পৃথিবী কোথা থেকে এলো?
আমি জানিনা। ভাবলো সোফি। নিশ্চয়ই কেউ-ই আসলে জানে না সেটা। জীবনে এই প্রথমবারের মতো সে উপলব্ধি করলো যে, পৃথিবীটা কোথা থেকে এলো এ- ব্যাপারে অন্তত প্রশ্ন না করে পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই ঠিক নয় …
Sophie’s World, Jostein Gaarder

এই সুন্দর ফল, সুন্দর ফল, মিঠানদীর পানি ছেড়ে এবার তাকানো যাক বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের দিকে। এই সুন্দর চাঁদ, সুন্দর তারা, অসীম শূন্যতার দিকে। বাইবেলের প্রথম বাক্য, ইন দ্য বিগিনিং… বা “শুরুতেই …” এবং পরবর্তীতে আরও অনেকবার মহাবিশ্ব সৃষ্টি সম্পর্কিত বাক্য, কুরআনের ৪৫: ৩-৫, ২১:৩০, ৪১:১১, ২১:৩৩, ৫১:৪৭ এইধরণের বাক্য পড়ে আমরা জানতে পারি, এই অপার মহাবিশ্ব একজন সৃষ্টি করেছিলেন শূন্য থেকে। বিভিন্ন ধর্ম বিভিন্ন ঈশ্বরকে বসিয়েছে সেই স্রষ্টার আসনে। ঈশ্বর ভিন্ন হলেও ধর্মবেত্তাদের আয়াত থেকে উদ্ধার করে আনা দেওয়া যুক্তিগুলো একদম কাছাকাছি।

১। প্রতিটি ঘটনারই এক বা একধিক কারণ রয়েছে।
২। কোনো ঘটনার কারণই সেই ঘটনাটা নিজে নয়।
৩। কোনো একটা ঘটনার কারণ হিসাবে থাকে একটা আদি ঘটনা। সেই আদি ঘটনার কারণ হিসাবেও থাকতে পারে অন্য কোনো আদিতর ঘটনা। কিন্তু এভাবে ঘটনাপ্রবাহ অনন্ত কাল ধরে চলতে পারেনা।
৪। তাই অবশ্যই কোনো ঘটনা প্রবাহের একটি মাত্র শুরুর কারণ থাকবে।
৫। আর সেই শুরুর কারণই ঈশ্বর। অতএব ঈশ্বর আছেন।

আমরা সাধারণভাবে ধরে নেই মহাবিশ্বের একটি সূচনা ছিলো। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে, বিগ ব্যাঙ নামক এক মহাবিস্ফোরণের ফলে এই সকল কিছুর উৎপত্তি হয়েছে। যেহেতু কোন কিছুই নিজে নিজে শুরু হতে পারেনা, একে অন্য কারও দ্বারা শুরু হতে হয়, সুতরাং ঈশ্বর হলেন সেই ব্যক্তি যিনি বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে প্রথম বলটা গড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমরা কি তবে ঈশ্বরকে খুঁজে পেলাম?

অবশ্যই না। ঈশ্বরবাদীদের যুক্তি তাদের নিজের তৈরী গর্তেই মুখ থুবড়ে পড়ে। যুক্তির প্রথম পয়েন্টটা এমন হওয়া উচিত ছিলো যে, ‘সকল কিছু হবার পেছনেই কারণ রয়েছে কিংবা এমন কিছু আছে যা হতে কোন কারণের প্রয়োজন নেই, সেটা এমনি এমনিই হতে পারে।’ সৃষ্টিবাদীদের কথা অনুসারে যদি সকল কিছুর হবার পেছনে একটি কারণ থাকে তাহলে সেটা ঈশ্বরের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্য। মহাবিশ্ব সৃষ্টি করা হয়েছে, সৃষ্টিকর্তা হলেন ঈশ্বর। এবার তাহলে কথা হলো, ঈশ্বরকে সৃষ্টি করলো কে? ঈশ্বর যদি নিজে নিজে সৃষ্টি হতে পারেন তাহলে প্রকৃতিও এমনি এমনি সৃষ্টি হয়েছে সেটা ধরে নিতে অসুবিধা কোথায়? ঈশ্বরবাদীরা এইক্ষেত্রে জবাব দেন, ঈশ্বরের কোন সূচনা নেই, তিনি প্রথম থেকেই এমন ছিলেন, তাঁকে কেউ সৃষ্টি করেননি, তিনি নিজে নিজেই হয়েছেন, তারপর খুব দারুন কিছু ব্যাখ্যা করে ফেলেছেন এমন একটা ভাব ধরেন।

‘যার শুরু আছে তার পেছনে কারণ থাকতেই হবে’- এই ধরণের দর্শন কোয়ান্টাম ফ্লাকচুয়েশনের উদাহরণের মাধ্যমে বিজ্ঞান অনেক আগেই বাতিল করে দিয়েছে। আণবিক পরিবৃত্তি (Atomic Transition), আণবিক নিউক্লিয়াসের তেজষ্ক্রিয় অবক্ষয়ের (Radio active decay of nuclei) মতো কোয়ান্টাম ঘটনাসমূহ ‘কারণবিহীন ঘটনা’ হিসেবে ইতিমধ্যেই বৈজ্ঞানিক সমাজে স্বীকৃত। হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা তত্ত্ব (uncertainty principle) অনুযায়ী সামান্য সময়ের জন্য শক্তি (যা E = mc2 সূত্রের মাধ্যমে শক্তি ও ভরের সমতুল্যতা প্রকাশ করে) উৎপন্ন ও বিনাশ ঘটতে পারে- স্বতঃস্ফুর্তভাবে- কোনও কারণ ছাড়াই। এগুলো সবগুলোই পরীক্ষিত সত্য। তাই আমরা যদি ধরে নেই প্রাকৃতিক বিশ্ব কোনও কারণ ছাড়া বা অন্যকারও হাত ছাড়াই এমন হয়েছে সেইক্ষেত্রে অযথা ঈশ্বরকে যোগ করার ঝামেলা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। অক্কামের রেজরের মূলনীতি অনুযায়ী অপ্রয়োজনীয় সকল ধারণা কেটে ফেলতে হয়১। মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে ঈশ্বরকে নিয়ে আসা একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। এই নিয়ে আসার মাধ্যমে আমরা কোন প্রশ্নেরই জবাব পাইনা, উলটা আরও প্রশ্ন সৃষ্টি করি।

সৃষ্টিবাদীরা প্রাকৃতিক বিশ্ব এমন কেন, এটা এমন কিভাবে হলো, যদি হয়েই থাকে তাহলে কে কাজটা করলো?- এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে দিশেহারা হয়ে একটি বাক্যই উচ্চারণ করেন, ঈশ্বর করেছেন। এখন তাহলে সেই একই প্রশ্ন আবার আসলো, ঈশ্বর কে? তিনি কিভাবে এলেন? যদি এসেই থাকেন তাহলে কে তাকে আনলেন? ঈশ্বরের মহাবিশ্ব সৃষ্টি এবং তার অপার মহিমা বর্ননা করার সময় সেন্ট অগাস্টিনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো, আচ্ছা! মহাবিশ্ব সৃষ্টি’র আগে ঈশ্বর কি করছিলেন? জবাবে তিনি রেগে মেগে উত্তর দিয়েছিলেন, যারা এইধরনের প্রশ্ন করে তাদের জন্য জাহান্নাম তৈরী করছিলেন।

