[ভূমিকাঃ নৃপেন্দ্র সরকারের “কৃষ্ণপক্ষের চাঁদ সংখ্যালঘু জীব (৩) এক রাজকাপুরের প্রথম মৃত্যু” লেখাটা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়ে এই লেখাটা ব্লগে দেয়া। এ বছরের একুশের বই-মেলায় ‘আমেরিকার গল্পঃ রঙ দিয়ে যায় চেনা’ নামে আমার একটা বই বের হয়েছে। আমার লেখা প্রথম প্রকাশিত বই। এই গল্পটা বইয়ের ১৪ টা গল্পের মধ্যে একটা। আগ্রহী পাঠকরা নিম্নোক্ত ওয়েবসাইট থেকে বইটা কিনতে পারেনঃ

বই-মেলা.কম

সবাইকে ধন্যবাদ]

কৈশোর ও যৌবনে বই পড়ার ভীষন বাতিক ছিল আমার। প্রায় সব ধরনের বই কম-বেশী পড়লেও আমাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষন করতো ওয়েষ্টার্ন সিরিজগুলো। এ্যাপাচী যোদ্ধা, কাউবয়, গরুর র্যা ঞ্চ, মরুভূমির লাগামছাড়া যাযাবর জীবন,…… সবকিছুই আমাকে আকর্ষন করতো খুব। তখন কি কখনও কল্পনা করেছি পশ্চিমের সেই মরু অঞ্চলে একদিন আবাস হবে আমার?

সিটি অব স্কট্‌স্‌ডেল (City of Scottsdale) কে বলা হয়, ‘the West’s Most Western Town’। এ্যারিজোনা স্টেইটের ফিনিক্স মেট্রো শহরে অবস্থিত অত্যন্ত ধনী সিটি হলো স্কট্‌স্‌ডেল। স্কট্স্‌ডেলের জনসংখ্যার প্রায় ৯৭% হলো সাদা (৯০% ককেইশিয়ান ও ৭% হিস্‌প্যানিক বা স্প্যানিশভাষী)। এই সিটির অধিবাসীদের মাথাপিছু বাৎসরিক আয় ১১০,৩০০ ডলার (পারিবারিক আয় ৯২,৩০০ ডলার; ২০০৭ সালের জরীপ অনুযায়ী)। গড়পড়তা বাড়ীর দাম ৪৪৫,০০০ ডলার।

‘বৈচিত্র্য’ সম্ভবতঃ মানুষের অবচেতন মনের এক চাহিদা। আর তাই দেখা যায়, একই ধরনের জীবন যাপনে, কিম্বা আশ-পাশে সবসময় এক ধরনের মানুষ দেখতে দেখতে একসময় মানুষ হাঁপিয়ে ওঠে; একঘেয়েমিতে পেয়ে বসে তাকে। মানুষ তাই ‘বৈচিত্র্য’ খোঁজে পরিবর্তনের জন্যে। ডাইভারসিটি বা বহুমুখিতা নিয়ে আসতে পারে সেই বৈচিত্র্যকে।

গত আট বছরে আমেরিকার চাকরি জীবনে বরাবর প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করে এসেছি, যদিও আমেরিকায় সরকারী চাকরি করার গোপন একটা বাসনা মনে মনে ছিলই। নিউজার্সী থেকে বছর দু’য়েক আগে এ্যারিজোনা মুভ করেছিলামও বেসরকারী চাকরি নিয়েই। এ্যারিজোনাতে আসার তখন এক বছরও পুরো হয়নি আমাদের। ২০০৮-এর শুরুর দিকে। কি খেয়ালে যেন স্টেইট আর সিটির ‘জব্‌-অপরচুনিটি’ গুলো অনলাইনে ঘেঁটে-ঘুঁটে দেখছিলাম একদিন। সিটি অব স্কট্‌স্‌ডেলের একটা ‘জব্‌-অপরচুনিটি’ হঠাৎ করেই আমার দৃষ্টি আকর্ষন করলো “সিনিয়র স্টর্মওয়াটার ইঞ্জিনিয়ার” (Sr. Stormwater Engineer)। কাংখিত যোগ্যতার লম্বা তালিকার অনেক গুলোই দেখা গেল আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সাথে মেলে। এ্যাপ্লিকেইশন ক্লোজিং-এর তখনও দিন তিনেক বাকি। তাড়াহুড়ো করে এ্যাপ্লিকেইশন ফিল্‌ আউট করে হাতে হাতে সিটি অব স্কট্‌স্‌ডেলের হিউম্যান রিসোর্সেস অফিসে জমা দিয়ে এলাম। সপ্তাহ খানেক পর অভাবিত ভাবে ফোন এলো ইন্টারভিউ-এর জন্যে। যথারীতি ইন্টারভিউ দিলাম। এবং তার দিন পনের পরেই চাকরির অফার পেলাম। পশ্চিমের সবচেয়ে পশ্চিমা সিটির এমপ্লয়ি হয়ে গেলাম সেই থেকে।

