এই লেখাটি মূলত বিবর্তন আরকাইভের জন্য টক অরিজিন্সের Evolution and Chance প্রবন্ধটির অনুবাদ হিসেবে প্রস্তুত করা হয়েছিল, কিন্তু লেখার মাঝে আপতন ছাড়াও অন্য অনেক কিছু চলে আসায় অভিজিতদার পরামর্শে ব্লগে পোষ্ট করলাম।

বিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অভিযোগ হল যে এটি আপতন বা chance এর উপর নির্ভরশীল। এই ধারার অভিযোগের একটি জনপ্রিয় উদাহরণ হল জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েলের “বোয়িং ৭৪৭” যুক্তি(এর জন্য দেখুন- http://www.mukto-mona.com/evolution/QA/hoyle_boeing.htm), যা বলে যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজাতির উৎপত্তি অনেকটা তুফান ঝড়ের ফলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কিছু বিচ্ছিন্ন যন্ত্রপাতি থেকে একটি সম্পূর্ণ বোয়িং ৭৪৭ বিমানের উদ্ভব ঘটারই সামিল। বিবর্তনকে আপতননির্ভর আখ্যা দিয়ে অনেকেই তাঁদের অবৈজ্ঞানিক আদর্শকে সামনে আনতে চেয়েছিলেন। চল্লিশের দশকে বংশগতিবিদ্যার অপবৈজ্ঞানিক স্ট্যালিনবাদী বিকৃতি, যাকে “লাইসেঙ্কোবাদ” বলে অভিহিত করা হয়, একটি কুখ্যাত উদাহরণ। ডারউইনবাদ সম্পর্কে লাইসেঙ্কো বলেন,

পদার্থবিদ্যা এবং রসায়নশাস্ত্রের মত বিজ্ঞান নিজেদেরকে আপতনের হাত থেকে মুক্ত করেছে। একারণেই তারা প্রকৃত বিজ্ঞানে উন্নীত হতে পেরেছে। জীবজগত কিছু আনুষঙ্গিক এবং শক্ত নীতি অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। তাদের প্রাকৃতিক এবং আনুষঙ্গিক চাহিদাকে পুঁজি করেই প্রজাতিগুলো গড়ে উঠেছে। মেন্ডেলবাদ-মরগানবাদ-ভাইজম্যানবাদকে আমাদের বিজ্ঞান হতে বিতাড়ন করে আমরা প্রাণীবিজ্ঞান হতে আপতনকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছি। আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে আপতন বিজ্ঞানের শত্রু।

বলাই বাহুল্য, মেন্ডেল, মরগান এবং ভাইজম্যান জিন ও পরিব্যক্তি আবিস্কার করেছিলেন। তাঁদের কর্মের উপরই আধুনিক জীববিজ্ঞান ও বিবর্তন তত্ত্ব দাঁড়িয়ে আছে। জীববিজ্ঞানে আপতনের সম্পর্কে লাইসেঙ্কোর অন্তঃর্জ্ঞান এতই সফল হয়েছিল যে তাঁর ধ্যান-ধারণা কৃষিকাজে প্রয়োগ করার ফলে ২ কোটি মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছিল। একই বাক্যে যদি প্রজাতিকে নিয়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনার গালগল্প ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, তবে এটিও হতে পারে একটি সৃষ্টিবাদী বিবৃতি। আপতন সম্পর্কে নোবেল জয়ী অণুজীববিজ্ঞানী জ্যাক মোনড বলেন,

প্রাণের মত একটি অতি রক্ষণশীল ব্যবস্থায় যে সব প্রাথমিক ঘটনাগুলো বিবর্তনের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দেয়, সেগুলো আণবিক, দৈবিক এবং পরমকারণবাদী দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অর্থহীন। কিন্তু এই সম্পূর্ণ আকস্মিক দুর্ঘটনাগুলোই যখন ডিএনএর স্তরে কাজ করে, তখন স্ব্য়ংক্রিয়ভাবে এবং নিষ্ঠার সাথে এগুলোর প্রতিলিপি তৈরী করা হয় এবং অনুবাদ করা হয়: অর্থাৎ, লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি অনুলিপিতে এই দুর্ঘটনাটি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আপতনের অঙ্গন থেকে তখন দুর্ঘটনাটি অপ্রশম্য নিশ্চয়তার জগতে প্রবেশ করে। প্রাকৃতিক নির্বাচন তখন প্রাণীর স্তরে কাজ শুরু করে।

