অনেক সময় বলতে শোনা যায় ‘জৈববিবর্তন জীববিজ্ঞানের নিছক (mere) একটি ‘তত্ত্ব’ মাত্র, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।’ (1) বিজ্ঞানে কোনো তত্ত্বের ‘বাস্তব ভিত্তি’ বা ফ্যাক্ট আছে কি নেই, বুঝতে হলে প্রথমে বিজ্ঞানে তত্ত্ব কিভাবে গঠিত হয়, বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের কাজ কি-সে সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে। প্রায়শ আমরা যেভাবে সাদামাটা অর্থে ‘তত্ত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি (যেমন কারো ব্যক্তিগত ধারণা, অনুমান, বিশ্বাসকে বোঝাতে), বিজ্ঞানে কিন্তু মোটেও সেরকমভাবে হাল্কা মেজাজে ‘তত্ত্ব’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় না। বিজ্ঞানে ‘তত্ত্ব’ শব্দটির অর্থ বেশ গভীর। অনেক সময় আমরা বলে থাকি, ‘বাংলাদেশের অমুক অঞ্চলের মানুষগুলো বড় বাজে, হাড়কিপ্টে। তাদের সাথে সম্পর্ক করা ভালো না।’ ‘সাদাদের তুলনায় কালো মানুষেরা বেশি বদমেজাজি, রাগী, খিটখিটে হয়’ কিংবা ‘মেয়েদের তুলনায় ছেলেরা বেশি মেধাবী হয়।’ উক্ত উদাহরণগুলির কোনোটিই পরীক্ষিত-প্রমাণিত কোনো বক্তব্য নয়; যেনতেন অনুমান, লোককথা, আর stereotype মানসিকতায় আচ্ছন্ন বক্তব্য। বিজ্ঞান মোটেও লোককথা, stereotype বক্তব্য, যেনতেন অনুমানকে ‘থিওরি’ বা ‘তত্ত্ব’ বলে গ্রহণ করে না। বিজ্ঞান গবেষণা-পরীক্ষণ-প্রমাণের উপর নির্ভরশীল। বিজ্ঞানের যে কোনো শাখায় গবেষণার প্রথম ধাপ হচ্ছে (সেটা নতুন তত্ত্ব গঠনের জন্য হতে পারে অথবা পুরাতন তত্ত্বকে সময়ের পরিবর্তনে নতুন করে ঝাচাই করে নেয়ার জন্য হতে পারে) ‘অনুকল্প’ (hypothesis) গঠন। অনুকল্প গঠনের কিছু আবশ্যিক পূর্বশর্ত আছে : যেমন ‘অনুকল্পটি অবশ্যই বাস্তব অভিজ্ঞতাপুষ্ট ধারণা হতে হবে, সুনির্দিষ্ট হতে হবে, প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, পর্যবেক্ষণ-পরীক্ষণ-বিশ্লেষণ-যাচাইযোগ্য, যুক্তিসঙ্গত ধারণার প্রকাশক হতে হবে, ইত্যাদি।’ উক্ত পূর্বশর্তগুলি পূরণ করে অনুকল্প গঠিত হলে এরপর অনুকল্পের অন্তর্ভুক্ত ঘটনা বা বিষয়গুলিকে সন্দেহাতীতভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। সন্দেহাতীতভাবে উক্ত বিষয় বা ঘটনাগুলি বিভিন্ন পদ্ধতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত হলে তবেই অনুকল্পটি ‘তত্ত্ব’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়; নয়তো অনুকল্পটি খারিজ হয়ে যায়।

কেবল কিছু ঘটনা বা বিষয়কে (যেমন পৃথিবীর সাথে চন্দ্রের দূরত্ব, সূর্যের দূরত্ব, পৃথিবীর বয়স কত, মেরুদণ্ডী ও অমেরুদণ্ডী প্রাণীর পার্থক্য, ইত্যাদি) জানা বা চিহ্নিত করার মাধ্যমে বিজ্ঞানে ‘তত্ত্ব’ গড়ে ওঠে না। রসায়নবিজ্ঞানে Atomic Theory বলতে কেবল বুঝায় না যে শুধু এটম বা পরমাণুর অস্তিত্ব রয়েছে; বরং কেমন করে-কিভাবে পরমাণুগুলো একে-অপরের সাথে ক্রিয়াশীল হয়, কিভাবে পরমাণুগুলো একত্রে মিলে যৌগ গঠন করে, রাসায়নিকভাবে পরমাণুগুলোর আচরণ কেমন ইত্যাদি বিষয়গুলো এই থিওরির আলোচ্য বিষয়। তারমানে বিজ্ঞান স্পষ্টই বৈজ্ঞানিক প্রকৃতির (Nature of Science) সাথে সম্পর্কিত। বৈজ্ঞানিক প্রকৃতি হচ্ছে মূলত বৈধ-প্রমাণের বৈশিষ্ট্য (the criteria of valid evidence), অর্থবোধক গবেষণা নক্সা (the design of meaningful experiments), সম্ভাবনার সুনির্দিষ্ট পরিমাণ নির্ণয় (the weighing of possibilities), গবেষণার জন্য গৃহীত অনুকল্পগুলোর পরীক্ষণ (the testing of hypothesis), উপযোগী তত্ত্ব গঠন (the establishment of useful theory) ইত্যাদি-যা এই পার্থিব জগতের কোনো নির্দিষ্ট ফেনোমেনা বা ঘটনা সম্পর্কে যথার্থ, নির্ভরযোগ্য এবং অর্থবোধক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সহায়তা করে। (2)