ঈশ্বরবাদীদের এই উত্তর খুঁজতে যেয়ে আরও বড় প্রশ্নের উদ্ভবানকে বার্ট্রান্ড রাসেল বেশ দারুন ভাবে বলেছিলেন। হিন্দু পুরান অনুযায়ী মহাবিশ্ব একটি হাতীর উপর, হাতীটি একটি কচ্ছপের উপর বিশ্রাম নেয়। যখন একজন বিশ্বাসী হিন্দুকে কচ্ছপটি কিসের উপর বিশ্রাম নেয় তা জিজ্ঞেস করা হয়, তখন তিনি বলেন, আসো অন্য কিছু নিয়ে কথা বলি।

আজকে আমরা অন্যকিছু নিয়ে কথা বলবোনা। এছাড়াও এই বইয়ের উদ্দেশ্যই এইধরণের নানা ধরণের কুসংস্কার সবার সামনে তুলে ধরা। শুধু প্রশ্ন উত্থাপন করেই আমরা থেমে যাবোনা, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়গুলো কিভাবে ব্যাখ্যা করা যায় সেটাও আলোচনা করবো। বিজ্ঞান হয়তো সকল প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম নয়, কিন্তু বৈপ্লবিক অগ্রগতীতে এখন অনেক কিছুরই জবাব দিতে সক্ষম। যেখানে বিজ্ঞান এখনও পৌঁছাতে সক্ষম হয়নি সেখানেই আমরা ঈশ্বরকে বসিয়ে দিয়ে হাত ঝেড়ে ফেলবো সেটাও ঠিক নয়। বিজ্ঞানের দর্শন আমাদের বুঝতে হবে। আমরা প্রশ্ন করবো, আমরা উত্তর খুঁজবো। সেই উত্তর খোঁজার পথটা যৌক্তিক হওয়া বাঞ্চনীয়। আমি বিশ্বাস করি, বা আমার মনে হয় এমন নয়।

মিরাকল

মহাবিশ্ব কেমন করে এলো? সহস্রবছর ধরে মানুষের মনকে আন্দোলিত করা একটি প্রশ্ন। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় তিনটি ধর্ম ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম অনুসারে একজন ঈশ্বর এই মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছিলেন। প্রশ্নটার এটি একটি উত্তর এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোন থেকে একটি হাইপোথিসিস। হাইপোথিসিস যে কোন কিছুই হতে পারে। তবে সেটিকে সত্য বা বাস্তবতার পর্যায়ে যাবার জন্য যৌক্তিকতা প্রমান করতে হয়। এই অধ্যায়ে আমরা এই ঈশ্বর হাইপোথিসিসকে বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষা করবো, আমরা খুঁজবো অতিপ্রাকৃতিকভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হবার হাইপোথিসিসের সত্যতার কোন প্রমান আছে কিনা। যে প্রমানগুলো আমাদের দরকার তা হলো, ১) মহাবিশ্বের একটি সূচনা ছিল, ২) এই সূচনা প্রাকৃতিকভাবে বা এমনি এমনি হয়নি। মহাবিশ্ব সৃষ্টির পুরো প্রক্রিয়ায় কোন একটি ক্ষেত্রে একটি অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা বা মিরাকল ঘটেছিলো। অর্থাৎ কসমলজিকাল ডাটা যদি আমাদের এমন তথ্য দেয় যে, সৃষ্টির শুরুতে একটি নির্দিষ্ট পর্যায়ে প্রাকৃতিক নিয়মের/ সুত্রের লংঘন ঘটেছিলো যা ব্যাখ্যাতীত এবং এই ব্যাখ্যাতীত ঘটনা বা মিরাকলের ফলেই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো তাহলে আমরা ধরে নিতে পারি ঈশ্বর হাইপোথিসিসের একটি শক্ত ভিত্তি রয়েছে। ঈশ্বর যে রয়েছেন সেটারও রয়েছে।

প্রায় শত বছর আগেই দার্শনিক ডেভিড হিউম দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োগের উপর ভিত্তি করে তিন ধরণের মিরাকলের কথা বর্ননা করে গিয়েছিলেন। ১) এমন কোন ঘটনা যা প্রতিষ্ঠিত কোন প্রাকৃতিক নিয়মের লংঘন। ২) ব্যাখ্যাতীত কিছু ৩) অসম্ভব কিন্তু কাকতালীয়ভাবে ঘটে যাওয়া কোন ঘটনা। ধরা যাক, নাসা অবজারভেটরির বিজ্ঞানীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন পৃথিবীর পাশে নতুন একটি গ্রহ করে উদয় হয়েছে। পৃথিবীর পাশে একটি গ্রহ নতুন করে উদয় হওয়া অসম্ভব কেননা এতে করে, শক্তির নিত্যতার সূত্রের সরাসরি লংঘন হবে। যদি এমনটা হয়ে থাকে তাহলে আমরা এই ঘটনাকে মিরাকল বা অতিপ্রাকৃতিক আখ্যায়িত করতে পারি।

ধর্মবেত্তা রিচার্ড সুইনবার্নও প্রাকৃতিক কোন নিয়মের লংঘনকে মিরাকল বলে আখ্যায়িত করেছেন২। তিনি এর সাথে আরও যোগ করেছেন, লংঘন মাত্র একবার সংগঠিত হলেই সেটা হবে মিরাকল। অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। কারণ কোন লংঘন যদি বার বার সংঘটিত হতে থাকে তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেটি ঘটার প্রাকৃতিক ব্যাখ্যা বের করা সম্ভব। যুক্তিসংগত কারণে, পর্যবেক্ষণে বিজ্ঞান পরিবর্তিত হয়। সুতরাং প্রাকৃতিক নিয়মের নিয়মিত লংঘন হতে থাকলে বিজ্ঞানীরা জানার চেষ্টা করবেন কেন এমন হচ্ছে এবং এর ব্যাখ্যা বের করার জন্য তারা জীবন দিয়ে দিবেন। অবশ্য বিজ্ঞানের এই ধর্মের কারণে অনেকেই একে ব্রাত্য মনে করেন। অনেকটা পাশের বাসার যদুর মতো, যে আদতে কিছুই জানেনা, আজকে এক কথা বলে তো কালকে অন্য!

অবশ্য বিজ্ঞান সম্পর্কে অনেকের ধারণা এমন হলেও, বর্তমানে বিজ্ঞানের জানার পরিধি তাদের অনেকেরই কল্পনাতীত। একই সাথে বিজ্ঞানের অনেক নিয়ম ও সত্যতা সহস্র বছর ধরে অপরিবর্তিত। পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্রগুলো নিউটনের সময় যেমন ছিলো এখনও তাই আছে। বিংশ শতকে কোয়াণ্টাম মেকানিক্সের অভূতপূর্ব উন্নতিতে সেই সূত্রগুলো পরিমার্জিত, পরিবর্ধিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু পদার্থবিজ্ঞান নিয়া নাড়াচাড়া করা সবাই এখনও নিউটনিয়ান মৌলিক বিষয়গুলো যেমন শক্তির নিত্যতার সূত্রের মতো বিষয়ে আগের মতই ঐক্যমত প্রকাশ করেন। চারশ বছরে ধরে এই সূত্র অপরিবর্তিত৩। নিত্যতা এবং নিউটনের গতিসূত্র এখনও আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সে ব্যবহৃত হয়। রকেটের কক্ষপথ নির্ণয়ের গানিতিক হিসেবে এখনও নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র ব্যবহার করা হয়।