জিনগত পরিবর্তন যে আকস্মিক, এই দৃষ্টিভঙ্গীটি ভুল। জিনগত পরিবর্তনের নানা কারণ প্রতিনিয়ত আবিস্কৃত হচ্ছে, এর মধ্যে কিছু কিছু আমরা বুঝতে পারছি এবং কিছু কিছু আমরা বুঝতে পারছি না- কিন্তু যাই হোক, এই পরিবর্তন গুলো দৈব নয়, এই অর্থে যে এই পরিবর্তনগুলোর পেছনে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণ রয়েছে।

দ্বিখন্ডিত বিবর্তন

ডারউইনের “প্রাকৃতিক নির্বাচন” এত বেশি বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে যে এর সাথে দার্শনিক হার্বার্ট স্পেন্সারের “সারভাইভাল অব দ্যা ফিটেস্ট” এর তুলনা করা যায়। এই “প্রাকৃতিক নির্বাচন”কে এমনভাবে তুলে ধরা হয় যেন প্রকৃতি একটি নির্বাচনী ঘটক, যা প্রজাতির উৎকর্ষতার উদ্দেশ্যে কেবল যোগ্যতম প্রাণীদেরকেই নির্বাচন করে। এর চেয়ে বড় বিভ্রান্তি কিছু হতে পারে না।

প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য দু’টো শক্তি দরকার। একটি শক্তি নিষ্ঠার সাথে জীবের প্রতিলিপি তৈরী করতে চেষ্টা করবে(কিন্তু সবসময় নির্ভুলভাবে করতে পারবে না), আরেকটি শক্তি জীবের ফেনোটাইপকে(পরিবেশের সাথে জীবের মিথস্ক্রীয়া, অথবা জিনের বাহ্যিক অভিব্যক্তি) বেঁচে থাকার সংগ্রামে কম অথবা বেশি দক্ষতা অনুযায়ী শ্রেণীকরণ করবে। এই প্রক্রিয়াকে আরেকভাবে বললে “উত্তরাধিকারের পরিবেশভিত্তিক বাছাইকরণ” ও বলা যায়, কারণ প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণেই কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য অন্য সব বৈশিষ্ট্যের সাপেক্ষে বেশি উপকারী হওয়ার কারণে পরবর্তী প্রজন্মে নিজেদের জন্য জায়গা করে নেয়। সোবার প্রক্রিয়াটিকে এভাবে চিত্রায়িত করেছেন: একটি শিশুতোষ খেলনার কথা কল্পনা করুন যেখানে একটি বাক্সে কয়েকটি বিভিন্ন আকৃতির গোলক রয়েছে এবং বাক্সটিতে ক্রমশঃ সংক্ষিপ্তমান রন্ধ্রযুক্ত দু’টো অভ্যন্তরীণ স্তর রয়েছে। বাক্সটিকে ঝাকালে(যা একটি দৈব প্রক্রিয়া) প্রথম স্তর দিয়ে ছোট গোলকগুলোর অনুপ্রবেশ এবং দ্বিতীয় স্তর দিয়ে সবচেয়ে ছোট গোলকগুলোর অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে ছোট গোলকগুলোই হল সবচেয়ে “যোগ্য” এবং এরাই কেবল দ্বিতীয় স্তরকে অতিক্রম করতে পারে। এখানে আমরা একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে পরিলক্ষণ করছি যার কারণে সবচেয়ে ছোট গোলকগুলোই তলদেশে গমন করতে পারছে।

