[সতর্কীকরণঃ ব্লগটির নাম বিভ্রান্তিকর। এর মধ্যে বিবর্তনের কিছু নেই। শুধু আছে বিবর্তনের উপর একটি প্রশ্ন। প্রশ্নটা পরিষ্কার করে উপস্থাপনের জন্যই এই অবতারণা]

এই যে আমাদের বুকভরা এত আবেগ এর সাথে ডারউনের Survival of the Fittest এর যোগসুত্রটা কী? আমাদের হাসি-কান্না-মাথাগরমের সাথে বিবর্তনের সম্পর্কটা কিভাবে? বিপরীত লিঙ্গের মানুষ দর্শনে যৌনাভূতির উদ্রেক হয় জিনের বংশগতি রক্ষার জন্য। বোধগম্য। কোন প্রশ্ন নাই। কিন্তু গান শুনলে হৃদয় জুড়িয়ে যায়, নিকট জনের বিয়োগ ব্যথায় বুকে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়, চোখের জলে আচল ভিজে যায়, কারও কথায় পিত্ত জ্বলে যায়। আবার মুক্তমনায় কারও মন্তব্য পড়েই তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি। আমাদের এরকম অদ্ভূত আচরণের ব্যাখ্যা বিবর্তন কী ভাবে দিয়ে থাকে!

ধর্ম ও সংস্কৃতি ভেদে আবেগের প্রকৃতি এবং বিস্ফোরণের মাত্রায় পার্থক্য লক্ষনীয়। নিকট জনের মৃত্যুবেদনা কোন সংস্কৃতির মানুষেরা দিনের পর দিন কেঁদেও শেষ করতে পারে না। আবার কোথাও দেখা যায় তারা এক ফোটা চোখের জলও ফেলে না। বাস্তবিকতাকে সহজেই মেনে নেয়। জীবন চলতে থাকে জীবনের মত।

হরমোন, বাইল, খাদ্য পরিপাক সহায়ক লালা সব কিছুই প্রয়োজনের সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিক্রেসন হয়ে থাকে আমাদের শশীরে। এসব কোন সুক্ষ্ম রাসায়নিক প্রক্রিয়ার ফসল হবে হয়ত। বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন। কান্নার জলও সেরকম রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি হতে পারে। যদি তাই হয়, তবে মানুষের ধর্মবোধ বা বিশ্বাস রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রনে প্রভাব রাখছে। আমার এই ভাবনা গুলো দু-একটা অপ্রয়োজনীয় উদাহরণ দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করব। পাঠক ইচ্ছে করলে উদাহরণগুলো ডিংগিয়ে যেতে পারেন।

প্রিয়জনের মৃত্যুতে কান্নাকাটিতে হিন্দুদের জুড়ি নেই। কান্না চলবে দিনের পর দিন। কোন কোন হিন্দু সমাজে এই কান্না এক মাস পর্য্যন্ত দীর্ঘায়িত করা হয়। মাস শেষে শ্রাদ্ধ করে অফিসিয়ালী কান্নার ইতি দেওয়া হয়। মানুষ তারপরও কাঁদে। পিতার মৃত্যু সংবাদ শুনে আমার স্ত্রী কয়েক বার ফিট হয়। আঠার ঘন্টা পরে জ্ঞান ফিরে আবুল তাবুল বলতে শুরু করে। ভাইয়ের মৃত্যু হয়। ধীরে ধীরে অত্যন্ত সাবধানে সংবাদটি দেওয়া হল। কান্না সাংগ হয়েও শেষ হল না। একবছর পরে দেশে গিয়ে নতুন করে পারিবারিক কান্না শুরু। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে অজ্ঞান। মৃতের স্ত্রীও অজ্ঞান। আশে পাশের লোকজনে বাড়ী ভরতি। মৃতের স্ত্রী ঠিক হলেন। কিন্তু আমার স্ত্রী ঠিক হচ্ছেন না। সমস্ত গা শক্ত। শশীরের জট সারতে না সারতেই কাঁপুনি শুরু। গ্রামে ডাক্তার নেই। সাঙ্ঘাতিক বিপদ।