এখন, শক্তির নিত্যতা এবং ক্লাসিকাল পদার্থবিজ্ঞানের অনেক নিয়ম বা সূত্র সৌরজগত ছাড়িয়ে লক্ষ কোটি আলোক বর্ষ দূরে অবস্থিত গ্যালাক্সির জন্যও সত্য। যেহেতু বিগব্যাঙ পরবর্তী তের বিলিয়ন বছর ধরে এই নিয়মের সত্যতা সম্পর্কে কারও কোন সন্দেহ নেই, সুতরাং যে কোন পর্যবেক্ষণ, যা এই সূত্রগুলোকে মিথ্যা বা ভুল প্রমান করে তাকে আমরা আমরা সরাসরি মিরাকল আখ্যায়িত করতে পারি।

সন্দেহ নেই, ঈশ্বর যদি আসলেই থেকে থাকেন তাহলে তার একই মিরাকল বারবার ঘটানোর সামর্থ্যও আছে। যাই হোক, আগেই বলেছি, বার বার কোন ঘটনা ঘটলে এর সম্পর্কে অনেক তথ্য জানা সম্ভব হয় এবং এইসব তথ্য পর্যালোচনার মাধ্যমে ঠিকই প্রাকৃতিক কোন ব্যাখ্যা বের করা সম্ভব হয়। কিন্তু যেই ঘটনা একবারই ঘটে সেটা রহস্যাবৃত কাকতালীয়ই রয়ে যায়। ক্রিকেটে ব্যাটসম্যানরা যেমন মাঝে মাঝেই আম্পায়ারের “বেনিফিট অফ ডাউট” পান এই পুরো আলোচনায় আমরা ঈশ্বর হাইপোথিসিসকে সেই রকম বেনিফিট অফ ডাউট দিতে চাই এবং মহাবিশ্বের ঈশ্বরের মাধ্যমে সৃষ্টি হবার সম্ভাবনার সকল পথ উন্মুক্ত রাখতে চাই। কিন্তু যদি সংজ্ঞা অনুযায়ী অত্যন্ত নিন্মমানের মিরাকলের সন্ধানও আমরা আমাদের আলোচনায় না পাই, তাহলে সেইক্ষেত্রে ঈশ্বর হাইপোথিসিসকে সরাসরি বাতিল করে দেওয়া সম্ভব একই সাথে ঈশ্বর নামক ধারণাকে, যিনি মিরাকল ঘটান।

পদার্থের সৃষ্টি

বিংশ শতকের শুরুর দিক পর্যন্ত মহাবিশ্ব সৃষ্টিতে যে একটি বা বেশ কয়েকটি অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন ছিলো তা বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত মানতেন। আমরা জানি মহাবিশ্ব বিপুল পরিমান পদার্থ দিয়ে গঠিত। আর পদার্থের ধর্ম হলো এর ভর। বিংশ শতাদ্বীর শুরু পর্যন্ত ধারনা করা হতো, ভরের সৃষ্টি বা ধ্বংস নেই, এটি শুরু এক রূপ থেকে আরেকরূপে পরিবর্তিত হয়। শক্তির নিত্যতার সূত্রের মতো এটি ভরের নিত্যতার সূত্র। সুতরাং এই বিপুল পরিমান ভর দেখে সবাই ধারণা করে নিয়েছিলেন একদম শুরুতে ভর সৃষ্টি হবার মতো অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো, যা সরাসরি ভরের নিত্যতার সূত্রের লংঘন। এবং এটি ঘটেছিলো মাত্র একবারই- মহাবিশ্বের সূচনাকালে।

পদার্থের অনেক সংজ্ঞা আমরা জানি। আমার কাছে এর সবচেয়ে দুর্দান্ত ও সহজ সংজ্ঞা হলো- পদার্থ এমন একটি জিনিস যাকে লাথি মারা হলে এটি পালটা লাথি মারে। কোন বস্তুর মধ্যকার পদার্থের পরিমাপ করা যায় এর ভরের সাহায্যে। একটি বস্তুর ভর যতো বেশি তাকে লাথি মারা হলে ফিরিয়ে দেওয়া লাথির শক্তি তত বেশি। বস্তু যখন চলা শুরু করে তখন সেই চলাটাকে বর্ননা করা হয় মোমেন্টামের মাধ্যমে, যা বেশিরভাগ সময়ই বস্তুর ভর ও বস্তুর যে গতিতে চলছে তার গুনফলের সমান। মোমেন্টাম একটি ভেক্টর রাশি, এর দিক ও বস্তুর গতির দিক একই।

ভর এবং মোমেন্টাম দুইটি জিনিসই পদার্থের আরেকটি ধর্মকে যথাযথভাবে সমর্থন করে যাকে আমরা বলি ইনারশিয়া বা জড়তা। একটি বস্তুর ভর যত বেশি তত এটিকে নাড়ানো কঠিন এবং এটি নড়তে থাকলে সেটাকে থামানো কঠিন। একই সাথে বস্তুর মোমেন্টাম যত বেশি তত একে থামানো কষ্ট, থেমে থাকলে চালাতে কষ্ট। অর্থাৎ বেশি পরিমান শক্তির প্রয়োজন।

বস্তুর গতির আরেকটি পরিমাপযোগ্য ধর্ম হলো এর শক্তি। শক্তি, ভর ও মোমেন্টাম থেকে স্বাধীন কোন ব্যাপার না, এই তিনটি একই সাথে সম্পর্কিত। তিনটির মধ্যে দুইটির মান জানা থাকলে অপরটি গানিতিকভাবে বের করা সম্ভব। ভর, মোমেন্টাম এবং শক্তি এই তিনটি রাশি দিয়ে আমরা একটি সমকোনী ত্রিভুজ আঁকতে পারি। সমকোনী ত্রিভুজটির লম্ব হলো মোমেন্টাম p, ভুমি ভর m আর অতিভুজ শক্তি E। এখন পিথাগোরাসের উপপাদ্য ব্যবহার করে এই তিনটির সম্পর্ক নির্নয় করা যায়। ছবিতে দ্রষ্টব্য-

লক্ষ করুন, কোন বস্তু যখন স্থির অবস্থায় থাকে তখন এর মোমেন্টাম শূন্য এবং এর শক্তি ভরের সমান (E=m)। এই শক্তিকে বলা হয়ে থাকে পদার্থের স্থিতি শক্তি। এটাই আইনস্টাইনের বিখ্যাত গানিতিক সম্পর্ক E=mc² যেখানে c মান 1। ১৯০৫ সালে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তার এই বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তিনি প্রমান করে দেখান যে, শক্তি থেকে ভরের সৃষ্টি সম্ভব এবং একই সাথে শক্তির মাঝে ভরের হারিয়ে যাওয়া সম্ভব।

স্থির অবস্থায় বস্তুর স্থিতি শক্তি ও ভরের মান সমান। এখন বস্তুটি যদি চলা শুরু করে তখন এর শক্তির মান পূর্ববর্তী স্থিতি শক্তির চেয়ে বেশি। অতিরিক্ত এই শক্তিকেই আমরা বলি, গতিশক্তি। রাসায়নিক ও নিউক্লিয়ার বিক্রিয়ার ফলে গতিশক্তি স্থিতি শক্তিতে রূপান্তরিত হয় যা আদতে বস্তুর ভর৪। একই সাথে উলটা ব্যাপারও ঘটে। ভর বা স্থিতি শক্তিকে রাসায়নিক ও নিউক্লিয় বিক্রিয়ার ফলে গতিশক্তিতে রূপান্তরিত করা সম্ভব, আর সেটা করে আমরা ইঞ্জিন চালাতে পারি, কিংবা বোমা মেরে সব উড়িয়ে দিতে পারি।

সুতরাং আমরা বুঝতে পারলাম মহাবিশ্বের ভরের উপস্থিতি কোন ধরণের প্রাকৃতিক নিয়মের লংঘন করেনা। শক্তি থেকে ভর সৃষ্টি সম্ভব একই সাথে ভরের শক্তিতে রুপান্তর হওয়াটাও একেবারে প্রাকৃতিক একটি ব্যাপার। সুতরাং ভর সৃষ্টি জনিত কোন মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনার প্রয়োজন মহাবিশ্ব সৃষ্টি সময় ছিলোনা। কিন্তু শক্তি এলো কোথা থেকে?