বিবর্তনে feedback loop তখনই সৃষ্ট হয় যখন জিনের গঠণ নতুন নতুন ফেনোটাইপিক বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করে। যেসব বৈশিষ্ট্য প্রজননগত জনগোষ্ঠীতে অন্যসব বিকল্প বৈশিষ্ট্য(যাকে সিওয়াল রাইট, জিন প্রবাহ প্রক্রিয়ার প্রস্তাবক, deme বলেছেন) থেকে বেশি যোগ্য, সেগুলোর প্রতিলিপি তৈরী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। ১৭৯৮ সালে মালথুসের Essay on Population পড়ে ডারউইন লক্ষ করেছিলেন যে প্রাকৃতিক সম্পদের তুলনায় জীবের সংখ্যা যদি বেশি হয়, তবে জনগোষ্ঠীতে সেসব জীবের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে যারা সীমিত সংখ্যাক প্রাকৃতিক সম্পদের যথোপযুক্ত ব্যবহার করতে পারে এবং সেসব জীবের সংখ্যা কমতে থাকবে যারা তা পারে না। একটি প্রজননক্ষম জনগোষ্ঠীকে যদি অন্য জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা করা হয়, তবে কালের বিবর্তনে উক্ত জনগোষ্ঠীটির বৈশিষ্ট্যসমূহ পূর্বের জনগোষ্ঠীর হতে এত বেশি অপসারিত হবে যে আগের সেই জনগোষ্ঠীর সাথে উক্ত জনগোষ্ঠীর প্রজনন অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই পর্যায়ে উদ্দীষ্ট জনগোষ্ঠীটি একটি নতুন প্রজাতিতে রুপান্তরিত হবে।

এধরণের পরিবর্তন থেকে অনেক নতুন নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। যেমন, “প্রজাতি” শব্দটির অর্থ অপরিস্কার হয়ে যায়। একটি অভিভাবক প্রজাতি ও তার অপত্য প্রজাতির মাঝে আপাতঃদৃষ্টিতে কোন ধরা-বাধা পার্থক্য থাকে না। কুকুর আর বিড়ালের মাঝে পরিস্কার পার্থক্য রয়েছে, কিন্তু গাধা আর ঘোড়ার মাঝের পার্থক্যটা অত সহজে লক্ষণীয় নয়। গাধা আর ঘোড়ার সঙ্গমে খচ্চরের জন্ম হয়, যা বন্ধ্যা। অন্যদিকে জেব্রা এবং ঘোড়া অথবা বাঘ এবং সিংহের মধ্যে অন্তঃপ্রজনন সম্ভব এবং এদের সন্তান-সন্ততিরা মাঝে মাঝে উর্বর হয়। “প্রজাতি” শব্দটি তাই স্রেফ শ্রেণীকরণের সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হয়, এর কোন অধিবৈদিক গুরুত্ব নেই। উপক্রমিক প্রজাতিগুলোকে তাই “প্রকারণ” কিংবা “উপপ্রজাতি” বলা হয়, আজকাল জীববিজ্ঞানীরা শুধু তখনই “প্রজাতি” শব্দটি ব্যবহার করেন যখন আন্তঃর্প্রজনন জিনগতভাবে অথবা ব্যবহারিকভাবে কঠিন হয়ে পড়ে। বাঘ ও সিংহের মত পাখিদের মধ্যে অনেক প্রজাতি আছে যারা সঙ্গম করে প্রজননক্ষম সন্তানের জন্ম দিতে পারলেও তারা তা করে না। তারা যেহেতু আন্তঃর্প্রজনন করে না, তাই তাদেরকে আলাদা প্রজাতি ধরা হয়।

