জীবন থেকে নেয়া

আকাশ মালিক।

(গল্প লেখা আমার দ্বারা বুঝি আর হলোনা। বাস্তব আর কল্পনার সংমিশ্রন না ঘটাতে পারলে গল্প কি আর গল্প হয়? ভাবলাম, নিজের চোখের দেখা বাস্তব ঘটনা থেকে আজ একটা গল্পই শুনাই। বলে রাখা ভাল, অবিশ্বাস্য হলেও কাহিনিটি সত্য।)

আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগের কথা। গা গতর, কাপড় চোপড় থেকে তখনও বিলেতের গন্ধ শুকিয়ে যায়নি। তিন মাসের মাথায় যথারিতি ঘরে নতুন বউ আনা হলো। এমনটা অপ্রত্যাশিতও ছিলনা। বিয়ের দুই সপ্তাহ পরে এক পড়ন্ত বিকেল বেলা, দরজার পাশে ঠান্ডা বারান্দায় মাদুর পেতে বসে, উঠোনে ছোটদের জাম্বুরা ফল দিয়ে ফুটবল খেলা দেখছি। সান্ধ্যকালীন রান্না-বান্নার বিরতি পর্যায়ে বড় ভাবী মুড়ো হাতে নিয়ে স্বশরীরে আমার একেবারে মুখোমুখী হয়ে বসলেন। বুঝলাম ওয়াজ নসীহত হবে, মানি আর না মানি আমাকে ধর্য্য ধরে শুনতে হবে। ভাবী জিজ্ঞেস করলেন-
– আচ্ছা বলো তো, তুমি মানুষ না ভুত।
– হাত পায়ের গঠন আকৃতি দেখে তো মনে হয় আমি মানুষই, তবে বানর হওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না।
– তুমি আসলেই একটা বান্দর (সিলেটি ভাষায়)। বিয়ের আগে বাহিরে রাত কাটায়ে গভীর রাতে বাড়ি ফিরেছো, কেউ কিছু বলে নাই। এখন তো এ সমস্ত চলবেনা। বাংলা ঘরে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নিশিরাত পর্যন্ত কিসের এমন মিটিং মাটিং। বাড়ি আর সিলেট, সিলেট আর বাড়ি, কিসের এত দৌড়াদৌড়িটা শুনি।
– ভাবী এতদিন পরে দেশে আসলাম, বন্ধু-বান্ধবের কাছে কত কথা বলার আছে, শুনার আছে তুমি বুঝো না?
– বাসর রাতেও তুমি দেরীতে ঘরে ফিরেছিলে, একটু ডর ভয় নেই?
– আমি তো লখিন্দর নই যে, লোহার বাসর ঘরে কাল-নাগ দংশন করবে, আর করলেও বেহুলা তো ঘরেই আছেন, তাকে না হয় ভেলায় ভাসিয়ে দিবেন। ভাবী তুমি বসো, আমি তোমাকে মনসা দেবীর কাহিনি বলি- মনসার পিতার নাম ছিল শিব, আর শিবের বউয়ের নাম ছিলো—-
– আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি কি বলেছি মনসা দেবীর কেচ্ছা শুনবো? কেচ্ছা শুনার জন্যে তো মানুষ ঘরে এনে দিয়েছি, তার কাছে গিয়ে রাত-ভর কেচ্ছা বলো। তুমি নাকি দুই দিনের জন্যে আজ রাতেই আবার সিলেট যাচ্ছো?
– হুঁম, রাহেলা নালিশ করেছেন বুঝি?
– ও বলবে কেন আমার কান নাই?
– ভাবী, আব্দুল্লাহ আল মামুন তার ‘সেনাপতি’ নিয়ে সিলেট পুলিশ ওডোটরিয়ামে আসছেন, সাথে ফেরদৌসি মজুমদার। বুঝুন এবার কেমন হবে নাটকটা। এদের মত মানুষকে কাছে থেকে দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। কপাল লাগে, ভাবী কপাল।
– আরে ভাই, বাহিরের নাটক তো অনেক হলো, এবার ঘরে থেকে নাটক হয়না? নায়িকা তো পাশেই আছেন। আচ্ছা বাহিরে গেলে তোমার মনে পড়েনা একটা মানুষ রাত জেগে তোমার অপেক্ষা করে। তুমি ঘরে না ফেরা পর্যন্ত আমরাও কেউ ঘুমাইনা, এটা তো ঠিক না। দুই সপ্তাহের মধ্যে কয় ঘন্টা সময় তুমি তাকে দিয়েছো বলো দেখি। সে যে তোমাকে মিস করে তুমি বুঝনা?
– ভাবী আমি যে কোন্ বনেলা পাখি তা তো তুমি জানোই, তারপর রাহেলা আমাকে মিস করবেন কেন? কিছুদিন পরেই তাকে নিয়ে যখন সাত সমুদ্দুর তের নদী দূরের দেশে উড়াল দেবো, তখন তোমরাই তো তাকে বেশী মিস করবে।

