800px-vincent_van_gogh_-_the_potato_eaters

এক.

হাভাতে বুড়িটি ভাতের সন্ধানেই কোনো এক আত্নীয় সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। তার জন্ম উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর রংপুরের মঙ্গা পীড়িত কোনো এক দূর্গম গ্রামে। তাই আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না, অনিবার্য এক অচিন ক্ষুধা আজন্ম চিটচিটে ঘামের মতো লেপ্টে থাকে তার জঠরে, গতরে এবং সর্বাঙ্গে। বুড়ির জীবনের গল্পটিও তাই মঙ্গা উপদ্রুত অন্চলের অন্যান্য বুড়ির মতো অতি সংক্ষিপ্ত এবং স্যাঁতসেঁতে টাইপের পুরনো। তাই আসুন, এই পর্বটুকু আমরা বরং এক বাক্যেই সেরে নেই :

১৫ বছর বয়সে এক ক্ষেতমজুরের সঙ্গে বিয়ে, বছর না ঘুরতেই বাচ্চা, পরের বছরগুলোতে আরো আরো আন্ডা-বাচ্চা, স্বামী আরেকটি বিয়ে করলে মেয়েটি পাঁচটি ছেলে-মেয়েকে একাই ক্ষেতমজুরী করে ও চেয়ে-চিন্তে বড় করে, মেয়ে-গুলোকে সাধ্যমত অন্যত্র বিয়ে দেয়, ছেলেরা বিয়ে করে মাকে ছেড়ে চলে যায়, এই শেষ বয়সে বুড়ির আর দিন চলে না, স্বামী খেদানো, ছেলেমেয়ে তাড়ানো বুড়ির এখন এক দফা এক দাবি– সামান্য এক মুঠো আহার।

দুই.

ঢাকায় বুড়ির নামমাত্র বেতন, তিন বেলা খাওয়া-পরার বিনিময়ে কাজ জুটে যায় আমার এক কর্পোরেট বন্ধুর বাসায়; আমরা ঘটনা বর্ণনার সুবিধার্থে বন্ধুটির নামে দেই বেলা বোস। বন্ধু বেলা বোসের অন্য দুই বোন বিয়ে করে আলাদা হয়েছেন, তারা স্বামীর সঙ্গে অন্যত্র থাকেন। বাড়িতে লোক বলতে মাত্র তিনজন, বেলা, বেলার বিধমা মা ও নানী। তার বাবা গত হয়েছেন দেড় যুগ আগে। তাই তাদের বাসায় আমাদের আলোচ্য মঙ্গাঞ্চলের বুড়ির ঝি’য়ের কাজকর্ম তেমন কিছু নেই।

বুড়ির প্রধান কাজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা কর্পোরেট চাকুরে টিপটপ বেলা বোসের ফুটফরমাশ খাটা, তার মেজাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে খানিকটা অতিষ্ঠ হয়ে থাকা।

বলতে নেই, তবু বলি, বেলা বোসের মন ভালো হলেও মেজাজ খুব চড়া। তাই আমাদের বুড়িটি একমাত্র এই আপাটিকে বেশ খানিকটা সমঝে চলতে হয়। সব সময় এক অজানা ভয় তাকে ঘিরে রাখে। কখন না জানি আবার পান থেকে চুন খসে পড়লে আপার তীক্ষ্ণ কথার ছুরিকাঘাতে তাকে বিদ্ধ হতে হয়! সে যে ক্ষুধার মতোই ক্ষুরধার ও বিষময়! সঙ্গে পাষাণপুরী এই ঢাকা মহানগরীর অচেনা জগত-ভীতিও বোধকরি বুড়িটিকে বেশ খানিকটা বিপর্যস্ত করে রাখে।…

তিন.

এক সকালে বন্ধুবরেষু বেলা বোস অফিস যাওয়ার জন্য ঝটপট তৈরি হচ্ছেন। তার চিল-চিৎকারে পুরো বাড়ি তখন মাথায় উঠেছে: বুয়া, আমার সালোয়ার-কামিজ দাও, এটা না, দেখো আলমিরার ওপরের তাকে আছে নীল রঙের বুটিক করা! বুয়া, আমার নীল চটিটা দেখো তো! আমার হেয়ার ক্লিপ? সানগ্লাসটা খুঁজে পাচ্ছি না, মাকে জিজ্ঞেস করো, সেটি কোথায়?

