আমার অভিজ্ঞতা মনে হয় এখানে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিক। কারন আমি জ্ঞানত নাস্তিক হইনি। তবে আস্তিক হলেও প্রথাগত ধর্মগুলির অন্ধভক্তির জগত থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি। এটা নি:সন্দেহে নাস্তিকতার পক্ষে বা আস্তিকতা চ্যালেঞ্জ করা কোন লেখা নয়। অবিশ্বাসের জবানবন্দী বিভাগটা লেখার জন্য নির্বাচিত করলেও তাই এই রুপান্তরের অভিজ্ঞতা মনে হয় এই বিভাগে বেশ কিছুটা ব্যাতিক্রম।

আমার জন্ম বাংলাদেশের আর ১০ টা পরিবারের মতই, ধর্মীয় তবে গোঁড়া না। মা সাধারনভাবে চরম ধার্মিক। তাকে জীবনে কখনো কোন নামাজ জ্ঞানতঃ ক্বাজা করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যদিও গানবাজনা, নাটক সিনেমা এসবেও তাঁর সারা জীবনই খুবই উৎসাহ। ধর্মের কথা বললে জবাব দিতেন যে ধর্মের কিছু কিছু রীতিনীতি যুগের সাথে বদলে যায়, আর নামাজ রোজা ঠিকমত করলে কোন সমস্যা নেই।

বাবা ধর্ম নিয়ে তেমন মাথা ঘামাতেন না, জীবনের শেষ দিকে এসে হজ্ব করেন, তবে তারপরেও নিয়মিত নামাজ রোযা ছাড়া আর তেমন কিছু বাহ্যত করতেন না। তিনি যে আমলে হজ্জ্ব করেন তখনো হজ্জ্ব করাটা পাবলিক ফ্যাশনের মত হয়ে দাড়ায়নি। মনে পড়ে না তাকে কখনো কাউকে ধর্ম নিয়ে ওয়াজ নসিহত বা কোন দোয়া দরুদ পাঠে কত সোয়াব এ জাতীয় আলাপ করতে শুনেছি, যে ধরনের কথাবার্তা সাধারনত ধর্ম কর্ম নিয়ে যারা থাকেন তারা বেশ উৎসাহের সাথেই নিত্যই করেন। ধর্ম নিয়ে পড়াশুনা করতে দেখেছি, কারন পাঠ্যাভাস ছিল তার মজ্জাগত, মরিস বুকাইলের সেই কোরান বাইবেল বিজ্ঞান বহু বছর আগে থেকেই আমাদের বাড়িতে ছিল। তিনি মনে হয় ধর্মকর্ম কে একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার বলেই মনে করতেন। পীরের দরগায় যাওয়া বা দ্বীন দুনিয়া ভুলে অহঃনিশি আল্লাহকে হাক ডাক করে ডাকাডাকি এসব একেবারেই পছন্দ করতেন না। এখানে আমার মা এর সাথে তার বিরাট তফাত। তবে আমাদের বাড়িতে ছোটবেলা থেকেই আর দশটা মুসলমান পরিবারের মতই হুজুর এসে আরবী কায়দা পড়াতেন। বড় বোনেরা কোরান খতম স্কুলের নীচের ক্লাসেই দেন, যদিও তারা সবাই সে আমলের ইংরেজী মিডিয়ামে পড়া। আমরা দুভাই কেন যেন শুরু করেও বেশীদূর আগাইনি। বাবাও গা ছাড়া ভাব দেখান, আমাদের অনুৎসাহী ভাব দেখে মার পীড়াপিড়ি তেমন আমল দেননি।