এবার দেখি ভাবীর চেহারাটা অন্য রকম হয়ে গেল। মায়াবী স্বকরুণ চোখে বেশ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি একটু কায়দা করে হিন্দী সিনেমার ভাষায় বললাম- ইযাজত হো তো ভাবী ময় চলু। তাতক্ষণিক অগ্নিমূর্তি চেহারা করে, গলার স্বর সপ্তম রাগে তুলে ভাবী বললেন- ‘আমার পারমিশনের দরকার নেই, যার পারমিশন নেয়া দরকার তার কাছে যাও’।

ছোট বেলা থেকে এই ভাবী মায়ের আদর দিয়ে আমাকে বড় করেছেন। ভাবী চলে যেতেই দরজার অপর পাশ থেকে নৃত্যের ছন্দে হাতের চুড়ির শব্দ শোনা গেল। পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি রাহেলা চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে। আশ্চর্য আমার দেশের নারী, এরা প্রকৃতির ভাষায় প্রকৃতির সুরে কথা বলে। আমি বললাম- এসো রাহেলা আমি তোমাকে— কথা শেষ হবার আগেই আবার চুড়ির শব্দ। কোন কথা নেই রহস্যভরা একটা হাসি ঠোঁটে তুলে অপলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। জিজ্ঞেস করলাম- কী ব্যাপার? বললেন- ‘ভিতরে আসুন, না হলে চা দেবো না’।

মনেমনে অপেক্ষা করছি বাবলু কেন এখনও আসে না। এদিকে মাগরিবের আজানের আগে বেরুতে না পারলে নামাজ ফাঁকি দেয়ার জন্যে এক্সট্রা বুদ্ধি খরচ করতে হবে। আবার ভাবীর কথাও একটু ভাবনায় ফেলে দিল। মাত্র দুই সপ্তাহ হলো, মান অভিমান করার বয়স এখনও রাহেলার হয় নি, এই ভরসা মনে রেখে স্ত্রীকে বললাম- ‘বসো আজ তোমাকে সেই গানের মর্ম বুঝাবো, দু দিন আগে আমাদের উঠোনে সাপের নাচ দেখাতে এসে বাইদানী যে গানটি গেয়েছিল। আচ্ছা বলো তো লখাই কে ছিল? গানটি কি তোমার মনে আছে? রাহেলার কোন উত্তর নেই। আমি বললাম, বাইদানী গাইছিল-
সোনার বরণ লখাই রে আমার বর্ণ হইলো কালো / কি সাপে দংশিল তারে তাই আমারে বলোরে—
বিধির কী—-হ—ইলো—-রে।
কাইল হইয়াছে লখাইর বিয়া, মাইল্যার মুকুট দিয়া / কেমন কইরা যাইমু আমি মাইল্যার পাড়া দিয়ারে —বিধির কী—-হ—-ইলো—-রে’।

