শিশু মন

 

 

নেমেসিসের মত এটাও বড়মণিদের গল্প। শিরোনামে শিশু মন দেখে শিশুতোষ গল্প ভাবলে ভয়ংকর রকমের ভুল করবেন আপনারা। তবে, নেমেসিস গল্পের অন্তঃস্রোতে ক্ষীণ একটা মেসেজ দেবার অপচেষ্টা ছিল। এখানে সেই অপচেষ্টাটি নেই। নিছকই বিনোদনের উদ্দেশ্যে লিখিত এই গল্পটা। গল্পের সারবস্তু খুঁজতে যাওয়াটাও বোকামির পর্যায়েই পড়বে। কাজেই, পাঠকের কাছে আমার অনুরোধ গল্পের গভীরে যাবার চেষ্টা না করে, হালকা মেজাজেই পড়ে ফেলুন এটা। তাতেই অনেক বেশি আনন্দ পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

 

আমি গল্পকার নই। গল্প লেখার জন্য যে কষ্ট-কসরত করতে হয় সেটা আমি কখনোই করি না। যে সামান্য কয়েকটা গল্প লিখেছি এ পর্যন্ত, সেগুলো সবই আচমকা ঝিলিক মেরে আসা কোন ভাবনারই অসফল ফলাফল। এই গল্পটাও সেরকমই এক আচানক ঝিলিকমারা ভাবনার ভূবন থেকেই এসেছে।

 

ভান-ভণিতা করবো না, কেননা গল্পটা পড়লেই আপনারা বুঝে যাবেন যে কোথা থেকে এই গল্পটার উৎপত্তি হয়েছে। গতকাল নৃপেন্দ্রদা তাঁর এক মন্তব্যে বলেছিলেন যে মাহফুজের শিশুর মত একটা মন আছে। এই শিশুর মত মন শব্দটাই ট্রিগার হিসাবে কাজ করেছে। সাথে সাথেই গল্পের এই আইডিয়াটা মাথায় চলে আসে আমার। শিশুর মত মন শব্দটাই এখানে মুখ্য, গল্পে মাহফুজ সাহেবের কোনো ভূমিকাই নেই। কাজেই দয়া করে কেউ এটাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ হিসাবে নেওয়ার কষ্ট-কল্পনা করবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।

 

গল্পের মূল কাহিনি সত্যি। পাত্র-পাত্রী আর অন্যান্য কিছু অংশে আমি রঙ চড়িয়েছি আমার ইচ্ছামতন।

 

মুক্তমনায় দুজন ব্যক্তি আমাকে অন্ধের মত স্নেহ করেন। এদের একজন হচ্ছেন ইরতিশাদ ভাই আর আরেকজন হচ্ছেন গীতাদি। এর মধ্যে ইরতিশাদ ভাই এর সাথে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় আছে, গীতাদির সাথে নেই। কিন্তু তার পরেও তিনি যে কোনো পরিস্থিতিতে অন্ধের মত আমাকে সমর্থন দিয়ে যান। ভুলভ্রান্তি করলে স্নেহার্দ স্বরে বকাঝকা করেন, অন্য অনেকের মত আমার বিনাশ চান না। আমার যে কোনো লেখাতেই, তা সে ছাইপাশ যাই হোক না কেন, দয়ার্দ্র কিছু কথাবার্তা তিনি বলে যাবেনই যাবেন। হাজার হাজার মাইল দূর থেকেও বড়বোনের স্নেহমাখা আচলের আদর মেশানো গন্ধ পাই আমি।

 

আমার পৃথিবী ছোট্ট, খুবই ছোট্ট। ইচ্ছাকৃতভাবেই ছোট করে রেখেছি আমি। সেই ছোট্ট পৃথিবীতে কারো সাথেই চাওয়া-পাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। আমিও কারো কাছে কিছু চাই না, অন্যেরাও আমার কাছে কিছু চায় না। এই না চাওয়া, না পাওয়ার জগতে হুট করে যখন কেউ ভালবেসে কিছু চেয়ে বসে বা আবদার করে তখন বড়ই আপ্লুত হয়ে যাই আমি।