আরেকটি সিদ্ধান্ত হল যে নির্বাচনের কোন লক্ষ নেই। প্রাকৃতিক কারণে প্রকারণের(variation) উৎপত্তি হয়। চতুষ্পদীরা ত্রিপদী প্রাণীর জন্ম না দিলেও পায়ের দৈর্ঘ্যের মাঝে সামান্য বৈচিত্র্য থাকতে পারে এবং এক্ষেত্রে যে দৈর্ঘ্য প্রাণীটিকে প্রজননে বিশেষভাবে সাহায্য করবে, সেই পদদৈর্ঘ্যটিই জনগোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়বে। প্রাকৃতিক সম্পদ যদি সীমিত হয় এবং লম্বা পা যদি খাটো পায়ের চেয়ে বেশি উপকারী হয়, তবে জনগোষ্ঠীতে গড় পদদৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পাবে এবং পরিবেশে আর কোন পরিবর্তন না হলে এই নতুন পদদৈর্ঘ্যই স্থির হবে। এখানে লম্বা পাকে “উৎকৃষ্ট” বলা যাবে না, বরং এগুলো বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রজননের জন্য যথেষ্ট সময়ে বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষাকৃত বেশি সন্তোষজনক। “Survival of the fittest” আসলে “Survival of the more adequate”।

প্রকৃতি আর জীবের মাঝে মিথস্ক্রীয়া দেখতে দেখতে আমরা প্রায়ই ভুলে যাই যে অন্য ক্ষেত্রেও অনুরুপ কিছু ঘটতে পারে। একটি ডারউইনীয় প্রক্রিয়ার প্রধান শর্তাবলী হল কিছু কাঠামো থাকতে হবে যার প্রতিলিপি ক্রমাগত তৈরী হতেই থাকবে, এর ফলে কিছু বৈশিষ্ট্যের উৎপত্তি ঘটতে হবে যা সম্পদ আহরণের সম্ভাবনাকে প্রভাবিত করবে এবং এই সম্পদগুলোই আবার প্রতিলিপি তৈরীর জন্য ব্যবহৃত হবে। এই ডারউইনীয় প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সামাজিক ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা হচ্ছে।৪,৫,৬,৭,৮ তাছাড়া কমপিউটার বিজ্ঞানে ব্যবহৃত তথাকথিত “জেনেটিক এলগরিদম” ও একই নীতি মেনে চলে। একটি সাধারণ ডারউইনীয় প্রক্রিয়া হল সেটাই যেখানে একটি জনগোষ্ঠী থাকবে এবং এই জনগোষ্ঠীতে কিছু interactor থাকবে যারা নিজেদের প্রতিলিপি তৈরী করবে এবং এই প্রতিলিপি তৈরী করার প্রক্রিয়ার সাথে interactive বৈশিষ্ট্যের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক থাকবে।

প্রাণের সূত্রগলো

জিনে বিভিন্ন কারণে পরিবর্তন ঘটতে পারে এবং এগুলো পপুলেশন জেনেটিক্স ও অণুবংশগতিবিদ্যার কিছু নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলে। ডিএনএকে প্রোটিনে লিপ্যন্তরকরণের প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপকারী বিভিন্ন রাসায়নিক প্রক্রিয়াও জিনে পরিবর্তন সাধন করতে পারে। যেভাবেই পরিবর্তনটি সাধিত হোক না কেন, এই পরিবর্তনটি ডিএনএ থেকে ফেনোটাইপে প্রবেশ করে। প্রোটিনে লিপ্যন্তরকরণের পরপরই বিভিন্ন প্রকার কোষ বেড়ে ওঠা শুরু করে এবং বিচিত্র কলায় বিভক্ত হয়ে পড়ে ধীরে ধীরে একতি জীবের জন্ম দেয়। অবশেষে ফেনোটাইপটি তার পরিবেশের অংশ হয়ে যায় এবং অন্য সব জীবের সাথে প্রজননগত সম্পদের(খাদ্য, সঙ্গী ইত্যাদি) জন্য প্রতিযোগীতা করে। এই প্রতিযোগীতায় শিকারী প্রাণীরাও অংশগ্রহণ করে। জিনে পরিবর্তনের কারণে জীবপুঞ্জে যে প্রকারণ সৃষ্টি হয়, সেই প্রকারণের জন্য প্রাকৃতিক নির্বাচন(যার মধ্যে যৌন নির্বাচনও অন্তর্ভুক্ত) একটি ছাঁকনি হিসেবে কাজ করে। যেসব বৈশিষ্ট্য একটি জীবকে অধিক সংখ্যাক বংশধর রেখে যেতে সাহায্য করে, সেসব বৈশিষ্ট্যই কেবল এই “ছাঁকনি” এর ভেতরে দিয়ে যেতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এই বৈশিষ্ট্যগুলো পুঞ্জীভূত হতে হতে এক সময় নতুন প্রজাতির জন্ম দেয়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় যেসব বৈজ্ঞানিক সূত্র কাজ করে, সেগুলোকে “বৈজ্ঞানিক সূত্র” এর অধিকাংশ সংজ্ঞার আওতায় ঠিকই “বৈজ্ঞানিক সূত্র” বলা যায়।

