বানান নিয়ে আরো কিছু বকরবকর

 

বিপ্লব রহমান তাঁর আমাদের সময়ের নায়কেরা প্রবন্ধের মন্তব্যে হঠাৎ করেই আমাকে উদ্দেশ্য করে করা এক মন্তব্যে বানান নিয়ে তাঁর এক প্রিয় কবি চয়ন খায়রুল হাবিবের একটি লেখা ভাষাচিন্তাঃ পোকায় কাটা কয়েকটা দাত ফেলে দিলেই দুখিনি বর্নমালার দাত ব্যাথা সেরে যাবেঃ লিংক দেন এবং পড়তে বলেনএই কবি তাঁর নিজস্ব রীতিতে বাংলা বানান লিখে থাকেন বলে বিপ্লব জানান

 

আমি মাঝে মাঝেই বানান নিয়ে অহেতুক লোকজনকে বিরক্ত করি এবং অযাচিতভাবে বকবক করি (যদিও আমার নিজের বানানের অবস্থাই করুণ) দেখেই হয়তো বিপ্লব রহমান আমাকে এই লেখাটি পড়তে দিয়েছিলেনলেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ি আমি এবং সিদ্ধান্ত নেই যে, এর পাঠ প্রতিক্রিয়া বিপ্লব রহমানকে আমার জানানো প্রয়োজনসেই অনুযায়ী মন্তব্যও লিখতে বসিকিন্তু সেই মন্তব্য আকারে আকৃতিতে বেড়ে এমনই এক বেঢপ আকৃতি নিয়ে নেয় যে, মন্তব্যের স্বল্প বসন দিয়ে তাকে ঢেকে রাখা বড়ই কষ্টকর হয়ে পড়েফলে, যে মন্তব্য বিপ্লব রহমানের লেখার প্রাপ্য ছিল, সেটাকে আমি কিছুটা অন্যায়ভাবেই স্বতন্ত্র একটা পোস্ট হিসেবে মুক্তমনায় দিয়ে দিতে বাধ্য হইএটা ঠিক যে, বিপ্লব রহমানের মূল লেখাটা এই আলোচনা থেকে বঞ্চিত হবে, তবে সেই বঞ্চনাকে ঠেকানোর জন্যে এই লেখার একটা লিংক আমি সেখানে দিয়ে দেবো বলে ভেবে রেখেছি

 

 

আপনার প্রিয় কবির বানান নিয়ে লেখাটা পড়লামবেশ আগ্রহোদ্দীপক এবং মজাদার লেখা তাতে কোন সন্দেহ নেইতবে দুঃখের বিষয় হচ্ছে যে এই লেখায় নতুনত্ব বলে তেমন কিছুই খুঁজে পেলাম আমিআপাত দৃষ্টিতে বেশ বৈপ্লবিক এবং বিদ্রোহব্যাঞ্জক মনে হলেও, তিনি যে সমস্ত বানান সংস্কারের কথা বলেছেন বা যেভাবে বানানকে লিখতে চাইছেন, তার অনেকগুলো নিয়ে প্রায় দুইশো আড়াইশো বছর আগে থেকেই বাংলা ভাষাতত্ত্ববিদদের মধ্যে আলোচনা সমালোচনা চলে আসছে

 

সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে উচ্চারণ অনুযায়ী তিনি বানান লেখার বিষয়ে মতামত দিচ্ছেন যে লেখায়, সেটাতেই তিনি তার নিজের মতামতকেই মেনে চলেননিস্ববিরোধিতা রয়ে গেছে তাঁর নিজের লেখাতেইযেখানে তিনি দন্ত, মুর্ধা, তালব্যের উচ্চারণে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন, আবার সেখানে নিজেই ভাষা, ভাষনের, শাষনের, পাষবিকতা, সুষমা, শাষনাধিন, শেষমেষ ইত্যাদি শব্দে ষ ব্যবহার করছেন

 