আমি একাই বলে যাচ্ছি রাহেলা আমার দিকে তাকিয়েই আছেন। সেই বিষ্ময়ভরা দৃষ্টি, ঠোঁটে রহস্যভরা হাসি, যেন আমি তার কত জনমের পরিচিত, আর না হয় আমি এলিইয়্যেন জাতীয় কিছু, তার কাছে অচেনা অজানা, আমাকে এর আগে কোনদিন দেখেন নি। মাঝে মাঝে মনে হয়, রাহেলা আমার মাঝে তার অনেক দিন আগের ‘মাষ্টরসাব’কে খুঁজেন। আমি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র, কামালের বোন এই রাহেলা তখন একই স্কুলের সপ্তম শ্রেণীর ছাত্রী। বললাম, শুনো রাহেলা সংক্ষেপে কাহিনিটি এ রকম- মনসা দেবীর পিতার নাম ছিল শিব, আর শিবের বউয়ের নাম ছিলো চন্ডি। চন্ডি কিছুতেই মনসাকে শিবের কন্যা মানতে রাজী নয়। আচ্ছা এটা একটা কথা হলো? শিবের বউ শিবের মেয়েকে গ্রহন করেন না, এ কেমন কথা? চন্ডি মনসাকে দু চোখে দেখতে পারেন না। তিনি মনসার ওপর অত্যাচার শুরু করে দেন। শিব যে একজন অসৎ কামুক স্বভাবের মানুষ, চন্ডি তা জানতেন। একদিন শিব, চন্ডির হাতে গড়া একটি বাগান দেখতে গিয়ে তার শরীরে শিহরণ অনুভব করেন। কামোত্তেজনা কন্ট্রোল করতে না পেরে শিব কোন একটি গাছের গোড়াতেই বির্যস্খলন ঘটান। সেই বির্য থেকেই জন্ম নেন মনসা দেবী। মনসার কোন গর্ভ নেই তাই তিনি অযোনিসম্ভাবা। শিব যখন মনসাকে তার ঘরে নিয়ে আসলেন, চন্ডির মাথায় তখন আগুন চড়ে যায়। চন্ডি, শিবের ওপর মানসিক এবং মনসার ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে দেন।। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে মনসা একদিন চন্ডিকে দংশন করেন। চন্ডি মারা যান। শিব মনসাকে অনুরোধ করেন চন্ডির জীবন ফিরিয়ে দেয়ার জন্য। মনসা চন্ডির জীবন ফিরিয়ে দেন। চাঁদ সওদাগরের ছেলে লখিন্দর যখন—

এখানে আসতেই বাবলুর হোন্ডার হর্ণ শুনা গেলো। কাহিনি শুনায় রাহেলার কোন ইন্টারেষ্ট ছিল বলে মনে হলো না। নারীরা নিজেকে রহস্যাবৃত করে রাখতে ভালবাসে কেন আল্লাহই জানে। চুপি চুপি মৃদুস্বরে বললেন- ‘দুই দিন বলেছেন, তিন দিন যেন না হয়’। আমি বললাম, কেন? রাহেলা বললেন- ‘বেহুলার কাহিনি যে শুরুই হলো না’।

আমার স্কুল জীবনের পরিচিত কয়েকজন বন্ধু সিলেট বেতারের সাথে জড়িত ছিলেন। দেশে যাওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই বেশ কিছু সাংস্কৃতিক সংগঠন ও নাট্যদলের সাথে জড়িয়ে পড়ি। তখন নাট্য মহলে রাবেয়া খাতুন দুলু, (**), আয়েশা আখতার, আর কণ্ঠশিল্পী পাড়ায় ইয়ারুন্নেসা, আরতি ধর, শুক্লা দে, আমিরুন্নেসার নাম সুপরিচিত। পয়ত্রিশ বছর পূর্বে এই (**)র সাথে সিরাজুদ্দৌলাহ নাটকের এক দৃশ্যে অভিনয়ের একটি লজ্বাষ্কর ঘটনা আজও স্পষ্ট মনে আছে। বাবলু আমাদের গ্রামের ছেলে। সিলেটের সুবিদ বাজার তাদের বাসা। তার সাথে পরামর্শ করে আমার সকল প্লান প্রোগ্রাম হয়। রাত ঠিক সাড়ে আটটায় সিলেট রেষ্ট হাউসের সামনে এসে আমরা পৌছুলাম। এই হোটেলের একটি রুমে সিলেট বেতার কেন্দ্রের শিল্পী শফিকুন্নুর ভাড়াটে থাকেন। দু দিন পর বেতারে ‘কমলা রাণীর দিঘী’র কেচ্ছা প্রচার হবে, আজ রাতে এর মহড়া হবে তার রুমে। কাহিনিতে কিছু গান আছে, তিনি সেই গানগুলোর কণ্ঠশিল্পী। কেচ্ছার প্রারম্ভে একটি বন্দনা গাওয়া হলো, কয়েকটা লাইন আজও পুরোপুরি মনে আছে-
পুবেতে বন্দনা করি, পুবে ভানুশ্বর,
এক দিগেতে উদয় ভানু, চৌদিগে পশর।
পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা বালুস্থান,
যেই যাগায় জন্ম নিল কিতাব আর কোরান।