হিন্দু কান্না এখানেও শেষ হয় না। গয়াতে পিন্ড দেওয়ার সময় একবার। কাশীতেও একবার। সেই পিন্ডদান একবছর পরেই হোক আর বার বছর পরেই হোক। বুক ভাংবে, চোখে বৃষ্টির ধারা বইবে। মুসলমানের বেলায় কান্নার ব্যাপারটি অন্য রকম। আল্লাহর নির্দেশে আজরাইল আসে। জান কবজ হয়। হাশরের মাঠে বাহাত্তুর কাঁতারের কোন একটি কাঁতারে দাঁড়াবে। বিচার হবে। কান্নাকাটি আল্লাহ বিরুদ্ধ কাজ। হিন্দুরা তা বুঝে না। তাই মুসলমানদের আত্মীয় বিয়োগ দেখে হতাশ হয়। ওদের কোন আত্মা নেই। কোন মায়ামমতা নেই। এ্কদিন কি দুই দিন। তারপর সব শেষ।

তবু তো মুসলমানরাও কাঁদে। অনেক জনগোষ্টি আছে যাদের চোখ একেবারে শুষ্ক – মরুভূমি।

১৯৯৯ সালে এরিক ভ্যালি একটি ফিল্ম ক্রু নিয়ে তিব্বত যান। তিব্বতিদের জীবন-যাপন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারী বানাবেন। কমুনিটির বৃদ্ধ নেতা টিনলের সহায়তায় একটি স্ক্রিপ্ট তৈরী করলেন। পাহাড়ি চড়াই-উতরাই পাড়ি দিয়ে তিন-চার মাসের বিপদ-সংকুল অভিযান। একপাল ক্ষুদ্রকায় মহিশ নিয়ে ভাটির পথে যাত্রা। লবন আনবে। দ্বিতীয় আর একটি অভিযান হবে পাহাড়-পর্বতের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দিকে। সেখানে কৃষিকাজ হয়। মহিশের পিঠে লবন যাবে। মহিশের পিঠেই ধান-গম আসবে। তাই সারা বছরের খাবার গ্রামবাসীর। টিনলে পরিবারের হাতে বংশপরম্পরায় নেতৃত্ব। টিনলে বৃদ্ধ। এবার ছেলের উপর দ্বায়িত্ব। এটাই তার প্রথম যাত্রা। ছোট ছেলেপুলেরা, মহিলা এবং বৃদ্ধজনেরা অপেক্ষায় থাকে। পাহাড়, পর্বত, শৈত্যপ্রবাহ। এদের কোন না কোন দেবতা রুষ্ট হন। পাহাড় থেকে ছিটকে প্রতিবারই অনেকেই মারা যায়।

তিন-চার মাস পরে মহিশ গুলো এল। প্রতিটির পিঠে ঝলানো লবনের বস্তা। একটির পিঠে লবনের বস্তা নেই। পরিবর্তে একটি মানুষ ঝুলে আছে। টিনলের একমাত্র ছেলেটি। একদিকে পা। আর একদিকে মাথা আর হাতদুটো। সবাই ক্ষনিক থমকে দাঁড়লো। মা ঘরের চৌকাটে দাঁড়িয়েই ছেলেকে চিনলেন। চৌকাঠে হেলান দিয়ে ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন। স্ত্রী প্রেমাও তাই করল। কারও চোখে জল নেই। দেবতা ক্রুদ্ধ হন। মানুষের বিপর্যয় আসে। জীবন চলতে থাকে।

