অনুমান করে বলা যায় ৯৭% মানুষ তা মানবে। এখানে বিরোধিতার কোন কারণ নেই। কারণ মানুষ তার জীবনের চারপাশের প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে অতি সহজে আল্লাহর অস্তিত্বের পক্ষে হাজারো প্রমাণ পাচ্ছে। এখানে অতিরিক্ত যুক্তি কিংবা বিরোধিতার প্রশ্ন অচল। এই আকাশ, বাতাস, চন্দ্রসুর্য, মহাসাগর, জীবজন্তু, একটি শিশুর সুনিপুন জন্ম কৌশল, মাটির উৎপাদন ক্ষমতা এসব কেমন করে হল ? কেমন করে ক্রমাগত ভাবে এক নিয়মতান্ত্রিক শৃঙ্খলাপথে এসব আবর্তন হচ্ছে ? সব মিলে হাজার হাজার প্রমাণ মানুষের চারপার্শে। সুতরাং আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি ও আবর্তন সম্বন্ধে অধিকাংশ মানুষের কোন সন্দেহ নেই। এই সহজ সম্বলকে বিশ্বাস করে পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে ধর্মের অণুরেনু। যে কেউ আল্লাহ বা ইশ্বরে বিশ্বাসী হয়ে কথা বললে তাঁকে কোনঠাসা করার কোন কারণ নেই। ঐ ব্যক্তি যদি নিজের ইচ্ছাশক্তির কৌশলে আল্লাহ কিংবা রাছুল সম্বন্ধে হাজারো গল্প ফেঁদে বসে তা’তে অবিশ্বাসের কিছু নেই। ( যেমন করে হাদিস লেখকগণ করেছেন) কারণ আল্লাহর সাথে দেখা সাক্ষাত করা কিংবা সেই গল্পের ফাঁক-ফোকরে ঢুকানো নিয়ম কানুন সত্য কি মিথ্যে তা যাচাই করার কোন পথ নেই। তা সাধ্যের বাইরে। সাধারণ বিবেচনার দিক থেকে উহা অগ্রহণযোগ্য মনে হলেও ইহা আল্লাহর বিধান বলে মেনে নিতে হয়। এমনকি এর বিপরীতে কি মঙ্গল নিহিত আছে তা ভবিষ্যৎের উপর ছেড়ে দিয়ে তা মানতে হয়। কাঁটা দিয়ে যেমন কাঁটা তুলা যায়, মিথ্যে দিয়ে যেমন মিথ্যে প্রমাণ করা যায় তদ্রূপ সত্য দিয়ে সত্যকে খণ্ডন করা যায়। অর্থাৎ বড় সত্য দিয়ে ছোট সত্যকে অতিক্রম করা যায়।
আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে আল্লাহ ও ধর্ম সম্বন্ধে যত কথা ও গল্পের আভরনে নিয়ম কানুন তৈরী হয়েছে তার থেকে বহুগুণে বেশী গল্প যদি কেউ তৈরী করতে পারে এবং তা যদি আল্লাহর অনুকুলে হয় তাহলে (বিজ্ঞান শিক্ষায় বঞ্চিত সমাজে) সে ধর্মে আরও বেশী লোক দীক্ষিত হবে। উদাহরণ সরূপ বলা যায় ধর্মগ্রন্থ কোরআনে আছে “পৃথিবীর সমুদয় বৃক্ষ যদি কলম হয় এবং যতটুকু সমুদ্রজল পৃথিবীতে আছে, সেরকম আরও সাত সমুদ্রের জল যদি একত্রে কালি হয়, তবুও আল্লাহর গুণাবলী লিখে শেষ করা যাবেনা। (ছুরা লোকমান আয়াত ২৭) এসব কথা হলো বাক-কৌশলের একটি চালাকি (অর্থাৎ গলাবাজি) এই যদি আল্লাহর কথা হয় তাহলে কোরআন কেন মাত্র ৬৬৬৬টি আয়াতে শেষ হবে ? (আয়াতের সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে) উচিত কমপক্ষে ছয়হাজার কোটি আয়াত আনয়ন করে তার কিছুটা প্রমাণ দেয়া।
যাইহোক আয়াতটির অভ্যন্তরে আল্লাহর মহাত্ম্য ছাড়াও আরেকটি উদ্দেশ্য নিহিত আছে । যার মুল উদ্দেশ্য হলো কোরআনের বাক্যের ব্যাপকতা ও গভীরতাকে বেশী করে বুঝানো। অর্থাৎ আয়াতের কথাটিকে কেউ যাতে সহজে পরাভূত করতে না পারে তা একটা কৌশল মাত্র। ইংরেজীতে যেমন সহজ কথায় বলা হয় “নোবডি ক্যান বীট আওয়ার প্রাইস” অর্থাৎ আমরা আমাদের দোকানে দ্রব্য মুল্যের দাম যে ভাবে কমিয়ে রেখেছি আর কোন দোকান সেটা করতে