পূর্ববর্তী পর্বের পর…

বিশ

কুয়ান্টাম তত্ব এক অভিনব সংযোজন আধুনিক বিজ্ঞানে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় অনেক জটিল সমস্যার সহজ সমাধান দিয়ে ফেলছে, অথচ ভাবতে গেলে মাথা ঘুরে যায়। ধাঁধার ঘোর যেন কিছুতেই কাটতে চায় না। এ আবার কেমনতরো কথা যে বস্তুজগতের ছোটবড় সব জিনিসই আণবিক দৃষ্টিতে একই সাথে ভরযুক্ত কণা, এবং ভরমুক্ত তরঙ্গ? কণা নয তরঙ্গ নয়, আবার দুটিই, এ কিরকমের রসিকতারে বাবা। পুরাকালের গাঁজাখোর ভাড়দের আষাঢ়ে গল্পের মত মনে হয়না কি? প্রকৃতি কি একটা পর্যায়ে গিয়ে মদ্যপ মাতালের মত আবোলতাবোল আচরণ করতে শুরু করে? ম্যাক্স প্লাঙ্ক একটা শক্ত জট ভাঙ্গতে গিয়ে অনেকটা অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মত করে একটা বুদ্ধি দিয়ে গেলেন বিজ্ঞানীদের, তার সাথে সুর মিলিয়ে স্বয়ং আইনস্টাইন সাহেব দাঁড় করালেন এক জলজ্যান্ত বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্য, ব্যস, হয়ে গেল সেটা মূল্যবান নতুন তত্ব। অথচ মানুষের সাধারণ বুদ্ধি বারবার কাত হয়ে যায় এর কাছে, কিছুতেই ঢুকতে চায় না মাথায়। সাধে কি নিলস বোরের (১৮৮৫-১৯৬২) মত জাঁদরেল নোবেল বিজয়ী পদার্থবিদ বলেছিলেনঃ “ কেউ যদি বলে কুয়ান্টাম বিজ্ঞান তাকে ধাঁধায় ফেলেনি তাহলে আমি বলব সে কুয়ান্টাম তত্বের মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেনি” ? অর্থাত্‌ একটা প্রশ্নের সমাধান হতে না হতেই আরো অনেক প্রশ্ন মাথা তুলে দাঁড়ায়। আশু প্রশ্ন যেটা দাঁড়াল, সেটা হল, এই দ্বৈত রূপ বিশ্বজগতের, বস্তু একই সাথে ভরযুক্ত এবং ভরমুক্ত, এটা যদি সত্যি সত্যি বাস্তব প্রমাণিত হয়, তাহলে প্রকৃতি তা কিভাবে প্রকাশ করছে আমাদের কাছে? এর ভাষা কি?

 

পাঠক হয়ত এরি মাঝে ধরে ফেলেছেন কি হবে তার জবাব। সেই যে লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি বলেছিলেন পঞ্চদশ শতাব্দীতে, আর গ্যালিলি বলেছিলেন তার দু’শ বছর পর, যে প্রকৃতির ভাষা হল গণিত—বাইবেলের ভাষা যেমন ছিল ল্যাটিন, কোরানের আরবি, গোটা প্রকৃতির ভাষা হল গণিত। সেটা আইজ্যাক নিউটন প্রমাণ করেছিলেন তাঁর বলবিদ্যায়, ম্যাক্সওয়েল তাঁর তড়িত-চৌম্বিক তত্বে, আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিক তত্বে, তেমনি করে কুয়ান্টাম বিজ্ঞানের সেই অসম্ভব হেঁয়ালিতে ভরা শাস্ত্রেও গণিত এল বন্ধুর হাত বাড়িয়ে। এবং এই কাজটি সমাধা হল অস্ট্রিয়ার এক তীক্ষ্ণধী পদার্থবিদ, আরুইন শ্রেডিঙ্গার (১৮৮৭-১৯৬১)দ্বারা। তবে তাঁর কাজটিই ছিল সবচেয়ে দুরূহ, কারণ নিউটনের মত তাঁর হাতে বস্তুজগতের স্থূলপদার্থ ছিল না, ম্যাক্সওয়েলের মত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ঢেউ ছিল না বিদ্যুতের, ছিল না আইনস্টাইনের মত মহাবিশ্বের বিচিত্র সমাহার। তাঁর মস্ত সমস্যা ছিল বস্তু আর কণাকে একই কামরায় ভরে একটা যুগ্ম ভাষা তৈরি করা। সৌভাগ্যবশতঃ গণিত তখন অনেকখানিই এগিয়ে গেছে, কুয়ান্টাম বিজ্ঞানও ধাপে ধাপে অনেক নতুন তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছে। তাঁর হাতে ছিল উন্নততর অন্তরকলন (differential calculus) তত্ব, ছিল সম্ভাবনা শাস্ত্রের বিবিধ টুকিটাকি খবর। এ সবকিছুকে একসাথে জড় করে তিনি তৈরি করলেন এক অভিনব জিনিস, একটি দ্বিঘাতী অন্তরকলনী সমীকরণ (second order differential equation), অনেকটা নিউটনের মতই, তবে তার চেয়ে অনেক জটিল ও অনেক গভীর, যাতে নির্ভার সংখ্যা (independent variable)এক বা একাধিক, বড় কথা, সাশ্রিত রাশি (dependent variable)দৈর্ঘ্য বা গতির মত কোনও পরিমেয় বস্তু নয়, যা দেখা যায় না, শোনা যায়না, এমনকি পরীক্ষাগারে নি্যে মাপারও উপায় নেই। এই অদ্ভূত জিনিসটির নাম wave function। অথচ ঠিক ঢেউও নয় এটা। এর কোন দৈর্ঘ্যপ্রস্থ নেই, নেই কোনও কম্পাঙ্ক। এ সত্বেও শ্রেডিঙ্গারের সমীকরণ আধুনিক আণবিক বিজ্ঞানের মুখের বুলিতে পরিণত হয়েছে। গোটা কুয়ান্টাম তত্বের বিসমিল্লাতেই এই জিনিসটা দিয়ে পাঠ শুরু করা সম্ভব, এমনই এর শক্তি। এ হল আধুনিক কুয়ান্টাম তত্বের মূল স্তম্ভ।

 
কি এই রহস্যময় জিনিস, এই ওয়েভ ফাংশন, যা ১৯২৬ সালের কোনও এক মাহেন্দ্রক্ষণে আবির্ভূত হয়েছিল শ্রেডিঙ্গার সাহেবের কল্পনাতে, যা সাধারণ বুদ্ধিকে হার মানায়, প্রচলিত ধ্যানধারণাকে করে বিমূঢ়? বাস্তবজীবনের কোনও সাধারণ অভিজ্ঞতার আলোতে বিছিয়ে একে বোঝানোর সাধ্য অন্তত আমার নেই। তবু চেষ্টা করব একটা পরিচিত দৃশ্য টেনে আবছা ধারণা দিতে। ধরুণ আপনার বসার ঘরের টেবিল ফ্যানটি—গরমের দিনের বড় বন্ধু (আপনার না হলেও আমার, কারণ আমার বাড়িতে এসি নেই)। অচল অবস্থায় ফ্যানের ফলাটি ঠিক কি জ্যামিতিক অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা খুবই সহজ। এবার আঙ্গুল দিয়ে একটু ঘোরান ফলাটিকে। কি দেখতে পাবেন? ফলাটির জায়গা পরিবর্তন হল, কিন্তু তখনো আপনি এর অবস্থান বুঝতে পারছেন। এবার ফ্যানের সুইচ টিপে দিন। ফলার গতি বেড়ে গেল। তুমুল বেগে ঘুরছে ফলাটি, পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন। খালি চোখে ওটার কোন্‌ মুহূর্তে কি অবস্থান তা বোঝা একেবারেই সম্ভব হচ্ছে না আপনার। তবে অতি আধুনিক সূক্ষ্ণ বীক্ষ্ণণযন্ত্র দিয়ে দেখলে তার অবস্থান মাপা সম্ভব হলে হতেও পারে। কিন্তু মনে করুন পাখার গতি এতটাই বাড়িয়ে দেওয়া হল যে সেগতি সাধারণ সীমারেখা ডিঙ্গিয়ে একেবারে মাত্রাহীনতার পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তখন আপনার চামড়ার চোখে কি মনে হবে ফলাটিকে? মনে হবে ছোট একটুকরো মেঘ আপনার পাখার ভেতর আটকা পড়ে গেছে–পাখার ফলাটি আলাদা করে দেখবার কোনও উপায়ই থাকছেনা—শুধু দেখা যাচ্ছে কুয়াশার মত কিছু একটা। অর্থাত্‌ একটা বস্তু তার অবস্থানের পরিমেয়তা হারিয়ে অপরিমেয়তার কুজ্ঝটিকাতে পরিণত হয়ে গেল।

 

ওয়েভ ফাংশন ব্যাপারটিও অনেকটা তাই। সব পদার্থেরই অণুপরমাণু আছে, যার মধ্যে ঋণাত্নক তড়িত্‌কণা (electron)অন্যতম। এমনই প্রচণ্ড এর গতি যে কোন্‌ মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছে সে তা বলার সাধ্য মানুষ কেন, কোন যন্ত্রেরও নেই। তার চলার পথ(trajectory) বলে নির্দিষ্ট কিছু নেই—তার চলার পথ সেই পাখার ফলার মতই কেবল দলা দলা মেঘ সৃষ্টি করে চলে। শুধু বলা যায়ঃ ওই জায়গাটুকুর কোন এক বিন্দুতে কোনও এক বিশেষ মুহূর্তে তার থাকবার সম্ভাবনা আছে। শ্রেডিঙ্গারের ওয়েভ ফাংশন সেই সম্ভাবনারই একটা সংখ্যা দাঁড় করায় আমাদের সুবিধার জন্যে। ধরুণ জায়গাটুকুর ‘আয়তন’ dq, এবং তার কোন এক বিন্দুতে ওয়েভ ফাংশন হল f (dq) ঠিক আমাদের পরিচিত ত্রিমাত্রিক বিশ্বের সাধারণ ‘আয়তন’ নয়, তবে তার সঙ্গে তুলনীয়)। তাহলে f^(2)dq রাশিটি সেই সম্ভাবনার পরিমাপ দেয়। ওই সম্ভাবনা পর্যন্তই মানুষের দৌড়—এর বেশি কিছু জানবার সব দরজাই বন্ধ করে রেখেছে প্রকৃতি। অণুরাজ্যের রহস্যপুরী যে কত হাজার রকমের পাহারা দিয়ে সুরক্ষিত তা ভাবতে গেলে মাথা ঘুরে যায়। প্রকৃতি সেখানে দারুণ পর্দানশীন!

 

সৌভাগ্যবশতঃ বিজ্ঞানের জন্যে এই ‘সম্ভাবনা’র বাইরে বেশি কিছু জানবার প্রয়োজনও হয়না আমাদের। আগেকার সেই পরিসাংখ্যনিক বলবিদ্যার মতই—একটা দু’শ ফুট উঁচু দালানের একটি ক্ষুদ্র ইঁটের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুপরমাণুর নিরন্তর গতিপথের কোন্‌ জায়গায় কোন্‌ অণুটি রয়েছে ঠিক কোন মুহূর্তে সেটা জানবার যদি কোনও উপায়ও থাকত, তাহলে সেই তথ্য সংগ্রহ করে আপনি কি অসাধ্য সাধন করে ফেলতেন বলে মনে হয় আপনার? সেটা হাস্যকর এবং অবান্তর। তবে ‘বৃহত্‌’ বস্তুর জগতে গতি তেমন বেয়াড়ারকম নয় (শব্দগতিছাড়ানো দ্রুততম জেটের গতিও আলোর গতির ধারেকাছে নয়)বলে আমাদের নিউটন সাহেবের বলবিদ্যা দিয়েই বেশ সুখেশান্তিতে জীবন কেটে যায়। কিন্তু অণুজগতের কণারা আলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে—সেখানে নিউটনমশাই একেবারে অসহায়। সেখানে শ্রেডিঙ্গারপ্রদত্ত ‘সম্ভাবনা’ দিয়েই কাজ চালাতে হয়। সম্ভাবনার বৈজ্ঞানিক তাত্‌পর্যের কথা আগেও একবার উল্লেখ করেছি আমি—এটি কোনও স্বাপ্নিক কবির অলস কল্পনা নয়, প্রকৃতিরই একটি সূক্ষ্ণ প্রত্যঙ্গ।

 

