সাধারণ বা বিশ্ব প্রেক্ষিত

আমরা সকলে জানি, বর্তমান যুগকে বলা হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিপ্লবের যুগ”The era of science & technological revolution(STR)” । বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এহেন উৎকর্ষতার যুগে বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধও হওয়ার কথা ছিল অত্যাধুনিক, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক। কারণ দার্শনিক প্রত্যয় হল‘-বস্তু চেতনার জন্ম দেয় এবং চেতনা বস্তুকে পাল্টায়’। ‘সামাজিক সত্ত্বা সামাজিক চেতনাকে নির্ধারণ করে।’ অর্থ্যাৎ যে জনগোষ্ঠী যে সামাজিক পরিবেশে বসবাস করে, সে সমাজের সামাজিক-প্রাকৃতিক পরিবেশ বা আবহের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে সে জনগোষ্ঠীর চিন্তা-চেতনা। ফলত: কোন সমাজের বস্তুগত উন্নয়ন সে সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের গুণগত পরিবর্তন ঘটায়। তাই দেখা যায় যে, বিশ্বে যে রাষ্ট্র বা সমাজ বস্তুগত ভাবে যত বিকশিত বা উন্নত, সে সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ তত উন্নত। পক্ষান্তরে একটি পশ্চাৎপদ সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধও সেকেলে বা পশ্চাৎপদ। বিষয়টিকে আরো সহজ ভাবে বুঝানোর জন্য আমরা আমাদের গ্রাম ও শহরের উদাহরণ টানতে পারি।
আমারা সবাই স্বীকার করব যে, আমাদের শহর আমাদের গ্রামের চেয়ে বস্তুগতভাবে অগ্রসর বা উন্নত। ফলত: শহরের মানুষও গ্রামের মানুষদের চেয়ে অধিকতর স্মার্ট বা সচেতন কিংবা চালাক। একই ভাবে সামগ্রিক বিশ্বের কথা বিবেচনা করলে দেখা যায়, তৃত্বীয় বিশ্বের পশ্চাৎপদ মানুষগুলোর মূল্যবোধ উন্নত বিশ্বের মানুষদের চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ এর চেয়ে পশ্চাৎপদ। কারণ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির একচেটিয়া মালিকানার কারণে আজ ইউরোপ-আমেরিকার উন্নত দেশগুলো পরিণত হয়েছে বিশ্ব শহর, আর অনুন্নত বা তথাকথিত উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিণত হয়েছে বিশ্ব শহরের উপর নির্ভরশীল বিশ্ব গ্রামে, তথা Metropolitan-satellite state এ। তারপরও বর্তমানে বিশ্ব মানবগোষ্ঠীর জন্য আপাত-স্ববিরোধী বিষয় (Paradox) হল, বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে বিশ্ব উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছলেও বিশ্ব-মানবগোষ্ঠী চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধে যুগপৎ বিকশিত হয়নি। তাই নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ আজ উন্নত বিশ্বেও বিদ্যমান যদিও মাত্রাগত ভিন্নতা আছে। অথচ নারীর প্রতি সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গী, নারীকে পুরুষের চেয়ে আতরাফ ভাবা, পরিণামে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিগ্রহ-নির্যাতন পশ্চাৎপদ চেতনা বা মূল্যবোধের বহি:প্রকাশ।

কিন্তু বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত আধুনিক বিশ্বেও কেন সে চেতনা বা মূল্যবোধ এখনো বিরাজমান থাকবে? তাহলে কি চেতনার বস্তুগত ভিত্তির প্রপঞ্চটি ভুল? না-তা নয়। তার প্রকৃত কারণ উপলব্ধি করতে হলে ‘বস্তু চেতনার জন্ম দেয় এবং চেতনা বস্তুকে পাল্টায়’, দার্শনিক এ প্রত্যয়টিকে যান্ত্রিক ভাবে দেখলে হবে না। বস্তু থেকে চেতনার জন্ম হলেও আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে, চেতনারও আছে আপেক্ষিক স্বাধীনতা। যে কারণে একটি পশ্চাৎপদ সমাজেও কখনো কখনো চিন্তা-চেতনায় প্রাগ্রসর মানুষের আবির্ভাব ঘটে। তেমনি সমাজের বস্তুগত বিকাশের সাথে সব সময়ে স্বত:স্ফূর্ত ভাবে চেতনার বিকাশ ঘটে না-তার ক্ষেত্র তৈরী হয় মাত্র। এমনকি বিজ্ঞানের অগ্রগতির মাধ্যমে সামাজিক সত্ত্বার পরিবর্তন অনিবার্য হলেও সামাজিক চেতনার বিকাশকে নানা ফন্দি-ফিকিরে দমিয়ে রাখা সম্ভব; অন্তত: কিছু কাল পর্যন্ত।