শক্তির নিত্যতা সূত্র বা তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী আমরা জানি শক্তিতে অন্য কোথাও থেকে আসতে হবে। ধর্মের সৃষ্টিতত্ত্ব সত্য হবে যদি তাত্ত্বিকভাবে এমন প্রমান পাওয়া যায় যে, আজ থেকে তের দশমিক সাত বিলিয়ন বছর পূর্বে বিগব্যাঙের শুরুতে শক্তির নিত্যতার সূত্রের লংঘন ঘটেছিলো।

কিন্তু পর্যবেক্ষণ থেকে শুরু করে তাত্ত্বিক ভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মোটেও ব্যাপারটি এমন নয়। তাপগতিবিদ্যার প্রথম সূত্র অনুযায়ী একটি বদ্ধ সিস্টেমে মোট শক্তির পরিমাপ স্থির থাকলেই কেবল শক্তি এক রূপ থেকে অন্য রূপে পরিবর্তিত হয়। মজার এবং আসলেই দারুন মজার ব্যাপার হচ্ছে, মহাবিশ্বের মোট শক্তির পরিমাণ শূন্য৫! বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং তার ১৯৮৮ এর সর্বাধিক বিক্রিত বই, কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বা A Brief History of Time এ উল্লেখ করেছেন, যদি এমন একটা মহাবিশ্ব ধরে নেওয়া যায়, যেটা মহাশূন্যে মোটামুটি সমস্বত্ত্ব, তাহলে দেখানো সম্ভব, যে ঋণাত্বক মহাকর্ষীয় শক্তি এবং ধনাত্বক মহাকর্ষীয় শক্তি ঠিক ঠিক কাটাকাটি যায়। তাই মহাবিশ্বের মোট শক্তি থাকে শূন্য। বিশেষ করে, পরিমাপের অতি সূক্ষ্ম বিচ্যুতি ধরে নিলেও, ক্ষুদ্র কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার মধ্যে, মহাবিশ্বের বড় শক্তির ঘনত্ব ঠিক ততটাই দেখা যায়, যতটা হতো সবকিছু একটা শূন্যশক্তির আদি অবস্থা থেকে শুরু হলে৬।

ধনাত্মক ও ঋণাত্মক শক্তির এই ভারসাম্যের কথা নিশ্চিত করে বিগ ব্যাঙ তত্ত্বের বর্তমান পরিবর্ধিত রূপ ইনফ্লেশনারি বিগ ব্যাঙ ধারণা। ইনফ্লেশন থিওরী প্রস্তাবিত করার পর একে নানাভাবে পরীক্ষা- নিরিক্ষা করা হয়েছে। যেকোন পরীক্ষায় ব্যর্থ বা ভুল ফলাফল দানই এই তত্ত্বকে বাতিল করে দেবার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু এটি সকল পরীক্ষায় উর্ত্তীর্ণ হয়েছে৭।

সংক্ষেপে, মহাবিশ্বে পদার্থ ও শক্তির উপস্থিতি কোন ধরণের প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক না। ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্ব মোতাবেক ঈশ্বরের হস্তক্ষেপের ফলে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পর্যবেক্ষণ ও বিজ্ঞান আমাদের দেখাচ্ছে কারও হস্তক্ষেপ নয় বরঞ্চ একদম প্রাকৃতিকভাবেই এর সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।

এই উদাহরণের মাধ্যমে আরেকটি বিষয়ে আলোকপাত করা যায়। অনেকেই বলে থাকেন, বিজ্ঞানের ঈশ্বর সম্বন্ধে কিছু বলার সামর্থ্য বা সাধ্য নেই। ধরা যাক আমাদের গননাকৃত ভরের ঘনত্বের মান মহাবিশ্বকে একদম শূন্য শক্তি অবস্থায় সৃষ্টি হতে যা প্রয়োজন তার মতো আসেনি। সেইক্ষেত্রে আমরা নির্দ্ধিধায় ধরে নিতে পারতাম, এখনে অন্য কারও হাত ছিলো। সেইক্ষেত্রে এমন ধারণা করাটা হতো বিজ্ঞান সম্মত সুকুমার আচরণ। এর ফলে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমান না হলেও তিনি যে আছেন বা থাকতে পারেন সেটা একটি ভালো ভিত্তি পেতো।

শৃঙ্খলার সূচনা

সৃষ্টিবাদের আরেকটি অনুমানও প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের সাথে মেলে না। যদি মহাবিশ্বকে সৃষ্টিই করা হয়ে থাকে তাহলে সৃষ্টির আদিতে এর মধ্যে কিছুটা হলেও শৃঙ্খলা থাকবে- একটি নকশা থাকবে যেটার নকশাকার সয়ং স্রষ্টা। এই যে আদি শৃঙ্খলা, এটার সম্ভাব্যতাকে সাধারণত প্রকাশ করা হয় তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রের আকারে। এই সূত্র মতে, কোনো একটা আবদ্ধ সিস্টেমের সব কিছু হয় একইরকম সাজানো গোছানো থাকবে (এন্ট্রপি স্থির) অথবা সময়ের সাথে সাথে বিশৃঙ্খল হতে থাকবে (অর্থাৎ এন্ট্রপি বা বিশৃঙ্খলা বাড়তেই থাকবে)। একটি সিস্টেমের এই বিক্ষিপ্ততা কমানো যেতে পারে শুধুমাত্র বাইরে থেকে যদি কেউ সেটাকে গুছিয়ে দেয় তখন। তবে বাইরে থেকে কোনো কিছু সিস্টেমকে প্রভাবিত করলে সেই সিস্টেম আর আবদ্ধ সিস্টেম থাকে না।

তাপগতিবিদ্যার এই দ্বিতীয় সূত্রটি প্রকৃতির অন্যতম একটি মৌলিক সূত্র, যার কখনো অন্যথা হয় না। কিন্তু আমরা চারপাশে তাকালে এলোমেলো অনেক কিছুর সাথে সাথে সাজানো গোছানো অনেক কিছুই দেখি। আমরা এক ধরণের সার্বিক শৃঙ্খলা দেখতে পাই যেটা প্রকৃতির নিয়মেই (তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র) দিনে দিনে বিশৃঙ্খল হচ্ছে। (যেমন তেজস্ক্রিয় পরমানু ভেঙ্গে বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়, অথবা ক্ষয়ে যেতে থাকে পুরোনো প্রাসাদ)। তার মানে সৃষ্টির আদিতে নিশ্চই সব কিছুকে একরকম ‘পরম শৃঙ্খলা’ দেওয়া হয়েছিলো। প্রকৃতির সকল ক্রিয়া-বিক্রিয়া তাপগতি বিদ্যা মেনে সেই শৃঙ্খলাকে প্রতিনিয়ত বিশৃঙ্খল করে চলেছে। তাহলে শুরুতে এই শৃঙ্খলার সূচনা করল কে?