এর পর বেলা বোস স্নান ও হালকা প্রসাধন সেরে তার শোবার ঘর থেকেই আবার হাক মারেন: বুয়া, রান্নাঘরে টোস্টারে দেখো রুটি টোস্ট করতে দিয়েছি, সেগুলোকে ডাইনিং টেবিলে রাখো, ফ্রিজ থেকে জ্যাম নিয়ে খাবার টেবিলে দাও! আর চট করে আমার জন্য একটা ডিম পোচ করে দাও! …

খাবার টেবিলে বসে বেলার ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে বসে। আমাদের বুড়ি ঝি কাম বেলা বোসের একান্ত কাজের বুয়া রান্না ঘর থেকে আসেনই না। বেলা বোস হাঁক ছাড়েন, বুয়া, কি হলো?…

পরে তিনি নিজেই রান্না ঘরে গিয়ে যা দেখেন, তাতে তার মেজাজ ধরে রাখা সত্যিই কঠিন হয়ে পড়ে। মেজাজের পারা চড় চড় করে সপ্তমে চড়তে থাকে, এরই মধ্যে বেলা বোস দ্রুত বুঝে যান, নাস্তা না খেয়েই আজ তাকে অফিসে দৌড়াতে হবে। সময় মতো অফিসেও হয়তো পৌঁছানো আর হলো না।

ওই সকালে মেজার চড়া হওয়ার মতো দৃশ্যই বেলা বোস দেখেছিলেন বটে। রান্নাঘরের মেঝেতে সেই গ্রামের হাভাতে বুড়ি বুয়া তখন ভাঙা টোস্টারের কয়েকটি টুকরো হাতে ধরে বসে আছেন। তার মুখে তখন পাগলের মতো বুলি: কই? উটি কই? নাই! নাই তো! হেথা তো কুনু উটি নাই!…

চার.

বাড়ির সকলে বেলা বোসের ভয়ঙ্কর চিৎকার-চেঁচামেঁচিতে রান্নাঘরে এসে জড়ো হন। নানান রকম প্রশ্নবান ও পুলিশি জেরার মুখে আমাদের মঙ্গা-বুড়ি চোখের পানিতে তার অপরাধটুকু স্বীকার করেন। অকপট সরল স্বীকারোক্তিতে তিনি জানান, বটি দিয়ে তিনি নিজেই নতুন কেনা টোস্টারটি টুকরো করে দেখতে চেয়েছেন, প্রতিদিন এই ‘আজব কল’ থেকে গরমা-গরম ধোঁয়া ওঠা পাউরুটির পিস বের হয় কী করে? তার গোপন ইচ্ছে, বেতনের টাকা দিয়ে এইরকম একটি ‘আজব কল’ কিনে গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ার। তখন প্রতিদিন কল টিপলেই ভাপ ওঠা সুস্বাদু রুটির টুকরো…এই শেষ বয়সে এসে তখন বুড়িকে আর কাজের জন্য মানুষের দুয়ারে খাটাখাটনি করতে হবে না, মুখ ঝামটা খেতে হবে না। বুড়ির থাকবে না কোনো অন্নচিন্তা!…

পাঁচ.

গল্পের চেয়েও সত্যি আমাদের বুড়ি বুয়ার কথনটির একেবারে সমাপ্তি পর্বে জানাই, সেদিন যথারীতি সকালে নাস্তা না করেই বেলা বোস অফিসে যান এবং কম্পিউটারাইজড হাজিরা পদ্ধতির বোতাম টিপতে গিয়ে আভাষ পান– ৪৫ মিনিট বিলম্বে তিনি সেদিন অফিস পৌঁছেছেন।

সে দিন লাঞ্চ আওয়ারে কি এক দরকারি কাজে বেলা বোসকে টেলিফোন করতেই তিনি নানা এলোমেলো কথার ফাঁকে আমাকে হরবর করে এই ঘটনাটি বলেন। আমার মনছবিতে পুরো ঘটনাটি স্লাইড শো’র মতো একে একে ভেসে আসে; আমার হাত থেকে টেলিফোন খসে পড়তে চায়।…

ছবি: পটেটো ইটার্স, ভ্যান গখ, অন্তর্জাল।