Theodor Verhoeven (থিওডোর ভারহোভান) নেদারল্যান্ডস থেকে সুদূর ইন্দোনেশিয়ার ফ্লোরেস দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছিলেন ধর্ম প্রচারের জন্য। কিন্তু পাহাড়-পর্বত আর প্রাগৈতিহাসিক ঐতিহ্যের হাতছানি তার অন্তরে ধর্মের চেয়েও গভীরভাবে প্রোথিত কৌতুহলটিকে জাগিয়ে তুলেছিল হয়ত, পুরো দ্বীপটি চষে বেরিয়েছিলেন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোঁজে। প্রায় সবগুলো প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানই তিনি খুঁজে বের করেছিলেন, এর মধ্যে ছিল অতি বিখ্যাত লিয়াং বুয়া, ২০০৩ সালে যেখান থেকে হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস নামক বামন প্রজাতির একটি প্রায় পূর্ণাঙ্গ ফসিল উদ্ধার করা হয়েছে। মানুষের এই প্রজাতিটি মাত্র ১৭,০০০ বছর পূর্বে বিলুপ্ত হয়েছে। তার মানে আমরা সভ্যতার দিকে যখন যাত্রা শুরু করে দিয়েছি তখনও পৃথিবীর বুকে আমাদের একাধিক প্রজাতি ঘুরে বেড়াতো যারা কখনো আমাদের জীবনসঙ্গী হতে পারতো না।

ফ্লোরেস দ্বীপের অবস্থান ওয়ালেস রেখার পূর্বে কিন্তু লাইডেকার রেখার পশ্চিমে, ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপ থেকে পূর্ব দিকে বিস্তীর্ণ দ্বীপগুলোর একটি এটি। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের সহ-আবিষ্কারক আলফ্রেড রাসেল ওয়ালেসের নামেই এই রেখার নাম রাখা হয়েছে, ওরিয়েন্ট থেকে অস্ট্রেলিয়ার প্রাণীকূলকে আলাদা করার জন্য তিনি এই রেখা প্রস্তাব করেছিলেন। অর্থাৎ এই রেখা পার হলেই প্রাণীদের মধ্যে আমরা ভিন্ন ধরণের বৈশিষ্ট্য দেখতে পাব। এ রেখার পূর্বের দ্বীপগুলোকে একসাথে ওয়ালেশিয়া বলা হয়। রিচার্ড লাইডেকার দেখলেন ওয়ালেশিয়ার প্রাণীদের সাথে অস্ট্রেলিয়া ও নিউ গিনির প্রাণীদের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, তাই অঞ্চল দুটির মাঝে আরেকটি রেখা টেনে দিলেন যার নাম হল লাইডেকার রেখা। ফ্লোরেস পড়ে গেল এই দুই রেখার মাঝে। ৫০ এবং ৬০-এর দশকে ভারহোভান এখানকার একটি ক্যাথলিক সেমিনারিতে ধর্মযাজক হিসেবে কাজ করতেন আর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খুঁজে বেড়াতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্নতত্ত্ব পড়ার সুবাদে প্রায় ডজন খানেক স্থান পেয়েও যান, কিন্তু বিজ্ঞানীরা তার আবিষ্কারগুলোকে তখন গুরুত্ব দেয়নি।

এর প্রায় ৩০ বছর পরে নেদারল্যান্ডস ও ইন্দোনেশিয়ার একটি যৌথ বিজ্ঞানী দলের অনুসন্ধান ভারহোভানের গবেষণাকে নতুন মাত্রা দেয়া, ভারহোভান সত্যিকার অর্থেই ফ্লোরেসে প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানের অগ্রদূত বনে যান। বিজ্ঞানীদের এই দলটি প্রথমে সোয়া অববাহিকায় ৭ লক্ষ বছরের পুরনো পাথরের অস্ত্র ও ফসিল খুঁজে পায়। এগুলোর বয়স বের করা হয়েছিল জীবাশ্ম-চুম্বকত্বের (প্যালিওম্যাগনেটিজম) মাধ্যমে। এসব নমুনা আমাদের একাধিপত্যকে আরেকটু ম্লান করে দেয়, কারণ আমরা বুঝতে পারি হোমো স্যাপিয়েন্স দের অনেক আগেই কেউ ওয়ালেস লাইন অতিক্রম করেছিল। আমাদের উদ্ভব মাত্র ২ লক্ষ বছর আগে যেখানে ফ্লোরেস দ্বীপে ৭ লক্ষ বছরের পুরনো বুদ্ধির নমুনা পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং কারো বুঝতে বাকি থাকে না যে আফ্রিকার আদিম কোন প্রজাতিই ওয়ালেস লাইন অতিক্রম করে এখানে পাড়ি জমিয়েছিল বহু আগে।