বাংলায় ষত্ব বিধান এসেছে সংস্কৃত থেকেযে সমস্ত সংস্কৃত শব্দ অবিকৃত বা বিকৃত অবস্থায় বাংলায় এসেছে সেখানেই সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসারে ষ কে ব্যবহার করা হয়খাঁটি বাংলা শব্দ এবং বিদেশি শব্দে ষ এর কোন ব্যবহারই নেইতার স্ববিরোধিতা শুধু এখানে সীমাবদ্ধ নয়বেশ কিছু সংস্কৃত শব্দকে তিনি শুধুমাত্র দীর্ঘ ঈ-কার আর ণ বাদ দিয়ে লিখেছেন, কিন্তু অন্তস্থ ব কে অবিকৃত রেখে দিয়েছেনযেমন, বিশ্বাস, স্বিকৃতি, স্বত্ত্বেও, ধ্বংশের, সিধ্বান্তের , বিশ্ববিদ্যালয়, স্বার্থেবাংলায় জিহ্বা, আহ্ববান ইত্যাদি দুই একটা জায়গা ছাড়া অন্তস্থ ব এর কোন উচ্চারণই নেইএ ছাড়া জ এবন য এরও আলাদা উচ্চারণ বাংলাতে হয় নাকিন্তু এই কবি দেখলাম অনেক জায়গাতেই জ এর বদলে য ব্যবহার করেছেনযেমন, য্যামন, যাওয়া, যোয়ালএগুলোতে জ ব্যবহার করলেইতো চলতোঅহেতুক আবার য কে টেনে আনার প্রয়োজন কী ছিল বুঝতে পারি নি

 

বাংলা বানানের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল যে, এর উচ্চারণ হয় প্রাকৃতের মত, কিন্তু বানান লেখা হয় সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুযায়ীফলে, বেশিরভাগ সময়ই বানান এবং উচ্চারণের সামঞ্জস্য থাকে নাআমরা বানান লিখি একরকম, কিন্তু উচ্চারণ করি ভিন্ন রকমেরএই সমস্যা দূরীকরণের জন্য ভাষাবিদেরা চিন্তাভাবনা করে আসছেন সেই অষ্টাদশ শতক থেকেইএ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ লিখেছেনঃ

 

১৭৭৮ থেকে বাঙলা ভাষাবিদেরা অনেকটা নিরবচ্ছিন্নভাবে চিন্তা করে আসছেন বাঙলা বানান ও তার সংস্কার সম্পর্কেএর ফলে, দু-শো চল্লিশ বছরে, অর্জিত হয়েছে বাঙলা মান বানান, যার কয়েকটি এলাকা এখনো অস্থিত-অস্থিরউল্লেখযোগ্য যে মান ভাষার মান বানান থাকা দরকার; কিন্তু ওই বানান যে বিজ্ঞানসম্মত হবেই, তার কোনো কথা নেইপৃথিবীর কোনো ভাষায়ই বিজ্ঞানসম্মত বানান নেই; আর চরম অর্থে শুদ্ধবলেও কোনো বানান নেই- যে বানান গৃহীত, তাই শুদ্ধ, আর যা গৃহীত নয়যতোই যুক্তিসংগত হোক না কেনো, তা অশুদ্ধহ্যালহেডের ব্যাকরণের (১৭৭৮) আগে বাঙলা বানান ছিলো উচ্চারণ-অনুসারী; কিন্তু হ্যালহেড থেকেই শুরু হয় সংস্কৃতনিষ্ঠ ব্যুৎপত্তিনির্ভর বানানঊনিশশতকে ব্যুৎপত্তিনির্ভর করে বাঙলা বানানের একরকম মান প্রতিষ্ঠিত হয়, যা সংস্কৃতপন্থীদের কাছে ছিল আদরণীয়, কিন্তু বাঙালপন্থীরা- যেহেতু ব্যুৎপত্তিনির্ভর বানান ও তার উচ্চারণে কয়েক শতাব্দীর ব্যবধান- ওই বানানকে স্বীকার করে নিতে পারেননিজনসনের অভিধানের ব্যুৎপত্তিনির্ভর বানান যেমন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিলো, ঠিক তেমন উত্তেজনাই এ-বানান সৃষ্টি করে প্রকৃত বাঙলাপন্থীদের মধ্যেব্যুৎপত্তিনির্ভর বানান বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা লিখি সংস্কৃত কিন্তু উচ্চারণ করি বাঙলা;-বানানই যেনো বাঙলা ভাষাকে দাস করে রাখছে সংস্কৃতেররবীন্দ্রনাথ (১৯৩৮) মনে করতেন যে, বানানের ছদ্মবেশ ঘুচিয়ে দিলেই দেখা যাবে বাংলায় তৎসম শব্দ নেই বললেই হয় এখন বাঙলা বানানের যে সমস্ত এলাকায় অস্থিরতা দেখি তার মূলে বিদ্যমান ব্যুৎপত্তি ও উচ্চারণের কলহ

