অঁরি পোঁকারের Intuition and Logic in Mathematics থেকে অনুবাদ

ফরাসী গণিতবিদ পোঁকারে সবচেয়ে পরিচিত পোঁকারে অনুমানের জন্য, কিন্তু তিনি গণিতের বহু শাখায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। অনুদিত প্রবন্ধটি ১৯০৫ সালে লেখা বিজ্ঞানের মূল্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত। প্রবন্ধের ইংরেজী অনুবাদ, যেখান থেকে এই বাংলা অনুবাদ করা হচ্ছে, ইন্টারনেটে সহজলভ্য।

গণিতে অন্তর্জ্ঞান ও যুক্তিবিদ্যা

বাস্তবতার সন্ধান তো করি, কিন্তু বাস্তবতা কি আসলে? শরীরবিজ্ঞানীরা আমাদের জানাচ্ছেন, জীবদেহ কোষ দিয়ে গঠিত, রসায়নবিদরা আবার জানিয়ে দিচ্ছেন যে কোষগুলি পরমাণু দিয়ে তৈরি। কোষ হোক, আর পরমাণুই হোক, জীব শরীরের বাস্তবতা বলতে কি শুধু সেগুলোকেই বুঝব? কোষগুলির বিন্যাস, এবং বিন্যাস থেকে গড়ে ওঠা জীবের গঠন-সংহতি, এও কি বাস্তব নয়, নয় বিচ্ছিন্ন উপাদান গুলির বাস্তবতার চেয়েও আকর্ষণীয় এক বাস্তবতা? যে জীববিজ্ঞানী হাতি নিয়ে গবেষণা করেছেন শুধুই অণুবীক্ষণের সাহায্যে, তাঁকে অদূরদর্শী বলাটা কি অন্যায় হবে?

গণিতে ঠিক এ ধরণেরই একটা ব্যাপার আছে। যুক্তিবিদেরা যেকোন প্রমাণকে কেটে-কুটে অনেক গুলি সহজ হিসেবে রূপান্তরিত করেন। এই হিসেবগুলির প্রত্যেকটা খতিয়ে দেখে যদি প্রতিটির সত্যতা যাচাই করা যায়, তাহলেই কি পরমার্থ লাভ হবে, এই প্রমাণের সত্যিকারের অর্থ আমরা বুঝতে পারব? প্রমাণটি মুখস্ত করে হুবুহু লিখে ফেলবার ক্ষমতাও যদি অর্জন করি, তাহলেও কি বলতে পারব প্রমাণটি বোঝার আর বাকি নেই? অবশ্যই নয়, গাণিতিক বাস্তবতার পুরোটা আমাদের জানা হয়ে উঠবে না, গাণিতিক প্রমাণকে একতা দেয় যে অনির্বচনীয় উপাদান, তা আমাদের অধরাই থেকে যাবে।

বিশুদ্ধ analysis থেকে আমরা পাই বহুসংখ্যক পদ্ধতির একটি সংগ্রহ, যাদের প্রত্যেকটির সঠিকতা সন্দেহাতীত। এই বিপুলায়তন সংগ্রহ আমাদের সামনে খুলে ধরে হাজারটা পথ, কিন্তু প্রশ্ন হল, এর মধ্যে কোন পথটা ধরে চট করে লক্ষ্যে পৌঁছনো যাবে? কে দেবে ঠিক পথের খোঁজ? এটা জানবার জন্য দূর থেকে পথের শেষ দেখতে পাবার একটা ক্ষমতা চাই আমাদের, আর অন্তর্জ্ঞানই হচ্ছে এই ক্ষমতা। যে অভিযাত্রী প্রথম পথের সন্ধান করছে তার জন্য অন্তর্জ্ঞান তো জরুরীই, কিন্তু পরে যারা প্রমাণটি বোঝার চেষ্টা করবে, তাদেরও অন্তর্জ্ঞানের দরকার আছে প্রথম অভিযাত্রীর পথ বাছাইয়ের কারণ বোঝবার জন্য।

