ধর্মীয় অপসংস্কৃতি, আফসান আজাদ আর যুদ্ধাপরাধ

 

বিশ্বকাপ ফুটবলের ডামাডোলে কিছু আপাত গুরুত্বহীন কিন্তু উদ্বেগজনক খবর-প্রতিবেদন হয়তো আমাদের অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে  ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার অপ্রত্যাশিত বিদায়ের (অকারণ) শোকে  মুহ্যমান  দেশবাসীর মনে হয় আর কোন দিকে মনযোগ দেয়ার ফুরসত ছিল না খবর দুটি দেশের দৈনিক পত্রিকায় (আমি অন্তত একটা পত্রিকা ‘কালের কণ্ঠে’ দেখেছি) গুরুত্বের সাথে না হলেও প্রচারিত হয়েছে

দুটো খবরই অপরাধ সংক্রান্ত দুটোর সাথেই ধর্মোন্মাদনা জড়িত দুটোর মূলেই রয়েছে অসহিষ্ণুতা, ধর্মীয় ধ্যানধারণা যার জন্ম দেয়  একটা একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে, সাম্প্রতিক অন্যটা একটা দেশের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, চল্লিশ বছর আগে সংঘটিত অপরাধ      

প্রথমে ব্যক্তিকে দিয়েই শুরু করি ব্যক্তিটির নাম আফসান আজাদ  মাত্র বাইশ বছর বয়স্কা একজন ফুটফুটে তরুনী, হ্যারি পটারের ছবিগুলোতে পদ্মা পাতিলের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন  ম্যাঞ্চেস্টারের অধিবাসী এক বাংলাদেশি-বৃটিশ  পরিবারে তাঁর জন্ম বাবা আব্দুল আজাদ আর ভাই আশরাফ তাঁকে মারধোর করে আর খুন করার হুমকি দেয়  এক হিন্দু যুবকের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার দায়ে আফসানের এই হতভাগ্য পরিণতি  আফসান বাধ্য হয়ে আদালতের আশ্রয় নিয়েছে, আর তাই এখনো বন্ধুদের আশ্রয়ে প্রাণে বেঁচে আছে  আফসানের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাবা-মা দুজনেরই জন্ম বৃটেনে  বৃটেনে জন্ম হলে’ও ধর্মীয় অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয় আফসানের পরিবার 

 

story_ashan

 

সমষ্টিগত ভাবে বাংলাদেশের সরকার আর জনগণও মুক্ত নয় ধর্মীয় অপসংস্কৃতির প্রভাব থেকে   দ্বিতীয়টি সেই সমষ্টির ওপরে প্রভাব নিয়ে   

একাত্তরে বাংলাদেশে পরিকল্পিতভাবে গণহত্যা করে তখনকার পাকিস্তানি সরকার ইসলামী ভাবধারায় উদ্ধুদ্ধ দলগুলো, যাদের মধ্যে জামাতে ইসলামী ছিল প্রধান, পাকিস্তানি সরকারের শুধু দোসরই ছিল না, তারা হত্যা-ধর্ষন-অগ্নিসংযোগে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে  দেশের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি নিধনের কাজে তাদের ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ  প্রকাশ্যে হত্যার উস্কানি দেয়া ছাড়াও তাদের ও তাদের সহযোগী সংগঠনের সদস্যরা আল-বদর, আল-শামস, ইসলামী ছাত্র সংঘ ইত্যাদির মাধ্যমে সারাদেশে কিলিং স্কোয়াড গড়ে তোলে   

স্বাধীনতার পরে কিছুটা শেখ মুজিব সরকারের সদিচ্ছার অভাবে, কিছুটা ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে, পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সদস্যদের যুদ্ধাপরাধের আর গণহত্যার অপরাধের শাস্তি হয় নি দেশের অভ্যন্তরের খুনী, ধর্ষকদেরও বিচারের আওতায় আনা হয় নি

201027asp0031

   

বললাম, শেখ মুজিব সরকারের সদিচ্ছার অভাব ছিল, কেন?  কারণ অনেক  তবে প্রধান এবং অন্তর্নিহিত কারণ, ধর্মের প্রতি দূর্বলতা  সেই ধর্মীয় অপসংস্কৃতির প্রভাব  মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আর একই নিশ্বাসে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয় বলা থেকেই বোঝা গিয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি একটা বোঝাস্বরূপ

দূর্বলতার রাজনৈতিক কারণও ছিল  ধর্মের কারণেই ভারত থেকে দূরত্ব সৃষ্টির একটা তাগিদ হয়তো শেখ মুজিব অনুভব করেছিলেন তাই নিজের উদ্যোগে ভুট্টোকে নিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ সফরে, বাংলার মাটিতে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ত শুকোবার আগেই আর পরম উৎসাহে উড়ে গিয়েছিলেন লাহোরে ইসলামী সম্মেলনে যোগ দিতে  ইসলামী বিশ্বের সমর্থন আর স্বীকৃতি আদায়ের জন্য শেখ মুজিব ছিলেন মরিয়া কেন? কারণ শুধু রাজনৈতিক নয়, অর্থনৈতিকও তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর কৃপাদৃষ্টি লাভের ইচ্ছাও এই সমস্ত কর্মকান্ডের সাথে যুক্ত ছিল কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! এত কিছু করেও ইসলামী বিশ্বের স্বীকৃতি শেখ মুজিব পান নি তাঁর জীবন থাকতে 