 

বাংলা বানানের ক্ষেত্রে সংস্কৃতের অনুশাসনকে মেনে নেওয়ার ব্যাপারে ঘোর আপত্তি ছিল রবীন্দ্রনাথেরও। তিনি তাঁর বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে বানান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন যেঃ

 

প্রাচীন বাঙালি, বানান সম্বন্ধে নির্ভীক ছিলেন, পুরানো বাংলা পুঁথি দেখিলেই তাহা বুঝা যায়আমরা হঠাৎ ভাষার উপর পুরাতত্ত্বের শাসন চালাইবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিএই শাসন ম্যালেরিয়া প্রভৃতি অন্যান্য নানা উপসর্গের মতো চিরদিনের মতো বাঙালির ছেলের আয়ুক্ষয় করিতে থাকিবেকোনো অভ্যাসকে একবার পুরানো হইতে দিলেই তাহা স্বভাবের চেয়েও প্রবল হইয়া ওঠেঅতএব এখনো সময় থাকিতে সাবধান হওয়া উচিতসংস্কৃত শব্দ বাংলায় অনেক আছে, এবং চিরদিন থাকিবেইসেখানে সংস্কৃতের রূপ ও প্রকৃতি আমাদের মানিতেই হইবেকিন্তু যেখানে বাংলা শব্দ বাংলাই সেখানেও সংস্কৃতের শাসন যদি টানিয়া আনি, তবে রাস্তায় যে পুলিস আছে ঘরের ব্যবস্থার জন্যও তাহার গুঁতা ডাকিয়া আনার মতো হয় সংস্কৃতে কর্ণ লিখিবার বেলা মূর্ধন্য ণ ব্যবহার করিতে আমরা বাধ্য, কিন্তু কান লিখিবার বেলাও যদি সংস্কৃত অভিধানের কানমলা খাইতে হয় তবে এ পীড়ন সহিবে কেন?

 

 

বাংলা বানানের ক্ষেত্রে ব্যুৎপত্তি ও উচ্চারণের কলহ দূর করার জন্যি এগিয়ে এসেছেন আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানীরা। রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে ১৯৩৫ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। বাংলা বানানকে উচ্চারণ অনুযায়ী সরল করার জন্য সুপারিশমালা পেশ করেন তারা। এর মধ্যে অন্যতম ছিল যে, বাংলায় যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দ আছে তাদের বানান সংস্কৃততে যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে, বাংলায় এর উচ্চারণ যেমনই হোক না কেন। তাদের ভাষাতেইঃ

 

অসংখ্য সংস্কৃত বা তৎসম শব্দ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হইয়া আছে এবং প্রয়োজনমত এইরূপ আরও শব্দ গৃহীত হইতে পারে। এই সকল শব্দের বানান সংস্কৃত ব্যাকরণ অভিধানাদির শাসনে সুনির্দিষ্ট হইয়াছে, সেজন্য তাহাতে হস্তক্ষেপ অবিধেয়।

 

বাংলায় যেহেতু দীর্ঘ স্বর নেই, সেই কারণে দীর্ঘ ঈ এবং দীর্ঘ ঊ বর্জনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংস্কৃত ছাড়া সকল দেশি এবং বিদেশি শব্দে দীর্ঘ ঈ কার এবং দীর্ঘ ঊ কার এর পরিবর্তে হ্রস্ব ই কার এবং হ্রস্ব উ কার ব্যবহারে সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে কবি চয়ন খায়রুল হাবিবের চিন্তাভাবনার সাথে তাঁদের চিন্তাভাবনার কোন পার্থক্য নেই।

 

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বানান সংস্কারের নিয়মে বলেঃ

 