বিজ্ঞানে তত্ত্বের কাজ কি? বিষয়টি বুঝার জন্য আমরা উদাহরণ হিসেবে নিউটনের অভিকর্ষ তত্ত্বকে বিবেচনায় নিই। নিউটনের জন্মের অনেক আগে থেকে (প্লেটোর যুগেও) মানুষের জানা ছিল কোনো বস্তু উপরের দিকে ছেড়ে দিলে তা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। কিন্তু কেন এমনটা ঘটে, তা মানুষের জানা ছিল না। নিউটন জানালেন, ‘ভর ভরকে আকর্ষণ করে’। তিনি আরো জানালেন, অভিকর্ষ বলের প্রভাবে পৃথিবী সবকিছুকে তার কেন্দ্রের দিকে টেনে ধরে। যার জন্য গাছ থেকে আম-জাম-কাঁঠাল-কলা পড়লে কোনো কিছুই আর শূন্যে ভেসে থাকে না, মাটিতে পড়ে যায়। উপরের দিকে ঢিল ছুঁড়লে তা মাটিতে নেমে আসে। নিউটনের এ অনুকল্পটি বিভিন্নভাবে-বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে; ফলে অনুকল্পটি ইতিমধ্যে ‘তত্ত্ব’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। নিউটনের এ তত্ত্বের দ্বারা আমরা পৃথিবীর একটি বাস্তবতা ‘অভিকর্ষ বল’-এর অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করতে পারছি। আবার জৈবযৌগ-অজৈবযৌগ হচ্ছে পৃথিবীর বাস্তবতা, সেই জৈবযৌগ-অজৈবযৌগের গঠন, রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ইত্যাদি আমরা ব্যাখ্যা করতে পারছি এটমিক থিওরি দ্বারা। অর্থাৎ বাস্তবতা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন তথ্য (Data) আর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হচ্ছে, পৃথিবীর সেই তথ্যের ব্যাখ্যা।(3) আরেকটু পরিষ্কার করে বলা যায়, ‘যে অনুকল্পটি সবচেয়ে ভালোভাবে বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে পারে, সেই অনুকল্পকেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব হিসেবে গ্রহণ করা হয়।’ কিছু বাস্তবতা আছে, আমরা সরাসরি উপস্থিত হয়ে চাক্ষুস অবলোকন করতে পারি না বা সম্ভবও না, যেমন পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহগুলি যেমন সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে সৌরজগতে ঘূর্ণায়মান রয়েছে; যা সরাসরি উপস্থিত থেকে চাক্ষুস পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব নয়। একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানীর পক্ষে সম্ভব নয় একটি নক্ষত্রকে কৃষ্ণগহ্বরে পরিণত হওয়া প্রত্যক্ষ করা কিংবা একজন ভূতাত্ত্বিকের পক্ষে সম্ভব নয় পৃথিবীর কেন্দ্রের গঠন দেখে আসা; অর্থাৎ, পৃথিবীর সব বাস্তবতা এক রকম নয়; কোনোটা চাক্ষুস দেখা যায়, কোনোটা চাক্ষুস দেখা যায় না; এবং বিজ্ঞানও তত্ত্ব গঠনের জন্য শুধুমাত্র গবেষণা পদ্ধতি ‘সরাসরি উপস্থিত হয়ে বাস্তবতা প্রত্যক্ষণের’ উপর নির্ভরশীল নয়। বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় গবেষণার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। কেউ ডিডাকটিভ পদ্ধতি অনুসরণ করেন, কেউবা ইনডাকটিভ পদ্ধতি, কেউবা মিথ্যা প্রতিপন্নকরণ যোগ্যতার (Falsifiability)-এর উপর গুরুত্ব প্রদান করেন, ইত্যাদি। কিন্তু বিজ্ঞানে কোথাও অপ্রমাণিত অনুমান বা অনুকল্পকে পরীক্ষণ-বিশ্লেষণ ব্যাতিরেকে মেনে নেওয়া হয় না, ‘তত্ত্ব’ হিসেবে গ্রহণ করা হয় না।

১৮০৮ সালে জন ডাল্টন A New System of Chemical Philosophy গ্রন্থে পরমাণুর গঠন নিয়ে প্রথম অনুকল্প প্রদান করেন, ১৮১১ সালে এভোগ্রেড্রো উক্ত অনুকল্পে কিছু সংশোধনী আনেন। ১৯০৪ সালে জে. জে. থমসন বলেন, পরমাণুর ভেতর ধনাত্মক আধানকে কেন্দ্র করে ইলেকট্রন পরিভ্রমণরত। ১৯০৯ সালে আর্নেস্ট রাদারফোর্ড পরমাণুর নিউকিয়াস আবিষ্কার করেন এবং এর পরে নীল্স বোর ইলেকট্রনের ঘূর্ণনের গতিপথ সম্পর্কে ধারণা দেন। ১৯৩২ সালের দিকে জেমস চ্যাডউইক পরমাণুর ভর আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এটমিক অনুকল্পটি প্রমাণিত হয় কিন্তু তখন পর্যন্ত কারও পক্ষে পরমাণুর গঠন ‘চাক্ষুস’ অবলোকন করা সম্ভব হয় নি। রাসায়নিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরমাণুর অস্তিত্ব সম্পর্কে নিশ্চিৎ হয়েছিলেন বলেই বিজ্ঞানীরা এটমিক থিওরি মেনে নিয়েছিলে। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালে শক্তিশালী স্কেনিং ইলেকট্রন অণুবীণ যন্ত্র আবিষ্কারের পর ছোট ছোট বলের মতন পরমাণুর অস্তিত্ব চাক্ষুস দেখা সম্ভব হয়েছে।