পারিবারিক ধর্মীয় শিক্ষা আর তেমন আগায়নি। স্কুলে শুধু চলত। সেও অনেকটা জোড়াতালি দেওয়া। তাতে ছোটবেলায় বেশ উৎসাহ পেলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে উৎসাহ চলে যায়। ক্লাস টুতে পড়াকালীন বাবা আরব দেশ থেকে হজ্ব করে ফেরার পর কিছুদিন বেশ গভীর ইসলামী চেতনায় উদ্ধুদ্ধ হই। এমনকি আরবী আলখাল্লা ও মাথার ব্যান্ডেরও জোর দাবী তুলি। তখন কিভাবে যেন ধারনা হয়েছিল সৌদী আরবই জগতের শ্রেষ্ঠ দেশ। ইহকাল পরকাল সব সেখানেই আছে। আরবী পড়তে কোনদিনই পারতাম না। কোরান কেন আরবীতে পড়তেই হবে অনেককে জিজ্ঞাসা করেও সদুত্তর পাইনি। বুঝলাম মুসলমান হিসেবে কোরান পড়তে হবে, তবে নিজে ভাষায় পড়তে সমস্যা কি? কেন আমাকে বিজাতীয় আরবীতেই পড়তে হবে? কাছাকাছি জবাব পেতাম যে যেকোন ভাষাতেই পড়া যায়, তবে আরবীতে পড়লে অনেক বেশী সোয়াব। ধীরে ধীরে বুঝেছি যে আমাদের ধর্ম জগতের বেশীরভাগ মোটিভেশনই গুনাহ এবং সোয়াবে নিহিত। ক্লাস সেভেন থেকে আমাদের ধর্ম পরীক্ষায় বেশ কিছু নম্বর থাকত নানা রকমের আরবী শব্দের উচ্চারন ও অর্থ লেখা। অত্যন্ত বিপদে পড়লাম। প্রথমে ফটোগ্রাফিক মেমোরির সাহায্য নিলাম। মানে আরবী শব্দ দেখেই তা হায়াগ্রোলিফিকক লিপি পড়ার কায়দায় মনে রাখার চেষ্টা। এই পদ্ধুতি তেমন ভাল কাজ দিল না। এরপর আরো সহজ ও অনেক কার্যকরি পদ্ধুতি নিলাম। আরবী জানা এক বন্ধুর সাথে মৌখিক চুক্তি করলাম। বিনিময় পদ্ধুতি যাকে বলা যায়। সে ছিল অংক, বিজ্ঞান, ও ইংরেজীতে মারাত্মক কাচা। তাকে আমি পরীক্ষায় ওইগুলিতে সাহায্য করতাম বিনিময়ে তার থেকে আরবী শব্দের উচ্চারন টুকলিফাই করতাম। ক্লাস নাইনে পদার্পন করে ঐচ্ছিক হিসেবে ইসলামিয়াত না নেওয়ায় এই যন্ত্রনা থেকে চিরমুক্তি পেলাম, কি যে শান্তি লেগেছিল। বলে রাখা ভাল যে সে সময় পর্যন্ত স্কুলে আরবী বিরক্তিকর লাগলেও ধর্ম শিক্ষা খারাপ লাগত না। নিজেদের এমন একটা ঐতিহ্যবাহী আইডেন্টিটি আছে এটা বোধ করতে খুবই ভাল লাগত।

এমনি করেই দিন যাচ্ছিল। ধর্ম কর্মের ধার তেমন ধারি না। মা মাঝে মাঝে নামাজ পড়তে বলেন, এক কানে ঢুকাই আরেক কানে বের করে দেই। শুধু জুমা/ঈদের নামাজে যাই। বাসার বাকী সবাই অবশ্য নিয়মিত নামাজ পড়ে। রোযা অবশ্য নিয়মিত রাখতাম খুব ছোটবেলা থেকেই। সে সময় বন্ধুবান্ধবের সাথে এসব নিয়ে আলাপ হত, কে কয়টা রোজা রাখল এ ব্যাপারটা ষ্ট্যাটাস ইস্যূ ছিল। আর ইফতারের সময় বেরোজদার বলে ভাগে কম পড়ার সম্ভাবনা থাকে না দেখে। মুরুব্বীরাও খুশী হতেন। সাথে সাথে বেরোজদারদের ফুটন্ত পুজের সাগরে সাতার কাটার মত ভয়াবহ শাস্তির ভয় তো ছিলই।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মাঝামাঝি থেকে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটল। ভয়াবহ ধরনের ধার্মিকে পরিণত হলাম। ৫ ওয়াক্ত নামাজ নিয়মিত মসজিদে গিয়ে পড়ি, সে শীত গ্রীষ্ম বর্ষা যাই হোক না কেন। ক্লাসের ফাকেও চলে যাই নামাজের যায়গায়। কিছুটা গোড়ামিও ভর করল। গুনাহর ভয়ে ছবি তুলতে চাই না, সিনেমা টিভি দেখিনা। বন্ধুবান্ধবেও বলে, কি ভাল ছেলে। সেসময় আসলেই মানসিকভাবে খুবই শান্তি পেতাম। দিন দুনিয়ার সুখ দূঃখ তেমন ষ্পর্শ করত না। এ অবস্থায় বেশ কিছু দিন গেল। এরপর বিদেশে আগমন, যদিও প্রথাগত ধর্ম পালনে ছেদ পড়ল না। মহা সমারোহেই চলল। কারন যে শহরে পড়তে এসেছিলাম সে শহরের বাংগালী এবং মুসলমান কমিউনিটি খুব ছোট এবং সবাই বেশ ধার্মিক। এ সময় এমনকি এক তবলীগের দলে ভিড়ে অন্য শহরেও ধর্মপ্রচারে বের হলাম। ধর্ম পালনে সংশয়ের ছাপ পড়ল আরো কবছর পর। মাত্র এই সেদিন।