যদি মূল সংস্কৃত শব্দে ঈ বা ঊ থাকে তবে তদ্ভব বা তৎসদৃশ শব্দে ঈ বা ঊ অথবা বিকল্পে ই বা উ হইবে, যথা- কুমীর, পাখী, বাড়ী, শীষ, ঊনিশ, চূন, পূব অথবা কুমির, পাখি, বাড়ি, শিষ, ঊনিশ, চুন, পুব। কিন্তু কতকগুলো শব্দে কেবল ঈ, কেবল ই অথবা কেবল উ হইবে, যথা- নীলা (নীলক), হীরা (হীরক); দিয়াশলাই (দীপশলাকা), খিল (কীল), পানি (পানীয়); চুল (চূল), তাডু (তর্দূ), জুয়া (দ্যূত)।

 

স্ত্রীলিঙ্গ এবং জাতি, ব্যক্তি, ভাষা ও বিশেষণ বাচক শব্দের অন্তে ঈ হইবে, যথা- কলুনী, বাঘিনী, কাবুলী, কেরানী, ঢাকী, ফরিয়াদী, ইংরেজী, বিলাতী, দাগী, রেশমী। কিন্তু কতকগুলি শব্দে ই হইবে, যথা- ঝি, দিদি, বিবি, কচি, মিহি, মাঝারি, চলতিপিসী, মাসী স্থানে বিকল্পে পিসি, মাসি লেখা চলিবে।

 

অন্যত্র মনুষ্যেতর জীব, বস্তু, গুণ, ভাব ও কর্ম বাচক শব্দের এবং দ্বিরাবৃত্ত শব্দের অন্তে কেবলই ই হইবে, যথা- বেঙাচি, বেঁজি, কাঠি, সুজি, কেরামতি, চুরি, পাগলামি, বাবুগিরি, তাড়াতাড়ি, সরাসরি, সোজাসুজি

 

অন্যদিকে ই, ঈ, উ এবং ঊ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমী এগিয়ে গিয়েছে আরো একধাপ। শুধুমাত্র সংস্কৃত শব্দ ছাড়া আর সব শব্দেই ঈ এবং ঊ ব্যবহারকে বাতিল করে দিয়েছে তারা। এমনকি যে সমস্ত সংস্কৃত শব্দের বানানে ঈ বা ই কিংবা ঊ বা উ হয় সেখানে শুধুমাত্র ই বা উ ব্যবহার করতে বলেছে। বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানের ২.০১ নিয়মে বলা হয়েছে

 

 

সকল অ-তৎসম অর্থাৎ তদ্ভব, দেশী, বিদেশী, মিশ্র শব্দে কেবল ই এবং উ এবং এদের কার চিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবেএমনকি স্ত্রীবাচক ও জাতিবাচক শব্দের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম প্রযোজ্য হবেযেমন; গাড়ি, চুরি, দাড়ি, বাড়ি, ভারি, শাড়ি, তরকারি, বোমাবাজি, দাবি, হাতি, বেশি, খুশি, হিজরি, আরবি, ফারসি, ফরাসি, বাঙালি, ইংরেজি, জাপানি, জার্মানি, ইরানি, হিন্দি, সিন্ধি, ফিরিঙ্গি, সিঙ্গি, টুপি, সরকারি, মালি, পাগলামি, পাগলি, দিঘি, কেরামতি, রেশমি, পশমি, পাখি, ফরিয়াদি, আসামি, বে-আইনি, ছড়ি, কুমির, নানি, দাদি, বিবি, মামি, চাচি, মাসি, পিসি, দিদি, বুড়ি, ছুঁড়ি, নিচে, নিচু, ইমান, চুন, পুব, ভুয়া, মুলা, পুজো, উনিশ, উনচল্লিশ। (মোট ৬০টি শব্দ আছে এখানে)

অনুরূপভাবে আলি প্রত্যয়যুক্ত শব্দে ই-কার হবেযেমন; খেয়ালি, বর্ণালি, মিতালি, সোনালি, হেঁয়ালি

তবে কোনো কোনো স্ত্রীবাচক শব্দের শেষে ঈ-কার দেওয়া যেতে পারেযেমন; রানী, পরী, গাভী

 

তৎসম শব্দের ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমীর প্রমিত বানানের .০ নিয়মে বলা হয়েছে

 

তবে যে সব তৎসম শব্দে ই ঈ বা উ ঊ উভয়ই শুদ্ধ সেইসব শব্দে কেবল ঈ বা উ এবং তার- কারচিহ্ন ি ু ব্যবহৃত হবে। যেমন কিংবদন্তি, খঞ্জনি, চিৎকার, ধমনি, ধূলি, পঞ্জি, পদবি, ভঙ্গি, মঞ্জরি, মসি, লহরি, সরণি, সূচিপত্র, উর্ণা, উষা।