রাত বারোটায় বাবলু বললো,- আকাশ ভাই আমি খুব ক্লান্ত, বাসায় যেতে হবে, কাল সকালে আবার আসবো। আমি বললাম চলো তোমাকে হোটেলের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। হোটেল সংলগ্ন পানের দোকানের মালিক রশিদ, দোকান বন্ধ করে বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বললাম, রশিদ ভাই কষ্ট না হলে দুটো পান দেয়া যায়? রশিদ খুশী মনে তার পোটলা-পুটলির যত প্রকার মাল মসলা আছে, চুন, জর্দা, খয়ের, আরো সাদা কালো কি কি জিনিষ মিশায়ে পাঁচপুরণের একটা পান ককটেইল বানায়ে দিয়ে বললেন- ‘লন্ডনি সাব, দুটো রথম্যান দেই’। পকেটে বেনসন আছে তবুও রশিদের অফার রিজেক্ট করতে পারলাম না। গরিব মানুষ অতিরিক্ত দুটো পয়সা কামাতে চায়, খারাপ কী? আজ সেই পাঁচপুরণের পান ককটেইল খেলে নিশ্চিত এম্ব্যুলেন্স কল করতে হবে। আমরা হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে শহরের জোছনা রাতের তারা গুনছি। রাত তখন সাড়ে বারোটা। যানবাহন শুন্য রাস্তা। জিয়াউর রহমান সাহেবের কুকুর নিধন অভিযানে শহিদ না হয়ে, ভাগ্য গুণে বেঁচে যাওয়া গাজী, আত্মীয় শোকে মুহ্যমান দু একটা কংকালসার কুকুর রাস্তার ধারে ঘুমিয়ে আছে। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম একটি রিক্সা আমাদের সামনে দিয়ে চলে গেল, পেছনে একটি বেবিট্যাক্সি তাকে ফলো করছে। সামনে রিক্সা আর পেছনে বেবিট্যাক্সি, গার্লস স্কুলের সামনে, তিনতারা রেষ্টুরেন্টের ধারে বিরাট শিউলি গাছের অন্ধকার ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে, জিন্দাবাজার কাকলি রেষ্টুরেন্টের সামনের চৌরাস্থার মোড় পর্যন্ত গিয়ে তারা আবার শিউলি গাছের নিচে ফিরে যায়। গার্লস স্কুল থেকে কাকলি রেষ্টুরেন্টের দুরত্ব হবে অনুমানিক এক মাইলের আট ভাগের এক ভাগ। আমরা দাঁড়িয়ে আছি ঠিক মাঝখানে। এরকম তিনবার আসা যাওয়া করার পর আমার সন্দেহ হলো, ব্যাপারটা কী? বিষয়টা বাবলুও নোটিশ করেছে। তৃতীয় বারের সময় ভালভাবে তাকিয়ে দেখলাম রিক্সার ভিতরে কড়া নীল রঙের শাড়ি পরিহিতা সঙ্গীহীন এক ভদ্র মহিলা। বাবলুকে অর্ডার দিলাম তাড়াতাড়ি হোন্ডায় স্টার্ট দিতে। তাতক্ষনিকভাবে আমরা উভয়েই আমাদের এনালাইজেশন ক্ষমতা ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ভদ্র মহিলা একজন শিক্ষিত মানুষ হবেন, কোথাও টিউশনিতে গিয়েছিলেন, বাসায় ফেরার পথে বখাটেদের খপ্পড়ে পড়েছেন, তাকে উদ্ধার করতে হবে। বাবলুকে বললাম, পুলিশ ষ্টেশনে ফোন করতে। সে বললো আগে নিশ্চিত হয়ে যাই বিষয়টা কী? আমরা রিক্সাকে ফলো করলাম, কিন্তু বেবী ট্যাক্সিটা কোনদিকে কোথায় উধাও হলো খেয়ালই হলোনা। এবার রিক্সা সোনালী ব্যাংকের গেইটের সামনে এসে দাঁড়ালো, আমরা তার পেছনে। হোন্ডা থেকে নেমে রিক্সা ড্রাইভারের সামনে গিয়ে দেখি ভদ্র মহিলা রিক্সায় নেই। ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম-
– তোমার প্যাসেঞ্জার কই?
– দেখলাম, ওই ব্যাঙ্কের হেই ডান দিক্যার সিড়ি দিয়া উফরে ছইলা গেলো গা।
– তোমাকে কিছু বলেন নি?
– জ্বী না স্যার।
– ভাড়ার জন্যে অপেক্ষা করছো বুঝি?
– জ্বী স্যার।
– কোথা থেকে এসেছো?
– ঐ—শেখঘাট থাইক্যা।
– কোথায় যাবে?
– জানিনা, ম্যাডাম কিছু কইলো না তো। হুদাই আমারে বওয়াইয়া রাখছে।
– ভাড়া কত হইলো?

