কাউখালিতে কাউ আছে। আর আছে রহিম।
–কাউ কেডা? গরু?
–উহু, গরু হৈব ক্যান। কাউফল। হলদে সিন্দুর। ভিতরডা লোদ লোদ। খাইলে টক—না খাইলে মিঠা। পুরা গেদেকম্বল।
–আর রহিম? রহিম বাদশা?
–রূপভান আইলে কুনহানে? উনি আব্দুর রহিম। আলেম। মোডা মোডা মেলা কিতাব লেখসেন । দ্যাখলে পিয়াস লাগে।
–আর কি?
–উনি জালেম। জামাতি। উনি কইছিলেন, সগোল সুমায় মানুষ মারণ গুণাহ না। ভূত ফরোস্তি দ্যাখলে ঠুস। সোজা বেহেস্ত। ৭০টা হুরী। মুখে হাসি। ঠোঁটে সাচি পান। ঠুস ঠুস ঠুস। কীসের বাইদ্য বাজে গো দাইমা—দাইমা গো। ওনার ওস্তাদে বড় জাগ্রত পীর। ইন্দুরহাটের পূব পাড়ে বাড়ি।

নদীর মাঝখানে চর। কাকপায়া ঘাস আর চড়াৎ চড়াৎ ফলগাছ। জোয়ারে ডুবে যায়। কয়েকটি বক পাখি উড়ে যায়। উড়ে আবার ফিরে আসে। দূরে কে একজন নাদান পোলা তারস্বরে চেঁচিয়ে বলছে—

অ বক তোর নাম কি?
নাম দিয়া তর কাম কি?
পুঁটি মাছের দাম কি ?
ঝৈরা পড়ছে ঘাম কি ?
ঘামে বড় গন্দ কি?
কাউখালি বন্ধ কি?

দক্ষিণ দিক থেকে কচা নদী কাউখালির ঠোঁটায় এসে সন্ধ্যা নদী। আর পশ্চিমে তিনি কালিগঙ্গা। বড় বড় ফোঁস। ওপারে হুলারহাট। এপারে গন্ধর্ব। বড় গ্রাম। দত্তবাবুদের এক আনি হিস্যা। ঘাটকুলে একটি মেয়ে হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বড়শি। নাকে নথ। হালকা করে সুর ধরেছে–

আমার সোনার ময়না পাখি
কোনবা দ্যাশে উইড়া গেলারে
দিয়া মোরে ফাঁকি।।

দুটো নাও ধীরে ধীরে ঢুকছে নদী থেকে সোতা খাল দিয়ে। একটার খোল জুড়ে আমড়া। আরেকটার বুকজুড়ে নারিকেল। ঘাটকুলের কাছ দিয়ে যেতে যেতে জলে ঢেউ ওঠে না। মেয়েটি হাঁটু জলে দাঁড়িয়ে ভাটা মাছ তোলে। কাকিলা মাছ ঘোরে ফেরে। বড়শি ফেলে মেয়েটি গাইতে থাকে—দিয়া মোরে ফাঁকি রে আমার সোনার ময়না পাখি। বাতাস প্রবল হলে সুরটা বহুদূরে উড়ে যায়। সেঙ্গলের ঠোঁটায় এসে সুড় সুড় করে। কড়াইগাছে একটি তক্ষক অবাক হয়ে চেয়ে থাকে। আর বাতাস মন্দ স্পষ্ট শোনা যায়—সোনার ময়না পাখিটি উড়ে যায়। ডানার শব্দ। আর কান্নার পুরণো কম্পন। বুঝতে হলে কান থাকা দরকার।
–শুনতে পারতেআছেন?
–সোনার ময়না পাখি?
–না, জোয়ার আইতেআছে। পানিতে কুল কুল আওয়াজ।

বৈঠার ছপাৎ ছপাৎ ধ্বনি আর আলম বিড়ির নাকজলা গন্ধ। চরে কাকপায়া ঘাস ডুবে গেছে। চড়াৎ চড়াৎ ফলের পাশে বকগুলো একপায়ে খাড়া। তার পায়ে জলের কুল কুল আওয়াজ। কোনবা দ্যাশে উইড়া গ্যালা রে…।