আমাদের এই চিরচেনা জগতের ‘বাস্তবতা’ কি কি? এককথায় ক্রম পরিবর্তনশীলতা; নিয়মিত পরিবর্তন এবং অনিয়মিত পরিবর্তন। নিয়মিত পরিবতর্নের উদাহরণ হচ্ছে, নিজ অক্ষে পৃথিবীর আহ্নিক গতির কারণে পৃথিবীতে দিন-রাতের পরিবর্তন, জোয়ার-ভাঁটা, চন্দ্রগ্রহণের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠে জলের উচ্চতা বৃদ্ধি, সূর্যকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বার্ষিক গতির কারণে ঋতুর পরিবর্তন, ইত্যাদি। অনিয়মিত পরিবর্তনের উদাহরণ হচ্ছে পৃথিবীর অভ্যন্তরে টেকটনিক প্লেটগুলোর অবস্থান পরির্তন, মরুকরণ, ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরি থেকে নির্গত লাভার মাধ্যমে পরিবেশের পরিবর্তন, বরফ যুগের আবির্ভাব, ইত্যাদি। জীবজগতের বাস্তবতা হচ্ছে-সকল জীবের বংশবৃদ্ধির হার অত্যন্ত বেশি, যেমন : ‘সাধারণ মাছির (Musca domestica) জীবনচক্র বা প্রজন্মকাল মাত্র ২৩ দিনের। ডিম থেকে বের হওয়ার ২৪ দিন পরেই মাছি ডিম পাড়তে শুরু করে। একটি স্ত্রীমাছির সব বংশধরেরা বেঁচে থেকে যদি নতুন বংশধর রেখে যেতে পারে, তবে এক বছরের মধ্যেই মোট মাছির সংখ্যা দাঁড়াবে ১৯১*১০(১৮)। একটি ঝিনুক বছরে ১০০ মিলিয়ন ডিম ছাড়তে পারে। একটি স্ত্রী স্যামন মাছ বছরে ২৮ মিলিয়ন ডিম পাড়ে। অন্য জাতের কোনো কোনো মাছ অবশ্য অনেক কম ডিম ছাড়ে। তাও বছরে ১.৭ মিলিয়ন হতে পারে। প্রতিটি তারা মাছ (Piaster oraceous) প্রতি বছরে ৫০ মিলিয়ন ডিম ছাড়ে। একটি অর্কিড গাছ থেকে বছরে এক মিলিয়ন বীজ উৎপন্ন হতে পারে। পৃথিবীতে যেসব জীবের প্রজনন হার অত্যন্ত কম, তার মধ্যে হাতি একটি। যদি সমস্ত প্রজন্মের সমস্ত হাতি সফলভাবে বংশরা করে যায়, তাহলে এক জোড়া হাতি থেকে ৭৫০ বছরে শুধু হাতির জনসংখ্যা হবে এক কোটি নব্বই লক্ষ।’ (4) কিন্তু প্রকৃতিতে বেঁচে থাকার জন্য জীবের খাদ্য, বাসস্থান, সঙ্গী, আনুসাঙ্গিক চাহিদা পূরণের অবলম্বনগুলোর বৃদ্ধির হার এতোটা নয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সকল জীবকে টিকে থাকার জন্য (মানে বেঁচে থাকার জন্য চাহিদা পূরণ করতে) নিজেদের অজান্তে জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হতে হয়। জীবজগতের এই বাস্তবতা নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ নেই। ডারউইন জীবের জীবন রার সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়া কিংবা অত্যাধিক বংশবৃদ্ধির হার সীমাবদ্ধ থাকার জন্য কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করেছেন, যেমন খাদ্য সংকট, শত্র“র সাথে লড়াই, আবহাওয়া-ভূপ্রকৃতি-পরিবেশের ক্রমপরিবর্তন ইত্যাদি। প্রতিটি জীবের এ জীবন সংগ্রামকে তিনটি ধারায় পরিচালিত হতে দেখা যায় : প্রথম, আন্তঃপ্রজাতি মানে একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে, দ্বিতীয়, একই ভৌগলিক এলাকায় বসবাসকারী বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে, এবং তৃতীয়, জীবন ধারণের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে। ডারউইনের মতে তিন ধরনের সংগ্রামের মধ্যে সবচেয়ে তীব্রতর সংগ্রাম হচ্ছে একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যেকার সংগ্রাম।

যৌন-প্রজননশীল জীবে মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় ‘জনন কোষ’ বিভাজনের সময় জিনের মিউটেশন বা ক্রোমসোম মিউটেশনের মাধ্যমে প্রকরণ (Variation)-এর উদ্ভব একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ প্রত্যেক প্রজাতির সদস্যরা সকলে দেখতে অবিকল এক রকম হয় না (অবিকল যমজ বাদে), সামান্যতম হলেও তাদের মধ্যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগত বিভিন্নতা থাকে; হতে পারে দৈহিক চেহারায় (ফর্সা, কালো, দাগযুক্ত, দাগ ছাড়া), আকৃতিতে (লম্বা, বেঁটে, মাঝারি) কিংবা অন্য কোনোভাবে; যেমন প্রজাপতির একই বংশধরদের মধ্যে কারো গায়ে ফুটকিযুক্ত দাগ বেশি, কারো কম, কেউবা ধূসর বর্ণের, কেউবা বেশি রঙিন, ইত্যাদি। টিকে থাকার জন্য সকল জীবই নিজেদের অজান্তে প্রতিযোগিতায় শামিল হয়, পরিবর্তিত পরিবেশে ঐসব ভ্যারিয়েশন বা প্রকরণগুলির কোনো কোনোটি যদি পরিবেশের সাথে অভিযোজন ঘটাতে সুবিধাজনক হয়ে দেখা দেয় তবে ঐ জীবেরা ‘জীবন সংগ্রামে’ টিকে যায়। অধিক হারে বংশধর রেখে যেতে পারে। কিন্তু যেসব জীবের প্রকরণগুলো পরিবেশের সাথে অনুকূল নয় (যেমন রঙের ভ্যারিয়েশনের কারণে অনেক প্রাণী ক্যামোফেজ করে শত্র“র হাত থেকে আত্মরা করতে পারে, আবার অনেকে উজ্জ্বল বর্ণের কারণে সহজেই শত্র“র হাতে ধরা পড়ে যায়), তারা জীবন-সংগ্রামে টিকে থাকতে পারে না, তাদের নির্বিশেষে বিলুপ্তি ঘটে। জীবের জীবন রার সংগ্রামে সফল হওয়ার অর্থ শুধু জীবের নিজের বেঁচে থাকাই যথেষ্ট নয়, সফলভাবে নিজের বংশরা করাটাও অত্যন্ত জরুরি।