চোখের পলকে কে যেন ঠাস করে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল ড্রাইভারের দুই গালে। চেয়ে দেখি ব্যাংকের ইউনিফরম পরা এক ব্যক্তি, কাঁধে বন্দুক। পুলিশ না দারোয়ান বুঝলাম না। বললাম-
– আপনি বেচারাকে মারলেন কেন?
– আপনারা এত রাতে এখানে গেইটের সামনে ভিড় করবেন না। দয়া করে চলে যান তো।
– ঐ মহিলা কোথায়?
– কিসের মহিলা, কোন মহিলা? এখানে কোন মহিলা টহিলা আসে নাই, আপনারা যান।
– রিক্সাওয়ালার ভাড়া কে দিবে?

আমার কথার কোন উত্তর না দিয়ে মানুষটা রিক্সা ড্রাইভারকে ধমক দিয়ে বললেন- ‘হারামজাদা এখনও দাঁড়িয়ে আছিস, কুত্তার বাচ্ছা যাবি না বন্দুকের গোঁতা খাবি’? চোখটা দুই হাতে মুছতে মুছতে ড্রাইভার চলে যাচ্ছিল, বললাম আমি তোমাকে ভাড়া দিচ্ছি, তোমার ভাড়া নাও। ‘লাগবোনা স্যার, আল্লায় হেইর বিছার কইরবো’ এই বলে ড্রাইভার চলে গেল। ইউনিফর্ম পরা লোকটা আমাদেরকে কিছু না বলেই গেইটের লোহার গ্রিলে তালা লাগিয়ে হাওয়া হয়ে গেলেন। ঠিক তখনই বিদ্যুত বেগে একটি হোন্ডা আমাদের সামনে এসে ইমার্জেন্সি ব্রেইক কষলো। হোন্ডা থেকে নেমে এক ভদ্রলোক বললেন-
– আমার নাম রহিম। আপনারা?
– জ্বী আমরা এম সি কলেজের ছাত্র, সাগর দীঘির পার আমাদের বাসা।
– ও আচ্ছা, কোন অসুবিধে নেই, আপনারা নয়া সড়ক (**) হোটেলে আসবেন, দেখা হবে।

জানা নেই, পরিচয় নেই, মানুষটা বলে কী? হোন্ডা নিয়ে রহিম সাহেব ব্যাংকের বাম পাশের দেউড়ির ইট বিছানো সরু রাস্তা দিয়ে পেছনে চলে গেলেন। আমি একটু কাঁত হয়ে চেষ্টা করলাম দেখতে, ওদিকেও কি বাহির হওয়ার রাস্তা আছে। ছোট ছোট আম গাছের ডাল-পাতার ছায়ায় ঘেরা অন্ধকারের মাঝে রহিম সাহেব বিলীন হয়ে গেলেন। বাবলু বললো-
– হঠাৎ বুদ্ধি পেলে কোথায়?
– তুই জানোস না আমার কাছে অহী নাজিল হয়?
– তোমাকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে তুমি এম সি কলেজের ছাত্র? আর আমাদের বাসা তো সাগর দীঘির পার নয়।
– ধুর বাদ দে, রাতের অন্ধকারে কে কাকে চেনে, আর সব জায়গায় সঠিক ঠিকানা বলা উচিৎ না। এখন কী করা সেই কথা বল।
– চলো আমি তোমাকে তোমার হোটেলে নামিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যাবো।
– বলিস কি বাবলু? তুই চলে যাবি যা। এতো রাতে রিক্সা পাবো না জানি, আমি এখান থেকে হেঁটেও না হয় (**) হোটেলে যাবোই।
– শুনো, পুলিশ ডেকে আর লাভ হবে না। বিষয়টা আমরা যা ভেবেছিলাম তা না। ভয়ংকর একটা ব্যাপার স্যাপার আছে।
– আমি ঘটনার শেষ না দেখে কোথাও যাচ্ছি না, এখন তুই কী করবি বল।
– চলো, উঠো হোন্ডায়।

