একবার আমাদের ভুলু হারিয়ে গেল। কে তাকে খুঁজবে? আমি বের হলাম। টলোমলো পায়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। বটগাছের শেকড়-বাকড়-ঝুরির ফাঁকে ফাঁকে খুঁজে দেখছি। ডাকছি, ভুলু। ভুলু।
রাস্তা পেরিয়ে গোহাট। কোনো গরু নেই। কিছু খড়কুটো আছে। একপাশে মন্দির। মা-কালী জিব কেটে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে মুণ্ডুমালা। গলায় শোলার ফুল। পায়ের নিচে শিব ঠাকুর। ঘুমুচ্ছে। একটি শিয়াল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফিস ফিস করে বলল, চুপ চুপ।
মাঠ পেরিয়ে নিচুপাড়ার খাল। জল ছল ছল করে না। কচুরিপানায় ভরা। চওড়া পাড়। একজন বুড়ো মিস্ত্রী ঠুক ঠুক করে নৌকা গড়ছে। বললেন, তুমি কোন বাড়ির খোকা?
আমি কোন বাড়ির খোকা? বললাম, ভুলুদের খোকা।
-কোন ভুলু?
– হারিয়ে যাওয়া ভুলু।

মাথার উপরে একটি শিল কড়াই গাছের ছায়া লম্বা হয়ে নৌকার গায়ে ঝুঁকে পড়েছে। বুড়ো মিস্ত্রী তার গামছাটি পেতে দিলেন। শান্ত হাওয়া এলো। আমাকে ঘুমের মধ্যে ধরে নিয়ে গেল।
তখনো সন্ধ্যে হয়নি। ঘুম ভাংলো। ছায়াটি খালের ঐ পাড়ে চলে গেছে। হাতুড়ি বাটাল বাক্সে ভরে বুড়ো মিস্ত্রী আমার গায়ের মাছি তাড়াচ্ছেন। হেসে বললেন, দ্যাখো, তোমাকে খুঁজতে এসেছে।
ভুলু আমার পায়ের কাছে ন্যাজ নাড়ছে। বুড়ো আমার মাথায় তার রোগা আঙ্গুলগুলো বারদুয়েক রেখে বললেন, কক্খোনো হারিয়ে যেও না খোকা।
কে হারাবে? কোনো মানুষ না থাকলেও ভুলু কুকুরটিতো আছে। আমাকে ঠিক খুঁজে বের করবে।

এ গল্পটি যখন আমার মেয়েদের কাছে করি, মেয়েরা হাসে। বলে, কী বোকা। কেউ হারায় নাকি! হুম, প্রশ্ন বটে।
যখন প্লেনে উঠেছি, তখনো আমার স্ত্রী কাঁদছেন।মেঘের অনেক উপরে চলে এসেছি। আমাদের শহরের আলোবিন্দুগুলো আর নেই। ছোট মেয়েটি বলল, আমরা কোথায় যাচ্ছি, বাবা?
জানি না।
বড়ো মেয়েটি বলল, হারিয়ে যাচ্ছি।

এই প্রথম সত্যি সত্যি হারিয়ে গেলাম। কোনো বটগাছ, গোহাট, জিব বের করা মা-কালী, ঘুম কাতুরে শিব ঠাকুর, ছোট মাঠ, খাল পাড়, শিল কড়াইয়ের ছায়া, বুড়া মিস্ত্রী, আধগড়া নৌকা, অথবা আমার ভুলু কুকুরটিও আজ জানে- যে যায়, সে আর ফেরে না।