 

কয়েকদিন আগে গীতাদি হঠাৎ করে একটা মেইলে উল্লেখ করলেন যে, অনেকদিন আমার গল্প পড়েন না। আমি যেন একটা গল্প লিখি। প্রবন্ধ লেখা আমার কাছে ডালভাতের মত, কিন্ত গল্প লেখাটা প্রায় অসম্ভব কাজ। আগেই বলেছি চেষ্টা করে আমার গল্প হয় না, হুট করে আসতে হয়। ফলে, গীতাদির সেই মেইলের উত্তর আমি দেই নি।

 

ইচ্ছা ছিল, যদি কখনো লিখতে পারি, তবে আমার পরের গল্পটা আমি গীতাদিকেই উৎসর্গ করবো। কিন্তু এই গল্পটা এমনই দুষ্টু গল্প আর এর এমনই করুণ দশা যে, এটা তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত এই কথাটা গীতাদিকে বলার সাহস আমার নেই। দিদির যদি পছন্দ হয় তবে এটা তাঁর, আর যদি না হয় তবে পড়ে থাকুক আমারই আঙিনায়। অবহেলায় আর অযত্নে।

 ________________________________

 

নাস্তার টেবিলে বসেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো আজিজ সাহেবের। সাড়ে আটটা বাজে। অথচ ছেলেমেয়েদের মধ্যে কেউ-ই নেই টেবিলে। সবাইকে নিয়ে একসাথে একটু নাস্তা করবেন, এই আশাটুকুও বুঝি পূরণ হবার নয়।

 

টেবিলের উপরে রাখা দৈনিক পত্রিকাটা কাছে টেনে নিলেন তিনি। ঘাড় ঘুরিয়ে রান্না ঘরে ব্যস্ত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, তা তোমার সোনার টুকরো ছেলেমেয়েরা সব কোথায়? বুড়ো বাপের সাথে বসে একসাথে নাস্তা করার ভদ্রতাটুকুও কী উঠে গেল নাকি জগৎ-সংসার থেকে?

 

কড়াইতে বসানো গরম তেলের মধ্যে একটা ডিম ভেঙে ছেড়ে দিলেন রাহেলা। ডিম পোচ করছেন। গায়ের উপর ডিমের অযাচিত স্পর্শ পেয়ে ফুঁসে উঠলো গরম তেল। ঝাঁঝালো একটা শব্দ করলো সে। খুন্তি দিয়ে ডিমটাকে উল্টাতে উল্টাতে গরম তেলের চেয়েও আরো ঝাঁঝালো স্বরে উত্তর দিলেন তিনি, ছেলেমেয়ে কি সব আমার একার নাকি? দুনিয়ার কোন খোঁজটা রাখো তুমি শুনি? সারাদিনতো শুধু খাও দাও, ঘুমাও আর পেপার পড়ো। এই রাবণের সংসার কীভাবে সামলাচ্ছি সে আমি জানি।

 

স্ত্রীর এমন ফুঁসে উঠা দেখে কিছুটা চুপসে যান আজিজ সাহেব। চোয়ালের পেশিগুলো যদিও শক্ত হয়ে উঠেছে। রাহেলা আগে এরকম ছিল না। তাঁর মুখের উপর কথা বলার সাহস কোনোদিনই ছিল না। ছেলেমেয়েরা বড় হবার পর থেকেই সাহস বেড়ে গিয়েছে তার। দাদা, বাবার কাছ থেকে শিখেছেন তিনি কীভাবে ঘরের মেয়েদেরকে বশে রাখতে হয়। তাঁর দাদিতো কোনোদিন দাদার সামনে চোখ তুলে তাকানোরই সাহস পেতো না। মাকেও দেখেছেন বাবাকে সমীহ এবং ভয়ের চোখে দেখতে। রাহেলাকেও তিনি সেভাবেই গড়ে নিয়েছিলেন। পুরুষেরা বাইরে পরিশ্রম করে টাকাপয়সা রোজগার করবে। মেয়েদের কাজ হচ্ছে রান্না-বান্না আর ঘর সংসার দেখা। তাহলেই সে না সংসারটা সুন্দরভাবে চলবে, ছেলেমেয়ারা মানুষ হবে। এটাই ছিল তাঁর নীতি।