এবার আমার মনে কিভাবে প্রথাগত ধর্মগুলির ব্যাপারে সন্দেহ বা অনীহা এল সেটা বলি। বলে রাখা ভাল যে আমার সন্দেহের বীজ বলতে আল্লাহর অস্তিত্ত্ব বোঝাচ্ছি না। সে ব্যাপারে আমার তেমন বড় ধরনের সন্দেহ এখনো হয়নি। বিবর্তনবাদ বা বিজ্ঞানের অন্য কোন মতবাদ পড়ে আমার অবিশ্বাস আসেনি। যুক্তি তর্ক বা কারো নাস্তিক্যবাদের লেখা পড়েও আমার অবিশ্বাসের সূত্রপাত হয়নি। সূত্রপাত হয়েছে বলা যায় নিজেরই ধর্মের নানান দর্শন, রীতিনীতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে চিন্তা করতে যেয়ে। এই ধরনের সন্দেহের বীজ মনে হয় সব ধার্মিকের মনেই থাকে বা থাকার কথা। আমার মত বেকুব বা কম ঈমানের হলে অনেকে মনে হয় প্রকাশ করে ফেলেন, আর বেশীরভাগ প্রকাশ করেন না বা নিজের মনকে স্বান্তনা দিতে নানান রকমের বুঝ দেন। এককালে তেমন আমিও করতাম। প্রশ্ন আসত, কাউকে জিজ্ঞাসা করতাম, উত্তর মনপূতঃ না হলেও কিছু কথা চালাচালির পর ভান করতাম যে মোক্ষম ব্যাখ্যা পেয়ে গেছি। খামোখা বেয়াড়া প্রশ্ন চালিয়ে গুনাহের ভাগীদার হতে চাই কোন আক্কেলে। এ জাতীয় আলাপে অবধারিতভাবেই এক পর্যায়ে মোড় নিত যে এসব নিয়ে বেশী চিন্তা করা নিষেধ আছে, ঈমান হালকা হয়ে যায়, কিংবা আমরা সামান্য মানুষ ভাল মন্দ কি বুঝি, আল্লাহই ভাল বোঝেন এ জাতীয় দিকে। এরপর আর কথা বাড়ানো ধার্মিক হিসেবে অসম্ভবের মত।

আমার মৃদু ধার্মিক, চরম ধার্মিক, বর্তমান সন্দেহে ভোগা ধার্মিক এই সব জীবনেই কিছু প্রশ্ন বার বার মনে এসে উকি দিত এবং দেয়, যেগুলির যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা আজো খুজে পাইনি। এককালে আশা ছিল পাওয়া যাবে, এখন বুঝতে পারছি যে আসলে পাওয়া যাবে না। ছোটবেলা থেকেই আশে পাশের ইসলামী পন্ডিতদের কাছ থেকে শুনে এসেছি যে মুসলমান বাদে আর বাকি সবাই জাহান্নামের আগুনে চিরকাল পুড়বে। মুসলমানেরা যাই হোক, কিছুটা গড়াই পেটাই এর পর একদিন না একদিন বেহেশত এ যাবেই। বিধর্মী, বিশেষ করে হিন্দুদের প্রতি বিদ্বেষের বীজ অনেকের মত খুব ছোটবেলা থেকে আমার মাঝেও ছিল। এই দর্শন মুসলমান হিসেবে ভালই লাগত, নিশ্চিত স্বর্গপ্রাপ্তির এহেন নিশ্চয়তায় কেই বা আপত্তি করে বা বেয়াড়া প্রশ্ন তোলে?
হিন্দুদের কেমন জব্দ হতে হবে ভাবলেও মনে বেশ প্রশান্তির ভাব আসত। মাত্র কিছুদিন আগেও কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বী লোকের সাথে পরিচয় হলেই মনে হত, আহা রে, বেচারার কপালে পরকালে অন্তত আগুনে পোড়াই লেখা আছে। ব্যাটা এমনই গাধা যে আমি বললেও বিশ্বাস করবে না। তবে গোল বাধল অন্য যায়গায়।

