অহল্যা দ্রৌপদী কুন্তি তারা মন্দাদরী
পঞ্চকন্যা স্মরে নিত্যং
মহাপাতক নাশনমঃ।

ছোটবেলায় এ লাইন কয়টি মুখস্ত করানো হয়েছিল সকালে পৌরাণিক সাহিত্যের এ পাঁচ চরিত্রের নাম নিয়ে পাপ তাপ বিনাশ করার জন্য।
কিছু চরিত্রের নাম নিলেও যে মহাপাপ স্খলন হয় তা আমাকে যে বয়োজ্যেষ্ঠরা শিখিয়েছেন তাদের কাছে উপরোক্ত চরিত্রগুলো দেবী, তবে তাদের নামে কোন লৌকিক পূজারও প্রচলন নেই। ধর্ম নিয়ে এত বিশ্লেষণী প্রয়োগ তাদের ছিল না। তারা উপরোক্ত চরিত্রদের শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করতেন। পূণ্যজ্ঞান করেই আমাদের তা শিখিয়েছেন আর সংস্কৃত শ্লোক মানেই তারা ভগবানের আরাধনা বুঝতেন।
আমি তখনও কোন এক কবির মত মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় লেখা ধর্ম গ্রন্থের সুরা বা মন্ত্র সম্বন্ধে ‘যা বুঝি না তা নিয়ে আমি স্বর্গেও যাব না” বলার মত অভিজ্ঞতা অর্জন করিনি।

কয়েকটি মন্ত্র বা সংস্কৃত শ্লোক প্রাত্যহিক কাজকর্মের বিভিন্ন সময়ে আওড়ে পূণ্য অর্জন হয়েছে ভেবে বড়রা মানসিক শান্তিতে সুস্থির থাকত। আমরা ছোটরা বিশেষ করে আমি অং তং বলে ভাবতাম ভগবান আমার বাংলা ভাষা না বুঝলেও আমি ভগবানের ভাষার কিছু তো জানি। তার ভাষা বুঝি। তাছাড়া মনে মনে খটকাও লাগত না যে এসব নারীদের স্মরণ করলে পাপমোচন হবে কি হবে না।

বড়বেলায় বুঝি চরিত্রগুলোকে শ্রদ্ধা করব কি না তা নির্ভর করে কীভাবে তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করছি। তবে তাদের নাম স্মরণে পূণ্য যে হবে না তা অনেক আগেই নিশ্চিত হয়েছি। যেমনঃ দ্রোপদীর ছিল পাঁচ স্বামী। এক দৃষ্টিতে দ্রৌপদী বহুগামী,অন্য দৃষ্টিতে ক্ষমতাময়ী নারী, অহংকার করার মত তার অবস্থান। অতি আধুনিক নারীও এমন যৌন স্বাধীনতা ভোগ করতে পারে না। মাতৃসুত্রীয় সমাজের ধারক নারী এবং বিপ্লবাত্মক উদাহরণ। কাজেই একজন নারীকে কে কীভাবে দেখছে এর উপর নির্ভর করছে নারীর অবস্থান।
এখনকার সমাজও নিজের স্বার্থে নারীর চরিত্রকে চিত্রণ করে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুইভাবেই। কখনও হনন করে, আবার কখনও তাকে দেবীর আসনে বসায়।
তবে এখন আমি এ পাঁচ নারীকে স্মরণ করি পাপমোচনের জন্য নয়, তাদের মত শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করার জন্য, শক্ত হওয়ার জন্য,পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পাপকে প্রতিরোধ করার জন্য, নারী হিসেবে নিজের অহংবোধকে ধারাল করার জন্য আর নারীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এ যাবৎ সংঘটিত অন্যায় ও অপরাধের প্রতিশোধ স্পৃহা অন্যের মধ্যে জাগিয়ে তোলার জন্য। তবে এ প্রতিশোধ ব্যক্তি পুরুষের বিরুদ্ধে নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোকে ভেঙ্গে প্রতিশোধ নেওয়ার স্পৃহা।