‘সম্ভাবনা’, ‘অনিশ্চয়তা’, ‘অনির্দিষ্টতা’, এইসব আপাতনেতিবাচক শব্দগুলো অণুজগতের কুয়ান্টাম শাস্ত্রে প্রায় ডালভাতের মত, প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে আসে ওগুলো। কুয়ান্টামতত্বের একটি চমকলাগানো আবিষ্কার হল হাইসেনবার্গের ‘অনিশ্চয়তা’ সূত্র। অনিশ্চয়তা সাধারণত মরণশীল মানুষের মৌলিক অপারগতাকেই বোঝায়। কিন্তু জার্মানীর ভার্নার হাইসেনবার্গ(১৯০১-১৯৭৬) এক অকাট্য যুক্তি দাঁড় করালেন যার সারমর্ম হল যে এই অপারগতা শুধু মানুষের নয়, যন্ত্রেরও—বলতে গেলে এ অপারগতার উত্‌স প্রকৃতি নিজেই। এর নাম দেওয়া হয়েছে ‘অনিশ্চয়তাসূত্র’ (uncertainty principle)। এর বক্তব্য হল যে দুটি যুগ্ম জিনিস, যেমন অণুর আয়তানিক অবস্থান ও তার গতিবেগ, বা কাল( অর্থাত্‌ কতখানি সময় ব্যয়িত হয়েছে) ও তেজ, ওরকম দুটি জিনিস একই সাথে নিখুঁতভাবে মেপে নেওয়া (যা নিউটনীয় গতিবিজ্ঞানে সম্ভব) একেবারেই অসম্ভব, অসাধ্য, যত অত্যাধুনিক আর উন্নতমানের যন্ত্রই আপনি ব্যবহার করু্ণ না কেন। এই যুগ্ম যুগলের একটিকে সূক্ষ্ণভাবে মাপতে গেলে আরেকটি আপনা থেকেই ঝাপসা হয়ে যাবে। যেমন ধরুন একটা চলমান জিনিসের দৈর্ঘ মাপতে চাচ্ছেন আপনি, এবং একেবারে নির্ভুলভাবে। সেজন্যে আপনার যন্ত্রটিকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যে ওই একটি দিক ছাড়া আর সবদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখবে যন্ত্রটি। কিন্তু এই একনিবিষ্ট মনোযোগের অপরিহার্য পরিণাম হল যে অলক্ষ্যে সেই পরীক্ষমান বস্তুটির চলনাবস্থাতে সৃষ্টি হল কিঞ্চিত বিঘ্নতা। যার ফলে অবস্থানের সাথে গতিকেও নিখুঁতভাবে নিরুপণ করবার আশা অঙ্কুরেই নষ্ট হয়ে গেল। যতই সূক্ষ্ণ হতে চাইবেন একটিতে ততই বিঘ্নিত হবে আরেকটি। স্থূলবস্তুর জগতে এটা মোটেই লক্ষণীয় নয়, কিন্তু অণুপরমাণুদের জগতে, যেখানে চলমান হওয়া মানে আলোর কাছাকাছি গতিবেগে চলমান হওয়া বোঝায়, সেখানে সামান্য বিঘ্নতা মানেই অনেক। এটা যন্ত্রের দোষ নয়, প্রকৃতিরই নিজস্ব ধর্ম। সেই যে বললাম একটু আগে, ক্ষুদ্রকণার জগতে প্রকৃতি বড্ড বদমেজাজী—বাইরের কেউ সেখানে উঁকিঝুঁকি মারুক সেটা ওর মোটেও পছন্দ নয়। হাইসেনবার্গ সাহেব শুধু খারাপ খবর দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, সেই অনিশ্চয়তার পরিমাণ কতখানি সেটাও অঙ্ক কষে বের করে গেছেন। দুটি বীক্ষিত বস্তুর নিরুপিত পরিমানের গুণফলের অনিবার্য অনিশ্চয়তা অন্ততপক্ষে একটি সুনির্দিষ্ট সংখ্যা, কিম্বা তারও বেশি। সেই সংখ্যাটি পদার্থবিজ্ঞানে প্লাঙ্কের পরমাঙ্ক নামে পরিচিত (Planck’s constant), এবং একটি নিত্যব্যবহৃত সংখ্যা। অর্থাত্‌ প্রকৃতি ওখানেই পাহারা বসিয়ে রেখেছে। এই ব্যুহ ভাঙ্গতে যাওয়ার পরিণতি খুব ভাল নয়। অথবা অবিশ্বাস্যরকম ভাল, নির্ভর করে আপনি কোনদিক থেকে দেখছেন। পরিণতির অকুস্থানে আবির্ভূত হয় আমাদের সেই অতিপরিচিত বন্ধু, বা শত্রু ( যে যেভাবে দেখে সেটাকে)—শূন্য। সেখানে অবাস্তব বাস্তবের মূর্তিতে আত্নপ্রকাশ করে, অবিশ্বাস্য আসে বিশ্বস্ত বন্ধুরুপে। শূন্য খামার থেকে সীমাহীন সম্ভার আহরণ বা হরণ করার মত। বিজ্ঞানে একে বলা হয় Zero-point energy , যার ভাবার্থ হল উত্‌সবিহীন জ্বালানি উত্‌পাদন!

 

পাঠক সম্ভবত সন্দিহান হয়ে উঠতে শুরু করেছেন — লোকটার মাথা ঠিক আছে তো? গাঁজা টাজা টেনে আসেনি তো ? না ভাই, গাঁজা টানিনি। একেবারে কেতাবের কথা—ঐহী কেতাব নয়, বৈজ্ঞানিক কেতাব। অণুবিজ্ঞানীরা তড়িতকণার ভর কিন্তু দাড়িপাল্লার মাপ অনুযায়ী কত আউন্স কত মিলিগ্রাম সে-হিসেবে বিচার করেন না, তারা মাপেন ভরসম শক্তির এককে। যেমন একটি তড়িতকণার ভরকে বলা হয় 0.511 million volts. যেন এটা কোনও বৈদ্যুতিক শক্তি উত্‌পাদনকেন্দ্রের (power station) সম্বন্ধে বলা হচ্ছে। এর মূলে আছে আইনস্টাইনের সেই সূত্রটিঃ E=mc^(2). কণা যদি ঠায় দাঁড়িয়েও থাকে তাহলেও তার ভরজাত শক্তি লোপ পায়না, একটা সুপ্ত সম্ভাবনা থেকেই যায় তাকে ওই পরিমাণ শক্তিতে রূপান্তরিত করা।

 

কল্পনা করুণ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আয়তনবিশিষ্ট একটি আধার যার পরিবর্তনীয় আয়তন কমাতে কমাতে এতটাই কমিয়ে ফেললেন যে তাতে একটা কি দুটোর বেশি ইলেক্ট্রন থাকা সম্ভব নয়। অর্থাত্‌ কার্যত শূন্য আয়তন। সেখানে যে ইলেট্রনটি আটকা পড়ে আছে তার ত্রিমাত্রিক অবস্থান অতি সূক্ষ্ণভাবেই জানা হয়ে গেল আপনার। কিন্তু হাইসেনবার্গের সূত্র অনুযায়ী ওটির তেজ বা শক্তিটি চলে গেল একেবারে আসমানে। একটাকে নিখুঁত করতে গিয়ে আরেকটা অনিশ্চয়তা সীমানার বাইরে। অনিশ্চয়তা নীতির পরিণামই এই যে এমন একটা শূন্যাবস্থা দাঁড়ায় একসময় যে কণা সেখানে থাক বা না থাক তেজ থেকে যায়, এবং একরকম গায়েবী কণা সৃষ্টি হয়( virtual particles), যারা অস্তিত্বের ভেতরে বাইরে ক্রমাগত আসা-যাওয়া করতে থাকে, অনেকটা আঁধার বনের জোনাকিরা যেমন মুহূর্তে মুহূর্তে জ্বলা-নেভা করে। এ থেকে উত্‌পন্ন শক্তি, অন্তত তাত্বিকভাবে উত্‌পন্ন শক্তি, সেটা মোটেও গায়েবী নয়—সে-শক্তি যে পদার্থের মধ্যেই গুদামজাত হয়ে আছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, যাকে বলে মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন, এ-শক্তিকে বাস্তবে কাজে লাগানোর কোনও উপায় আছে কিনা। বর্তমান যুগের তেলসংকটে এ এক জরুরি প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজব এই অণুজগত—হাওয়া ( হাওয়া বলতে আমি এখানে বায়ু বুঝাচ্ছি না) থেকে জ্বালানিপ্রাপ্তি। আমাদের অভাগা দেশটির বড় উপকার হতে পারত।

একুশ

আগের অধ্যায়ে আমরা দেখলাম ‘শূন্য’ এবং তার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ‘অসীম’, কেমন অবিশ্বাস্য উপায়ে দর্শন দেয় ক্ষুদ্রকণার জগতে। এবার সেই একই দৃশ্য দেখব বৃহতের বিশ্বে। এবং অত্যন্ত ভয়াবহ মূর্তিতে। ‘শূন্য’ কিভাবে আমাদের মহাবিশ্বের গোটা অস্তিত্বকেই শূন্যতে নামিয়ে আনার ক্ষমতা ধারণ করে তারই দুয়েকটি উদাহরণ দেব।

 

পদার্থবিজ্ঞানের এইসব বিস্ময়কর নাট্যচিত্রের সূত্র বলতে গেলে একই জায়গাতে। কুয়ান্টাম শাস্ত্রে দেখেছি আলোর দ্বৈত ভূমিকা—কখনো কণা, কখনো ঢেউ—যা সাধারণ মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। এখন আমরা প্রবেশ করব প্রকৃতির আরেকটি গুপ্তকক্ষে—যেখানে আলো বলতে গেলে সর্বেসর্বা, সে তার নিজের আইন ছাড়া আর কোন আইন মেনে চলতে নারাজ।

 

‘আপেক্ষিক তত্বের’ নাম শোনেনি এমন কোনও ছাত্র/ছাত্রী পৃথিবীর কোথাও পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এদের যে-কাউকে জিজ্ঞেস করুণ এ-তত্বের জনক কে। তারা সমস্বরে জবাব দেবেঃ আলবার্ট আইনস্টাইন। কিন্তু খুব কম লোকই পাওয়া যাবে, বাচ্চা বুড়ো যে’ই হোক, যে এটুকু খবর রাখে যে কথাটি আংশিকভাবে সত্য, সর্বাংশে নয়। আপেক্ষিক তত্বের একটা প্রাথমিক কাঠামো দাঁড় করিয়েছিলেন, আইনস্টাইনের ২৫০ বছর আগে, স্বয়ং গ্যালিলিও গ্যালিলি। তাঁর সময়কালে এটা জানা ছিল না যে আলোর গতিবেগ সীমাহীন নয়, যে সেকেণ্ডে ৩০০,০০০কিলোমিটারের বেশি বেগে চলবার শক্তি তার নেই। ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়স্ক কিশোর আইনস্টাইনের তা জানা ছিল। গ্যালিলির আপেক্ষিক তত্বও তাঁর মোটামুটি জানা। এর সারমর্ম হল যে দুজন মানুষ যদি একই গতিতে, এবং কোনরকম অদলবদল না ঘটিয়ে, সমান্তরাল পথে চলতে থাকে, তাহলে তারা যে আদৌ চলছে সেটা অন্তত তাদের নিজেদের কাছে প্রতীয়মান হবেনা। অর্থাত্‌ ত্বরণহীন গতির অস্তিত্ব আছে কি নেই তা নির্ভর করে পর্যবেক্ষকের নিজের অবস্থানের ওপর—সে দাঁড়ানো অবস্থায়, না চলমান অবস্থায়। নদীর তীরেতে বসা একটি মানুষ হয়ত দেখছে একটা লঞ্চ ঘন্টায় ১০ মাইল বেগে চলে গেল তার সামনে দিয়ে। সেই একই লঞ্চের চলা যদি সে দেখত সাইকেলে করে, এবং সাইকেলের গতি হত ঘন্টায় ৫ মাইল, তাহলে তার দৃষ্টিকোন থেকে লঞ্চের গতি হত ২০ মাইল অথবা ৫ মাইল (বিপরীত দিকে না একই দিকে, সে অনুযায়ী)। অর্থাত্‌ পরম বা ধ্রুব গতি বলে সংসারে কিছু নেই—সবই আপেক্ষিক। নির্ভর করে যে-লোকটা বা যে যন্ত্রটি গতি মাপছে তার নিজের গতিটা কি, পরস্পরের পরিপ্রেক্ষিতে।

 

ষোল বছরের জার্মান বালকের ভাল করেই জানা ছিল গ্যালিলির বিজ্ঞান। তাঁর এও জানা ছিল যে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটেনের ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তড়িতচৌম্বিক তত্বের (eletromagnetic theory) আইনকানুন সব লিপিবদ্ধ করে রেখেছিলেন, যার একটি মৌলিক কথা ছিল এই যে আলো চলে প্রতি সেকেণ্ডে ২৯৯,৭৯২,৪৫৮ মিটার। এ তথ্যের সঙ্গে গ্যালিলির আপেক্ষিক তত্ব মেলাতে গিয়ে প্রশ্ন ওঠেঃ এই সীমিত সংখ্যাটি, এটা কিসের পরিপ্রেক্ষিতে? আলোর গতিমাপন যন্ত্রটি কি স্থিত অবস্থায় না গতিশীল? ‘স্থিত’ অবস্থাই বা কি জিনিস? ‘স্থিত’—কার দৃষ্টিতে? ‘গতিশীল’ই বা কি? এই প্রশ্নের সমাধান পেলেন বিজ্ঞানীরা ‘ইথর’ (ether) নামক একটি অদৃশ্য মাধ্যমের অস্তিত্ব কল্পনা করে। তাঁরা ধরে নিলেন যে এই একটিমাত্র বস্তু ইহসংসারে যা একেবারে অনড়, চিরস্থির ও চির বিদ্যমান। তড়িতচৌম্বিক তরঙ্গ এই মাধ্যমের মধ্য দিয়েই চলাচল করে, যেমন করে শব্দতরঙ্গ চলাচল করে বায়ুমাধ্যমে। সবকিছুরই একটা বাহন দরকার, তাই না? এই বিশ্বাসটি এমনই আঁট করে আশ্রয় নিল বিজ্ঞানীদের মনে যে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়াংশটির অনেকটাই তাঁরা ব্যয় করলেন ইথরের সন্ধানে। আবিষ্কার করলেন বিবিধ যন্ত্রপাতি–ইথরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্যে।

 

আমাদের ষোল বছরের বালক একটি কাল্পনিক পরীক্ষাগার নির্মাণ করলেন নিজের মনে। আচ্ছা, আমি যদি একটা আয়না হাতে করে আকাশপথে উড়ে যেতে পারতাম আলোর বেগে তাহলে আমি কি দেখতাম আয়নাতে? আমার চোখ থেকে আলোকরশ্মি যাবে আয়নার দিকে, এবং সেটা আবার ফিরে আসবে আমার কাছে—তাহলেই তো আমার ছবি দেখতে পাব আয়নাতে, তাই না? কিন্তু গ্যালিলির আইনানুযায়ী আলো তো আমার চোখ থেকে বেরই হবে না, কারণ আলো আর আমার তো একই গতি এবং একই দিকে। তাহলে আলো চোখ থেকে বেরিয়ে আবার ফিরে আসবে আমার কাছে, তা তো কখনোই হতে পারেনা। তাহলে দুটোর একটিকে ভুল হতে হবে—হয় গ্যালিলি ভুল নয় ইথরের অস্তিত্ব। কিন্তু গ্যালিলিসূত্রের সত্যতা বহুবার প্রমাণিত হয়েছে, সুতরাং ইথর বলে আসলে কিছু নেই। এই অসাধারণ একটি সিদ্ধান্তে তিনি পৌঁছুলেন কেবলমাত্র একটি মানসিক কল্পচিত্র(thought experiment) দাঁড় করিয়ে।

 