–বোঝছেন? এই চর আছেলে না। কুম্ভির ওয়াস্ত পানি। সোজা পাতাল।
–পাতালপুরীর রাজকন্যা?
–রাজকৈন্যা অইবে ক্যান। মাইয়া গান গাইতেআছে আর মাছ ধরতেআছে–হ্যার নাম আন্ধা কুসুম।
–চোখ নাই?
–চউক্ষু থাকলে আন্ধা নাম হয় ক্যামনে। আন্ধা কুসুম মাছ ধরে। গান হায়। সোনার ময়না পাখির পায়ে কুল কুল শব্দে জোয়ার আছড়ে পড়ে।

গেল রাতে একজন এটিইও মারা গেছেন। বয়স্ক লোক। বালিপাড়ায় গিয়েছিলেন স্কুল ভিজিটে। দুটো ভালমন্দ খেয়েছেন। বউ পোলাপান গ্রামের বাড়ি জুজখোলায়। একা ঘরে– দেখার কেউ নাই। পাড়াপ্রতিবেশী হাসপাতালে নেওয়ার কালে চোখের পাতা আর নড়ে না।

ইমাম সাহেব জানাজা পড়ার আগে একটি টিনটিনে লোক সামনে এগিয়ে আসে।শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় তার আব্বাকে মাফ করে দেওয়ার কথা বলে। আব্বার শরীর কাফনে মোড়ানো। শেষ দিকে গলাটা খুব পড়ে গিয়েছে। টিএনও সাহেবের ইঙ্গিতে ইমাম সাহেব মোনাজাত ধরেছেন। মেলা কাজ পড়ে আছে। সময় বড় দামী। চারিদিকে ধ্বনি উঠেছে—আমেন আমেন।

তিনি কবি ছিলেন। স্থানীয় সাহিত্য মজলিসের সহসভাপতি। তার একটি কাব্যগ্রন্থ নূর প্রেসে যন্ত্রস্থ আছে। সৎ মানুষের পয়গাম। আরও দুটো পাণ্ডুলিপি তৈরি আছে। প্রকাশক নেই। লোকজন বলছেন, দেখি কী করা যায়। এর মধ্যে ছৈলানামা গ্রন্থটির মধ্যে বাংলার আকাশ বাতাস আর সবুজ প্রকৃতির কথা বিধৃত হয়েছে। মজলিসে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নামটা একটু পাল্টে দিতে হবে—ছৈলবৃক্ষনামা। ছেলা দক্ষিণাঞ্চলের গাছপ্রতিনিধি। লবণাম্বুজ বৃক্ষ। ইহার নানাবিধ কার্যকারিতা আছে। ছৈলার আরেক নাম—ওড়া। শ্বাসমুলীয়। ভাঙ্গন ঠেকাতে ইহার তুল্য আর কিছু নাই। ফুলে মধু। ফল পাঙ্গাস মাছের খাদ্য। মুশকিল হল, উপজেলা পরিষদে সাহিত্য করার জন্য কোন বরাদ্দ নাই। টিএনও কপাল কুচছে আছেন। আউয়াল চেয়ারম্যান গলা তুলে বলছেন, বরাদ্দ নাই তো কি হইছে। বরাদ্দ কৈরা নিমুআনে। কথা ফাইনাল। ঘরে ঘরে পঠিত হৈবে ছৈলাবৃক্ষনামা।

