কোরান ওনলি মুসলমান-ধারনাটির ইতিহাস সম্পর্কে আমার ভাল ধারণা নেই। কে বা কারা এর প্রধাণ প্রবক্তা তাও জানিনা। ধারণাটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়েছে বছর পাঁচেক আগে। কিন্তু তখন আমার কাছে ধারণাটিকে খুব একটা সম্ভাবনাময় কিছু বলে মনে হয়নি। সম্প্রতি মুক্তমনার মাধ্যমে এই চিন্তা ও এর অনুসারীদের সাথে সরাসরি পরিচয় ঘটে। চিন্তাটা বেশ অভিনব, আর এর অনুসারীরাও যথেষ্ট আধুনিক। বোধ,বুদ্ধি, রুচি সবকিছুতে আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। মানে আপনি তর্ক চালিয়ে যেতে পারবেন। কারণ আধুনিকতা সম্পর্কে আপনার পূর্ব ধারণা, আধুনিকতার ছাপ দ্বারা বিভ্রান্ত হবে। ছাপ ভেদ করে অরো ভিতরে প্রবেশ করার পরে আপনি আপনার ভুল বুঝতে পারবেন। যেহেতু আপনার কাছে আধুনিকতা মানে ইউরোপের শিল্প বিপ্লব ও তা থেকে অনুপ্রাণিত বৌদ্ধিক বিকাশ, যেটাকে পাশ্চাত্য সভ্যতার অঙ্গীভূত করে দেখা হয়। যেমন গনতন্ত্র, ব্যাক্তি স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, বিজ্ঞাণ মনস্কতা, নারী মুক্তি, আইনের শাসন ইত্যাদি যাবতীয় মূল্যবোধ, যাকিছু এখন আর পাশ্চাত্যের একক কোন সম্পদ নয় বরং মানবজাতির উন্নয়ণের মাণদন্ড বলে আপনিও মনে করেন। এই আপনি আপনার যাবতীয় পরমত সহিষ্ণুতা সত্ত্বেও যীসুর জন্ম বৃত্তান্তের ধর্মীয় উপাখ্যানকে মেনে নিতে পারবেন না, যেমন সম্ভব হবে না তাঁর মৃতকে জিবীত করার মহান কাহিনীকে মেনে নেয়া। কারণ আধুনিকেরা জানতে চায় মূলত কোন প্রক্রিয়াতে এমনটি ঘটেছিল। জানাটা এমন হতে হবে যেন আবার ঐ একই ব্যাপার প্রকাশ্যে ঘটান যায়। কিন্তু কারণ হিসাবে যখন পাওয়া যায় কেবল মাত্র ব্যাখ্যাতীত কোন স্বর্গীয় প্রেরণা তখন তারা উৎসাহ হারিয়ে ফেলে এবং আগ্রহের তালিকা থেকে একে বাদ দেয়।

বিজ্ঞাণের সীমাবদ্ধতা নিয়ে একটা অভিযোগ এই ছাপওয়ালাদের তরফ থেকে প্রায়ই করা হয় যে, মৃত্যুর পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে বিজ্ঞাণ আমাদেরকে কিছুই বলতে পারেনা। আসলে মৃত্যুর পরে একটা জীব দেহে কি ধরণের পরিনতি ঘটে তা বিজ্ঞাণ ঠিক ঠিক বলে দিতে পারে কিন্তু তা অনেকের কাছেই যথেষ্ট না। তারা এমন কিছুর ব্যাপারে জানতে চায় যা তারা আজো নিশ্চিৎ করে বলতেই পারেনি। যেমন আত্মা, আত্মার যে সকল ব্যাখ্যা এযাবৎ হাজির করা হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত কোন স্পষ্ট অবয়ব ধারণ করার আগেই মিইয়ে যায়। অর্থাৎ বিজ্ঞাণকে এমন কিছুর জন্য ব্যার্থতার দায় নিতে বলা হয়, যেটা সমস্যা হিসাবেই পরিস্কার না।