সেসময় তাঁর জানা ছিল না যে ১৮৮৭ সালে আমেরিকার দুজন পদার্থবিজ্ঞানী আলবার্ট মাইকেলসন (১৮৫২-১৯৩১, পদার্থবিজ্ঞানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম নোবেলবিজয়ী)ও তাঁর সহকর্মী রসায়নবিদ এডওয়ার্ড মোর্লি( ১৮৩৮-১৯২৩), যন্ত্রপাতির সাহায্যেই, দীর্ঘ সাত বছর ধরে বহু পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে ঠিক একই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। এই আবিষ্কার চিরকালের জন্যে ইথরবিতর্কের যবনিকা টেনে দেয়।
কিন্তু আইনস্টাইন সেখানেই থেমে গেলেন না। ঠিক আছে, ইথর নেই, আলোর গতিতে চললে নিজের মুখ দেখতে পারবনা আয়নাতে, কিন্তু তার সঙ্গে প্রকৃতির কি সম্পর্ক? সম্পর্ক আছে বইকি। মাইকেলসন-মোর্লির আবিষ্কার থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেল যে আলো মহাশয় গ্যালিলি সাহেবকে খুব একটা সম্মান করেন না—সে তার নিজের নিয়ম ছাড়া আর কারো আইনের তোয়াক্কা করে না। সব গতির সেরা গতি হল আলোর—ওটা কোনও মাধ্যম টাধ্যমের ধার ধারে না, ঠিক একই গতিতে চলবে, যতক্ষণ না বড়রকমের কোন বাধা সৃষ্টি করা হয় তার চলার পথে।

কিন্তু তাই বা হয় কি করে? তাহলে তো শুধু ইথরের অস্তিত্বই সন্দেহের মুখে পড়ে না, গ্যালিলির আপেক্ষিক সূত্রও সন্দেহাতীত থাকে না। অনেক ভাবলেন আইনস্টাইন এই সমস্যা নিয়ে। একদিকে গ্যালিলি বলছেন সব গতিই আপেক্ষিক, নির্ভর করে দর্শকের নিজের গতির ওপর, আরেকদিকে শূন্যতার পরিবেশে আলোর গতি অপরিবর্তনশীল—দুটিকে তো আপাতবিরোধী বলে মনে হয়। ইথরকে বর্জন করাতে কোন বেগ পেতে হলনা, কারণ অস্তিত্ব কখনোই প্রমানিত হয়নি, কিন্তু গ্যালিলি কি করে ভুল হয়? তবে হ্যাঁ তাঁর বিজ্ঞানে আলোকে কিন্তু ধরা হয়েছে এমন এক জিনিস যার গতির কোনও মাত্রা নেই, কার্যত অসীম। সেটা হয়ত সত্য ছিল সপ্তদশ শতাব্দীতে যখন তড়িতচৌম্বিক তরঙ্গ সম্বন্ধে মানুষের কোনও স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কিন্তু ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েলের পর জানাজানি হয়ে গেছে যে আসলে তা নয়, আলোর গতি মাত্রাহীন নয়।

এসব মানসিক যুক্তিতর্কের প্রেক্ষিতে তরুণ আইনস্টাইন সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে সমস্যাটা আলোতে নয়, গ্যালিলিতে নয়, সমস্যাটি বিজ্ঞানের মৌলিক ধ্যানধারনাতে। স্পেস বা ব্যাপ্তি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি ত্রিমাত্রিক একটা বিষয়—উত্তর-দক্ষিণ, পূর্ব-পশ্চিম, উপর -নিচ। এগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপরিচিত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, আমাদের সহজ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতায় লিপ্ত মাত্রা। এই তিন মাত্রাকে ধরে নিয়েই আমরা দুটি বিন্দুর দূরত্ব নিরূপন করি পাইথাগোরাসের সূত্র ব্যবহার করে। আইনস্টাইন ঘোষণা করলেন যে দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ পর্যায়ে তা গ্রহনযোগ্য হলেও উর্ধগতি (অর্থাত্‌ আলোর গতির সঙ্গে তুলনীয়) বস্তুর বেলায় সে নিয়ম চলবেনা— চতুর্থ একটি মাত্রা যোগ করতে হবে, সময়, যা দৈর্ঘপ্রস্থের মতই একটি পরিবর্তনশীল জিনিস, এবং এমনই একটি নিয়মে চলে যাতে করে আলোর গতিটা যেমন ছিল তেমনই থাকে, দর্শকের গতি যা’ই হোক। আলোর গতি যদি c হয় প্রতি সেকেণ্ডে তাহলে t সেকেণ্ডে তা অতিক্রম করবে ct দূরত্ব, সুতরাং পাইথাগোরাসের সূত্র ব্যবহারের সময় এই দূরত্বটিকেও গোনার মধ্যে রাখতে হবে। প্রকৃতি, স্থানকাল ব্যাপ্তি নিয়ে এই যে অভূতপূর্ব এবং অভিনব চিন্তাধারা নিয়ে এলেন আধুনিক বিজ্ঞানে ২৫ বছরের যুবক আইনস্টাইন, এই ছিল তাঁর ১৯০৫ সালের দ্বিতীয় যুগান্তকারী কীর্তি। এই অসাধারণ আবিষ্কার বিশ্বজগতকে কাঁপিয়ে তুলেছিল সেসময়। সমস্ত প্রথাগত ধ্যানধারণা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মূলে করেছিল নির্মম কুঠারাঘাত। শুধু বিজ্ঞান নয়, অচিরেই তা শিল্পকলা, সাহিত্য, স্থাপত্য, চিকিত্‌সা, সর্বক্ষেত্রেই তার প্রভাব বিস্তার হতে থাকে। বিজ্ঞানজগতে এর চেয়ে বৈপ্লবিক ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি, পরে কখনও ঘটবে কিনা কেউ বলতে পারেনা।
আইনস্টাইনের মৌলিক উদ্ভাবনের বড় স্তম্ভ হল এই চতুর্মাত্রিক বিশ্বের আইডিয়াটি। শুধু স্পেস (space) বললে হবেনা, বলতে হবে স্পেস-টাইম (spacetime)। অনভ্যস্ত চিন্তায় এর ছবি আঁকা সহজ না হলেও এটাই সত্য—গতির সাথে স্থূল দূরত্ব যেমন বদলায়, সময়ের দূরত্বও বদলায়, অর্থাত্‌ ঘড়ি সেখানে ঠিক একইভাবে ঘোরে না—যত বেশি গতি ততই ঘড়ির কাঁটায় আসে শিথিলতা। আইনস্টাইনের বিখ্যাত যমজধন্ধটি (twin paradox) এখানে নিশ্চয়ই উল্লেখের দাবি রাখে। এ’ও তাঁর একটি কল্পচিত্র—সেই আয়না হাতে শুন্যভ্রমণের মতন। দুটি যমজ ভাইএর একজন চলে গেলেন শুন্যযানে করে মহাকাশের দূর দূর জায়গায় এবং আলোর নয় দশমাংশ গতিতে। দ্বিতীয় ভাইটি থেকে গেলেন মরজগতের সাংসারিক জীবনে। শূন্যচারী ভাইটি তাঁর ঘড়ি অনুযায়ী পাকা বিশ বছর পর ফিরে এলেন মর্ত্যভূমিতে। ওমা, সেকি! অবাক অবাক! তাঁর যমজ ভাইটির বয়স এগিয়ে গেছে ২০ নয়, ৪৬ বছর! একই সময় জন্মলাভ করা সত্বেও ওই ভাইটির বয়স এখন তাঁর চেয়ে ২৬ বছর বেশি! তাজ্জব ব্যাপার। সত্যি কি তাই ঘটে? না, ঘটে না। তার একটি কারণ হল যে গতির সাথে শুধু যে ঘড়ির কাঁটা ঢিলে হয়ে যায় তাই নয়, দৈর্ঘ্য, ভর, এগুলোও আমূল বদলে যায়। যেমন, আলোর ৪/৫ গতিতে ১ মিটার দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট কাঠির আপাতদৈর্ঘ্য দাঁড়াবে ৩/৫ মিটার—অর্থাত্‌ সেটা কুঁচকে যাবে। অন্যদিকে ১ পাউণ্ড ওজনের একটা চিনির ঠোঙ্গা সেই একই স্পেসশীপে মাপলে দাঁড়াবে ৫/৩ পাউণ্ডে। সুতরাং ভাবনেন না যে আপনি চিরযৌবন প্রাপ্তির লোভে শূন্যযানে করে আলোর গতিতে ভ্রমণ করে একদিকে সময়কে হার মানাবেন, আরেকদিকে দূরত্ব কমাবেন—উঁহু, প্রকৃতিদেবী তাঁর নিরাপত্তার ব্যবস্থা বেশ পাকাপোক্তভাবেই করে রেখেছেন। দূরত্ব কমাতে গিয়ে আপনার ওজন এতটাই বেড়ে যাবে যে এক ইঞ্চি দূরকেই আপনার মনে হবে লক্ষ কোটি মাইল দূরে। তারপর যদি সত্যি সত্যি আপনি আলোর গতির সমান মাত্রায় পৌঁছে যেতে পারেন কোনক্রমে, তাহলে দূরত্ব হবে শূন্য, এদিকে আপনার ওজনও হবে অসীম। বাহ, কেমন দশা হল বলুন দেখি! তার অর্থ আপনি প্রকৃতির চোখে ধূলো দিয়ে নিজের খেয়ালখুশি মত যাচ্ছেতাই আদায় করে নেবেন সেটি হবার নয়। যেখানে যেখানে পাহারা বসাবার সেখানে বসানো হয়েছে ঠিকই।
তবে কি জানেন, এই শূন্য জিনিসটি যেন একটা লজ্জাশরমশূন্য বেহায়া চরিত্র যে হেরেও হারবে না, ঘায়েল হয়েও কাত হবে না। এপর্যন্ত আমরা শুধু আইনস্টাইনের বিশেষ তত্বের (special theory of relativity) কথাই বললাম, যেখানে গতি বলতে কেবল ত্বরণবিহীন গতির( constant velocity) কথাই বলা হল। কিন্তু গতি তো স্থির থাকে না সাধারণত। বাস্তবজীবনে এমন কোনও উদাহরণ কি পাওয়া যাবে যেখানে একটা বস্তু চিরকাল ঠিক একই বেগে একই সরলরেখাতে চলমান থাকে? আপনি গাড়িতে স্টার্ট দেবার সঙ্গে সঙ্গেই তো গতি বদল হয়ে ত্বরণ এসে গেল। সুতরাং স্থির গতির চেয়ে বরং ত্বরণই বেশি স্বাভাবিক।

 

অবশ্য আইনস্টাইন যে ত্বরণের প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন ১৯১৫ সালে, সেটা আরো মৌলিক, এবং সেটা প্রকৃতির আপন সত্তার মধ্যেই নিবিড়ভাবে জড়িত—এই ত্বরণের উত্‌স হল বস্তুজগতের নিহিত অভিকর্ষ শক্তি। এই শক্তির উপস্থিতিকে আলোচনায় রেখে আইনস্টাইন সূচনা করলেন এক ব্যাপকতর আপেক্ষিক তত্ব (general relativity), যার প্রধান উপাদান হল অভিকর্ষ শক্তি। এই মহাবৈশ্বিক শক্তির কারণে ত্বরণ ঘটে বস্তুতে, এমনকি যার প্রভাব থেকে আলো নিজেও মুক্ত নয়।

বাইশ

পত্রপত্রিকায় মাঝেমাঝেই খবর বেরোয় যে একটা নতুন তারা আবিষ্কার হয়েছে পৃথিবীর কোন-না-কোনও জায়গায়। আমাদের মত সাধারণ মানুষদের তখন ধারণা হয় যে তারাটি নতুন বলেই দেখা গেছে আকাশে। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং অতি পুরাতন বলেই দেখা গেল এতকাল পর। ব্যাপারটি হল এই যে নক্ষত্রটি এতই দূরে, এত অবিশ্বাস্যরকম দূরে, যে সৃষ্টির আদিতেই হয়ত তার জন্ম হয়েছিল, কিন্তু তার আলোটা ভূপৃষ্ঠে এসে পৌঁছুতে এতটা সময় লেগে গেল। আলোর গতি অসীম হলে তা হত না, গোড়া থেকেই দেখা যেত। জোতির্বিজ্ঞানীরা তাই নক্ষত্রাদির দূরত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মাপকাঠি ব্যবহার করেন না, করেন আলোকবর্ষের একক। আলোকবর্ষ মানে একবছরে আলো কতটা পথ অতিক্রম করতে পারে সেকেণ্ডে ৩০০,০০০ কিঃ বেগে, সেই দূরত্বটি। একদিনে যদি ৮৬,৪০০ সেকেণ্ড হয় এবং ৩৬৫ দিনে এক বছর, তাহলে এক আলোকবর্ষ মানে কতটা দূরত্ব, সেটা একটা সহজ অঙ্ক করলেই পাওয়া যাবে।
জোতির্বিজ্ঞানীরা যখন তাঁদের যন্ত্রপাতি নিয়ে দূর আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করেন পুরনো কোনও গ্রহনক্ষত্রের খোঁজে তখন যে তারাটি তাঁদের বীক্ষণযন্ত্রে ধরা দেয় সেটি ঠিক কোন বিন্দু থেকে এল সেটা তাঁরা জানবেন কি করে? আমরা যারা বিজ্ঞানে নেহাতই আনাড়ি তারা ভাবব, কেন, দিক তো একটাই—আলোটা যেদিক থেকে এল সেদিকে। সেখানেই হল চোখের ফাঁকি। সেটা সত্য যদি ওই তারা এবং আপনার চোখের মাঝে কোনও বড় ভরবিশিষ্ট নক্ষত্র, গ্রহ বা নক্ষত্রপুঞ্জ অবস্থিত না থাকে। সাধারণত অতি দূর থেকে আগত আলোকরশ্মি আপনার দৃষ্টির গোচরিভূত হবার পথে বহু বহু নক্ষত্রাদির পাশ কাটিয়ে আসতে হয়। আইনস্টাইনের বিশেষ তত্বে কোনও বিশেষ নির্দেশনা নেই সেক্ষেত্রে রশ্মিটির কি আচরণ হবে। অনেক ভাবনাচিন্তার পর আইনস্টাইন সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে আলোকরশ্মিও অভিকর্ষের প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। অর্থাত্‌ ভারি বস্তুর অভিকর্ষবলয়ের মধ্যে এসে গেলে অন্যান্য বস্তুর মত আলোও আকৃষ্ট হবে সেই ভারি বস্তুর প্রতি—মানে আলো তখন সরলরেখা থেকে বিচ্যুত হয়ে বাঁকা পথ নেবে। কতটা বাঁকা সেটা নির্ভর করে কত শক্তিশালী সেই আকর্ষণ, অর্থাত্‌ কতটা ভর সেই নক্ষত্রের। ১৯১৫ সালে আইনস্টাইনঘোষিত ‘সাধারণ আপেক্ষিক তত্বের’ এটি ছিল অন্যতম স্তম্ভ, যা আর কোনও বিজ্ঞানীর কল্পনায় ঢোকেনি আগে, যা সাধারণ বুদ্ধিকে বিচলিত করে, আলোর চিরপরিচিত আচার আচরণের আপাতবিরোধী, যা ইউক্লিডের জ্যামিতিকে অমান্য করার আভাস দেয়। আলো সরল রেখাতে চলবে না, সে আবার কেমন কথা? ছেলেমেয়েরা এতদিন যা শিখে এল বিশ্ববিদ্যালয়ের অপ্টিক্স ক্লাসে, সবই কি মিথ্যা? না, সব মিথ্যা নয়, আইনস্টাইন তা বলেন নি, তবে গ্রহতারাদের জগতে তার কিঞ্চিত্‌ সংশোধন দরকার, এটাই ছিল তাঁর বক্তব্য। বলা বাহুল্য সেসময় লোকে খুব একটা গুরত্ব দেয়নি তাঁর সাধারণ তত্বকে। এমন মনোভাব নিয়ে বসেছিলেন সবাই যে, ঠিক আছে, একটা চমকদার কথা শোনা গেল, কিন্তু এর প্রমাণ কি? আলো যে বাঁকে সেটা কেউ চোখে দেখেছে?