কে আবার? নিশ্চই সৃষ্টিকর্তা! ১৯২৯ এর আগ পর্যন্ত সৃষ্টিবাদের পিছনে এটাই ছিলো অলৌকিক সৃষ্টিবাদীদের একটা শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক যুক্তি। কিন্তু সেই বছর জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডউইন হাবল পর্যবেক্ষণ করেন যে গ্যালাক্সি সমূহ একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে নিজেদের দূরত্বের সমানুপাতিক হারে। অর্থাৎ দুইটা গ্যালাক্সির পারস্পারিক দূরত্ব যত বেশি একে অপর থেকে দূরে সরে যাওয়ার গতিও তত বেশি। এই পর্যবেক্ষণই বিগ ব্যাঙ তত্ত্বের সর্বপ্রথম আলামত। আর আমরা জানি, একটা প্রসারনশীল মহাবিশ্ব চরম বিশৃঙ্খলার থেকে শুরু হলেও এর মধ্যে আঞ্চলিক শৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ সব কিছু এলোমেলোভাবে শুরু হলেও তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে ভঙ্গ না করেও প্রসারনশীল কোনো সিস্টেমের কোনো কোনো অংশে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব।

ব্যাপারটাকে একটা গৃহস্থলির উদাহরণ দিয়ে বর্ণনা করা যায়। ধরুন যখনই আপনি আপনার বাড়ি পরিষ্কার করেন তখন জোগাড় হওয়া ময়লাগুলো জানলা দিয়ে বাড়ির উঠানে ফেলে দেন। এভাবে যদিও দিনে দিনে উঠানটা ময়লা আবর্জনায় ভরে যেতে থাকে কিন্তু ঘরটা সাজানো-গোছানো এবং পরিষ্কারই থাকে। এভাবে বছরের পর বছর চালিয়ে যেতে হলে যেটা করতে হবে উঠান সব আবর্জনায় ভরে গেলে আশে পাশের নতুন জমি কিনে ফেলতে হবে। তারপর সেসব জমিকেও ময়লা ফেলার উঠান হিসাবে ব্যবহার করলেই হলো। তারমানে এভাবে আপনি আপনার ঘরের মধ্যে একটা আঞ্চলিক শৃঙ্খলা রক্ষা করতে পারছেন কিন্তু এর জন্য বাকি দুনিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে।

চিত্র -২: এখানে মহাবিশ্বের সর্বমোট-এন্ট্রপি এবং সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য-এন্ট্রপিকে মহাবিশ্বের ব্যাসার্ধের ফাংশন আকারে আঁকা হয়েছে। শুরুতে (প্লাঙ্ক সময়ে) উভয়ই সমান, যেখান থেকে বলা যায় মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলার মধ্যে। কিন্তু যেহেতু মহাবিশ্ব ক্রমপ্রসারমান, তাই এই নতুন সৃষ্ট স্পেসে সর্বোচ্চ-এন্ট্রপি বা বা সর্বোচ্চ-বিশৃঙ্খলা যতটা হতে পারত মহাবিশ্বের মোট এন্ট্রপি, যদিও সেটাও ক্রমবর্ধমান, তার চেয়ে কম। অর্থাৎ তাবপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্রকে লঙ্ঘন না করেও এই ক্রমবর্ধমান বাড়তি স্পেস মহাবিশ্বের কোনো কোনো অংশে শৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।

একই ভাবে মহাবিশ্বের অংশ বিশেষে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যেতে পারে, যদি সেখানে সৃষ্ট এন্ট্রপি (বিশৃঙ্খলা) ক্রমাগত ভাবে বাইরের সেই চিরবর্ধনশীল মহাশূন্যে ছুড়ে দেওয়া হয়। চিত্র-২ এ আমরা দেখি মহাবিশের সার্বিক বিশৃঙ্খলা তাপগতিবিদ্যা মেনেই ধারাবাহিক ভাবে বেড়ে চলেছে৮। কিন্তু মহাবিশ্বের আয়তনও বাড়ছে ক্রমাগত। সেই বর্ধিত আয়তন (স্পেস) কে পুরোপুরি বিশৃঙ্খলায় ভরে ফেলতে যে বাড়তি এন্ট্রপি লাগতো সেটাই হচ্ছে আমাদের সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য-বিশৃঙ্খলা। কিন্তু চিত্র-১ থেকেই আমরা দেখি বাস্তবে বিশৃঙ্খলার বৃদ্ধির হার তটটা নয়। আর বিশৃঙ্খলার অনুপস্থিতি মানেই শৃঙ্খলা। তাই এই বাড়তি স্পেসে অনিবার্যভাবেই শৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে।

ব্যাপারটাকে এভাবে দেখা যায়। আমরা জানি, কোনো একটা গোলকের (আমরা মহাবিশ্বকে গোলক কল্পনা করছি) এন্ট্রপি যদি সর্বোচ্চ হয় তাহলে সেই গোলকটা ব্লাক হোলে পরিণত হয়। অর্থাৎ ঐ গোলকের আয়তনের একটা ব্লাকহোলই হচ্ছে একমাত্র বস্তু যার এন্ট্রপি ঐ আয়তনের জন্য সর্বোচ্চ। কিন্তু আমাদের এই ক্রমপ্রসারনশীল মহাবিশ্বতো পুরোটাই একটা ব্লাকহোল নয়। তার মানে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি(বিশৃঙ্খলা) সম্ভাব্য-সর্বোচ্চের চেয়ে কিছুটা হলেও কম। তার মানে যদিও সময়ের সাথে সাথে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে ক্রমাগত, তারপরও আমাদের মহাবিশ্ব এখন সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল নয়। কিন্তু একসময় ছিলো। একদম শুরুতে।

ধরুন যদি আমরা মহাবিশ্বের এই প্রসারণকে পিছনের দিকে ১৩.৭ বিলিওন বছর ফিরিয়ে নিয়ে যাই তাহলে আমরা পৌছাব সংজ্ঞাযোগ্য একদম আদিতম সময়ে অর্থাৎ প্লাঙ্ক সময় ৬.৪ x ১০-৪৪ সেকেন্ডে যখন মহাবিশ্ব ছিলো ততটাই ক্ষুদ্র যার চেয়ে ক্ষুদ্রতম কিছু স্পেসে থাকতে পারে না। এটাকে বলা হয় প্লাঙ্ক গোলক যার ব্যাসার্ধ হচ্ছে প্লাঙ্ক দৈর্ঘের (১.৬x১০­-৩৫ মিটার) সমান। তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র থেকে যেমন অনুমান করা হয় তখন মহাবিশ্বের মোট এন্ট্রপি এখনকার মোট এন্ট্রপির চেয়ে তেমন ভাবেই কম ছিলো। অবশ্য প্লাঙ্ক গোলকের মত একোটা ক্ষুদ্রতম গোলকের পক্ষে সর্বোচ্চ যতটা এন্ট্রপি ধারণ করা সম্ভব তখন মহাবিশের এন্ট্রপি ঠিক ততটাই ছিলো। কারণ একমাত্র কোনো ব্লাকহোলের পক্ষেই প্লাঙ্ক গোলকের মত এতটা ক্ষুদ্র আকার ধারণ করা সম্ভব। আর আমরা জানি ব্লাকহোলের এন্ট্রপি সব সময়ই সর্বোচ্চ্য।