ধরুন, দাবা খেলা দেখছেন। খেলা বোঝবার জন্য দাবার গুটি চালার আইন-কানুন গুলো জানলেই কিন্তু চলবে না। সেটুকু জেনেই যদি ক্ষান্ত হন, তাহলে খেলা দেখে এটুকুই শুধু বুঝবেন যে চালগুলো সব নিয়ম মেনে দেয়া হচ্ছে, এবং এই বোঝা প্রায় মূল্যহীন বললেই চলে। কেউ যদি স্রেফ যুক্তিবিদ্যার ভিত্তিতে গণিতের কোন বই পড়তে যায়, তার অবস্থাটি হবে ঠিক এরকম। খেলা সত্যিই বোঝা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস, একগাদা বৈধ চালের মধ্যে দাবাড়ু বিশেষ একটাকেই কেন বেছে নিলেন সেটা বোঝাই হল আসল ব্যাপার। পর-পর চালগুলির মধ্যের গভীর ঐক্যের রহস্যটা জানা হলে তবেই দাবা খেলা জানা সম্পূর্ণ হয়। স্বাভাবিক ভাবেই, দর্শকের চেয়েও এই জ্ঞানটা বেশি দরকার দাবাড়ুর, যার মাথা থেকে চাল গুলো বেরোচ্ছে।

দাবার সাথে তুলনা বাদ দিয়ে গণিতে ফেরা যাক। উদাহরণ-স্বরূপ, অবিচ্ছিন্নতার ধারণা। প্রথমে এটা ছিল একটা কাণ্ডজ্ঞানজাত ছবি। যেমন, কথার কথা, বোর্ডে টানা হাত না তুলে চক দিয়ে আঁকা একটা দাগ। তারপর আস্তে আস্তে ধারণাটা আরেকটু পরিস্রুত হল, তারপর অবশেষে বেশ কিছু অসমতার একটা জটিল ব্যবস্থায় এসে এই বিবর্তন থামল। দালান বানাবার পরে বাঁশের কাঠামো যেমন ফেলা দেয়া হয়, এ পর্যায়ে এসে ওই প্রথম ছবিটিকেও তেমনি নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া গেল, যা বাকি থাকল, তা যুক্তির বিচারে নিশ্ছিদ্র। কিন্তু ওই ছবিটা যদি আমাদের স্মৃতি থেকে একেবারেই বিদায় নেয়, তাহলে এই অসমতার জটাজাল কেনই বা একদা গঠন করা হয়েছিল সেটা আমরা বুঝব কিভাবে?

পাঠক হয়ত ভাবছেন, অামি কেবলই তুলনা-প্রতিতুলনা করে চলেছি। আরেকটা তুলনা দিই, ঠিক আছে? স্পঞ্জ প্রাণীটির জটিল সিলিকন নির্মিত কঙ্কাল হয়ত পাঠক দেখে থাকবেন।

স্পঞ্জ কঙ্কাল

স্পঞ্জ মারা যাবার পর যাবতীয় জৈব উপাদান ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাবার পর এই অসাধারণ কারুকাজময় কঙ্কাল অবশিষ্ট থাকে। কঙ্কালে সিলিকা ছাড়া আর কিছুই নেই, কিন্তু বড় কথা সেটা নয়, বড় কথা হল সিলিকার এই আশ্চর্য রূপ ধারণ, এবং সেটার কারণ জানার জন্য আমাদের জানতে হবে সেই জীবন্ত স্পঞ্জের কথা, যে সিলিকাকে এই রূপ দান করেছে। একই ভাবে, আমাদের পূর্বপুরুষদের অন্তর্জ্ঞান, আজ অপ্রয়োজনীয় হলেও, আমাদের যুক্তির মিনারের ওপর তাদের ছাপ বসিয়ে রেখে গেছে।

বাস্তবতার সম্পূর্ণ চিত্র উদ্ভাবকের যেমন চাই, তেমনি চাই যে উদ্ভাবনের পদ্ধতি উপলব্ধি করতে চায় তারও। যুক্তি কি এটা আমাদের দিতে পারে? না! এর প্রমাণের জন্য এটা লক্ষ্য করাই যথেষ্ট যে গণিতে যুক্তিবিদ্যাকে analysis (অর্থাৎ বিশ্লেষণ) বলা হয়। বিশ্লেষণ মানে বিভাজন, ব্যবচ্ছেদ। ছুরি আর অণুবীক্ষণ, শুধু এই নিয়ে তার কারবার।

যুক্তি আর অন্তর্জ্ঞান, দুটিরই ভুমিকা আছে, দুটিই অপরিহার্য। যুক্তি প্রমাণের অস্ত্র, কারণ শুধু যুক্তিই দেয় নিশ্চিতি, আর অন্তর্জ্ঞান উদ্ভাবনের উৎস।

চলবে…