ছোটবেলা থেকেই ঘরে গৃহশিক্ষক আসতেন। সে আমলে তারা কেন যেন বেশীরভাগই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। মুসলমান নাকি ভাল শিক্ষক হয় না এমন কথা অনেকের কাছেই শুনেছি। মুশকিল হত যে হিন্দুদের ঘৃণা করার শিক্ষা ধর্মীয় দর্শন থেকে পেয়েছি সেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক যারা শিক্ষক হয়ে জীবনে এসেছেন তাদেরকে মনে হত দেবতূল্য মানুষ। বাসুদেব নামের একজন বৃদ্ধ শিক্ষক আমাদের কলোনীর অনেক বাসায় পড়াতেন, যেমন ছিলেন রসিক, তেমনি নীতিবান ও ভাল শিক্ষক। তার ভাই ফনীভূষন মজুমদার ছিলেন বংগবন্ধুর আমলের মন্ত্রী। ওনার কাছে আমি ক্লাস টু থেকে ফাইভ পর্যন্ত পড়ি। এনার মতন ভালমানুষ মনে হয় না আশেপাশে খুব বেশী দেখতাম। আমার জীবনের একটি বড় টার্নিং পয়েন্টও ক্লাস সেভেনে হৃষিকেশ নামের আরেকজন হিন্দু শিক্ষকের থেকেই আসে। যে কারনেই আজ মনে হয় আমি পেশাগত জীবনে মোটামুটিভাবে প্রতিষ্ঠিত, এতে আমার কোনই সন্দেহ নেই। আমি তার আগ পর্যন্ত ছিলাম অত্যন্ত সাধারন মানের ছাত্র, পড়াশুনা করতে হয় বলেই করি, পরীক্ষায় ফেলনা করলেও অবস্থান থাকে মাঝামাঝি, অংকে ছিলাম খুবই সাধারন। মাটির মানুষ এই লোকটি এসে কোনরকম মারধর বা ধমকাধমকি ছাড়াই আমাকে কিভাবে যেন অংক বিজ্ঞানে চরমভাবে উতসাহী করে তোলেন। তারই ধারাবাহিকতায় আমার আজকের অবস্থান। টেন এ উঠেও নিত্যানন্দ কুন্ড নামের আরেক শিক্ষক পাই যাকেও সহজে ভোলা যায় না। এরা সবাই যেমন ছিলেন ভাল শিক্ষক তেমনি মানুষ হিসেবে দেবতূল্য। ওনাদের মত ভালমানুষেরা মৃত্যুর পর অনন্তকাল আগুনে পুড়বেন এমন ধারনা আমার কচিমন কখনোই মেনে নিতে পারত না।

এসব দেবতূল্য লোকদের দেখতাম আর মার কাছে জিজ্ঞাসা করতাম; মা অমুক স্যারও তো হিন্দু, উনি কত ভাল মানুষ, উনিও কি সারা জীবন দো্যখে পুড়বেন? মা সরাসরি উত্তর দিতেন না, শুধু ঘুরিয়ে মনে হয় আমাকে স্বান্তনা দিতেই বলতেন যে হিন্দুরাও ভাল কাজের পুরষ্কার পাবেন। যদিও অনন্তকাল দো্যখে পুড়েও কিভাবে পুরষ্কার পাওয়া যায় এ প্রশ্নের যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা কখনোই দিতে পারেননি। আজ পর্যন্ত অন্য কেউই দিতে পারেননি।