টিনলে বেড়িয়ে এলেন। সবাইকে নির্দেশ দিলেন লবন নামাতে। পন্ডিতেরা দিনক্ষন ঠিক করবেন। এই লবন নিয়ে যেতে হবে অন্যদিকে। শৈত্যপ্রবাহ আর বরফ স্তুপের উপর দিয়ে দূর্গম অঞ্চলে যেখানে কৃষিকাজ হয়। কারও কোন বেদনা নেই। দুঃখ নেই। কষ্ট নেই। আবেগ নেই। টিনলে মৃত ছেলেকে নিয়ে কাছেই একটা পাহাড়ে গেলেন। বড় একটা ছোড়া দিয়ে মৃত ছেলেকে টুকরো টুকরো কাটলেন। তারপর এদিক ওদিক ছড়ায়ে দিলেন। শকুনের রূপ নিয়ে দেবতারা এলেন। ভূড়ি ভোজন করলেন।

স্থানীয় সাধারণ মানুষ নিয়ে ডকুমেন্টারী করতে এসেছিলেন এরিক ভ্যালি। কিন্তু তা হলনা। তৈরী তার চেয়ে বিরাট একটা কিছু। হয়ে গেল অত্যন্ত ভাল একটি ফিল্ম। অস্কারের কথা মনে এল। পাঠালেন। অস্কার পেলেন না। জুটল Oscar nod. Best Foreign Language Film ক্যাটাগরীতে।
netflix গ্রাহকরা এখানে ক্লিক করে ছবিটি দেখতে পারেন আমি একই সাথে চারবার দেখেছিলাম।

গতকাল (৮-৯-২০১০) এক মৃতের funeral service. ডালাসের কাছে একটি ছোট শহর, Burleson. ফুলেফুলে শোভিত ভাব-গাম্ভির্য পূর্ণ অনুষ্ঠান। পৌঁছেই মনটা শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে উঠল। মৃতের পরিবার-পরিজন হাস্যবদনে আমন্ত্রিতদের অভ্যর্থনা করলেন। কারও মনে কোন দুঃখবোধ নেই। সবাইকে একটা কাগজ দেওয়া হল। তাতে লেখা

God saw you getting tired
And a cure was not to be


God broke our hearts to prove us
He only takes the best

অসম্ভব যাদু এক লেখাগুলোয়। বুঝতে দেরী হল না এই লেখাগুলোতে বিশ্বাসবোধই মৃতের পরিবার-পরিজনের সমস্ত শক্তির উৎস। তাই তাদের কোন দুঃখবোধ নেই। জীবনের অন্য দিনগুলোর মতই এই দিনটিও স্বাভাবিক। জীবন চলতে থাকে Godএর নির্দেশে।
একটা ছোট কাগজে লেখা মৃতের হয়ে লেখা

brad

মৃতের কাছ থেকে শান্তি ও বিশ্বাসের বাণী – I’ll greet you with a smile and say “Welcome Home” যাদুকরী এই বাণী স্বজন-বিয়োগ জনিত কষ্ট বেদনা ধূয়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয়। সবার প্রানে তাই আনন্দের ধারা। হাসিমুখে অভ্যর্থনা। গীটার সহযোগে বিদায়ী গান।

একই বেঞ্চে মাঝখানে আমার মেয়ে ইয়েন, স্ত্রী মিনু আর আমি। আমরা ভিন্ন, আলাদা। ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠেছি। আমাদের কাজ-কারবারও ভিন্ন। মৃতের একমাত্র মেয়েটি Mercy Me এর Homesick গানটি ধরল –

homesick

গানটি এখানে শুনা যাবে

আমার স্ত্রী পার্সে টিস্যু পেপার খুজছেন। আমার চোখও ভিজে ছপছপ করছে। হাত-ইশারায় আমি একটি চাইলাম। ডানপাশের ভদ্রলোক আমাদেরকে Kleenex এগিয়ে দিলেন।

আমাদের আত্মা নেই। কিন্তু আবেগ আছে। কারও বেশী। কারও কম। আমাদের দেহের ভিতর কোথায় এরা বাস করে? কী কারণে এরা জাগ্রত হয়? ধর্ম এবং সংস্কৃতির প্রভাব ভিন্ন ভাবে কাজ করে আমাদের জৈবিক প্রক্রিয়ায়। বিবর্তন কী ব্যাখ্যা আনে এখানে?

টেক্সাস, ১০-১১-২০১০