 

এই ‘চোখে দেখার’ কাজটি সমাধা করলেন ব্রিটেনের স্যার আর্থার এডিংটন (১৮৮২-১৯৪৪)। ১৯১৯ সালে এক সূর্যগ্রহণকালে গৃহীত পরীক্ষাতে তিনি দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলেন যে বৃহদাকার নক্ষত্রের ধার দিয়ে যাবার সময় আলোকরশ্মি সত্যি সত্যি খানিক বাঁকা হয়ে যাচ্ছে । অবশ্য সামান্য বক্রতা যে ঘটবে সে আভাস নিউটন নিজেও দিয়েছিলেন তাঁর অভিকর্ষ তত্বের বরাতে, কিন্তু তাঁর প্রদত্ত সংখ্যার সাথে এডিংটন সাহেব যে সংখ্যাটি পেয়েছিলেন তার সঙ্গে ততটা খাপ খায়নি যতটা খেয়েছিল আইনস্টাইনের দেওয়া সংখ্যার সঙ্গে। তখন আর কোনও সশংয় থাকে না বিজ্ঞানজগতে যে আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিক বা অভিকর্ষ তত্ব এক অসাধারণ কল্পনাশক্তিসম্পন্ন তরুণ বিজ্ঞানীর দুঃসাহসী কল্পনা শুধু নয়, নিরেট বাস্তব। এতে যেন কেউ ভেবে না বসেন যে আইনস্টাইন নিউটনকে ভুল প্রমাণিত করেছিলেন—বেশ কিছু শিক্ষিত লোকও সে ধারণা পোষণ করেন, সেটা আমি জানি। তিনি নিউটনতত্বের সীমানা একটু বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, এই যা। যেখানে নিঊটনের চোখ যায়নি সেখানে আইনস্টাইনের গিয়েছিল। তবে এটাও যেন কেউ ভুলে না যান যে দুজনের মাঝে প্রায় দু’শ বছরের তফাত। আইনস্টাইন জানতেন নিউটনের কাজ, এবং জানতেন বলেই মহাবিশ্বের নানা অজানা দিগন্তে তাঁর মানসচক্ষুর সন্ধানী দৃষ্টি পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন।
আইনস্টাইনের সাধারণ তত্বের গুণগান করেছেন বিংশ শতাব্দীর বহু খ্যাতনামা বিজ্ঞানী। অনেকে এও বলেছেন যে নিছক নান্দনিকতার বিচারে এর চেয়ে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যময় সৃষ্টি সম্ভবত আর নেই বিজ্ঞানে। এ হল পদার্থবিজ্ঞানের ‘মোনালিসা’—অন্তত আমার নিজের বিচারে–যতই তাকাবেন ততই সে টেনে নেবে আপনার কাছে, ততই ছড়াবে তার মায়াজাল।

 

আইনস্টাইন তাঁর বিশেষ ও সাধারণ তত্বের মৌলিক আইডিয়াগুলোকে একত্র করে মহাবিশ্বের (universe) একটা মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন যা একটি চতুর্মাত্রিক স্পেস-টাইমে অবস্থিত একটি রাবারের বলের মত। বড় বড় নক্ষত্রগুলো, যাদের এতটাই ভর (mass) যে আলোরেখা ওদের কাছ দিয়ে চলার সময় খানিক বক্রতা লাভ করে, যার ফলে তারা সেই রাবারের গায়ে একটা টোলের মত জ্যামিতিক আকার সৃষ্টি করে—ছোট বাচ্চাদের গালের চামড়াতে যেমন করে টোল পড়তে দেখা যায়, বিশেষ করে হাসির সময়। আইনস্টাইনের অভিকর্ষ তত্বের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল ত্ত্বরণ ও অভিকর্ষণের সমতুল্যায়ন (equivalence principle)—-যেমন ধরুণ একটা শূন্যযান যদি ভ্রমন করতে গিয়ে যাত্রীরা যদি হঠাত্‌ একটা ধাক্কা বোধ করেন গায়ে ( এবং সেখানে বায়ুচাপ প্রায় নেই বললেই চলে যার কারণে আকস্মিক ঘূর্ণিবাত্যা হবে) তাহলে সেটা কোন যান্ত্রিক গোলযোগসংক্রান্ত ত্বরণ, না, কোনও নিকটবর্তী নক্ষত্রের অভিকর্ষ তা বুঝবার উপায় থাকবে না— অর্থাত্‌ ত্বরণ ও অভিকর্ষ, দুটির উত্‌স আলাদা হতে পারে, কিন্তু ফলাফল এক। এই গূঢ় সূত্রটির বীজ কিন্তু নিউটনের তত্বেই ছিল, লোকে সেটা নিয়ে তেমন ভাবেনি, এই যা। আমরা যারা ছাত্রজীবনে বলবিদ্যার ক্লাস করেছি তারা নিউটনের দ্বিতীয় সূত্রের গাণিতিক অনুশীলন হিসেবে অঙ্ক কষে বের করেছি একটা ঢিল কোনাকুনি করে ছুড়ে মারলে তার গতিপথটা কি হবে। ভূপৃষ্ঠে দ্বিতীয় সূত্রটি দাঁড়ায়ঃ

 

ভর*ত্বরণ=ভর*g, g কে ধরা হয় অভিকর্ষজনিত ত্বরণ,
যার মানে ত্বরণ=g.

 

তারপর ত্বরণের গাণিতিক রূপ, মানে গতিবেগ পরিবর্তনের হার যা নিঊটনের ক্যালকুলাস থেকে পাই, সেটা ব্যবহার করে অনায়াসেই আমরা আবিষ্কার করেছি যে অভিক্ষিত ঢিলটির গতিপথ হল একট অধিবৃত্ত(parabola)। উল্লিখিত সমীকরণ থেকে একটা জিনিস নিশ্চ্য়ই পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে ত্বরণ আর অভিকর্ষ, দুয়ের মাঝে কোণও পার্থক্য আছে কিনা, সেটা আগে থেকে বলে না দিলে কোনও ভরযুক্ত বস্তুর পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। একটা উর্ধগামী বেলুন থেকে যদি এক পাউণ্ড ওজনের একটা কাঠের টুকরা ফেলেন নিচে সেটা যে ত্বরণে নামবে নিচে, ঠিক একই ত্বরণে নিম্নমুখী হবে একটা আধমণী বালুর বস্তা (অবশ্য ধরে নিতে হবে যে নিচে নামার পথে অন্য কোনও শক্তির প্রভাব পড়ছে না)। আইনস্টাইন তাঁর সমতুল্যতার আইডিয়াটি এধরণের কোনও সরল উদাহরণ থেকে পেয়েছিলেন কিনা জানিনা, কিন্তু এই একটি আইডিয়া কিভাবে অভিকর্ষের সঙ্গে মিশে গোটা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডেরই এক বিমূর্তক জ্যামিতিক মডেলে রুপান্তরিত হয়েছিল আইনস্টাইনের মানসপটে, তা’ও পরিচিত দৈ্র্ঘ্য-প্রস্থ-লম্বের ত্রিমাত্রিক আয়তনে নয়, সাধারণ বুদ্ধিবহির্ভূত চতুর্মাত্রিক স্থান-কাল মাত্রাবৃত্তে, সে এক অবিশ্বাস্য উপাখ্যান বটে বিজ্ঞানের ইতিহাসে। এই চতুর্মাত্রিক সীমানার মধ্যে গঠিত রাবার বলের যে বক্রতা সে বক্রতা কালেরও বক্রতা—-বক্রতা যত বাড়ে সময় তত ঢিলে হয়, ভর হয় আরো ভারি( যার নামকরণ করেছেন বিজ্ঞানীরা mass inflation), আকারে হয় তত খর্ব। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব, এনং তাঁর মসৃণ রাবারের মডেল, আমি ভাল বুঝেছি সেদাবি করার সাহস আমার নেই। তবুও যেটুকু বুঝেছি তাতেই তার অসামান্য রূপ আমাকে মুগ্ধ বিস্ময়ে অভিভূত করেছে।
একটু আগে আমরা ইঙ্গিত দিয়েছিলাম ‘শূন্যের’ অপ্রত্যাশিত প্রবেশ আইনস্টাইনের বিশেষ তত্বে, তাতে কিরকম বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা ছিল, এবং শেষ পর্যন্ত তার সুরাহা হল কেমন করে। প্রকৃতি যেন একদিকে বিপদ সৃষ্টি করে, তেমনি আবার বিপদমুক্তিরও পথ উন্মুক্ত করে দেয়। আইনস্টাইনের অভিকর্ষ তত্বেও ‘শূন্য’ দর্শন দিতে ভোলে না—এবং এখানে তার মূর্তি আরো ভয়াবহ। এই শূন্যের একটা চলতি নাম আছে—-কৃষ্ণবিবর (black hole)। দূর মহাকাশের উর্ধলোকে রহস্যজনকভাবে গঠিত এক মহাগহবর, এক নিরঙ্কুশ নির্মম অন্ধকার, তার নাম দেওয়া হয়েছে কৃষ্ণবিবর। গণিতের ভগ্নাংশে বিভাজকের আসনে যখন শূন্য বসে যায় তখনই শুরু হয় তুলকালাম—আমরা গাণিতিকরা একে বলি singularity, গণিতের একটি শাখাতে (complex variables) এর উপস্থিতি অবাঞ্ছনীয় তো নয়ই, বরং অপরিহার্য, singularityই হল এবিষয়টির প্রাণরস। কিন্তু বাস্তব জগতে, মহাকাশের দিগন্তপারে, এই অশুভ শূন্য যখন তার বিশাল মরণগহবর রচনা করে বিভীষিকা সৃষ্টি করে তখন তা মানবজাতির গোটা অস্তিত্বকেই সঙ্কটের মুখে ঠেলে দেয় যেন। কথা হল এই black hole জিনিসটা কি।

 

একটু আগেই দেখলাম আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব কিভাবে আধুনিক বিজ্ঞানের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল, কিভাবে কেপ্লার, গ্যালিলি আর নিউটনের ধ্যানধারণাকে নতুন করে সাজিয়ে এক অভিনব বিশ্বপ্রকৃতির আদল সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এতে আমরা ইঙ্গিত পেতে শুরু করেছিলাম কোথা থেকে আমাদের আগমন, কোথায় আমাদের গন্তব্য। কিন্তু আইনস্টাইনের এই অসাধারণ আবিষ্কারের প্রথম দিকে যা জানা যায়নি তা হল তাঁর সমীকরণগুলোর মধ্যেই নিহিত ছিল ভবিষ্যতের অশুভ সঙ্কেত—একটি অনাকাঙ্খিত ‘শূন্যের’ অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা। সে তথ্যটি আবিষ্কার করেছিলেন ভারতীয় জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী নোবেল বিজয়ী সুব্রামানিয়াম চন্দ্রশেখর ( ১৯১০-১৯৯৫), ১৯৩৩ সালে। সেবছরই তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী R.H. Fowler(১৮৮৯-১৯৪৪) এর অবেক্ষণায়(supervision)। অনেকের মতে এই কাজটিই ছিল চন্দ্রশেখরের গৌরবময় বৈজ্ঞানিক জীবনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় কাজ—প্রধানত এর জন্যেই তিনি সারা বিশ্বের অতিপরিচিত একটি নাম, এবং অনেকটা এই কাজের স্বীকৃতিস্বরূপই তাঁর নোবেল পুরস্কার পাওয়া ১৯৮৩ সালে। তবে, আইনস্টাইনের সমীকরণে কৃষ্ণবিবরের উপস্থিতির সম্ভাবনা যে লুকিয়ে আছে গোপনে সে উপলব্ধিটা কিন্তু চন্দ্রশেখরের মনে অনেক আগেই উদয় হয়েছিল, যখন তাঁর বয়স কুড়ি পার হয়নি, এবং বলতে গেলে কেম্ব্রিজাভিমুখে যাত্রাকালে সমুদ্রগামী জাহাজের আরামকেদারায় বসে। সে এক অসাধারণ দিব্যজ্যোতি বটে!