এ প্রশ্নের যুক্তিসংগত উত্তর কখনোই পাইনি। অনেকেই বলেন যে তাদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ইসলাম গ্রহন করার, তারা করেনি, কাজেই অমন পরিনতি তাদের প্রাপ্য। বলাই বাহুল্য, ধর্মীয় পরিচয় যখন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জন্মগত বা পারিবারিকভাবেই স্থির হয়ে যায় সেক্ষেত্রে তাদের দায় কিভাবে দেওয়া যায় এমন কুযুক্তিরও যুক্তিসংগত উত্তর কোথাও পাইনি। আমি নিজে বা এমন ব্যাখ্যা যারা দেন তারাও অন্য সব ধর্মের গ্রন্থ পাঠ করে এ সত্য বুঝেছেন তেমন কোন আলামতও পাইনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ক্লাসে একজন ছাত্র ছিল যে দ্বিতীয় বর্ষের শুরু থেকে কঠিন তবলিগী হয়ে যায়। সে সময় তার কাছে আমরা নানান রকমের ইসলামী জ্ঞান নিতাম। এই প্রশ্নও একদিন তাকে করেছিলাম। উদাহরন হিসেবে বলেছিলাম যে মাদার টেরেসা এত জনকল্যানমূলক কাজ করেন, কিছুই কাজে আসবে না? তার কপালেও অনন্তকাল জ্বলে পুড়াই লেখা আছে? এত মানবতাবাদী কাজকর্ম সব বৃথা যাবে, এর ব্যাখ্যা কি? এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর বেশীরভাগই কেন যেন পালটা প্রশ্ন বা উদাহরন হয়ে থাকে। সেও বেহেশতি হাসি হেসে ব্যাখ্যা করেছিল; তোমরা তো কত কষ্ট করে পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা কর, সবসময় কি ভাল ফল লাভ কর? অনেক সময় এমন হয় না যে অনেক ভাল প্রিপারেশন নেবার পরেও পরীক্ষায় খারাপ করলে? এ ব্যাপারটাও তেমন। এহেন ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হলেও আর কথা বাড়াইনি। এর কিছুদিন পরে কোরানের বাংলা পড়ে অবশ্য আবিষ্কার করেছি যে আহলে কিতাবধারীরাও বেহেশতে যেতেই পারেন (অনেকের মতে অন্য কোন আয়াতে এর উলটা ধারনাও আছে)। মাদার টেরেসার ব্যাপারে মোটামুটিভাবে আশ্বস্ত হলেও হিন্দু বা নাস্তিকদের যে কোনই রেহাই নেই এতে কোন সন্দেহ নেই।

এই নিয়ে মনের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব কাজ করলেও তা খুব বেশী ডালপালা মেলতে পারেনি বা বলা ভাল যে মেলতে দেইনি। আল্লাহ নিশ্চয়ই সব বিষয় ভাল বোঝেন, কারো উপর অবিচার হবে না এমন ধারনা বিশ্বাস করতে চেষ্টা করতাম, আজো করি। মুশকিল বাধত কোরান শরীফ সহ নানান ধর্মীয় পুস্তকে এমন ধারনার পরিষ্কার বিরোধীতা আবিষ্কার করে। নানা বিশেষজ্ঞের এ সম্পর্কিত কথাবার্তা, সাম্প্রদায়িক মতবাদ যত শুনতাম ততই মনের একটা দিক প্রথাগত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসত। এ হতে পারে না। যে জন্মের উপর মানুষের কোনই হাত নেই সে জন্মের কারনেই কেউ অনন্তকাল বেহেশতের ফল ফ্রুটস হুরী ভোগ করবেন আবার কেউ বেগুনপোড়া হবেন, সৎকর্মের কোনই প্রতিফল থাকবে না এটা কোন সূস্থ যুক্তিতে ব্যাখ্যা করা যায় আজো জানি না। কেউ কেউ আরো সোজা বুদ্ধি দিতেন, এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে নিজে ধর্মকর্ম করে যাও। কেমন যেন গা এড়ানো বলে মনে হয়।