(**) হোটেলের সামনে এসে দেখি সাদা রঙের ময়লা এক খানা লুঙ্গি পরা লিকলিকে ধরণের একজন মানুষ, এক পা টুলের উপর তুলে আর এক পা মাটিতে রেখে মনের সুখে পাতার বিড়ি টানছেন। মুখে শব্দ তুলে সুপারী চিবুচ্ছেন, ঠোঁট দুটোতে যেন লিপ্সটিক দেয়া, ঠোঁটের কোণে চুনের আলপনা। আয়েশ করে মুখ ভরে বিড়ির ধোঁয়া নিয়ে আকাশে বৃত্তাকার ছবি আঁকছেন। দেখলেই বুঝা যায় তার মত সুখী দ্বিতীয় কোন ব্যক্তি এই দুনিয়ায় আর কেউ নেই। আমাদেরকে দেখেই বললেন- ‘যান উপরে এক নম্বর রুমে চলে যান’। হোটেলের সিড়িগুলো এতই ছোট যে একজন মোটা সোটা মানুষের পক্ষে উপরে যাওয়া মুশকিল হবে। দশ কি পনেরো ওয়াটসের একটি বাল্ব সিড়ির উপরে মিটিমিটি জ্বলছে। চতুর্দিকে যেন একটা আবছা অন্ধকারের ছায়া। আমি বললাম- ‘আমরা তো রহিম সাহেবের সাথে দেখা করতে এসেছি’। উনি বললেন- ‘জানি, রহিম সাহেব একটু বাহিরে গেছেন, বলে গেছেন আপনারা আসলে এক নম্বর রুমে পাঠিয়ে দিতাম’। বাবলু আমার হাত ধরে টান দিল। একটু দূরে নিয়ে বললো- উপরে যাবি না, আমার ভয় হচ্ছে, মারাত্বক কিছু ঘটে যাবে। বলা বাহুল্য, ততক্ষণে আমার শরীরের ব্লাডের সুগার লেভেলও কিছুটা ডাউন হয়ে গেছে। বললাম- ‘শোন বাবলু, আমাদের এই ভদ্র পোশাক, নিরপরাধ চেহারা দেখে বাঘেও আমাদের দিকে করুণার চোখে তাকাবে। তুই ভয় করিস না, আমাদের কিচ্ছুই হবে না’।

এক নম্বর রুমের দরজার সামনে একহাত ভাঙ্গা, হাতলওয়ালা একখানি পঙ্গু চেয়ার। দরজা অর্ধেক খোলা। বাবলু ভীত বিষন্ন মনে কালো মুখ করে চেয়ারে বসে পড়লো। আমি নিঃশব্দ পায়ে খুব ধীরে দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। কম পক্ষে দেড়শো ওয়াটসের পাঁচ ফুট লম্বা টিউব বাল্ব দেয়ালে লাগানো। প্রখর আলোতে প্রথমে রুমের দিকে তাকাতে কষ্ট হলো। একখানা সিঙ্গল বেড, উপরে সাদা বেডসিট আর তার উপর চোখ বুঁজে শুয়ে আছেন সাদা ধবধবে এক রমণী। অনুমান করলাম বয়সটা বিশের নিচে হবে। ঘাঢ় নীল রঙের শাড়ীটা অগোছালোভাবে বেডের এক কোণে পড়ে আছে, তার উপর লাল একটি ব্লাউজ। ব্রা-টাও নিশ্চয়ই কোথাও আছে, হয়তো বালিশের নিচে বা অন্য কোথাও। যে ভংগিমায় মেয়েটি বেডের উপর চিৎ হয়ে শুয়েছে James Cameron তা দেখলে হয়তো টাইটানিক আরো আগে বানাতে পারতেন। পার্থক্য শুধু এইটুকু, Jack যখন উলংগ Rose এর ছবি আঁকেন তখন Rose এর গলায় একটি লকেট ছিল, এই মেয়ের সর্বাঙ্গের কোথাও চুল পরিমান একটা সুতাও নেই। চুলের রঙ দেখে বুঝাই যায় দেহে মিশ্র জিনের প্রভাব আছে। আমাকে নীরব নিশ্চুপ দেখে মেয়েটি নিজেই কথা বললো-
‘কী হলো, টাকা টেবিলে রেখে কাম সেরে ছিটকে পড়ুন, আমি খুব টায়ার্ড, আমি ঘুমাবো’। ‘টায়ার্ড’ শব্দটার উচ্চারণ আমার কাছে পরিচিত মনে হলো। বেশ কিছুক্ষণ কোন সাড়া শব্দ নেই। আধা ঘুম আধা সজাগ অবস্থায় ঢুলুঢুলু চোখে গুনগুন করে সে যা বললো, হয়তো নিজেই জানে না সে কী বলেছে। সে বলেছিল-‘ কাম অন দ্যেন হোয়াটস হ্যাপেন্ড, আই এম টায়ার্ড’। আমি জিজ্ঞেস করলাম-‘হোয়াটস ইওর নেইম’? ঘুমের ঘোরেই বললো-‘নুরজাহান’। আমি বললাম- লুক এট মি-