যাজক ভারহোভান লিয়াং বুয়া আবিষ্কার করেছিলেন ১৯৬৫ সালে, আর সেখানে অস্ট্রেলিয়া-ইন্দোনেশিয়ার একটি বিজ্ঞানী দল পুরোদস্তুর উদ্ধার তৎপরতা শুরু করেছে ২০০১ সালে। আঞ্চলিক ভাষায় লিয়াং বুয়া শব্দের অর্থ শীতল গুহা। এই শীতল গুহার চক্ষু শীতলকারী আবিষ্কার ছিল “লিয়াং বুয়া ১” (এলবি১) নামের ফসিলটি। ২০০৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর, শনিবার- বেনিয়ামিন টারুস গুহার ৭ নম্বর সেক্টরে কাজ করার সময় হঠাৎ একটি মাথার খুলির উপরিভাগ দেখতে পান। প্রথমে দেখে মনে হয়েছিল কোন মানব শিশুর ফসিল, নয়ত খুলি এত ছোট হবে কেন। কিন্তু আরেকটু খননের পর যখন দাঁতের পাটি বেরিয়ে আসে তখনই বিস্মিত হবার পালা- দাঁতগুলোই বলে দিল যে এ ফসিল কোন পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তি ছাড়া আর কারো হতে পারে না। কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এলবি১ এর মাথার খুলির বাকি অংশ উন্মোচন করা হয়। কোন প্রজাতির সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ যে ফসিলটি পাওয়া যায় এবং প্রজাতিটির আদর্শ হিসেবে বিজ্ঞানীরা যে ফসিলটিকে তুলে ধরেন সেটাকে বলা হয় হলোটাইপ ফসিল। হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস প্রজাতির হলোটাইপ ফসিলে পরিণত হয় এলবি১। ৩০ বছর বয়সের এই নারীকে অনেকেই “দ্য লিটল লেডি অফ ফ্লোরেস” নামে ডাকেন, অনেক আরো সংক্ষেপ করে বলেন “ফ্লো” (Flo)। তার ফসিলের প্রাথমিক বর্ণনা দিয়ে নেচার পত্রিকায় গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ২০০৪ সালের ২৮শে অক্টোবর, এতেই প্রথমবারের মত হোমো ফ্লোরেসিয়েনসিস নামে একটি ভিন্ন প্রজাতি প্রস্তাব করা হয়। অধিকাংশ বিজ্ঞানী এই শ্রেণীবিভাগে সন্তুষ্ট থাকলেও অনেকে আবার বলে বসেন, এলবি১ হচ্ছে মাইক্রোসেফালি রোগে আক্রান্ত একজন আধুনিক মানুষ। মাইক্রোসেফালির রোগীদের মস্তিষ্ক অনেক ছোট হয়। তবে এই সন্দেহ ধোপে টিকেনি, এখন প্রায় সবাই ভিন্ন প্রজাতির ব্যাপারে একমত।

মানবেতিহাস উদ্ধার অভিযানে ফ্লোরেসিয়েনসিসদের মত চমক আমাদেরকে খুব কম প্রজাতিই দিতে পেরেছে। এ যেন জে আর আর টলকিন এর রূপকথার গল্পের পৃথিবী ফুড়ে বেরিয়ে আসা। লর্ড অফ দ্য রিংস উপন্যাসে হবিট নামে একটি জাতির বর্ণনা দিয়েছিলেন টলকিন যাদের উচ্চতা ২ থেকে ৪ ফুটের মধ্যে। উপন্যাসের নায়ক ফ্রোডো ব্যাগিন্স সেই হবিট জাতিরই একজন। পিটার জ্যাকসনের সিনেমার বদৌলতে ফ্রোডো বিশ্বব্যাপীই প্রেমময় সংগ্রামের প্রতিমায় পরিণত হয়েছে। সেই প্রতিমা যে ফ্লোরেস দ্বীপের প্রত্নতাত্ত্বিকদেরও ছুঁয়ে গিয়েছিল তা বলাই বাহুল্য, বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও সংবাদ বিজ্ঞপত্তিতে তারাই প্রথম এদের বর্ণনা করার জন্য টলকিনের হবিট শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সিনেমায় হবিটদের সাথে অন্য মানুষদের উচ্চতার পার্থক্য দেখে আপনারা যতোটা মজা পেয়েছেন নিচের ছবিতে সেই পার্থক্যের বাস্তব রূপায়ন দেখে ঠিক ততোটাই ভিড়মি খাবেন-

flores1

দেখা যাচ্ছে বাস্তব পৃথিবীর এই হবিটদের উচ্চতা ছিল গড়ে ১ মিটার অর্থাৎ ৩ ফুট ৬ ইঞ্চি, সে তুলনায় তাদের ৩০ কেজি ভরকে একটু বেশিই বলতে হবে। দৈহিক গড়নের দিক দিয়ে তারা আমাদের চেয়ে বেশ আলাদা। তাদের হাত দুটোও আমাদের চেয়ে অনেক লম্বা, সুতরাং গাছে গাছে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস যে তাদের ছিল না সেটা হলফ করে বলা যায় না। এদের কাঁধ ছিল হোমো ইরেক্টাসদের মত আর পা অনেকটা অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস তথা লুসির মত। মাত্র ৩৮০ ঘন সেন্টিমিটার মস্তিষ্ক (শিম্পাঞ্জির সমতুল্য) নিয়ে তারা কতোটা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সৃষ্টি করতে পেরেছিল, তারা কথা বলতে পারতো কিনা এসব প্রশ্ন ভবিষ্যতের জন্য জমা আছে। তবে এ নিয়ে সন্দেহ নেই যে তাদের জগৎটা মোটেও টলকিনের শায়ারের (উপন্যাসে হবিটদের বাসস্থান) মত ছিল না, সমুদ্র পাড়ি দিয়ে তাদেরকে কেউ বিরক্ত করতে না আসলেও প্রকৃতির সাথে পেরে উঠেনি ফ্লোরেস দ্বীপের এই বামনরা। ১৭,০০০ বছর আগে যে অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল সেখানে সম্ভবত তাই তাদের কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল।[১]

মাত্র ৭ বছর আগে এলবি১ আবিষ্কৃত হয়েছে, তাই তার সম্পর্কে অধিকাংশ তথ্যই যে এখনো জানার বাকি সে বলে না দিলেও চলে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য জানাটা একটু কষ্টকর হলেও খাদ্যাভ্যাস ও শিকার পদ্ধতি জানা খুব একটা কঠিন নয়। তাদের দেশের হাতিগুলোও ছিল বেশ ছোট আকৃতির, পাথরের হাতিয়ার দিয়ে তারা এসব হাতি শিকার করতো, বিশালকায় কমোডো ড্রাগনের সাথে লড়তেও ভয় পেতো না।[২] তবে সর্বোপরী এই হবিটরা যতো না প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি ফসিল আবিষ্কারের পরই অনেকগুলো নতুন প্রশ্নের উৎপত্তি ঘটে, যতো দিন যায় ততোই প্রশ্নগুলোর উত্তর বেরিয়ে আসতে থাকে, জীবাশ্ম-নৃবিজ্ঞানের অগ্রগতির ধারাটাই এমন। তো হবিটরা মানব বিবর্তনের যে তত্ত্বটিকে একেবারে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে সেটি হল আউট অফ আফ্রিকা তথা আফ্রিকা থেকে বহির্গমন তত্ত্ব।