একটি আম গাছে মুকুল ধরে হাজার-হাজার, সেই মুকুলের অনেকাংশেই ঝরে পড়ে যায় ঝড়-বৃষ্টির কারণে। তারপর আবার পোকার আক্রমণের কারণে মুকুলের পরিমাণ আরো কমে যায়, যে সংখ্যক মুকুল থেকে আম ধরে, সেগুলিও ঝড়-বৃষ্টির কারণে বড় হবার আগেই ঝড়ে যায়, পোকার আক্রমণেও মরে যায় অনেকগুলো। আম গাছে যে পরিমাণ মুকুল ধরে, সে তুলনায় গাছে আম হয় অত্যন্ত নগণ্য পরিমাণ; এবং এই নগণ্য পরিমাণ আমের বীজ থেকে নতুন আমের চারা হয় আরো অনেক কম পরিমাণ। একটি মাছের পেটে যে পরিমাণ ডিম থাকে তার বেশিভাগই ডিম ছাড়ার পর শিকারী মাছের খাবারে পরিণত হয়, পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে অনেক ডিম উর্বর হতে পারে না, এমন কী স্রোতেও প্রচুর ডিম নষ্ট হয়ে যায়। যে পরিমাণ ডিম থেকেও মাছের পোনা হয় তারও একটা বড় অংশ আবার বড় মাছের খাদ্যের শিকার হয়, যে পোনাগুলি শেষমেশ বেঁচে থাকতে পারে শত প্রতিকূলতা অতিক্রম করে, তাদের মধ্যেও বড় হবার সাথে সাথে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের সংস্থান করা, শত্র“ মাছ এড়িয়ে টিকে থাকা, সঙ্গী নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে জীবন সংগ্রাম চলতে থাকে। এভাবে দেখা যায়, জীবজগতের নিষ্ঠুর বাস্তবতা হচ্ছে বেঁচে থাকার প্রতিযোগিতা। জীবের বংশবৃদ্ধির অত্যাধিক প্রবণতার কারণে বিপুল সন্তান জন্ম দিলেও প্রত্যেকটি প্রজাতির জীবসংখ্যার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটে না। ডারউইন ‘অরিজিন অব স্পিসিজ’ গ্রন্থে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ প্রক্রিয়ায় জীবজগতের এই বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করেছেন। জীববিজ্ঞানে আর এমন একটি বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নেই, যা জীবজগতের এ বাস্তবতাগুলোকে সুষ্ঠুভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। জীবজগতে খাদ্যের জন্য, বাসস্থানের জন্য, সঙ্গী নির্ধারণের জন্য, বংশ রার জন্য, শত্র“র হাত থেকে আত্মরার জন্য কেউবা অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে থাকে প্রকরণ থেকে, কেউবা পায় না। অতিরিক্ত সুবিধা পেলে ঐ প্রাণী কঠোর অস্তিত্বের সংগ্রামে উদ্বর্তিত হয়, নতুন বংশধর রেখে যেতে পারে। ডারউইন যাকে বলেছিলেন ‘পরিবর্তনযুক্ত উত্তরাধিকার’ (Descent with Modification)। দীর্ঘসময় ধরে প্রজন্মান্তরে এভাবে চলতে থাকলে একসময় ‘পরিবর্তনযুক্ত উত্তরাধিকার’ থেকে সম্পূর্ণ নতুন প্রজাতির উদ্ভব হয়। প্রজাতির উৎপত্তির এই গোটা প্রক্রিয়াটির নাম ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’।

জৈববিবর্তন তত্ত্ব (প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব) দ্বারা ‘শুধু জীব বিবর্তিত হয়’ কিংবা ‘জীবের বিবর্তন ঘটে থাকে’-সামান্য এ প্রস্তাবনাকে বুঝায় না। এ তত্ত্ব আমাদের সামনে তুলে ধরে জীবজগতে ভ্যারিয়েশন বা বৈচিত্র্যের কারণ এবং প্রক্রিয়া, নিজের অজান্তে জীবের জীবন সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়া, জীবের অভিযোজন (Adaptation), জীবের বিলুপ্তি (Extinction), নতুন প্রজাতির উৎপত্তি, জীবের ভৌগলিক বিন্যাস, জীবের প্রতিবেশ, জীবের অভিপ্রয়াণ, জীবের পরিবেশগত ভারসাম্য ইত্যাদি বিষয়কে। অর্থাৎ জৈববিবর্তন কেন ও কিভাবে প্রকৃতিতে ঘটে থাকে বি¯তৃত পরিসরে তার প্রমাণসহ ব্যাখ্যা উপস্থাপন করাই এ তত্ত্বের আলোচ্য।