এখানে আমাদের আরো একটি দার্শনিক প্রত্যয় স্মরণ রাখতে হবে যে, একটি সমাজের শাসক শ্রেণীর মূল্যবোধ ও চেতনা সমাজের প্রধান মূলবোধ ও চেতনা হিসাবে বিরাজমান থাকে। (The ruling ideas of a society are the ideas of the ruling class)। তাই দেখা যায়, কি ধর্মবেত্তা, কি ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ, কি অর্থলোভী বিশ্ব-বেনিয়ার দল, তথা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি-তারা নিজেরা বৈজ্ঞানিক বিকাশের সর্বশেষ সুফল, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলেও-সর্বাধুনিক চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধকে তারা ধারণ করে না এবং সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে তদানুসারে মানুষের চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধকে বিকশিত হতে দেয় না-তাদের কায়েমী স্বার্থে। তারা মানুষের চিন্তা-চেতনার বিকাশকে ততটুকুই মেনে নেয়, যতটুকু মেনে নিলে তাদের কায়েমী স্বার্থে আঘাত লাগবে না। এ ক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা বিপদাশঙ্কায় (Vulnarable) আছে ধর্ম ও ধর্মবেত্তারা। কারণ প্রতিটি নতুন বৈজ্ঞানিক আবিস্কার শত সহস্র বৎসর ধরে লালিত মানুষের ধর্ম বিশ্বাসে সুতীব্র আঘাত হানে। তখন ধর্মবেত্তারা মরিয়া হয়ে নানা অপযুক্তি-কুযুক্তি দিয়ে প্রমাণ করতে লেগে যায় যে, বিজ্ঞানের এ নতুন আবিস্কার পূর্ব থেকেই তাদের ধর্মগ্রন্থে ছিল। নরাধম(!) বিজ্ঞানীর তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে চুরি করে তা তার নামে প্রচার করছে। (কিন্তু তারা কেন এতদিন তাদের ধর্মগ্রন্থের এ যুগান্তকারী আবিস্কার বা তার ফর্মূলা মানুষকে জানাল না, সে প্রশ্ন তাদের করবে কে?) এর বাহিরে, নয়াঔপনিবেশিক বা সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সুফল ষোলকলা উপভোগ করলেও রাষ্ট্রীয় ভাবে আধুনিক চিন্তা-চেতনাকে একটি সীমারেখার বাইরে বাড়তে দেয় না। তাই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সদম্ভে ঘোষণা করেন, ঈশ্বরের নির্দেশে তিনি ইরাক আক্রমণ করেছেন। বুশ-ক্লিনটন গং বিশ্বের সর্বাপেক্ষা আধুনিক প্রযুক্তির অধিকারী দেশের রাষ্ট্র প্রধান হয়েও জেনেটিক সায়েন্স এর অভাবিত আবিস্কারগুলোকে ধর্মীয় নৈতিকতার দোহাই দিয়ে নিষিদ্ধ করে রেখেছেন। ফলত: এসব উন্নত দেশও সর্বাংশে এখনো পশ্চাৎপদ সকল মূল্যবোধ পরিহার করতে পারে নি। সে কারণে বিশ্বের সর্বাধুনিক ও সর্বোন্নত দেশেও নারী নির্যাতন চলে। তবে সে সব উন্নত বিশ্বে নারী নির্যাতনের ধরণ ও মাত্রা পশ্চাৎপদ দেশের নারী নির্যাতনের চেয়ে ভিন্ন। আমাদের দেশের মত পশ্চাৎপদ দেশগুলোতে নারী নির্যাতন এখনো মধ্যযুগীয় বর্বরতার পর্যায়ে রয়ে গেছে।