 

মন দিয়ে পত্রিকাটা পড়ার চেষ্টা করেন তিনি। হঠাৎ খুটখুট শব্দ শুনে পত্রিকাটাকে একপাশে সরিয়ে রেখে লিভিং রুমের দিকে তাকান তিনি। খেলনা নিয়ে এক কোণে আপন মনে খেলা করছে তাঁর নাতনি বুবলি। সকালবেলাতেই কত সুন্দর ঘুম ভেঙে উঠে পড়ে বাচ্চাটা। ওর মা ওকে দাদির কাছে দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে। তারপর সেই দুপুর অবধি পড়ে পড়ে ঘুমোয় স্বামী-স্ত্রী। মাত্র দুদিন হলো চট্টগ্রাম থেকে এসেছে বাবুলরা। তারপর থেকেই ঘর আলো করে রেখেছে বুবলি। বুবলিকে দেখেই মুখের পেশিগুলো নরম হয়ে আসে তাঁর। স্নেহভরা কোমল চোখে তিনি তাকান নাতনির দিকে। হাত ইশারা ডাক দেন বুবলিকে, ওরে আমার দাদুমণি যে, এসোতো দাদুর কাছে এসো।

 

দাদুর ডাক শুনেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় সে। একমাথা কোঁকড়ানো চুলের মাঝখানে নরম ফোলা ফোলা একটা মায়াবী মুখ। ডাগর দুটো কালো চোখ। একেবারে রাহেলার চেহারা পেয়েছে। রাহেলাকে যখন বিয়ে করে আনেন তিনি, কিশোরী একটা মেয়ে ছিল। এরকমই কোঁকড়ানো চুল আর গোলাকার ফুলোফুলো আদুরে চেহারা ছিল তার।

 

এসো, আমার কাছে এসোতো দাদুনি। গলায় আরো আদর ঢেলে বুবলিকে আবারো ডাকেন তিনি। কোন কথা না বলে জিভ বের করে ভেংচি কাটে বুবলি।

 

ওমা, মেয়ে দেখি ভেংচি কাটে। আমি আবার কী করলাম। আদুরে ভঙ্গিতে বলেন তিনি।

 

তুমি পঁচা। আধো আধো মিষ্টি স্বরে বুবলি বলে।

 

আমি পঁচা?

 

হু, তুমি পঁচা। নিজের সিদ্ধান্তে স্থির থাকে বুবলি।

 

কেন পঁচা আমি? কি করেছি আমি?

 

দিদা ভাল। তুমি দিদাকে বকা দিয়েছো, তাই তুমি পঁচা।

 

হো হো করে হেসে উঠেন আজিজ সাহেব নাতনির কথা শুনে। স্ত্রীকে বলেন, শুনেছো তোমার নাতনি কী বলে? আমি নাকি পঁচা? যেমন দিদা, তেমনই তার নাতনি হয়েছে। ভালই ট্রেনিং দিয়েছো।

 

এদিক ওদিক একটু দেখে নিয়ে রাহেলার দিকে তাকিয়ে গলা নামিয়ে বলেন, একেবারে তোমার মতই সুন্দর হয়েছে নাতনিটা আমার। পাকা ডালিম যেন।

 