বিবর্তন-বিরোধীরা জৈববিবর্তনকে অনেক সময় ‘নিছক তত্ত্ব’ হিসেবেই উপস্থাপন করেন; জৈববিবর্তন অবশ্যই জীববিজ্ঞানের তত্ত্ব (পাশপাশি জীবের পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া); পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞানের এটমিক থিওরি, ইলেকট্রোম্যাগনেটিক থিওরি, থিওরি অব রিলেটিভিটি, থিওরি অব গ্র্যাভিটি’র মত প্রমাণিত তত্ত্ব। এটি আর বর্তমানে কোনো অনুকল্প নয়; নয় কতিপয় ব্যক্তির কষ্টকল্পনা ‘ঈশ্বরদ্রোহী মতবাদ’। ডারউইন যুগে বিজ্ঞান বিশেষ করে জীববিজ্ঞান ‘বংশগতি’ সম্পর্কে অনেকাংশেই পিছিয়ে ছিল, ফলে ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’ জীবের বিবর্তন সম্পর্কিত অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে সম ছিল না। ডারউইনও এ সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থের ষষ্ঠ অধ্যায়ে (Difficulties of the Theory) তুলে ধরেছিলেন তার তত্ত্বের কিছু সীমাবদ্ধতা, যেমন অন্তর্বর্তী প্রাণীর স্বল্পতা, জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ভব সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ব্যাখ্যা, সহজাত প্রবৃত্তি সম্পর্কে প্রাকৃতিক নির্বাচনের ব্যাখ্যা, প্রজাতির মধ্যে প্রজন্মান্তরে সঞ্চারণশীল বৈশিষ্ট্য কিভাবে সঞ্চারিত হয় ইত্যাদি। ডারউইন এ সীমাবদ্ধতাগুলো দূরীকরণে কিছু ব্যাখ্যাও প্রদান করেছিলেন কিন্তু সে সময় বংশগতি সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকায় অনেক প্রশ্নেরই উত্তর দেয়া সম্ভব হয় নি। পরবর্তীতে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের পর থেকে মূলত জৈববিবর্তন তত্ত্বের সাথে বংশগতির সংযোগ সেতু উদ্ঘাটিত হলে এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা থেকে প্রাপ্ত হাজার হাজার প্রমাণের মাধ্যমে ‘সত্য’ বলে প্রমাণিত হয়েছে এ তত্ত্ব।

প্রত্নজীববিদ্যা বা ফসিলবিদ্যা থেকে জানা গেছে, বিলুপ্ত প্রজাতির জীবনধারা, প্রতিবেশ (Ecology), তাদের জীবনধারণের সময়কাল, এক প্রজাতি থেকে আরেক প্রজাতির উদ্ভব প্রক্রিয়া ইত্যাদি, তুলনামূলক শারীরসংস্থানবিদ্যা (Comparative Anatomy) জানায় একই পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত জীবসমূহের অঙ্গসংস্থানের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য, পরিবেশের সাথে অভিযোজন; ভূজীববিদ্যা (ইরড়-এবড়মৎধঢ়যু) হতে জানতে পারি জীবের ভৌগলিক বিন্যাস, তাদের অভিযোজন, জীবের পরিবেশগত ভারসাম্য, জীবের প্রতিবেশ; আণবিক জীববিজ্ঞান, বিবর্তনীয় বিকাশমূলক জীববিজ্ঞান (Evolutionary Developmental Biology) হতে জানি, ক্রোমোসোম মিউটেশন, জেনেটিক মিউটেশন কিভাবে ঘটে, জীবদেহে তার প্রভাব, প্রজাতিতে প্রকরণ উদ্ভবের কারণ ও প্রক্রিয়া, আণবিক পর্যায়ে বিবর্তনের ধরন, একই পূর্বপুরুষ হতে উদ্ভূত জীবসমূহের আণবিক পর্যায়ে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য ইত্যাদি। গবেষণাগারেও ইতিমধ্যে ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন’কে নানাভাবে প্রমাণ করা হয়েছে, যেমন : ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নতুন নতুন ওষুধের বিশেষত অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ও অনিয়মিত ব্যবহারের ফলে খুব দ্রুত জীবাণুগুলি ওষুধ-প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। এক সময় গনেরিয়া নামক যৌনরোগ চিকিৎসায় পেনিসিলিন ওষুধই ব্যবহৃত হত। কিন্তু এ ওষুধের যথেচ্ছ আর অনিয়মিত ব্যবহারের কারণে এখন আর গনেরিয়া রোগ নিরাময়ে পেনিসিলিন ওষুধ কোনো কাজ করতে পারে না। গনেরিয়া রোগের জীবাণু গনোকক্কাস (Gonococus) ব্যাকটেরিয়া ইতিমধ্যে পেনিসিলিন প্রতিরোধক হয়ে গেছে। ফলে এই রোগের চিকিৎসার জন্য এখন পেনিসিলিন থেকে শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কৃষিক্ষেতে কীটনাশক হিসাবে ডিডিটি (Dichlorodiphenyl Trichloroethane) স্প্রে করা হয়ে আসছে। আমাদের দেশেও সত্তর-আশির দশকে সরকারিভাবে ক্ষেত-খামারে যথেচ্ছ পরিমাণে ডিডিটি স্প্রে করা হয়েছিল। ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গ, ম্যালেরিয়া রোগের ‘প্লাসমোডিয়াম’ এককোষী জীবাণু নির্মূলে নির্বিচারে ডিডিটি ব্যবহৃত হয়েছিল একসময়। এতে এদের বিশাল সংখ্যক সদ্যস্যের বিলুপ্তি ঘটেছে। প্রায় নির্মূল হবার অবস্থার মধ্যে মিউটেশনের মাধ্যমে কয়েক বছরের মাথাতেই এসব কীটপতঙ্গ, ম্যালেরিয়া জীবাণুর জিনগত কাঠামো যায়। জিনগত কাঠামো বদলে যাওয়া কীটপতঙ্গ বা জীবাণুরা ‘ডিডিটি স্প্রে করা পরিবেশে’ প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় টিকে গেছে এবং বংশবিস্তার করেছে। এখন তারা ডিডিটি বা এর বিকল্প ওষুধ যেমন ম্যালাথিয়ন (Malathion), সংশ্লেষিত পাইরেথ্রয়েড (Synthetic pyrethroids)-প্রতিরোধী। এ ধরনের ঘটনা শুধু ডিডিটি’র ক্ষেত্রে ঘটে নি, কীটনাশক নিয়ে প্রতিটি গবেষণাতেই দেখা গেছে, যথেচ্ছ আর অনিয়মিত ব্যবহারের কারণে জীবাণু-কীটপতঙ্গেরা অনেক সময় মাত্র দুই থেকে আড়াই বছরের মাথায় কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠতে পারে। তবে কীটনাশক-প্রতিরোধী সকল জীবের ‘প্রতিরোধ ক্ষমতা’ সমান নয়।’(5) আমেরিকার মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের Microbial Ecology বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড লেনস্কি প্রাকৃতিক নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে দীর্ঘসময় ব্যাপী গবেষণা কার্যক্রম চালিয়েছেন। ১৯৮৮ সালে রিচার্ড লেনস্কি Escherichia coli ব্যাকটেরিয়া নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ২০১০ সালের ফেব্র“য়ারি মাস পর্যন্ত ই. কোলাই ব্যাকটেরিয়ার পঞ্চাশ হাজার প্রজন্মের উপর মিউটেশন, ভ্যারিয়েশন, নতুন পরিবেশের সাথে অভিযোজন, বেঁচে থাকার লড়াই নির্বাচন ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে ল্যাবরেটরিতে প্রমাণ করেছেন।(6)