প্রথাগত ধর্মের আরেকটি দিক আমার কাছে চিরকালই বাড়াবাড়ি রকমের হাস্যকর লাগত। তা হল ইসলামী মতে আমি যা বুঝেছি তা হল যাবতীয় সোয়াব নেকি কামানোর সবচেয়ে বড় উপায় হল নানান উপায়ে আল্লাহর আরাধনা করা। নামাজ, রোযা, নিয়মিত কোরান পড়া, কোন সূরা বা দরূদ পাঠে কত ফযিলত এসব হল উল্লেখযোগ্য। যেটা আমার কাছে খুবই আশ্চর্যের মনে হয় যে প্রথাগত ইসলামে সেভাবে মানব উপকার বা জনকল্যানমূলক কাজের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে বলে কোনদিন মনে হয় নি (হতে পারে আমি ভুল? তবে যারা জোরে শোরে ইসলাম পালন করেন ও গবেষনা করেন তাদের তাত্ত্বিক লেখালেখি, বয়ান, ও জীবন পদ্ধুতি দেখে এমন মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক)। সুন্নী ইসলামের ৫ প্রধান স্তম্ভের যাকাত বাদে আর কোনটাকেই আমার কাছে এখন আর রিচূয়াল বাদে তেমন কিছু মনে হয় না। ভাল কাজের জন্য সোয়াব বা মন্দ কাজের জন্য গুনাহ বা শাস্তির ভয় আছে, তবে নানান উপায়ে আল্লাহর গুনগান গাওয়ার উপর যতটা গুরুত্ত্ব দেওয়া হয়েছে সেভাবে এসবের জন্য গুরুত্ত্ব নেই। মোল্লা আলেমে এনারা যেভাবে এক ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে কত কোটি বছর দোযখ বাস তার হিসেব দিতে পছন্দ করেন তেমনি ভাবে ১ টাকা ঘুষ খেলে কত বছর দোযখ তার হিসেব নিয়ে তেমন চিন্তিত হতে আমি অন্তত দেখিনি। ছেলেবেলা থেকেই দেখেছি কোন নামাজে কত সোয়াব, নফলের সোয়াব, সুন্নতের ফজিলত এসব নিয়ে মানুষ যেভাবে চিন্তা করে সেভাবে দুনিয়াদারির জনকল্যানমূলক কার্যাবলী নিয়ে কেউ তেমন করে ভাবে না। এটাও আমার মনের যৌক্তিক অংশকে প্রায়ই জ্বালায়; যে আল্লাহ এত ক্ষমতাবান, যার ক্ষমতা বর্ণনা বা বোঝার মত ক্ষমতাও আমি সামান্য মানুষের নেই সেই আল্লাহ কেন অফিসের বড় সাহেবের মত তার গুনগান গাওয়া সোজা বাংলায় তেলানো এত পছন্দ করেন? তিনি আছেন, মানি। কিন্তু দিবা রাত্র অষ্টপ্রহর তার গুনাগুন বিজাতীয় ভাষায় তারই কাছে বর্ননা করে যাওয়ার মাঝে কি কল্যান নিহিত থাকতে পারে? আত্মমহিমা তার মত মহান অতিপ্রাকৃত স্বত্ত্বার এত পছন্দ বা দরকার কেন?

এক ওয়াক্ত নামাজ বাদ পড়া তো বহু দুরের কথা, ইচ্ছাকৃতভাবে কাজ্বা করলেও নাকি ভয়াবহ শাস্তি। একদিন রোযা না রাখার শাস্তি যেন কত বছর ফুটন্ত পূঁজের সাগরে হাবুডুবু খাওয়া, আর খাদ্য হিসেবে কাঁটা। অথচ এগুলির তূলনায় পার্থিব অপরাধগুলির শাস্তির ব্যাপারে ইসলাম যেন অনেকটাই নিশ্চুপ। ঘুষ খাওয়া বা দেওয়ার শাস্তি কত বছর, ক্ষুধার্ত মানুষকে খাদ্য না দেবার শাস্তি ঠিক কত বছর দোজখ বাস কিংবা অন্যায়ভাবে কারো সম্পত্তি মেরে খেলে তার শাস্তি কত বছর বা কোন প্রকারের দোজখ সেসব নিয়ে মোল্লা আলেমদের তেমন কথাবার্তা বলতে কোনদিন শুনিনা। ভাসা ভাসা ভাবে বলেন মহাপাপ, ঠিক, তবে গুরুত্ব তেমন দেন বলে কোনদিন মনে হয়নি। সাধারনভাবে ইসলাম ধর্ম পালন বলতে নামাজ রোযা কোরান পাঠ, সাথে হয়ত হজ্জ্ব বা যাকাত ছাড়া তেমন কিছুই বাহ্যিক বিশেষত্ব দেখি না। এগুলি পালন করার সাথে (আমার কাছে নিছকই কিছু রিচূয়াল) মানুষের নৈতিক সততার কি সম্পর্কে এই প্রশ্ন সবসময়ই মনে হয়েছে।