 

এই আইডিয়াটির পেছনে আরেকটা ছোট্ট ইতিহাস আছে। উলফ্‌গ্যাং পাওলি( ১৯০০-১৯৫৮) নামক এক অস্ট্রো-আমেরিকান আণবিক বিজ্ঞানী (অস্ট্রিয়াতে জন্ম, ১৯৪৫ সালে নোবেল বিজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্বপ্রাপ্তি), আণবিক জগতের একটি অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য আবিষ্কার করেছিলেন যে, একটি পরমাণুর (atom) ভেতরে দুটি সমতেজবিশিষ্ট তড়িতকণা(electron) সহাবস্থান করতে পারে না। এই সূত্রটি তাঁরই নামে নামকৃত হয়েছে–পাওলির বহির্ভূতি সূত্র(Pauli’s Exclusion Principle)। ১৯২৩ সালে আবিষ্কৃত এই সূত্রটির জন্যই তিনি বিশেষভাবে পরিচিত ও সম্মানিত।

 

১৯৩০ সালে বিংশতম জন্মবার্ষিকীতে পৌঁছুবার আগেই প্রায়-কিশোর চন্দ্রশেখর ভারতের উচ্চশিক্ষা অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে সমাপ্ত করে রওয়ানা হয়েছিলেন কেম্ব্রিজের পথে সেখানকার বড় বড় পদার্থ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে আসার আকর্ষণে। কিন্তু সমুদ্রভ্রমণের আয়েসজীবনে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করে সবটা সময় অতিবাহিত করার মত প্রবৃত্তি তাঁর ছিল না। ফাঁকে ফাঁকে নিজস্ব চিন্তাভাবনার সূত্র ধরে বেশ কিছু গবেষণার কাজও চালিয়ে যাচ্ছিলেন একই সঙ্গে। তাঁর জীবনচরিতে লিপিবদ্ধ আছে যে সেই সমুদ্রভ্রমণের সময়তেই তিনি আইনস্টাইনের সমীকরণসমূহের সঙ্গে পাউলির বহির্ভূতি সূত্র মেলাতে গিয়ে বুঝতে পারলেন যে সূত্রটি সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। একটা সময় আসে যখন স্পেস-টাইমে অবস্থিত অভিকর্ষ শক্তি সেই বহির্ভূতির সমস্ত বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে একটা বিপর্যয় সৃষ্টি করে দিতে পারে। ঠিক কোন্‌ পর্যায়ে গিয়ে সেই সূত্র-লঙ্ঘনের প্রক্রিয়াটির সূচনা হতে পারে সেটাও তিনি অঙ্ক কষে বের করে ফেললেন। তাঁর গণনা অনুযায়ী, সূর্যের ভরের চেয়ে ১.৪৪ গুণ বা তারও বেশি ভরবিশিষ্ট নক্ষত্রের আভ্যন্তরীন তড়িত্‌কণাদের চলাচলের ক্ষেত্রে পাউলির বহির্ভূতি সূত্রকে অগ্রাহ্য করে অভিকর্ষ শক্তি আত্নপ্রতিষ্ঠা স্থাপন করবে। এই সংখ্যাটিকে (১.৪৪) বলা হয় চন্দ্রশেখর মাত্রা (Chandrasekhar Limit)। কিন্তু ঘটনাটি হুট করে ঘটতে শুরু করে না, ধাপে ধাপে ঘটে। প্রথম পর্যায়ে ঋণাত্নক কণাগুলো ধনাত্নক কণাদের (protons)সঙ্গে মুহুর্মুহু ধাক্কা খেয়ে সৃষ্টি করে তড়িতশক্তিরহিত নিউট্রন কণা। যার পরিণাম হল বিশাল ভরসম্পন্ন ও বিদ্যুতশক্তিবিবর্জিত একটি বিরাট নিউট্রন স্টার। এই স্তরে তারাটির ঘনত্ব এমন একটা দুঃসহ অবস্থায় পৌঁছে যায় যে এক চিমটি বালুকণাও মনে হবে লক্ষ কোটি মনের বস্তা, এতটাই ভারি। নিউট্রন স্টারের এক জলজ্যান্ত সাক্ষ্য দাঁড় করিয়েছিলেন ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জসেলিন বেল, ১৯৬৭ সালে, তাঁর শক্তিশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে মহাকাশের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তাঁর আবিষ্কৃত ম্রিয়মান নক্ষত্রটি, অসম্ভব ক্ষীণজ্যোতিসম্পন্ন একটি বামনাকার (তুলনামূলকভাবে) তারা বারবার জ্বলছে আর নিভছে, জ্বলছে আর নিভছে। এর নামকরণ হয়েছিল তখন pulsar। আমার মনে আছে সেসময় এর আবিষ্কার তুমুল সাড়া সৃষ্টি করেছিল সারা বিশ্ব জুড়ে। নিউট্রন অবস্থাতে তারাগুলোর ব্যাসার্ধ সাধারণত ৫ কিলোমিটার বা তারও কম হয়। অথচ তাদের ঘনত্ব এক অবিশ্বাস্য সংখ্যা—-এক চামচ চিনির ওজনই মনে হবে কয়েক বিলিয়ন টন। এ অবস্থাতে তারাদের আয়ু প্রায় শেষ হয়ে গেছে। অভিকর্ষশক্তি তখন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। এমন একটা অপ্রতিরোধ্য পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে এর থেকে আর নিস্তার নেই। ঘনত্ব বৃদ্ধি ও আয়তনের সঙ্কোচন ততক্ষণে সকল বাধা অতিক্রম করে ফেলেছে। এক পর্যায়ে নিউট্রনগুলো পরিণত হয় কুয়ার্কে—নিউট্রন স্টার হয়ে যায় কুয়ার্ক স্টার। এবং একেবারে চূড়ান্ত অবস্থা যখন দাঁড়ায় তখন সে একটা নির্মাত্রিক বিন্দুতে পরিণত হয়, যার কোন দৃশ্যমান অস্তিত্ব নেই, অথচ তার ওজন অনেকগুলো সৌরমণ্ডলের ওজনকে একত্র করলেও হয়ত তার সমান হবে না। এক মহা হাহাকার শূন্যতা, নিরাকার অস্তিত্ব নিয়ে আপন আধিপত্য বিস্তার করে থাকা এক ভয়াবহ দৈত্য—তাকেই বলা হয় black hole—কৃষ্ণবিবর। এখানে স্পেস-টাইমের বক্রতা আক্ষরিক অর্থেই অসীম—খাড়া পর্বত যেমন—আলোকরশ্নি সেখানে একবার ঢুকলে তার কোনও নিষ্ক্রমনের পথ থাকে না—সেখান থেকে বের হয়ে কাউকে খবর দেবার জো নেই। সে লোকচক্ষুর অন্তরালে চিরতরে হারিয়ে যাবে। এই হল মহাকাশের মহাশূন্যের মহাপ্রলয় কাহিনী।

 

প্রথম দিকে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতে চান নি এই অত্যাশ্চর্য দৃশ্যটির বাস্তবায়িত হবার সম্ভাবনা। স্বয়ং আইনস্টাইনও সংশয়বিদ্ধ ছিলেন তাঁর সৃষ্ট বিশ্বচিত্রের কোথাও এমন দুষ্ট ফাঁকফোকর থাকতে পারে যাতে করে এমন একটি উদ্ভট ও অশুভ পরিণতি দাঁড়িয়ে যেতে পারে উর্ধাকাশে। কিন্তু তাঁর রক্ষণশীল চিন্তাধারাকে ভুল প্রমাণিত করে পরবর্তীকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণবিবর যে সত্যি সত্যি আছে তার সাক্ষ্যপ্রমাণ আবিষ্কার করেছিলেন।

তেইশ

আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের দুটি অগ্রনী শাখা—কুয়ান্টাম তত্ব ও আপেক্ষিক তত্ব। একটি ব্যাপৃত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুকণার জগতে, যেখানে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি ও কল্পনা, উভয়ই হয় সমভাবে পরাভূত। ওদিকে আপেক্ষিক তত্বের মাপকাঠি আরেক বিপরীতে—সেখানে বাজারে কেনা ঘড়ি কোনও কাজে লাগবে না, কারণ সময় নিজেই গতির আজ্ঞাবহ, এবং সেখানে দৈর্ঘ্য -প্রস্থ কোনকিছুরই কোনও স্থিরতা নেই, সবই সেই গতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। গতি বেড়ে গেলে ঘড়ি স্লো হয়ে যায়, বস্তুর ওজন বেড়ে ঢাউস হয়ে ওঠে, দৈর্ঘ-প্রস্থ-লম্ব সবই কুঁচকাতে থাকে—সে এক অদ্ভূত ব্যাপার। এ-জগতের অস্তিত্ব নিয়ে সাধারণ মানুষের সংশয়প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক, কারণ সাধারণ মানুষের সাধারণ জীবন গ্যালিলি-নিউটনের শান্ত সুশীল তত্ব দ্বারাই সুন্দর সুচারুভাবে চালিত পালিত। তাদের দৈনন্দিন জীবনে দূর নীহারিকার কোনও নক্ষত্রের প্রাণহানি হল কি না হল তাতে কি আসে যায়।

 

কিন্তু আসে যায় বইকি। আসে যায় যখন ওই কালনাশী ‘শূন্য’ এসে মহা তাণ্ডবের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে দেয় আমাদেরই পরম আরামদায়ক পরিচিত বিশ্বপরিবেশে। কৃষ্ণবিবর একটি ভয়ঙ্করী শূন্য, যা থেকেও নেই, যা মরেও মরেনি, যা চোখে দেখা যায় না, যার কোন আয়তন নেই অথচ মহাকাশের স্পেস-টাইমে অবস্থিত একটি রূঢ় বাস্তবতা। তাকে অগ্রাহ্য করবার কোনও উপায়ই নেই। এখানে আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব ও প্লাঙ্ক-হাইসেনবার্গ-শ্রেডিঙ্গারের কুয়ান্টাম তত্ব পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু মিলিত হয়নি—বলতে গেলে একরকম সংঘর্ষের পর্যায়ে পৌঁচেছে। আগের অধ্যায়গুলোতে আমরা দেখেছি আলোর একটা বিশেষ চরিত্রের কারণেই উদ্ভব হয়েছে বিজ্ঞানের এ-দুটি প্রধান শাখা। কিন্তু তারা এসেছে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরু থেকে, এবং এদের বিচরণক্ষেত্রও দুটি বিপরীত পৃথিবী। এই বৈপরীত্যের কারণে কুয়ান্টাম তত্বকে আশ্রয় নিতে হয়েছে ব্যবচ্ছিন্ন গতিধারার—যেখানে নিরবচ্ছিন্নতা বা continuity র গণিত খুব একটা কাজে লাগে না। এখানে তেজ, গতি, অবস্থান, সবই যেন গড়িয়ে গড়িয়ে না চলে মণ্ডূকের মত লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। ম্যাক্স প্লাঙ্ক এটা প্রথমে প্রস্তাব করেছিলেন অনেকটা মরিয়া হয়ে, যেন জোর করে ফল মেলাতে চাওয়া। পরে দেখা গেল সেটাই প্রকৃতির নিয়ম। ওদিকে আইনস্টাইনের স্পেস-টাইমের যে জগত তার বক্রতা নির্দেশ করে প্রকৃতিরই চিরবিরাজমান অভিকর্ষ শক্তি, সে জগত একেবারেই নিরবচ্ছিন্ন, সেজগতে বক্রতা থাকলেও ভগ্নতা নেই, নেই কোন ফাঁকফোকর, কোনও ব্যবচ্ছিন্নতা। সেখানে যে বিশাল রাবার বলের মত কূলকিনারাহীন একটা বস্তু তার শরীর অত্যন্ত মসৃণ, তার প্রতিটি বিন্দুতেই একটা সুনির্দিষ্ট স্পর্শক আঁকা সম্ভব, যদিও বড়সড় গ্রহনক্ষত্রের কাছাকাছি এসে সেই রাবার বলেতে যেমন টোল পড়তে আরম্ভ করে, তেমনি তার চতুর্পাশ্বের স্পর্শকগুলি বাঁকা হতে হতে প্রায় খাড়া হবার উপক্রম হয়—অভিকর্ষ শক্তি যত প্রবল ততই তীক্ষ্ণ তাদের বক্রতা। মনে হবে যেন কেউ সেই মসৃণ রাবারের গায়ে গর্ত করে দিয়েছে। এই গর্তের ভেতর অনন্ত রহস্য—এ-রহস্য উদ্ঘাটনের কোনও উপায়ই নেই—দুঃসাধ্য বলে সত্যি সত্যি যদি কিছু থাকে তাহলে এটি হল সেই জিনিস। প্রকৃতি এখানে চিরকালের জন্যেই দরজা বন্ধ করে রেখেছে। ‘শূন্য’ এখানে আক্ষরিক অর্থেই দুর্ভেদ্য ও দুর্জয়।
বর্তমান যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্টিফেন হাকিং (১৯৪২-), তাঁর A Brief History of Time গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছিলেন যে এডউইন হাবলের ( ১৮৮৯-১৯৫৩) পর্যবেক্ষণ অনুসারে, সৃষ্টির আদিতে এমন একটা জিনিস ছিল, যাকে বলা হয় বিগ ব্যাং (Big Bang), যখন বিশ্বজগত (universe) ছিল অসম্ভবরকম ছোট, এবং তার ঘনত্ব ছিল সীমাহীন, ঐ অবস্থাতে বিজ্ঞানের সমস্ত আইনকানুন অচল হয়ে যায়, ভবিষ্যতে কি হবে না হবে তার কোনরকম আভাস দেওয়া সম্ভব হয় না। এডউইন পাওয়েল হাবলের নাম শোনেনি এমন লোক খুবই আছে এযুগে, বিশেষ করে বিজ্ঞানমহলে। ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মধ্যে তাঁর নাম অবশ্যই স্বর্ণাক্ষরে স্থান পাবার যোগ্য বলে অনেকেরই বিশ্বাস। জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সঙ্গে অন্যান্য বিজ্ঞানীদের বড় পার্থক্য হল যে তাঁদের কোনও পরীক্ষাগার বা ল্যাবলেটরি বলতে কিছু নেই। তাঁদের একমাত্র সহায় হল দূরবীন, যার আদিমতম সংস্করণটি আবিষ্কার করেছিলেন গ্যালিলিও গ্যালিলি। কুয়ান্টাম জগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুপরমাণু পরীক্ষা করার জন্যে যেমন শক্তিশালী অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া গত্যন্তর নেই, তেমনি দূর দূর নক্ষত্রপুঞ্জের গতিবিধি স্বচক্ষে দেখতে চাইলে দরকার হয় অনুরূপ বা তার চেয়েও শক্তিশালী দূরবীন। শুধু তাই নয়, তাঁদের নির্ভর করতে হয় অনুকূল আবহাওয়ার—আকাশে যেন মেঘ না থাকে, কুয়াশা না থাকে, এবং অধিকাংশ সময়ই তাঁদের খুঁজতে হয় উঁচু উঁচু পর্বতচূড়া। এ থেকে খানিকটা অনুমান করা যায় পুরাকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কতখানি প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা, যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তাঁদের গবেষণা চালিয়ে যেতে হয়েছিল। যুগে যুগে বিজ্ঞানীরা নিজেদের গরজেই উন্নতমানের যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করে উর্ধাকাশের নতুন নতুন রহস্য উদ্ঘাটন করেছিলেন। এই অসামান্য মেধা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পূর্বসূরীদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন এই অসাধারণ মানুষটি—এডউইন হাবল। একেবারে শিশুকাল থেকেই দূরবীন আর গ্রহনক্ষত্র একরকম নেশা ছিল তাঁর। কালে কালে সেই নেশা হয়ে দাঁড়ালো সাধনা ও পেশা। এমন এক দূরবীন তিনি আবিষ্কার করলেন যাতে করে আকাশের সুদূরতম তারাগুলোও তাঁর চোখের সামনে এসে ধরা দিতে শুরু করল একে একে। দূর মানে সাধারণ দূর নয়, লক্ষ লক্ষ আলোকবর্ষ আগে জন্মেছিল যারা, তারাও। তাদের বিচ্ছুরিত আলো এতই ক্ষীণ যে খালি চোখে দেখার কোনও প্রশ্নই ওঠেনা, এবং তারা জ্বলে আর নেভে, জ্বলে আর নেভে, সেই জোসেলিন বেলের পালসারদের মত। হাবলের আবিষ্কৃত তথ্যসমূহ বিশ্লেষণ করে হকিংসহ বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন যে আমাদের বিশ্বজগত কেবল একটি ছায়াপথের ( Milky Way) মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, যা আগে ভাবা হত, সম্ভবত এরকম আরো লক্ষ কোটি ছায়াপথ বিরাজ করছে শত কোটি আলোকবর্ষ দূরে যাদের আলোকরশ্মি আজো পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়নি। এবং বিগ ব্যাং বলে সত্যি সত্যি একটা জিনিস রয়েছে, যা অস্বীকার করবার কোনও উপায় নেই।

