মুক্তিযুদ্ধ – জয়বাংলাদের বিনা টিকিটে ট্রেন ভ্রমণ
[মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচুর পেয়েছি আমি। সে ঋণ শোধ করা সম্ভব নয় কোনভাবেই। এই লেখাটি ঋণগ্রস্থের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার চেষ্টা মাত্র। লেখাটিতে ভাল কিছু থাকলে তা আতীক রাঢ়ীর জন্য। না থাকলে গঠনমূলক মন্তব্যের জন্য আরও একবার ধন্যবাদ।]

কুচবিহার থেকে শিলিগুড়ি যাওয়ার ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। বগলতলায় বহুদিনের পুরণো একটি এটাসি ব্যা্গে আমার সংসার। একটি জামা, একটি লুংগি, আর একটি টুথ ব্রাশ। প্যান্টটা তো পড়নেই আছে। টুথ পেস্ট আর দাড়িকাটা যখন যেখানে থাকি তাদেরটা দিয়ে চালিয়ে দেই। কিন্তু মুশকিল টুথ ব্রাশটা নিয়ে। ওটা চালানো যায় না।

আমার সামনেই প্রথম শ্রেণীর একটি কামড়া এসে দাঁড়াল। জয়বাংলাদের টিকিট লাগে না। প্রথম শ্রেণীতে গেলেও যা, তৃতীয় শ্রেণীতেও তা। উঠে পড়লাম। ফাঁকা একটা কক্ষে আমি একাই রাজা। দেশে কখনও প্রথম শ্রেণীতে চড়া হয়নি। নরম সীট। দারূণ মজা। কিন্তু আমার এটাসী ব্যাগটা দেখে একটা টিটি(?) নিশ্চয় বুঝে ফেলেছে আমি জয়বাংলা। তিনি চলতি ট্রেনেই এসে উঠলেন। প্রথমেই আমার কক্ষটায়।

জিজ্ঞেস করলেন – টিকিট আছে?

বললাম – পূর্ব পাকিস্তান থেকে এসেছি। রিফিউজি।

তিনি সামনের সীটে এসে বসলেন। কোন ডিস্ট্রিক্টে বাড়ি ছিল জিজ্ঞেস করলেন। তারপর তার নিজের স্মৃতি কথা সংক্ষেপে মনে করলেন। পঞ্চাশের দশকের শেষে নারায়গঞ্জ ছেড়ে চলে এসেছেন। আর যাওয়া হয়নি। কত স্মৃতি। স্কুল, পৈত্রিক ব্যবসা, নৌকা ভ্রমণ, ইলিশ মাছ, ইত্যাদি। একসময় তিনি উঠলেন। বললেন – আপনারা টিকিট করতে পারেন না জানি। প্রথম শ্রেণীতে গেলে আমাদের অসুবিধা হয়। সামনে নেমে তৃতীয় শ্রেণীতে অনেক সীট পাবেন। কেউ কিছু বলবে না।

টিটিটা খারাপ কিছুই বললেন না। কিন্তু আমি মরমে মরে গেলাম। বিনা পয়সায় যেতে পারছি। এই তো যথেষ্ঠ। প্রথম শ্রেণীতে উঠার লোভটা কেন সামলাতে পারলাম না। একটা জিনিষ খেয়াল করলাম। আলাপ হলেই দেখি প্রায় সবাই পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা। নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, না হয় বিক্রমপুর। গৌহাটী রেল স্টেশন থেকে বেরোতে গিয়ে ধরা পড়লাম। তার বাড়ী ছিল নোয়াখালীতে।
মাস দুই পরে কলকাতা মাসির বাসায় এলাম। শিয়ালদা স্টেশনে চেকার গুলো ভিখেরীর মত টিকিটের জন্য হাত পেতে দাঁড়িয়ে থাকে। হাত ঠেলে চলে যাই। বুঝতেই পারেনা আমার monthly ticket নেই। যাই হরিদাস বাবুর বাড়ীতে কিম্বা তাঁর অফিসে। তিনি নীলরতণ মেডিকেল কলেজের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের প্রধান। ছ্যাক খেয়ে দেশ ছেড়েছেন পঞ্চাশের দশকে। আর বিয়ে করা হয়নি।