–আব্বার ইচ্ছে আছিল হজ্ব করার।বুলবুলের শ্লেষ্মা তখনো কমে নি। টিনের ঘরের সামনে এক চিলতে উঠোন। একটি কাঠালগাছ ডগডগিয়ে উঠেছে। আর দুটো ঘোড়া লেবুগাছে ফুল ফুটতে শুরু করেছে। একটি পূর্ণমণ্ডলী পেয়ারার চারার জন্য মাটি খোড়া হয়েছে। চারাটি স্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে। বুলবুলের মাথায় টুপি। হাতে তসবী। বলছে, আসল কথা হল সঙ্গতি নাই।এদেশে অনেস্ট অফিসারদের কে কবে হজ্ব করতে পারছে? ঘরের ভিতরে বুলবুলের আম্মা কেঁদে উঠেছে তারস্বরে। আর সঙ্গে চারটি বোন। উত্তরপাশে হাসনুহেনার ঝাড় বেড়ে উঠছে। রাতে ফুল ফুটবে। তিনি উঠোনে বসে কবিতা লিখবেন। এজন্য সংগ্রহ করে রেখেছেন নজরুলের আমপরা। ঘরের কান্নাটা একটু ঘন হয়ে আসে। বুলবুল চক্ষু বুঝে বলে উঠেছে, আল্লাহু। আল্লাহু। তিনি অতিশয় দয়ালু। এবং ক্ষমাশীল।একটি মেয়ে এক গ্লাস সরবত নিয়ে আসে। রুহ আফজা। কড়া লাল টকটকে। মেয়েটির মাথায় লাল ওড়না। পায়ে মল রুমঝুম। হাতে সোনার বালা।
–খোদেজা। আমার মামাতো বোন। নাইনে পড়ে।


ছৈলাগাছ দেখা গেছে শারিকতলার যুগীপাড়ায়। খালের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। গোল গোল পাতা। ঘন সবুজ। খাড়া হয়ে উঠে গেছে গাছটি। হাওয়ায় পাতা ঝিকিমিকি করে। আর শ্বাসমূল গোড়া থেকে খালের মধ্যে চলে গেছে। লাঠির মত গলা তুলে চাগিয়ে আছে। এখানে পাড়ে ভাঙন নেই। চর পড়তে শুরু করেছে। ছৈলাগাছে সাপ থাকে। দেখা কঠিন। রাতে জোনাকির ভিড় করে ঝিলমিল।

কঠিন মুখ করে বুলবুল বেহেশতী কুঞ্জী উল্টে পাল্টে দেখছে। কপালে ভাজ। মুখে হালকা দাড়ি। মানিকগঞ্জের ব্রাকের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। ভাইবোন ছোট ছোট। বাড়িটা পুরনো। এক বুড়ি বসার ঘরে এসে বলছেন, অ বুলবুল, খোদেজার শ্যাম্ফু লাগব। বাজারে যা।
–আমার নানী লাগে।

বুড়ির ফোকলা দাঁত। হাসলে গাল বসে যায়। চোখে সুরমা টানা। ফরফর করে বলছেন, বুলবুল আমার নাতি। এখন আবার নাত-জামাই। ওরে এই বাড়ি আনছি। কোন চিন্তা নাই। আহুক তো দেহি কোন ব্যাডা বেড়া ঠেলে?এই পুরনো বাড়িটার ঘরটি দোচালা। উপরে নকশী কাটা। বসার ঘরের দেয়ালে একজন গোলগাল লোকের ছবি। সাদা কালো। নিচে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা—মরণ সাগর পারে তোমরা অমর—তোমাদেরি স্মরি। ছবিটির কাঁচ আঁচল দিয়ে বুড়ি মোছে। আর কাঁদতে কাঁদতে বলে, মোর পোলা। মোর নাড়ি ছেঁচা পোলা। খোদেজার আব্বায়।
–উনি ?
–নাই। মস্ত বাড়িডায় আর কেউ নাই। নাতনী খোদেজা। আর আমি। আর মাঝে মাঝে কয়েকডা মুরগী—কুনো সুমায় শিয়ালে ধরে, মাইনসে নিয়া যায়। মুই বুইড়া অভাগা মাইয়া মানুষ—কী করি, কও?

নানীবুড়ির বাড়ির পাশে পাঁচতলা বিল্ডিং। হাজী সাহেবের। তার নামে একটি কলেজ হয়েছে। আলহাজ্ব আব্দুস সোভাহান কলেজ, টোনা। প্রিন্সিপাল লোকটি অল্প বয়স্ক। হাজী সাহেবের বোন পো। বরিশাল বিএম কলেজের বাংলায় এমএ। থার্ড ক্লাস। খুবই করিৎকর্মা। গ্রামের কলেজের জন্য বৃদ্ধ প্রিন্সিপাল কোনো কাজে লাগে না। কলেজের একজন ইংরেজি শিক্ষক দরকার।
–এখন কে পড়ান?
–বুলবুল সাব। কৃষি,অংক আর ইংরেজি। ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। এগ্রি ইনভার্সিটির।