ভালবাসার কথাতেও মুখ ঝামটে উঠেন রাহেলা। বুড়ো বয়সেও মিনসের রস কমলো না। কোথায় একটু নামাজ কালাম পড়বে তা না পিরিতের বাণী ঝাড়ছেন এখন।

 

বুড়ো হয়েছি বলে কি প্রেম করা যাবে না নাকি? তুমিতো আর বাইরের কেউ না, বিয়ে করা বউ-ইতো।

 

তা যাবে না কেন। এখন প্রেম করবা আবার দুই মিনিট পরেই কিল দিতে চাইবা। তোমাকে আমি চিনি না মনে করেছো। বত্রিশ বছর ধরে আমার হাড় মাংস জ্বালিয়ে খাচ্ছো তুমি। পত্রিকা গিলছো, ওটাই গেলো, আমাকে জ্বালাতে এসো না।

 

নাতনি আর বউ কোনোদিকেই সুবিধা না করতে পেরে মুখটাকে আমশি করে আবারো পত্রিকা পড়া শুরু করেন তিনি।

 

হাই তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে হাফপ্যান্ট আর একটা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে ছোট ছেলে রাতুল এসে দাঁড়ায় ডাইনিং টেবিলের পাশে।

 

হাই, পাপা, গুড মর্নিং।

 

রাতুলের এই সম্ভাষণ শুনেই মাথায় রক্ত চড়ে যায় আজিজ সাহেবের। আগে তাঁর অন্য সন্তানদের মতই বাবা বলে ডাকতো সে। ইদানিং হঠাৎ করেই পাপা বলে ডাকছে। বেশিরভাগ কথাই তাঁর সাথে ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করছে। বাকি সবার সাথেই আগের মত আচরণ আছে, শুধু তাঁর সাথেই রাতুল এ রকম করছে। ফলে, আজিজ সাহেবের মনে বেশ বড়সড় একটা ধারণা জন্মে গেছে যে, কোন কারণে হোক না কেন রাতুল ইদানিং তাঁর সাথে ফাজলেমি করা শুরু করেছে। ঠিক করে রেখেছেন একদিন কষে এমনই ধমক দেবেন যে পাপা বাদ দিয়ে বাবা ডেকে কুল পাবে না এই পাংকু মিয়া।

 

আপাতত দুচোখে আগুন নিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন রাতুলের দিকে। সেই অগ্নিদৃষ্টি সামলাতে না পেরেই হয়তো রাতুল সরে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

 

মা, ভাইয়া কি ঘুম থেকে উঠেছে। আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে রাহেলাকে জিজ্ঞেস করে সে।

 

নাতো উঠেনি। কেনরে ভাইয়াকে কি দরকার তোর? নরম কন্ঠে রাহেলা বলে।

 

তাঁর সাথে কথা বলার সময় রাহেলার এই নরম কণ্ঠ কোথায় উধাও হয় কে জানে। ভাবেন আজিজ সাহেব।

 

না, এই একটু দরকার ছিল। ঠিক আছে, ভাইয়া উঠলে আমাকে ডাক দিয়ো। টেবিলে রাখা কলার কাঁদি থেকে একটা কলা ছিড়ে নিয়ে দ্রুত তার ঘরের দিকে চলে যায় রাতুল।

 

বড় ছেলে বাবুলকে খবর দিয়ে ঢাকায় আনিয়েছেন তিনি। অফিস থেকে দিন কয়েকের ছুটি নিয়ে এসেছে সে। আজিজ সাহেবের পুরোনো অফিসেরই একাউন্ট্যান্ট সাহেব বড় মেয়ে নিশার জন্য একটা পাত্র খুঁজে এনেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। কোনো এক বড় কোম্পানিতে নাকি কাজ করে। তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়ে ঢাকায় এসেছে। মূল উদ্দেশ্য বিয়ে করা।  একাউন্ট্যান্ট সাহেবের দূর সম্পর্কের ভাগ্নে হয়। তিনি সার্টিফাই করেছেন সোনার টুকরো ছেলে বলে। একাউন্ট্যান্ট সাহেব রাশভারী লোক। ফালতু কথা বলেন না। তিনি যখন সোনার টুকরো বলেছেন তখন এই ছেলে শুধু সোনার টুকরো না, হিরের টুকরো হলেও তিনি অবাক হবেন না।