নারী নির্যাতন : আমাদের সংস্কৃতি ও দেশীয় প্রেক্ষিত

আমাদের দেশে নারী নির্যাতন ও তার প্রতিকার নিয়ে প্রকাশিত নানা প্রবন্ধ-নিবন্ধ-টক্-শো, সভা সেমিনারের পাশাপাশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াতে যে সব আলোচনা হচ্ছে, সেখানে অধিকাংশ আলোচনাতে বিষয়টাকে কেবল আইন-শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা হিসাবে দেখানো হচ্ছে। নির্যাতনের ধরণ, সংখ্যা, তা অবদমনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ইত্যাকার বিষয় আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে। কিন্তু বিষয়টিকে মনস্তাত্ত্বিক ও সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে, অর্থাৎ সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবস্থার প্রেক্ষিতে দেখার প্রবণতা তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। এ যেন অনেকটা রোগের উপসর্গ দূর করে রোগ সারানো হাতুড়ে ডাক্তারী প্রয়াস।

নারী নির্যাতন আমাদের সংস্কৃতি বিশেষভাবে লোকজ সংস্কৃতির একটি অপরিহার্য অনুসঙ্গ হয়ে আছে। এটা আমাদের ঐতিহ্য। বলাবাহুল্য, আমাদের সকল ঐতিহ্য কিন্তু গৌরবের নয়; বরং অনেক পশ্চাৎপদ এবং লজ্জাজনক ঐতিহ্য জাতিগতভাবে আমরা এখনো আকঁড়ে ধরে আছি। যেমন অসুখে-বিসুখে তাবিজ-মাদুলী-পানিপড়া গ্রামের সিংহভাগ মানুষের কাছে এখনো একটি বিশ্বাসযোগ্য চিকিৎসা । বালা-মুসিবত থেকে পরিত্রাণের আশায় গলায় মাদুলি, কোমরে, বাহুতে কিংবা কব্জিতে তাবিজ এবং অঙ্গুলীতে রঙ-বেরং এর পাথরের অঙ্গুরী এখনো অনেক শিক্ষিত এবং শহুরে মানুষের মধ্যেও দেখা যায়। গ্রামে-গঞ্জে এমনকি শহুরে অনেক মানুষেরাও এখনো ইহকাল-পরকালের মুক্তির আশায় অশিক্ষিত গ্রাম্য হুজুর-তান্ত্রিক-সাধু-সন্ত-সাঁইবাবা, এমন কি উম্মাদ-ন্যাংটা ফকিরের আস্তানায় হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। এটাও আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রাপ্ত কত শহুরে তরুণীদের দেখেছি বর পাওয়া কিংবা বিবাহোত্তর সন্তান লাভের আশায় গ্রাম্য ফকির বাবার দরগায় গিয়ে শিরনি দিতে, দরগাহের খাদেম নামক মস্তানদের পা ছুঁয়ে দোয়া চাইতে। বন্ধ্যাত্ব্য ঘুচানোর জন্য হুজুর সাঈদাবাদীর সিদ্ধ ডিম বিতরণের গল্প এবং তৎজন্য কলকাতায় কারাভোগের সংবাদ তো আমরা জানি। মজার ব্যাপার হল, আমাদের কতিপয় জাতীয় নেতারাদেরও একবার তার “হিমেল পাউডার” এর মডেল সাজিয়ে কোন কোন জাতীয় পত্রিকার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। আমাদের এখনো স্মরণ আছে একদা আমাদের এক রাষ্ট্রপ্রধান-তার বিরুদ্ধে যখন গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হল-রাষ্ট্রীয় প্রটোকল নিয়ে প্রকাশ্যে আটরশ্মির পীরের কাছে ধর্ণা দিতে শুরু করল এবং সে পীর তাকে কী কী নসিহত করত তা সে সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে জানাত ! আমাদের বহু জাতীয় নেতা ব্যক্তিভাবে এজাতীয় কোন না কোন অশিক্ষিত গ্রাম্য পীরের মুরিদ হয়ে আছে। অস্বস্তিকর হলেও স্বীকার করতে হয়, এসব নিয়েই আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের পরিবারগুলোতে ছেলে-মেয়ের সাথে বাবা-মার আচরণ, স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য সম্পর্কের ধরণ, ছেলে ও মেয়ে সন্তানের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গী, বিশেষ ভাবে পরিবারের নারী সদস্যাদের আচরণ, তার পোষাক-পরিচ্ছদ, চলাফেরা, কথা-বার্তা ইত্যাকার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে ধর্মের নামে যে সব বিধি-বিধান-তা যুক্তিযুক্ত হউক বা না হউক-সে সব আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে বহন করে আসছি। বলা বাহুল্য, ঘুষ-দুর্নীতি-ভূমি দখল-লুটপাট এর মত বিষয়গুলোও আমাদের সংস্কৃতিতে অঙ্গীভূত হয়ে গেছে কালক্রমে। পক্ষান্তরে আধুনিক কিংবা উত্তর আধুনিক কালে বিশ্বব্যাপী যে সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণÑমানবাধিকার, মানবতাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমান অধিকার, ইত্যাকার চেতনা ও মূল্যবোধগুলো এখনো আমাদের শাসক শ্রেণীর মূল্যবোধ ও চেতনায় প্রভাব ফেলতে পারে নি। ফলত: এসব বিষয় সমাজের বিশাল জনগোষ্ঠীর চেতনাকে স্পর্শ করা এখনো সুদূরপরাহত। ন্যূনতম যুক্তিবোধ থাকলে আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, ঐতিহ্যগতভাবেই নারীর প্রতি আমাদের পরিবার ও সমাজের বিদ্যমান যে দৃষ্টিভঙ্গী, তা মোটেও রমণীয় নয়, বরং দমনীয়-নিবর্তনমূলক। নারী নির্যাতনে মূল হেতু কিন্তু এখানেই। তাই আমাদের আর্থ-সামাজিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাঠামোকে অক্ষুণœ রেখে বিচ্ছিন্ন ভাবে কেবল নারী-মুক্তির চিন্তা অবৈজ্ঞানিক। আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, জাতীয়-মুক্তির প্রশ্নের সাথে সার্বিক অর্থে নারী মুক্তির প্রশ্নটি অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে।
আমাদের সমাজে বিদ্যমান উপরোক্ত সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গগুলো আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার কোন রোগ নয়; বস্তুত: দারিদ্র্যের যে মহামারিতে আমাদের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা আক্রান্ত, তার বহুমাত্রিক উপসর্গ মাত্র। এসব অসহনীয় উপসর্গ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের নির্ণয় করতে হবে প্রকৃত রোগ এবং তার কারণ। এর কোন বিকল্প নেই। তবে এক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের সাথে রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রশ্নটিও জড়িত, যার আশু কোন সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না, ফলত: তা একটি সুদূরপরাহত ব্যাপার।