পারবেনা। অতএব উপরের কোরআনের আয়াতের কথাটিকে যদি কেউ পরাস্ত করতে ইচ্ছে করেন তবে তাকে আরও বড় গলায় সত্যবাক্য বলতে হবে যেমন: “পৃথিবী ও মহাশুণ্যের সকল গ্রহে উপগ্রহে যত জলরাশি রয়েছে সেরকম কয়েক লক্ষগুণ জল রাশিতে কালি বানিয়ে এবং পৃথিবী ও মহাশুণ্যের সকল গ্রহ উপগ্রহে যত বৃক্ষরাজি আছে তাই দিয়ে কলম বানিয়ে অসংখ্য ফেরেশতা দিয়ে যদি প্রতি মিনিটে দশ হাজার পৃষ্ঠা করে লিখা হয় এবং তা লিখতে লিখতে কেয়ামত অতিক্রান্ত হয়ে যায় তবুও আল্লাহর গুণাবলী লিখে শেষ করা যাবে না।” কোরআনের আরেকটি আয়াতের প্রতি লক্ষ্য করুন (দুঃখিত এই মুহুর্তে ছুরার নাম স্মরণ হচ্ছে না) “আমি যদি এই কোরআন পাহাড়ের উপর অবতীর্ণ করতাম তাহলে তোমরা দেখতে তা আল্লাহর ভয়ে বিদীর্ণ হয়ে গেছে।” এই বাক্যটিকে আরও জোরলো সত্যবাক্য দিয়ে পরাজিত করা সম্ভব যেমন: “এই ধর্ম গ্রন্থ যদি আল্লাহ সুর্যের উপর অবতীর্ণ করতেন তা হলে “ মহা উত্তপ্ত সুর্যও” শিশুদের মুখের ফুৎকারে নির্বাপিত প্রদীপের মতো আল্লাহর ভয়ে নির্বাপিত ও বিদীর্ণ হয়ে যেত।”
উপরে যে দু’টি উদাহরণের কথা বলা হলো তা নিশ্চয়ই লেখকের মেধা থেকে উৎপন্ন এবং বিষয়টি আল্লাহ বিশ্বাসের ও আল্লাহ ভক্তির অনুকুলে। এভাবেই এক ধর্মাবতার আরেক ধর্মাবতারকে নিজের মেধা ও প্রজ্ঞার দ্বারা টেক্কা দিয়ে উপরে উঠে এসেছেন। শুধু তাই নয় এসব কৌশলকে কেউ যাতে অতিক্রম করতে না পারে তারজন্য আছে আর ও বাককৌশলের নিপূণ হাতিয়ার। যেমন: কোরআনের ছুরা “সাবা” আয়াত পাঁচ, এবং আয়াত আটত্রিশে আছে “যারা প্রবল হওয়ার উদ্দেশ্যে আমার বাক্যকে ব্যর্থ করার চেষ্টা করে তাদের জন্য ভয়ঙ্কর মর্মান্তিক শাস্তি রয়েছে।” ছুরা লোকমানের সাত নম্বর আয়াতটিও অনুরূপ ভাবে প্রযোজ্য। এভাবে প্রতিটি কথার যুক্তিকে আগে থেকে কর্তন করার ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে কোরআনে।
পূর্ব যুগের ইহুদী ধর্ম ও খৃষ্টান ধর্মের ভেতর যে সমস্ত ধর্মীয় কাহিনীর সুত্রপাত ও বিকাশ ঘটেছিল তাকে আবর্ত করে ধর্ম হিসেবে স্বীকার করে কোরআন তার অতিরিক্ত শাখা গজিয়ে নতুন ফুল ও ফলদান করেছে মানুষকে। সেযুগে মানুষ অন্যায়কে প্রাধান্য দিয়ে বিপথগামী হয়েছিল। অন্যায়ের বিপরীতে ‘ন্যায়’ বলে যে শব্দটি আছে
তা বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সত্যি কথা বললে বলতে হয় মানুষের মধ্যে ন্যায় অন্যায় বোধ ও বিচার বিবেককে সত্যের শিক্ষা হিসেবে কেউ সামাজিক ভাবে চিহ্নিত ও প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। যাদের জোর ও প্রভাব ছিল তারাই নিজ নিজ এলাকায় তাদের নিজস্ব স্বার্থের নীতিকে ‘ন্যায়বোধ’ হিসেবে গড়ে তুলেছিল। (যেমনটি আজকের বাংলাদেশে হচ্ছে) এতে করে নিজের বাঁচার তাগিদে অন্যের উপর জুলুম কিংবা তার মালামাল লুট কিংবা কাউকে দুর্বল পেয়ে তার থেকে শ্রম আদায় করার ফলে আরেকজনের কি ক্ষতি হচ্ছে ? কি মনকষ্ট হচ্ছে ? এই বোধটুকু সমাজের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত ছিলনা। বরং প্রতিষ্ঠিত ছিল মজলুমের চোখের কান্না এর বিপরীতে প্রতিশোধের এক জমাট বাধা নির্মম ইচ্ছে।