একেবারে মৌলিক জিজ্ঞাসা থেকে শুরু করা যাক। হবিটরা তো আর কল্পবিজ্ঞানের এলিয়েন না যে একটা স্পেস শিপ বা ‌ইউএফও দিয়ে তাদের উদ্ভবকে ব্যাখ্যা করা যাবে। পৃথিবীর বুকেই তাদের পূর্বপুরুষদের জন্ম হয়েছে এবং জন্মটা যে আফ্রিকা বৈ অন্য কোথাও নয় এ নিয়েও কোন সন্দেহ নেই। তাহলে এতো আগে আফ্রিকা থেকে এশিয়ার একেবারে শেষ প্রান্তে তারা কিভাবে পৌঁছুলো? আনুমানিক ১৭ লক্ষ বছর আগে হোমো ইরেক্টাস প্রজাতিটি আফ্রিকা ছেড়েছিল যে ঘটনাকে আমরা প্রথম আফ্রিকা থেকে বহির্গমন বলে থাকি। ধরে নেয়াই স্বাভাবিক যে এই প্রজাতির কেউ কেউ কোন না কোনভাবে ফ্লোরেসে পাড়ি জমিয়েছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায়, হোমো ইরেক্টাসদের চেয়ে এই হবিটদের সাথে আরও আদিম অস্ট্রালোপিথেকাস গণের প্রজাতিগুলোর মিল বেশি কেন? ইরেক্টাসরা ফ্লোরেসে এসে এমন কি পেল যে দৈহিক কাঠামোই গেল বদলে? এসব প্রশ্নের কথা ভেবেই বিজ্ঞানীরা নতুন অনুকল্পের কথা ভাবছেন- এমন কি হতে পারে না, ৩০ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকায় আমাদের যে আদিপুরুষরা বসবাস করত তাদেরই কোন দল আফ্রিকা ছেড়ে এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল এবং সবশেষে ইন্দোনেশিয়ার ওরাং ওটাং, বিরল পক্ষিকূল আর বিশালকায় কচ্ছপদের মাঝে স্থান করে নিয়েছিল? এই অনুকল্প নিয়েও সন্দেহ আছে, অনেকে বলেন হোমো ইরেক্টাসরাই প্রথম প্রজাতি যাদের বিশাল দূরত্ব পাড়ি দেয়ার মত দৈহিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা ছিল, তাহলে এতো প্রাচীনেরা কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করল? যথারীতি এসব প্রশ্নের সদুত্তর এখনো পাওয়া যায় নি, তাই আমাদের আলোচনার সিংহভাগ জুড়ে কেবল প্রশ্ন আর তার সম্ভাব্য উত্তরই থাকবে। হবিটদের উদ্ভবের আগে আমরা এতোদিন ধরে বিজ্ঞানী মহলে চলে আসা আফ্রিকা থেকে বহির্গমন তত্ত্বের সাথেই পরিচিত হব।

আফ্রিকা ত্যাগের ইতিবৃত্ত

আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিল বেশ বুনো ও রুক্ষ প্রকৃতির। এমনটি না হওয়ার কোন কারণ নেই। বনে থাকলে বা বন নির্ভর হলে বুনোই হওয়ার কথা, আর আমাদের মত সাংস্কৃতিক ভব্যতা অর্জন করতে না পারলে আমাদের চোখে তার রুক্ষ হওয়া ছাড়া গতি নেই। তবে অস্বীকার করার উপায় নেই, এই বুনো রুক্ষতাই বর্তমান সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। বুনো রুক্ষতাকে স্বীকার করে নেয়া কেবল নয়, একে উদযাপন করাও তাই কখনও কখনও সভ্যতার উৎকর্ষের প্রতীক হয়ে উছে। গ্রিক সভ্যতার স্বর্ণযুগে মানুষ ডায়োনিসাসের পূজার মাধ্যমে এই বুনো শূন্যতাকেই উদযাপন করত। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে তারা যেন হয়ে যেতো আর্কায়িক, যাদের থেকে আমরা, আধুনিকেরা, বিবর্তিত হয়েছি। এ সময় তারা বনে জঙ্গলে উন্মাদ শিকারীর মত ঘুরে বেড়াতো, পশুপাখি মেরে কাঁচা খেতো, প্রকৃতির সাথে মেতে ওঠার প্রেরণা জোগাতো মদ, ডায়োনিসাস ছিল মদের দেবতা। এই পূজাকে আর্কায়িক স্বভাবের উদযাপন বললে মোটেও অত্যুক্তি হবে না।