ততদিন কি আমাদের সমাজে নারী নির্যাতন নির্বিঘ্নে চলবে? তা প্রতিরোধের কোন লড়াই কি চালানো নিরর্থক? না, মোটেই নয়। আমাদের ভুললে চলবেনা যে, আমাদের সমাজ পশ্চাৎপদ হলেও তা আজ বিশ্ব সমাজেরই অংশ। আজ বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিকাশের বিশ্ব প্রেক্ষিতে আমাদের সমাজেও যুক্তিবাদ বিকাশের ক্ষেত্র অত্যন্ত উর্বর হয়ে আছে। প্রয়োজন আধুনিক শিক্ষা, বিশেষভাবে বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা এবং যুক্তিবাদের চর্চা।
স্বাধীনতার সুদীর্ঘ প্রায় চার দশক পরও নির্মম সত্য হল, আমাদের দেশ এখনো একটি পশ্চাৎপদ দেশ। আমাদের এ পশ্চাৎপদতা সামগ্রিক। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে আমরা পশ্চাৎপদ। কি শিল্পে, কি কৃষিতে, কাক্সিক্ষত বিকাশের মাধ্যমে আমরা আমাদের দারিদ্য্র ঘুঁচাতে পারি নি। নির্মম ফলশ্রুতিতে নানা রূপ পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধ আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠীকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাছাড়া ঐতিহ্যগত ভাবেও অনেক কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস আমাদের সমাজে বিদ্যমান। অর্থাৎ আমারা বিত্তে পশ্চাৎপদ বলে চিত্তেও পশ্চাৎপদ। আবার আমাদের চিত্তের এ পশ্চাৎপদতা আমাদের বিত্তের পশ্চাৎপদতা অতিক্রম করার পথে এক দুর্লঙ্ঘ্য বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পশ্চাৎপদতার এ দুষ্ঠচক্র (A vicious circle of lagging-behind) ভাঙ্গতে না পারলে আমাদের মুক্তি অসম্ভব ।