আধুনিকতার ছাপওয়ালারা সবসময় নিজেদেরকে একটা সামগ্রীক ধারনায় উপনীত দেখতে চান। বিশ্বজগতের এমন একটা ব্যাখ্যা তারা খোঁজেন যাতে তারা সন্তুষ্ট। সেই ব্যাখ্যাটা মোটামুটি এরকম – কোন একজন স্রষ্টা, অতি অবশ্যই একজন এই বিশ্বের সমস্ত কিছুকে সৃষ্টি করেই কেবল ক্ষান্ত হননি বরং এদের বিচার করার জন্য নিদৃষ্ট সময়ের অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে বসে আছেন। আরো অভিনব ব্যাপার হচ্ছে এই স্রষ্টা একখানা গ্রন্থ মানব জাতির জন্য দিক নির্দেষনা হিসাবে প্রেরণ করেছেন। কিভাবে এবং কোন প্রক্রিয়াতে তিনি এই গ্রন্থ প্রেরণ করেছেন এসবই গুরুত্ত্বহীন প্রশ্ন। একমাত্র গুরুত্ত্বপূর্ন ব্যাপারটি এখানে এই মহিমান্বিত গ্রন্থটি সয়ং। এমন কি এতে যা কিছু বলা আছে তাও গ্রন্থটির মত সমান গুরুত্ত্বপূর্ন নয়। এই গ্রন্থের সবচেয়ে বড় মহিমা হচ্ছে এটি স্রষ্টা কতৃক রচিত ও সংরক্ষিত ছিল। উপযুক্ত পরিবেশ ও পরিস্থিতীতে ক্রমাগত আসমান থেকে জিবরাইলের পাখায় ভর করে নেমে এসেছে। এই ছাপওয়ালাদের বিশ্বাস, আস্থা ও ভক্তি যা কিছে এভাবে আসমান থেকে নেমে আসে, তার প্রতি। লালসালু উপন্যাসের মজিদ যেভাবে মধ্য দুপুরে বড় রাস্তা থেকে নেমে আসে অথচ গ্রামবাসীর বেশী পছন্দ হতো যদি সে গাছ থেকে নেমে আসত। ঠিক অনুরূপ আস্থা লক্ষ্য করা যায় এইসব ছাপওয়ালাদের মাঝে। যীসুর জন্ম বৃত্যান্ত তারা এজন্যই কেবল মেনে নেন যেহেতু তা এই গ্রন্থ কতৃক সত্যায়িত। আর গ্রন্থটি যেহেতু আসমানি ফলে ২ + ২ = ৪, একেবারে হাতে নাতে প্রমাণ।

আসলে এই গ্রন্থের ব্যাপারে অন্য সব মুসলমানদের থেকে এই ছাপওয়ালাদের চিন্তায় মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। তাদের নিয়ে আলাদা ভাবে আলোচনার কারণ, তারা নাকি এই গ্রন্থখানি ছাড়া আর কোন কিছুতে বিশ্বাস করেন না। এমন কি হাদিসও না। এইখানে এসে তারা মুসলমানদের অন্য সব প্রজাতি থেকে নিজেদেরকে আক্ষরিক অর্থেই আলাদা করে ফেলেন। যেহেতু আল্লাহ সয়ং হাদিসের বিশুদ্ধতা রক্ষার দায় নিজে গ্রহন করেন নি, যেমনটা করেছেন কোরানের ক্ষেত্রে, ফলে এর বিশুদ্ধতে প্রশ্নবিদ্ধ। আর তাছাড়া হাদিস যেভাবে সংগ্রহ করা হয়েছে এবং এই সংগ্রহ আন্দোলনের সময়কাল, কোন কিছুই এর বিশুদ্ধতার ব্যাপারে গ্যারান্টি দেয় না, যেমনটা জিবরাইল মারফত নবি মোহাম্মদের কাছে আল্লাহর বানী পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে ঘটে ! হাদিস সংগ্রহের প্রক্রিয়াটিযে কেবল প্রশ্নবিদ্ধ তাই নয়, বরং যা কিছু তারা হাদিসের নামে সংগ্রহ করেছে তা ক্ষেত্র বিশেষে নবি মোহাম্মদ ও আল্লাহর বানী সংকোলন উভয়ের জন্য চূড়ান্ত মানহানীকর। বলে রাখা ভাল যে এই মান বা সম্ভ্রমবোধটি কিন্তু আধুনিক। ইউরোপের রেনেসা যুগের অগে কেউ এর মধ্যে মানহানীকর কিছু খুঁজে পায়নি।