আমি রামায়ণ বা মহাভারতের নামী দামী বা উপাস্য নারী চরিত নয়, সংবাদ পত্রের পাতায় খবরে পরিণত হওয়া বাংলাদেশের আনাচে কানাচের নারীদের কথা বলব। তাদের জীবন ও মরণের চিত্র আঁকব। তাদের শিকারে পরিণত হওয়ার গাঁথা লিখব — যাতে পাঠকরা নারীর অবস্থানকে সঠিকভাবে ও সম্মানের সাথে বিশ্লেষণ করতে পারে।

এমনি একটি ঘটনার কথা গত ১ জুলাই, ২০১০ তারিখে দৈনিক ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক খবর থেকে জানা যায়—ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কলেজ পড়ুয়া এক তরুণী গতকাল বুধবার কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবে অভিযোগ করেছেন, কুষ্টিয়ার উত্তর মির্জাপুর গ্রামের বাবলু জোয়ার্দার নামে প্রভাবশালী এক ব্যক্তি কয়েক মাস আগে তাকে অপহরণের পর ধর্ষন করে। পরে তাকে বিয়ে করে। কিন্তু ঘরে নিচ্ছে না। এ নিয়ে মামলা করায় তাকে হত্যার হুমকি দিচ্ছে।
অভিযোগ আছে, ঐ তরুণী শৈলকুপা থানায় মামলা করতে গেলে প্রথমে পুলিশ গড়িমসি করে। পরে স্থানীয় সংসদ সদস্যের নির্দেশে গত ২৪ জুন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা নেয় শৈলকুপা থানা।
ছোট্ট এ খবরটি পত্রিকার পাতার এক কোণে ঠাঁই পেয়েছে। এতে অনেকের চোখও পড়বে না। চোখে পড়লেও হয়ত গুরুত্ব পাবে না। তবে আদালতে এ মামলা নিয়ে দিনের পর দিন চলবে বাদী বিবাদীর আনাগোনা ও টাকা-পয়সা খরচ।

নারীকে নিয়ে, নারীঘটিত এ ধরনের খবর পত্র-পত্রিকায় অহরহ প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়।
বাবলু জোয়ার্দার একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি। মেয়েটি নিজেই জানে সে কার দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। জেনে শুনে তবে বোধের সাথে না বুঝেই একজন ধর্ষককে বিয়ে করেছে। অথবা বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে।

আমাদের দেশে এমন ডজন ডজন উদাহরণ আছে, ধর্ষক ধর্ষণের শিকার নারীটিকে বিয়ে করে ফেলে আইনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে। ধর্ষক আইনের চোখে অপরাধী হলেও, নারীর উপলব্ধিতে ঘৃণিত হলেও, সমাজের কাছে লম্পট হলেও এ দেশের অগণিত নারীরা অপরাধীকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়।
এখানেও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।ধর্ষক বাবলু জোয়ার্দার স্ব্বামী হয়। যার পায়ের নীচে আবার তরুণীটির বেহেস্তও লুকিয়ে আছে বলে ধারণা রয়েছে। সেই অপরাধী পরিস্থিতি সামাল দিতে ধর্ষণের শিকার নারীটিকে বিয়ে করে ফেলে। উভয়েই সাময়িকভাবে স্বস্তি পায়। কিন্তু ধর্ষক যে ঘর করার জন্য বিয়ে করেনি তা শীঘ্রই প্রকাশ পায়। তখন নারীটি ধর্ষণের শিকার নারী হিসেবে ধর্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করার পরিবর্তে তথাকথিত স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী হিসেবে মামলা করে। নারী নিজে,পরিবার,সমাজ,এমনকি রাষ্ট পর্যন্ত নারীটিকে ধর্ষণের শিকার নারী পরিচয় থেকে একজন স্ত্রী পরিচয়ে নারীকে দেখতে চায়, যদিও এ ক্ষেত্রে নারীটির স্ত্রী পরিচয় মামলাটিকে দুর্বল করে রাখে।
এটি আসলে ধর্ষণের শিকার এক নারীর তথাকথিত সামাজিক অনুশাসনের চাকার নীচে পিষ্ট হওয়া থেকে বাঁচতে ধর্ষককে স্বামীর মর্যাদা দেওয়া। পুরুষটির সামাজিক অবস্থান ধর্ষক হিসেবে নড়বড়ে না হয়ে স্বামী হিসেবে সম্মানের হয়; তবে এতে কিন্তু নারীটির ভোগান্তি কমে না।