কিন্তু আর্কায়িক ও আধুনিকদের মধ্যে কোন সুস্পষ্ট সীমারেখা টানা সম্ভব নয়। কারণ এটা বিবর্তন, এখানে হঠাৎ করে কিছু হয় না, লক্ষ বছরে পরিবর্তন হয় খুব সামান্য। জোনাথন কিংডন ইরেক্ট, আর্কায়িক এবং মডার্ন নামে যে তিন ভাগ করেছেন তা কেবলই সম-বৈশিষ্ট্যের ফসিলগুলোকে আলাদা করার জন্য। এখন পর্যন্ত জানা মতে প্রাচীনতম আধুনিক মানুষের ফসিল পাওয়া গেছে ইথিওপিয়ার আফার নিম্নভূমির হার্টো অঞ্চলে। ১,৬০,০০০ বছর পূর্বের এই ফসিলগুলো যাদের তাদের হার্টো মানব নামেই ডাকা হয়। এত প্রাচীন হোমো স্যাপিয়েন্স এর ফসিল কেবল আফ্রিকাতেই পাওয়া গেছে। প্রায় সব জীবাশ্মবিজ্ঞানীই তাই একমত যে, আর্কায়িক মানবদের থেকে আফ্রিকাতে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছে এবং পরে প্রায় ১ লক্ষ বছর পূর্বে তারা ইউরোপ-এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে ১ লক্ষ বছরের পুরনো আধুনিক মানুষের ফসিল পাওয়া গেছে। অর্ধ শতাব্দীর মধ্যে এই দুই মহাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েছিলাম আমরা। আশির দশকের প্রথম দিকেই আফ্রিকা থেকে এই বহির্গমন নিয়ে প্রায় সবাই একমত হয়ে গিয়েছিল, জিন বিশ্লেষণ খুব একটা না এগোলেও শুধুমাত্র ফসিল রেকর্ড দেখেই অনেক কিছু বলে দেয়া যাচ্ছিল। এই বিশাল ঘটনার একটি নাম প্রচলিত হয়ে গেল ১৯৮৫ সালে “আউট অফ আফ্রিকা” সিনেমাটি মুক্তি পাওয়ার পর। ডেনমার্কের লেখিকা ক্যারেন ব্লিক্সেন (ছদ্মনাম ‘ইসক ডিনেসিন’) তার আফ্রিকাবাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে যে আত্মজীবনী লিখেছিলেন তারই চলচ্চিত্ররূপ এটি। আত্মজীবনীটির নামও ছিল আউট অফ আফ্রিকা, ব্লিক্সেন তার ১৯১৫ সালের বিখ্যাত কবিতা “Ex Africa” (ইংরেজি ভাষায় Out of Africa) থেকেই সম্ভবত এই নাম চয়ন করেছিলেন। আর কবিতার নাম যেখান থেকে এসেছে সে তো আফ্রিকার ঐতিহ্যের অংশ। প্রাচীন ইতিহাসবিদ ও বিজ্ঞানী প্লিনি দি এল্ডার বেশ কিছুদিন আফ্রিকায় ছিলেন, আফ্রিকা সম্পর্কে করা তার বিখ্যাত উক্তি “Ex Africa semper aliquid novi” যার ইংরেজি অর্থ “Out of Africa, always something new”। এই উক্তির মায়াজাল আজও গেল না, আফ্রিকা তার অনুর্বর মৃত্তিকা উন্মুক্ত করে দিয়ে আমাদের বিস্মিত করেই চলল। এই বিস্ময়ের সূচনা কিন্তু ডারউইন থেকেই। ডারউইন তার ডিসেন্ট অফ ম্যান বইয়ে লিখেছিলেন:

“পৃথিবীর প্রতিটি বড় অঞ্চলেই জীবিত স্তন্যপায়ীরা বিলুপ্ত প্রজাতিগুলোর সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। সুতরাং ধারণা করা যায় আফ্রিকাতে এক সময় গরিলা ও শিম্পাঞ্জির নিকটাত্মীয় বনমানুষেরা বসবাস করত; আর যেহেতু বর্তমানে এই দুটি প্রজাতির সাথেই আমাদের মিল সবচেয়ে বেশি সেহেতু আমাদের পূর্বপুরুষদের পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় আফ্রিকাতে বাস করার সম্ভাবনাই বেশি। ”

আফ্রিকা ত্যাগের ইতিহাস কিন্তু আধুনিক মানুষের একার না, আমাদের পূর্বপুরুষরাও বেরিয়েছিল বিশ্বের পথে। ১৭ লক্ষ বছর পূর্বে হোমো ইরেক্টাস প্রজাতিটি ইউরোপ এবং এশিয়া ছড়িয়ে পড়েছিল। আদিম এই বহির্গমনকে আউট অফ আফ্রিকা ১ বা প্রাচীন আউট অফ আফ্রিকা নামে ডাকা হয়। আর আধুনিক মানুষের আফ্রিকা ত্যাগকে বলা হয় নবীন আউট অফ আফ্রিকা। ২০০২ সালের পূর্বে বহির্গমনের তত্ত্বটা এমনই ছিল। কিন্তু এ বছর অ্যালান টেম্পলটন একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেন, নেচারে প্রকাশিত তার গবেষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়- মানুষ এবং তার পূর্বপুরুষেরা দুইবার নয়, অসংখ্যবার আফ্রিকা ও ইউরেশিয়ার মধ্যে যাতায়াত করেছে। তবে গণহারে আফ্রিকা থেকে বহির্গমন ঘটেছে ৩ বার, ২ বার নয়। টেম্পলটনের সময়ের হিসাব ছিল এমন- ১৭ লক্ষ বছর পূর্বে প্রথমবার, ৮,৪০,০০০ থেকে ৪,২০,০০০ বছর পূর্বের মধ্যে দ্বিতীয়বার এবং ১,১৫,০০০ থেকে ৮০,০০০ বছর পূর্বের মধ্যে শেষ বার। টেম্পলটন তার গবেষণায় জিন ব্যবহার করেছেন।

আউট অফ আফ্রিকা কেবল নয়, যেকোন অঞ্চলে মানব উপনিবেশের ইতিহাস জানতেই জীববিজ্ঞানীরা জিন ব্যভহার করেন। পারিবারিক বংশধারার চেয়ে জিনের বংশগতীয় ধারা অনেক নির্দিষ্ট। কারণ প্রতিটি ব্যক্তির বাবা-মা দুজন থাকলেও একটি জিনের হয় বাবা নয়তো মা থাকে। আমাদের দেহের প্রতিটি জিন হয় বাবা নয়তো মা-র কাছ থেকে এসেছে, একইসাথে দুজনের কাছ থেকে আসেনি। এজন্য দেখা যায় হিজিবিজি বংশগতির বৃক্ষে জিনের বংশগতীয় ধারা একটি সরলরেখা অনুসরণ করে। এই সরলরেখা ধরে পেছাতে থাকলে প্রতিটি জিনের পূর্ব-বাহকদের দেখা মিলবে। আর মানুষকে মনে হবে কেবলই জিনের বাহক।