 

কিন্তু বাবুল আসার পর থেকেও কিছুতেই এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারছেন তিনি। দুপুর অবধি সে আর তার বউ ঘুমিয়ে থাকে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া হতে না হতেই দুজনে সেজেগুজে বের হয়ে পড়ে। আজ বেইলি রোডে নাটকতো, কাল কোনো বন্ধুর বাড়িতে আড্ডা। দুজনেই একসাথে পড়াশোনা করেছে বলে বন্ধুমহলও দুজনেরই এক। ফলে, ফুর্তি আর দেখে কে দুজনের। বাবুলের বিয়েটাকে মানতে অনেক কষ্ট হয়েছিল আজিজ সাহেবের। রাহেলাকে বলেছিলেন যে, সমবয়েসি মেয়ে স্বামীকে মান্যগণ্য করে চলবে না। রাহেলা উত্তরে বলেছিল যে, ও নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। এখন যুগ পাল্টেছে। অনেক ছেলেই ক্লাসমেট বিয়ে করছে। কারোতো সেরকম কোনো সমস্যা শুনি নি কখনো।

 

অবশ্য সমস্যা কি সেটা রাহেলা বোঝে কি না সেটা নিয়েই সন্দেহ আছে আজিজ সাহেবের। এই তার ছেলেটা বউয়ের কাছে ভেড়া হয়ে থাকে এটা কি একটা সমস্যা নয়? পুরুষ মানুষকে যদি বউয়ের কথায় চলতে হয় তাহলে আর সে পুরুষ মানুষ থাকে নাকি?

 

নিশার তীক্ষ্ণ চিৎকারে ভাবনায় ছেদ পড়ে আজিজ সাহেবের। নিজের রুম থেকেই চেচিয়ে মাকে বলছে।

 

মা, আমার নীল ব্যাগটা কোথায়?

 

ড্রেসিং টেবিলের উপরেই আছে। খুঁজে দ্যাখ। চেচিয়ে উত্তর দেন রাহেলা।

 

একটু পরেই হুড়মুড় করে নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসে নিশা। শাড়ি পড়েছে। নীল রঙের। ইদানিং খুব ঘন ঘন শাড়ি পড়ছে নিশা, খেয়াল করেছেন আজিজ সাহেব। তাঁদের সময়ে মেয়েরা অবশ্য শাড়ি পরেই ইউনিভার্সিটিতে যেতো। আজকাল সেই চল নেই। আজ আবার খোঁপায় একটা মালাও জড়িয়েছে দেখতে পেলেন। ভাবসাব দেখে একটু শংকিতই হয়ে পড়লেন তিনি। সমবয়েসি কোন ক্লাসমেটের সাথে আবেগময় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেতো বড় সমস্যা হবে। ছেলের ক্ষেত্রে মেনে নিয়েছেন, কিন্তু মেয়ের ক্ষেত্রে মেনে নেওয়াটা কষ্টকর হবে তাঁর জন্য। চালচুলোহীন বেকার ছেলের কাছে বিয়ে দিয়ে মেয়ের সর্বনাশ করবেন নাকি তিনি।

 

মা, গেলাম আমি। বলেই দরজার দিকে রওনা দেয় সে।

 

হাহা করে উঠেন রাহেলা। সে কি রে! নাস্তা করে যাবি না?