সিভিক সেন্টারের দোতলায় ‘পাবলিক ওয়ার্ক্‌স্’ ও ‘ট্রান্সপোর্টেশন’ ডিপার্টমেন্ট। গোটা ফ্লোরে প্রায় শ’ দেড়েক এমপ্লয়ি। গেব্রি (Gebre) আর আমি বাদে বাকি সবাই সাদা। গেব্রি ইরিত্রিয়ান। কালো। ‘স্টর্মওয়াটার প্ল্যানার’’। সিটিতে যোগ দিয়েছে আমার কিছুদিন আগে।

একটু আগে ডাইভারসিটির কথা বলছিলাম। ডাইভারসিটির উল্লেখ ও আমার বেসরকারী থেকে সরকারী চাকরিতে সুইচ্‌ করার গল্প থেকে কারো কারো মনে হতে পারে যে, আমি বোধহয় আমার চাকরির বৈচিত্র্যের কথা বলছি। আসলে তা না। ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি।

সিটি অব স্কট্‌স্‌ডেলের মেয়র, কাউন্সিল্‌পারসন্স ও সিটি ম্যানেজারের সম্বিলিত গৃহিত সিদ্ধান্ত এবং তদানুযায়ী হায়ারিং ম্যানেজার ও হিউম্যান রিসোর্স-এর উপর নির্দেশ হলো, বিভিন্ন রেস্ (race) ও ব্যাকগ্রাউন্ডের যোগ্য প্রার্থীদেরকে সিটিতে এমপ্লয় করার প্রচেষ্টা করা যেন স্কট্‌স্‌ডেল ক্রমে ডাইভার্‌সিফাইড হয়ে ওঠে; অনন্তকাল যেন কেবল সাদাদের আবাসভূমি না হয়ে থাকে। ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ইন্টারেষ্টিং। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা সংখ্যালঘু এমপ্লয়ীরা যেন সংখ্যাগরিষ্ট সাদা এমপ্লয়ীদের সাথে সহজে মিশতে পারে এবং কেউ যেন কোনভাবে ডিস্‌ক্রিমিনেইটেড না হয়, সে জন্যে আলাদা একটা ডিপার্টমেন্টও প্রতিষ্ঠা করেছে সিটি “অফিস অব ডাইভারসিটি এ্যান্ড ডায়ালগ” নামে। এই অফিসের কাজ হলো, এমপ্লয়ীদেরকে ডাইভারসিটি সম্বন্ধে সম্যক জ্ঞান বা ট্রেইনিং দেয়া এবং কোন ধরনের ডিস্‌ক্রিমিনেইটিং কমপ্লেইন পেলে তা তদন্ত করে দেখা ও উপযুক্ত সমাধান করা।

আমার আজকের গল্প ডাইভারসিটির উপর সিটি অব স্কট্‌স্‌ডেলে করা আমার সেই ট্রেইনিং প্রসঙ্গে। সিটির প্রত্যেক নতুন এমপ্লয়ীর জন্যে চাকরি শুরু করার সুনির্দিষ্ট একটা সময়ের মধ্যে এই ট্রেইনিং-এ অংশগ্রহন করা বাধ্যতামূলক। পুরোনো এমপ্লয়ীদের মধ্যে যারা আগে কখনো এই ট্রেইনিং-এ অংশগ্রহন করেনি, তাদের জন্যেও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এই ট্রেইনিং কে। ট্রেইনিং সেশনের টাইটেল হলো, “Beyond Race & Gender: Becoming Culturally Competent”। দৈনিক আধা দিন করে তিন দিন ব্যাপী এই ট্রেইনিং সেশন।