 

তবে, কবি চয়ন খায়রুল হাবিব বাংলা বানান থেকে চন্দ্রবিন্দুকে একেবারেই বিদায় করে দেবার পক্ষপাতি। চন্দ্রবিন্দু বিসর্জনের তাঁর বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা কতখানি কার্যকর হবে সে বিষয়ে অবশ্য যথেষ্টই সন্দেহ আছে আমার। ভাষাবিদ আবুল হাসনাৎ-ও তাঁর বাঙলা ভাষার সংস্কার গ্রন্থে চন্দ্রবিন্দু বিসর্জনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেনঃ

 

বহু ভাষায় সানুনাসিক স্বরধ্বনি নাই; ইংরেজী ইহাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। …… সম্ভ্রমাত্মক ঁ ব্যবহারে আর এক মুশকিল হইয়াছে। ইংরেজীতে পাপাচারী, দুর্বৃত্ত হইতে যীশুখ্রীষ্ট, সম্রাট, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত সকলের জন্য He or They কথা ব্যবহৃত হয়। আরবী-ফারসীতেও পয়গম্বর ও শয়তান উভয়ের জন্য বলে, করে, যায় ইত্যাদি বলা হয়। অথচ তিনি, তাঁহারা, যাঁহারা, কাঁহারা ইত্যাদির প্রচলনে আমাদের অনাবশ্যক শ্রম স্বীকার করিতে হইতেছে।

 

এর বিরোধিতা করে ফেরদাউস খান তাঁর হরফ সমস্যা প্রবন্ধে বলেন যে,

 

অন্য ভাষায় অনুনাসিক ঁ স্বর নেই, বাংলায় আছে; অন্য ভাষায় সম্ভ্রমাত্মকভাবে সর্বনামের ব্যবহারের উপায় নেই, বাংলায় আছে; ইহা অন্য ভাষার দরিদ্রতা এবং বাংলার বাহাদুরি। আমি বলবো, অন্ততঃ এই ব্যাপারে ঁ সম্বলিত বাংলা বর্ণমালা অনুরূপ স্বরবিহীন অন্য ভাষার বর্ণমালার চেয়ে উৎকৃষ্ট। ঁ কে বাদ দিয়ে বাংলা হরফের প্রকাশ ক্ষমতা এবং ধারণ-ক্ষমতা খর্ব করা কিছুতেই ন্যায়সঙ্গত হবে না।

 

 

আনুনাসিক উচ্চারণ বাংলার এক অনন্য বৈশিষ্ট এবং অপরিহার্যও বটে। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী তাঁর বাঙলা বানান ও লিপি সংস্কার প্রবন্ধে লেখেনঃ

 

চন্দ্রবিন্দু আনুনাসিকতার প্রতীক হিসাবে বাঙলায় অপরিহার্য। বাঙলায় স্বরধ্বনির অনুনাসিকতা স্বতন্ত্র অর্থের দ্যোতনা করে, যেমন-হাস-হাঁস, বাস-বাঁশ, কাসা-কাঁসা, কাদা-কাঁদা ইত্যাদি। এই আনুনাসিকতা নাসিক্য ধ্বনির পূর্ববর্তী বা পরবর্তী স্বরধ্বনিতেও লক্ষ্য করা যায়, যেমন, কান, নাক, এদের প্রকৃত উচ্চারণ কাঁন, নাঁক; কিন্তু আনুনাসিকতা এখানে নাসিক্য ধ্বনির একটি অপরিহার্য অনুসঙ্গিক বলে একে চন্দ্রবিন্দু দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে দেখাবার প্রয়োজন করে না, অথচ পূর্ববর্তী দৃষ্টান্তগুলিতে সে প্রয়োজন রয়েছে, নইলে অর্থের গোলমাল হয়ে যাবার সম্ভাবনা। তাই চন্দ্রবিন্দু থাকবে; কিন্তু একে স্বতন্ত্র বর্ণ মনে করার কারণ নেই। এটি স্বরধ্বনির একটি বিশেষক (modifier) যা ভাষাবিজ্ঞানী Prof. I.R Firth এর ভাষায় Prosody; পূর্বের ন্যায় এটিকে সিলেবলের আরম্ভেই হরফের উপরে লেখা হবে, যেমন, চাঁদ।