বিভিন্ন বা একই ব্যক্তির মধ্যকার দুই বা ততোধিক জিনের অবশ্যই একটি সাধারণ পূর্বপুরুষ রয়েছে। ধরা যাক, ৪ জন ব্যক্তির ৪টি জিনের বংশগতির রেখা ধরে পেছনের দিকে যাওয়া হচ্ছে। তাহলে একটা সময়ে ৪টি রেখাই এক বিন্দুতে মিলিত হবে। ঐ বিন্দুটি যে ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করে সেই হবে জিনগুলোর নিকটতম সাধারণ পূর্বপুরুষ। এই মিলিত হওয়াকে জিনতত্ত্বের ভাষায় বলে কোয়ালেসেন্স আর মিলন বিন্দুকে বলা হয় কোয়ালেসেন্ট পয়েন্ট। কে বা কারা ছিল এই জিনগুলোর পূর্বপুরুষ এবং সেই নিকটতম সাধারণ পূর্বপুরুষটি কত বছর আগের তার সবই বের করা যায়। জিনের মধ্যেও সুস্পষ্টভাবে যে জিনিসটির গতিবিধি অনুসরণ করা যায় সেটি হচ্ছে মিউটেশন। মিউটেশন কিভাবে জেনেটিক মার্কার হিসেবে কাজ করে সে সম্পর্কে বন্যা আহমেদের ‘বিবর্তনের পথ ধরে’ বই থেকে উদ্ধৃতি দেয়া যাক:
“আমরা জানি যে, আমাদের জিনে কখনো কখনো বিক্ষিপ্তভাবে মিউটেশন ঘটে। জেনেটিক্সের নিয়ম মেনে তারপর তা পরবর্তী বংশধরদের ডিএনএতেও দেখা যায়। এই মিউটেশনগুলোকেই জেনেটিক মার্কার বা নির্দেশক হিসেবে ব্যবহার করেন বিজ্ঞানীরা। বহু প্রজন্মে পরে যদি আপনার এবং আমার দুজনেরই ডিএনএতে একই মিউটেশন দেখা যায় তা হলে বুঝে নিতে হবে যে, কোন-না-কোন সময়ে আমাদের একই পূর্বপুরুষ ছিল। বিভিন্ন জনপুঞ্জের মধ্যে এই সাধারণ নির্দেশকগুলো খুঁজে বের করে তুলনামূলক পর্যালোচনা করতে পারলেই বোঝা যাবে তারা সবাই একই পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত হয়েছে কি হয় নি।”

এখানে ‘তুলনামূলক পর্যালোচনা’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের দেহের একটি জিন আমাদের পূর্বপুরুষ সম্পর্কে সঠিক ধারণা নাও দিতে পারে, একেকটি জিনের বংশগতির ধারা একেক রকম হতে পারে। যে জিনটির কারণে আমাদের চোখের রং কালো সেটি যেই রেখা ধরে এসেছে চুলের রং কালো হওয়ার জন্য দায়ী জিনটি একেবারে ভিন্ন দিক হতেও আসতে পারে। মিউটেশনের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাই বেশ কিছু জিনের মিউটেশন পর্যালোচনা করে তারপর সেটাকে ফসিল রেকর্ডের সাথে মিলালেই কেবল নিশ্চিত ফলাফল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু যেকোন ডিএনএ-র মিউটেশন নিয়ে পরীক্ষা করলেই কি হবে? সবগুলোই কি সমান নির্ভরযোগ্য? মোটেই নয়। প্রতিটি শুক্রাণু এবং ডিম্বানু তৈরির সময়ই রিকম্বিনেশন ঘটে। এ সময় একই ডিএনএর বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে অদল বদল ঘটে। সাধারণত মানুষের প্রতিটি ক্রোমোজোমে গড়ে একটি থেকে দুটি অদল বদল ঘটতে পারে। কিন্তু অনেক প্রজন্মে এই সংখ্যাটা অনেক বেড়ে যায়। সুতরাং ক্রোমোজোমের ভেতর দুটি ডিএনএ যত কাছাকাছি থাকবে অতীতে তাদের মধ্যে অদল বদল ঘটেছে এমন সম্ভাবনাও তত কম থাকবে। সেক্ষেত্রে ধরে নেয়া যাবে বাবা বা মা-র মধ্যেই এই ডিএনএ দুটি এভাবেই ছিল। মোটকথা, ডিএনএ যত কাছাকাছি তাদের ইতিহাস তত কাছাকাছি। বিজ্ঞানীরা এমন ঘন সন্নিবিষ্ট ডিএনএ-র সন্ধানই করেন।

তবে সবচেয়ে ভাল হয় যদি এমন এক গুচ্ছ ডিএনএ পাওয়া যায় যারা অনেক প্রজন্ম ধরে একইভাবে প্রবাহিত হচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে এমন ডিএনএ-ও মানব দেহে রয়েছে যাদের নাম হ্যাপ্লোটাইপ। ওয়াই ক্রোমোজোমাল ডিএনএ এবং মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হ্যাপ্লোটাইপের উদাহরণ। এর মধ্যে ওয়াই ক্রোমোজোম কেবল পুরুষদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয় আর মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ কেবল নারীদের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়। এগুলো সহ টেম্পলটন মোট ১৩টি হ্যাপ্লোটাইপ নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন। আর নমুনা নিয়েছেন ইউরোপ, এশিয়া এবং আফ্রিকা সহ বিশ্বের প্রায় সব অঞ্চলের মানুষদের থেকে। প্রতিটি হ্যাপ্লোটাইপের জিন বৃক্ষ নির্মাণ করেছেন, কোয়ালেসেন্স বিন্দুগুলো চিহ্নিত করেছেন আর কোন কোয়ালেসেন্সটি কখন ঘটেছে সেটার হিসাব করেছেন। এটাই এখণ পর্যন্ত আউট অফ আফ্রিকার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ফলাফল দিয়েছে। টেম্পলটনের গবেষণা বোঝানোর জন্য নিচের ছবিটি হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়:

1

ছবিতে উল্লম্ব রেখাগুলো জিনের বংশগতি বোঝাচ্ছে আর আড়াআড়ি রেখাগুলোর মাধ্যমে স্থানান্তর বোঝানো হয়েছে। মোটা দাগের মাধ্যমে বড় আকারের স্থানান্তর বোঝায়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ১৭ লক্ষ বছর পূর্বে হোমো ইরেক্টাসরা আফ্রিকা ছেড়ে গণহারে বেরিয়ে পড়েছিল। ফসিল রেকর্ডের সাথেও এই ফলাফলের মিল রয়েছে। তবে মানুষ একেবারে থেমে থাকেনি, বড় আকারের বহির্গমনের পরও আফ্রিকা, দক্ষিণ ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আনাগোনা করেছে তারা। আফ্রিকা দ্বিতীয় বড় ধরণের বহির্গমন ঘটেছে ৮,৪০,০০০ থেকে ৪,২০,০০০ বছর পূর্বের মধ্যে, ১৩টির মধ্যে ৩টি হ্যাপ্লোটাইপ এই বহির্গমন সমর্থন করেছে। হ্যাপ্লোটাইপগুলো হচ্ছে হিমোগ্লোবিন বেটা, MS205 এবং MC1R. আর শেষ যে বহির্গমন ঘটেছে ১,১৫,০০০ থেকে ৮০,০০০ বছর পূর্বের মধ্যে সেটা ওয়াই ক্রোমোজোমাল এবং মাইটোকোন্ড্রিয়াল ডিএনএর মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। তবে ওয়াই ক্রোমোজোমাল ডিএনএ এবং হিমোগ্লোবিন বেটা মিলে এই সরল বহির্গমন তত্ত্বের মধ্যে একটি ঝামেলা বাঁধিয়ে দিয়েছে, এদের বিশ্লেষণ থেকে দেখা যাচ্ছে ৫০,০০০ বছর পূর্বে মানুষ এশিয়া থেকে আবার গণহারে আফ্রিকায় প্রত্যাবর্তন করেছিল। এরও কিছু পরে ইউরোপের দক্ষিণাংশ থেকে উত্তরাংশে ছড়িয়ে পড়েছিল। আসলে সমগ্র বিশ্ব অধিকারের যুগ শুরু হয়েছে এই সময়েই। দক্ষিণ এশিয়া থেকে উত্তর এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মানুষের আগমন ঘটেছে, সবশেষে মানব বসতি স্থাপিত হয়েছে আমেরিকা মহাদেশে আনুমানিক ১৪,০০০ বছর পূর্বে। মাইটোকোন্ড্রিয়াল ডিএনএ এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমেরিকায় মানব উপনিবেশের এই তত্ত্ব সমর্থন করেছে, আর এই যাত্রাপথে যে তারা উত্তর-পূর্ব এশিয়ার সাথে আমেরিকার আলাস্কা অঞ্চলের মধ্যকার বেরিং স্থলসেতু ব্যবহার করেছে সে নিয়েও তেমন কোন সন্দেহ নেই। সে সময় আলাস্কা এবং রাশিয়ার মধ্যকার সমুদ্রভাগ ঠাণ্ডায় জমাট বেঁধে একটি প্রাকৃতিক সেতুর রূপ নিয়েছিল।

উত্তর আমেরিকা থেকে পানামা হয়ে খুব দ্রুতই মানুষ দক্ষিণ আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এই আলোচনার পর ক্রিস্টোফার কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারকে এতোটা গুরুত্ব দেয়ার কি আর কোন কারণ থাকে? ডকিন্স তো কলম্বাসকে আমেরিকার আবিষ্কারক বলাটাকে বর্ণবাদী মনোভাবের পরিচায়ক বলেছেন। আবার আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যেও এক ধরণের অন্ধ বিশ্বাস চালু আছে যে, তাদের পূর্বপুরুষরা কখনো আমেরিকার বাইরে বাস করেনি; এটাও গুরুত্বহীন। এতো গেল টেম্পেলটনের গবেষণার কথা। কিন্তু এ বিষয়ে তখনই নিঃসংশয় হওয়া যাবে যখন এর সাথে ফসিল রেকর্ড মিলে যাবে। জ্যারেড ডায়মন্ড তার “গানস, জার্মস অ্যান্ড স্টিল” বইয়ের প্রথম অধ্যায়ে ফসিল রেকর্ডের আলোয় আফ্রিকাবাসীদের সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার কাহিনী বর্ণনা করেছেন। দেখা যায়, জিন বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া ফলাফলের সাথে ফসিল রেকর্ড অনেকটাই মিলে যায়। তাছাড়া ফসিল বেশ দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় জিনের অনেক ফলাফলকে সমর্থন করার মত ফসিল প্রাপ্তির আশা হয়ত আমাদের ছেড়েই দিতে হবে। তবে যতটুকু পাওয়া গেছে তাই আউট অফ আফ্রিকার মানচিত্র অংকনের জন্য যথেষ্ট।

এই সেদিন পর্যন্তও আউট অফ আফ্রিকার এই দ্বিমুখী প্রমাণ নিয়ে আমরা বেশ সন্তুষ্ট ছিলাম। কিন্তু ফ্লোরেসিয়েনসিসরা দৃশ্যপটে আবির্ভূত হওয়ার পরই আবার গোলমাল বেঁধে গেল। আগেই বলেছি এদের সাথে হোমো ইরেক্টাসদের তুলনায় আরও প্রাচীন আফ্রিকান প্রজাতিগুলোর মিল অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে ৩২ লক্ষ বছর বয়সী লুসির কথাই ধরা যাক। অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেনসিস প্রজাতির এই মেয়েটির সাথে ফ্লোরেসিয়েনসিসদের মিল লক্ষ্য করার মত। সবচেয়ে মিল হাড়ের গঠনে। তাছাড়া উচ্চতাও অনেক কম, যা ইরেক্টাসদের তুলনায় অস্ট্রালোপিথেকাসদের প্রতিনিধিত্বই বেশি করে। বিজ্ঞানীরা তাই ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন- হয়ত হবিটরা ইন্দোনেশিয়ায় এসে হঠাৎ খুব বেশি খাটো হয়ে যায়নি, বরং ইরেক্টাসদের চেয়ে বেঁটে কোন প্রজাতি থেকেই বিবর্তিত হয়েছে, হয়ত ৩০ লক্ষ বছর পূর্বেই আমাদের পূর্বপুরুষরা কোন এক অজানা উপায়ে ইন্দোনেশিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল। সেক্ষেত্রে আরও আদিম একটি আউট অফ আফ্রিকার প্রয়োজন পড়ছে। এই অনুকল্পে ইন্ধন জুগিয়েছে ফ্লোরেসে পাওয়া ১১ লক্ষ বছরের পুরনো পাথরের হাতিয়ার। ইরেক্টাসদের ইন্দোনেশিয়ায় থিতু হওয়ার সময়কাল যদি ১০ লক্ষ বছর পূর্বে ধরা হয় তবে এই হাতিয়ারগুলো আমাদের সত্যিই ভাবিয়ে তোলে।

