আজ থেকে প্রায় বত্রিশ বছর আগে ঢাকা কলেজের এক নবীন শিক্ষক পা বাড়িয়েছিলেন নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে। আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি, অনেকেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু উচ্চাভিলাষী এই অধ্যাপক স্বপ্ন দেখেছিলেন মানুষের মাঝে স্বপ্ন সৃষ্টি করার, তাদের হৃদয়ের মাঝে থাকা আগুনকে হাওয়া দিয়ে আলো তৈ্রি করার এবং আলোকিত মানুষ তৈ্রী করার। তাই তিনি “আলোকিত মানুষ চাই” এই প্রত্যয় নিয়ে গড়ে তোলেন “বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র” নামে একটি সংস্থা।
তিনি বুঝতে পেরেছিলেন দেশকে সত্যিকার সোনার বাংলা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে আলোকিত মানুষ প্রয়োজন। আর তিনি জানতেন বই ছাড়া আর কোন জিনিস মানুষের মাঝে গভীর চিন্তা, দর্শন, ঊপলব্ধি, অনুভূতি, মননশীলতা ও বৈশ্বিক চেতনা তৈরী করতে পারেনা। তাই তিনি একটি পাঠাগার স্থাপনের চিন্তা করলেন যেখানে বাংলাদেশের এবং বিশ্বসাহিত্যের উল্লেখযোগ্য কিছু বই সদস্য পাঠকদেরকে পড়ার সুযোগ দেয়া হবে। এজন্য প্রথমেই দরকার অর্থ। আর পাঠাগারের জন্য অর্থ সংগ্রহ করা কতটা দূরুহ কাজ তা সবারই জানা থাকার কথা। কিন্তু অদম্য প্রাণশক্তির অধিকারী দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এই ব্যাক্তি নিজ উদ্যোগে মাত্র ৩৫ টাকা দিয়ে কিছুসংখ্যক বই কিনে পাঠাগারের কাজ শুরু করলেন। তার এই কাজ অনেকের কাছে ‘পাগলামি’ বলে পরিচিত হয়েছিল। যা হোক, বই তো কিছু কেনা হল কিন্তু পাঠকের অভাব রয়েই গেল। তাই তখন তিনি পাঠকদের আসার অপেক্ষা না করে নিজেই পাঠকের দোরগোড়ায় যাবার উদ্যোগ নিলেন। এভাবেই শুরু হল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমান পাঠাগার যা বাস এ করে বই নিয়ে গেল ঢাকা শহরের কিছু এলাকার কিছু নির্দিষ্ট জায়গায়, একেবারে পাঠকদের হাতের নাগালে। এধরণের ভ্রাম্যমান পাঠাগার এদেশে ছিল সেই প্রথম এবং এখনো একমাত্র। এভাবে পাঠকদের কাছাকাছি চলে যাওয়ার ফলে ধীরে ধীরে পাঠকসংখ্যা বাড়তে থাকল। তিনি এ কার্যক্রমের আওতায় স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদেরও নিয়ে এলেন। স্কুলের ৬ষ্ঠ-১২শ শ্রেণীর ছাত্র-ছাত্রীরা শুধুমাত্র ১০ টাকার বিনিময়ে সদস্য হয়ে প্রত্যেক শ্রেণীর জন্য নির্ধারিত বইগুলো পড়তে পারে। আমার জানামতে এখন পর্যন্ত দেশের প্রায় ২২০০ স্কুল-কলেজ এই কর্মসূচীর আওতাভুক্ত এবং এই সংখ্যা এ বছর ১০,০০০ এ উন্নীত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে তাঁর শুরু করা বিপ্লবের ছোট্ট অগ্নিস্ফুলিঙ্গ দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ল বাংলাদেশের আনাচে কানাচে। সেদিনের সেই ৩৫ টাকা দিয়ে শুরু করা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র আজ ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ভবনে এদেশের পড়ুয়া শ্রেণীর জন্য দেশের ও বিশ্বের উল্লেখযোগ্য হাজারো বই সন্নিবেশিত এক স্বপ্নরাজ্য তৈ্রি করছে।
যিনি এই অসাধারণ কাজটি শুরু করেছিলেন, এগিয়ে নিয়ে এসেছেন এ পর্যন্ত, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সাথে যার নাম ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে তিনি হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় লেখক স্যার আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। টেলিভিশন অনুষ্ঠান উপস্থাপনার খ্যাতি তথা ‘স্টারডম’(স্যারের ভাষায়) দিয়ে তিনি এই কেন্দ্র পরিচালনা করেছেন এর শুরুর দিনগুলোতে। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রম ও নিষ্ঠার ফল হিসাবে একদা ‘পাগলামি’ বলে পরিচিত এ কর্মসূচী আজ শুধু দেশের অসংখ্য পাঠক ও সাহিত্যিক মহলেই নয় বরং আন্তর্জাতিক মহলেও ভূয়সী প্রশংসা অর্জন করেছে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজের মাঝে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করার জন্য এবং বাংলাদেশের ও বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম বইগুলো পড়ার সুযোগ করে দেবার জন্য আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদকে সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সৃজনশীল যোগাযোগ বিষয়ক কলা (Journalism, Literature and the Creative Communication Arts)ক্ষেত্রে ৯৭তম Ramon Magsaysay Award দেয়া হয় ২০০৪ সালে। আর ২০০৮ সালে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র অর্জন করে ইউনেস্কোর Jan Amos Comenius Medal.