এই নিয়ে ইসলাম জানা ব্যাক্তিদের প্রশ্নও করেছি। পন্ডিতদের মতে মন থেকে নামাজ রোযা করলে, বুঝে আমলের সাথে কোরান পাঠ করলে নাকি মানুষ এমনিতেই ভাল হয়ে যাবে। কাজেই, নামাজ রোযা এ জাতীয় আল্লাহর ইবাদতই মূল। যদি উদাহরন দেখাতাম যে অমুকে তো দিনরাত মসজিদে পড়ে থাকে কিন্তু বদের ধাড়ি, ব্যাপার কি? সোজা জবাব, সে লোক দেখানো ইবাদত করে, মন থেকে করে না। বলাই বাহুল্য এমন জবাব কখনোই খুব একটা সন্তোষজনক মনে হয়নি। ইসলামের পূর্নাংগ জীবন বিধানের জোর দাবী দিনে দিনে আরো বেশী হাস্যকর ঠেকেছে। আশে পাশে যারা জোরে শোরে ইসলাম পালন করেন তাদের সবসময়ই দেখি মানব কল্যানমূলক কাজকর্মের প্রতি তেমন মনোযোগ নেই। তাদের দেখলে কখনোই ইসলামের আওতা বেশী করে নামাজ পড়া বা নানান রকমের ইবাদতের বেশী কিছু মনে হয়নি। ব্লগেও ইসলাম বিষয়ক অসংখ্য লেখাই আসে, সেগুলির সামগ্রিক মানও মোটামুটি একই।

এরপর কোরানের বিভিন্ন আয়াতের অনুবাদ একটু নিরপেক্ষ ও সংশয়বাদী চোখে পড়তে গিয়ে বুঝতে পারলাম যে কোরান আল্লাহর বানী কিনা সে বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে এর কোরানের বেশ কিছু আয়াতই এই যুগে শুধু অচলই নয়, রীতিমত অমান। কোরানের প্রতিটা অক্ষর সব যুগের সব মানুষের জন্য অবশ্য পালনীয় এহেন দাবী শুধু অযৌক্তিকই নয়, রীতিমত হাস্যকরই ঠেকে। এমন দাবী যারা করেন তারা নিজেরাও পালন করেন না। যদিও মুখে স্বীকার করেন না, নানান রকমের ওজর দেখান। আর হাদীসের তো কথাই নেই। বিভিন্ন বাংলা ব্লগের ধর্ম বিষয়ক বিতর্কগুলিও এ ব্যাপারে বেশ সাহায্য করল। অবাক হয়ে দেখতাম উচ্চশিক্ষিত মানুষেও কিরকম অবলীলাক্রমে কি অন্ধভাবে প্রাচীনপন্থী অমানবিক রীতিনীতি ডিফেন্ড করে চলেছেন। যদিও সেসব রীতিনীতির বেশীরভাগই নিঃসন্দেহে নিজেরাই পালন করেন না, কেউ পালন করেন শুনলে মনের অজান্তেই হয়ত নাক সিটকাবেন।