আমরা সকলে জানি, একটি স্রোতহীন মৃত নদী কিংবা বদ্ধ জলাশয়ে যেমন অসংখ্য শেওলা-আগাছা জন্ম নেয়, ঠিক তেমনি একটি পশ্চাৎপদ সমাজে মানুষের মধ্যে নানা প্রকার অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, ধর্ম কিংবা বর্ণ ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডুকতা, পরমত অসহিষ্ণুতা, পরিণামে মৌলবাদ-জঙ্গীবাদ ইত্যাদি জন্ম নিতে থাকে। আমরা সকলে জানি, কিংবা কোন কোন বিশ্ব সংস্থা ফি বছর আমাদের জানান দেন যে, আমরা পৃথীবির দরিদ্রতম দেশগুলোর মধ্যে ১ম, ২য় না ৩য় স্থান দখল করে আছি। একদিকে সম্পদ নেই বলে আমরা গরীব, অন্যদিকে বিত্তহীন এ সমাজও নিদারুণ ভাবে বৈষম্যময়। এখানে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান সীমাহীন। কোন সমাজে যদি বৈষম্য বিদ্যমান থাকে এবং সেখানে যদি অবিচার, জুলুম, লুটপাট অব্যাহত থাকে, তাহলে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, সর্বাধিক দুর্বল জনগোষ্ঠীই হবে এর সর্বাধিক শিকার। আমাদের সমাজে নারী এখনো পিতা-স্বামী-পুত্রের উপর চুড়ান্তভাবে নির্ভরশীল। তাই তাদের সিংহভাগ একবার শোষিত-নির্যাতিত হচ্ছে শ্রেণীগত ভাবে, আবার হচ্ছে লিঙ্গ বৈষম্যের ভিত্তিতে । লিঙ্গ ভিত্তিক শোষণ থেকে ধনাঢ্য পরিবারের নারীরাও কিন্তু মুক্তি পাচ্ছে না। শ্রেণীগত শোষণের কারণ আর্থ-সামাজিক, যা নির্ভর করে একটি শ্রেণী বিভক্ত সমাজের উপর, আবার লিঙ্গভিত্তিক শোষণ-নির্যাতনের কারণ সামাজিক সাংস্কৃতিক, যার মূলে রয়েছে আমাদের চিন্তা চেতনা মূল্যবোধের দৈন্যতা। আমরা শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, আমাদের এ দৈন্যতা কিন্তু আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