 

অকালপ্রয়াত স্বনামধন্য লেখক মুহম্মদ জুবায়ের সাম্প্রতিককালে চন্দবিন্দু ব্যবহারের চরম অনীহা দেখে চমৎকার একটি লেখা লিখেছিলেন চন্দ্রবিন্দুরা সব গেলো কোথায়? নামে। সেখান থেকেই কিছুটা উদ্ধৃতি দেই।

 

অভাবের দেশ আমাদেরএটা নেই, ওটা নেই শুনতে শুনতে আমরা বড়ো হয়ে উঠেছি, অভ্যস্ত হতে শিখেছিএকদা সবচেয়ে বড়ো অভাব ছিলো খাদ্যের, তা এখন আর আগের মতো অতো তীব্র নয় বলে শুনতে পাইতবু আকাল এখনো আছে, কিছু পুরনো, কিছু নতুনমানুষের নিরাপত্তার আকাল আমাদের দেশে চিরকাল ছিলো এবং সে বিষয়ে কোনো উন্নতির আশা আজকাল কেউ করে বলে মনে হয় নাসামপ্রতিক আকাল বিদ্যুতের, পানির, জ্বালানি তেলের, সারেরখবরের কাগজ খুললে এইসব আকালের খবর প্রতিদিন পাওয়া যায়এর সঙ্গে প্রায় নিঃশব্দে আরেকটি জিনিস ক্রমে উধাও হয়ে যাচ্ছে  আমাদের বাংলা বর্ণমালার চন্দ্রবিন্দুদেশের দৈনিক ও সাপ্তাহিক কাগজগুলির ইন্টারনেট সংস্করণে এবং মুদ্রিত পত্রিকা যা কালেভদ্রে হাতে আসে তাতে এই সিদ্ধান্তে আসা যাচ্ছে যে বাংলা ভাষায় চন্দ্রবিন্দুর আকাল দারুণ আকাল পড়ে গেছে হয়তো অবিলম্বে তা দুর্ভিক্ষের চেহারা ধারণ করে বসবে

 

শুধু এখানেই থেমে থাকেন নি তিনি। চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার না করার ফলে শব্দের অর্থ পালটে কী করুণ দশা হয় তারও একটি রসঘন বর্ণনাও দিয়েছেন তিনি এভাবেঃ

 

কিছুদিন আগে পর্যন্ত সাপ্তাহিক এবং অধুনা দৈনিক একটি কাগজ তো মনে হয় আরেক মার্গে চলে গেছে চন্দ্রবিন্দুকে পুরোপুরি পরিহার করে (অহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা!‘)এই বর্জনের পক্ষে যুক্তি কী, তা আমার জানা নেইকিন্তু এর কতকগুলি সম্ভাব্য বিপদ আমি দেখতে পাইযে কোনো দুঃখেই আমার পক্ষে আর কাঁদাসম্ভব হবে না, কেননা তা কাদাহয়ে যাবেচন্দ্রবিন্দু ছাড়া কাদতেহবে ভাবতেই কান্না পেয়ে যাচ্ছেক্রন্দন অর্থেকাঁদাআর প্যাচপেচে কাদা‘-র পার্থক্য তাহলে কীভাবে করা যাবে? ভাত রাঁধাহবে না আর, কারণ সেখানে রাধাএসে উপস্থিত হয়ে যাচ্ছেছিরিছাঁদবলতে তা বাড়ির ছাদ‘- উঠে যাচ্ছেআমি আর কিছুতেই বাঁধাপড়তে পারবো না, কারণ তা হয়ে যাবে বাধা চন্দ্রবিন্দু বিহনে চাঁদহয়ে থাকছে চাদবাঁদরহবে বাদর‘ (‘এ ভরা বাদরে তুমি কোথা…‘)চন্দ্রবিন্দু বাদ দিয়ে বাঁশকীভাবে লেখা যাবে, বা বাঁশি‘? ‘বাশি‘-তে সুর উঠবে কি? ‘গাঁয়েআর ফেরা হবে না, হবে গায়েফেরা গোঁয়ারগোবিন্দ‘-র অবস্থা কী হবে ভাবা যায়? গোলাপের কাঁটাপড়বে কাটাআর ভূতের গল্পের কী হবে? চন্দ্রবিন্দু বাদ দিয়ে ভূতেরা কথা বলতে পারে না বলে জেনে এসেছি এতোদিন