মাসির বাসায় বোর হয়ে গেছি। ভাবলাম ঘুরে আসি নদীয়া থেকে। ওখানে বাবার দুই পিসতুত ভাইএর বাড়ি। একটু দূরেই থাকে সুধীর মামা। বাংলাদেশ বর্ডার ঘেষে ফুলিয়া ফার্ম। তার ম্যানেজার। পকেটে দীর্ঘদিনের সহযাত্রী একটি সিকি। শিয়ালদা থেকে প্রায় দুই ঘন্টা ট্রেনে। বাম পাশে বসা আমার মত এক জয়বাংলা। উনিশ কি বিশ। আমার বয়েসী। ট্রেনের দোলায় দুলতে দুলতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বার বার আমার গায়ে এসে পড়ছে। ঠেলে সরিয়ে দেই। আবার এসে পড়ে। ভারি বিরক্তিকর। টিটি মশাই তার ডানায় কয়েকবার ধাক্কা দিলেন। ঘুম ভেংগে টিটিকে দেখে আবার চোখ বুঝলো ছেলেটি। আবার ধাক্কা দিলেন। টিকিট চাইলেন। ছেলেটির চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ। মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে বিরক্তিমাখা উত্তর দিল – জয়বাংলা।

আর যায় কোথায়? টিটি মশাই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন। – জয়বাংলা! জয়বাংলা, তাতে হয়েছেটা কী? এত বছর হল আমরা এদেশে এসেছি। একটা দিন আলিপুর চিড়িয়াখানা যেতে পারলাম না। আপনারা বিনা টিকিটে মাসির বাড়ি, পিসির বাড়ি, চিড়িয়াখানা ঘুরে বেড়াবেন। টিকিট চাইলেই মেজাজ দেখাবেন। আপনার চেহারা দেখে কি আমাদেরকে বুঝতে হবে যে আপনি পাকিস্তান থেকে এসেছেন? আপনাদের কাছে টিকিট চাওয়া কি অন্যায়?

আমারও একই কেস। টিকিট নাই। পকেটে একটা সিকি। ভিতরে আমি ঘেমে গেছি। বাথরুমে যাওয়া দরকার মনে হচ্ছে। টিটি মশাই রাগে গজ গজ করছেন। ওটাকে ছেড়ে দিয়ে আমার কাছে টিকিট চাইলেন। আমি ভীষন নার্ভাস হয়ে গেছি। এযাত্রায় আর বুঝি রক্ষা নেই। সবিনয়ে উঠে দাঁড়ালাম। পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে তার ভাঁজ খুলে এগিয়ে দিলাম। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদের সম্পাদক সুব্রত মুখার্জি কি প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সীর স্বাক্ষরিত চিঠি। বাংলাদেশ থেকে আগত এই ছাত্রটিকে যথাসাধ্য সাহাযের আবেদন।

টিটি মহাই আকাশ থেকে নেমে এলেন। ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে দ্বিতীয় দফা শুরু করলেন – এনাকে দেখুন। শিখুন। আমিও ঐ দেশেরই মানুষ। আজ আপনারা বিপদে পড়েই এসেছেন। পশ্চিম বঙ্গের অবস্থা ভাল নয়। এত লোক। দারূণ চাপ। তবু যতটা পারছি করছি। বিনা টিকিটে ট্রেনে ফাঁকা জায়গায় বসে যাবেন। অসুবিধা কী? এটা আমাদের জন্য তেমন অতিরিক্ত বোঝা নয়। কিন্তু আমরা কি আপনাদের কাছ থেকে একটু ভদ্র ব্যবহার আশা করতে পারিনা?

টেক্সাস, ১৭ আগষ্ট ২০১০।