ধর্ম এখনো আমাদের সংস্কৃতিতে একটি নির্ধারক প্রভাবক হিসাবে বিরাজমান। বিশেষভাবে লোকজ সংস্কৃতিতে ধর্মের প্রভাব সর্বগ্রাসী। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খৃস্টান সব ধর্মের লোকদের ব্যাপরে এ বক্তব্য সমানভাবে প্রযোজ্য এবং এটা আমাদের সুদীর্ঘ দিনের পারিবারিক ও সামাজিক ঐতিহ্য। আমরা দেখি আমাদের পরিবারগুলোতে একটি শিশুর জন্মের সাথে সাথে সদ্যজাত শিশুটির সামনেই সজোরে বারংবার সজোরে উচ্চারিত হতে থাকে নানা ধর্মীয় বাণী-দোয়া-দুরুদ-মন্ত্র পাঠ। পরম আত্মীয়দের তৈরী নানা জামা কাপড়ের মত বিশ্বাস-চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের অদৃশ্য এক তকমাও সদ্যজাতকের জন্য তৈরী হয়ে থাকেÑ জন্মের সাথে সাথে যা তার শরীরে এঁটে দেওয়া হয়। চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের সে তকমায় আবৃত থেকে সে কালক্রমে বেড়ে ওঠতে থাকে। সেখান থেকে মুক্তি পাওয়া দু:সাধ্য ব্যাপার। বরং কালক্রমে তার চিন্তা-চেতনা-মূল্যবোধের সাথে তা মিশে একাকার হয়ে যায়। নারী সম্পর্কে বিশেষ যে দৃষ্টিভঙ্গী আমরা পোষণ করি, তার প্রাথমিক উৎস কিন্তু আমাদের ধর্ম। আমাদের ধর্মে নারী সম্পর্কে যে দৃষ্টিভঙ্গী তা বুঝার জন্য আমি ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কুরআন এর কিছু আয়াত এখানে উদ্ধৃত করছিÑ
“আর যদি তোমরা ভয় কর যে, এতিম মেয়েদের হক যথাযথ ভাবে পূরণ করতে পারবে না তবে সে সব মেয়েদের মধ্য থেকে যাদের ভাল লাগে বিয়ে করে নাও দুই, তিন কিংবা চারটি পর্যন্ত। তবে যদি আশঙ্কা হয় যে, তাদের সাথে ন্যায়সঙ্গত আচরণ করতে পারবে না তবে শুধুমাত্র একটি।” আল কোরান; সূরা আন্-নিসা (৪:৩)
“ঈমানদার নারীদের বলুন, তারা যেন দৃষ্টি নত রাখে এবং যৌনাঙ্গের হেফাজত করে। যা সাধারণত প্রকাশমান তা ছাড়া তারা যেন সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে, তারা যেন মাথার ওড়না বক্ষদেশে ফেলে রাখে। তারা যেন স্বামী, পিতা, শশ—র, পুত্র, ভ্রাতা, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নিপুত্র, স্ত্রীলোক, অধিকারভুক্ত বাঁদী, যৌণ কামনামুক্ত পুরুষ, বা বালক, যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত কারও কাছে সৌন্দর্য্য প্রকাশ না করে। গোপন সোন্দর্য্য প্রকাশের জন্য তারা যেন জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগন, তোমরা আল্লাহের সামনে তওবা কর যেন সফলকাম হতে পার।” সূরা আন-নূর(২৪ : ৩১)
“তোমাদের স্ত্রীরা হল তোমাদের জন্য শস্যক্ষেত্র। তোমরা যে ভাবে ইচ্ছা তাদেরকে ব্যবহার কর।” সূরা আল বাক্বারা (২:২২৩)
“আর নারীদের ওপর পুরুষদের শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে। আর আল্লাহ পরাক্রমশীল ও বিজ্ঞ।” সূরা আল বাক্বারা(২:২২৮)
“ পুরুষেরা নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল এ জন্য যে, আল্লাহ একের উপর অন্যের বৈশিষ্ট দান করেছেন এবং এ জন্য যে, তারা তাদের অর্থ ব্যয় করে। সে মতে নেক্কার স্ত্রীলোকগণ হয় অনুগত এবং অল্লাহ্ যা হেফাজতযোগ্য করে দিয়েছেন লোক চক্ষুর অন্তরালে তার হেফাজত করে। আর যাদের মধ্যে অবাধ্যতার আশঙ্কা কর তাদের সদুপদেশ দাও. তাদের শয্যা ত্যাগ কর এবং প্রহার কর। যদি তাতে তারা বাধ্য হযে যায়, তবে আর তাদের জন্য অন্য কোন পথ অনুসন্ধান করো না। নিশ্চয় আল্লাহ সবার উপরে শ্রেষ্ঠ।” সূরা আন্ নিসা( (৪:৩৪)
“ সকল সধবা নারী তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে, কিন্ত তোমাদের স্বত্বাধীন যেসব দাসী রয়েছে তাদের হারাম করা হয়নি।” সূরা আন্ নিসা(৪:২৪)
“ দুজন স্বাক্ষী কর তোমাদের পুরুষদের মধ্য থেকে। যদি দুজন পুরুষ না হয়, তবে একজন পুরুষ ও দুজন মহিলা”। সূরা আল বাক্বারা (২: ২৮২)
উপরোক্ত আয়াতগুলোর ব্যাখ্যা বা তফশির মুসলিম ধর্মবেত্তারা কিংবা ডাক্তার জাকির নায়েকদের মত ইসলামী বিশেষজ্ঞরা যে ভাবেই করুক না কেন, তাতে ইসলাম ধর্মে নারীর অবস্থান যে পুরুষের চেয়ে অধস্তন, সেটা কি অস্বীকার করার কোন অবকাশ আছে ? অথচ প্রত্যেক ধর্মবিশ্বাসী মুসলমানের কাছে উপরোক্ত বাণী গুলো আল্লাহের অমোঘ বিধান হিসাবে বিশ্বাসযোগ্য এবং তা তারা পালন করার সর্বোত চেষ্টা করে।
নারীর প্রতি ইসলামে চরম বৈষম্য ধরা পড়ে মৌরসী সম্পত্তির উত্তরাধিকারের প্রশ্নে।
যেমন-“ একজন পুরুষের অংশ দু’জন নারীর সমান।”
সূরা আন নিসা ( ৪:১১)