অর্থাৎ আমরা বলতে পারি, জৈববিবর্তন জীবজগতের এক ধরনের বাস্তবতা আর সেই বাস্তবতাকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সুষ্ঠুভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে ডারউইনের ‘প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব’।

বলা হয়ে থাকে ‘জৈববিবর্তন (প্রাকৃতিক নির্বাচন) এমন একটি তত্ত্ব, যাকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন (falsify) করার কোনো সুযোগ নেই।’ অভিযোগটি মোটেও সত্য নয়। এ তত্ত্বটি অবাস্তব-কল্পিত কোনো বক্তব্য-ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেনি যে, একে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করার সুযোগ থাকবে না। জৈববিবর্তনের গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হচ্ছে জিনেটিক মিউটেশন। যার ফলে প্রজাতিতে বংশ পরম্পরায় ভ্যারিয়েশনের উদ্ভব হয়। এখন কেউ যদি কোনোভাবে প্রমাণ করতে পারেন জীবদেহের জননকোষে মিউটেশন ঘটে না কিংবা জননকোষে মিউটেশন ঘটে কিন্তু ঐ জীবের পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে তা প্রবাহিত হয় না, কিংবা প্রবাহিত হলেও বংশধরদের মধ্যে কোনো ভ্যারিয়েশনের উদ্ভব হয় না, কিংবা পরিবর্তিত পরিবেশের পক্ষে উপযুক্ত ভ্যারিয়েশনসম্পন্ন জীব অভিযোজন ঘটাতে পারে না-তাহলে জৈববিবর্তনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বটি ‘মিথ্যা’ প্রমাণিত হয়ে যায়! কিন্তু তেমন কিছু এখনো হাজির হয় নি।

জৈববিবর্তনের পক্ষে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ-প্রমাণ সংগৃহীত হয়েছে ফসিলবিদ্যা থেকে। এখন পর্যন্ত এমন একটি ফসিলও পাওয়া যায় নি, যা জৈববিবর্তনের ‘জীবন-বৃক্ষের’ (tree of life) বিরোধী কিংবা ভূতাত্ত্বিক সময়কালের সাথে খাপ খায় না। যদি এমন কোন ফসিল উপস্থাপন করা যায়, যা পরীক্ষা-নিরীক্ষা (শারীরসংস্থান পরীক্ষা, ডিএনএ টেস্ট, রেডিওঅ্যাক্টিভ ডেটিং ইত্যাদি) দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব হয় যে উক্ত ফসিল জৈববিবর্তনের জীবন-বৃক্ষ, ভূতাত্ত্বিক সময়কালের সাথে সাংঘর্ষিক, তাহলে জৈববিবর্তন তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যাবে। কিন্তু এখনও তেমন কোনো ফসিল পাওয়া যায় নি।