হিউম্যান রিসোর্সেস অফিসের সুবিশাল কনফারেন্স রুমে শুরু হলো আমাদের ট্রেইনিং। জনা ত্রিশেক ট্রেইনী। আমি ছাড়া ট্রেইনীদের বাকি সবাই সাদা। বেশীর ভাগই ককেশিয়ান; সাথে হাতে গোনা দু’চার জন হিসপ্যানিক। অবশ্য তিনজন ট্রেইনারের মাঝে কেবল একজন সাদা; বাকি দু’জনই কালো- আফ্রিকান আমেরিকান।

ট্রেইনিং সেশন শুরু হলো পরিচয় পর্বের মাধ্যমে। একে একে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিতে হবে- কোথায় জন্ম, কোথায় বড় হয়েছে, সিটির কোন্‌ ডিপার্টমেন্টের সাথে যুক্ত এবং সিটিতে কতদিন যাবৎ কাজ করছে, ইত্যাদি। বলা বাহুল্য, আমি বাদে ট্রেইনী এবং ট্রেইনারদের সবার জন্ম আমেরিকায়। তবে অনেকেই যে স্টেইটে জন্মেছে, সেখানে হয়ত বড় হয়নি; বড় হয়েছে অন্য আরেক স্টেইটে। একসময় আমার পালা এলো পরিচয় দেবার। উঠে দাঁড়ালাম। বললাম, “My name is Mohammad. I was born and brought up in Bangladesh……..””। বলা বাহুল্য, ট্রেইনী এবং ট্রেইনার- সবার চোখেমুখে অদম্য এক কৌতুহল ফুঁটে উঠলো, যা পরিষ্কার নজরে পড়লো আমার।

ট্রেইনিং সেশনের একটা অংশ ছিল ট্রেইনীদেরকে পরীক্ষা করা যে, আমরা অন্য ধর্মের বা এথ্‌নিক গ্রুপের রীতিনীতি সম্বন্ধে কে কতটুকু জানি। উদ্দেশ্য এটাই যে, আমাদের জানার বাইরেও অন্য ধর্মের বা এথ্‌নিক গ্রুপের কত অসংখ্য ধর্মীয় আচার ও জাতিগত কালচার আছে এবং এসব ডিফারেন্সকে এ্যাকোমোডেট্‌ করেও কিভাবে একটা প্রতিষ্ঠান সফলতা পেতে পারে- ধর্মীয় ও জাতিগত পার্থক্যের উপরে উঠে। পরীক্ষার শিরোনাম ছিল, “Developing Cultural Competency” এবং প্রশ্নগুলো ছিলঃ

১। What is Hanukkah?
২। Name two traditionally Black US colleges
৩। Do you know somebody who was born outside of the US?
৪। What is Cinco de Mayo?
৫। What is the name of the head covering worn by many Muslim women?
৬। Are you bi-lingual or multi-lingual?
৭। Who are Intuit and where do they live?
৮। What country lies between Pakistan and Bangladesh?
৯। Do you have a living Abuela?
১০। How do most Canadians pronounce the last letter of the alphabet?
১১। Why did the Irish immigrated to the US in the 1840s?
১২। What are the names of the two religious sects in Iraq?
১৩। Do you know what your Chinese birth sign is?
১৪। What is the meaning of an upside-down pink triangle?
১৫। What is the meaning of the word “Kosher”?

সাদা অধ্যুষিত, পশ্চিমের সবচেয়ে পশ্চিমা শহরের সিটি এমপ্লয়ীদের ট্রেইনিং-এর জন্যে বাছাই করা গুটিকয়েক প্রশ্নের মাঝে বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে সেট্‌ করা প্রশ্নটা দেখে গর্বে বুকটা ভরে গেল আমার। পৃথিবীর সাম্প্রতিক গ্লোবালাইজেইশনে এবং কেব্‌ল্‌ নিউজের কল্যানে অনেক আমেরিকানই হয়ত আজ বাংলাদেশের নাম জানে। কিন্তু ৩,৫০০ এমপ্লয়ী সমৃদ্ধ সুবিশাল একটা প্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক এমপ্লয়ী কেবল নামে নয়, বরং ভৌগলিক অবস্থানের দিক দিয়েও বাংলাদেশকে চেনার সুযোগ পাচ্ছে, একজন বাংলাদেশী হিসেবে তা জেনে গর্বে ও আনন্দে প্রাণটা ভরে উঠলো আমার।