পদার্থবিজ্ঞানীরা এই তত্ত্ব শুনে অনেক সময়ই যে আপত্তি জানান সেটা হলো, ‘আমাদের হাতে এখনো প্লাঙ্ক টাইমের পূর্বের ঘটনাবলির উপর প্রয়োগ করার মত কোনো কোয়ান্টাম মহাকর্ষের তত্ত্ব নেই’। আমরা যদি সময়ের আইন্সটাইনিয় সংজ্ঞাটাই গ্রহন করি, মানে ঘড়ির সাহায্যে যেটা মাপা হয়। তাহলে দেখা যায় প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্রতম সময়ের ব্যাপ্তি মাপতে হলে আমাদের প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের চেয়ে ক্ষুদ্রতম দৈর্ঘ্যে মাপযোখ করতে হবে। যেখানে প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্য হচ্ছে প্লাঙ্ক সময়ের আলো যে পথ অতিক্রম করে তার দৈর্ঘ্য। অর্থাৎ আলোর গতি ও প্লাঙ্ক সময়ের গুণফল। কিন্তু হাইজেনবার্গের আনসার্টেনিটি প্রিন্সিপাল থেকে আমরা জানি, কোনো বস্তুর অবস্থান যত সূক্ষ ভাবে মাপা হয় তার শক্তি সম্ভাব্য মান ততই বাড়তে থাকে। এবং গাণিতিক হিসাব থেকে দেখানো যায় প্লাঙ্ক দৈর্ঘ্যের সমান কোনো বস্তুকে পরিমাপযোগ্য ভাবে অস্তিত্বশীল হতে হলে তার শক্তি এতটাই বাড়তে হবে যে সেটা তখন একটা ব্লাকহোল এ পরিণত হবে। যে ব্লাকহোল থেকে কোনো তথ্যই বের হতে পারে না। এখান থেকে বলা যায় প্লাঙ্কটাইমের চেয়ে ক্ষুদ্রতম কোনো সময়ের বিস্তার সংজ্ঞায়িত করা সম্ভব নয়৯।

বর্তমান সময়ের কথা চিন্তা করুন। পদার্থবিজ্ঞানের কোনো প্রতিষ্ঠিত সূত্র প্রয়োগেই আমাদের দ্বিধার কিছু নেই যতক্ষণ না আমরা প্লাঙ্ক সময়ের চেয়ে ক্ষুদ্র বিস্তারের কোনো সময়ের জন্য এর প্রয়োগ করছি। মূলত সংজ্ঞা অনুযায়ী সময়কে গণনা করা হয় প্লাঙ্ক সময়ের পূর্ণসঙ্খ্যার গুণিতক হিসাবে। আমারা আমাদের গাণিতিক পদার্থবিজ্ঞানে সময়কে একটা কন্টিনিউয়াস চলক হিসাবে ধরে পার পেয়ে যাই, কারণ সময়ের এই ক্ষুদ্র অবিভাজ্য একক এতই ছোটো যে ব্যবহারিক ক্যালকুলাসে আমাদের এর কাছাকাছি আকারের কিছুই গণনা করতে হয় না। আমাদের সূত্রগুলো প্লাঙ্ক সময়ের মধ্যেকার অংশগুলো দিয়ে এক্সট্রাপলেট হয়ে যায় যদিও এই ইন্টারভেলের মধ্যে কিছু পরিমাপ অযোগ্য এবং অসংজ্ঞায়িত। এখন এভাবে এক্সট্রাপোলেট যেহেতু আমরা ‘এখন’ করতে পারি, সেহেতু নিশ্চই বিগ ব্যাঙ এর শুরুতে প্রথম প্লাঙ্ক ইন্টারভেলের শেষেও করতে পারবো।

সেই সময়ে আমাদের এক্সট্রপোলেশন এর হিসাব থেকে আমরা জানি যে তখন এন্ট্রপি ছিলো সর্বোচ্চ। এর মানে সেখানে ছিলো শুধুমাত্র ‘পরম বিশৃঙ্খলা’। অর্থাৎ, কোনো ধরণের শৃঙ্খলাই অস্তিত্ব ছিলো না। তাই, শুরুতে মহাবিশ্বে কোনো শৃঙ্খলাই ছিলো না। এখন আমরা মহাবিশ্বে যে শৃঙ্খলা দেখি তার কারণ, এখন বর্ধিত আয়তন অনুপাতে মহাবিশ্বের এন্ট্রপি সর্বোচ্চ নয়।

সংক্ষেপে বললে, আমাদের হাতের কসমোলজিক্যাল উপাত্ত মতে মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে কোনো ধরণের শৃঙ্খলা, নকশা বা নির্মান ছাড়াই। শুরুতে ছিলো শুধুই বিশৃঙ্খলা।

বাধ্য হয়েই আমাদের বলতে হচ্ছে যে আমরা চারিপাশে যে সূক্ষাতিসূক্ষ শৃঙ্খলা দেখি তা কোনো আদি স্রষ্টার দ্বারা সৃষ্ট নয়। বিগ-ব্যাঙ এর আগে কী হয়েছে তার কোনো চিহ্নই মহাবিশ্বে নেই। এবং সৃষ্টিকর্তার কোনো কাজের চিহ্নই বা তার কোনো নকশাই এখানে বলবত নেই। তাই তার অস্তিত্বের ধারনাও অপ্রয়োজনীয়।

আবারও আমরা কিছু বৈজ্ঞানিক ফলাফল পেলাম যেগুলো একটু অন্যরকম হলেই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রমাণ হতে পারতো। যেমন মহাবিশ্ব যদি ক্রমপ্রসারণমান না হয়ে স্থির আকৃতির হতো (যেমনটা বাইবেলে বলে) তাহলেই তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র মতে আমরা দেখতাম সৃষ্টির আদিতে এন্ট্রপির মান সর্বোচ্চ-সম্ভাব্য-এন্ট্রপির চেয়ে কম ছিলো। তার মানে দাড়াতো মহাবিশ্বের সূচনাই হয়েছে খুবই সুশৃঙ্খল একটা অবস্থায়। যে শৃঙ্খলা আনয়ন করা হয়েছে বাইরে থেকে। এমনকি পিছনের দিকে অসীম অতীতেও মহাবিশ্বের অস্তিত্ব থাকতো তাহলে আমরা যতই পিছনে যেতাম দেখতাম সব কিছুই ততই সুশৃঙ্খল হচ্ছে এবং আমরা একটা পরম শৃঙ্খলার অবস্থায় পৌছে যেতাম যে শৃঙ্খলার উৎস সকল প্রাকৃতিক নিয়মকেই লঙ্ঘন করে।

মহাবিশ্বের সূচনা

বিগব্যাঙ বা মহাবিস্ফোরণের মধ্যদিয়ে এই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে- বিজ্ঞানের এই আবিষ্কারের পর ধর্মবেত্তারা বলা শুরু করেছেন এই আবিষ্কারের ফলেই প্রমান হলো ঈশ্বর আছেন, তাদের ধর্মগ্রন্থে আছে বিগব্যাঙ এর কথা।