বুলবুল হাসে না। গম্ভীর। বলে, সমস্যা অনেক। খোদেজার মুখ কালো। কি করা যায়?
–ঘটনা কি?
–ঘটনা কিছুই না। সারাক্ষণ ঘরে থাকতে থাকতে বেদ্দিক।
–স্কুল?
–স্কুলে যাওয়া লাভ কি? রাতে গোজ হৈয়া থাকে—নড়ন চড়ন নট। পোলাপাইন মাইয়া। এখনো ঢক ওঠে নাই। মুসিবৎ।

খোদেজা গান গায়। নাচে। মোমেরও পুতুল। মমীর দেশের মেয়ে। নেচে যায়—চঞ্চল বিহ্বল পায়ে। নাচতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়েছে। ঘোর আজাব।

এর মধ্যে বুলবুল ব্যস্ত। কলেজে ছেলেমেয়েরা আসতে লেগেছে। তিনটি সাবজেক্ট আর প্রাইভেট। মাঝে মাঝে ফরিদ মাওলানার সঙ্গে গুজগুজ ফুস ফুস। শহরে আলী আহমেদ খানের বাড়িতে অফিস হবে। উদ্বোধন করার আগে রুকনদের দাওয়াত বাড়ানো দরকার।সৎ লোকের শাসন দরকার।

নানী বুড়ি কাঁদে। আর চুপচাপ শুয়ে থাকে খোদেজা বেগম। অকাল গর্ভপাতের ধকল কম নয়। চোখে কালি। টেবিলে বেহিশতী কুঞ্জীর পাতা ফড় ফড় করে ওড়ে। খোদেজা চেঁচিয়ে ওঠে—ও নানী। ও নানী। মোমবাতি দপ দপ করে জ্বলে। মাঝে মাঝে নেভে। এ বাড়ির হাওয়া প্রবল। মাঝে মাঝে লক্ষ্মী পেঁচা ডেকে ওঠে। উড়ে উড়ে মাঠের ইঁদুর খুঁজতে যায় পেঁচা।নানী বুড়ি আঁচল দিয়ে ছবির কাঁচ মোছে। গোলগাল মুখটি। কপালে ডান পাশে কাটা দাগ। গৈয়া গাছ থেকে পড়ে গিয়েছিল। তবু মুখে হাসি। হাতে ডাশা পেয়ারা। শহীদ নেছারউদ্দিন। মরণ সাগর পারে, তোমরা অমর। তোমাদেরি স্মরি।

সন্ধ্যা নদীর ঘাটে ফেরী বসেছে। কাউখালি টু গন্ধর্ব। ফ্রি পারাপার। যোগাযোগ মন্ত্রী সাহেবের অবদান। ফেরীতে ওঠার গাড়ি নাই। লোক কম। ফেরীর মাথায় কাপাড় দোলে—যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবের সালাম নিন। লাঙ্গল মার্কায় ভোট দিন। এরশাদের হাসি হাসি মুখ।
–হাসি হাসি মুখ দেইখা ফাঁসি ফাঁসি মনে আসে।
-কার ফাঁসি। পল্লী বন্ধু এরশাদের?
–বালের বন্ধু। হালারে কুত্তায়ও চাডে না। ব্যাডায় রাজাকাররে মেডেল দিছে!
–তাইলে?

তাইলে অন্ধকার। ঝিঁ ঝিঁ ডাকছে। ভরা নদী। ছলাৎ ছলাৎ শব্দ। গন্ধর্ব ঘাটকুলে ছৈলাগাছটিতে হাওয়ায় পাতা নড়ে। গোল গোল পাতা। শির শির করে কয়েকটি লাউডগা সাপ এ ডাল থেকে ও ডালে সরে যায়। নড়ে না। চড়ে না। শরীর তো নয়। গাছের অংশমাত্র। ছপছপ শব্দ হতেই চাপা গলায় কে বলে ওঠে—সোবান আইলি?
–হ, আইসা পড়েন।