এখান থেকে অন্তত এটুকু পরিস্কার যে প্রকৃতিতে সম্পদের জন্য লড়াইয়ে আপতনের যেটুকু ভূমিকা থাকতে পারে, তা ছাড়া বিবর্তনের আণবিক প্রক্রিয়ায় এর আর কোনই ভূমিকা নেই।

ঠিক কার সাপেক্ষে “দৈব”?

বিজ্ঞানীদের আপতন আর ধর্মবেত্তা/নীতিশাস্ত্রের দার্শনিকদের আপতনের মাঝে পার্থক্যটা অবলোকন করতে চাইলে এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করা জরুরী। একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে বর্ণীত কোন প্রক্রিয়ার যে নকশা দাঁড় করানো হয়, তাতে অনেক কিছুকেই স্বতঃসিদ্ধ ধরা হয়। বিজ্ঞানের দার্শনিকরা এগুলোকে “প্রকল্প” বা hypotheses বলেন। এদের মধ্যে কিছু কিছু সম্পর্কে বিজ্ঞান আপাতত কিছু জানে না, কিছু কিছু আবার অন্য বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব দ্বারা ভালমত প্রমাণিত হয়েছে।

উদাহরণস্বরুপ, ডারউইন উত্তরাধিকার সম্পর্কে জানতেন কিন্তু উত্তরাধিকারকে ব্যাখ্যা করার মত কোন তত্ত্ব তাঁর জানা ছিল না। তাঁর এবং ওয়ালেসের নির্বাচনী তত্ত্ব ধরেই নিয়েছিল বৈশিষ্ট্যগুলো উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া যায়। তিনি তাঁর তত্ত্বের সুবিধার্থে “প্যানজেনেসিস” নামক একটি উত্তরাধিকারের তত্ত্ব ঠিকই প্রণয়ন করেছিলেন(যা ভুল প্রমাণিত হয়েছে), কিন্তু সেটি কখনওই প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। উত্তরাধিকারের রহস্য তখনও মিমাংসিত হওয়া বাকি ছিল।

মেন্ডেলের উত্তরাধিকারের সূত্রগুলো যখন পুনঃআবিস্কৃত হল এবং হাল্ডেন, ফিশার, রাইট সহ অন্যরা যখন তিরিশ ও চল্লিশের দশকে জনগোষ্ঠীর স্তরে জিনগত পরিবর্তনের গাণিতিক নকশা প্রণয়ন করলেন, তখন তথাকথিত নব্য-ডারউইনীয় প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব(অথবা বিবর্তনের “সংশ্লেষণী” তত্ত্ব) এগুলোকে স্বতঃসিদ্ধ ধরে কাজ করা শুরু করল। এর সাথে যখন ভাইজম্যানের germ plasm তত্ত্ব যোগ হল, তখন জিনের প্রাকৃতিক নির্বাচন একটি এক-রৈখিক কার্যকারণ প্রক্রিয়ায় রুপান্তরিত হল। জিনই ফেনোটাইপ সৃষ্টি করে, ফেনোটাইপ জিনকে নিয়ন্ত্রণ করে না। সুতরাং, প্রাকৃতিক নির্বাচনের সাপেক্ষে জিনের পরিবর্তন “দৈব” ঘটনাই বটে।