বাংলা ব্লগগুলো থেকে প্রথম জানতে পারলাম ইসলামের ইতিহাসের আরেক দিক যা আমাদের দেশের ধর্মীয় শিক্ষার সিলেবাস এবং যাবতীয় ধর্মীয় প্রচারনা থেকে যত্নের সাথে আড়াল করে রাখা হয়। বলতেই হয় যে সত্য গোপন করার এই টেকনিক ইন্টারনেটের যুগের আগে পর্যন্ত খুবই সফলভাবে কাজে দিয়ে এসেছে। প্রথম প্রথম এসব বিশ্বাস করতাম না, মনে হত সবই বুঝি বিধর্মীদের বানানো গালগল্প। নিজে কিছু যাচাই করতে বুঝলাম যে কিছু কিছু ইতিহাসে বিতর্ক থাকলেও বেশীরভাগেরই মূল উৎস স্বীকৃত ইসলামী সূত্রেই আছে। হতে পারে এসবের অনেক কিছুই ভুল বা সঠিকভাবে ইতিহাসবদ্ধ হয়নি। সেটা সত্য হলে বলতে হয় যে হাজার বছরেরও উপর ধরে কেউ এসব পারিষ্কার করার দায় নেননি। আর নানান বড় বড় অতি পরিচিত আলেম স্কলারের ধর্ম বিষয়ক বইপত্র পড়লে উল্টাটাই মনে হয়। যেই ইসলাম বা ইসলামী ইতিহাসের হিরো বলে যাদের শিখে এসেছি তাদের অন্যরকম চেহারা নানান সহি ইসলামী সোর্স থেকেই আবিষ্কার মানসিকভাবে বেশ আঘাত দিল। নিজেকে সাথে সাথে বেশ প্রতারিতও মনে হল। বেছে বেছে কোরানের কিছু ভাল ভাল আয়াত শুনিয়ে বা কিছু বাছা বাছা হাদীস পাঠ করা যে সত্য পথের দিশারী হতে পারে না বুঝলাম। বুঝতে পারলাম যে অধিকাংশ ধার্মিকের ঈমান আনয়নের বুনিয়াদ তৈরীর সময়টায় বেশ লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে যথেষ্ট যত্নের সাথে কচি মন গড়াই পেটাই করা হয়। আর এই গড়াই পেটাই এর কাজে দোযখের ভীতি প্রদর্শন হল অন্যতম বড় অস্ত্র।

কোরান আল্লাহ হেফাজত করে আসছেন, যার একটি অক্ষরও বদল করার সাধ্য কারো নেই। হতে পারে। কিন্তু তাতে কি লাভ হয়েছে বা হচ্ছে এই নিয়ে মনে ঘোর সংশয় আছে। কোরানের অনুবাদ দেখি যে যার মত করছেন। একজনের সাথে আরেকজনের অনুবাদ, তাফসীরের আকাশ পাতাল পার্থক্যও ঘটে। আল্লাহর কোরান হেফাজত করার সুফল তেমন পাওয়া যাচ্ছে বলি কিভাবে? বুঝতে পারলাম যে কোরান পড়ে হয়ত মনের শান্তি পাওয়া যেতে পারে, তেমনি আবার ঘোর সাম্প্রদায়িক এমনকি জেহাদী বোমারু হবার অনুপ্রেরনাও পাওয়া যেতে পারে। কারো মতে এই আয়াতের অর্থ এমন, কারো মতে এমন, কন্টেক্সট বুঝতে হবে। আবার কারো মতে অমুক আয়াত মানসুখ হয়ে গেছে। অন্য কেউ আবার প্রতিবাদে তেড়ে আসছেন। অনেক ইসলাম ডিফেন্ডার আবার অতি পরিচিত নামাজ, রোজা, হজ্বের মত ইসলামিক রিচুয়ালগুলি চ্যালেঞ্জ করে বসছেন। তাদের মতে আসল ইসলাম হাজার বছর আগেই হাইজ্যাক হয়ে গেছে। কোরানের বেশ কিছু আয়াত পড়ে বিধর্মীদের প্রতি আল্লাহর অসীম জাতিগত ক্রোধের পরিচয় পেয়ে খুবই বিস্মিত হলাম। খুবই গোলমেলে ব্যাপার। মোট কথা, ইসলামের ভিত্তি কোরানের নানান দর্শন সম্পর্কে মনে গভীর সংশয় জাগল। যদিও পরকালের মত ইসলামের কিছু মূল দর্শন এখনো ভালই লাগে।

সংশয়বাদ খুব সুখকর কোন অভিজ্ঞতা নয়। হয়ত আত্মপ্রতারনা করে গেলে এই জ্বালা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেত। এটাও করতে পারি না। যা সত্য মনে হয় বলি। ধর্মের মূল বানী অবশ্যই সত্য পথে থাকা, সেটা করার জন্য অতি অবশ্যই কোন প্রাচীন ঐশীগ্রন্থ চোখ কান বুঁজে পালন করতে হবে বা পালন করার দাবী করে যেতে হবে এই ধারনা এখন খুবই অদ্ভূত লাগে। ঈশ্বর বিশ্বাসের মত একটি ব্যাপার যা যুক্তি প্রমান দিয়ে কোনদিন প্রমানের উপায় নেই তা নিয়ে মাতামাতি করাও সময়ের অপচয় মাত্র বলেই মনে করি।

——————————————————————————–
The New Busy is not the old busy. Search, chat and e-mail from your inbox. Get started.