 

আগেই উল্লেখ করেছিলাম যে, কবি চয়ন খায়রুলের উচ্চারণ অনুযায়ী বানানের দাবিটা কোন বৈপ্লবিক কোন চিন্তাধারা নয় বা নতুন কোন দাবিও নয়। উচ্চারণ অনুযায়ী বানানের ধারণাটা একশ বছর বা তার চেয়েও বেশি পুরোনো। অনেক আগে থেকেই এই কর্ম অনেকেই করে আসছেন বা সেই অনুযায়ী বানান লেখারও চেষ্টা করেছেন। এখন থেকে একশ বছর আগে ললিতকুমার বন্দোপাধ্যায় সাহিত্য পত্রিকায় ব্যাকরণ-বিভীষিকা নামে একটি রচনা লেখেন। সেই রচনার পরিশিষ্টে তিনি বাণান-সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। উচ্চারণ অনুসারিতায় তাঁর সময়ে যে বিচিত্র সংস্কৃতদ্রোহী বানান লিখিত হচ্ছিল তার সমালোচনা করেছেন তিনি তাঁর এই প্রবন্ধে। তিনি লিখেছিলেনঃ

 

আজকাল এক সম্প্রদায় লেখক দেখা দিয়েছেন, তাঁহারা কথাবার্ত্তায় শব্দগুলি যে ভাবে উচ্চারিত হয়, অবিকল সেই মত বাণান গ্রন্থাদিতে চালাইতেছেন। শিশুপাঠ্য রূপকথার বহিতে এরূপ করিলে আপত্তিকর নহে, কেননা সেগুলিতে দিদিমার মুখের কথা ঠিকটি শুনিতেছে, শিশুদিগের মনে এইরূপ ভ্রান্তি জন্মিলে গল্পটা জমে ভাল। কিন্তু গভীর রচনায় পর্য্যন্ত এইরূপ বাণান দেখা যায়। ভগবানের গুণগান করিবার সময়ও কি ভক্তের মুখের ঠিক উচ্চারণটি ফনোগ্র্যাফের সাহায্যে আদায় করিয়া ছাপার কেতাবে চালাইতে হইবে? গ্যাছে, খাচ্চে, দেখছিলুম, কোর্চ্চে, যাচ্চি, হয়েছেল, গেলুম, ইত্যাদি ক্রিয়াপদ সদগ্রন্থে স্থান পাইতেছে। এখনি, কখনো, তাই তো, কোনো, কতো, মতো, কালো, প্রভৃতি বাণান করা একটা ফ্যাশান হইয়া দাঁড়াইতেছে। মতো কি কলিকাতার উচ্চারণানুগত? আমাদের অঞ্চলে উভয় আকারেরই বিকৃত উচ্চারণ হয়, সেরূপ লিখিতে গেলে মোতো লিখিতে হয়। কিন্তু তাহাতে একটা কদর্য্য শারীরক্রিয়া সাধনের অনুমতি বলিয়া কেহ বুঝিলেই ত চমৎকার! কী, যে কি বস্তু তাহা সমজদার ভিন্ন কেহ বুঝিতে পারে না। কেহ কেহ যুক্তি দেন, বুঝিবার সুবিধার জন্য অর্থভেদে মত (মৎ উচ্চারণ) মতো, কাল (কাল্ উচ্চারণ) কালো, ইত্যাদি বাণান করা সুবিধা। কিন্তু পূর্ব্বে বলিয়াছি, এই প্রভেদজ্ঞানের জন্য বয়ঃস্থ পাঠকের সহজজ্ঞানের উপর নির্ভর করিলে চলে না কি?