১৯৭০ সালে জ্যোতি-পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং এবং গণিতবিদ রজার পেনরোজ, পেনরোজের আগের একটি উপপাদ্য আলোকে প্রমান করেন যে, বিগব্যাং এর শুরুতে “সিংগুলারিটি” র অস্তিত্ব ছিলো১০। সাধারণ আপেক্ষিকতাকে শূন্য সময়ের আলোকে বিবেচনা করার মাধ্যমে দেখা যায় যে, বর্তমান থেকে পেছনে যেতে থাকলে মহাবিশ্বের আকার ক্রমশ ছোট এবং ঘনত্ব বৃদ্ধি পায়। পেছন যেতে যেতে যখন মহাবিশ্বের আকার শূন্য হয় তখন সাধারণ আপেক্ষিকতার গণিত অনুযায়ী এর ঘনত্ব হয় অসীম। মহাবিশ্ব তখন অসীম ভর ও ঘনত্ব বিশিষ্ট একটি বিন্দু যার নাম “পয়েন্ট অফ সিংগুলারিটি”। ধর্মবেত্তারা যারা বিগব্যাঙকে ঈশ্বরের কেরামতি হিসেবে ফুটিয়ে তুলতে চান তারা বলেন, তখন সময় বলেও কিছু ছিলোনা।

তারপর থেকে এভাবেই চলছে। বিগব্যাঙ এর আগে অসীম ভর ও ঘনত্বের বিন্দুতে সবকিছু আবদ্ধ ছিলো, তখন ছিলোনা কোন সময়। তারপর ঈশ্বর ফুঁ দানের মাধ্যমে এক মহাবিস্ফোরণ ঘটান, সূচনা হয় মহাবিশ্বের, সূচনা হয় সময়ের। আরেক ধর্মবেত্তা দিনেশ ডি’সুজা বলেন, বুক অফ জেনেসিস যে ঈশ্বর প্রদত্ত মহা সত্য গ্রন্থ সেটা আরেকবার প্রমানিত হলো। আধুনিক বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে, মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছিলো শক্তি এবং আলোর এক বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে। এমন না যে, স্থান ও সময়ে মহাবিশ্বের সুচনা তখন ঘটেছে, বরঞ্চ মহাবিশ্বের সূচনা ছিলো সময় ও স্থানেরও সূচনা১১। ডি’সুজা আরও বলেন, “মহাবিশ্বের সূচনার আগে সময় বলে কিছুর অস্তিত্ব ছিলোনা। অগাস্টিন অনেক আগেই লিখেছিলেন, মহাবিশ্বের সুচনার ফলে সময়ের সূচনা হয়েছিলো। এতোদিনে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান নিশ্চিত করলো, অগাস্টিন এবং ইহুদি, খ্রিস্টানদের মহাবিশ্বের সূচনা সম্পর্কে আদিম উপলব্ধির সত্যতা”১২। অবশ্য আদতে বিজ্ঞানের এই আবিষ্কার জেনেসিসের সত্যতার কোন রকমের নিশ্চয়তা তো দেই না, বরঞ্চ এই ধর্ম গ্রন্থ এবং আরও অনেক ধর্ম গ্রন্থে থাকা সৃষ্টির যে গল্প এতোদিন ধার্মিকরা বিশ্বাস করিয়ে এসেছেন তা কতোটা ভুল এবং অদ্ভুত সেটাই প্রমান করে।

যাই হোক, সিঙ্গুলারিটির কথা বলে ধর্মবেত্তাদের ভেতরে গভীর সাড়া ফেলা স্টিফেন হকিং এবং পেনরোজ প্রায় বিশ বছর আগে ঐক্যমতে পৌঁছান যে, বাস্ততে সিংগুলারিটি নামের কোন পয়েন্টের অস্তিত্ব ছিলোনা। সাধারণ আপেক্ষিকতার ধারনায় হিসেব করলে অবশ্য তাদের আগের হিসেবে কোন ভুল ছিলোনা। কিন্তু সেই ধারনায় সংযুক্ত হয়নি কোয়ান্টাম মেকানিক্স। আর তাই সেই হিসেব আমলে নেওয়া যায়না। ১৯৮৮ সালে হকিন্স এ ব্রিফ হিস্টোরি অফ টাইম বইতে বলেন, There was in fact no singularity at the beginning of universe. অর্থাৎ মহাবিশ্বের সূচনার সময়ে সিঙ্গুলারিটির অস্তিত্ব ছিলোনা১৩।

ডি’সুজার মতো মানুষেরা ব্রিফ হিস্টরি অফ টাইম বইটিতে একনজর চোখ বুলিয়েছেন সেটা সত্যি। কিন্তু পড়ে বোঝার জন্য না। তারা খুঁজেছেন তাদের মতাদর্শের সাথে যায় এমন একটি বাক্য এবং সেটা পেয়েই বাকি কোনদিকে নজর না দিয়ে লাফিয়ে উঠেছিলেন। বইয়ের আলোকে সুজা হকিংকে উদ্ধৃত করে বলেন, বিগ ব্যাঙ এর আগে অবশ্যই একটি সিংগুলারিটির অস্তিত্ব ছিলো১৪। ডি’সুজা এই উদ্ধৃতির সামনের পেছনের বাকি বাক্যগুলোকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে এমন একটি অর্থ দাঁড় করালেন, যা হকিং এর মতের ঠিক উলটো। হকিং আসলে বলছিলেন তাদের ১৯৭০ করা হিসেবের কথা, যেখানে তারা সিঙ্গুলারিটির কথা আলোচনা করেছিলেন। সম্পূর্ণ কথাটি ছিলো এমন- আমার এবং পেনরোজের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল ১৯৭০ সালে একটি যুগ্ম প্রবন্ধের মাধ্যমে প্রথম প্রকাশিত হয়, যেখানে আমরা প্রমান করে দেখাই যে, বিগ ব্যাঙ এর আগে অবশ্যই সিঙ্গুলারিটির অস্তিত্ব ছিলো, যতক্ষণ পর্যন্ত সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সঠিক বলে ধরে নেওয়া হয়, এবং এও ধরে নেওয়া হয় যে, বর্তমানে মহাবিশ্ব যেই পরিমান পদার্থ রয়েছে আগেও তাই ছিলো”১৫ হকিং আরও বলেন,

এক সময় আমাদের(হকিং এবং পেনরোস) তত্ত্ব সবাই গ্রহন করে নিলো এবং আজকাল দেখা যায় প্রায় সবাই এটা ধরে নিচ্ছে যে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে একটা বিন্দু(সিঙ্গুলারিটি) থেকে বিগ ব্যাঙ এর মাধ্যমে। এতা হয়তো একটা পরিহাস যে এ বিষয়ে আমার মত পালটানোর পরে আমিই অন্য পদার্থবিজ্ঞানীদের আশ্বস্ত করতে চেষ্টা করছি, যে এমন কোনো সিঙ্গুলারিটি ছিলো না- আমরা পরে দেখতে পাবো, কোয়ান্টাম ইফেক্টগুলো হিসাবে ধরলে এই সিঙ্গুলারিটি আর থাকে না১৬।