এদিকে মাইক মরউড আবার নিকটবর্তী সুলাবেসি থেকে প্রায় ২০ লক্ষ বছরের পুরনো পাথরের হাতিয়ার উদ্ধার করেছেন বলে দাবী করছেন। সেক্ষেত্রে তো প্রাগৈতিহাসিক উপনিবেশের সম্ভাবনা আরও জোড়দাড় হচ্ছে। ডেবি আর্গু এর পরিচালনায় বিজ্ঞানীদের একটি দল জার্নাল অফ হিউম্যান এভল্যুশনে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলছেন, ২৩ লক্ষ বছর পূর্বে আফ্রিকায় যেসব নরবানর প্রজাতির উদ্ভব ঘটেছিল তাদেরই ফ্লোরেসিয়েনসিস দের পূর্বপুরুষ হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কিন্তু ২৩ লক্ষ বছর পূর্বে অস্ট্রালোপিথেকাসরা তো ছিল না, ছিল হোমো হ্যাবিলিস রা। হোমো হ্যাবিলিসদের সাথেও কিন্তু ফ্লোরেসিয়েনসিসদের মিল অনেক। এই গবেষণার পর সময়কালের বিবেচনায় তাই হোমো হ্যাবিলিস কেই ফ্লোরেসিয়েনসিসদের পূর্বপুরুষ ভাবা হচ্ছে। তবে কথা হচ্ছে, হ্যাবিলিসদের কি ক্ষমতা ছিল এত পথ পাড়ি দেয়ার?

ফ্লো নামের এই হবিটের পায়ের পাতার দৈর্ঘ্য ২০ সেন্টিমিটার। উড়ুর হাড়ের সাথে এর অনুপাত হচ্ছে ১০০:৭০। অপরদিকে মানুষের উড়ুর হাড় ও পায়ের পাতার দৈর্ঘ্যের অনুপাত হচ্ছে ১০০:৫৫। অর্থাৎ হবিটদের পা ছোট ছোট এবং পায়ের পাতা সে তুলনায় অনেক দীর্ঘ যা আদিম আফ্রিকান নরবানরদের সাথে মিলে যায়। কিন্তু সাথে সাথে সৃষ্টি হয় উভয় সংকটের, এতো ছোট পা আর বড় পায়ের পাতা নিয়ে এতোটা পথ পাড়ি দেয়া কি সম্ভব? হাতের ক্ষেত্রেও মানুষের সাথে এদের অনেক ফারাক। হবিটদের হাতে ট্রাপিজয়েড আকৃতির হাড় রয়েছে যা পাথরের হাতিয়াড় তৈরিতে বাঁধার সৃষ্টি করে। নরবানরদের হাত এমন ছিল। তার মানে আদিম প্রকৃতির হাত হওয়া সত্ত্বেও তারা কিছু হাতিয়ার বানাতে পেরেছিল। মস্তিষ্কের ক্ষেত্রেও এই বিস্ময়ের মুখোমুখি হই আমরা। এদের মস্তিষ্কের আয়তন শিম্পাঞ্জি থেকে সামান্য বেশি হলেও সিটি স্ক্যান এর মাধ্যমে জানা গেছে তারা এমন অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল যেগুলো আদিম নরবানরদের ছিল না। এতো সব বৈসাদৃশ্য আমাদেরকে আরও ধাঁধার মধ্যে ফেলে দেয়। ছোট্ট মস্তিষ্ক, বিশাল পায়ের পাতা বিশিষ্ট ছোট ছোট পা, অপটু হাত আর দুর্বল শারীরিক গড়ন নিয়ে এই বামুনেরা কিভাবে আফ্রিকা থেকে ইন্দোনেশিয়ায় আসার ধৃষ্টতা দেখালো?

তাছাড়া ফ্লোরেস একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। ইন্দোনেশিয়া পোঁছালেও নৌ-চালনা জানা না থাকায় হ্যাবিলিসদের পক্ষে তো ফ্লোরেসে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এক্ষেত্রে অবশ্য আগ্ন্যুৎপাত ও ভূমিকম্পকে দায়ী করা চলে। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরে সুনামি হওয়ার পর মূলভূমি থেকে অনেক দূরে জীবিত মানুষ পাওয়া গিয়েছিল। ভেলা বা এ ধরণের কিছুতে ভাসতে ভাসতে তারা অনেক দূরে চলে গিয়েছিল। হয়ত সেই আদ্যিকালে ইন্দোনেশিয়া বসবাসরত হ্যাবিলিসদের কেউ কেউ এভাবেই ফ্লোরেসে পৌঁছেছিল। আবার সে সময় দ্বীপগুলো মূলভূমির সাথৈ সংযুক্ত থাকার সম্ভাবনাকেও একেবারে নাকচ করে দেয়া যায় না। তবে ফ্লোরেসে পৌঁছার পর যে তারা মূলভূমি থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল এটা প্রায় নিশ্চিত, এমনকি তাদের মধ্যে বহুকাল যোগাযোগও হয় নি। এর আগে আমাদের জানা মতে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে মূলভূমির মানুষদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা দ্বীপটি ছিল তাসমানিয়া। মূল অস্ট্রেলিয়া থেকে ১১,০০০ বছর পূর্বে তারা বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। আর এখন এমনই এক দ্বীপ পাওয়া গেল যেখানে আমাদের যাতায়াত বা যোগাযোগ ছিল না ১০ লক্ষেরও বেশি সময় ধরে। আর মরউডের কথা যদি সত্যি হয় তাহলে তো ২০ লক্ষ বছর পূর্বেই এই দ্বীপে বসে কোন মানুষ পাথর দিয়ে হাতিয়ার বানাচ্ছিল।