আসুন এবার সনাতন হিন্দু ধর্মে নারীর জন্য কী বিধান রাখা হয়েছে। হিন্দু ধর্মে “পতি পরম গুরু”, “পতি সেবা সতী ধর্ম” ইত্যাদি শ্লোক হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা মনপ্রাণ দিয়ে মেনে চলে। কারণ মনুর বিধানে আছে (৯:৩)Ñপিতা রক্ষতি কৌমারে ভর্ত্তা রক্ষতি যৌবনে। রক্ষতি স্থবিরে পুত্রা না স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমহতি।। অর্থাৎ নারীকে পিতা রক্ষা করবে কুমারীকালে, স্বামী রক্ষা করবে যৌবনে । বার্ধক্যে রক্ষা করবে পুত্ররা। স্ত্রী স্বাধীনতার যোগ্য নয়।।
মনুসংহিতা(২:৬৭) বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদকঃ স্মৃতঃ পতিসেবা গুরৌবাসো গৃহার্থোহান্নি পরিক্রিয়া।।
অর্থাৎ বিয়েই নারীর বৈদিক উপনয়ন, পতিসেবাই গুরুগৃহবাস, গৃহকর্মই গোমস্বরূপ অগ্নিপরিচর্যা।।
মনু আরো বলেছেন (৫ঃ১৫৪) পতি সদাচারহীণ, পরস্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্কযুক্ত বা গুণহীন হলেও সতী স্ত্রী সেই পতিকে দেবতার মতই পুজা করবে।
(৫ঃ১৫৫) স্ত্রীর স্বামী ছাড়া পৃথক যজ্ঞ নেই, পতির অনুমতি ছাড়া ব্রত বা উপবাস নেই। নারী স্বর্গে যেতে পারে কেবল মাত্র স্বামী সেবার সাহায্যেই। এ জাতীয় নারীর জন্য অবমাননাকর আরো অনেক উদ্বৃতি দেওয়া যাবে।
মনুসংহিতার এ সকল বিধান এখনো হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সর্বান্তকরণে মেনে চলে। মৃত স্বামীর সাথে হিন্দু বিধবার সহমরণ তো বন্ধ হয়েছে রাজা রামমোহন রায় সহ কিছু সমাজসংস্কারকদের তীব্র আন্দোলন ও তৎপ্রেক্ষিতে বৃটিশ রাজের আইনী বিধানের ফলে। তবে এখনো সহমরণকে পরম ধর্ম জ্ঞান করে বিশাল ভারতের কোন কোন রাজ্যে সরকারের অগোচরে সহমরণের ঘটনার সংবাদ পত্রিকান্তরে জানতে পাওয়া যায়।

এ হল আমাদের উপমহাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী মুসলিম ও হিন্দু ধর্মে নারী সম্পর্কে বিধি বিধান। এ সকল ধর্মীয় বিশ্বাস এর পেছনে কী যুক্তি আছে কিংবা কোন আধুনিক যুক্তিবাদী মানুষ কী নারী সর্ম্পকে এ জাতীয় বিধি-বিধান মেনে নিতে পারেন? রাষ্ট্র ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করবে আবার নারী মুক্তির কথা বলবে একি প্রতারণা নয়?
কিন্তু দেশের লোকজ সংস্কৃতিতে ধর্মীয় এসব মূল্যবোধের শিকড় এত গভীরে যে, সাধারণ মানুষÑশিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে প্রশ্নাতীত ভাবে এ সকল বিধিবিধানকে বিশ্বাস করে। তাদের এ বিশ্বাস ভাঙ্গতে হলে তাদের মধ্যে এসব অন্ধ বিশ্বাসের বিপরীতে যুক্তিবোধের উম্মেষ ঘটাতে হবে, যা করতে পারে একটি শিকড়-নাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লব।

কাক্ষিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের রূপরেখা: রণনীতি রণকৌশল

আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, নারী নির্যাতন আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং আমাদের আর্থ-সামাজিক পশ্চাৎপদতার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও মূল্যবোধ এক্ষেত্রে সর্বাপেক্ষা প্রণিধানযোগ্য ভূমিকা রাখছে। আমাদের এ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মধ্যযুগীয়ও পশ্চাৎপদ হলেও মানুষের আজন্ম-লালিত এসব চেতনা ও মূল্যবোধ এর শিকড় এত গভীরে যে, অনেক শিক্ষিত মানুষও তাকে পরিত্যাগ করতে পারে না। আমরা পূর্বেও আলোচনা করেছে যে, বিজ্ঞানের এ চরম উৎকর্ষতার যুগেও পৃথিবীর সর্বাংশে আর্থ-সামাজিক বিকাশ সমভাবে ঘটেনি। একইভাবে বিজ্ঞান ও জ্ঞানের বিকাশেও আছে মাত্রাগত তারতম্য। আমাদের সমাজে বিদ্যমান চেতনা ও মূল্যবোধকেÑতা যত পশ্বাৎপদ হউক না কেনÑএক ধাক্কায় গুড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আজন্ম লালিত বিশ্বাস থেকে বের হয়ে আসা মানুষের জন্য সাধারণত: দু:সাধ্য ব্যাপার। বরং তাতে হিতে বিপরীত হবে। প্রতিক্রিয়ায় নতুন করে চাঙ্গা হবে ধর্মীয় বিশ্বাস। আবার সমাজের প্রতিটি মানুষকে বৈজ্ঞানিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ বা সচেতন করে আমরা উন্নয়ন অগ্রগতির পথে এগুবো সে ধারণাও অবাস্তব। তাহলে কী ভাবে এগুনো যাবে?

এটাই হল মূল প্রশ্ন। এখানে কৌশল হতে পারে পশ্চাৎপদ ধারণা বা মূল্যবোধের বিপরীতে আধুনিক মূল্যবোধ ও চেতনাকে ‘সহনীয় মাত্রায়’ উপস্থাপন করে পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণার য়ুক্তিহীনতা তুলে ধরা। বিজ্ঞানে এমন কিছু সত্য আছে, যার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের সংঘাত প্রত্যক্ষ নহে। যুক্তি-তর্ক ও কাযর্-কারণ বাখ্যা করে আমাদের সে সকল সত্য তুলে ধরতে হবে । এ ভাবে আমজনগণকে প্রস্তুত করে ধীরে ধীরে বৈজ্ঞানিক চেতনার প্রতি আসক্ত বা বিশ্বাসী করে তুললে অবচেতন মনেই সে গ্রহণ করতে থাকবে যুক্তিপূর্ণ সত্যকে। তখন আজন্ম লালিত বিশ্বাস ভেঙ্গে গেল বলে তার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়বে না। এ পদ্ধতিটাকে আমি বলছি, “সত্য ও যুক্তি প্রকাশের সহনীয় মাত্রা”। আধুনিক ধর্মবেত্তারা ধর্মীয় বিশ্বাসকে টিকিয়ে রাখার শেষ চেষ্টা হিসাবে যতই বিজ্ঞানের আলোকে ধর্মকে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস পাক না কেন, আমাদের কেবল বৈজ্ঞানিক সত্যটাকে আমজনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে যুক্তি-তর্ক ও কার্য-কারণ ব্যাখার মাধ্যমে। ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি কোন মন্তব্য করার প্রয়োজন নেই। অন্তঃস্থ অসারতার কারণে তা আপনি-আচরি মরে যাবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের অবিচল থাকতে হবে আমাদের।

রণনীতিতে অর্থাৎ আমজনগণকে সচেতন করার মাধ্যমে তাকে যু্ক্তিবাদী করা। এভাবে আমজনগণকে বিজ্ঞানমনস্ক করার একটি সচেতন প্রয়াস চালাতে হবে বিরামহীন ভাবে। তখন এমন একদিন আসবে, যখন বিজ্ঞানের সাথে ধর্ম, যুক্তির সাথে বিশ্বাসের এবং কার্যকারণের সাথে অলৌকিকত্ব নিয়ে বিতর্ক অসার হয়ে পড়বে। প্রশ্ন হল কে বা কারা এ প্রয়াস চালাবে? সচেতন নাগরিক সমাজ, যারা নারী মুক্তির আন্দোলন করছে সে সকল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে এ দায়িত্ব নিতে হবে। একাত্তুরের মুক্তিযোদ্ধাদের মত এখন আমাদের বড় প্রযোজন একদল সাংস্কৃতিক যোদ্ধার।