এবং আমাদের আলোচনার জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বিগ ব্যাং মানে শূন্য থেকেই আমাদের যাত্রা শুরু—-গোটা সৃষ্টির।

 

আগের অধ্যায়ে আমরা দেখেছি কুয়ান্টাম তত্বে ‘শূন্য’ কিভাবে অপ্রত্যাশিতভাবে দর্শন দিয়ে সবকিছু তছনছ করে দেয়—এবং তার গোড়ায় হল কুয়ান্টাম বিজ্ঞানের নানা সমীকরণের সঙ্গে হাইসেনবার্গের এক অসমীকরণের সংযোগ। একটা জিনিস মাপতে চাইলে আরেকটা মাপা যাবেনা ভাল করে, একটিতে চোখ ফেললে আরেকটি থেকে চোখ সরাতে হবে, যার ফলে একটা সীমানার বাইরে সব মাপজোকে গণ্ডগোল বেধে যায়। এ-সংকট থেকে পরিত্রাণের একটা পথ বাত্‌লে দিয়েছিলেন রিচার্ড ফাইনমেন (১৯১৮-১৯৮৮), তাঁর রিনর্মালেজন তত্ব দ্বারা। এর মূল কথা হল যে কোন ক্ষুদ্র কোনও বিশেষ তথ্য জানতে চাইলে ( যেমন তড়িত্‌কনার ভর বা বিদ্যুতমাত্রা) তার গায়ের ওপর একেবারে উপুড় হয়ে পড়লে কিছুই দেখা যাবে না, কিঞ্চিত্‌ দূরত্ব বজায় রাখতে হবে, যাতে ঠিক ঐ দূরত্বে থেকেই সবকিছু নিখুঁতভাবে মাপা যাবে, তার কাছে গেলে সব ঝাপসা হয়ে যাবে। ফাইনমেন তাঁর সুবিখ্যাত ছবিটবি দিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন—এগুলোকে বলা হয় ফাইনমেন ডায়েগ্রাম।

 

ফাইনমেনের ডায়েগ্রাম তাঁর কুয়ান্টাম-তড়িতগতিবিজ্ঞানের (Quantum Electrodynamics) বেলায় খুবই কার্যকরী হয়েছিল, কিন্তু মহাকাশ বিজ্ঞানে তেমন প্রযোজ্য মনে হয়নি। সে অভাবটি পূরণ করবার চেষ্টাতে গত শতাব্দীর শেষের দিকে আরেকটি অভিনব তত্ব সূচিত হয় যার নাম String Theory (রজ্জুতত্ব?)। পুরোপুরি গণিতের কারসাজি এতে—-দূরবীণ, অণুবীক্ষণ এসবের সঙ্গে কোনও সনপর্ক নেই তার। কিন্তু ফল মিলে যায়। এর মূল বিষয়টি হল, সব নষ্টের গোড়া— ‘শূন্য’, তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একটা নতুন জিনিস সৃষ্টি করা তার পরিবর্তে, যা শূন্যের মত মাত্রাহীন বিন্দু নয়, যার অন্তত একটি মাত্রা আছে, অর্থাত্‌ তাত্বিকভাবে হলেও যা পরিমাপনীয়। তাতে করে একদিকে যেমন ইলেট্রন একটা মাত্রালাভ করে, ফলে হাইসেনবার্গের সূত্রের বাইরে চলে যাবার আশঙ্কা থাকেনা, অপরদিকে উর্ধাকাশের কৃষ্ণবিবরেও শূন্য ঢুকে তুলকালাম বাধিয়ে দেয় না। ক্ষুদ্র পরিবেশ হলেও সবকিছুতেই একটা মসৃণতা সৃষ্টি হয়, গণিত অকেজো হয়ে যায় না, বিজ্ঞান হয়না অচল। নব্বুই দশক ও এশতাব্দীর গোড়াতে এবিষয়ে তুমুল গবেষণা চলতে থাকে তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে (Theoretical Physics)। মুস্কিল হল, স্ট্রিং থিওরিকে বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গেলে দেখা গেল একটি দুটি মাত্রাতে চলবে না, এমনকি আইনস্টাইনের চতুর্মাত্রিক বিশ্বও যথেষ্ট নয়, পুরো দশটি মাত্রা দরকার। আজকাল কেউ কেউ তার সঙ্গে আরো একটি মাত্রা যোগ করতে চাইছেন, যাতে করে একেবারে হুবহু খাপ খেয়ে যায় সবকিছু। পাঠক নিশ্চয়ই দারুন দ্বিধায় ভুগছেন—-তিন মাত্রা নিয়েই সাধারণ মানুষ হাবুডুবু খায়, তারপর আইনস্টাইন নিয়ে এলেন এক চতুর্থ, সেটাও নাহয় কষ্টে সৃষ্টে হজম করা গেল, কিন্তু তাই বলে দশ কি এগারো মাত্রা? নিশ্চয়ই বিশুদ্ধতাবাদী(pure mathematician) গাণিতিকদের শ্বেতপ্রাসাদ, তাই না? দশ মাত্রা কি কখনো যন্ত্র দ্বারা দেখা সম্ভব?

 

হ্যাঁ সেটাই প্রশ্ন, মস্ত বড় প্রশ্ন। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুপরমাণুকে দেখার জন্যে কোটি কোটি ডলার মূল্যের বিশাল বিশাল ত্বরণপ্রণালী(accelerators) তৈরি করতে হয়। ইউরোপে যেটি স্থাপিত হয়েছে সম্প্রতি তাতে আছে ৫৪ মাইল লম্বা একটি চক্রাকার যন্ত্র যাতে কমপক্ষে ১০,০০০ চুম্বক বসানো আছে। অনুমান করা হয় যে একটা দশমাত্রিক স্ট্রিং দেখবার জন্যে ৬*(১০^১৫) মাইল দীর্ঘ প্রণালী দরকার হবে। সংখ্যাটি যে কতবড় তার কোন ধারণাই নেই আমাদের। আলোর গতিতে চললেও একটা কনার হাজার বছর লাগবে ওই পথটুকু একবার ঘুরে আসতে। সুতরাং স্ট্রিং তত্ব আপাতত গণিতের পাতা থেকে বের হয়ে বাস্তব জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে সে আশা বোধ হয় বৃথা। তবে ভবিষ্যতে বিজ্ঞান এবং গণিত কোথায় গড়াবে সেটা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। পঞ্চাশ বছর আগে আমরা যাকে কল্পনা বলে ভাবতাম, রূপকথার সামগ্রী, তার অধিকাংশই তো বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। সুতরাং—।
সুতরাং আপাতত ‘শূন্য’ থেকে আমাদের উদ্ধার নেই।

চব্বিশ

বিগ ব্যাং যে সবাই বিশ্বাস করে তা নয়। মজার ব্যাপার যে যারা করে তাদের মধ্যে গোঁড়া ধার্মিক যেমন আছেন পাড় নাস্তিকও আছেন প্রচুর। এর তাত্‌পর্য হল যে আক্ষরিক অর্থেই আমাদের বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটা সূচনা ছিল, এবং সেই সূচনাটি ছিল একটি শূন্য থেকে, যা মাত্রাহীন, অথচ যার ভেতরে আবদ্ধ হয়ে ছিল সমস্ত বস্তুজগত। সেখান থেকে সহসা এক বিশাল বিস্ফোরণ—এবং স্থান-কাল-বস্তুর যাত্রা শুরু। এ-দৃশ্য সাধারণ মানুষের কল্পনার বাইরে।
প্রশ্ন হল, আসলে কি সেভাবেই শুরু হয়েছিল আমাদের বিশ্বজগত? প্রথমে কিছুই না, এবং সেই কিছু-না থেকে সবকিছুর জন্ম? এমুহূর্তে সব অন্ধকার, পরমুহূর্তে সব আলোয় আলোময় হয়ে ওঠা?

 

শূন্যের বিরুদ্ধে প্রাচীন যুগে (গ্রীস নয় কেবল, পশ্চিম বিশ্ব ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় প্রতিটি দেশেই) প্রচুর কুসংস্কার ছিল, এবং তা ছিল অনেকটা দার্শনিক ভিত্তিতে। শূন্য তাঁদের জ্যামিতিক ধারার দর্শনচিন্তার সঙ্গে খাপ খেত না বলেই তাঁরা একে সহজে গ্রহণ করতে পারছিলেন না। মজার ব্যাপার যে ভারতবর্ষের দর্শনভাবনা ছিল তখন অধ্যাত্নভিত্তিক, যেখানে শূন্য আর অসীম হল একই সত্তার দুটি ভিন্ন রূপ মাত্র, তাই শূন্যের আইডিয়াটি অনায়সেই তাঁদের গাণিতিক চেতনাতে স্থান করে নেয়। ওদিকে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত আরব গাণিতিক, দার্শনিক ও বিজ্ঞানীরা ছিলেন বুদ্ধিজগতের অগ্রদূত—-তাঁদের চিন্তা ছিল তখন সম্মুখমুখী। তাই তাঁরা শূন্য শুধু গ্রহণই করেননি, জ্ঞানবিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাতে অত্যন্ত নিপুনভাবে ব্যবহার করেছিলেন। এবিষয়ে বরং পশ্চিমই অনেকটা পিছিয়ে ছিল দীর্ঘকাল—প্রধানত হয়ত এরিস্টটোলিয়ান শূন্য-বিরোধী চিন্তাধারাতে যুগযুগ ব্যাপী দীক্ষিত হয়ে থাকার কারণেই। অবশ্য মধ্যযুগ থেকে অদ্যাবধি পশ্চিমের গণিত এবং বিজ্ঞান অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে গেছে অন্যান্য দেশের তুলনায়, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রকৃতির কোষে কোষে শূন্যের প্রভাব, সেটা এখনও তাঁরা পুরোপুরি গ্রহণ করতে পেরেছেন বলে মনে হয়না। তাই পৃথিবীর সূচনা শূন্যতে, হয়ত শেষও, সেটা এখনও বিতর্কিত।

 

অনেকে আছেন যারা, ধর্মীয় কারণেই হোক আর অন্য কোনও দার্শনিক ভিত্তিতেই হোক, সৃষ্টিবাদের ওপর গভীর আস্থাশীল, কিন্তু শূন্য থেকে সবকিছুর শুরু, এটা সহজে মেনে নিতে পারেন না। কারণ সৃষ্টি হলে তো তার একজন স্রষ্টা দরকার যাঁর উপস্থিতি থাকা উচিত ‘সৃষ্টি’র আগে। তার অর্থ ‘শূন্যে’র আগেও তিনি ছিলেন, আর কিছু না থাকলেও। যুক্তির প্যাঁচটা সেখানে। স্রষ্টা নিজেই সেই শূন্যের ভেতরে ছিলেন সেটা তাঁরা কিছুতেই গ্রহণ করতে চাইবেন না। এর একটা মীমাংসা এভাবে করা যায় যায় যে সৃষ্টি জিনিসটেই একটা চিরসত্য, চিরবিরাজমান বাস্তবতা বলে গ্রহণ করে নেওয়া। আমাদের এই চিরপরিচিত মহাবিশ্ব এখন যা চিরকাল তাই ছিল এবং ভবিষ্যতেও তাই থাকবে। এই বিশ্বাস পরম স্বস্তিকর, নিরাপদ ও সংকটমুক্ত। এই চিরন্তনতার ওপর ভরসা করেই এরিস্টটোল নির্মাণ করেছিলেন তাঁর বিজ্ঞান, দর্শন ও গণিতের ভিত্তি।

 

বিশ্বজগতের আদি-অন্তের বিষয়টি এমনই মৌলিক এবং আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত যে জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রায় প্রতিটি শাখারই অনুসন্ধানী দৃষ্টি যুগে যুগে আরোপিত হয়েছে এর প্রতি। সেই আদিম প্রশ্নঃ আমরা কারা। কোথা থেকে এসেছি, কোথায় যাচ্ছি, এবং কেন, এসব প্রশ্ন দার্শনিকদের যেমন ভাবিয়েছে, তেমনি ভাবিয়েছে ধর্মগুরুদের, ভাবিয়েছে বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সাধকদের, এমনকি সাধারণ ছাপোষা মানুষদেরও।

 