 

না মা। দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করলে বাস মিস করবো।

 

 

মাঝপথে বুবলির কাছে থামে সে। কোঁকড়া চুলগুলোতে আঙুল বুলিয়ে আদর করে। তারপর ফোলা ফোলা গালে দুটো চুমু দিয়েই ঝড়ের গতিতে বের হয়ে যায় সে।

 

মেয়ের কাণ্ড দেখে রেগে যাওয়ার পরিবর্তে আতংকিত হয়ে পড়েন আজিজ সাহেব। আর দেরি করা যাবে না। কে জানে মেয়ে কারো প্রেমে পড়ে গিয়েছে কি না। বাবুলের সাথে আজ যে করেই হোক আলাপ করতে হবে। ওর বন্ধুবান্ধব আছে আমেরিকায়। তাঁদেরকে দিয়ে খোঁজখবর নিয়ে এই ছেলেটার সাথে বিয়ের সম্বন্ধটাকে এগিয়ে নিতে হবে।

 

বাবা, মাঝের পাতাটা একটু দেবে আমাকে। তুমিতো পড়ছো না। কোন ফাঁকে যে ছোট মেয়ে দিশা এসে বসেছে ডাইনিং টেবিলে সেটা খেয়াল করেন নি তিনি।

 

কিরে তোর ইউনিভার্সিটি নেই আজকে? মাঝের পাতাটা এগিয়ে দিতে দিতে তিনি বলেন।

 

আছে। টিউটোরিয়াল ক্লাস আছে বিকালে।

 

পত্রিকার মাঝের পাতা থেকে বিজ্ঞাপনের পাতাটা খুলে নেই দিশা। তারপর আধাআধি ভাজ করে দুই টুকরা করে ফেলে। একটা টুকরো দিয়ে দক্ষ হাতে একটা এরোপ্লেন বানিয়ে ফেলে। তারপর বুবলির দিকে তাকিয়ে বলে, বুবলি সোনা, এই দেখো কেমন সুন্দর একটা প্লেন।

 

প্লেনটাকে উড়িয়ে দেয় সে। হাওয়ায় উড়তে উড়তে সেটা একটা সোফার উপরে ঘাড় বাঁকা করে ল্যান্ড করে। খুশি হয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে বুবলি। হাততালি দেয়।

 

রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসেন রাহেলা। বাটিতে স্যুপ। বুবলির জন্য। বুবলিকে হাতে ধরে নিয়ে আসেন তিনি। ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসিয়ে দেন তাকে। তারপর পাশের চেয়ারে বসে চামচ দিয়ে নাতনিকে স্যুপ খাওয়াতে থাকেন তিনি।

 

আজিজ সাহেব আড়চোখে দেখতে পান যে, বাবুলের শোবার ঘরের দরজা সামান্য পরিমাণে খোলা রয়েছে। তারমানে হয়তো জেগে আছে সে। নিশার বিয়ের আলোচনাটা এই সকাল বেলাতে করে ফেলতে পারলেই সবচেয়ে ভাল হয়। দুপুরের পরেই কোনোদিকে চলে যাবে কে জানে। তারপরতো ফিরবে সেই মধ্যরাত পার হয়ে।

 

দিশার দিকে মাথাটা একটু ঝুকিয়ে দেন তিনি। তারপর ষড়যন্ত্রকারীদের মত করে বলেন যে, দেখতো তোর ভাইয়া কোথায়? একটু কথা ছিল। ডেকে নিয়ে আয়তো।

 

বাবুলের শোবার ঘরের দিকে তাকায় দিশা। বড় ভাইয়াকে সে যমের মত ভয় পায়। দ্বিধাগ্রস্থ স্বরে বলে, থাক না বাবা। কাল অনেক রাতে ফিরেছে ভাইয়া আর ভাবি। এখন মনে হয় ঘুমোচ্ছে।

 

সবাইকে চমকে দিয়ে সেই মুহুর্তে কথা বলে উঠে বুবলি, ‘না, না, আব্বুতো ঘুমোচ্ছে না। আব্বু আম্মুর দুদু খাচ্ছে।’