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র কয়জন আলোকিত মানুষ তৈ্রি করতে পেরেছে জানিনা কিন্তু আমি এই সংস্থাটির প্রতি এবং এর প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রতি চির শ্রদ্ধাশীল এবং কৃতজ্ঞ। কারন এর স্কুল কর্মসূচী আমার সামনে বই পড়ার অবারিত সুযোগ করে দিয়েছিল সেই সময়ে যখন আমার বাড়িতে পাঠ্যবই ছাড়া অন্য কোন বই(যা অধিকাংশ মা-বাবার কাছে অবশ্য পরিত্যাজ্য ‘আউট বই’ হিসেবে পরিচিত)পড়া ও কেনা নিষিদ্ধ ছিল। সেই সময়ে টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে রীতিমত অমূল্য (!!) ১০ টি টাকা দিয়ে নিজের জন্য নানা রুচির ও স্বাদের বই অসাধারণ সব বই পড়ার অমূল্য সুযোগ কিনে নিয়েছিলাম। বস্তুত আমার অনুভূতি, চিন্তা, মূল্যবোধ ও উপলব্ধির যতটুকুই বিকাশ হয়েছে তার ভিত্তি ছিল বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের সেই অমূল্য সুযোগ। (অবশ্য কত রকম উপায়ে বাবা-মাকে ফাঁকি দিয়ে তাদের মার ও বকার হাত থেকে বেঁচে গল্পের বই পড়া যায় এই বুদ্ধিটির বিশেষ বিকাশ ঘটেছিল!) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের স্কুল কর্মসূচীতে প্রতি শ্রেণীর জন্য নির্দিষ্ট বইগুলোর উপর নির্দিষ্ট সংখ্যক সপ্তাহ পরে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় এবং এর ফলাফলের ভিত্তিতে ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কার দেয়া হয় যা ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে প্রথমবার পুরস্কার পাওয়াতে যতটা অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছিলাম আম্মুর ধারণার কিঞ্চিত পরিবর্তনে যে গল্পের বই পড়ে কিছুটা হলেও লাভ হয়েছে! আর আম্মু যখন দেখল যে আমি একাই নিজের পড়া-লেখা নষ্ট (!) করিনি, আরো লাখো ছেলে-মেয়ে এই কর্মসূচীর সাথে জড়িত। এরপর থেকে আব্বু গল্পের বই পড়ার জন্য বকা দিত তখন আম্মু মাঝে মাঝে আমার পক্ষ নিত। আর আমিও প্রতি বছর সদস্য হয়ে বই পড়তে থাকলাম এবং পুরস্কার পেতে থাকলাম। এর পরে স্কুলের এক বইমেলায় বই কেনার জন্য আম্মু আমাকে টাকা দিয়েছিল, আর একবার আমাকে একটা ‘তিন গোয়েন্দা’ কিনে দিয়েছিল! আজ যখন আমি প্রতি মাসে কয়েকটা করে বই কিনি আর আমার আম্মু আমার বইপত্র গুছিয়ে রাখে তখন আমি আমার ছোটোবেলার দিনগুলোর কথা, আম্মুর দেয়া সেই বইয়ের কথা এগুলো মনে করি আর আবারো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতি কৃ্তজ্ঞতা জানাই, স্যারকে শ্রদ্ধা জানাই। কিছুদিন আগে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রের সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে স্যারকে যখন আমার মায়ের এই পরিবর্তনের কথা বললাম তিনি খুবই খুশি হয়েছিলেন।

আজ ২৫ শে জুলাই, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের জন্মদিন। এই অসাধারণ স্বপ্নবাজ মানুষটিকে তাঁর জন্মদিনে জানাই অশেষ শুভকামনা এবং শ্রদ্ধা। তিনি আলোর স্বপ্ন দেখেছিলেন, আর আজ তার স্বপ্নের আলো ছড়িয়ে পড়ছে সকল আলোকিত ও আলোকপ্রত্যাশী মানুষের মাঝে, এ আলো আরো ছড়াক এই কামনা করি।