মধ্যযুগ, এমনকি আধুনিক যুগেরও অনেক বড় বড় বিজ্ঞানী তাঁদের ধর্মবিশ্বাস ও বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তিবাদী চিন্তাধারার সমন্বয় খোঁজার চেষ্টা চালিয়েছেন সারাজীবন। স্বয়ং আইনস্টাইন গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বজগত একটি স্থাযী এবং স্থিতিশীল বস্তু, চিরকাল ছিল, চিরকাল থাকবেও। এ থেকে প্রমাণ হয় না যে তিনি দারুণভাবে ধর্মবিশ্বাসী ছিলেন বা ছিলেন না, শুধু এটুকুই প্রমাণ হয় যে বৃহত্তর নৈতিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি কিছুতেই মানতে রাজী ছিলেন না যে আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী হয়ত একটি অন্তিম সমাপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে ( শূন্য থেকে যদি শুরু হয়ে থাকে যাত্রা কোনও কারণে, তাহলে সেই একই কারণে শূন্যতে সমাপ্তি হতে বাধা কোথায়)। মহাবিশ্বের এই ভয়াবহ পরিণতির কোনও যৌক্তিকতা তিনি খুঁজে পাননি। পরম বিড়ম্বনা এই যে তাঁর নিজেরই কাজের মধ্যে উপ্ত ছিল এই প্রারম্ভ ও পরিণতির সম্ভাবনা। তাঁর সমীকরণগুলো ভাল করে পরীক্ষা করেই তো চন্দ্রশেখর কৃষ্ণবিবরের খোঁজ পেয়েছিলেন। অর্থাত্‌ মহাজগতের যেসব সম্ভাব্য দৃশ্য তাঁর অভিকর্ষ তত্ব থেকে বেরিয়ে আসে সেগুলো মূলতঃ অস্থাবর ও স্থিতিস্থাপকতাহীন পৃথিবীরই ইঙ্গিত দেয়। এবিষয়ে আইনস্টাইন সচেতন ছিলেন না তা নয়। কিন্তু এর ফলাফল নিয়ে তিনি এতটাই চিন্তিত ছিলেন যে এর সংশোধনের চেষ্টায় তিনি ‘cosmological constant’ নামক একটা কৃত্রিম সংখ্যা জুড়ে দিলেন তাঁর সমীকরণগুলোতে। অনেকটা তালি দিয়ে ছেঁড়া কাঁথা মেরামত করার মত। পরে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে জোড়াতালি দিয়ে প্রকৃতিকে ঠেকানো যায় না, চেষ্টা করাও উচিত নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ অবধি আমাদের পরিচিত আকাশের বাইরে উর্ধাকাশের খুব একটা বিস্তারিত খবর জানার কোনও উপায় ছিল না। পরিচিত আকাশ মানে ইহজগতের যেটুকু সীমানা, আমাদেরই একান্ত আপন ছায়াপথ (Milky Way), যার বাইরে কোনকিছু আছে কি নেই তা অন্তত দূরবীন দিয়ে দেখার মত শক্তিশালী যন্ত্র তখনও আবিষ্কার হয়নি। আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ব দূরাকাশের অপার রহস্যে ঢাকা সেই মায়াপুরীর দ্বার খুলে দিলেও সেখানে দূরবীণের সন্ধানী চোখ পাঠানোর অবস্থা ছিল না। ঐ অচলাবস্থার অবসান ঘটতে শুরু করে গত শতাব্দীর কুড়ির দশক থেকে। প্রথমত আর্থার এডিংটন (১৯১৯) প্রমাণ করলেন যে গ্রহনক্ষত্রের সূক্ষতর বিষয়গুলোতে নিউটনের চেয়ে বরং আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণ তত্বই অপেক্ষাকৃত ত্রুটিমুক্ত তথ্যদান করে। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি আসে বিশের দশকের মাঝামাঝিতে—এডউইন হাবলের গবেষণাতে। আমাদের পরিচিত গ্যালাক্সির বাইরে যে আরো গ্যালাক্সি আছে সেটা তাঁর দূরবীক্ষণেই ধরা দেয় প্রথম একটু আগেই যা উল্লেখ করা হল। একটি নয় শত শত, হয়ত হাজার কোটি অনুরূপ ছায়াপথ সারা আকাশ জুড়ে, যা আমাদের চোখ দূরে থাক, কল্পনারও বাইরে। পাঠকের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, লোকটার দূ্রবীণ কি এতই শক্তিশালী যে কোট কোটি মাইল দূরের তারাও দেখতে পাওয়া যায়? আক্ষরিকভাবে, না, ঠিক তা নয়। দূরবীণ আলাদা হয়ত ছিল না, আলাদা ছিল তাঁর পদ্ধতি। মৌলিকত্বটা সেখানে। অনেকটা তারার চোখ দিয়ে তারা দেখা বলতে পারেন—কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মত। এই বীক্ষণ তারাটির নাম ‘সেফিডতারকা’(cepheid star), যা মিটমিট করে জ্বলে আর নেভে, সেই জোনাকি তারাদের মত (pulsars)। তাই বলে কেউ যেন ভাবতে শুরু না করেন যে এই তারাগুলো জোনাকিদের মতই ক্ষুদ্রাকার এবং তাদেরই মত মুহুর্তে মুহূর্তে জ্বলা-নেভা করে। এদের আকার কত ‘ছোট’ তার অনুমান দেওয়া যায় এভাবে যে এদের একেকটির ওজন ৫ থেকে ২০টি সূর্যের সমান। এবং যখন ভাল করে জ্বলে তখন তাদের প্রাখর্য সূর্যের চাইতে ৩০,০০০ গুণ বেশি। তবে এই তারাগুলোর বৈশিষ্ট্য হল যে এদের উজ্জ্বলতা এবং জ্বলা-নেভার সময়সীমা, এদুটি সংখ্যার মাঝে একটা সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক আছে, যা একবার জানা থাকলে সেটা কাজে লাগানো যায়। আরো একটা মজার বিষয় হল যে জ্বলা-নেভার কালে ওদের পুরো শরীরটাই ব্যাঙ্গের পেটের মত একবার বাড়ে একবার কমে, এবং এই বাড়া-কমাটা এমনই লক্ষনীয় যে মোট ব্যাসার্ধের শতকরা ত্রিশ ভাগই বদলে যেতে পারে, যা অনেকসময় বেশ কয়েক মিলিয়ন কিলোমিটারে দাঁড়িয়ে যায়। সাত আসমানের জোনাকিরাও নেহাত হেলাফেলা করার মত নয়। এই নিত্য পরিবর্তনশীল স্বভাবের জন্যেই এদের বলা হয় pulsating variable stars। প্রথম সেফিড তারকা আবিষ্কার হয়েছিল ১৭৮৪ খৃষ্টাব্দে। তারপর ১৯০৮ সালে হেনরিয়েটা সোয়ান লেভিট নামক এক জ্যোতির্বিজ্ঞানী একই সাথে হাজার হাজার সেফিড তারার সন্ধান পেলেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সেফিডতারার উপস্থিতি আবিষ্কার করলেন এই হাবল সাহেব ১৯২৪ সালে, আন্দ্রোমেদা গ্যালাক্সির মাঝে। অনেক নক্ষত্রমণ্ডলেই এরকম বীক্ষণ তারকা বিরাজ করে, যেন প্রকৃতি পরিকল্পিতভাবেই জায়গায় জায়গায় অবজার্ভেশন টাওয়ার স্থাপন করে রেখেছেন। সেফিডতারকার সাহায্যে হাবল সক্ষম হয়েছিলেন এমন সব তারার সন্ধান পেতে যাদের দূরত্ব মাইল-কিলোমিটারের চেয়ে বরং আলোকবর্ষের এককে মাপাই যুক্তিসঙ্গত। তাদের দূরত্ব হাজার হাজার আলোকবর্ষ , বা তারও বেশি। সেফিডতারকারা হল অনেকটা আকাশের মোমবাতির মত—তাদের সুপরিচিত জ্বলা-নেভার ইশারাতে ভূপৃষ্ঠের পর্যবেক্ষকরা নির্ধারণ করতে পারেন মহাকাশের দূরদূরান্তে কোথায় কি আছে এবং তাদের কি গতিবিধি এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য। আলোকতরঙ্গের দৈর্ঘ(wavelength) আর কম্পাঙ্ক(frequency) দিয়ে একটা জিনিসের দূরত্ব নির্ধারণ করা যায় সেটা আমরা আগেই দেখেছি। শুধু তাই নয়, বীক্ষিয়মান বস্তুটি স্থির না চলমান, এবং চলমান হলে কোনদিকে চলছে, বীক্ষকের দিকে না তার বিপরীতে, সেটাও ধরা পড়ে যায়। বিজ্ঞানে একে বলা হয় ডপ্লার এফেক্ট (Doppler Effect), বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার ক্লাসে এসব পড়ানো হয়। একটা ট্রেন দ্রুতবেগে আমাদের দিকে আসতে আসতে সাঁই করে পার হয়ে যাবার সময় যেমন শব্দটা কেমন যেন থেঁতলে গেল বলে মনে হয়, সেটা হল অনেকটা ঢেউগুলোকে জোর করে চ্যাপ্টা করে দেওয়ার মত। তারপর যখন ট্রেনটা অন্যদিকে চলে যেতে থাকল তখন যেন সবকিছু থিতিয়ে যেতে যেতে একসময় ঠাণ্ডা হয়ে যায়। এ সবই হল সেই তরঙ্গের উঠানামার ব্যাপার—দৈর্ঘ এবং কম্পাঙ্ক উভয়তেই। আপনি-আমি যখন হাইওয়েতে গাড়ি চালাই উঁচুবেগে, তখন হাইওয়ে পুলিশ আমাদের গতিবেগ নির্ধারণ করে কিভাবে? ঠিক একই ভাবে—ডপ্লার এফেক্টের সাহায্যে। জোরে চালালে তাদের যন্ত্রে কম্পাঙ্ক হু হু করে ওপরে উঠে যায়, তা থেকেই তারা টের পায় আমরা মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। তখনই তারা লাল বাতি জ্বালিয়ে আমাদের ধাওয়া করতে শুরু করবে।

 

অনুরূপভাবে এডউইন হাবল ডপ্লার এফেক্টের সাহায্যে আবিষ্কার করলেন (বিশেষ করে তরঙ্গের দৈর্ঘ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া কালে, অর্থাত্‌ লালের দিকে চলতে থাকলে) একটা গ্যালাক্সি কেমন করে দ্রুতবেগে সরে যাচ্ছে আমাদের ছায়াপথের পরিবেশ থেকে, দূরে বহুদূরে। এই ব্যাপারটিই ‘হাবল সূত্র’ নামে বহুল পরিচিত বিজ্ঞানমহলে। এবং এতে করে পৌঁছানো গেল এক যুগান্তকারি সিদ্ধান্তে—-বিশ্বব্রহ্মাণ্ড স্থিতিশীল তো নয়ই, বরং অতি দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে (expanding universe)—প্রতি সেকেণ্ডে ১০০/২০০ মাইল বা তারও বেশি। ভাগ্যিস উর্ধাকাশে কোনও ট্র্যাফিক পুলিশ নেই যে টিকিট দেবে!

 

আমাদের মত সাধারণ মরণশীল মানুষদের পক্ষে এসবের কোনকিছুই বোঝা সম্ভব নয়। এমনকি বিজ্ঞানের চোখা চোখা ছাত্রছাত্রীদের মনেও প্রশ্ন জাগতে পারেঃ তাই যদি হয় তাহলে তো আমরাও সেই গতিশীল নক্ষত্রপুঞ্জেরই অধিবাসী—সেই পাগলের মত ছোটা আইনলঙ্ঘনকারী শকটের যাত্রী। অথচ আমরা বিন্দুমাত্র টের পাচ্ছি না কেন সেই গতির ঝাঁকুনি? পাচ্ছি না এজন্যে যে আমরা এই গতির বাইরে নেই, ভেতরে—আইনস্টাইনের প্রথম আপেক্ষিক সূত্রের কথা ভাবুন, মানুষ কেবল আপেক্ষিক গতিটাই টের পায়। পরম বা ধ্রুব গতি বলে কিছু নেই, থাকলেও তা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য হবার নয়।

 

হাবল সূত্র এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্ত অনুসিদ্ধান্তগুলো যে অকাট্য সত্য সে দাবি কেউ করছেন না। অনেকগুলো মডেলের মধ্যে এ’ও একটি বিকল্প মডেল—অপেক্ষাকৃত বিশ্বাসযোগ্য মডেল, কারণ এর পেছনে একটা বড়রকমের পর্যবেক্ষণের মদদ আছে। ঘরে বসে অঙ্ক কষে একটা তত্ব আওড়ানোর চাইতে মাঠে গিয়ে নিজের চোখে দেখা সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে এলে তার দাম বাড়ে অনেকখানি। আলবার্ট আইনস্টাইন নিজেও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন হাবলের গবেষণায়। তাঁর স্থিতিশীল বিশ্বের চিন্তাভাবনায় খানিক চিড় ধরার পেছনে হাবলের প্রভাব অনেকটাই ছিল।

 

স্থিতিশীলতার পরিবর্তে স্ফীতিশীলতার তত্বটিকে মেনে নিলে একটা প্রশ্ন খানিক স্তিমিত হলেও আরো অনেক নতুন প্রশ্ন দাঁড়িয়ে যায়। সবচেয়ে বড়টি হলঃ আজকে এই মুহূর্তে যদি বিশ্বজগত তীব্রবেগে ছুটে চলে বহির্মুখে, তাহলে এই গতিটা নিশ্চয়ই আরম্ভ হয়েছিল একসময়। ১৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ আগের দৃশ্যটা কি ছিল? হাবলের দূরবীণ বলছে মহাজগতের বয়স ১৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ। তার অর্থ, ঠিক ওই মুহূর্তটিতে পৃথিবীতে কিছুই ছিল না—শূন্য, মহাশূন্য। এই শূন্যাবস্থাটি থেকে অকস্মাত্‌ মহাকাল ও মহাবিশ্বের জন্ম, তাকেই বলা হয় বিগ ব্যাং–মহাবিস্ফোরণ। মহাজগতের যা কিছু দেখছি আমরা তার সবই পুঞ্জীভূত বিন্দুর আকারে আবদ্ধ হয়ে ছিল সেই বিন্দুর কোঠরে। গণিতের সেই অপয়া শূন্য, সেই ভয়াবহ শূন্য, যে লবের আসনে বসে সবকিছুকে শূন্যের অঙ্কে বসিয়ে মায়াময় করে তোলে, এবং হরের আসনে বসে রূপধারণ করে সর্বনাশা সীমাহীনতার। শূন্যের দ্বৈতচরিত্র চিরকালই মানুষকে বিভ্রান্ত করেছে। সাধারণ মানুষ ভাবে সৃষ্টির আদিতে বিগব্যাঙ্গের বিস্ফোরণের অর্থ হল পাহাড়পর্বত বনবৃক্ষ আকাশ সাগর নদী পশুপাখি জীবজন্তু, সবকিছু মিলে যা বোঝায় তার জন্ম। না, শুধু তা নয়। বিগ ব্যাং মানে শুধু বস্তু নয়, স্থান (space), এবং কাল (time)ও।

 

কিন্তু বিগব্যাং বলে একটা জিনিস যে সত্যি সত্যি ছিল তারই বা প্রমাণ কি—এ হল দ্বিতীয় প্রশ্ন। স্বচক্ষে দেখবার তো কোনও উপায় নেই, তাই একটা পরোক্ষ সাক্ষ্য দরকার। সেটা নাহলে আমরা কি করে মেনে নেব যে এমন একটা বড় ঘটনা সত্যি সত্যি ঘটেছিল? বলা বাহুল্য যে এ বড় শক্ত পরীক্ষা। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা অনেক তেলখড়ি পোড়াবার পরই পেয়েছিলেন আমাদের এই নিজস্ব গৃহ—ছায়াপথের খবর। হাবল সাহেব যা পেলেন সে তুলনায় তো এটা ছেলেখেলা মাত্র। বিশাল প্রতিভা নিয়ে যাদের জন্ম তাদের পক্ষে সব অসম্ভবই বোধ হয় একদিন সম্ভব হয়ে যায়। কিন্তু ১৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ আগেকার ঘটনা? তার স্বাক্ষর কি কারুর পক্ষে পাওয়া সম্ভব কোথাও?

