করিম সাহেব খুবই ব্যস্ত। স্ত্রীর উদ্দেশ্যে হাক ছেড়ে বললেন। কই! আমার পাঞ্জাবিটা আয়রণ করা হল? হাতে একদম সময় নেই। আজ ভাগ্য রজনী। এ রজনীতে আল্লাহ তায়ালা নির্ধারন করেন জন্ম-মৃত্যু। রুটি-রুজি, জীবনের সাথে জড়িত সব কিছু। সারাবছরের গুনাহও আল্লাহ তায়ালা এ রাতে ক্ষমা করে দিবেন। সকল সগীরা গুনাহ নেকীর সাথে অদল বদল করা হয় এ রাতে।

করিম সাহেব আতর লাগাতে লাগাতে আবার হাক ছাড়তেই দেখতে পেলেন বেগম সাহেবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন। হাতে তার আয়রণ করা সাদা পাঞ্জাবী। স্ত্রীকে বললেন ড্রাইভারকে বল পাজারোটা বের করতে। স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই করিম সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এ বছর তার ভাগ্য মোটেও ভাল ছিল না। মেঝ ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন পড়ালেখা করতে। লোক মারফত খবর পেয়েছেন সে নাকি পড়ালেখার টাকা জুয়া খেলেই উড়িয়ে দেয়। কয়েকদিন পর পর টাকা চেয়ে চিঠি পাঠাতো সে। টাকার প্রয়োজন মেটাতে করিম সাহেব চা-পানির মুল্য বৃদ্ধি করে দেন। রাজধনীর উন্নয়নে জড়িত একটি সংস্থার সদস্য তিনি। ক্ষমতার সাথে সেলারি মানানসই নয় বলে আয়ের সিংহভাগ জনগণের বহন করা উচিত বলে তিনি মনে করেন। এদিকে মেয়েটাও দিনে দিনে বখে যাচ্ছে। নাজমুল সাহেবের ছেলেটার সাথে একদিন রাস্তায় দেখেছেন। মেয়েকে কঠিনভাবে শাসিয়ে দেন সেদিন। শুনেছেন ছেলেটি অনেক মেধাবী। তাতে কি! নাজমুল সাহেব তার চেয়ে ছোট পোস্টে চাকুরি করেন। করিম সাহেবের পারিবারিক স্ট্যাটাস এর সাথে ঠিক যায় না। সবকিছুর উপর তার শরীরটা ভীষণ খারাপ যাচ্ছে। ছেলে মেয়েদের জন্যে চিন্তা হয়। যদিও তার ব্যাংক ব্যালান্সে নাতি-নাতনীরও জীবন পার হয়ে যাবে। তাছারা বড় ছেলেটাকে তদবিরের জোরে বি.আর.টি.এ তে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তবুও নিজের ভাগ্য খারাপ বলেই মনে হচ্ছে। তাই আজ সারারাত মসজিদে কাটাবেন বলে ঠিক করেছেন।

যাবার জন্যে তৈরী হয়ে খাটের কিনারায় বসলেন করিম সাহেব। স্ত্রীকে বলেছেন আজ ভাল ভাল রান্না করতে। এ রাতে যারা ভাল ভাল রান্না করে সারা বছর আল্লাহ তায়ালা তাদের ভাগ্যে ভাল ভাল খাবার লিখে রাখেন। স্ত্রীর হাতে বানানো গরম রুটি আর হালুয়া খেয়ে করিম সাহবে কবরস্থানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

প্রচন্ড ভীড়ের কারনে করিম সাহেবকে মেইন রোডে নামতে হল। ড্রাইভারকে মসজিদের কাছে গাড়ি নিয়ে যেতে বলে হাঁটা শুরু করলেন করিম সাহেব। কবরস্থানের গেটের কাছে আসতেই তাজ মিয়াকে চোখে পড়ল তার। বেশ অবাক হলেন তাকে দেখে। করিম সাহেবেকে দেখে তাজ মিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল।

কেমন আছেন স্যার? তাজ মিয়া জিজ্ঞেস করল।

-ভাল। তুমি এখানে কেন? তোমার ছেলেটাকে না চাকুরি দিলাম।

স্যার পোলাডা সাত মাস আগে এক্সিরেন্ট কইরা মইরা গেছে। গরিবের কি আর ভাগ্য খুলে।

কিছুটা বিমর্ষ বোধ করলেন করিম সাহবে। গত বছর দৈহিক সমস্যা সম্বলিত হাজারো ফকিরের মাঝে তাজ মিয়াকে তার চোখে পড়েছিল। দু’পা ও এক চোখহীন এ ফকিরটি একটা সাইনবোর্ড নিয়ে বসেছিল। তাতে লিখা ছিল, আমার এ+ পাওয়া ছেলেকে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহনে সাহায্য করুন। করিম সাহেব পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছেন যে তাজ মিয়ার ছেলে দুটো পাবলিক পরীক্ষাতেই এ+ পেয়েছে। পড়ালেখার প্রাথমিক খরচ যোগানোর জন্যে বাবাকে ভিক্ষা করতে পাঠিয়েছিল সে। এ কথা জানার পর তিনি ছেলেটাকে একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেন। আর বলে দেন বাবাকে যেন ভিক্ষা করতে না পাঠায়।

-এখানে বসে ভিক্ষা করলে ভাগ্য পরিবর্তন হবে? যাও, কিছু নামাজ কালাম পড়। এগুলা কর না দেইখাই তো তোমার ভাগ্য পরিবর্তন হইতে গিয়াও হইল না। নামাজ কালাম না পড়লেতো পরকালও হারাইবা।

স্যার। আমাগো ভাগ্যতো এই রাইতেই কিছুডা ভালা অয়। সারা বছর এত কামাই করবার পারিনা।

করিম সাহেব এবার বিরক্ত হলেন। তাজ মিয়াকে একশ টাকা দিয়ে করিম সাহেব বিদায় নিলেন। মা-বাবার কবর জিয়ারত করে মসজিদের উদ্দেশ্যে আবার হাঁটা শুরু করলেন। অনেকক্ষণ এসিতে না থাকায় বেশ হাপিয়ে উঠলেন করিম সাহেব। হঠাৎ বুকে ব্যাথা অনুভব করলেন। মসজিদের কাছে এসে জ্ঞান হারালেন।

সেই রাতে আল্লাহ তায়ালা নতুন করে ভাগ্য লিখলেন কিছু মানুষের। করিম সাহেব ফজরের সময় মারা গেলেন। পারিবারিক মর্যাদা রক্ষা করতে করিম সাহেবের বড় ছেলে কিছুদিন পর বোনকে বিদেশে মেঝ ভাই এর কাছে পাঠিয়ে দিল। বোনের দায়িত্ব কাধে চাপায় সেও সংযত জীবন যাপন শুরু করল। আর তাজ মিয়া…পরের শবে বরাতে অপেক্ষায় রইলেন করিম সাহেবের। এ জন্যে গেটের কাছে জায়গাটা পেতে তার অনেক যুদ্ধ করতে হয়। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় যুদ্ধ তিনি আরেকবার করেছিলেন। তিরিশ বছর আগে এ দেশকে স্বাধীন করতে…

[আমার সম্পূর্ণ কাল্পনিক চিন্তাভাবনার ফসল। গল্প লিখতে পারিনা। তারপরেও বাস্তবে এর কাছাকাছি ঘটনাগুলো নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছা হয়। তাই লিখলাম।]