পায়ের নিচে তীক্ষ্ণ শ্বাসমূল। সাবধানে পা ফেলে ফেলে নৌকার কাছে আসতে হচ্ছে। সোভহান ফস করে চেরাগ জ্বালিয়ে দিয়েছে। জলের মধ্যে আলো চেরাগের দাঁত বের করে হাসে। আবার নিভে যায়। গভীর অন্ধকার চেপে আসে।
–কী করিস। কী করিস সোবান?
–কিছু না। মেলা কৈরা বসেন।

ওরা পাঁচজন গয়না নৌকার খোলে বসেছে। উপরে আকাশ। নীরব বাতাস। দূরে কয়েকটা শিশু তারস্বরে কঁকিয়ে কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে। ভয় নাই। ওরা শকুন। খিদে পেলে শিশুর মত কাঁদে। কাঁদুক। মাঝে মাঝে কোনো কোনো কান্না ভাল লাগে। সার্চ লাইট জ্বলে ওঠে একটি গান বোট থেকে।
–তারপর?
–তারপর আবার কি? অই যে কাউখালির লঞ্চঘাট দ্যাখছেন—ওর পাশ দিয়া পাঁচডা মানুষ ভাইসা যায়। একজনের কপালের পাশে কাটা দাগ। গৈয়া গাছ থেকে পইড়া কপাল কাডছে ছেলেবেলা। পাঁচজন মানুষ ভাইসা যায় সন্ধ্যা নদী দিয়া দক্ষিণে কচা নদীর দিকে। আরও দক্ষিণে সাগর। প্রবল স্রোতধারায়। নতুন ঢেউয়ের দোলায়। দুলতে দুলতে জলে জুনি জ্বলে। লবণ জল।

ততক্ষণে ফরিদ একটি ছাপা করা শার্ট নিয়ে এসেছে রাজারহাটে। মস্ত বড় বাড়ি।সবচেয়ে উঁচু দোচালা টিনের ঘর।কোনো বিল্ডিং নাই আশে পাশে। বসার ঘরে নকশী কাপড়। সুতা দিয়ে লেখা—মনে রেখ—ভুল না আমায়। বউটি কোলের মেয়েটিকে দুধ দিতে দিতে দেখতে পেয়েছে—গোলগাল দুধের শিশুটি খেতে খেতে হাসে। হাসতে হাসতে ঘুম যায়। সোভহান মিয়ার সঙ্গে একটি লোক দরোজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকে চানতারা ব্যাচ। সোভহান মিয়া চিন্তিত মুখে ডাকছে, ও ভাবী—ভাবী।

জামাটি হাতে নিয়ে বউটি বলে ওঠে, কার জামা?
–নেছারউদ্দিনের।
–তিনি কোথায়?
–কাউখালি।

কাউখালি খুব ভাল বন্দর। স্টিমার ভেড়ে। বড় বড় লঞ্চ থামে। আর গয়না নৌকা আমড়া নেয়। চালতা নেয়। নারিকেল নেয়। নদীতে ট্যাংকার থামে। তেল চুরি হয়। আর সারেং সাহেবরা ডাকবাংলায় এক রাত ঘুম যায়। আর স্কুল মাঠে–আর্মিরা ক্যাম্প করে। ঘুরিয়া ঘুরিয়ে তাহারা ঠুস ঠুস করে গুলি করে আর হাক দেয়–মুক্তি কাহা। নদীতে নদীতে গান বোট ঘোরে।

–কাউখালিতে কী আছে?

–দুগ্ধবতী নারী।

–তিনি কী করেন?
–কী আর করবেন দুগ্ধবতী নারী। তিনি একবার পাকদণ্ডি জলের দিকে চান। আরেকবার আকাশের দিকে চান। তারপর সোভহান আর ফরিদরে জিগান, মোগো তিনি কুনহানে?
–অইখানে।

ঠিক নদীটির গভীর জলের জায়গাটি দেখিয়ে বলা হয়—অইখানে।

আর তিনি, অই সহজ সরল অবলা বউটির মনে নাই– ঘরে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হাসে ছোট্ট মেয়েটি। নাম—খোদেজা খাতুন। বউটির বুকের কাছে আঁচল ভিজছে। প্রবল স্রোতের মত দুগ্ধ প্রপাত হচ্ছে। খোদেজা খাতুন খিদে পেলে হাসে। হাত পা ছড়িয়ে ছড়িয়ে হাসে। হাসতে হাসতে খায়। হাসতে হাসতে ঘুমায়। বউটি জলের গভীর পাকটির দিকে তাকিয়ে বলে—এইখানে?
–এইখানে।