 

কিন্তু মানুষ সবই পারে—দুঃসাধ্য বলে সত্যি সত্যি কিছু নেই তার অভিধানে। মেধার সাথে সাধনা আর অধ্যবসায় মেশাতে পারলে সব অসাধ্যকেই একসময় সাধ্যের আওতায় নিয়ে আসা যায়। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের কতিপয় জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী চিন্তাভাবনা শুরু করলেন বিগ ব্যাঙ্গের কোন লক্ষণ পাওয়া যায় কিনা কোনও ভাবে। বিশেষ করে রবার্ট ডিকি ও জিম পিবিল্‌স্‌ নামক দুজন তরুণ বিজ্ঞানী একেবারে কাছা বেঁধে লেগে গেলেন পরকল্পনাটি নিয়ে। তাঁরা যুক্তি দাঁড় করালেন এভাবেঃ বিগ ব্যাঙ্গের অব্যবহিত পরের মুহূর্তে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কি অবস্থা ছিল। সেটা অনুমান করাও শক্ত, তবে একটা জিনিস পরিষ্কার—-তাপ এবং বস্তুর ঘনত্ব একেবারে মাত্রাছাড়ানো অবস্থাতে ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাপের সেই প্রচণ্ডতার কারণে যে আলো বিচ্ছুরিত হবার কথা সে আলোর ছিটেফোঁটা বিকিরণ এত এত আলোকবর্ষ পরেও একেবারে মুছে যাওয়া সম্ভব নয়। খুব দুর্বল হলেও তার স্বাক্ষর কোন-না-কোনও ভাবে কোথাও-না-কোথাও পাওয়ার কথা। এর একটা নামও দিয়ে ফেললেন তাঁরা—cosmic background radiation ( মহাজাগতিক আদিবিকিরণ)। তাঁরা অনুমান করলেন যে সে আলোর তাপ কমতে কমতে হয়ত একেবারে শূন্যের কাছে চলে এসেছে—শূন্য মানে লণ্ডন-নিউইয়র্কের শীতকালের শূন্যমাত্রা নয়, লর্ড কেলভিনের পূর্ববর্নিত শূন্য—-আনুমানিক -২৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অত্যন্ত সূক্ষ্ণ ‘থার্মোমিটার’ ছাড়া এই তাপ যান্ত্রিকভাবে পাওয়া সম্ভব নয়। সেরকম যন্ত্র কোথায়? না, প্রিন্সটনের অধ্যাপকরা তখন সক্ষম হননি সেরকম শক্তিশালী যন্ত্র তৈরি করতে। কিন্তু তাঁরা পেপার লিখে প্রচার করে দিলেন যে এভাবেই বিগ ব্যাঙ্গের পদচিহ্ন আবিষ্কার করা সম্ভব—সেরকম সূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি যদি কেউ বের করতে পারেন তাহলে হয়ত আলোকরশ্নির মাইক্রোওয়েভ অঞ্চলে খোঁজ করলে এর সাক্ষ্য উদ্ধার করা অবাস্তব নয়। খবর পেয়ে তত্‌ক্ষনাত্‌ কাজে লেগে গেলেন নিউ জার্সির দুজন তরুণ গবেষক—আর্নো পেঞ্জিয়াস(১৯৩৩-) ও রবার্ট উড্র উইলসন (১৯৩৬-)। বিরাট এক টাওয়ার দাঁড় করালেন তাঁরা ল্যাবের চত্বরে—সূক্ষ থেকে সূক্ষতর সিগন্যাল যাতে ধরা যায় এমন শক্তিশালী এন্টেনা সহকারে। প্রথম কয়েকটি পরীক্ষাতে তাঁরা একরকমের দুর্বল, অতি, অতি দুর্বল, আওয়াজ(background noise) পেলেন বটে, কিন্তু তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেননি এটা কিসের শব্দ। অনেকটা রেডিওতে যেমন হিস হিস শব্দ শোনা যায় মাঝে মাঝে, যাকে আমরা ‘স্ট্যাটিক’ বলে থাকি, সেরকম। তাঁরা ভাবলেন হয়ত নিউ ইয়র্ক শহরের হাজার কোলাহলের কারণেই এই উতপাত। তাঁরা লোকজন লাগিয়ে জায়গাটা এমনভাবে ঘেরাও করে ফেললেন যে নিউ ইয়র্কের কোন শব্দ, আলো বা অন্যান্য ইলেক্ট্রিক গোলযোগের প্রভাবে তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু তার পরও সেই একই ক্ষীণ শব্দ। তখন তাদের মনে পড়ল এ অঞ্চলে খুব কবুতরের উপদ্রব। ওরা তো অহরহই বিষ্ঠা ফেলে যাচ্ছে যেখানে সেখানে। হয়ত কবুতরের ফেলেযাওয়া বিষ্ঠার কারণেই এন্টেনাগুলো ঠিক কাজ করতে পারছে না। তখন তাঁরা সিদ্ধান্ত নিলেন সেই এন্টেনার ওপরে বসা কবুতরগুলোকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। ( এই আপাতনিষ্ঠুর সিদ্ধান্তের জন্যে বিজ্ঞানীরা পরে রসচ্ছলে একে অন্যকে দায়ী করেছিলেন, যদিও সিদ্ধান্তটি আসলেই ছিল তাঁদের দুজনেরই)। কিন্তু মজার ব্যাপার যে তাতেও কোনও কাজ হল না। তার পরও সেই একই মৃদু, করুণ শব্দ, যেন দূর, বহুদূর থেকে কোনও মুমূর্ষু প্রানী গলা দিয়ে কষ্টে একরকম খসখসে শব্দ করছে। অনর্থক এতগুলো কবুতরের প্রাণ গেল এক ব্যর্থ পরীক্ষার জন্যে।

 

কিন্তু না, ব্যর্থ মোটেও না। বরং ঠিক এটাই আশা করছিলেন প্রিন্সটনের সেই বিজ্ঞানী যুগল। বেল ল্যাবের এই ঘটনাটির পুরোপুরি ব্যাখ্যা পেনজিয়াস আর উইলসন নিজেরা ততটা বুঝতে পারেননি, বুঝেছিলেন প্রিন্সটনের ডিকি সাহেব। বেল ল্যাবের খবর পেয়ে তিনি উল্লাসে আত্মহারা—পেয়েছি পেয়েছি বলে আর্কিমেডিসের মত চিত্‌কার করার অবস্থা। বেলল্যাবের দুই বিজ্ঞানী, যাঁরা ছিলেন প্রধানত প্রকৌশলি, তাঁরা এই ফলাফলগুলো নিয়ে পেপার লিখলেন জার্নালে। ১৯৭৮ সালে এই যুগান্তকারি কাজটির জন্যে তাঁরা পেলেন নোবেল প্রাইজ—প্রিন্সটনের বিজ্ঞানীরা পেলেন সহবিজ্ঞানীদের প্রশংসা ও সহানুভূতি।

 

বিগ ব্যাঙ্গের বিতর্কটি মীমাংসা হয়ে গেল এতে। কিন্তু তাই কি? একটা প্রশ্ন মিটে গেলে আরেকটা প্রশ্ন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে–এটা তো চিরকালই ঘটে আসছে। জ্ঞানবিজ্ঞানের সব শাখারই মৌলিক ধারা এটি। প্রশ্ন থাকে বলেই গতি থাকে, এবং গতির ধারাতে আসে প্রগতি। বিগব্যাং সংক্রান্ত যে প্রশ্নটা খুবই স্বাভাবিক বলে মনে হয়, অন্তত আমার কাছে, সেটা হল এইঃ একটা মাত্রাবিহীন শুন্য আয়তনের ভেতরে এত এত বিশাল বস্তু যে জমা হল এগুলোই বা এল কোত্থেকে? এই অবর্ণনীয় ওজনের বস্তুজগত, বিন্দুর কোঠরে ঘাপটি মেরে বসে থাকা, এর উত্‌স কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব কোথাও আছে কিনা জানিনা। ধর্মবিশ্বাসীরা কি বলবেন সেটা অনুমান করা শক্ত নয়, কিন্তু এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে কেউ দিতে পেরেছেন বলে মনে হয়না। একটা সম্ভাবনার কথা অনেকেই বলছেন। বিগব্যাঙ্গের ক্ষুদ্র পরিসরে উর্ধাকাশের সব আইনকানুনই অচল হয়ে যায়। সোটা হল কুয়ান্টাম জগত। প্প্লাঙ্ক, শ্রেডিঙ্গার আর হাইসেনবার্গের উদ্যান। একটু আগেই তো দেখলাম আমরা, কেমন করে অনিশ্চয়তা সূত্র কুয়ান্টাম বিজ্ঞানের অন্যান্য নিয়মাবলীর সঙ্গে মিলে একপ্রকারের ‘গায়েবী’ কণা (virtual particles) সৃষ্টি করতে পারে। কে জানে, সৃষ্টির আগে হয়ত এই সব লক্ষ কোটি নির্বুদ অর্বুদ কণাসমূহের সম্মিলিত উপস্থিতিই সূচনা করেছিল মহাসৃষ্টির আয়োজন। তবে যাতে আর কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই, সেটা হল যে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মহাযাত্রার আদিমতম ইতিহাস সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র শূন্যের গর্ভে। শূন্য আমাদের আদিজনক।
এই কি শেষ প্রশ্ন? তা কি হয় কখনও। ওই যে বললাম, এক প্রশ্ন জন্ম দেয় আরেক প্রশ্নকে। এতক্ষণ আমরা জন্মের গল্প বললাম। বললাম দ্রুত সম্প্রসারণের গল্প। রাবারের বল কেবলি ফুলছে, ফুলছে আর ফুলছে। এই ফোলা কি অনন্তকাল চলবে? এই চলার জন্যে যে শক্তি আর তেজের প্রয়োজন তারই বা জোগান দেবে কে? না, এই স্ফীতির একটা সীমা থাকতেই হবে। অনেক বিজ্ঞানীর ধারণা, একটা সময়সীমা পার হলে, সূর্যসহ অন্যান্য তেজী নক্ষত্রাদির জ্বালানি শক্তি যখন নিঃশেষ হয়ে যাবে, তখন মহাবিশ্ব(universe) নামক বিপুলাকার বস্তুটির প্রসারণের তেজ হ্রাস হতে হতে এমন একটা পর্যায়ে চলে আসবে যে প্রসারের ঠিক উল্টোটাই শুরু হয়ে যেতে পারে—‌ সঙ্কোচন। আজকে যেমন প্রসারণের গতি রোধ করা যাচ্ছে না, একদিন সঙ্কোচনের গতিও রোধ করবার ক্ষমতা থাকবে না কারুর। এবং সব নাটকেরই সাঙ্গ হবে এক মহাসঙ্কোচনের মধ্য দিয়ে—যাকে বলা হয় Big Crunch. এক শুন্যতে জন্ম নিয়ে আরেক মহাশূন্যতায় মিলিয়ে যাবে অস্তিত্বের প্রতিটি অঙ্গ। মাটি থেকে মাটি নয়, নয় ভস্ম হতে ভস্ম—এ হবে একেবারেই নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া, সব খেলারই শেষ খেলা। কেউ নেই, কিছু নেই, কেবলি শূন্য, মহাশূন্য!

পঁচিশ

ভয় নেই। বর্তমান সরকারের আমলে তা ঘটবে না। দশ কোটি বছর পরে যদি জীবজন্তু বলে কিছু বেঁচে থাকে তখনও সেটা ঘটবে কিনা সন্দেহ। একেবারেই ঘটবে কিনা কোনও দিন তাই বা হলপ করে কে বলতে পারে। আগের অধ্যায়ের সব আলোচনাই তো একহিসেবে তাত্বিক—-সর্বাংশে সত্য সেরকম দাবি জোর দিয়ে করা সম্ভব নয়। হবার সম্ভাবনা আছে, কোনটার কম, কোনটার বেশি্‌, কিন্তু ধ্রুব নিশ্চয়তার দাবিদার কোনটাই নয়। এমনও তো হতে পারে যে আজ থেকে একশত বছর পর কেউ আবিষ্কার করবেন এক অত্যাশ্চর্য যন্ত্র যাতে করে ১০^(-৩৩) সেন্টিমিটার দীর্ঘ স্ট্রিঙ্গের খোঁজ পাওয়া সম্ভব হয়ে যাবে। তখন কি কেউ শূন্যের দৌরাত্ন্য নিয়ে কারো মাথা ঘামাবার প্রয়োজন হবে? তখন বিগ ব্যাং আর বিগ ক্রাঞ্চ সবই ইতহাসের বর্জ্যদ্রব্যের আস্তাকুঁড়ে নির্বাসিত হবে। কে জানে? আপাতত মনে হচ্ছে শূন্যকে সাথে নিয়েই আমাদের যাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।

তথ্যসূত্র
(প্রধান সূত্র)1. Charles Seife, “ Zero: the biography of a dangerous idea”, Penguin Books, 2000
(অন্যান্য সূত্র)
2.Carl B. Boyer, (revised by Uta C. Merzbach), “ A History of Mathematics”, 2nd ed., John Wiley and Sons, 1968, 1989, 1991.
3.Ronald W. Clark, “Einstein, The Life and Times”, Thomas Y. Crowell Company, New York, 1971.
4.Funk and Wagnalls New Encyclopedia, Funk and Wagnalls, Inc. New York, 1973.
5.Richard P. Feynman, “QED: The Strange Theory of Light and Matter”, Princeton University Press, 2006.
6.Stephen Hawking, “A Brief History of Time”, Bantam Dell Publishing Group, 1988.
7.D.E. Smith, “History of Mathematics” , vol.2, Dover Publications, Inc., New York, 1958.
8.Simon Singh, “ Big Bang—The Origin of the Universe”, Harper Perennial, London, 2004.
9.The World of the Atom, Ed. Henry A. Boorse and Lloyd Motz, Basic Books, Inc., Publishers, New York, London, 1966.
10. Internet.

 

সমাপ্ত