অথচ ধর্মবেত্তারা আজ অবদি সেই সিংগুলারিটি পয়েন্টকে কেন্দ্রে করে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমান বিষয়ক অসংখ্য বই লিখে চলছেন। বছরখানেক আগে প্রকাশিত বইয়ে র‍্যাভি যাকারিয়াস বলেন, “আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বের পাশাপাশি বিগ ব্যাঙ তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা এখন নিশ্চিত সব কিছুর অবশ্যই একটি সূচনা ছিলো। সকল ডাটা আমাদের এই উপসংহার দেয় যে, একটি অসীম ঘনত্বের বিন্দু থেকেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ শুরু হয়েছিলো”১৭।

স্টিফেন হকিং এর প্রথম প্রবন্ধ এতো ভালোভাবে পড়লেও পরবর্তীতে আর কিছু পড়ে দেখার ইচ্ছে হয়তো তাদের হয়নি। কিংবা পড়লেই, নিজেদের মতের সাথে মিলেনা বলে তারা সেটা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে বের করে দিয়েছেন আরেক কান দিয়ে। তারা অবিরাম ঘেঁটে চলছেন সেই পুরোনো কাসুন্দি, যেই কাসুন্দি আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেন কাসুন্দি প্রস্তুতকারী মানুষটি নিজেই।

‘বিগ ব্যাঙ’ তত্ত্বটি বৈজ্ঞানিক সমাজে গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫১ সালে Pope Pius XII পন্টিফিকাল একাডেমীর সভায় ঘোষণা করেছিলেন,

‘যদি সৃষ্টির শুরু থাকে, তবে অবশ্যই এই সৃষ্টির একজন স্রষ্টাও রয়েছে, আর সেই স্রষ্টাই হলেন ঈশ্বর।’

এই কারণেই জ্যোর্তিবিজ্ঞানী এবং ধর্মযাজক জর্জ হেনরি লেমিত্রি (যিনি ‘বিগ ব্যাঙ’ প্রতিভাসের একজন অন্যতম প্রবক্তা) পোপকে সে সময় বিনয়ের সঙ্গে এ ধরনের যুক্তিকে ‘অভ্রান্ত’ হিসেবে প্রচার করা থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন সেটা এখন আমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছি। পোপ বুঝতে পারেন নি, আর তাই এখন পোপের সময় এসেছে ঈশ্বরের বানীকে পরিবর্তন করে বিগ ব্যাঙ্গের মূল বিষয়ের সাথে ধর্মগ্রন্থকে খাপ খাওয়াতে।

প্রাকৃতিক ভাবে কিভাবে মহাবিশ্বের সূচনা হতে পারে

মহাবিশ্বের একটি সূচনা থাকতেই এমন কোন কথা কিন্তু নেই। একে পেছনে সীমাহীন অনন্ত সময় পর্যন্ত টেনে নেওয়া সম্ভব, যেমন সম্ভব সামনের দিকে অনন্ত সময় পর্যন্ত যাওয়া, অর্থাৎ এর কোনো ধ্বংসও নেই। আজ থেকে হাজার কোটি বছর পরে হতে পারে মহাবিশ্বের আর কোন প্রাণ তো দূরের কথা নিউট্রিনোস ছাড়া আর কিছুই নেই, কিন্তু নিউট্রিনো দিয়েই তৈরী একটা ঘড়ি কিন্তু তখনও চলবে- টিক টিক করে।

প্রাকৃতিক ভাবে মহাবিশ্বের সূচনা কিভাবে হতে পারে সেটা নিয়ে জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী ভিক্টর যে স্টেংগরের ব্যাখ্যা আমার সবচেয়ে পছন্দের। এই মতবাদ তিনি দিয়েছেন ১৯৮৩ সালে দেওয়া বিজ্ঞানী জেমস হার্টেল ও স্টিফেন হকিং একটি প্রস্তাবনার আলোকে১৮। গানিতিক মডেল তৈরী করার মাধ্যমে স্টেংগর সম্পূর্ণ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছেন। পরবর্তীতে সেটা নিয়ে তিনি একটি বই ও দার্শনিক প্রবন্ধ প্রকাশ করেন১৯ ২০। তাঁর প্রস্তাবনা সল্প পরিসরে নীচে তুলে ধরা হলো।

এই প্রস্তাবনা অনুযায়ী আমাদের মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো কোয়ান্টাম টানেলিং নামক পক্রিয়ায় অপর একটি মহাবিশ্ব থেকে- যেই মহাবিশ্ব অস্তিত্ব ছিলো অসীম সময় পর্যন্ত, অন্তত আমাদের সময় পরিমাপের দৃষ্টিকোন থেকে। কোয়ান্টাম টানেলিং একটি প্রতিষ্ঠিত বৈজ্ঞানিক ধারণা। কোন বস্তুর একটি বাধার বা দেওয়ালের ভেতর গলে বের হয়ে যাওয়াই কোয়ান্টাম টানেলিং। বিগ ব্যাঙ নামক যেই অভিজ্ঞতা আমাদের মহাবিশ্ব উপলব্ধি করেছে আদিম মহাবিশ্বটি উপলব্ধি করেছে ঠিক তার উলটো একটি অভিজ্ঞতা। আরও একটি ব্যাপার হলো, একটি মহাবিশ্বে সময়ের দিক নির্ধারণ করা হয়ে থাকে এনট্রপি বৃদ্ধি বা বিশৃংখলা বৃদ্ধির দিকের সাথে। এখন অপর মহাবিশ্বের সময়ের দিক যদি আমাদের মহাবিশ্বের সময়ের দিকের ঠিক উলটো হয় তাহলে কোয়াণ্টাম টানেলিং এর মাধ্যমে দুই দিকে দুটি মহাবিশ্বের পথচলা শুরু হতে পারে একেবারে “কিছু না” থেকে।

তবে ভিক্টর স্টেনগর নিজেও স্বীকার করেছেন, আদতে এমনটাই হয়েছে সেটা তিনিও হলফ করে বলতে পারে না। নিউ এথিজম গ্রন্থে তিনি এ বিষয়ে বলেছেন, যেটা হতে পারে এই লেখারও শেষ বক্তব্য২১,

আমার বলতে দ্বিধা নেই, মহাবিশ্বের সূচনা কিভাবে হয়েছিলো তা নিয়ে করা আমার ব্যাখ্যা এতোটা বিখ্যাত নয় সাধারণের কাছে। অবশ্য, এই প্রস্তাবনা প্রকাশের পর কয়েকবছর কেটে গেলেও এখন পর্যন্ত কোন পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ এমনকি দার্শনিকরা কোন ভুল বের করতে পারেন নি। তারপরও আমি দাবী করিনা, ঠিক এইভাবেই মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছিলো। আমি এতটুকুই বলতে চাই, এটি আমাদের বর্তমান জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ন একটি প্রস্তাবনা যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারে, মহাবিশ্বের একটি প্রাকৃতিক অসম্ভব কোন ধারণা নয়। এবং একই সাথে আমি এটাও বলতে চাই, মহাবিশ্ব সূচনায় আসলে ব্যাখ্যাতীত কোন বিষয় বা শূন্যস্থান নেই, যেখানে ধর্মবেত্তারা টুপ করে ঈশ্বরকে বসিয়ে দিতে পারবেন।

তথ্যসূত্রঃ

ছবিতে ক্লিক করে বড় করে দেখুন

অসীম কৃতজ্ঞতাঃ তানভীরুল ইসলাম ওরফে স্পর্শ। নিশ্চয়ই তার জন্য বেহেশতের আম্রকাননে অপেক্ষায় নেই সত্তরজন হুর পরী!