এবারে আসুন দেখি এই সুমহান গ্রন্থখানিতে বিশ্বাসীরা যখন বলেন তারা শুধুমাত্র এটিকেই বিশ্বাস করেন; তখন তারা মূলত কি বোঝাতে চান। প্রায় ১৪০০ বছর আগে আরবের মক্কাবাসী এক ব্যাক্তি দাবি করেন যে, এই বিশ্বজগতের স্রষ্টা ও প্রতিপালক তাঁর ফেরেস্থা জিবরাইল মারফত তার কাছে একখানি গ্রন্থ পাঠিয়েছেন। যেটা মানব ও জিন জাতির জন্য সর্বশেষ বা চূড়ান্ত পথ প্রদর্শক। গ্রন্থখানি বহু প্রাচীন ও আরবি ভাষায় লেখা। কাজেই একে বোঝার একমাত্র উপায় অনুবাদ। কিন্তু অনুবাদ বা তাফসিরের সীমাবদ্ধতা হলো এটি মূলগ্রন্থের ভাবধারা কখনই শতভাগ তুলে ধরতে পারেনা। যারা নিজেদেরকে কোরান ওনলি মুসলমান বলে দাবি করেন। তারাও এমন একজন তাফসির কারকের নাম বলতে পারবেন না যার কাজকে তারা সঠিক হিসাবে মেনে নিয়েছেন। বিগত ১৪০০ বছর ব্যাপি করা তাফসিরের মধ্যে থেকে কোন একটার সঠিকতার ব্যাপারে আজো মতৈক্যে পৌঁছান সম্ভব হয়ে উঠেনি। আগামী দিনে মতৈক্য হবে এমন কোন যুক্তিগ্রাহ্য কারণ কেউ দেখাতে পারেনি। তবে এখানে পূর্নাঙ্গ তাফসিরের ব্যাপারে একমত হওয়া না গেলেও এই গ্রন্থের কিছু কিছু অংশের তাফসিরের ব্যাপারে অভূতপূর্ব মতৈক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন- “ ইহা একটি সত্য গ্রন্থ” এই জাতীয় সমুদয় বাক্যবিন্যাস গুলো অবিশ্বাস্য ভাবে শতভাগ সফলতার সাথে এবং মূলভাব থেকে একচুল বিচ্যুৎ না হয়েই অনুদীত হতে দেখা যায়। হাজারটা তফসিরের ক্ষেত্রে কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই এগুলোকে সফল হতে দেখা যায়। ভাষার কাব্যময়তা ও আদিমতা কোন কিছুই সফল অনুবাদেরে পথে বাঁধা হয়ে উঠতে পারে না। এই বাক্য সমূহকে প্রামান্য স্বরূপ ধরে নিয়ে চলতে থাকে সত্যানুসন্ধান। যেহেতু কোরান নিজেই বলেছে যে, সে একটি সত্য গ্রন্থ ফলে এখানে কোন মিথ্যা থাকতে পারে না। ফলে যে সকল তাফসির যুগোপযোগী মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক তা সরাসরি বাজে তাফসির হিসাবে পরিত্যাক্ত হয়। যদি বিগত ১৪০০ বছরে এমন একটা তাফসিরও পাওয়া না যায়, যা যুগোপযোগী নীতি, নৈতিকতা, এমন কি বিজ্ঞাণের সর্বশেষ আবিস্কারের সাথে তাল মেলাতে ব্যার্থ, তবুও অসুবিধা নেই, ধরে নেয়া হয় যে আসল তাফসিরটি হারিয়ে গেছে। অন্যদিকে বিজ্ঞাণের বেলায় বিপরীত ফলদায়ী তাফসিরের ক্ষেত্রে বলা হয়ে থাকে যে, বিজ্ঞাণ এখনো তার শৈশবে বিচরন করছে, ফলে আমাদেরকে এর মর্মার্থ উপলদ্ধি করার জন্য অপেক্ষা করতে হবে, যে পর্যন্ত না বিজ্ঞাণ সাবালক হচ্ছে।