আমেরিকানদের জেনেরাল নলেজ নিয়ে অনেক মজার মজার গল্প প্রচলিত আছে বাজারে। টিভি শো গুলোতে মজার মজার অনেক অনুষ্ঠানও হয় এসব নিয়ে। যেমন, অধিকাংশ আমেরিকান তাদের প্রেসিডেন্টের নাম জানলেও, ভাইস প্রেসিডেন্টের নাম জানেনা। আমেরিকার বর্ডার কোন্‌ কোন্‌ দেশের সাথে তা অধিকাংশ আমেরিকানই জানেনা। আপনি দোকান থেকে একটা জিনিষ কিনলেন যার দাম ৫.৪৫ ডলার; সেল্‌স্‌পারসনকে একটা ১০ ডলারের নোট ও সাথে খুঁচরো ৪৫ সেন্ট দিলেন যেন সে আপনাকে একটা ৫ ডলারের নোট ফেরৎ দেয়; অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনাকে চারটে এক ডলারের নোট ও আপনার ৪৫ সেন্টসহ আরও ৫৫ সেন্ট আপনাকে ফেরৎ দেবে দোকানী…… ইত্যাদি, ইত্যাদি। পাঠক, এরপর কি আর বলার প্রয়োজন আছে, ট্রেইনীদের মাঝ থেকে উপরের প্রশ্নগুলোর সবচেয়ে বেশী সংখ্যক সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল কে?

আমি নিশ্চিত, অধিকাংশ পাঠকই উপরের বেশীরভাগ প্রশ্নেরই উত্তর জানেন। তারপরও, সবার জানার সুবিধার্থে উত্তরের তালিকাটা নীচে দিয়ে দিচ্ছিঃ

১। Jewish Holiday
২। Howard College, Florida A&M, North Carolina A&T, Texas Southern College, etc.……..
৩। আমার পরিচয় জানার পর ট্রেইনীদের সবার উত্তর ছিল ‘Yes’
৪। Observed on May 5 in celebration of Mexican unity and patriotism
৫। Hijab
৬। আমি সহ দু’চার জন ছাড়া বাকি সবার উত্তর ছিল ‘No’
৭। Polar people who live in the far north of Canada, Alaska and Greenland
৮। India
৯। ‘Abuela’ means ‘grandmother’ in Spanish
১০। ‘Zed’ (আমেরিকানরা ‘Z’ কে উচ্চারন করে ‘জি’)
১১। Mainly due to great Irish Potato Famine
১২। Shiites and Sunnis
১৩। আমাদের সবার উত্তর ছিল ‘No’
১৪। Gay Rights movement
১৫। Food prepared in accordance with Jewish dietary law

আমেরিকানদের অনেক কিছুই আমি পছন্দ করিনা। আবার আমেরিকানদের যা যা পছন্দ করি, তার তালিকাও নেহায়েত ছোট নয়। এদেশে বসবাসকারী প্রতিটা মানুষের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করার যে অনন্ত প্রচেষ্টা চলছে প্রসাশনিক ও সামাজিক প্রতিটা পর্যায়ে, তার কেবল মৌখিক প্রশংসা করলে মনেহয় অনেক কম করা হবে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সংখ্যালঘূদের আনুপাতিক সংখ্যা ছিল প্রায় ২০%। আজ তা এসে ঠেকেছে ১০%-এর নীচে। স্বেচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক, অর্ধেকের বেশী সংখ্যালঘূ ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ছেড়ে migrate করেছে পাশের দেশে। কারন জিজ্ঞেস করলে আমরা এক দল আরেক দলের দিকে অঙ্গুলী নির্দেশ করি; দোষারোপ করি একে অন্যকে। এ তো গেলো রাজনীতিবিদদের কথা। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, আমরা সাধারন সংখ্যাগুরুরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইঙ্গিত করি সংখ্যালঘূদের প্রতিই; প্রশ্ন করি তাদের দেশপ্রেমকে। আজ আমেরিকার মত সাম্যবাদী, সম-অধিকারের দেশে বসেও একজন সংখ্যালঘূ হিসেবে আমার কেবলই মনে হয়, সংখ্যাগুরু প্রতিটা বাংলাদেশীকে একেকজন সংখ্যালঘূর জুতায় পা ঢুকিয়ে যদি বাংলাদেশের প্রসাশন ও সমাজ কে দেখানো যেত, তবে তারা প্রত্যেকেই হয়ত দেখতে পেতো “অনেক কিছুর সংগাই তার জন্যে আলাদা””।।

আব্দুর রহমান আবিদ
রচনাকালঃ এপ্রিল, ২০০৯