এই প্রথম পুরো চোখ মেলে সে আমার দিকে তাকালো আর উঠে বসে উরুর উপর একটা বালিশ টেনে শরীরের কিছুটা অংশ ঢেকে নিল। শ্বাসে মদের গন্ধ, বুঝাই যায় সে অর্ধ মাতাল। আমি তার শাড়িটা তার বুকের উপর ছড়িয়ে দিলাম। সে আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলে-
– আপনি কি পুলিশের লোক?
– না, আমি পুলিশের লোক নয়। তুমি কি একটু আগে সোনালী ব্যাংকে উঠেছিলে?
– ইয়েস।
– তুমি ইংরেজি শিখলে কোথায়?
– হোয়াই, হোয়াই ডু ইউ ওয়ান্ট টু নো?
– না, এমনি জানতে চাইলাম।
– আর ইউ ফ্রম ইংল্যান্ড?
– হ্যাঁ।
– ফ্রম হোয়ার?
– বর্ণমাউথ। এন্ড ইউ?
– মানচেষ্টার।
– তো তুমি এখানে কেন?
– ও ইট্স এ লং ষ্টোরি ম্যান।
– তোমার মায়ের নাম কী?
– লিন্ডা।
– দেশের বাড়ি কোথায়?
– সিলেট থেকে বিশ মাইল দূরে (**) থানার(**) গ্রামে।
– মা কোথায় থাকেন?
– জানিনা। আগে বার্মিংহাম থাকতেন।
– তুমি তোমার মায়ের কাছে যাবে?
– পাসপোর্ট নাই।
– কেন?
– বাবা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছেন। ১৪ বছর বয়সে হলিডের কথা বলে আমাকে দেশে এনে এক মোল্লা দাড়িওয়ালা মানুষের সাথে আমার বিয়ে দিয়েছিলেন——
– শুনো নুরজাহান, আমি তোমার সব কাহিনি শুনবো। তুমি যদি রাজি হও, আমি কালই তোমাকে ঢাকা বৃটিশ হাই কমিশনের কাছে নিয়ে যাবো। পাসপোর্ট ছাড়াও তারা নিশ্চয়ই তোমাকে ইংল্যান্ড পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে পারবেন।

লক্ষ্য করলাম ইতিমধ্যে মেয়েটির চোখের কোণে একসাগর জল এসে ভর করেছে। সহসাই বুক ফেটে ঝড় উঠার সম্ভাবনা আছে। আমি তার লাল ব্লাউজটি হাত বাড়িয়ে তার হাতে এগিয়ে দিলাম। সে আমার ডান হাতের দুটো আঙ্গুল ধরে হাতখানি তার চোখের সামনে মেলে ধরলো। জিজ্ঞেস করলো-
– হোয়াই হেভ ইউ গট মেন্দী অন ইউর হ্যান্ড?
– নতুন বিয়ে করেছি তো, তাই।
– আপনি বাসায় চলে যান। এক মুহুর্ত আর এখানে থাকবেন না।
– কেন, কী হলো?
– আমি চিৎকার করে মানুষ জড়ো করবো, পুলিশ ডেকে হাজতে পাঠিয়ে দেবো। ইউ গেট আউট নাও। প্লীজ গো–।

কী এক অদ্ভুত অস্থিরতা মেয়েটির মাথায় চেপে বসলো, আমাকে আর একটি কথাও বলার সুযোগ দিলনা। তার বাবার দেখা কোনদিন পেলে জিজ্ঞেস করতাম, তার এই অবস্থার জন্যে দায়ী কে, আর জীবিত মেয়েটিকে নরকবাসী করে তিনি কোন্ স্বর্গসুখে আছেন?