ইসলাম পূর্ববর্তী ধর্মকে অস্বীকার করেনি বরং ওখান থেকে সে তাঁর গল্পের সব উপকরণ নিয়ে এসেছে। তা না হলে মুসা, ঈসা, আব্রাহাম (ইব্রাহিম) ইফসুফ, ইউনুছ ও তৎপরবর্তী অনেক ধর্মাবতারদের যে কাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে (কিছু লিখিত কিছু অলিখিত) বিশেষ করে রূপকথা ও লোকগাঁথা বা প্রবাদগাঁথা কাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা কেন কোরআনের উপকরণ হবে ? মধ্যপ্রাচ্যে তখনও গৌতম বুদ্ধের কোন কাহিনীর প্রভাব পড়েনি, পড়লে তাও হয়তো কোরআনের উপকরণ হিসেবে কাজে লাগতো। আল্লাহর মহিমা ও গুণাবলী যদি পৃথিবীর সমস্ত সমুদ্রজলে কালি ও বৃক্ষ দ্বারা কলম বানিয়ে লিখে শেষ করা না যায় তাহলে দাউদ, সুলায়মান, ঈসা, মুসা বা ইহুদীদের কাহিনী আর মক্কাবাসীর দাঙ্গা-ফ্যাসাদকে উপকরণ হিসেবে বেছ নেয়ার কারণ কি ? ইহুদীরা বলছে তাদের কাহিনী তাদের ধর্মের জন্য । তদ্রূপ খৃষ্টানরা বলছে তাদের ধর্মীয় গল্প তাদের জন্য। মোহাম্মদ তা থেকে উপকরণ নিয়ে নিজের প্রজ্ঞা ও মেধার বলে নতুন ধর্ম তৈরী করছেন। কোরআনে তাঁদের ও তাঁদের পূর্বপুরুষদের গল্পকে সংক্ষিপ্ত ভাবে লেফাফা দুরস্ত করে পুনরায় ইহুদী খৃষ্টানদের কাছে বিলিয়ে দিচ্ছেন। (অর্থাৎ ধর্ম প্রচার ও ধর্মের দাওয়াত দিচ্ছেন ) হযরত মোহাম্মদের সেকালীন এবং একালীন মুখপাত্ররা বলছেন “ মুহম্মদতো সরল সোজা মানুষ, নিরক্ষর মানুষ, এসব কেচ্ছা কাহিনীর তিনি কিছুই জানেন না, আল্লাহর ইচ্ছায় তিনি ওহী হিসেবে এসব জেনে নিচ্ছেন জিব্রাইল মারফত। তিনি তো আল্লাহর মনোনীত নবী। মুখপাত্রদের এই যে বিনয়ী হয়ে কথা বলার ভঙ্গী তাও এক ধরনের ন্যাকামী ছাড়া আর কী-ই বা বলা যায়। (বাক্যটি অবোধগম্য ? তাহলে পরবর্তীতে পড়ুন ‍ “ইসলাম ধর্মের উপকরণ”) । সুতরাং ইহুদী খৃস্টান বিধর্মী আখ্যায়িতদের কাছে এ দাওয়াত ঠিক যেন মায়ের কাছে মামার বাড়ীর গল্প।

যে কোন কথা যে কোন গল্প নিখুঁত ভাবে এবং কৌশলগত ভাবে প্রয়োগ করার সাধ্য থাকলে মানুষের মনকে সহজে জয় করা যায়। এরকম ভাল ভাল প্রয়োগ আছে স্বয়ং কোরআনেও যেমন: কোরআনের প্রথম ছুরা ‘ফাতেহার’ পর ছুরা বাক্বারার প্রথম আয়াতে বলা হয়েছে “এই সেই কিতাব যার সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই, যা সাবধানীদের জন্য পথ প্রদর্শক। যারা অদৃশ্যে বিশ্বাস করে, যথাযথ ভাবে নামাজ, পড়ে ও তাদের যা দান করেছি তা থেকে ব্যয় করে।” উলিস্নখিত বাক্যগুলোকে ধর্মানুরাগীরা সুন্দর করে নিজেদের প্রজ্ঞা ও মেধার বলে শুরু থেকে সাজিয়েছেন। এখানে আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তা শুরু হয়নি। যদি আল্লাহর কথা অনুযায়ী শুরু হতো তা হলে সর্বপ্রথম “পড় তোমার প্রতিপালকের নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে রক্তপিন্ড থেকে “। অর্থাৎ ছুরা আলাক (ইকরা বিইছমি রাবি্বকাল্লাজী) সর্বপ্রথম পাঠ করার বিধান হতো। কেননা হযরত মোহাম্মদ নিজেই বলেছেন এ ছুরাটি সর্বপ্রথম নাজিল হয়েছে। সত্যি যদি তাই হয় তাহলে আলেফলাম মীম, যালিক্বাল কিতাবুলা রাইবা-ফি-হি। শুরু করার কারণ নিশ্চয়ই মানুষকে ধর্মীয় ছায়াতলে আকর্ষণ করার কৌশল মাত্র।