মোদ্দা কথাটি হচ্ছে, যেহেতু তারা জানে যে, কোরান একটি সত্য গ্রন্থ, ফলে এখানে মিথ্যা, ভুল, অপবিজ্ঞান, এক কথায়; নেতিবাচক কোন কিছুই থাকতে পারে না। সে কারণে কোরান ওনলি মুসলমানদের যাবতীয় তৎপরতা, শ্রম ও মেধা নিবেদিত আছে সভ্য ও আধুনিক বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের উপযোগী তাফসির প্রণয়নে। এই কাজে তাদের মধ্যে কাজ করে এক বিচিত্র স্বর্গীয় অনুপ্রেরণা। হাদিসের সত্যাসত্য, যুক্তিগ্রাহ্যতা বিচারের সময় তাদের মধ্যে যে ধরণের নিরীক্ষাধর্মী মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়, যে ধরণের আপোষহীন অনুসন্ধিষ্ণুতা দেখা যায়, কোরানের ক্ষেত্রে রহস্যজনক ভাবে তার কিছুই দেখা যায় না। বরং দেখা যায়, চিত্তাকর্ষক সব কাব্য প্রতিভাব উচু মাত্রার বিকাশ। এখানে স্বর্গীয় প্রেরণা এতই প্রবলভাবে কাজ করে যে, তা সমস্ত দ্বীধা-সংকোচের উর্ধ্বে নিয়ে যায় একজনকে। যুগপযোগী মূল্যবোধের আমদানি ঘটাতে গিয়ে পিতাকে যদি ভ্রাতা বানাতে হয় তবু কিছু যায় আসে না। ( যেমন- আয়েশা হচ্ছে আবু বকরের বোন।)

হাদিসের উপরে মূল ক্ষোভ এই যে, এটি এখন আর কোরানের বিশুদ্ধতাকে রক্ষাতো করেই না বরং কোরানের বানী সমূহের অবতীর্ণ হবার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে তাফসির করার সীমাহীন স্বাধীনতাকে খর্ব করে। অথচ তারা চান তাফসির করতে পারার সার্বজনীন অধিকার। যে পথের প্রধাণ অন্তরায় আজকে হাদিস।

হাদিসের এইসব সংকোলন আসলে ইতিহাসের আকড় বিশেষ। একটা সময়কে বোঝার জন্য এর গুরুত্ত্ব অপরিসীম। মেগাস্তিনিস ভারত সম্পর্কে যত আজব কথাই বলে গিয়ে থাকুন না কেন, একে ছেঁকে আমরা কিন্তু ঠিকই সত্য সম্পর্কে একটা ধারণায় পৌঁছাতে পারি। তো হাদিস নামক ইতিহাসের এই সব বাতিঘরগুলো নিভিয়ে দিতে পারলে এমন এক অন্ধকার ঘনায়মান করা যাবে, যেখানে বসে চোখ বন্ধ করে বলে দেয়া যাবে যে, আয়েশা, জায়েদ, জয়নব এগুলো কোন মানুষের নাম ছিলো না। এগুলো ছিলো স্থানের নাম বিশেষ। মুসার হাতের লাঠিটি ছিলো মূলত একটি মমিকৃত সাপ। ফলে মানব বিবর্তনের অতিরিক্ত লেজটির মত হাদিসকে খসিয়ে ফেলা মুসলমানদের এই অভিনব প্রজাতিটির জন্য এখন একান্ত জরুরী হয়ে উঠা এক অনিবার্যতা।

আগেই বলেছি, তারা এসব করে চলেছে এক বিশেষ স্বর্গীয় প্রেরণায়, যার মূলে রয়েছে সত্যানুসন্ধান। তবে সত্যানুসন্ধানের সার্বজনীন রীতির সাথে প্রক্রিয়াগত দিক দিয়ে একটি মাত্র অমিল রয়েছে তাদের। আমরা সত্যকে জানার জন্য তর্ক-বিতর্ক, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, অনুসন্ধান-গবেষণা ইত্যাকার যাবতীয় যা কিছু করে থাকি, এর সবই কোরান ওনলি মুসলমানরাও করেন। তবে ঐ বিশেষ স্বর্গীয় প্রেরণাবসত তারা এসব কষ্টসাধ্য কাজ করে থাকেন সত্যে উপনীত হবার পরে। মানে আমরা জ্ঞান থেকে প্রজ্ঞায় উপনীত হই, তারা প্রজ্ঞা থেকে জ্ঞাণে।

লেখাটি সেইসব নিবেদিত প্রাণ কোরান ওনলি মুসলমানদের তরে উৎসর্গীকৃত। শুভহোক আপনাদের পথচলা।