কিন্তু চল্লিশ বছর পরেও জনগণ ভোলে নি তাদের প্রাণের দাবী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী বিচার না হওয়া পর্যন্ত কোনদিনও ভুলবে না   

আওয়ামী লীগ আবারো ক্ষমতায়  এবারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার ওয়াদা দিয়ে ভোট পেয়েছে আওয়ামী লীগ কিন্তু বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নানাবিধ বাগাড়ম্বর সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে আবারো সেই একই কারণে সেই একই রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক কারণে  

যে কারণে নিজামী-মুজাহিদেরা জেলে গিয়েও সদম্ভে বলতে পারে, আমাদের বিচার করার ক্ষমতা কারো নাই বুঝতে কষ্ট হয় না, কিসের জোরে তারা এই কথা বলে ছাগল খুঁটির জোরেই নাচে তাদের খুঁটিটা কোথায়? বেশি দূরে নয়, পশ্চিম দিকে ইসলামের জন্মস্থান সৌদি আরবে যেখানে আমাদের জননেত্রী আর দেশনেত্রী নির্বাচনের আগে একবার, পরে আরেকবার মুখের ওপরে হিজাব-ঘোমটা টেনে ওমরাহ পালন করতে যান  তাই বলছিলাম, সাংস্কৃতিক কারণটাকেও উপেক্ষা করি কি ভাবে?

যে কারণে নিজামী-মুজাহিদেরা নিজেদের বিচার নিয়ে চিন্তিত নয়, সেই একই কারণে সংশয় প্রকাশ করেছেন সাপ্তাহিক ইকনমিস্টের (জুলাই ১, ২০১০) প্রতিবেদক বাংলাদেশ সরকার কি আসলেই চল্লিশ বছর আগে ঘটা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারবে?  প্রতিবেদকের সংশয় সবকিছু ছাপিয়ে সৌদি আরবকে নিয়ে সৌদি আরব কমদামে বাংলাদেশকে তেল দেয় বাংলাদেশের বিশ লক্ষ নাগরিক সেই দেশে কাজ করেন ইকনমিস্টের প্রতিবেদকের মতে, বাহাত্তরের সংবিধানে বাংলাদেশের ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সৌদি আরবের সায় নেই

একই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে, কিন্তু আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ নাকি বলেছেন, সৌদি আরব বিচারপ্রক্রিয়ায় ‘সবুজ সঙ্কেত’ দিয়েছে আমি আবারো শঙ্কিত হলাম  সৌদি আরব থেকে সবুজ সঙ্কেত না পেলে কি তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করা যেত না?  এই বিচারপ্রক্রিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে বেশি আশা না করাই ভাল ইকনমিস্টের প্রতিবেদক আমাদের জানাচ্ছেন, সৌদি আরবে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি ২০০৭-এ কমেছে ১৭ হাজার আর ২০০৮-এ ১১ হাজার – মাসে প্রায় ৮০০ জন করে কমছে সরকার সবুজ সঙ্কেতের সাথে লালবাতির আভাসও নিশ্চয় দেখতে পাচ্ছেন আমাদের দূর্বলচিত্ত রাজনৈতিক নেতৃত্ব সৌদি সবুজ সঙ্কেত না পেলে নিজ কর্তব্য পালন করতে পারেন না, তাঁরা লালবাতির ভয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া আবারো শিকেয় তুলবেন না এই নিশ্চয়তা কোথায় পাওয়া যাবে?

আফসান আজাদ ধর্মের কুপ্রভাব থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য লড়ছেন  আফসান যদি বাংলাদেশে বসবাসকারী কেউ হতেন, দেশের আদালত আর সমাজ তাঁকে কতটা নিরাপত্তা দিতে পারতো এ প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই মনে জাগে  যে দেশে শস্যের চেয়ে টুপি বেশি, যে দেশে ইসলাম এখনো রাষ্ট্রীয় ধর্ম, যে দেশের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা কথাটা ছেঁটে দিয়ে নিতান্তই সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রকাশ ঘটিয়ে কোনরকমে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উল্লেখ করা হয়, সে দেশে অনেক আফসান আজাদ আছেন  তাঁরা হ্যারি পটারে অভিনয় করার সুযোগ পান না  তাই পত্রিকার পাতায়ও আসেন না  কিন্তু নিজেদের জীবনের ট্রাজিক নাটকে দিনের পর দিন তাঁরা অভিনয় করে চলেছেন ধর্মীয় অপসংস্কৃতির পটভূমিতে   

সেই একই ধর্মীয় অপসংস্কৃতির পটভূমিতে ঘটা যুদ্ধাপরাধের বিচার হয় নি চল্লিশ বছর ধরে ধর্মীয় অপসংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবান্বিত বাংলাদেশে

আফসান আজাদের মতো বাংলাদেশের জনগণেরও অধিকার আছে আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার ধর্মীয় অপসংস্কৃতির কুপ্রভাব থেকে বেরিয়ে আসার  জনগণ দৃঢ়সংকল্প থাকলে সৌদি আরব এখানে বাধা হতে পারে না, পারে না বাদ সাধতে  দরকার আমাদের সৌদি আরবকে না বলার সাহসের  চাই না তাদের সস্তা তেল, আর পেট্রোডলারের মজুরি  চাই যুদ্ধাপরাধের বিচার  

জুলাই ৫, ২০১০