আরেকভাবে বলা যায় যে জিনের পরিবর্তনগুলো জিনের বাহকের ইষ্টকর্মের কথা চিন্তা করে সাধিত হয় না। একটি সময়ে কোন নির্দিষ্ট কারণে অণুজীববিজ্ঞানের সূত্র মেনে চলে জিনে যেকোন পরিবর্তন ঘটতে পারে। এই পরিবর্তনের কারণে ফেনোটাইপে কোন পরিবেশবান্ধব পরিবর্তন ঘটতে পারে, আবার নাও ঘটতে পারে। একারণে পরিবেশের সাপেক্ষে পুরো প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়াটাই একটি “দৈব” প্রক্রিয়া, কারণ এই প্রক্রিয়া পরিবেশকে বিবেচনায় রেখে চালিত হয় না।

বিবর্তনের প্রক্রিয়াটা হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্রের মত প্রকৃতিগতভাবে(ontologically) দৈব না, এটি কিছু কিছু বিষয়ের সাপেক্ষে “দৈব”। অনেক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক মনে করেন যে সম্ভাবনা(probability) বস্তুজগতের ভবিষ্যবাচ্যতাকে অনেকটাই ধোঁয়াটে করে ফেলে। তত্ত্বীয়ভাবে একটি সিস্টেমের সম্ভাব্য কারণসমূহ সম্পর্কে যদি আপনার কাছে পরিপূর্ণ তথ্য থাকেও, তবুও আপনি খুব বেশি হলে একতি বস্তুর জন্য একটি বন্টন চিত্রাঙ্ক(distribution curve) আন্দাজ করতে পারবেন, কোন সুনির্দিষ্ট পরিণতিকে সন্দেহতাতীতভাবে প্রমাণ করতে পারবেন না। একে বলে propensity interpretation- বস্তুজগতে যেকোন বস্তু বিভিন্ন প্রকার আচরণ প্রদর্শন করতে পারে, একটি নির্দিষ্ট আচরণ প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। এটি সত্য কিনা তা বিবর্তনের সাথে মোটেই প্রাসঙ্গিক না। যদি এটি সত্য হয়েও থাকে, তবে সেটি সবার জন্যই প্রযোজ্য হবে- তা সেটা জীব হোক অথবা জড়ই হোক।

তথ্যসূত্র

১) ফ্রেড হয়েল, Evolution from Space, ১৯৮১। ফ্রয়েল এখানে অজৈবজনির মাধ্যমে প্রোটিন অণু সৃষ্টির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।

২) টি.ডি. লাইসেঙ্কো, অগাস্ট ৭ ১৯৪৮

৩) Sober E, The Nature of Selection, MIT Press (1985 reprint with amendments) 1984; “ডারউইনবাদ কি অনুলাপ?”, “নির্বাচনের একক কি?”, “প্রাকৃতিক নির্বাচন কি কোন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব” প্রভৃতি প্রসঙ্গে এই বইটি দাবি করে যে বিবর্তন তত্ত্বে নির্বাচন হল একটি অথবা একাধিক জীববৈজ্ঞানিক “বল”।

৪) Richards R J, Darwin and the Emergence of Evolutionary Theories of Mind and Behavior, U Chicago P 1987

৫) Cavalli-Sforza L L and M W Feldman। Cultural Transmission and Evolution: A quantitative approach। Princeton UP 1981

৬) Rindos D, The Origins of Agriculture: An evolutionary perspective, Academic Press 1984

৭) Hull D L, Science as a Process: An evolutionary account of the social and conceptual development of scienc্ U Chicago P 1988

৮) Plotkin H C, Darwin Machines and the Nature of Knowledge: Concerning adaptations, instinct and the evolution of intelligence Penguin 1994

৯) Ruse M ed What the Philosophy of Biology Is: Essays dedicated to David Hull Kluwer Academic Publishers 1989

১০) Gould S J “Betting on chance — and no fair peeking”, essay 29 in Eight Little Piggies, Norton 1993 (ref from Larry Moran)