 

 

আসলে পৃথিবীর কোন ভাষারই উচ্চারণ অনুযায়ী বানান নেই। ইংরেজিতেতো এই দোষ প্রবলভাবে দৃশ্যমান। লিখে একরকম করে আর উচ্চারণ করে সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষ্যেইঃ

 

ইংরেজিতে বানানে-উচ্চারণে ভাসুর-ভাদ্রবৌ সম্পর্ক, পরস্পরের মাঝখানে প্রাচীন শব্দতত্ত্বের লম্বা ঘোমটাইংরেজিতে লিখি ট্রেআসূরে (treasure) পড়ি ট্রেজার; লিখি ক্‌নৌলেডগে (knowledge) পড়ি নলেজ্‌; লিখি রিঘ্‌টেওউস (righteous) পড়ি রাইটিয়স

 

ইংরেজির সংগে তুলনা করলে বাংলা অক্ষরবিন্যাসপ্রণালী বরং অনেক নির্দোষ। উচ্চারণানুযায়ী বানান লেখার পক্ষে অনেক বেশি সহায়ক। তবে, এর মূল সমস্যা অন্যত্র। কথা হচ্ছে কোথাকার বা কোন অঞ্চলের বাংলাকে আমরা আদর্শ হিসাবে ধরবো। বাংলা মুল্লুকে একেক জায়গার উচ্চারণ একেকরকম। উচ্চারণানুযায়ী বানান লেখার সুবিধা দিলে বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জায়গায় একই শব্দ লেখা হবে অসংখ্যভাবে। ফলে, দেখা যাবে যে কেউ-ই কারো লেখার অর্থ উদ্ধার করতে পারছে না। ভাল শব্দকেই যশোরের লোক লিখবে ভালো, ময়মনসিংহের লোক লিখবে ভালু, আর সিলেটের লোক লিখবে বালা। ইরতিশাদ ভাই আর প্রদীপ দেব যদি চাটগাঁইয়া ভাষায় প্রবন্ধ লেখে তবে কী দশা হবে আমাদের? কিংবা সৈকত চৌধুরী যদি লিখে সিলেটি ভাষায়? (উইকি ঘাটতে গিয়ে মাত্র গতকালই জানতে পারলাম যে চাটগাঁইয়া আর সিলেটি ভাষা পরস্পর সহোদরা। বাংলার সাথে এদের কোন সম্পর্কই নেই, এমনকি বাংলার কোন উপভাষাও এরা নয়। সম্পূর্ণ আলাদা ভাষা এদুটো। আগে আমি এদেরকে বাংলার আঞ্চলিক ভাষাই মনে করতাম। তার মানে দাঁড়াচ্ছে গিয়ে ইরতিশাদ ভাই, প্রদীপ দেব, সৈকত চৌধুরী এরা আসলে টেকনিক্যালি বাঙালি নন। কী সর্বনাশের কথা!!)

 

উচ্চারণ অনুযায়ী নিজের মত করে বানান লিখলে কি কি অসুবিধা হতে পারে সে সম্পর্কে আশা করি কিছুটা ধারণা দিতে পেরেছি। শেষ করছি সেই ললিতকুমার বন্দোপাধ্যায়কে দিয়েইঃ

 

উচ্চারণানুযায়ী বাণানের বিরুদ্ধে প্রধান আপত্তি, ইহাতে অনেকস্থলে শব্দের ব্যুৎপত্তিজ্ঞানের বিঘ্ন ঘটিবে। একেই ত আমাদের বিকৃত উচ্চারণে শব্দের প্রকৃত স্বরূপ চিনিয়া উঠা অনেকস্থলে কঠিন, তাহার উপর বাণানে এই রকম দৌরাত্ম হইলে দুর্গতির একশেষ হইবে। যে সকল সংস্কৃত শব্দ অবিকৃত অবস্থায় বাঙ্গালায় গৃহীত হইয়াছে, সে গুলির বাণানে পরিবর্ত্তন করিতে বড় একটা কেহ সাহসী হয়েন নাই। (দুই একজন মৌলিক লেখক আকাঙ্খা করিতেছেন)। তবে অজ্ঞতা বা অনবধানতাবশতঃ ভুলভ্রান্তি হইয়া পড়ে। কিন্তু যত গোল অপভ্রংশগুলির বেলায়। কেহ উচ্চারণ মত লেখেন, কেহ প্রাকৃতের নজীর টানিয়া আনিয়া প্রশ্নটি আরও জটিল করিয়া তুলেন, কেহ যা খুসী তাই লেখেন। অনেক স্থলে শব্দটি কোন সংস্কৃত শব্দের অপভ্রংশ তাহা লেখকদিগের জানা থাকে না বা সে দিকে খেয়াল থাকে না। অনেক স্থলে তাহা ঠাহর করাও শক্ত।