তবে ফ্লোরেস নিয়ে এত অনিশ্চয়তার মাঝে একটি আশার দিকও আছে। সমুদ্র স্রোত এবং দূরত্বের বিচারে ফ্লোরেস বেশ দুর্গম একটি দ্বীপ। তাই ভাগ্যের গুণে কেউ যদি একবার সে দ্বীপে গিয়ে পড়ে তবে সহজে সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারবে না, অন্য কেউ গিয়ে তাদের বিরক্তও করতে পারবে না। ফলে অনেকদিন সে ঐ দ্বীপে সুখে শান্তিতে বাস করতে পারবে। হয়ত এমনটিই ঘটেছিল হবিটদের ক্ষেত্রে। শুধু হবিট তো নয়, এই দ্বীপে এমন সুরক্ষিত প্রজাতি আরও আছে। বামুন হাতি এবং কমোডো ড্রাডনরাও এই দ্বীপে খুব সুরক্ষিত ছিল। দেখা যাচ্ছে দুর্গম হওয়ার সুবিধাও কম না।

২০০৪ সালে হবিটরা আবিষ্কৃত না হলে আমাদের আউট অফ আফ্রিকা নিয়ে আর তেমন কোন সন্দেহই থাকতো না। কিন্তু এখন অনেক কিছু নতুন করে ভাবতে হবে। আমরা একদা আফ্রিকায় ছিলাম এবং সেখান থেকে তিন তিনবার বেরিয়ে পড়েছি, অধিকার করে নিয়েছি গোটা বিশ্ব- এত সহজভাবে আর বলা যাবে না হয়ত। কারণ আমাদের পূর্বপুরুষ নরবানরদেরও আফ্রিকা ত্যাগের সম্ভাবনা দিয়েছে এখন। বলা যায় গবেষণার একটি নতুন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে।

বর্তমানে গৃহীত তিনবার আফ্রিকা থেকে বহির্গমনের বিষয়টি লক্ষ্য করলে কিন্তু বোঝা যায়, একমাত্র আদিম আধুনিক মানুষ ছাড়া আর যারাই আফ্রিকা থেকে বেরিয়েছে তারাই বিলুপ্ত হয়েছে। প্রথম দুইবার যারা আফ্রিকা ত্যাগ করেছে তাদের কেউ কিন্তু আধুনিক মানুষ ছিল না, টিকতেও পারেনি কেউ। দেখা যাচ্ছে তাদের শেষ বংশধর ছিল এই হবিটরা, তাও ১৭,০০০ বছর পূর্বে বিদায় নিয়েছে তারা। আর প্রায় লাখ খানেক বছর পূর্বে হোমো স্যাপিয়েন্স আফ্রিকা তাগ করে পুরো বিশ্ব অধিকার করে নিয়েছে। তাদেরকে যেন জায়গা করে দিয়েছে প্রকৃতিই, প্রাকৃতিক নির্বাচনের সকল সুবিধা সঞ্চয় করে অগ্রসর হয়েছে তারা। যেখানেই গেছে সেখানেই একক আধিপত্য বিস্তার করেছে। অনেক স্থানের আদিম অধিবাসীদের বিলুপ্তির পেছনে তাদের প্রত্যক্ষ ভূমিকাও আছে। হবিটদের ক্ষেত্রেও কি এমন হতে পারে না? হবিটদের বিলুপ্তি নিয়ে অবশ্য অনুকল্প আছে, অগ্ন্যুৎপাতের কথা আগেই বলেছি। এখানে দুটি অনুকল্পই উল্লেখ করছি-

১৭,০০০ বছর পূর্বে এই অঞ্চলে একটি বড় আকারের অগ্ন্যুৎপাত ঘটেছিল। লিয়াং বুয়া গুহায় ছাইয়ের একটি পুরু আস্তরণ আছে যা অগ্ন্যুৎপাতেরই সাক্ষ্য বহন করে। এ কারণেই হয়থ তারা বিলুপ্ত হয়েছিল, কিংবা অগ্ন্যুৎপাতের পর খাদ্যের অভাবে ধীরে ধীলে নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল। অগ্ন্যুৎপাতের তারিখ এবং ফসিল রেকর্ড থেকে হবিটদের উধাও হয়ে যাওয়ার তারিখ মিলে গেলেও বিজ্ঞানীরা অন্য অনুকল্পের কথা ভাবছেন। নিশ্চিত হতে চান না কেউই। বিকল্প অনুকল্পটি হচ্ছে মানুষের প্রত্যক্ষ আগ্রাসন। আর বিজ্ঞানীদেরই বা কি দোষ। মানুষের ইতিহাস যে খারাপ তাতে তাদের সন্দেহ না করে তো উপায় থাকে না। ৪০,০০০ ব্ছর পূর্বে আফ্রিকা থেকে বহির্গমনের পথে ইউরোপে আসল মানুষ, এর পরপরই বিদায় নিল নিয়ানডার্থালরা। এমনটা ইন্দোনেশিয়াতেও যে ঘটেনি তার প্রমাণ কি? বিজ্ঞানী স্ট্রিংগার বলছেন, ১ লক্ষ বছর আগে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে খুব দ্রুতই ছড়িয়ে পড়ছিল মানুষ। যে সময়ে হবিটরা বিলুপ্ত হয়েছে ততোদিনে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবখানেও বসতি তৈরি করে ফেলেছিল তারা। সে হিসেবে ফ্লোরেসকে যে হবিটরা আধুনিক মানবমুক্ত রাখতে পারেনি তা বলাই বাহুল্য। দেখঅ হওয়ার পর তারা একে অপরকে কি করেছে কে জানে; হয়ত সংঘাত হয়েছে। হয়ত হবিটদের সব খাবার আধুনিকেরা নিঃশেষ করে ফেলছিল।

তথ্যসূত্র:

১। http://humanorigins.si.edu/research/asian-research/hobbits
২। http://www.guardian.co.uk/science/2010/feb/21/hobbit-rewriting-history-human-race
৩। Up to the starting line, “Guns, Germs and Steel: The Fates of Human Societies” – Jared Diamond
৪। Richard Dawkins, “The Ancestor’s Tale”