ইংল্যান্ডের খ্যাতিমান বিজ্ঞানী জে বি এস হ্যালডেনকে (১৮৯২-১৯৬৪) একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘জৈববিবর্তন তত্ত্বকে কিভাবে মিথ্যা প্রমাণ করা সম্ভব?’ উত্তরে হ্যালডেন জানিয়েছিলেন : ‘কেউ যদি প্রাক-ক্যাম্ব্রিয়ান পিরিয়ডের শিলাখণ্ডে একটি খরগোশের ফসিল আবিষ্কার করতে পারে, তবে জৈববিবর্তন তত্ত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যাবে।’(7) কারণ জৈববিবর্তনের ফসিল রেকর্ড অনুসারে প্রাক-ক্যাম্ব্রিয়ান সময়ে (৪৫০০ থেকে ৫৪৩ মিলিয়ন বছর পূর্বে) শুধু নীলাভ-সবুজ শৈবাল (সায়ানোব্যাকটেরিয়া), আরকিয়ান জাতীয় জীবের অস্তিত্ব ছিল। মেরুদণ্ডী প্রাণী, উভচর, সরীসৃপ, স্তন্যপায়ী প্রাণীর কোনো অস্তিত্ব ছিল না। খরগোশ সম্পূর্ণ স্তন্যপায়ী প্রাণী, স্তন্যপায়ী প্রাণীর উদ্ভব হয়েছে ট্রায়াসিক পিরিয়ডে (২৪৮ থেকে ২০৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে)। সহজভাবে বলতে গেলে জৈববিবর্তনের ধারা অনুসারে এক কোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবের উদ্ভব, এরপর আদিম অমেরুদণ্ডী প্রাণী থেকে আদিম মেরুদণ্ডী প্রাণী; সামুদ্রিক প্রাণী মাছ থেকে উভচর প্রাণী। উভচর প্রাণী থেকে সরীসৃপ এবং সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকে স্তন্যপায়ী জাতীয় প্রাণীর উদ্ভব। তাই প্রাক-ক্যাম্ব্রিয়ান যুগের শিলাখণ্ডে খরগোশ কিংবা অন্য কোনো স্তন্যপায়ী প্রাণীর ফসিল পাওয়া গেলে এক মুহূর্তেই জৈববিবর্তন তত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করে দিবে।

জার্মান জীববিজ্ঞানী আর্নেস্ট মায়ার (১৯০৪-২০০৫) অবশ্য আরো সহজ করে বলেছেন : ‘সকল আধুনিক স্তন্যপায়ী প্রাণীই ১০০ থেকে ২০০ মিলিয়ন বছরের পুরাতন। স্তন্যপায়ী প্রাণী জিরাফের উদ্ভব ঘটেছে তিন কোটি বছর (৩০ মিলিয়ন) আগে মধ্য-টারশিয়ারি সময়কালে। এখন যদি ছয় কোটি বছর (৬০ মিলিয়ন) পূর্বে প্যালিয়োসিন সময়কালের শিলায় কোনো জিরাফের ফসিল পাওয়া যায়, তাহলে তাও জৈববিবর্তন তত্ত্বকে নস্যাৎ করে দিবে।’ (8)

এরপরও কথা থাকে। ‘বিজ্ঞান তো নিয়ত পরিবর্তনশীল; তার তত্ত্বগুলোও অনেক সময় পরিবর্তন হয়ে যায়। তাহলে তত্ত্বের মূল্য থাকে কই?’ অবশ্যই বিজ্ঞান স্থির কোনো কিছু নয়; স্থবির নয়। প্রতিনিয়তই বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা হতে প্রাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমেই তত্ত্বগুলো তৈরি হয়, পূর্বের তত্ত্বগুলো ঝাচাই হয়, পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত-সংস্কার হয়। একটা উদাহরণ দিই : নিউটনের অভিকর্ষ তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা পৃথিবীর একটি ফ্যাক্ট বা বাস্তবতা ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি’কে ব্যাখ্যা করতে পারি। কিন্তু ২৫০ বছর পরে বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাঁর ‘সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বে’র মাধ্যমে দেখালেন, নিউটনের থিওরি কিছু বিশেষ পরিস্থিতিতে সঠিক ফল দেয় না; যেমন যে সমস্ত জায়গায় মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাব বেশি (যেমন ব্ল্যাকহোল), সে সমস্ত জায়গায় আলোর গতিপথ বেঁকে যায়। ১৯১৯ সালে ২৯ মে মাসে সূর্য গ্রহণের সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার ফ্র্যাঙ্ক ডাইসন আইনস্টাইনের (১৯১৫ সালে প্রদত্ত) সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্বটি প্রমাণ করেন। যেহেতু ‘বিশেষ পরিস্থিতিতে নিউটনের থিওরি অব গ্র্যাভিটি’র সীমাবদ্ধতা’ আবি®কৃত হয়েছে, তবে কি পৃথিবীতে অভিকর্ষ বলের বাস্তবতা বাতিল হয়ে গেছে? অর্থাৎ গাছ থেকে ফল এখন মাটিতে পড়ে না, শূন্যে ভেসে থাকে, উপরের দিকে ঢিল ছুঁড়লে সেটা মাটিতে নেমে আসে না, সেটাও শূন্যে রয়ে যায়? মোটেও না। বাস্তবতা থিওরির উপর নির্ভরশীল হয়ে বসে নেই। আবার নিউটনের অভিকর্ষ তত্ত্ব এখনও (বিশেষ পরিস্থিতি বাদে) যথেষ্ট পরিমাণে অভিকর্ষ বলকে ব্যাখ্যা করতে পারে।

বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যে অনুকল্পটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা-বিশ্লেষণের পর বাস্তবতাকে সবচেয়ে ভালোভাবে এই মুহূর্তে ব্যাখ্যা করতে পারে, তাকেই ‘তত্ত্ব’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। পরবর্তীতে যদি দেখা যায়, বর্তমানে প্রচলিত তত্ত্বের চেয়ে আরো ভালো ব্যাখ্যা অন্য কোনো অনুকল্পকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাওয়া যাচ্ছে, তখন বিজ্ঞানের স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ীই নতুন এই অনুকল্পকে ‘তত্ত্ব’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এটা বিজ্ঞানের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য, অত্যাবশ্যকীয় বৈজ্ঞানিক নীতিমালা। এভাবেই নতুন-উন্নততর তত্ত্বের মাধ্যমে বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞানের অগ্রগামিতা রচিত হয়। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বও এর ব্যতিক্রম নয়। ভবিষ্যতে যদি কখনো দেখা যায়, নতুন কোনো অনুকল্প পরীক্ষা-নিরীক্ষা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্ব থেকেও আরো ভালোভাবে বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড বজায় রেখে জীবজগতের বিভিন্ন বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করতে পারছে, তখন নির্দ্বিধায় নতুন অনুকল্পটিকে ‘তত্ত্ব’ হিসেবে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে যেহেতু প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের বাইরে আর একটিও বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নেই যা জীবজগতের বাস্তবতাগুলিকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় ব্যাখ্যা করতে পারে, বিধায় এ তত্ত্বকে গ্রহণের কোনো বিকল্পও নেই।

আগ্রহী পাঠকের সুবিধার্থে নিম্নে জৈববিবর্তন সম্পর্কে আমেরিকার প্রত্নজীববিদদের সংগঠন ‘;প্যালিওন্টোলজিক্যাল সোসাইটি’র বক্তব্য তুলে ধরা হল :

The Paleontological Society Position Statement: Evolution

Evolution is both a scientific fact and a scientific theory. Evolution is a fact in the sense that life has changed through time. In nature today, the characteristics of species are changing, and new species are arising. The fossil record is the primary factual evidence for evolution in times past, and evolution is well documented by further evidence from other scientific disciplines, including comparative anatomy, biogeography, genetics, molecular biology, and studies of viral and bacterial diseases. Evolution is also a theory – an explanation for the observed changes in life through Earth history that has been tested numerous times and repeatedly confirmed. Evolution is an elegant theory that explains the history of life through geologic time; the diversity of living organisms, including their genetic, molecular, and physical similarities and differences; and the geographic distribution of organisms. Evolutionary principles are the foundation of all basic and applied biology and paleontology, from biodiversity studies to studies on the control of emerging diseases.

Because evolution is fundamental to understanding both living and extinct organisms, it must be taught in public school science classes. In contrast, creationism is religion rather than science, as ruled by the Supreme Court, because it invokes supernatural explanations that cannot be tested. Consequently, creationism in any form (including “scientific creationism,” “creation science,” and “intelligent design”) must be excluded from public school science classes. Because science involves testing hypotheses, scientific explanations are restricted to natural causes.

This difference between science and religion does not mean that the two fields are incompatible. Many scientists who study evolution are religious, and many religious denominations have issued statements supporting evolution. Science and religion address different questions and employ different ways of knowing.

The evolution paradigm has withstood nearly 150 years of scrutiny. Although the existence of evolution has been confirmed many times, as a science evolutionary theory must continue to be open to testing. At this time, however, more fruitful inquiries address the tempo and mode of evolution, various processes involved in evolution, and driving factors for evolution. Through such inquiry, the unifying theory of evolution will become an even more powerful explanation for the history of life on Earth.

তথ্যসূত্র :

1. শিক্ষানবিস, প্রসঙ্গ ‘বিবর্তন’ : জাকির নায়েকের মিথ্যাচার, যুক্তি, সংখ্যা ৩, জানুয়ারি ২০১০, বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল, সিলেট, পৃষ্ঠা ১৩৮।
2. বিজ্ঞানের কর্ম-প্রক্রিয়া জানতে পাশের ওয়েব সাইট দেখুন : Understanding Science: how science really works, http://undsci.berkeley.edu/article/howscienceworks_01
3. Michael Shermer, Why Darwin Matters, Henry Holt and Company, LLC, New York, 2007, pp. 93-99
4. চার্লস রবার্ট ডারউইন, প্রজাতির উৎপত্তি, (ভাষান্তর : ম. আখতারুজ্জামান), ২০০০, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, পৃষ্ঠা (অনুবাদকের কথা) বিশ-একুশ।
5. ডাঃ বাসুদেব মুখোপাধ্যায়, বংশগতি ও জিনের অসুখ, ২০০১, পাভলভ ইনস্টিউট, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৪৪-৪৫।
6. প্রকৃতিতে ব্যাকটেরিয়া প্রজাতিগুলোর এক প্রজন্মকাল খুব কম করে হলে মাত্র ১৫ মিনিট আর খুব বেশি হলে দিন কয়েক পর্যন্ত হয়ে থাকে। মানুষের এক প্রজন্মকাল ২৫ বছর। প্রাকৃতিক পরিবেশে ঊ. ঈড়ষর নামক ব্যাকটেরিয়ার এক প্রজন্মকাল ৬০ মিনিট কিন্তু ল্যাবরেটরির নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ই কোলাইয়ের চাষের সময় বাহির থেকে খাদ্য সরবরাহ করলে এর প্রজন্মকাল মাত্র ১৫-২০ মিনিট পর্যন্ত হয়ে থাকে।
7. Ridley, M (2003). Evolution, 3rd Edition. Blackwell Publishing Limited.
8. Ernst Mayr (2002). What Evolution is, Orion Publsing Group, p. 20

অতিরিক্ত পাঠ :
1. Evolution is a Fact and a Theory, Laurence Moran, The Talk Origin Archive, http://www.talkorigins.org/faqs/evolution-fact.html
2. T. Ryan Gregory, Evolution as Fact, Theory, and Path, http://www.gregorylab.org/reprints/FactTheoryPath.pdf
3. Carl Zimmer, A New Step In Evolution, http://scienceblogs.com/loom/2008/06/02/a_new_step_in_evolution.php
4. Richard Lenski Experimental Evolution, http://myxo.css.msu.edu/ecoli/