তারপর ঝপ করে শব্দ হয়। ফরিদ তখনো মাওলানা হয় নাই। সোভহান তখনো হাজী গিরি পায় নাই। মাওলানা রহিম পাক পাকিস্তানের জন্য দুই হাত তুলে দোআ করে আর। শুধু ফরিদ আর সোভহান অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে—দুগ্ধবতী নারী কি করে?
–জলে ভাসে।

শুনে রহিম মাওলানা হাসে। ঠোঁট টিপে। দাঁত বের করা বেদাতী বটে। তার ওস্তাদ জাগ্রত পীর। আস্তানা ইন্দুরকাঠির ওপাড়ে। গম্বুজে চানতারা পতাকা ওড়ে। আর টিক্কা খানের লোকজেনর সঙ্গে সলা পরামর্শ করে। মুরিদের এলেম বেশ বড়। বলে, কে বলে দুগ্ধবতী নারী ভাসে। অই দ্যাখ—

নদীর বুকে আচানক ভাটা লেগে যায়। জেগে ওঠে চর। চরের উপরে হাওয়ায় চাগিয়ে আছে শ্বাসমুল। ছৈলাগাছের পারা। হাওয়ায় পাতা নড়ে। গোল গোল পাতা। টঙ্কাবৎ। আর গোড়ায় পড়ে আছে—দুগ্ধবতী নারী। কাপড় ভিজে গেছে তপ্ত দুধে। শিয়রে জোড়া সাপ।
–ওহে সর্প?
–এরশাদ করেন হুজুর।
–তোমরা যাও। দুগ্ধবতী নারীটি পরস্ত্রী। এখন বেওয়া। বেগানা জেনানার মুখ দেখা নাজায়েজ।
–উনি আপনের কী লাগে হযরত?

–ছোটি বিবি। পূনরায় তার গর্ভ হৈলে যিনি আসিবেন, তাহার নাম হৈবে মোছাম্মাৎ কুসুম বিবি। এর মাজেজা বোঝা ভার। জলে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ। নৌকার গুরায় পাল নড়ে চড়ে ওঠে। বুড়ো মাঝি শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় গান গায়–

ছয় মাসের এক কন্যা ছিল
নয় মাসে তার গর্ভ হল
এগারো মাসে তিনটি সন্তান
তোমরা এরে বলবে কী।
চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে …

সাগর থেকে ইলিশ ছুটে আসে। ঝাঁকে ঝাঁকে কচা নদীর দিকে। তারপর সন্ধ্যা নদী। জোয়ারে জলে ভেসে যেতে যেতে শোনা যায় চরের কাছে কুলু কুলু শব্দ। দুটো নৌকা খুব ধীরে ধীরে পার হয় ঘাটকুল। হাঁটুজলে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। হাতে বড়শী। মাছ ধরে। ভাটা মাছ। অথবা পুঁটি। খুব নীচু স্বরে হাওয়া কেঁপে ওঠে—

সোনার ময়না পাখি
কোনবা দ্যাশে উইড়া গেলা রে
দিয়া মোরে ফাঁকি

হাওয়া প্রবল হলে সুরটি সেহাঙ্গলের ঠোঁটায় গিয়ে বাড়ি খায়। ছড়িয়ে যায় সমদে কাঠি। জলাবাড়ি। ওপারে রাজবাড়ি। অথবা সারেংকাঠির জল। তারপর ইন্দুরহাট। পূবপারে রহিম মাওলানার হুজুরের বাড়ি। গম্বুজে চাঁনচারা পতাকা ওড়ে। তার গলায় ঝোলে এরশাদের পদক। আর হাওয়া মন্দগতি হলে স্পষ্ট শোনা যায়—দীর্ঘ মর্মরিত সুর।

–নাম কি মেয়েটির?
–আন্ধা কুসুম।